হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু

আকাশ মালিক

আজ ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের এই দিনে প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকদের হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এদিন রচিত হয় ইতিহাসের নির্মম নিষ্ঠুর জঘন্যতম ঘৃণ্য কলঙ্কিত এক হত্যা যজ্ঞের। সেদিন, নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বেগম ফজিলাতুন্নেছা, তাঁর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল, কনিষ্ঠ শিশু পুত্র শেখ রাসেল, বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ ও কর্তব্যরত অনেক পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারী সহ ২৬ জন নিরপরাধ মানুষ। শিশু রাসেলকে লুকিয়ে রেখে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু অসুরদের চোখকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব হয় নি। জল্লাদদের হাত জোড় করে রাসেল মিনতি করেছিল- আমাকে হাসু আপার (হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন, আমাকে মারবেন না। চোখের সামনে রক্তে ভাষা তার আপনজনদের সারি সারি লাশ। প্রচন্ড গুলাগুলির শব্দে ভীত-সন্ত্রস্ত শিশু শেষ আকুতি জানালো-‘আমি মায়ের কাছে যাবো’। নিষ্ঠুর জল্লাদদের অন্তরে কোন ভাবান্তর নাই, মনে বিন্দুমাত্র করুণার উদ্রেক হলোনা, মুহুর্তেই ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায় রাসেলের সারা দেহ। তারা ঠান্ডা মাথায় হত্যা করলো নিরপরাধ শিশুটিকে। ফজলুল হক মণির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, সেরনিয়াবাতের ছোট মেয়ে বেবী ও আট বছরের শিশু শেখ রাসেলকে যে ভাবে খুন করা হইয়েছিল, তার বিবরণ শুনে আমার সব সময়ই মনে হয়েছে, এই নৃশংস হত্যার পেছনে শুধুই কিছু পথভ্রষ্ট উচ্চাভিলাসী সামরিক অফিসারের ক্ষমতার লোভ বা শুধুই রাজনৈতিক কারণ ছিলনা, এই হত্যার উৎস ও প্রেরণার পেছনে অন্য কিছুও ছিল। অধ্যাপক অজয় রায় তার একটি লেখায় বর্ণনা করেন-

‘অনেকে বিষয়টির গভীরে না গিয়ে বলে থাকেন শেখ মুজিব ও তাঁর সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে অপশাসন ও দুর্নীতির কারণে কিন্তু তা ঠিক নয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় তাঁর আদর্শের জন্য, যে আদর্শ বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ এবং উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে তুলে ধরেছে। অন্যদিকে তাঁর হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পুরানো পাকিস্তানী ধ্যানধারণায় প্রবর্তন এবং বাংলাদেশকে একটি ধর্মতাত্ত্বিক স্টেটে রূপান্তরিত করা এবং সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদের স্থলে ‘মুসলিম বাংলা’ নামের আদর্শভিত্তিক ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন। স্বঘোষিত হত্যাকারীদের একজন হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক কর্ণেল ফারুখ একটি সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন-

“শেখ মুজিবকে অবশ্যই মৃত্যুবরণ করতে হত। কারণ ঐ ব্যক্তিটি তার ধর্ম ইসলামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে — যে বিশ্বাস আমার জনগণের ধর্ম…।”(ঞযব ঝঁহফধু ঃরসবং, গধু ৩০, ১৯৭১)। হত্যাকাণ্ডের আর একজন নায়ক মেজর রশীদের ভাষ্যমতে ‘১৯৭৪’ এর গ্রীষ্মকালে ফারুখ ও রশীদ মুজিবকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা শুরু করে — যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে ধর্মভিত্তিক ‘ইসলামিক রিপাবলিক রাষ্ট্রে পরিণত করা।’

অন্য একটি সাক্ষাৎকারে খুনী ফারুক আর রশিদ তাদের মতো করে বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণ ব্যাখ্যা করেছে, কিন্তু বলে গেলনা বঙ্গবন্ধু পরিবারের এতোটা নারী ও শিশুগুলোকে তারা কেন খুন করেছিলো?

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করার ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা আমার মোটেই নেই। যে দিন রেডিওতে বঙ্গবন্ধু্-কণ্ঠের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ এর ভাষণ শুনেছি, সে দিন থেকে শেখ মুজিব আমার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। তখন ছোট ছিলাম, মাদ্রাসায় পড়তাম, রাজনীতি বুঝতাম না, বোঝার বয়সও ছিলনা। আমরা গোটা কয়েক মাদ্রাসার ছাত্র এক বন্ধুর বাড়িতে প্রায়ই জড়ো হতাম সেই ভাষণ শোনার জন্যে। আবুল কাশেম ফজলুল হক কে যে, শেরে বাংলা ডাকা হতো তা আমরা জানতাম না। যেহেতু ‘শের’ উর্দু শব্দটির সাথে আমাদের বেশ পরিচয় ছিল, আমরা সে দিন থেকে বঙ্গবন্ধুকেই শেরে বাংলা (বাংলার বাঘ) বলে ডাকতাম। বঙ্গবন্ধুকে যারা কাছে থেকে দেখেছেন, ৭ মার্চ ৭১ থেকে ১৫ আগষ্ট ৭৫ সাল পর্যন্ত তাদের লেখা স্মৃতিচারণ থেকে আজ আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও সেই সময়ে ঘটিত স্ম্বরণীয় কিছু ঘটনাবলি জানার চেষ্টা করবো।

দৈনিক ভোরের কাগজ ও চ্যানেল আই এর নোয়াখালী জেলার সিনিয়র সাংবাদিক বিজন সেন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেন-

৭ মার্চ’১৯৭১, বাঙালী জাতির জীবনে ঐতিহাসিক দিন। অনন্য এই ইতিহাসের স্রষ্টা বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিব। ৭’মার্চের ভাষন পৃথিবীর ইতিহাসে বর্তমান সময় পর্যন্ত একজন অবিস্মরণীয় জাতীয় নেতা কর্তৃক একটি জাতির মুক্তি ও জাগরণের শ্রেষ্ঠ কাব্য। সকাল ১১টায় তিনি তাঁর উপদেষ্টামন্ডলীকে নিয়ে বাড়ির লাইব্রেরি কক্ষে বৈঠক করলেন। ৭’মার্চের ভাষন নিয়ে, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন আহাম্মদ, ড. কামাল ও ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলামের সাথে রুদ্ধদ্বার আলোচনার পর ভাষনের একটা খসড়া তৈরি করতে বললেন। এরপর ঘন্টা খানেকের মধ্যে সকলকে বিদায় দিয়ে তিনি গোসল, নামাজ ও দুপুরের খাওয়া শেষ করে শোবার ঘরে বিশ্রামে গেলেন। তাঁর মাথার পাশে বসে ছিলেন বাল্যবিবাহিতা স্ত্রী ফজিলেতুননেছা রেণু। তিনি গভীর ভালোবাসায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বঙ্গবন্ধুকে বললেন,”শোন নিজে যা’বোঝ এবং বিশ্বাস কর বক্তব্যে তাই বলবে, কারো কথা শুনবেনা”। মুজিবের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক জীবনে তাঁর সাথী ছিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী রেণু। যিনি দূর্দিনে বাড়ির ফার্নিসার, দেশের বাড়ি থেকে গোলার ধান বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করে বঙ্গবন্ধুর কারারুদ্ধকালীন সময়ে দল ও দলের কর্মীদের সহায়তা দিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর কাছে টেলিফোনে কেউ একজন খবর দিয়েছে রেসকোর্স ময়দানের দিকে কামান তাক করেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। মাঠের উপরে আকাশে ঘুরছে গানবাহী সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার। যদি স্বাধীনতা ঘোষনা করা হয় তাহলে মাঠে গোলা বর্ষণ করা হতে পারে। তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বেলা সোয়া তিনটায় বাড়ি থেকে বের হয়ে জনসভাস্থলে যাত্রা করলেন। গাড়ি থেকে নেমে দিপ্ত পায়ে মঞ্চে উঠে এলেন। তখন স্বভাবের চাইতে কিছুটা গম্ভীর দেখাচ্ছিল মুজিবকে। কারো সাথে কোনো কথা নেই। সকালে তাঁর নির্দেশে করা বক্তৃতার খসড়া কেউ একজন দিতে চাইল, মাথা নেড়ে বারণ করলেন। মঞ্চে একবার তাজউদ্দিন আহাম্মেদের দিকে কিছুটা নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকালেন। মনে হলো চোখের ভাষায় বিশ্বস্থ বন্ধুকে কিছু একটা বললেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন, জনতার প্রতি নিবিষ্ট দৃষ্টি। এদিক ওদিক করে বার কয়েক তাকিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাঁর সুপ্ত বাসনার অসম্ভব বিশ্বাসের কথাটি বলতে শুরু করলেন। রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সাহরোয়ার্দী উদ্যান) পড়ন্ত বিকেলে শেখ মুজিবের বজ্রকন্ঠের ঘোষনা “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” পিনপতণ নিরবতা থেকে গর্জে উঠলো বাঙালী। লাখ লাখ বাঙালী। মাঠ জুড়ে গগণবিদারি শ্লোগান “জাগো, জাগো, বাঙালী জাগো”, “বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।” “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা” “তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ”। মূহুর্তের মধ্যে সে নির্দেশ ছড়িয়ে পড়লো মুজিবের বাংলায়’।

শেখ মুজিবের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসার কথাটা উল্লেখই যখন হলো, এখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের স্মৃতিচারণ থেকে কিছুটা অংশ তুলে ধরছি-

’পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের ৭/৮ তিন আগে নতুন গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হয়। আমাকে দেখেই বঙ্গবন্ধু বলে ওঠেন, ‘সেলিম আপনার নেতারা আমাকে সাবধান করে গেছেন। আমি যেনো সাবধানে থাকি। তারা কি কি সব আশংকা করছেন।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি আপনার নেতাদের বলেছি, আমাকে নিয়ে ভয় করবেন না। আমি বরং আপনাদের নিয়ে চিন্তা করি। কোনো বাঙালি আমাকে গুলি করতে পারবে না। আপনারা সাবধানে থাকবেন, আমার কিছু হবেনা’

বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক থাকার কথা প্রবাসী লেখক গোলাম মুরশিদও তার একটি গ্রন্থে (মুক্তিযুদ্ধ ও তার পর) উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের দূতাবাস থেকেও বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা হয়েছিলো। কিন্তু তিনি তা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেননি। হত্যার ক’দিন আগে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মনি সিংহও তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। গোলাম মুরশিদ বলেন, অসামান্য সাহস এবং আত্মবিশ্বাস ছিলো মুজিবের। জনগণকে তিনি ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে, বাঙালিরা তাঁকে খুন করতে পারে। এমন কি তিনি সপরিবারে সুরক্ষিত গণভবনেও থাকতে চান নি।

মুজাহিদুল ইসলাম একবার পুরনো গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন । তখন ছিলো দুপুর। বঙ্গবন্ধু সেলিমকে নিয়ে উপরে যান। টিফিন ক্যারিয়ার খুলে বাসা থেকে পাঠানো খাবার দু’জনে ভাগ করে খান। শিং মাছের ঝোল, ভাজি এবং ডাল দিয়ে ভাত খেতে খেতে অনেক বিষয়ে আলাপ হয় দু’জনের মধ্যে। এ সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোমার ভাবীর হাতের (বেগম মুজিব) রান্না না খেলে আমার তৃপ্তি হয় না। অনেক কষ্ট করে প্রতিদিন বাসা থেকে পুরনো গণভবনে খাবার পাঠায়।’ জবাবে সেলিম বঙ্গবন্ধুকে বলেন, এতো কষ্ট করে খাওয়ার চেয়ে এখানে (গণভবনে) সবাইকে নিয়ে থাকলেই পারেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দেখো সেলিম, রাজনীতিতো কর- একটি কথা সব সময় মনে রাখতে হবে। আজকে আমি প্রাইম মিনিস্টার আছি, কালকে আমি নাও থাকতে পারি। তখনতো থাকতে হবে নিজের বাড়ীতে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলকে নিয়ে আমি যদি এখানে থাকি সবাই এয়ারকন্ডিশনসহ বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।

এখানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে তার পারিবারিক অবস্থা কেমন ছিল জানার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কারাবন্দী থাকাকালীন সময়ে তার হাতের লেখা শত শত চিঠি থেকে দুটো চিঠি তুলে দেয়া হলো-
(কৃতজ্ঞতা, অমি রহমান পিয়াল)

শেখ লুতফর রহমানকে শেখ মুজিব, ১২ নভেম্বর, ১৯৫৮

রাজনৈতিক বন্দী
ঢাকা জেল
১২-১১-৫৮

আব্বা,
আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম গ্রহণ করবেন ও মাকে দিবেন। মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিল, কারণ এবার তার সামনেই আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল। দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবে না। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামীও একবার করেছিল। আল্লা আছে, সত্যের জয় হবেই। আপনি জানেন বাসায় কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন। বাড়ি যেতে বলে দিতাম। কিন্তু ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে। আমাকে আবার রাজবন্দী করেছে, দরকার ছিল না। কারণ রাজনীতি আর নাই, এবং রাজনীতি আর করবো না। সরকার অনুমতি দিলেও আর করবো না। যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে আমি ঘুষ খেতে পারি সে দেশে কোনো কাজই করা উচিত না। এ দেশে ত্যাগ আর সাধনার কোনো দামই নাই। যদি কোনদিন জেল হতে বের হতে পারি তবে কোন কিছু একটা করে ছেলেমেয়ে ও আপনাদের নিয়ে ভাল ভাবে সংসার করবো। নিজেও কষ্ট করেছি, আপনাদেরও দিয়েছি। বাড়ির সকলকে আমার ছালাম দিবেন। দোয়া করতে বলবেন। আপনার ও মায়ের শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন। চিন্তা করে মন খারাপ করবেন না। মাকে কাঁদতে নিষেধ করবেন। আমি ভাল আছি।

আপনার স্নেহের
মুজিব
NB: গোপালগঞ্জের বাসাটা ভাড়া দিয়া দেবেন। বাসার আর দরকার হবে না।

বেগম ফজিলাতুন্নেসার কাছে লেখা শেখ মুজিবের একটি চিঠি-

ঢাকা জেল
১৬-৪-৫৯

রেনু,

আমার ভালোবাসা নিও। ঈদের পরে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো ছেলেমেয়েদের নিয়ে আস নাই। কারণ তুমি ঈদ করো নাই। ছেলেমেয়েরাও করে নাই। খুবই অন্যায় করেছো। ছেলেমেয়েরা ঈদে একটু আনন্দ করতে চায়। কারণ সকলেই করে। তুমি বুঝতে পারো ওরা কতো দুঃখ পেয়েছে। আব্বা ও মা শুনলে খুবই রাগ করবেন। আগামী দেখার সময় ওদের সকলকে নিয়ে আসিও। কেন যে চিন্তা করো বুঝি না। আমার যে কবে মুক্তি হবে তার কোনো ঠিক নাই। তোমার একমাত্র কাজ হবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখানো। টাকার দরকার হলে আব্বাকে লেখিও, কিছু কিছু মাসে মাসে দিতে পারবেন। হাছিনাকে মন দিয়ে পড়তে বলিও। কামালের স্বাস্থ্য মোটেই ভাল হচ্ছে না। ওকে নিয়ম মতো খেতে বলিও। জামাল যেন মন দিয়ে পড়ে আর ছবি আঁকে। এবার একটা ছবি একে যেন নিয়ে আসে আমি দেখব। রেহানা খুব দুষ্ট ওকে কিছুদিন পর স্কুলে দিয়ে দিও জামালের সাথে। যদি সময় পাও নিজেও একটু লেখাপড়া করিও। একাকী থাকাতে একটু কষ্ট প্রথম হতো। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে কোন চিন্তা নাই। বসে বসে বই পড়ি। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও।

ইতি-
তোমার মুজিব

৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব যখন বলেন- ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবানা’ কিংবা ‘আর আমার মানুষের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করোনা’ তখন বুঝতে কষ্ট হয়না এটা কারো হাতের লেখা খসড়া বা ফরমায়েসী ভাষণ নয়। আমার মনে হয়েছে, দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি হৃদয়ের গভীর ভালবাসা থেকে উৎসারিত, অন্তরের অন্তস্থল থেকে স্বতস্ফুর্ত ভাবে বেরিয়ে আসা প্রতিটি সঠীক শব্দ তাতক্ষণিকভাবে তার মস্তিষ্ক তৈরী করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই তার বক্তৃতায়, দেশী বিদেশী পত্রিকা বা রিপোর্টারের সাথে সাক্ষাৎকারে ‘আমার’ শব্দ ব্যবহার করতেন। মাই কাউন্ট্রি, মাই পিউপল, আমার দেশ, আমার মানুষ, আমার ছেলেরা ইত্যাদি। এ দেশের মাটি ও মানুষকে তিনি কতো আপন মনে করতেন এ তারই বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ৩৭টি বৎসর অতিবাহিত হয়ে গেছে। ৭মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্টির ২১ বছরের বৈষম্যের ইতিহাস তুলে ধরে প্রশ্ন করেছিলেন- ‘কী পেলাম আমরা’। ৩৭ বছর পর আজও মনে প্রশ্ন জাগে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে কী পেল এই জাতি? দুটো বৎসর পার হতে না হতে একদল রাতারাতি আশা করে বসলেন আলাদিনের প্রদীপ, আরেকদল জাতিকে টেনে নিতে চাইলেন উলটো দিকে পাকিস্তানি আদর্শের গহিন অন্ধকারের পথে। বছর ঘুরে ১৫আগষ্ট আসে, আর প্রতিবার প্রতি দিন মনে মনে কামনা করি- যদি রাত পোহালে শোনা যেতো বঙ্গবন্ধু মরে নাই-

৭ মার্চের পর সুদীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, লাখো শহিদের প্রাণের বিনিময়ে, এক সাগর রক্ত পেরিয়ে, হাজারো বাঙ্গালী নারীর সতীত্বের রক্ত দিয়ে অর্জিত হলো একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, একটি নতুন পতাকা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন- “ আমি হিমালয় দেখিনি। কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি’। আজ হিমালয়ের চোখে জল! এদিন বাঙ্গালির সারা জনমের শোকে, দুঃখে, আবেগে,আনন্দে হিমালয় বুঝি একটু কেঁপেই উঠেছিল।

১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, “আজ থেকে পাকবাহিনী নির্যাতিত মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়, তারা এখন থেকে বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত। ‘বীরাঙ্গনা নাম যেভাবে হলো’ এর নেপথ্য ঘটনাটি ছিল এ রকম- পাবনা জেলার বেড়া, সুজানগর ও সাথিয়া উপজেলার জনসম্পদ ও ফসলি জমিকে যমুনা নদীর প্লাবন থেকে রক্ষার জন্য নগরবাড়ী ঘাট থেকে কাজীরহাট পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করতে গেছেন বঙ্গবন্ধু। তারিখ ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। কোদাল দিয়ে মাটি কেটে টুকরিতে তুলে বাঁধের স্থানে ফেলে বাঁধ নির্মাণ কার্যক্রমের শুভ উদ্বোধন করে মঞ্চে গিয়ে বসলেন বঙ্গবন্ধু ও নেতৃবৃন্দ। বক্তৃতার পালা চলাকালে জনসমাবেশের এক পাশে একাধিক মহিলার হট্টগোল লক্ষ্য করা গেল। ঐ মহিলারা মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর কাছে আসতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আয়োজক স্বেচ্ছা সেবকদের বাধার কারণে মহিলারা হট্টগোল শুরু করেন। ঘটনাটি লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু বললেন ওদের আসতে দাও। তিনি তাঁর ভাষণে ’৭১-এর নির্যাতিত মহিলাদের বীরাঙ্গনা উপাধি প্রদান করে বলেন- ‘মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাঁদের অবদান কম নয়, বরং কয়েক ধাপ উপরে, আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাঁদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে। আর সেই স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশে আমি বলছি যে, আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা মেয়ের পিতা হয়েছেন।” সেদিন থেকে বিরাঙ্গনাদের গর্ভের সন্তানরা হলো যুদ্ধ শিশু।

একই বৎসরের ১২ মার্চ, দেশ স্বাধীন হওয়ার তিন মাসের ভিতরে বঙ্গবন্ধুর অনুরুধে ভারতের মিত্র বিহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। যুদ্ধ-বিধস্ত দেশকে একটি স্বনির্ভরশীল দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু আত্মনিয়োগ করেন। সপ্ন দেখলেন একটি সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের। মৈত্রী ও বানিজ্যচুক্তি করলেন বিভিন্ন দেশের সাথে।

সদ্য স্বাধীন সার্বভৌম দেশে একটি আদর্শ, শক্তিশালী সামরিক সংগঠনের গুরুত্ব ও প্রয়োজন উপলব্ধি করে ১৯৭৪ সালে কুমিল্লায় বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেন, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি। এখানে বঙ্গবন্ধু নিজেকে পিতা হিসেবে উপস্থাপন করে বলেন-দেশে মন্ত্রী বদল হতে পারে, প্রেসিডেন্ট বারবার বদলাতে পারে কিন্তু পিতা একবারই হওয়া যায়। এই কথাগুলো শোনার পর আমার বারবার মনে হয়েছে, এই দিনটাই যদি হতো বঙ্গবন্ধুর সরকারি দায়ীত্ব পালনের শেষ দিন। ভাবি, যদি এই দিন থেকে বঙ্গবন্ধু রাজনীতি থেকে অবসরে চলে যেতেন?

তবে এও জানি মৃত্যু ভয় যার নেই, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যিনি কখনও ভাবেন নি বাংগালীদের মধ্যে কেউ তার শত্রু, কেউ তাকে হত্যা করতে পারে, তিনি ধ্বংস-স্তুপের উপর তার দেশকে, দেশের জনগনকে রেখে, কাংখিত সপ্ন বাস্তবায়ন না করে হাত গুটিয়ে অবসরে যাওয়ার ব্যক্তি নন। বঙ্গবন্ধুকে মরেই প্রমাণ করতে হবে তিনি মরেন নাই। আজকের এই শোকের দিনে শ্রদ্ধা জানাই সেই মহান নেতার প্রতি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবেন এদেশের ঘরে ঘরে, প্রতিটি বাঙ্গালীর হৃদয়ে চিরভাস্বর, চির অম্লান।

কবি অন্নদাশঙ্কর যথার্থই লিখেন-

যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা
গৌরী যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনাদের মা বলে সম্মোধন করেছিলেন। লেখাটি শেষ করবো একজন বীরাঙ্গনার একটি সাক্ষাৎকার পাঠের মাধ্যমে। তথ্য ধার করেছি শনিবারের চিঠি থেকে-

দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনাদের জন্য পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। নীলিমা ইব্রাহীম সে-ই বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাসন্তী গুহঠাকুরতা, নূরজাহান মুরশিদ, রাজিয়া বেগম, মমতাজ বেগম, নওসবা শরীফ। অনেক বীরাঙ্গনাকে ধানমণ্ডিতে পুনর্বাসিত করা হয়। সেখানে তাঁদের মেডিক্যাল সাহায্য দেয়া হতো। সেই কেন্দ্র থেকে প্রায় দুইশত শিশুকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে মিসেস টি নিয়েলসনের একটি সাক্ষাৎকারের কথা। যে সাক্ষাৎকারটি আগরতলার রবীন্দ্র সেনগুপ্তের সহযোগিতায় দুলাল ঘোষ সংগ্রহ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে নীলিমা ইব্রাহীম এটি প্রকাশ করেন।

http://www.youtube.com/watch?v=qfryIrKdXGU