প্রতিদিনকার মত আজ ফেইসবুকে বসার পর হুট করে একটি পোস্ট দেখলাম। লিখেছেন ডা: নাজমুল হাসান। পোষ্টটি পড়ে চোখে জল জমে গেলো। নিজেকে একজন বাংলাদেশী বলার অধিকার অর্জন করেছি যাদের আত্নত্যাগে তাদের সেই মহান আত্নাহুতি আজ আমরা ভুলতে বসেছি। আমি প্রিয় পাঠকদের উদেশ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে এক নিখোজ মুক্তিযোদ্ধা পিতার প্রতি যুদ্ধপরবর্তী সময়ের ত্যাগের বর্ণনা সহিত তারই সন্তান যিনি এখন পেশাগত ভাবে একজন ডাক্তার তার সেই চিঠিটি নিচে হুবুহু পোষ্ট করা হল।

চিঠি:
বাবা,
আজ তোমার নিখোঁজ হবার দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসোনি। তোমকে ধরার জন্য পাক সেনাবাহিনীর যে ফরমান জারী হয়েছিল, তার সফল বাস্তবায়নকারী রাজাকার বিহারীরেদর হাতে তুমি আজকের দিনে ধরা পড়ে যাও। তোমার কি পরিনতি হয়েছিল তা সঠিকভাবে আমরা আজও জানি না। শুনেছি তোমাকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। তোমার অপরাধ ছিল, তুমি ছিলে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তি যুদ্ধের সংগঠক। তোমার বড় ছেলে জাহাঙ্গীর আলম, যাকে তুমি মুক্তি যুদ্ধে পাঠিয়েছিলে, যে ছিল আলফাডাঙ্গা থানার প্রথম মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, সে এখন শ্রবন প্রতিবন্ধী। কোন প্রকার সরকারী সহযোগিতার দৃষ্টি তার উপরে পড়েনি। বৃদ্ধ অবস্থায়, অসহায়, নিঃসম্বল হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে সে। তোমার মেঝো ছেলে মোঃ হুমায়ুন কবীর, যে ছিল সুইসাইডাল নৌ কমান্ডো বাহিনীর কমান্ডার, যিনি ১৯৭১ সালে মংলায় পাকবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের লাল গালিচা সম্বর্ধনা পেয়েছিলেন, তিনিও অসহায় অবস্থায় বেঁচে আছেন। তোমার আরেক সাফল্য, তোমার বড় বোনের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল ইসলাম বটু এবং ছোট বোনের ছেলে সাইদুর রহমার সাকেনও অসহায় হয়ে বেঁচে আছে। যে ৩৩ জনেকে তুমি মুক্তি যুদ্ধে পাঠিয়েছিলে তাদের মধ্যে আর কারো খবর আমি জানিনা।
তোমার বিধবা স্ত্রী অর্থাৎ আমার দুখিনি মা, ৩৯ বছর তোমর পথ চেয়ে বসে কেঁদেছেন। পরিবারের একমাত্র অন্নদাতা তোমাকে হারিয়ে, সাতজন অসহায় এতিমকে নিয়ে সহায়-সম্বলহীন এই মহিয়সী মহিলা যে কি নিদারুন কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন তা ভাষায় বর্ননা করা যায়না। অন্যের বাড়ীতে ফায়-ফরমাস খেটেছেন, এতিমখানায় রেখে বাচ্চা পড়িয়েছেন আর কেঁদেছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়স থেকে আমিও করেছি অন্যের গোলামী, জীবনের তাগিদে, শুধু বেঁচে থাকার জন্য। অশিক্ষিত মা আমার হেরে যাননি। যে গ্রাম থেকে কেউ কখনও অক্ষর জ্ঞানও শেখেনি, সেই গ্রামে থেকে তুমি তোমার ছেলেকে ডাক্তার বানিয়েছ। প্রতিটি সন্তানকে করেছেন উচ্চ শিক্ষিত। তুমি বঙ্গমাতা নও, তুমি ইতিহাসের কোন অংশ নও, তুমি মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী নও, তুমি মুক্তিযোদ্ধার মাতা নও, প্রচলিত অর্থে তুমি কেউ নও, কিন্তু আমার দৃষ্টিতে, আমার অনুভবে তুমি মহিয়সী নারী, তুমি অতুলনীয়া। তুমি স্বর্গবাসী হও।
বাবা, তুমি সরকারের কোন তালিকায় নেই। না মুক্তি যোদ্ধার তালিকায়, না শহীদের তালিকায়, না নিখোঁজের তালিকায়। আমরা আবেদন করেছিলাম, কেন যেন তালিকায় তোমার নাম ওঠে নাই। অথচ তোমাকে যারা জবাই করেছিল, দেশ স্বাধীনের পর সরকারীভাবে তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাদের পানি-বিদ্যুতের বিলও দিতে হয় না, আজ পর্যন্তও না। তাদের ভোটাধিকার ছিল না, সেটাও দেওয়া হয়েছে। তোমার হত্যাকারী এবং আমার অধিকার আজ সমান নয় বরং হ্যতাকারীর অধিকার অনেক বেশী, কারন সে বিনামূল্যে আবাসন সুবিধা পায়, দিতে হয় না গ্যাস, বিদ্যুত ও পানির বিল, উপরন্ত রেশন পায়।
তুমি নেই। তোমার আত্বত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়া এই দেশ আছে। পরাধীনতার দৃশ্যমান শৃঙ্খল থেকে স্বাধীনতার অদৃশ্য শৃঙ্থল যে কত ভয়াবহ তা দেখার জন্য তোমার সন্তানেরা আছে, আছে এ দেশের কোটি কোটি মানুষ। তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ধৃষ্টতা দেখাবো না, সে যোগ্যতা আমার নেই। শুধু বলবো, এ দেশের নেতৃত্ব তোমাকে ভুলেছে, মানুষ তোমাকে ভোলেনি। এই বিশাল মানুষের কাতারের মধ্যে আমিও একজন। তোমায় সশ্রদ্ধ সালাম বাবা।
-তোমার সন্তান।

নাজমুল হাসান

নিচে সেই শহীদ মহান মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল মজিদ এর একটি ছবি দেওয়া হলো:

Freedom fighter late Sheikh Abdul Mazid, Village – Nandigram, P.O – Panail, Upazila – Alfadanga, District – Faridpur.