নাদিম আহমেদ

ছোটবেলার একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। আমরা ঢাকায় নতুন এসেছি। এখানকার একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। প্রথম দিন ক্লাস এ গেলাম। সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ, নতুন জায়গা, নতুন মানুষ। নিজেকে খুব একা মনে হচ্ছিলো। সবাই হইচই করছে, আমি এক কোনে একা বসে আছি। একটু পর স্যার আসলেন, এসেই বই বের করতে বললেন। যাদের বই ছিল তারা বের করলো। আমার যেহেতু প্রথম ক্লাস, সেহেতু আমার বই ছিল না। স্যার তখন বললেন, “যাদের বই নেই তারা কান ধরে দাড়া”। কারা কারা নতুন এসেছে তাদের সাথে পরিচিত হওয়া দূরে থাক, জানার আগ্রহও বোধ করলেন না। আমি আশা করেছিলাম নতুন ক্লাসে নতুন বন্ধু হবে, টিচার দের সাথে ভালো সম্পর্ক হবে। কিন্তু উল্টোটা হল। স্যার দাড়িয়ে থাকা সবাই কে বেত্রাঘাত করলেন। ক্লাসের অন্য ছেলেরা সেটা দেখে খুব মজা পেলো। এই হল আমার ঢাকায় প্রথম ক্লাসের অভিজ্ঞতা। সেদিনের পর শিক্ষক জাতির উপর আমার এক ধরনের ঘৃণা বোধ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর যাই হই জীবনে শিক্ষক হব না। এই শিক্ষকদের বলা হয় জাতি গড়ার কারিগর। অথচ আমাদের স্কুল গুলোতে ছাত্র ছাত্রী দের কাছে শিক্ষা এবং বিদ্যালয় কে ভীতিকর ব্যাপার করে তোলেন এই তথাকথিত শিক্ষকরা। বিদ্যালয়ে এদের প্রধান কাজই হল ছোট ছোট কোমলমতি বাচ্চাদের কে শারীরিক ও মানসিক ভাবে আঘাত করা। স্কুল এ পড়া কালীন সময়ে দেখেছি, কিছু কিছু শিক্ষক ক্লাসে এসে প্রথমে বলতেন, কে কে পড়া শিখস নাই দাড়া। ক্লাসের প্রায় অর্ধেক ছেলে দাঁড়াত। ক্লাসের অর্ধেক সময় এদের কে প্রহার করে কাটিয়ে দিতেন স্যার। এছাড়া ধর্মীয় ব্যাপারেও শিক্ষকদের বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা যায় বিদ্যালয়গুলোতে। সাধারনত ইসলাম ধর্মের শিক্ষকদের মাঝে অন্য ধর্মের শিক্ষার্থীদের কে হেয় করার প্রবণতা দেখা যায়। অনেক শিক্ষককে দেখেছি ক্লাসে হিন্দু শিক্ষার্থীদের সামনে তাদের ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করতে। যার ফলে মুসলিম ছাত্ররা ও হিন্দু ধর্ম কে নিয়ে ব্যঙ্গ করত। এভাবে ছোটবেলা থেকেই অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষমুলক মনোভাব তৈরি করতে আমাদের শিক্ষকগণ অবদান রাখেন। একই মেধা সম্পন্ন হওয়া সত্তেও অন্য ধর্মের হওয়ার কারনে বিমাতাসুলভ আচরণের স্বীকার হতে হয় অনেক হিন্দু শিক্ষার্থীদের। এসব কারনে আমাদের দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের হীনমন্যতা তৈরি হয়ে যায় খুব ছোট বেলা থেকে। যার ফলে ইসলাম এবং মুসলিম দের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা বোধ তৈরি হয় তাদের মাঝে।

শুধু হিন্দুরা নয় মুসলিম ছাত্ররা ও নিস্তার পায়না এসব ধর্মান্ধ শিক্ষক দের অত্যাচার থেকে। মনে পড়ে ক্লাসে টুপি না পড়ার অপরাধে কত মার খেয়েছি। ধর্ম ক্লাসে অদ্ভুত অদ্ভুত কারনে ছাত্রদের কে প্রহার করা হত। এসব কারনের মধ্যে রয়েছে নামাজ না পড়া, কোরান না পড়া, সালাম না দেওয়া, টুপি না পড়া, টাকনুর নিচে প্যান্ট পড়া ইত্যাদি। মেয়েদের ক্ষেত্রে নেইল পলিশ দেওয়া, ছোট কাপড় পড়া, পর্দা না করা ইত্যাদি কারনে শাস্তি পেতে হত।

কিছুদিন আগে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপর প্রহার করা নিষিদ্ধ হয় সরকারী ভাবে। কিন্তু তার পর ও থেমে নেই প্রহার। আগে বেত দিয়ে মারত এখন ডাস্টার দিয়ে, হাত দিয়ে মারে। আর কথার প্রহার তো আছেই। শিক্ষকগণ বিশ্বাস করেন যে ছাত্রদের থেকে তাদের স্পষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ছাত্রদের কে লাই দিলে সব মাথায় উঠবে। তাদেরকে সব সময় ভয়ে রাখতে হবে। অনেককে বলতে শুনি তারা তাদের শিক্ষক কে রাস্তায় দেখলে ভয়ে তারা অন্য রাস্তা দিয়ে যেতেন, আর এখনকার ছাত্ররা নাকি শিক্ষক কে সম্মান ই দিতে জানে না। ভয় পাওয়ার নাম যদি সম্মান হয় তাহলে সেই সম্মান ছাত্র শিক্ষক দুজনের জন্যই ক্ষতিকর। শিক্ষকের সাথে ছাত্রের দূরত্ব মানে শিক্ষার সাথে ছাত্রের দূরত্ব।

কোনভাবে এই ধারনা আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে ঢুকে গেছে যে ছাত্রদের কে প্রহার না করলে তারা মানুষ হবে না। শুধু স্কুলে না বাড়িতে ও বাবা মার শাসনের প্রক্রিয়াটি খুবই সেকেলে এবং অযৌক্তিক। সন্তান কোন অপরাধ করলে প্রথমেই তাকে শারীরিক শাস্তি দেওয়া হয়। পরীক্ষায় খারাপ ফলাফলের জন্য শিশুকে শারীরিক শাস্তি দেওয়া কখনোই সমর্থন যোগ্য নয়। ধর্মীয় অনুশাসন না মানার জন্য ও অনেকসময় শিশুদের প্রহার করেন বাবা মা’রা। ধর্মের বই তে তাই বলা আছে। আমাদের বাবা মা’রা কখনোই বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের ব্যাপারটা গুরুত্তের সাথে নেন না। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে একশ টা নিষেধাজ্ঞা, আর না মানলে বকা আর মাইর। এমন অনেক বাবা কে দেখেছি যারা শিক্ষকের কাছে ছেলে কে নিয়ে বলে, “স্যার ছেলে কে দিয়ে গেলাম। পড়া না পারলে ইচ্ছামত পিটাইবেন। মাংসগুলা আপনের, হাড্ডিগুলা খালি আমার কাছে পাঠাইয়া দিয়েন”। সেইসব বাবা মা’রা কখনো জানতে পারবেন না যে তারা তার আদরের সন্তান টির কি পরিমাণ ক্ষতি করলেন।

ভয়, লজ্জা আর অপমান নিয়ে বেড়ে ওঠে সেইসব শিশুরা। মানসিক এবং শারীরিক শাস্তি দিয়ে কখনো ই ভালো কিছু আশা করা যায় না একটা মানুষের কাছ থেকে। এসবের ফলে তার মধ্যে তৈরি হয় ঘৃণা, ভয় এবং অশ্রদ্ধা। খারাপ ফলাফলের জন্য একটা বাচ্চা কে শাস্তি দিলে, তার আত্মবিশ্বাস কমে যায়। ক্লাসে শিক্ষক খারাপ ফল করা ছাত্র কে সবার সামনে খারাপ ছাত্র বলে গালি দেন। বাড়িতে বাবা বলেন, তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ফলে সে নিজেও এটা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, তাকে দিয়ে কিছু হবে না। এভাবে সে শিক্ষা থেকে ক্রমশ নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়। পড়াশোনা তার কাছে একটা বোঝার মত হয়ে যায়। মানসিক ভাবে থেকে যায় অপরিপক্ক। আত্মবিশ্বাস হীনতার ফলে জীবনের সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পরে।

আমাদের সমাজে বাবা মায়ের সাথে সন্তানদের এক প্রকার দূরত্ব লক্ষ্য করা যায়। যেটা তৈরি হয় প্রধানত তাদের শাসন প্রক্রিয়া থেকে। বাবার সাথে দূরত্ব টা সবচে বেশি থাকে। বাবার সাথে কথা বলতেও অনেকে ভয় পায়। মজার ব্যাপার হল আমাদের বাবা রা ই আমাদের সাথে একটা দূরত্ব বজায় রাখতে চান, কারন লাই দিলে মাথায় উঠবে। এর প্রভাব টা আমরা একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারব। আমরা ছোটবেলা থেকেই বাবা মা কে লুকিয়ে অনেক কাজ করি, কারন তারা জানতে পারলে শাস্তি দেবে। সন্তানদের প্রতি হাজার টা নিষেধাজ্ঞা থাকে বলে বেশিরভাগ কাজ তারা বাবা মাকে না জানিয়ে করে।ছেলেমেয়েরা কোথায় যাচ্ছে, কাদের সাথে মিশছে এসব কিছুই বাবা মা জানতে পারে না। বলতে গেলে আমাদের জীবনের শতকরা ৮০ ভাগ ব্যপারই তাদের কাছে থাকে অজানা। ফলে নিজের অজান্তে আমরা অনেক বড় বড় ভুল করে ফেলি আর কাউকে বলতে না পেরে নিজের মধ্যে যন্ত্রণায় ছটফট করি।

আমাদের বেশিরভাগ অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের কে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আর ব্যাংকার বানাতে চায়। অনেকে নিজেদের অতৃপ্ত আকাঙ্খা তার সন্তান কে দিয়ে পুরন করতে চায়। বাবা মার ইচ্ছেমত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার হওয়ার জন্য স্কুল জীবনের প্রথম দিন থেকে শুরু হয় যুদ্ধ। বুদ্ধি হওয়ার আগে ই তার মাথায় ঢোকানো হয় ভালো রেজাল্ট করতে হবে, পরীক্ষায় প্রথম হতে হবে, ভালো জায়গায় চান্স পেতে হবে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে নয়ত জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে। পৃথিবী টাকে ভালোভাবে বুঝতে না বুঝতেই তাকে ঠেলে দেওয়া হয় এক অসম প্রতিযোগিতার মাঝে। নষ্ট করা হয় শিশুর মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা। জন্মের পর পিতামাতা ঠিক করে দেন তার সন্তানের জীবনের উদ্দেশ্য কী হবে, তার ধর্ম কী হবে, তার চিন্তা ভাবনা কী হবে। একবার ও জানতে চাওয়া হয় না তার কোনটা ভালো লাগে, সে কী হতে চায়। বেশীরভাগ বাবা মা তাদের সন্তান কে সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহিত করে না। আবৃত্তি বা চিত্রাঙ্কন নয় বরং দুবোর্ধ্য আরবি ভাষা শেখানোর জন্য হুজুর রাখা হয়। এভাবে তার নিজস্ব চিন্তা ভাবনার পরিধিকে ছোট করে দেওয়া হয়।

ছোট ছোট বাচ্চাদের উপর আঁট দশটা রসকসহীন বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এবং সেগুলো মুখস্ত করতে বাধ্য করে অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের সুস্থ মানসিক বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছেন। এসব কারনে মুক্তচিন্তা এবং যুক্তি বোধ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। কুসংস্কার, কুপমন্ডুকতা, ধর্মান্ধতা বাসা বাধছে তাদের মনে।

সবশেষে যে কথাটা বলতে চাই তা হল, শিশুদের কে সঠিক ভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ না দিলে একটা সুস্থ সমাজ গঠন কখনোই সম্ভব নয়। ছোট বাচ্চাদের ছোট ছোট কথা, অনুভতিগুলো কে গুরুত্ত দেওয়া উচিত। তারা যেন কখনো হীনমন্যতায় না ভোগে। সবচেয়ে বড়কথা শিশুর সাথে তার শিক্ষক এবং বাবা মার সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। তাদের পছন্দ অপছন্দ গুলোকে বোঝা উচিত। শিশুদের কে ভালো এবং মন্দের মধ্যে পার্থক্য গুলো বোঝাতে হবে, এবং সেসব বিষয়ে তার মতামত বিবেচনা করতে হবে। তাকে নিজস্ব ব্যাক্তিত্ত বোধ এবং রুচি বোধ তৈরি করতে সাহায্য করতে হবে। নতুন কিছু জানার আগ্রহ কে উৎসাহিত করতে হবে এবং শিক্ষাকে আনন্দময় করে তুলতে হবে। দয়া করে আপনার সন্তান কে অসম প্রতিযোগিতার মাঝে ঠেলে দেবেন না। তার শৈশব এবং কৈশোরের আনন্দময় সময়টুকু কেড়ে নেবেন না। প্রত্যেকটি শিশুর সুস্থভাবে বেচে থাকার অধিকার রয়েছে। প্রতিটি শিশুকে সুশিক্ষা এবং সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেড়ে উঠতে দিন। তাদের পৃথিবী হোক ভয়হীন ও বাধাহীন। অবাধে বিচরন করুক তারা চিন্তার রাজ্যে।