মেয়েটাকে যেতে দিলো গৃহকর্ত্রী হালিমা খাতুন। না দিয়ে কি করবে? এই ভর সন্ধায় মেয়েটা একটু পড়াশুনা করে, বই-খাতা উল্টে পাল্টে দেখে। কাজের মেয়ে বলে কি ভোলানীর সখ-স্বপ্ন থাকতে নেই? এই এতদিনে ভোলানী একটু একটু করে অক্ষর চিনতে পেরেছে। বড় বড় করে লেখা বইগুলোও সে খুড়িয়ে খুড়িয়ে পড়তে পারে। এই বাড়ীর সবাই ওর পড়ার জন্য খাটে- সময় পেলেই খাটে। গৃহকর্ত্রীর একছেলে এক মেয়ে পিঠাপিঠি। তারা স্কুল কলেজের পাঠ চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দীতে পা রেখেছে। হালিমা খাতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেনি কিন্তু পূত্র-কন্যাদের ভেতর দিয়ে নিজের স্বপ্ন সামান্য হলেও মেটাতে পেরেছে। সেটা তার মুখ দেখলে বোঝা যায়। গর্বিত মা সে- ছেলে মেয়ের সাফল্যে গর্বিত। তার পরেও নিজের জন্যে মাঝে মাঝে আফসোস হয় তার। মাথাতো তার মন্দ ছিল না। তবে কেন যে এমন দুর্গতি হলো! বাপ-মার কথা তখন কানেই ঢুকতো না। বিশেষ করে বাপজানের আদেশ অনুরোধের ভাষা, শব্দগুলো এখনও তার মাথার ভেতরে চর্কির মত ঘোরে। বাপজান বলতেন- বলতেন শুতে বসতে অষ্ট-প্রহর, “হালিরে, সময়ের কাজ সময়ে না করলি, কাইন্দাও কুল পাবিনে। সারাডা দিন টো টো করে বেড়াসনে। লেহা-পড়ায় এট্টু মন দে”। কিন্তু কে শোনে কার কথা। একেতো পড়াশুনায় অনিয়ম, অধোগতি তার ওপরে চোহারা সুরতের চেকনাই। সব মিলে আধা গ্রাম আধা শহরে বাস করে মানুষের কুনজরে পড়তে সময় লাগেনি হালিমার। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধা হয়। অবশেষে একরাতের নোটিশে বাপজান তারে বিয়ে দিয়ে দিলো গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে পড়ালেখা জানা মোটামুটি এক সৎপাত্রের সাথে। চোখের পাতায় শহরের রং লাগা হালিমা খাতুন মনের ভেতরে পছন্দ অপছন্দের নানান আঁকিঝুকি নিয়ে সেই সৎপাত্রের সাথে কাটিয়ে দিল জীবনের অনেকগুলো সময়। স্বামী তার ছোট খাটো চাকুরে- কাজ করে, খেটে খায়। হালিমাও বসে নেই। সংসারের শুরুতে স্বামীর সাথে একই প্রতিষ্ঠানে চাকরী নিয়েছে সেও। দুই জনের রোজগারে তাদের সংসার চলেছে টাঙ্গার মত টম টম করে। কর্তা অবসরে গেছে মাস দুই হলো, তার নিজের চাকরী আছে আরও কিছু দিন। অবসরে যাওয়া লোকটারে দেখে মনটা কেমন জানি করে হালিমা খাতুনের। আগেতো এমন ছিলনা মানুষটা! মাঝে মাঝে বিরক্ত হয় সে- এত বোকা মানুষ হয়! অতি সরল মানুষকে লোকে কখনও কখনও ভুল বোঝে। এমন পরিস্থিতিতেও তাকে পড়তে হয় কখনও সখনও। তখন লোকের ভুল ভাঙিয়ে দেবার জন্য মুখে একটা হালকা ভদ্রতার হাসি মাখিয়ে তাকে বলতে হয়- “আপনারা কিছু মনে কইরেন না, মানুষটা এট্টু আউলা”।

কাজ করতে ভালবাসে হালিমা খাতুন। কর্মজীবি মানুষ সে। দশটা পাঁচটার আপিস শেষ করে এই ভর সন্ধায় রুটি গড়তে বসেছে। এইতো কয়টা রুটি, সে একাই পারবে। যাক মেয়েটা একটু পড়ুক- বেচারা ভোলানী। পড়াশুনা করুক, বড় হোক, অনেক দূর যাক সে- এই তার মনের ইচ্ছা। পরের বাড়ী কাজ করে করে কি জীবন চলবে? হালিমা খাতুন এমনই- জন্মের থেকে এমন। ডুবন্ত মানুষকে হাত ধরে ডাঙায় তুলতে পারলে তার কলজে জুড়ায়, পরানে শান্তি আসে। এগুলো যেন তাকে করতেই হয়। নিজের সাধ্যমত করে সে। কোন কিছু জেনে শুনে বুঝে সে করতে পারে না। হিসেব করে অন্যের জন্য করতে পারে না। কেমন যেন অবুঝ শিশু অথবা অবোধ পশুর সহজাত প্রবৃত্তি কাজ করে তার ভেতরে। নিজের অজান্তে চারপাশের ঘুট ঘুটে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া অপ্রয়োজনী মানুষগুলোরে নিজের সাধ্যমত টেনে টেনে বেরিয়ে আনে দিনের আলোয়। এমনটা তার জীবনে ঘটে যায় কোন কিছু জানান না দিয়ে। ভোলানী তেমন একজন বেদরকারী চির-দুঃখি মেয়ে। তিন তিনটা মেয়ে স্বামীর উপরে রেখে মা তার পালিয়েছে অন্য কারুর হাত ধরে ভয়ে- অভাবের ভয়ে। এদিকে বাজান তার ভাবের পাগল। পেটে টান পড়লে মাটি কাটতে যায়। সংসার চালায় ভোলানী- বোনদের পেটে দানা পড়ে। হালিমা খাতুনের সংসারে খাটে সে। নিজের মেয়ে আর কাজের মেয়ের ভেতরে পার্থক্য ধরতে চায় না গৃহকর্ত্রী। একই শব্দ, বাক্য তার ব্যবহৃত হয় নিজের ছেলে মেয়ে আর পরের মেয়ের বেলায়। এ পরিবারের একজন গর্বিত সদস্য ভোলানী।

ভোলানী তার এই ছোট্ট জীবনে অনেক বাড়ীতে শ্রম দিয়েছে, কিন্তু এমন বাড়ী সে আর একটাও দেখেনি। এই বাড়ীর মানুষগুলো কেমন জানি। খুব বেশি ভাল। মানুষ কি কখনও এত ভাল হয়? বেশি ভাল জিনিস দেখে মানুষ দুই রকম ভাব করে- হয় দৌড়ে পালায়, না হয় নেশায় পড়ে যায়। ভোলানী নেশায় পড়ে গেছে- ভালর নেশায়। এ এক অদ্ভূত নেশা। এই বাড়ী থেকে এক মিনিট হাটলে তার বাজানের ছাপড়া। সেখানে ফিরতে চায় না সে রাতে। কাজ নেই তারপরেও পড়ে থাকে। কর্তা গিন্নীর আশে পাশে ঘুর ঘুর করে। ইনভার্সিটিতে পড়া ভাইজান আর আপারে অপ্রয়োজনে চা বানিয়ে দেয়। খামাখা কাজ বাড়ায় আরও কিছু সময় থাকার জন্যে। সাথে সাথে পড়ালেখাও ঝালাই করে। অল্প দিনে তার অনেক উন্নতি হয়েছে। ভোলানী এখন লিখতে পারে। তার চৌদ্দপুরুষে যা পারে নি তাই সে এখন পারে। এ বাড়ীর কর্তা আলাভোলা, কিন্তু গৃহকর্ত্রীর চোখ কান খোলা। রাত বাড়ছে, অথচ ভোলানী নিজের বাড়ী যাচ্ছে না। তাড়া লাগায় হালিমা খাতুন স্নেহের শাসনে, “তোর কি হইলরে ভোলানী, বাড়ী যাসনা ক্যান। ছোট বোন দুইডারে থুয়ে, বাপডারে থুয়ে তুই এখানে থাকপি ক্যান? যা বাড়ী যা”। তাড়া দেয় গিন্নি। এই একই কথা তাকে বার বার বলতে হয় প্রতিদিন। আহ্লাদের যেন শেষ নেই।

ভোলানী এখন পড়তে পারে। ছোট ছোট অক্ষরে লেখা বই, মোটা মোটা বই পড়তে পারে দ্রুত। আসছে শীতকালে সে স্কুলে ভর্তি হবে-
একবারে পাঁচ ক্লাশে ভর্তি হবে। ছোট ছোট চোখে তার অনেক বড় স্বপ্ন। আরও অনেক স্বপ্ন আছে তার মাথায়, মনে। এই এখানে, এই বাড়ীতে ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও সে স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। তাকে স্বপ্ন দেখায় তার ভেতরের এক অপরিচিত নতুন স্বত্তা। আজ হঠাৎ করে চৌদ্দ বছরে পা দিয়ে চমকে উঠে ভোলানী। লজ্জা পায়, নিজেকে ছোট মনে হয়। এই বাড়ীর খালু, খালা, ভাইজান, আপা তার মনের কথা জানতে পারলে কি ভাববে! ছিঃ ভোলানী ছিঃ। শত চেষ্টা করেও তার স্বরূপটাকে লুকিয়ে ফেলতে পারে না সে। ভাইজানকে তার ভাল লাগে- বড় বেশি ভাল লাগে, অন্যরকম লাগে- কেমন এক অচেনা নিষিদ্ধ জিনিসের মত। কেন বার বার পোড়া শরীরের ভাষায়, ছন্দে এই সব ছাইপাশ প্রকাশ হয়ে পড়ে। কখনো আবার অন্তর ‘পাপ পাপ’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। সংশয় জেগে উঠে মনে। নিষিদ্ধ চিন্তার অপরাধে আশ্রয় হারাবার ভয় আছে- এমন সতর্কবাণীও কাজ করে তার মাথায়। কোন সতর্ক সংকেতে কাজ হয় না। শরীরটা তার বড্ড বেয়াড়া- মনটাও তাই। বেড়ে উঠেছে সেই মত।

ভোলানী এখন লিখতে পারে। মাথার ভেতরে অপরিচিত নিষেধটা বড্ড বেশি দাপাদাপী করছে। ওটাকে বার করে আনতে হবে। যে কথা সেই কাজ। দুপুরের অলস প্রহরে নির্জন ঘরে বসে ভোলানী মনের ভেতরের নিষিদ্ধ জিনিসটারে বের করে আনে কাগজের উপরে কলমের আচড়ে। তিন তিনটা পত্র লিখে ফেলে সে- প্রেমপত্র। এই বাড়ীর যাকে তার অন্য রকম ভাল লাগে তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। যাকে এতগুলো দিন সে দেখতে পাচ্ছিল না, মাথার ভেতরে বসে বিরামহীন যন্ত্রনার ফসল বুনতো, সে এখন খাতার পাতায়, কাগজে কলমে মাখামাখি। অনেক সময় ধরে ভোলানী কথা বলে চলে চিঠিগুলোর শব্দের সাথে। গৃহকর্ত্রীর আগমনে ত্বরাসে লুকিয়ে ফেলে চিঠিগুলো। আজ হোক কাল হোক চিঠিগুলো তাকে লিখতেই হতো। কারণ সে এখন লিখতে শিখেছে। এ বাড়ীর মানুষগুলো বড় ভাল। তাদের স্নেহের উপরে বিশ্বাস রাখা যায়। এতটুকু প্রকাশ ক্ষমার অযোগ্য হতে পারে না- এটা তার বিশ্বাস। সে তো এখনও কাউকে দেয় নি, দেবে না ওগুলো। ওগুলো তার সম্পদ। ওগুলোর সাথে তার কথা হবে নিত্য প্রহরে।

কোন ভাবে আর শেষ রক্ষা হয় না ভোলানীর। আনাড়ী হাতে লেখা তাজা চিঠিগুলো আবিস্কার করে ফেলে এ বাড়ীর আপামনি। সেগুলোর সব চলে যায় হালিমা খাতুনের কাছে। বাড়ীর সবাই লজ্জায় জীহ্‌বা কাটে, কাটা যায় সবার মাথা। শুধু গৃহকর্ত্রীর গোপনে চোখের পানি ঝরে আর ঝরে। অসহায় হালিমা খাতুন। ভেতরটা তার মোচড়ায়- আলোর মুখ দেখতে পাওয়া দুটো হাত আবার কোন ঘুট ঘুটে অন্ধকারে হারিয়ে যাবে এই কষ্টে। কোন ভাবেই এই মেয়েকে রাখা যাবে না। ছোট্ট এই বয়সের চঞ্চলতাটা, সামাজিক ক্ষুদ্র এই ভুলটা অনেক বড় হয়ে মানুষের চোখে চোখে, কানে কানে ঘুরবে। তার আগেই বিদায় নিতে হবে ভোলানীকে এই বাড়ী থেকে।
নির্লিপ্ত কন্ঠে ভোলানীকে জানিয়ে দেয়া হলো- ‘এটা সম্ভব নয়’।

এই চৌদ্দবছরের জীবনে অনেক বাড়ীতে ভোলানীকে শ্রম দিতে হয়েছে। অনেকে হাতে মেরেছে। অনেকে মেরেছে ভাতে। সে সব কষ্ট শরীর ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে পারেনি। কিন্তু কি আশ্চার্য্য, তিনটা মাত্র শব্দের এত ক্ষমতা, এত শক্তি? অন্তরটাকে একেবারে ফালাফালা রক্তাক্ত করে ছেড়েছে। “এটা সম্ভব নয়” শব্দগুলোর চাবুক আঘাতে আঘাতে মার খাওয়া কুকুরের মত ভোলানীকে রাস্তায় নিয়ে ফেলে। সেখান থেকে এক মুহুর্তে লজ্জায় ঘৃণায় একাকার হয়ে সবার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায় সে। ভোলানীদের ভেতরে অনেক সম্ভাবনা কেন জানি হঠাৎ জেগে ওঠে আবার হঠাৎই মিলিয়ে যায়। কি যেন এক অন্ধকারের শক্তিশেল তাদের নামিয়ে আনে আবার সেই অন্ধকারে। আলোতে আর আসা হয় না। কিন্তু হালিমা খাতুনেরা আলো জ্বালানোর সে চেষ্টা করে যায় নিরলস। এক ভোলানী হারিয়ে গেছে তাতে কি হয়েছে? আর কোন ভোলানী জুটে যাবে হালিমাদের কোলে। আলো জ্বালাবার চেষ্টা তাদের করে যেতেই হবে, কারণ হালিমারা জন্মেই ও রকম। এ যে তাদের সহজাত প্রবৃত্তি।