বিজয়কেতন চাকমাই সম্ভবত এদেশের একমাত্র গজদন্ত-কারুশিল্পী। হাতির দাঁতের ওপর সুক্ষ নকশা আর কারুকাজে শৌখিন অলংকার বা ঘর সাজানোর শো-পিস তৈরির কাজ তাদের তিন পুরুষের পেশা।

প্রচণ্ড পড়ুয়া ও গভীর প্রজ্ঞার অধিকারী বর্ষিয়ান মানুষটির সঙ্গে পরিচয় সেই নয়ের দশকের শুরুতে অশান্ত পার্বত্য পরিস্থিতে, লোগাং গণহত্যার (১০ এপ্রিল, ১৯৯৬) কালে, খাগড়াছড়িতে।

পরে পেশাগত কাজে গত প্রায় দেড় দশকে একাধিকার বার রাঙামাটি গেলে প্রতিবারই তার জেলা সদরের বাসস্থান ‘কল্পতরু’তে একবার ঢুঁ মারা হয়েছে। চমৎকার গাছ-গাছালিতে ছাওয়া একতলা বাসাটির একাংশে তার কারুশিল্পের শো-রুম, অন্য অংশে কারখানা ও বাসস্থান। নিবিড় আলাপ-চারিতায় জেনে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে পাহাড়ের হাল-হকিকত। তার অমায়িক ব্যবহার, পাহাড় ও প্রকৃতির প্রতি তার অকপট ভালবাসা বা পার্বত্য রাজনীতি বিশ্লেষণ করার দুর্দান্ত ক্ষমতা — খুব সহজেই মুগ্ধ করে। এটি পার্বত্য বিষয়ক এই তথ্য সাংবাদিকের জন্য অতিব জরুরি বটে।

কল্পনা চাকমা অপহরণের (১২ জুন ১৯৯৬) কালে বিজয়কেতন দা রাঙামাটি আসন থেকে ‘প্রজাপতি’ মার্কায় স্বতন্ত্র পদে নির্বাচন করেছিলেন। সে সময় সেনা বাহিনীর ২৪ ডিভিশন পদাতিক কল্পনা চাকমা অপহরণটিকে সাবেক গেরিলা গ্রুপ ‘শান্তিবাহিনীর পরিকল্পিত প্রচার’ বলে দাবি করে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেয়। ওই বিবৃতিতে সরাসরি বিজয়কেতন দার নাম উল্লেখ করা না হলেও সামরিক জান্তা ‘প্রজাপতি’ মার্কাটিকে শান্তিবাহিনীর মনোনীতি প্রার্থীর বলেই প্রচার করে। …

চরম সামরিক নিষ্পেষনের ভেতর দল-গোত্রহীন ভাবে নির্বাচনের বিপদ বিজয় দা হয়তো আগেই জানতেন। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, সে সময় তাকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করায় তিনি সামান্য হেসে বলেছিলেন, ওরা খুব বেশী হলে আর কী করতে পারবে? বড়োজোর ধরে নিয়ে চরম নির্যাতন করে মেরে ফেলবে; এর চেয়ে বেশী কিছু তো করতে পারবে না, তাই না?…

এরপর বিজয় দা’র সঙ্গে নিবিড় আলাপের সুযোগ কমে আসে। উনি পাহাড়ের বাইরে খুব প্রয়োজন ছাড়া যান না। পাহাড়েরই বিভিন্ন সামাজিক অনুস্ঠানে তার সঙ্গে কখনো কখনো দেখা হয়। চাকমাদের বিঝু উৎসবের হই হট্টোগোলের ভেতর প্রতিবার তার বাড়িতে একবার বেড়াতে যাওয়া হয়…কিন্তু অনেকদিন প্রাণ খুলে তার সঙ্গে আলাপচারিতা আর হয়ে উঠে না।

বেশকিছু দিন আগে তার সঙ্গে আবারো এক সন্ধ্যেয় আড্ডা জমেছিলো। অশান্ত রাজনীতির বাইরে কথা হয় তার গজদন্ত-কারুশিল্প নিয়ে। বিজয়কেতন দা’র কথা শিশুর মতো অবাক বিস্ময়ে শোনা হতে থাকে।

এখনো তিনি এই শেষ বয়সে ঘুমঘোরে ফিরে যান দূর অতীতে। স্পষ্ট যেনো সব স্লাইডের স্থির চিত্র হয়ে একের পর এক চোখের সামনে ভেসে আসে।…

উঁচু পাহাড় থেকে বন -জঙ্গল ভেঙে নামছে ম্যামথের মতো প্রমাণ আকৃতির বুনো হাতির পাল। তাদের তাণ্ডেব তটস্থ হয় পুরো পাহাড়। উজাড় হয় জুম চাষে সাজানো ফসলের বাগান। অথচ আদিবাসী মানুষ একে মেনে নেয় পাহাড়ি জীবনের স্বাভাবিকতা হিসেবে।

প্রজনন মৌসুমে হাতির পাল ভারী করার সুযোগ দেন তারা। বাকি সময় অরণ্যের গহিন পথে শিকারের খোঁজে ছোটেন দুর্ধর্ষ ম্রো কি বম আদিবাসী তরুণ। তার গাদা বন্দুকের নিশানায় কখনো বা ধরাশায়ী হয় দু – একটি দাঁতাল হাতি। তারপর পাহাড় জুড়ে কয়েকদিন ধরে চলে খাওয়া-দাওয়া, উৎসব। এ ভাবেই বয়ে চলে পাহাড়ি জীবন। পরম মমতায় প্রতিটি প্রাণ সত্বাকে টিকিয়ে রেখে পাহাড়ি মানুষ আবার সেগুলোকে আশ্রয় করেই বাঁচিয়ে রাখেন নিজেদের।

বিজয়কেতন দা’র স্বপ্নে আরো ধরা দেয়– শিকারী নামমাত্র দামে হাত দেড়েক লম্বা হাতির দাঁত বিক্রি করলেন ব্রিটিশ সাহেব কি ফরেস্টের বড় কর্তার কাছে। সেখান থেকে আদেশ পেয়ে লংগদুতে মাচাং ঘরের ইজরে বসে কাজে ডুব দেন তার দাদু কল্পতরু চাকমা। ক্ষুদে হাতুড়ি – বাটাল দিয়ে হাতির দাঁতের উপর আশ্চর্য – সুন্দর নকশা বোনেন তিনি।

কিন্তু এ সবই এখন ধূসর অতীত, শুধুই স্বপ্ন মাত্র। সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। সংঘাত বিক্ষুব্ধ পাহাড়ি বন এখন সবুজ মরুভূমি। দিন দিন সেখানে বাড়ছে চিরচেনা গাছ উজাড়ের সংখ্যা। বিপন্ন বনে এখন বিপন্ন বুনো হাতিও। এই নিদানকালে এখন বড়ই দুর্লভ বিশালাকায় সেই হাতির দাঁত। বিজয়কেতন দা’র তিন পুরুষের এই পেশা এখন তাই খাদের কিনারে।

বন উজাড়ের সঙ্গে হাতির অস্তিত্ব হারিয়ে যাক, কোনোমতেই এটি তার কাম্য নয়। তবু আছে চোরাই হাতি শিকারীর উৎপাত। প্রবীন এই গজদন্ত শিল্পী বলেন, বন থাকলে থাকবে বুনো হাতির প্রাচুর্য; আর নিজেদের পরিবেশে মাথা উঁচু করে বাঁচবেন অরণ্যচারী পাহাড়ি মানুষ। তাই কোনোভাবেই বিপন্ন হাতি শিকারের পক্ষে নন তিনি।

বিজয়কেতন দা বললেন, বাবা মোহনবাঁশি চাকমার কাছে আমি কাজ শিখি সেই ১৯৬২ সালে, ছাত্র অবস্থায়। তারপর কখনো বন্ধ করিনি কাজ। আর এখন হাতির দাঁত তো পাওয়াই যায় না। তারপরেও খবর দেওয়া আছে বন বিভাগকে। অপঘাতে বা দুর্ঘটনায় কোনো হাতি মারা গেলে তাদের কাছ থেকে নিলামে দাঁত কিনে নেই। অনেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া হাতির দাঁতও মাঝে-মধ্যে বিক্রি করেন। চোরাই শিকারীদের জব্দকৃত মালামালের ভেতর অনেক সময় হাতির দাঁতও পাওয়া যায়। বন বিভাগের কাছে থেকে সে সব গজদন্ত দরদাম করে কিনে নিতে হয়।

তিনি বলেন, হাতির আবাসের তথা খাদ্যের এখন বড় সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তার ওপর আছে, পাহাড় কেটে অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন। সব মিলিয়ে বুদ্ধিমান এই প্রাণীটি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় পাড়ি জমাচ্ছে ভারত ও মায়নমারের গহিন অরণ্যে।

হাতির দাঁত দিয়ে মেয়েদের প্রায় সব ধরনের সৌখিন অলঙ্কার বানান তিনি। তার সংগ্রহে আছে কয়েক ধরনের চুলের কাঁটা, চিরুনী, আঙটি, গলার হার, কানের দুল। ছেলেদের জন্য আছে টাই পিন, কোট পিন, কাফলিঙ্ক, টোবাকো পাইপ, সিগারেট হোল্ডার–ইত্যাদি। এছাড়া আছে ছোটবড় নানান ধরনের শোপিস। পাওয়া যাবে হাত পাখা, বুদ্ধ মূর্তি, হাতির প্রতিকৃতি, পেপার নাইফ, ছোটো-বড় স্টিক, ফুল-লতা-পাতার নকশা।…গভীর ধৈর্য ও মমতা দিয়ে সৃষ্টি আশ্চর্য সুন্দর এইসব মূল্যবান কারুকর্ম। হাতির হাড় দিয়ে বানানো বেশ কিছু শৌখিন জিনিষ-পত্রও বানিয়েছেন তিনি।

তার শিল্পকর্মের দাম জানতে চাইলে বিজয়কেতন দা হেসে বলেন, দেখুন, এই সবের তো কোনো নির্দিষ্ট দাম হয় না; পুরোটাই সখের বিষয়। কোনো জিনিষের কতো দাম হবে, তা নির্ভর করছে কাজটির আকৃতি ও নকশার মাত্রার ওপর। ২০০ টাকা থেকে শুরু করে এক-দেড় লাখ টাকার জিনিষও পাবেন আমার কাছে।

এক থেকে দেড় লাখ টাকা! বিজয়কেতন দা আবারো অমায়িক হাসেন, ঠিক তাই, এর চেয়েও বেশী দাম হতে পারে। একটি আস্ত দাঁত খোদাই করে যদি সুক্ষ নকশা করি, তবে দাম হতে পারে দেড় লাখ টাকারও বেশী। এ কাজে লাগবে এক মাসেরও বেশী সময়।…

আপনিই তো এই শিল্পের শেষ কারিগর। এরপর? এমন প্রশ্নের জবাবে হতাশা ছড়ায় বিজয়কেতন দা’র কন্ঠে। ‘এর পর কি হবে জানি না। হাতির দাঁত না পেলে এই শিল্প টিকবে না।’ বলেন ৭০ বছর বয়স পেরুনো এই শিল্পী।

ছবি : বিজয়কেতন চাকমা, লেখক।

সংযুক্ত: ০১। লাইফ ইজ নট আওয়ার্স, সিএইচটি কমিশন রিপোর্ট।
০২। ফেবু গ্রুপ- পাহাড়ের রূদ্ধকণ্ঠ CHT Voice