লিখেছেন: সুম সায়েদ
জ্ঞান হবার পর থেকেই ছোট্ট রবার্ট স্টেবিন্স মাঠে-ঘাটে-নালায়-ডোবায়-বনে-বাঁদাড়ে খুঁজে বেড়াতেন ছোট ছোট সরিসৃপ, সাপ আর ছোট উভচর প্রাণী। সবাই ভাবতো এ তার ছেলেপনা, আরেকটু বড় হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তিরিশ পার হবার আগেই এই স্টেবিন্স ক্যালিফোরনিয়ার উপত্যকা ঘিরে এক প্রাণীর বিভিন্ন উপপ্রজাতির গঠনগত কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেন এবং তাদের নিয়ে এক হাইপোথিসিস প্রকাশ করেন ১৯৪৭ সালে। বহু বইয়ের রচয়িতা স্টেবিন্স এ বছর ৯৫ তে পা দিলেন। আগের মত আর মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াতে না পারলেও, আগের মতই প্রবল বেগে লিখে যাচ্ছেন তার নানান অভিজ্ঞতার কথা। বলার আছে তার অনেক কিছুই। আর কেন নয়! পাঁচ যুগ আগে দেওয়া হাইপোথিসিস এখনো কেউ ভুল প্রমাণ করতে পারেনি, বরং আধুনিক জিন প্রকৌশলের হাতে তার সেই পর্যবেক্ষণ হয়ে উঠেছে বিবর্তন থিওরির অন্যতম এক দৃষ্টান্ত।
রিচার্ড ডকিন্স তার ২০০৪ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত “দ্যা এনসেসটোরস টেইল” বইয়ে মানব প্রজাতির বিবর্তনের ইতিহাস দেখাতে গিয়ে একটু একটু করে পিছিয়ে পিছিয়ে সহজ সরল ভাষায় নিয়ে গেছে মানুষের কমন এনসেসটোরের কাছে, যেই আদি প্রজাতি থেকে আজকের মানুষ ও মানুষের বিবর্তনের খালাতো ভাই বোন শিম্পাঞ্জি, বনোবো, গরিলা ইত্যাদি এসেছে। সেই আদি প্রজাতি, বা তার থেকে বিবর্তিত সকল মধ্যবর্তী প্রজাতি আজ সময়ের সাথে সাথে বিলুপ্ত, আছে কেবল অসংখ্য ফসিল। শুধু এই ফসিল দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিবর্তনের ধারা বুঝানো আসলেই খুব কঠিন। আর বিবর্তন অনেক ধীর প্রক্রিয়া, যেটা এখনকার তুলনামূলক স্থির ভৌগলিক পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষণ করতে পারা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এর মাঝেই বিবর্তন বিশেষজ্ঞরা অনেক অসাধারণ উদাহরণ নিয়ে এসেছেন, যা আমাদের দেখায় কিভাবে ভৌগলিক ভাবে অবস্থানগত পরিবর্তন ও সময়ের সাথে সাথে একটি আদি প্রজাতি থেকে উদ্ভুত প্রজাতি বিবর্তনের দ্বারা একটু একটু করে পরিবর্তিত হতে হতে সম্পূর্ন ভিন্ন প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে।
ডকিন্স-এর খুবই প্রিয় এরকমই এক প্রজাতির উদাহরণ হলো ডানা মেলা শংখচিল। উত্তর মেরুকে ঘিরে এক বলয় সৃষ্টি করে শংখচিলের এর বিভিন্ন প্রজাতিগুলো। গ্রেইট ব্রিটেনের শংখচিলগুলো তাদের খালাতো ভাই- উত্তর আমেরিকার শংখচিলগুলোর সাথে মিলিত হতে পারে, এবং সংকর প্রজাতির শংখচিলের জন্ম দিতে পারে। আমেরিকান শংখচিলগুলো আবার মিলিত হতে পারে সাইবেরিয়ার পশ্চিম অঞ্চলের শংখচিলের সাথে। শুধু সাইবেরিয়াতেই চক্রাকারে বিভিন্ন ভৌগলিক স্থানে আছে মোট ৪ ধরনের শংখচিল। এই সব প্রজাতিগুলো কেবল মাত্র তার ভৌগলিক প্রতিবেশির সাথে মিলিত হতে পারে। যেমন ব্রিটিশ শংখচিল শুধু আমেরিকানের সাথে মিলিত হবে, কিন্তু সাইবেরিয়ানের সাথে না। আবার সাইবেরিয়া থেকে আরেক প্রজাতি বিবর্তিত হয়ে আসে, তাদের পাওয়া যায় উত্তর-পূর্ব ইউরোপে, অনেক সময় ব্রিটেনেও। এভাবে শংখচিলরা তৈরি করে এক বলয়, যে কারনে এ ধরনের প্রাণীদের বলা হয় চক্র প্রজাতি বা রিং স্পিসিস। কিন্তু ভৌগলিকভাবে একই ঘরানার হওয়া সত্ত্বেও এই উত্তর-পূর্ব ইউরোপের শংখচিল, ব্রিটেনের শংখচিলের সাথে সাধারণভাবে কখনোই মিলিত হয় না। শংখচিলের এরকম প্রজাতিগুলোকে আলাদা আলাদা স্পিসিস বা প্রজাতি না ধরে বলা হয় সাব-স্পিসিস। বিবর্তন এর বিজ্ঞানে তাদেরকেই ভিন্ন প্রজাতির ধরা হয় যারা নিজেদের মধ্যে কোনভাবেই মিলিত হতে পারে না। তাই শংখচিলের রিং স্পিসিসে পরিষ্কার ভাবে ব্রিটেনে পাওয়া দুই ধরনের শংখচিলকে আলাদা স্পিসিস বা আলাদা প্রজাতি ধরা হয়।
এমনটা কেন হলো! প্রতিবেশি সাব-স্পিসিস গুলোর মাঝে জিন ফ্লো বিদ্যমান। আমেরিকার শংখচিল কোন সময় উড়ে গিয়ে সাইবেরিয়ার আরো শীতল স্থানে বাসা বাধে, আস্তে আস্তে তার দেহের পালক হয়তো আরো ঘন হয়, তারপর নিজেদের মধ্যে মিলিত হবার পর আলাদা প্রজাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ব্রিটেনের শংখচিল যখন আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়, তখন হয়তো শুধু ঐ শংখচিলগুলোই এসেছিল আমেরিকায়, যাদের পাখায় জোর বেশি ছিল। “হয়তো” বলছি কারন, এই বিষয়ে বিস্তারিত পড়ার সুযোগ হয়নি। আর শংখচিল অনেক বিবর্তন বিশারদ, যেমন ডকিন্সের খুব প্রিয় হলেও, আমার না। শংখচিলের কর্কশ চিৎকার, তাদের খাবার চুরি করার অদম্য চেষ্টা, তাদের মাথার উপর বিনা মেঘে বজ্রপাত ইত্যাদি আমাকে শংখচিল দমন কমিটির প্রধান হিসেবে দাঁড়ানোর ইচ্ছা জাগায় মাত্র। এরচেয়ে বরং আমার প্রিয় রিং স্পিসিসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই যাদেরকে রবার্ট স্টেবিন্স চল্লিশের দশকেই সনাক্ত করে গেছেন রিং স্পিসিস হিসেবে। তাদের পাওয়া যায় আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার উপত্যকায় বা ভ্যালিতে। সরিসৃপ সদৃশ্য এক উভচারী স্যালামেন্ডার, এই ছোট্ট প্রাণীর নাম এনসাতিনা। এনসাতিনা এসোলোৎজি এর ৭টি সাব স্পিসিস দিয়ে বিবর্তনের প্রমাণ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যায়। ডকিন্স নিজেও তার এনসেসটরস টেইল বইয়ে স্টেবিন্সের স্যালামেন্ডারদের জন্য লিখেছেন এক আলাদা অধ্যায়, দি স্যালামেন্ডারস টেইল।
এনসাতিনা এসোলোৎজি হলো একটি ফুসফুসহীন স্যালামেন্ডার প্রাণী। ছোট ছোট চার পা বিশিষ্ট, স্বল্প আয়ুর এই স্যালামেন্ডার তাদের জীবদ্দশায় ৪০কিমি ব্যাপ্তি এলাকার বাইরে যেতে পারে না। কিন্তু কয়েকশ মিলিয়ন বছর ধরে এই এনসাতিনার সাব-স্পিসিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমেরিকার পশ্চিম উপকূলবর্তী ক্যালিফোরনিয়ার উপত্যকা ঘিরে। এর সাতটি সাব-স্পিসিস পাওয়া যায়- ওরেগোনেনসিস, পিকতা ও প্লাটেনসিস, জেনথপতিকা, এসোলোৎজি, ক্রোকিয়েতর এবং ক্লবেরি। এনসাতিনাদের পাওয়া যায় কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায়, সেখান থেকে আমেরিকার ওয়াশিংটন স্টেইটে, একটু নিচে ওরেগন স্টেইট-এ, তারপর ক্যালিফোরনিয়ার পশ্চিম উপকূলে, এবং আমেরিকার আরেকটু ভিতরে নেভাডা হয়ে শেষমেশ পাওয়া যায় মেক্সিকোর বাহা ক্যালিফোরনিয়াতে। পুরো ক্যালিফোরনিয়ার কেন্দ্রীয় উপত্যকা ঘিরে তৈরি হয় এক বলয়। এই জন্যই এনসাতিনার সাব-স্পিসিসগুলো তাদের ভৌগলিক প্রতিবেশির সাথে সংকর প্রজাতি জন্ম দিতে পারে দেখে এদের সার্বিকভাবে রিং স্পিসিস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু শুধু মাত্র একজোড়া প্রতিবেশি কোনভাবেই মিলিত হতে চায় না, তারা হল ক্লবেরি আর এসোলোৎজি।
উপত্যকার একদম উপরে- ওরেগন, ওয়াশিংটন আর ব্রিটিশ কলাম্বিয়াতে পাওয়া যায় ওরেগোনেনসিসকে । এই প্রজাতি থেকে দুইটি প্রজাতি উদ্ভূত হয়, পিকতা ও প্লাটেন্সিস। প্লাটেন্সিসকে পাওয়া যায় সিয়েরা নেভাডা তে, আর এর থেকে আরেক সাবস্পিসিস উদ্ভুত হয়- ক্রকিয়েতর। আর পিকতা উপকূল এলাকা ধরে বিস্তৃত লাভ করে শেষে সান ফ্রান্সিসকো এলাকাতে আরেক সাব স্পিসিস জেনথপতিকা এর জন্ম দেয়। এই জেনথপতিকা থেকে একদম দক্ষিণ ক্যালিফোরনিয়ার উপকূলে উদ্ভুত হয় এসোলোৎজির।
এসোলোৎজির অঞ্চলের আরেকটু দক্ষিণে গেলে পাওয়া যায় ক্লবেরিকে। পুর্ববর্তী আর সব স্যালামেন্ডার সাব স্পিসিস নিজেদের প্রতিবেশিদের মধ্যে মিলিত হয়ে সংকর প্রজাতি সৃষ্টি করলেও ক্লবেরি আরে এসোলোৎজি কোনভাবেই মিলিত হয় না। বরং ক্লবেরি এর গায়ের রং দেখে রবার্ট স্টেবিন্স বলেন এটি এসোলোৎজির নিকটবর্তী প্রতিবেশি হওয়া স্বত্তেও এ আসলে উদ্ভুত হয় ক্রকিয়েতর থেকে। তিনি সর্বশেষে হাইপোথিসিস দেন যে, “আদি একটি একটি স্যালামেন্ডার থেকে এই সব স্যালামেন্ডার গুলো একে একে উদ্ভুত হয় ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে পুরো উপত্যকা ঘিরে এক রিং তৈরি হয়, এবং এরা প্বারিপার্শিক জলবায়ু ও বাসস্থান এর উপর নির্ভর করে বিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন গায়ের রঙের অধিকারী হয়। কিন্তু যখন ঐ রিং উত্তর থেকে দক্ষিণে এসে নিচে মিলিত হয়, তখন এসোলোৎজি ও ক্লবেরি এতটাই ভিন্ন ভাবে বিবর্তিত হয় যে তারা আর কোনভাবেই মিলিত হয় না”।
স্টেবিন্সের এর আরেক ছাত্র, চার্লস ব্রাউন ষাট এর দশকে আরেকদফা মাঠে নামেন জানতে, কেন এই দুটি সাব স্পিসিস মিলিত হয় না। তখনকার দিনে আজকের এই আণবিক পর্যায়ের জেনেটিক্যাল গবেষণার কোন ধারাই আবিষ্কৃত হয়নি। তাই এসব গবেষণা ছিল পর্যবেক্ষণ এর উপর ভিত্তি করে। ব্রাউন দক্ষিণ অঞ্চলে ৪টি জায়গা আবিষ্কার করেন যেখানে এসোলোৎজি আর ক্লবেরি মিলিত হবার মত পরিবেশ বিদ্যমান। কিন্তু ৪টির ৩টি জায়গাতে কোনভাবেই এসোলোৎজি আর ক্লবেরির সংকর পাওয়া গেল না। কিন্তু চতুর্থ স্থান, কায়ুমাকা পাহাড়ে পাওয়া গেল আবছা ছোপ ছোপ দাগ সহ এক সংকর প্রজাতি। এ যে এসোলোৎজি আর ক্লবেরি এর সংকর কোন সন্দেহ নাই! তাহলে কি স্টেবিন্স এর হাইপোথিসিস ভুল ছিল! আর প্রশ্ন থেকেই যায়,যদি এক জায়গাতে সংকর পাওয়াই যায়,অন্য তিনটি জায়গাতে কেন পাওয়া যাচ্ছে না! তবে কি ঐ দুই প্রজাতির জন্য মিলিত হবার পরিবেশ উপযোগী নয়! এই সকল প্রশ্ন এর উত্তর নিয়ে নানান থিওরি আসতে লাগলো। কিন্তু এই গবেষণা নতুন এক ধারায় প্রবাহিত হল তখন, যখন আশির দশকে স্যালামেন্ডারের প্রোটিন নিয়ে ল্যাবে গবেষণা শুরু হল।
প্রোটিন, একটা জটিল রাসায়নিক কমপ্লেক্স, যা হলো আমাদের শরীরের প্রতিটি আণবিক পর্যায়ে বিদ্যমান অঙ্গানুগুলো তৈরীর প্রধান উপাদান। মানুষ সহ সকল প্রাণীতে হাজার হাজার ধরনের প্রোটিন বিদ্যমান। এই প্রোটিন নিয়ে গবেষণায় দেখা যায় এসোলোৎজি আর ক্লবেরি দুটোর প্রোটিনের গঠন ও ধরন অনেক ভিন্ন। বরং উভয়েরই তাদের ঠিক উপরে থাকা উত্তর দিকের প্রতিবেশিদের প্রোটিনের সাথে মিল পাওয়া যায়। শুধু তাই না, পিকতা এর প্রোটিন এর সমন্নয় এমনই দিকনির্দেশনা দেয় যা থেকে ধারনা করা যায় যে পিকতা এর আদি পিতাই আসলে এইসব এনসাতিনা সাব স্পিসিসের আদি পিতা বা কমন এনসেস্টর। এই গবেষণা আবারো স্টেবিন্সের হাইপোথিসিসকেই সমর্থন করে।
নব্বই এর দশকে যখন কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়, তখন আবারো নতুন ভাবে তথ্য বের হয়ে আসে। এবার পুরো সাব স্পিসিসের ভৌগলিক অবস্থান নিয়ে স্টেবিন্সের চল্লিশের দশকের হাইপোথিসিস নতুন ভাবে সামনে আসে, আবারো তার হাইপোথিসিসই জয় লাভ করে। দেখা যায় উত্তর থেকে দক্ষিণে বিবর্তিত হতে হতে আসে এই এনসাতিনা, আর দক্ষিণে এসে রিং স্পিসিস মিলিত হলেও ভিন্ন দুটি প্রজাতির সৃষ্টি হয়। ২০০৪ সালে যখন এনসাতিনা এর নিউক্লিয়াসের ডিএনএ নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু হয় তখন সেই প্রোজেক্ট-এর প্রধান টম ডেভিডকে সবাই প্রশ্ন করতে থাকে, নতুন করে তোমরা কি আবিস্কার করতে পারবে যেটা আমরা এখনো জানি না! টম আর তার দল দমেনি এতটুকু, আবারো মাঠ পর্যায়ে নেমে খোঁজা শুরু করলো এনসাতিনাদের। এনসাতিনা-এর জিনম, যেখানে সব ডিএনএ তথ্য জট পাকিয়ে থাকে, তার আকার অনেক বড়। মানুষের জিনম থেকে ছয়গুণ বড়! তার এর থেকে উপযোগী তথ্য বের করা হয়ে উঠে দুঃসাধ্য। প্রয়োজনীয় তথ্য থেকে অপ্রয়োজনীয় কোডিং-এ জিনম ভর্তি। আবারো ফলাফল হলো সেই একই, স্টেবিন্সের হাইপোথিসিসে ভুল নেই।
মাঝে দিয়ে আরেক প্রশ্নের উত্তর বের হলো। টম ডেভিড জানতে আগ্রহী কেন একটি মাত্র মিলন স্থানে এসোলোৎজি আর ক্লবেরির দুর্লভ সংকর পাওয়া যায়। গবেষণা থেকে দেখা যায়, ক্লবেরির মেয়েরা এসোলোৎজি, ক্লবেরি এবং নিজেদের সংকরের সাথে প্রয়োজনের খাতিরে মিলিত হয়। কিন্তু এসোলোৎজি-এর মেয়েরা কিছুতেই ক্লবেরি এর পুরুষদের সাথে মিলিত হয়না। অর্থাৎ এসোলোৎজি-এর মেয়েরা ক্লবেরিদের সম্ভাব্য মিলন সঙ্গী হিসেবে গন্যই করে না। এসোলোৎজির মেয়েদের কাছে ক্লবেরিরা অপরিচিত অন্য প্রজাতি। টম ডেভিসের গবেষণাগারে ডিএনএ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যে সংকরগুলো পাওয়া গেছে তারা কেবল ক্লবেরি মেয়ে ও এসোলোৎজি পুরুষের মিলনের ফসল। আর ডিএনএ তথ্য এও জানায় এই ধারা অব্যাহত আছে অনেক মিলিয়ন বছর ধরে। যদি আমরা আরো হাজার বছর পর এসোলোৎজি আর ক্লবেরিকে একসাথে দেখি, দেখা যাবে বিবর্তনের ধারায় এরা পূর্নাংগ দুটি আলাদা প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাদেরকে আর এনসাতিনা এর সাব স্পিসিস ধরা হবে না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বিবর্তনে এই এনসাতিনা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন! এই প্রশ্নটা কোন বিবর্তন বিশারদকে করলেই তার মুখে হাসি দেখা যাবে। কারন অনেকেই দাবী করেন বিবর্তন খুব ধীর প্রক্রিয়া, এটিকে আমরা কখনোই পর্যবেক্ষণ করতে পারবো না, মিসিং লিংক কই ইত্যাদি ইত্যাদি। ছোট্ট এই এনসাতিনা একাই এর উত্তর দিতে পারে। ধরুন এসোলোৎজি হলো আজকের মানুষ প্রজাতি আর ক্লবেরি আজকের শিম্পাঞ্জি। আমাদের কমন আদি পিতা বা এনসেস্টর আছে, যাদের থেকে আমরা বিবর্তিত হয়ে আজকে দুটো আলাদা প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত। আমাদের এনসেস্টর থেকে বিবর্তন প্রয়োজন অনুসারে এতটাই হয়েছে যে এখন আর আমরা নিজেদেরকে এইপ’দের সাথে আত্মীয়তা ছিল তা বাহ্যিকভাবে স্বীকারই করতে পারি না। অনেক ফসিল নিয়ে গবেষণা হয়েছে, হাইপোথিসিস এসেছে, প্রোটিন, ডিএনএ নিয়ে গবেষনা হয়েছে। সব গবেষণা এটাই বলে যে আমরা মানুষ আর আজকের এইপ সম্পর্কে খালাতো ভাই বোন। কিন্তু সাধারণ মানুষ ল্যাব এর গবেষণা অগ্রাহ্য করে আর চাক্ষুষ প্রমাণ চায়। তখন ১৯৪০ সালের স্টেবিন্স এক হাতের উপর এসোলোৎজি আর আরেক হাতে ক্লবেরি নিয়ে বলেন, এই নাও প্রমাণ! আর ১৯৬০ সালের ব্রাউনের দুহাতে জেনথপতিকা আর ক্রোকিয়েতর, ২০০৪ সালের টম ও ডকিন্সের হাতে ওরেগোনেনসিস, পিকতা ও প্লাটেনসিস। এসোলোৎজি আর ক্লবেরি-এর কমন আদি পিতা ওরেগোনেনসিস এখনো বিদ্যমান। কমন আদি পিতা থেকে উদ্ভুত লিংক পিকতা-জেনথপতিকা ও প্লাটেনসিস- ক্রোকিয়েতর এখনো বিদ্যমান। মানুষের আদি পিতা নেই, বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কিন্তু এনসাতিনা-এর আছে! এরাই জীবিত ফসিল!
টম ডেভিস আর রবার্ট স্টেবিন্সকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এনসাতিনা-এর উপর ভবিষ্যত গবেষণা নিয়ে তারা কি চিন্তা করে, দুজনেরই একই মত। যত নতুন গবেষণার উপায় ও প্রযুক্তি আসবে ততই আমরা নতুন নতুন প্রশ্ন করে যাব আর নতুন তথ্য শিখে যাব। কেউই মনে করে না এনসাতিনাকে নিয়ে আমাদের জানা শেষ হয়ে গিয়েছে!
সূত্রঃ
১) http://www.ensatina.net/FILES/ensatina.htm
২) http://evolution.berkeley.edu/evolibrary/article/0_0_0/devitt_03
৩) http://mukto-mona.com/evolution/QA/evolution_species.htm
৪) ছবি ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত।
বিজ্ঞানের ছাত্র নই বলে ভাসা ভাসা বুঝেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম; কিন্তু এখানে এসে থামতে হল। আপনার এই লাইনগুলো আমার নিকট লেখাটির আকর্ষণ বাড়িয়ে দিল অনেকগুণ। পেছনে ফিরে গেলাম, মন দিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম কেন মিলিত হতে পারে না এসোলোৎজি আর ক্লবেরি একই স্পেসিস আর নিকটবর্তী প্রতিবেশী হওয়া স্বত্বেও। খুব উপভোগ করলাম একটা প্রশ্নের সমাধানে বিজ্ঞানের দীর্ঘ সাধনার ইতিহাস। বিজ্ঞানে বোধহয় এমন আরও অনেক প্রশ্ন রয়েছে, যার উত্তর খুঁজে ফিরছেন বিজ্ঞানীরা যুগ-যুগান্তর ধরে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
আপনার লেখা ঝরঝরে, ভাষা আকর্ষণীয়। এমন অসাধারণ মানের লেখা দিয়ে মুক্তমনাকে ভবিষ্যতেও সমৃদ্ধ করে যাবেন, সেই প্রত্যাশা থাকল….
@কাজি মামুন,
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। আমিও আপনার মতই এরকম একটি তুলনামূলক কথা শোনার পর চক্রীয় প্রজাতি নিয়ে আগ্রহী হই। খুব ভালো লাগছে জেনে যে আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুটা অন্য কারো মাঝেও ছড়াতে পেরেছি। নিচের ভিডিওটি ছিল আমার জন্য অনুপ্রেরণা;
httpv://www.youtube.com/watch?v=7XuMCVjGX3Y
মুক্তমনায় স্বাগতম। আপনার লেখার স্টাইলটা আকর্ষনীয়, আশা করি ভবিষ্যতে আরও লিখবেন।
পরে সংকরের কথা বললেও এই ডিএনএ গবেষণাটায় ঠিক কী পাওয়া গেছিল যা দিয়ে স্টেবিন্সের প্রকল্পটি প্রমাণিত হয় তা উল্লেখ করেননি। এ ব্যাপারে আরেকটু বিস্তারিত জানলে মন্দ হত না।
আরেকটা ছোট্ট কথা, যদিও তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। হাইপোথিসিস, স্পিসিজ, মিলিয়ন, এনসেস্টর, থিওরি, জিন ফ্লো এর মত শব্দগুলো হয়তো বাংলা করে দেওয়া যেত।
@বন্যাদি,
একদম আসল জায়গাতে ধরেছেন। আমি সহজে কিছুতেই অনুবাদ করতে পারছিলাম না দেখে ঐ জায়গাটা তাড়াতাড়ি এড়িয়ে গেছি। মন্তব্যতে এখন কোন সংকোচ ছাড়া চেষ্টা করি।
মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ থেকে নিচের তথ্য আসেঃ
কিন্তু ১৯৯০ সালে বার্কলি এর এক ছাত্র এনসাতিনার নতুন কিছু মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ নিয়ে তথ্য বিশ্লেষণ করে এটা বলেন যে, এনসাতিনা উত্তর নয়, বরং দক্ষিণ সান ফ্রান্সিসকো থেকে উদ্ভূত হয়, যেটা কিনা স্টেবিন্স-এর হাইপোথিসিস এর পক্ষে যায় না। তাই নতুন করে জিন সংগ্রহ করে এই তথ্য বিবেচনা করা জরুরী হয়ে পরে। নতুন নিউক্লিয়াসের ডিএনএ জোগার করা কঠিন ছিল, সেটা তো একটু বলেছি। এদের ডিএনএ সিকুয়েন্স ছিল শর্ট আর অনেক অনেক রিপিটেটিভ। তাই উল্লেখযোগ্য জেনেটিক ভেরিয়েশন এই শর্ট সিকুয়েন্সএ খুঁজে পাওয়া ছিল কঠিন। নতুন ডিএনএ বিশ্লেষণ করার আগেই এটা অনুমান করা যায় যে, যদি স্টেবিন্স এর কথা ঠিক থাকে তাহলে উপরে উত্তর দিকের এনসাতিনাদের থেকে দক্ষিণের রিং এর নিচের এনসাতিনাদের জিন ভেরিয়েশন বেশি থাকবে। টম এর গবেষক দল যা পায় তা হল, এনসাতিনা এর জিনম এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রেইটে বিবর্তিত হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সব সাব স্পিসিসে একই ধারা পাওয়া যায়, কোনো কোনো অংশে ভেরিয়েশন অনেক বেশি।
বন্যাদি হাইপোথিসিস, স্পিসিজ, মিলিয়ন, এনসেস্টর, থিওরি, জিন ফ্লো এর মত শব্দগুলো বাংলা করে দেওয়া যেত, আলসেমো করে করি নি। তবে ভবিষ্যতে বিজ্ঞান বিষয়ক কিছু লিখলে চেষ্টা করবো আরো বাংলা শব্দ ব্যবহার করার। :))
বাহ, বেশ সুন্দর, গুছিয়ে হালকাভাবে লিখেছেন।
@কৌস্তুভ,
ধন্যবাদ। অনেকের বিজ্ঞানভীতি থাকে, বা বিজ্ঞানের ছাত্র না অনেক দিন। তাদের কথা চিন্তা করে লেখার চেষ্টা করেছি।
চমৎকার এ লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
রিং স্পিশিজ বা চক্র প্রজাতি আমারও খুব প্রিয় একটা বিষয়। এগুলোতো বিবর্তনের একেবারে চাক্ষুষ প্রমাণ বলে আমি মনে করি। মার্করিডলীর ইভলুশন বইয়ে কিভাবে চক্র প্রজাতি তৈরি হয় তার বিস্তৃত বিবরণ পড়েছিলাম। বিবর্তনের পথ ধরে বইটাতেও এসোলোৎজিদের রিং স্পিসিজ তৈরির কথা আছে ‘চোখার সামনেই ঘটছে বিবর্তন’ অধ্যায়টিতে, দেখেছেন নিশ্চয়। তবে আপনার লেখা এ ব্যাপারে খুবই বিস্তৃত এবং তথ্যসমৃদ্ধ হয়েছে।
আপনার লেখার হাতও বেশ ভাল, বিশেষত এই কথাগুলো চমৎকার হাস্যরসের খোড়াক –
আপনার লেখাটি আমাদের বিবর্তন আর্কাইভকে সমৃদ্ধ করবে নিঃসন্দেহে। মুক্তমনায় নিয়মিত লিখবেন আশা করছি।
@অভিজিৎ দা,
ধন্যবাদ। আপনারা বিবর্তন আর্কাইভে অলরেডি সব টপিক নিয়ে লিখেই ফেলেছেন। :)) আমাকে খুঁজে বের করতে হলো কোনটা নিয়ে আমি আরো তথ্য যুক্ত করতে পারবো। ভেবেছিলাম এটা হোক প্রথম চেষ্টা। আর প্রথম চেষ্টাতেই বুঝলাম বিজ্ঞান নিয়ে লেখা খুবই কঠিন। আমি বন্যাদির ঐ অধ্যায়ের লিংক পেয়েছিলাম, আরেকটা লেখার নিচে, কিন্তু ঐ পেইজটা ওপেন হয় না।
@সুম সায়েদ,
কোন লিঙ্কটা আপনি ওপেন করতে পারছেন না জানাবেন কি? এখান থেকে তো সব কিছুই ঠিকমত ওপেন হচ্ছে।
@অভিজিৎ দা,
আমি বিবর্তন আর্কাইভে গেলে বামে যে বই এর লিস্ট আছে, তার মধ্যে বিবর্তনের পথ ধরে আর মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে এই দুটিতে ক্লিক করলে This webpage is not available দেখায়। আর http://mukto-mona.com/evolution/QA/evolution_species.htm লিংকে গেলে একদম নিচে চোখের সামনে ঘটছে বিবর্তন- এর লিংক এও যায় না। আমি বাংলাদেশ থেকে গতকাল থেকে চেষ্টা করছি।
@সুম সায়েদ,
আমার এখান থেকে ঠিকমতোই ওপেন করা যাচ্ছে সবকিছু।
আপনি মুক্তমনা ডট কম এর লিঙ্ক কাজ না করে কম-এর জায়গায় ডট নেট (.net) টাইপ করে দেখতে পারেন। লিঙ্ক চলে আসার কথা।
অর্থাৎ,
http://www.mukto-mona.com/Articles/bonna/book/index.htm এই লিঙ্ক কাজ না করলে
http://mukto-mona.net/Articles/bonna/book/index.htm ট্রাই করুন।
চোখের সামনে ঘটছে বিবর্তনটাও সরাসরি মুক্তমনা ডট নেট সাইট থেকে দেখুন, এখানে।
ঠিক মত কাজ করছে কিনা দেখে জানান।
আরেকটা ব্যাপার, আপনার ইমেইল চেক করুন। ভবিষ্যতে লগইন করে মন্তব্য করতে পারেন। তাহলে এপ্রুভালের ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকবেন। 🙂
@অভিজিৎ দা,
নতুন লিংক ঠিক মত কাজ করছে। ইউজার আইডি পেয়েছি। একটিভ করে নিলাম। ধন্যবাদ। 🙂
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। (D)
মুক্তমনায় স্বাগতম,লেখালেখি চালিয়ে যান (Y) ।
আপনাকে মুক্ত-মনায় স্বাগতম। (F) (F)
পড়ছিলাম গতরাতেই,দারুন লেগেছে, ভাষাটা ছিল ঝরঝরে। মুক্তমনায় স্বাগতম। (F)
চমৎকার লেখা।
@এ.প্রামানিক,
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। 🙂
বাহ! চমৎকার!!
@ফরিদ আহমেদ,
ধন্যবাদ।