লিখেছেন: কালযাত্রী
সঠিক ইতিহাস জানা সবারই প্রয়োজন, যে যাই মতাদর্শের অনুসারী হন না কেন। বাংলাদেশে রাজনীতির ক্রম ইসলামায়ন বা ইসলামীকরণ নিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণা বা কনভেনশনাল উইজডম আছে, যেমন যে কোন ইসলামী পদক্ষেপকে পাকি-জামাতি পদক্ষেপ হিসেবে লেবেল দেওয়া। অথচ বাস্তব হল জামাত পাকিস্তানে কখনো ক্ষমতায় আসেনি, জনপ্রিয়ও ছিল না (পাকিস্তানে জামাতের ভোট বাংলাদেশে জামাতের ভোটের চেয়েও কম, এবং সব পাক সরকারই জামাত বিরোধী ছিল (পাক সামরিক বাহিনী জামাতকে ১৯৭১ সালে ব্যবহার করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবান/আল-কায়েদা কে ব্যবহার করেছিল আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েটদের তাড়াতে আশির দশকে) এবং একাধিকবার জামাত নেতা মওদুদীকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। এরকম আরো কিছু প্রচলিত ধারণার ত্রুটি ও বাংলাদেশে রাজনীতির ক্রম ইসলামীকরণের প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে এই লেখা। যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতি পাকিস্তানের উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত এবং যে কোন ইসলামী পদক্ষেপের মূল কারণ হিসেবে পাকিস্তানের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করা হয় তাই এই ইতিহাসে পাকিস্তানের ইসলামীকরণের ইতিহাসও আলোচনা করা দরকার। যে বিষয় সমূহে প্রচলিত ভুলধারণা বিদ্যমান এবং যেগুলি আলোচনার বিষয়বস্তু হবে সেগুলো হলঃ
১। জিন্নাহ ও তাঁর সৃষ্ট পাকিস্তানের ভিত্তিতে ইসলামের কথিত ভূমিকা।
২। পাকি-জামাতি ফ্যাক্টর।
৩। পাকিস্তানে ইসলামীকরণে কার কি ভূমিকা ছিল (ও শুধু সেনাবাহিনীরাই জড়িত এই মিথ খন্ডন)
৪। বাংলাদেশের ইসলামীকরণে মুজিব, মোশতাক সরকার (ক্ষণস্থায়ী কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ), জেনারেল জিয়া ও এরশাদের ভূমিকা।
৫। বাংলাদেশের ইসলামীকরণে খালেদা জিয়া ও হাসিনার অবদান।
উপরের বিষয়গুলির বিস্তারিত আলোচনায় যাবার আগে কিছু সাধারণ আলোচনায় আসি। ইসলামীকরণের উৎস কোথায় যদি জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে প্রথমেই বলতে হয় ইসলাম ধর্মেই এর বীজ। ইসলামের কোর বা মর্মবাণী হল ব্যক্তি, সমাজ তথা রাষ্ট্র কে ইসলামের বিধানের আওয়তায় আনা। আমরা অসংখ্যবার শুনি ইসলাম শুধু ধর্মই নয়, এটা ব্যক্তির জীবন ও রাষ্ট্রের সার্বিক সূত্র। মুসলীম প্রধান দেশকে ১০০% ধর্মনিরপেক্ষ করতে হলে বল বা চাপের প্রয়োজন (আক্ষরিক অর্থে নয়)। একটা স্প্রিংকে স্বাভাবিক ভাবে ছেড়ে দিলে তার নিজস্ব স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যে স্থিতিশিল থাকে। অন্য কোন দৈর্ঘ্যে স্থিতিশিল রাখতে হলে তাকে চাপ দিয়ে বা টান দিয়ে রাখতে হবে, চাপ বা টান শিথিল করলেই তা আবার তার স্বাভাবিক দৈর্ঘ্যে ফিরে যাবে। মুসলীম দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাটা অনেকটা সেরকম। বল প্রয়োগ (যেমন কমিউনিস্ট বিপ্লব বা কোন রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে শক্তিশালী ধর্মনিরপেক্ষ নেতার উদয়) ছাড়া ১০০% ধর্মনিরপেক্ষ করা যায়না স্থায়ীভাবে। স্বাভাবিক বা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কোন মুসলীম প্রধান দেশে পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে জানা নেই। তুরস্কে কামাল পাশার শক্তিশালী বল প্রয়োগে ধর্মনিরপেক্ষতা কায়েম হয়েছিল। টিউনিসিয়ায় হাবিব বরগুইবার দ্বারা হয়েছিল একইভাবে। আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট নাজিবুল্লাহর সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতা অনেকদূর এগিয়েছিল। ইরাকে সাদ্দামের লৌহ শাসনে ধর্মনিরপেক্ষতা কায়েম হয়েছিল। সিরিয়াতে হাফেজের কড়া শাসনে ধর্মনিরপেক্ষতা (যদিও ১০০% নয়) এসেছিল। আজ এই সব দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা শিথিল হয়ে আসছে (ইরাকে ও আফগানিস্তানে প্রায় সম্পূর্ণ বিদায় নিয়েছে)।
তবে পাকিস্তান বা বাংলাদেশে যেখানে সীমিত মাত্রায় কাজ চলার মত ধর্মনিরপেক্ষতা স্বাভাবিকভাবে পাওয়া সম্ভব এবং ছিল, সেখানে দুষ্ট নেতার হস্তক্ষেপে সেটুকুও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে এবং হয়েছেও অনেকটা, যেমন জিয়াউল হক বা এরশাদ। একজন বিদায় নিয়েছেন, আরেকজন এখনো ক্ষমতায় আসলে শারিয়া আইন চালু করবেন বলে হুমকি (নাকি আশ্বাস?) দিচ্ছেন। যদি পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ইসলামীকরণের মূল হোতা কে জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে নির্দ্বিধায় উত্তর দেয়া যায় পাকিস্তানে জেনারেল জিয়াউল হক (১৯৭৭-৮৮) ও বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদ (১৯৮২-৯০)। রাজনৈতিক আকাশে এই দুই অশুভ আত্মার উদয় না ঘটলে আজ আমরা এক ভিন্ন বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দেখতাম। ইসলামকে সব দল ও সরকারই কম বেশি ব্যবহার করেছে ক্ষমতায় যাওয়ার ও টিকে থাকার জন্য (পাকিস্তানে হোক বা বাংলাদেশেই হোক)। তার মানে ইসলামকে ব্যবহার করলে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। বাজারে যেটা চলে তার পসরা সাজিয়েই তো বিক্রেতারা ক্রেতাকে আকর্ষণ করবে। এর থেকে যে অস্বস্তিকর ও অপ্রিয় সত্যটা (আমাদের মত যারা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের স্বপ্ন দেখি তাদের জন্য) বের হয়ে আসে সেটা হল অধিকাংশ সাধারণ মানুষ ইসলাম প্রিয়, তারা গণতান্ত্রিকভাবে ইসলামের প্রতিফলন দেখতে চায় সমাজে ও রাষ্ট্রে, কিন্তু এই প্রতিফলনের কাজটা তারা মোল্লা মওলানাদের দ্বারা গঠিত কোন ধর্মীয় দলের দ্বারা হোক সেটা চায় না, তারা চায় মূল ধারার মুসলিমদের (অর্থাৎ মওলানা/মৌলভী নয় কিন্তু নামাজ, রোজা, কুরাণ ও হাদীসে বিশ্বাসী এমন মুসলীম) দ্বারা গঠিত (সেটা বিএনপি হোক, বা আওয়ামী লীগ হোক,বা যে কোন দলই হোক) দলের দ্বারা হোক। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জেপি, সব দলই জনগণের এই সাইকীটা বোঝে, আর এই দলগুলির সবাই মুল ধারার মুসলমানদের নিয়ে গঠিত (কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে, যেমন হিন্দু সদস্য, নগন্য সংখ্যক নাস্তিক সদস্য)। রাজনীতির ইসলামীকরণ তাদের ব্যক্তিগত আদর্শ বা জীবনপদ্ধতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। আর তাই তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, কে বেশি ইসলামী ভাবধারার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। এর অধুনাতন উদাহরণ হল আওয়ামীপসন্দ্ বিচারকদের মুসলীম অনুভূতিকে আঘাত করা বেআইনী বলে রায় দেয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ব্লগের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু। আরেকটা কথা এখন সবার কাছে পরিস্কার হওয়া উচিত যে রাজনীতিতে আদর্শ বা নীতির স্থান গৌণ। এটা সব দলের জন্য প্রযোজ্য। নীতির ব্যাপারে কেউই ধোয়া তুলসীপাতা নয়। রাজনীতিতে বাংলাদেশে অন্তত এটা সত্য যে রাজনীতিতে খারাপ কাজ করতে যেমন ছলাকৌশলের আশ্রয় নিতে হয় আবার ভাল কাজ করতেও। কে জানি বলেছিলেন ইতিহাস সরল রেখায় চলে না । ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বিভিন্ন দল ও নেতা সুবিধার জন্য তাদের অবস্থান একাধিকবার পরিবর্তন করেছে (সরল রেখা থেকে বিচ্যুতি)। তাই বোধ হয় ২০০৬ এর ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের সাথে খেলাফাত মজলিশের আঁতাতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছিলেন “রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই”।
আরেকটা ব্যাপারে কিছু বলা প্রয়োজন। সেটা হল ইসলামায়নকারী/ইসলামীকারক (Islamizer) এর প্রকারভেদ (মূল ধারার রাজনৈতিক দলের নেতাদের কথা হচ্ছে)। এক প্রকার হল গররাজী বা নিমরাজী ইসলামায়নকারী(Reluctant Islamizer),আরেক প্রকার হল সুবিধাবাদী ইসলামায়ক (Opportunistic Islamizer), আর হল উৎসাহী ইসলামায়নকারী (Enthusiastic Islamizer). যারা আসলে ধর্মীয় রাজনীতি বা দর্শনে বিশ্বাসী না, কিন্তু চাপে পড়ে(ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বা বহিঃ সাহায্যের প্রয়োজনে) কখনো কখনো ন্যূনতম ইসলামায়ন করতে বাধ্য হন তাদের গররাজী(বা নিমরাজী) ইসলামায়নকারী বলা যায়। আর যারা ধর্মীয় রাজনীতির দর্শনে বা মতাদর্শে বিশ্বাসী/অবিশ্বাসী কোনটাই নয়, সুবিধা অনুযায়ী যে কোন ইসলামী পদক্ষেপ নিতে কুন্ঠিত বোধ করেনা, তাদের সুবিধাবাদী ইসলামায়নকারী বলা যায়। আরেক প্রকার ইসলামায়নকারী হল যারা অন্তরে ইসলামী জোশ পোষণ করে এবং স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে (চাপে না পড়েও), ইসলামীকরণে প্রবৃত্ত হন। এরা হল উৎসাহী ইসলামায়নকারী। তাদের এক ঢিলে দুই পাখী মারা হয়, কারণ ফায়দাও লূটা হয় আবার নিজের মতাদর্শের বাস্তবায়নও হয়। একজন ১০০% উৎসাহী ইসলামায়নকারীর বক্তব্য ও কাজকর্ম ধর্মীয় দলের ম্যানিফেস্টোর থেকে ভিন্ন নয়। উৎসাহী ইসলামায়নকারী ধাপে ধাপে ইসলামীকরণের দিকে এগোয়, ধর্মীয় পোশাক না পরেও। কে কোন প্রকারের সেটা আলোচনার মাধ্যমেই জানা যাবে। তবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে উৎসাহী ইসলামায়নকারীর দুই প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন পাকিস্তানের জেনারেল জিয়াউল হক ও বাংলাদেশের জেনারেল এরশাদ। আরো বিস্তারিত পরে।
রাজনৈতিক নেতাদের শুধু কর্মই নয়, তাঁদের উক্তিসমূহ ও গুরুত্ব বহন করে, কারণ তাঁদের উক্তি দেশের সমগ্র জনগণ শোনে, ও মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় এবং তার ভিত্তিতেই তাদেরকে নির্বাচন করা হয়, বিচার করা হয় আর জনগণও তার দ্বারা প্রভাবিত বা অণুপ্রাণিত হয়। তাই এই আলোচনয়ায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নেতারা কি বলেছেন সেগুলো বিশেষভাবে স্থান পাবে। এবার আসি উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলির বিস্তারিত আলোচনায়।
এই পর্বে ১-৩ বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হবে। ৪-৫ দ্বিতীয় পর্বে আলোচিত হবে
১। জিন্নাহ ও পাকিস্তান
প্রচলিত বিজ্ঞতা বলে জিন্নাহ এক ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি এবং ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তাঁর পাকিস্তান সৃষ্টি। বাস্তব বা ইতিহাস তার উল্টোটাই সাক্ষ্য দেয়। এই প্রচলিত মিথকে ভাঙ্গার জন্যে যে তিনটি পান্ডিত্যপূর্ণ বই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে সেগুলো হল,
১। “Secular and Nationalist Jinnah” – Dr. Ajeet Jawed
(রিভিঊ এর লিঙ্কঃ http://www.saglobalaffairs.com/book-reviews/413-the-real-mr-jinnah.pdf )
২। “Jinnah, – Partition and Independence” – Jaswant Singh
(রিভিঊ এর লিঙ্কঃ http://www.ishtiaqahmad.com/item_display.aspx?listing_id=607&listing_type=1 )
৩। “The sole spokesman” – Ayesha Jalal
(রিভিউঃ http://www.anusha.com/ayesha.htm )
তিনি উর্দু (জিন্নাহর মাতৃভাষা উর্দু ছিল না, গুজরাটী ছিল) কে বাঙ্গালীদের উপর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে ঘৃণ্য কাজ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু সেটা অবান্তর এখানে। তবু উল্লেখ করলাম পাছে কেউ এই প্রসংগ তোলেন, কারণ কেউ কেউ অপ্রাসংগিকভাবে এইসব কথা তুলে আলোচনাকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে।
ইসলামী দেশ প্রতিষ্ঠা যার লক্ষ্য এবং যে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাস করে ব্যক্তিগত জীবনেও তার ইসলামী আদর্শ দৃশ্যমান হয়ার কথা। কিন্তু জিন্নাহর ব্যক্তিগত জীবনের নীচের বিবরণ তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়ঃ
(দ্রঃ http://www.bitsonline.net/eqbal/articles_by_eqbal_view_7667D80E.htm )
His aristocratic English lifestyle, Victorian manners, and secular outlook rendered him a most unlikely leader of India’s Muslims.
He was the prototypical westernized Indian, tutored at Lincoln’s Inn, tailored at Saville Row, in his youth a Shakepearian actor, a constitutionalist barrister in the Anglo-Saxon tradition, married to a Parsi woman. More at home in English than his native Gujrati, Jinnah spoke little Urdu which he would later designate as Pakistan’s official language, knew neither Persian nor Arabic, and had only the rudimentary knowledge of Islam which is common to western educated Muslims. He was anathema to an overwhelming majority of the Ulema of the subcontinent, including so grand a figure as Maulana Husain Ahmed Madani and such ideologue as Abul Ala Maudoodi.
ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না তার আরেক প্রমাণ এই উদ্ধৃতি থেকেঃ
(জাভেদ এর বই থেকে উদ্ধৃত, রিভিউ দ্রঃ)
“Jinnah, who ate pork, drank whisky, seldom entered a mosque, was ignorant of Islamic teachings, did not observe Islamic rituals, could not speak Urdu, wore high-class western suits and had come from Hindu Bhatia family…”
তিনি খেলফাত আন্দোলনের সমালোচনা করেছিলেন কারণ তাঁর মতে খেলাফাত আন্দোলন ছিল ধর্মান্ধতা। গান্ধী খেলফাত আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিলেন, যার জন্য জিন্নাহ গান্ধীর সমালোচনা করেছিলেন। (জালাল-পৃঃ৮)
গান্ধী বলতেন তিনি হিন্দু, সেহেতু তিনি সত্যিকার ভারতীয়। জিন্নাহ বলতেন, তিনি আগে একজন ভারতীয়, তারপর মুসলীম (জাভেদ এর বই এর “differences and disagreements” অধ্যায় থেকে উদ্ধৃত)
সরোজিনী নাইডু জিন্নাহর বিভিন্ন বক্তৃতা সংকলন করে একটি বই লিখেছিলেন। সেই বই থেকে কিছু উদ্ধৃতিঃ
(দ্রঃ http://m-a-jinnah.blogspot.com/2011/01/jinnah-hindu-muslim-unity.html )
১। Gopal Krishna Gokhale expressed the view that Jinnah “has true stuff in him and that freedom from all sectarian prejudice which will make him the best ambassador of Hindu-Muslim unity.
২। Jinnah stood “approved and confirmed by his countrymen not merely as an ambassador, but as an embodied symbol of Hindu-Muslim unity.
আয়েশা জালাল ও তাঁর বইতে এক জায়গায় লিখেছেন জিন্নাহ আসলে পৃথক মুসলীম রাষ্ট্র চানই নি, ঘটনাকচক্রেই তাঁর পাকিস্তানের জনক হয়ে যাওয়া। (রিভিউ তে দ্রঃ)
জিন্নাহ ১৯৪০ এর আগে অখন্ড ভারতেই বিশ্বাস করতেন, এবং হিন্দু-মুসলীম ঐক্যের জন্য প্রায় দুই দশক চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন শুধু ভারতের পশ্চাদপদ মুসলীম জনগণ যাতে স্বাধীন ভারতে যথাযথ প্রতিনিধিত্ব প্রায় সেটাই তিনি চেয়েছিলেন। এর জন্য তিনি নেহরুকে অনেকবার মুসলীমদের সঙ্খ্যা অনুপাতে কংগ্রেসে তাদের জন্য পৃথক ইলেক্টরেটের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। নেহেরু, গান্ধী ও সরদার প্যাটেল এর ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। শেষে গান্ধী ও সরদার প্যাটেলএর অনমনীয়তার জন্য জিন্নাহ কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের মধ্যে আপোষ করাতে না পেরে ১৯৪০ সালের ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাব কে সমর্থন দিলেন, যার পরিণতিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপরও তিনি ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান এ রাজী হলেন, যে প্ল্যানে অখন্ড ভারত অখন্ডই থাকবে, কিন্তু মুসলিম ও হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে দুটি ফেডারেশন হবে, শুধু পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। কিন্তু কংগ্রেস(বিশেষ করে প্যাটেল ) এটা মানল না। তারপরই তাঁর “ডাইরেক্ট একশান ডে” পালনের আহবান জানান। জিন্নাহ ক্ষেদ করে বলেছিলেন “”Look here, I never wanted this damned partition. It was forced upon me by Sardar Patel…” (জাভেদ এর বই থেকে উদ্ধৃত)।
কেউ কেউ ১৯৪৬ এর কোলকাতা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য জিন্নাহকে দায়ী করেন। সঠিক বিচারে এটাও ভুল। জিন্নাহ শান্তিপূর্ণভাবে ভারতব্যাপী “ডাইরেক্ট একশান ডে” পালনের জন্য আহবান জানিয়েছিলেন (দ্রঃ http://www.massviolence.org/The-Calcutta-Riots-of-1946 ) কিন্তু বাংলায় মুসলিম লীগের প্রধান ছিলেন সুহরাওয়ার্দী, যিনি কোলকাতার “ডাইরেক্ট একশান ডে” পালনের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মুসলীম লীগের প্রধান পদের জন্য জিন্নাহর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। কোলকাতার হিন্দু মুসলীম দাঙ্গার জন্য তিনি যে দায়ী এটা মোটামুটি অনেকে ঐক্যমত। এর সবচেয়ে বড় প্রমান বোধ হয় নীচের তথ্যঃ
১৯৮৩ সালে গান্ধীর এক সময়কার সহচর বৃটিশ কুয়েকার হোরেস আলেকজান্ডার গান্ধীর গুনগান গেয়ে “A miracle in Calcutta” নামে একটি স্মৃতিকথা লেখেন (যার কপি পাওয়া যাবে http://www.prospectmagazine.co.uk/2007/08/amiracleincalcutta/ ) তিনি লিখেছেন দাঙ্গার পরে যখন গান্ধী আর সুহরাওয়ার্দী মিলিত হলেন তখন এক উত্তেজিত হিন্দু সুহরাওয়ার্দী কে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি গতবছরের কোলকাতার ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়িত্ব স্বীকার করেন?” উত্তরে সুহরাওয়ার্দী বললেন “হ্যাঁ, আমি এর দায়িত্ব স্বীকার করছি এবং এর জন্য আমি লজ্জিত”
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা বলেই তাঁকে ধর্মান্ধ বা ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী বলা ভুল হবে। তাহলে সুহরাওয়ারদী (এবং মুজিব) কেও একই বিচারে ধর্মান্ধ বা ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী বলে স্বীকার করতে হবে, কারণ পাকিস্তান আন্দোলনে তাঁরা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় জিন্নাহর ভূমিকা একটি শৃংখলের সর্বশেষ গ্রন্থি, কিন্তু একমাত্র নয়। এটা পরিহাসের বিষয় যে প্রাক্তন পশ্চিম পাকিস্তানের যে চারটি প্রদেশ নিয়ে পরে পাকিস্তান গঠিত তার কোনটাতেই মুসলীম লীগ নির্বাচিত হতে পারে নি ১৯৪৬ এ। কেবল বাংলাতেই মুসলীম লীগ সরকার (সুহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে) নির্বাচিত হয়েছিল। তাছাড়া ভারতের উত্তর প্রদেশের মুসলমানেরাও পাকিস্তান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কাজেই পাকিস্তান সৃষ্টিতে পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) এর চেয়ে বাংলাদেশের ও ভারতের মুসলমানদের ভূমিকাই মুখ্য ছিল।
জিন্নাহর পাকিস্তান সৃষ্টির লক্ষ্য শরীয়া আইন শাসিত কোন ধর্মতন্ত্র চালু করা ছিলনা। লক্ষ্য ছিল একটা মুসলীম প্রদান দেশ সৃষ্টি করা কারণ স্বাধীন ভারতে সংখ্যালঘু মুসলীমরা বৈষম্যের শিকার হবে ও সব কিছুতে পিছিয়ে থাকবে বলে তাঁর বিশ্বাস ছিল। তাঁর লক্ষ্য ছিল মুসলীম প্রধান ধর্মনিরপেক্ষ দেশ সৃষ্টি করা যেখানে পেছনে থাকা ভারতের মুসলীমেরা শিক্ষা সংস্কৃতিতে এগিয়ে যাবে হিন্দু আধিপত্যের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে। পাকিস্তানে হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মালম্বীদের তিনি একই রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বা অধিকারের দেয়ার কথা বলেছিলেন। রতনে রতন চেনে। যদি সত্যিই জিন্নাহ ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী হতেন ও পাকিস্তানকে ইসলামী দেশ হিসেবে গড়তে চাইতেন তাহলে মওদুদীর মত ইসলামপন্থীর রোষাণলে পড়তেন না আর মওদুদীও পাকিস্তানের বিরোধিতা করতেন না, মওদুদীর সর্বাত্মক সমর্থনই পেতেন।
পাকিস্তান স্বাধীন হবার কয়েকদিন আগে ১১ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের গঠন পরিষদে দেয়া বক্তৃতায় জিন্নাহ বলেছিলেনঃ
“Now I think we should keep that in front of us as our ideal and you will find that in course of time Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims, not in the religious sense, because that is the personal faith of each individual, but in the political sense as citizens of the State. ”
(http://www.columbia.edu/itc/mealac/pritchett/00islamlinks/txt_jinnah_assembly_1947.html )
এর চেয়ে পরিস্কার ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ইঙ্গিত আর কি হতে পারে।
অনেকের মতে পাকিস্তান সৃষ্টির মূল কারন হল ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আর এই দাঙ্গার মূল দায়িত্ব সুহরাওয়ারদীর। তিনি বা মুজিব এর এই দাঙ্গার নিন্দাও করেন নি বা থামাতেও চেষ্টা করেন নি তখন। ডাইরেক্ট ডে তে হিন্দুদের আক্রমণের তিনদিন পর হিন্দু ও শিখেরা যখন পালটা আক্রমণ শুরু করে তখন মুসলীমদের রক্ষা করার জন্য সুহরাওয়ারদী (এবং মুজিব) কোলকাতার রাস্তায় টহল দেয়া শুরু করেন। ১৪ই মার্চ ১৯৭০ এ সাংবাদিক মুস্তাফা মালিকের সাথে এক সাক্ষাৎকারে মুজিব বলেন “বাংলায় মুসলীম লীগের বিজয় [১৯৪৬ এর নির্বাচনে] আর কোলকাতার দাঙ্গা না ঘটলে পাকিস্তান একটা স্বপ্নই থেকে যেত” (Without the victory of the Bengal Muslim League [in the 1946 elections] and the Calcutta riots, Pakistan would have remained a dream.”)
(দ্রঃ http://www.mepc.org/journal/middle-east-policy-archives/pakistan-can-us-policy-save-day )
তবে এটাও বলা দরকার যে জিন্নাহ কোলকাতা দাঙ্গার প্রত্যক্ষ প্ররোচক না হলেও তিনি যে এর সুস্পষ্ট নিন্দা করেছিলেন তারও কোন সাক্ষ্য নেই (হিন্দু নিধনই হোক বা পরবর্তী মুসলীম নিধনই হোক)। এখানেই তাঁর নেতৃসুলভ মাহাত্ম্যের অভাব প্রমাণ করে। তিনি এলিট নেতা ছিলেন, রাস্তার ঘটনায় জড়িত হতে তাঁর কোন উৎসাহ ছিল না, যেটা গান্ধী ভাল করতে পারতেন। কিন্তু আমার লেখার উদ্দেশ্য তিনি যে ইসলামী ছিলেন সেই প্রচলিত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করা। উপরের মন্তব্য এ ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক নয়।
২। পাকি-জামাতি ফ্যাক্টরঃ
“পাকি-জামাতি” (অর্থাৎ পাকি=জামাতি) বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত এক বুলি। লেখার শুরুতেই এর মিথের ভুল নির্দেশ করে কিছু তথ্য উল্লেখ করেছি। আরো কিছু উল্লেখ করি। অনেকেই এটা হয়ত জানে না যে জামাত (তখন জামাতে হিন্দ) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ও জিন্নাহর ঘোর বিরোধী ছিল। পাকিস্তান, জিন্নাহ ও মুসলীম লীগ সম্পর্কে জামাত নেতা মওদুদী তখন কি বলেছিলেন দেখা যাকঃ
(দ্রঃ http://www.spittoon.org/archives/6885 )
“The establishment and birth of Pakistan is equivalent to the birth of a beast.”
(পাকিস্তানের জন্ম একটী পশুর জন্মের সমতুল্য)
“Muhammad Ali Jinnah’s place is not on the throne of leadership. He deserves to face trial as a traitor.”
(জিন্নাহ নেতৃত্বের সিংহাসনে স্থান পেতে পারেনা। বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাঁর বিচার হওয়া উচিত)
“It is haraam to vote for the Muslim League.” (মুসলীম লীগকে ভোট দেয়া হারাম)
“Pakistan is a fool’s paradise and an infidel state of Muslims.”
(পাকিস্তান একটা বোকার স্বর্গ আর কাফির মুসলীমদের দেশ)
“The Muslim League is an unrighteous and immoral party that has made our collective environment filthier than the lavatory.”
(মুসলীম লীগ একটি অনৈতিক দল যা আমদের সমষ্টিগত পরিবেশকে শৌচাগার থেকেও বেশী নোংরা করেছে)
তিনি ইসলামী পাকিস্তানের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ পাকিস্তান চাওয়ার জন্য মুসলীম লীগের নেতাদের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মওদুদী পাকিস্তানে চলে যান, ও পাকিস্তানকে ইসলামীকরণের জোর চেষ্টা চালিয়ে যান। তিনি শরিয়া আইন চালু করার জন্য আন্দোলনে নামেন এবং পাকিস্তান সরকার এ জন্য তাকে ১৯৪৮ এর অক্টোবরে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায় ও শরীয়ার দাবীতে সোচ্চার জামাতের মুখপাত্র “কাওসার”, “জাহানে নাও” এবং “তাসনীম” নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
তাঁকে জেলের মেয়াদ চার মাস করে বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল। চতুর্থবার মেয়াদ বাড়াবার সময়ে কাকতালীয়ভাবে মুলতান জেলে বামপন্থী এক বন্দী তার নিজের ব্যাপারে চতুর্থবার মেয়াদ বাড়াবার বিরুদ্ধে কোর্টে এক রীট আবেদন করে। কোর্ট তার পক্ষে রায় দিয়ে চতুর্থবার মেয়াদ বাড়ানো বেয়াইনী ঘোষণা করে। মওদুদী আইনতই এর বেনেফিসিয়ারী হয়ে জেল থেকে মুক্ত হন ১৯৫০ এ, কুড়ি মাস পরে।
(দ্রঃ http://www.facebook.com/pages/IMAM-MAUDUDI/111287245570400?v=info )
বলা যায় এক বামপন্থী বন্দীর রীটের বদৌলতে মওদুদী ছাড়া পান। তা না হলে আরো কতদিন জেলে থাকতেন কে জানে। একজন ইসলামিস্টের চেয়ে একজন বামপন্থীই পাক সরকারের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল!
এরপর মওদুদী ১৯৫৩ সালে আহমেদিয়াদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে ও লাহোরে আহমেদিয়া বিরোধী দাঙ্গা বাধালে এক সামরিক কোর্ট (তখন বেসামরিক সরকার ছিল) মওদুদীকে এই দাঙ্গা ঘটানোর ও কাদিয়ানী বিরোধী বই “কাদিয়ানী প্রশ্ন” লেখার অপরাধে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে। কোর্ট মওদুদীর আত্মপক্ষ সমর্থনের সব যুক্তিই প্রত্যাখ্যান করে। এই মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের চেয়ে বহির্বিশ্বেই বেশি হৈ চৈ শূরু হয়।, বিশেষ করে মুসলীম দেশ সমূহ থেকে। ইন্দোনেশিয়ার ৬০ টি ইসলামী দলের এক মোর্চা ঘোষণা দেয় যে “পাকিস্তান মওদুদীকে না চাইলেও ইসলামী বিশ্ব মওদুদীকে চায়”। প্যালেস্টাইনের গ্র্যান্ড মুফতী মৃত্যদন্ডের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের কাছে আপত্তি জানান। সমগ্র বিশ্বে এই মৃত্যুদন্ড বহুল প্রচার লাভ করে আর প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিশেষ করে মুসলীম বিশ্বে। একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়ে পাকিস্তান সরকার অবশেষে মওদুদীর মৃত্যুদন্ড রহিত করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়। পরে হাই কোর্ট এর এক রুলিংএ তিনি মুক্তি পান তিন বছর পরে।
জেলে থেকে মুক্তি পেয়ে মওদুদী আবার পাক সরকারে বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যান। তিনি পাকিস্তানের জন্য যাকে ইংরেজীতে বলে “Pain in the ass” হয়ে দাঁড়ান। শেষে এই ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে ১৯৫৬ সালের ২৩ শে মার্চ প্রধান মন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের নাম “ঈসলামী প্রজাতন্ত্র” করে নতুন সংবিধান রচনা করেন। স্মরণ করিয়ে দেই চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর সরকার বেসামরিক সরকার ছিল, সামরিক নয়।
এরপর ঘটনা নাটকীয় মোড় নিল। অক্টোবর ১৯৫৮ সেনাবাহিনীপ্রধান আইয়ুব খান ক্ষমতা নিয়ে সংবিধান বাতিল ঘোষণা করলেন এবং পরে ১৯৬২ সালে নতুন সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানের নাম থেকে “ইসলামী” বাদ দিলেন। কিন্তু জাতীয় পরিষদের অনেক সাংসদরা (স্বভাবতই বেসামরিক লোক) ইসলাম বাদ দেয়ার বিপক্ষে আপত্তি তোলেন ও সে কারণে আইয়ুব বাধ্য হন নামে “ইসলামিক” বহাল রাখতে। তাহলে ঘটনাটা দাঁড়ালা বেসামরিক নেতা/সরকার “ইসলামিক প্রজাতন্ত্র” ঘোষণা দিল (১৯৫৬,মওদুদীর চাপে), সামরিক নেতা “ইসলামিক” বাদ দিলেন (১৯৬২) আবার “বেসামরিক” নেতাদের চাপে সামরিক নেতা “ইসলামিক” ফিরিয়ে আনলেন। কোন সামরিক নেতা পাকিস্তানকে “ইসলামিক” দেশ নামকরণ করেননি প্রথম।
ক্ষমতায় এসে আইয়ুব ইসলামের দৃষ্টিতে অনৈতিক কিছু কাজে হাত দেন। যেমন পরিবার পরিকল্পনা (জন্ম নিয়ন্ত্রণ), মুসলীম নারীদের বিষয়ে পারিবারিক আইন সংস্কার। মওদুদী এর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন এবং একটা বই লিখেছিলেন “জন্ম নিয়ন্ত্রণ” নামে যা আইয়ুব খান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
অক্টোবর ১৯৬৩ আইয়ুব খান সামরিক আইন তুলে নিলে জামাত ২৫ শে অক্টোবর তাদের প্রথম জনসভার আয়োজন করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু আইয়ুব সরকার জামাতকে লাউড স্পীকার ব্যবহার করতে অনুমতি দিলেন না, জমসভায় আইয়ুব সমর্থিত লোকজন ছোরা ও পিস্তল নিয়ে আক্রমণ চালায় ও সভা পণ্ড করে দেয়।
এর পর রেডিওতে আইয়ুব সরকার জামাত বিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকেন এবং জানুয়ারী ৬, ১৯৬৪ তে জামাতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। মওদুদীসহ ৬৫ জন জামাত নেতাকে আটক করে জেলে পাঠান। পরে সুপ্রীম কোর্ট জামাতকে নিষিদ্ধ করা অবৈধ ঘোষণা করলে তিনি ছাড়া পান।
মওদুদীকে আবার দুই মাসের জন্য গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৬৭ তে ইদের চাঁদ দেখার ব্যাপারে সরকারের সাথে একমত না হওয়াতে।
আইয়ুবের পতনের পর মওদুদী ১৯৭০ এর নির্বাচনী প্রচারণার সময় ভুট্টোর পিপিপি পার্টির বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করতে লাগলেন পিপিপির সমাজতান্ত্রিক ও ইসলাম বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে। ইয়াহিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ই শুধু বাংলাদেশের জামাতকে বাংলাদেশে নিয়োজিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ব্যবহার করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। কিন্তূ এটা একটা সুবিধাবাদী পদক্ষেপ ছিল, যেমন মার্কিনীদের তালেবানদের সুবিধাবাদী ব্যবহার। অবশ্য জামাতকে এভাবে প্রাধান্য দেয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং তাদের এক প্রতিনিধিদল নিয়াজীর কাছে এসে নিয়াজী শুধু জামাতকে দিয়ে রাজাকার বাহিনী গড়ছেন বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে। তখন নিয়াজী নির্দেশ দিলেন রাজাকার এর জায়গায় আল-বদর, আল-শামস বলতে”। (সূত্রঃ Witness to Surrender – Siddique Salik, p-105) উল্লেখ্য যে আল-বদর, আল-শামস বিভিন্ন ইসলাম ও ডানপন্থী দল ও ধর্মীয়মনা নির্দলীয় লোকদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল।
ইয়াহিয়া আইয়ুবের চেয়ে আরও ইসলাম বিরোধী ছিলেন চিন্তা ধারায়। যে কোন পাক সরকার বা মিলিটারীর প্রথম প্রাইওরিটি ছিল পাকিস্তানকে অখন্ড রাখা, ইসলামের আদর্শের প্রচার বা সংরক্ষণ নয়।
৩। পাকিস্তানে ইসলামীকরণ (ও শুধু সেনাবাহিনীরাই জড়িত এই মিথ খন্ডন)
উপরে (২) এ আমরা দেখেছি ১৯৪৭-৫৬ পর্যন্ত ইসলামীকরণের কোন লক্ষনণই ছিলনা। জামাতের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ১৯৫৬ তে শুধু পাকিস্তানের নাম ইসলামী প্রজাতন্ত্র করেছিলেন (বলা যায় গররাজী ইসলামায়ন)। আর কোন ইসলামী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এটা পাকিস্তানের সমাজে বা জনজীবনের উপর কোন ইসলামী প্রভাব ফেলেনি। এটা ছিল প্রতীকী ব্যাপার। আইয়ুব আমলে ও কোন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামায়ন হয় নি। বরং আইয়ুব কিছুটা বিপরীত দিকে যাবার চেষ্টা করেছিলে, যার উদাহরণ (২) এ দিয়েছি। আইয়ুব আমলে তাঁর পশ্চিমা আধুনিকতা আর উদার দৃষ্টিভঙ্গীর ছাপ যে পাকিস্তানের জনজীবনেও পড়েছিল হুমায়ুন আজাদের বই “আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম” বইতেই তার সাক্ষ্য আছে,ষাটের দশকের তাঁর স্মৃতিচারণায়। তাঁর বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি (পৃঃ১৭)
“কলাভবন, শরিফ মিয়ার ক্যান্টিন, বিভিন্ন ছাত্রাবাস, নিউমার্কেটের নতুন ঝলমলে বইএর দোকান এবং আরও নানা জায়গা ছিলো আধুনিকতা সম্পর্কে তর্ক বিতর্ক আর অণুপ্রাণিত হওয়ার স্থান; তখন অনাধুনিকতা, মধ্যযুগীয়তা,বিসমিল্লা আলহামদুলিল্লাহ জোব্বা বোরকা ছিল হাস্যকর, হিজাবের কথা কেউ জানত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পরতো চমকপ্রদ ট্রাউজার, মেয়েরা ঠাশা এমন সব পোশাক, যা এখনকার উপাচার্যরা দেখলে হৃদরোগে ঢ’লে পড়বে, পুলিশ ও প্রক্টররা পাগলামো করবে, ১৯২১ সালে ফিরে যাবে, শুক্রবারে তালেবান ধার্মিকেরা লাঠি নিয়ে মিছিল করবে”
বস্তুত পূর্ব পাকিস্তানের অনেক ধর্মীয়ভাবাপন্ন মানুষও স্বাধীন বাংলাদেশ চাইত, কারণ পাকিস্তানকে তারা পশ্চিমা মানসিকতার (বা ইংরেজদের অনুকরণকারী) ও আধুনিকতায় বিশ্বাসী এক দেশ হিসেবে দেখত, শুধু ভারত বিরোধীতেই তারা সন্তূষ্ট ছিল না। সাধারণ দরিদ্র বা গ্রামে গঞ্জের মানুষ পাকিস্তানকে এক ইসলামী দেশ হিসেবে দেখত না, দেখত বাঙ্গালীদের শোষণকারী পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে দূষিত এক দেশ হিসাবে। দীর্ঘকায়, ফর্সা বিদেশী সদৃশ স্যুট টাই পরিহিত ইংরেজীতে ভাষন্দানকারী আইয়ুবের চেয়ে ইসলামী পোশাক সদৃশ মুজিব কোট পাজামা পরিহিত আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা মুজিব তাদের হৃদয়ের অনেক কাছে মনে হত। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে মুজিবের মত একজন বাঙ্গালী মুসলীম নেতার অধীনে ইসলাম বান্ধব পশ্চিমা ভাবধারা মুক্ত এক দেশ হবে এটা তাদের আশা ছিল (সাধারণ মানুষের কথা বলছি, বুদ্ধিজীবীদের নয়)। এ জন্য কিছু ধর্মীয় নেতারাও (জামাত বহির্ভূত) আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিল ও সদস্য ছিল।
এরপর ইয়াহিয়া (১৯৬৯-৭১) এ আসার পরও তেমন কোন ইসলামী পদক্ষেপ নেননি। তাহলে দেখা যাচ্ছে অখন্ড পাকিস্তানে (যা ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়) কার্যত কোন বড় ধরণের ইসলামায়ন হয় নি । শুধু তাই নয়, পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবার পরও ১৯৭৭ পর্যন্ত ভুট্টোর পিপিপি দল পাকিস্তানে ক্ষমতায় ছিল, যার মূল দর্শন ছিল সামাজিক গণতন্ত্র (ইসলামায়ন নয়)। ভুট্টো ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড ও লিন্কন্স্ ইন্স এ শিক্ষাপ্রাপ্ত উদারপন্থী উচ্চশিক্ষিত লোক ছিলেন। তবে রাজনীতিতে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যা যা করা দরকার সেটা ঠিকই করতেন। কিন্তু বটম লাইন হল তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামী মুক্ত নেতা ছিলেন। তাঁর সরকার কিছু ইসলামায়ন করতে বাধ্য হন, যেমন আহমেদীয়ায়দের অমুসলীম ঘোষণা ১৯৭৪ এ (সৌদী বাদশাহ ফয়সলের চাপে, লাহোরে ইসলামী সম্মেলনের পর)। সৌদী বাদশাহ পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়ার সঙ্গে আহমেদিয়াদের অমুসলীম ঘোষণার শর্ত জুড়ে দেন। (Economist London 15 June 1974 থেকে উদ্ধৃত, (দ্রঃ http://alhafeez.org/rashid/constipak.html )। ইউটিউবেও এটা নিয়ে কিছু ভিডিও আছে।
এরপর ভু্ট্টোকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউল হক। তিনিই একমাত্র উৎসাহী ইসলামায়নকারী। আইয়ুব ইয়াহিয়ার মত উদার অনৈসলামিক জীবন যাপন করতেন না উনি। ছিলেন কট্টর মুসলীম। দীর্ঘ ১১ বছর একের পর এক ইসলামী পদক্ষেপ নিতে থাকেন (যার শেষ হয় ১৫ই জুলাই ১৯৮৮ এর ঘোষনা দিয়ে যে ইসলামী আইনই হবে দেশের সর্বোচ্চ আইন।) এর কিছুদিন পরই তিনি মারা যান। ইসলামায়ন এত গভীর ভাবে ঢুকে গিয়েছিল যে পরবর্তী মোটামুটি উদার দলরাও একে নির্মূল করতে পারে নি। এরপর বেনজীর ভুট্টো ১৯৮৮-৯০ এ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসলেন। এসময় কোন ইসলামায়ন হয় নি। বেনজীর ভুট্টো মহিলা, উচ্চশিক্ষিত ও উদার চিন্তার নেত্রী ছিলেন। বিপুল ভোটে তাঁর নির্বাচিত হওয়া পাকিস্তানের জন্য তাৎপর্য্যপূর্ণ। তারপর নাওয়াজ শরীফের মুসলীম লীগ (PML) আর ইসলামী মোর্চা মিলে (IJI ) এক সরকার আসে ১৯৯১ এ। ইসলামী অংশীদার দলের চাপে নাওয়াজ শরীফ মে ১৯৯১ তে শরীয়া বিল (আইন নয়) চালু করেন । এই বিলে কোরাণ ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোন আইন না করার কথা বলা হয়। তারপর আবার আসেন বেনজীর ভুট্টো (১৯৯৩-৯৭)। এই সময়েও কোন ইসলামায়ন হয়নি। এরপর আবার নাওয়াজ শরীফের মুসলীম লীগ এককভাবে ১৯৯৭ এ নির্বাচিত হয়, পিপিপি ও জামাতকে পরাজিত করে। ভোট কারচুপীর অভিযোগ উঠেছিল অবশ্য। এই সময়ে নাওয়াজ শরীফ কোন ইসলামায়নের পদক্ষেপ নেননি। কাশ্মীর, ভারত-পাক সম্পর্কই ব্যস্ত রেখেছিল তাঁকে। এরপর পারভেজ মোশাররফ আসেন শরীফকে সরিয়ে। তিনি ধর্মনিরপক্ষে দৃষ্টিভঙ্গীর লোক বলে সপরিচিত। তারপর আবার পিপিপির ক্ষমতায় আগমন। দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের প্রকৃত ইসলামায়ন হয় মূলত জিয়ায়ুল হক ও প্রথম নাওয়াজ শরীফের আমলে।
সেনাবাহিনী মাত্রই ইসলামী, ইসলামায়নের জন্য সেনাবাহিনী শুধু দায়ী (বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে) এই মিথ ভঞ্জনঃ
এটা ঠিক যে জেনারেল জিয়া পাকিস্তানের ইসলামায়নের সবচেয়ে উৎসাহী ছিলেন আর জেনারেল এরশাদ বাংলাদেশে। কিন্তু সেটা নিয়মের একটা ব্যতিক্রম, নিয়ম নয়। আরেকটা কথা জোর দিয়ে বলা উচিত যে বাংলাদেশেই হোক বা পাকিস্তানেই হোক ইসলামীকরণের জন্য সেনাবাহিনীকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দায়ী কখনই করা যায় না। সেনাবাহিনীর দর্শনই হল “Command Structure” কড়া ভাবে মেনে চলা আর । তাই শুধু শুধু সেনাপ্রধানের একার ব্যক্তিগত মতাদর্শের কারণেই অনেক রাষ্ট্রীয় নীতি পরিবর্তন করা যায়, সামরিক বাহিনীর সামগ্রিক কোন সহায়তা ছাড়াই, তা ছাড়া একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রেসিডেন্ট কি নীতি বাস্তবায়ন করছেন সেটা বিচার করা বা বাধা দেয়ার ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর নেই। জিয়াউল হক বা এরশাদ ক্ষমতায় আসার সময় দুই সামরিক বাহিনীই ধর্মীয় আদর্শে শিক্ষাপাপ্ত বা অণুপ্রাণিত ছিল না। বরং তার আগে তাহের ও জাসদের দ্বারা বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে বামপন্থী অনেক আদর্শ ঢুকানো হয়েছিল, যার একজন শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন জিয়া হত্যাকারী জেনারেল মঞ্জুর।
পাকিস্তানের কথায় আসি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিবর্তনশীল চেহারা নামে কায়সার ফারুক গন্ডাল এক প্রবন্ধে এটা নিয়ে বিশদ লিখেছেন।
(দ্রঃ http://communities.washingtontimes.com/neighborhood/letters-pakistan/2011/oct/29/changing-face-pakistans-army/ )
গন্ডাল উল্লেখ করেন যে অভিভক্ত ভারতের সেনাবাহিনী থেকে ধর্মনিরপক্ষেমনা অফিসাররাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং জুনিয়র অফিসারদের ধর্মনিরপক্ষে জীবন যাপনের প্রশিক্ষণ দেন এবং ধর্ম নয় বরং দেশের প্রতি আনুগত্যই সেই প্রশিক্ষণে প্রাধান্য পায়।
আরও উল্লেখ করেন যে আইয়ুব খান মিলিটারী একননায়ক ছিলেন কিন্তু চিন্তায় উদারমনা ছিলেন এবং সেনাবাহিনীতে ধর্মীয় আদর্শ ঢোকাবার কোন চেষ্টা করেননি। ইয়াহিয়ার আমলে উদারমনা ধর্মনিরপেক্ষ লোকেরাই সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, যাদের চিন্তাধারা ইয়াহিয়া খানের আদর্শেরই অনুরূপ ছিল। গোঁড়া ও কট্টরপন্থীরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে উৎসাহী ছিল না।
সেনাবাহিনীর এই ধর্মনিরপেক্ষ চেহারা চলতে থাকে জিয়াউল হকের সেনাপ্রধান হওয়ার (১৯৭৭) আগ পর্যন্ত। জিয়া ধর্মনিরপেক্ষ সদস্যদের ধীরে ধীরে সরিয়ে গোঁড়া সদস্যদের নিয়োগ দিতে শুরু করলেন। অথবা ধর্মনিরপেক্ষ অফিসারদের বাধ্য করলেন ইসলামী মূল্যবোধের সাথে মানিয়ে চলতে । ১৯৮৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পর সেনাবাহিনীর এই ইসলামীকরণের বা কট্টর ইসলামপন্থীদের প্রাধান্যের অবসান হয়।
এরপর এগার বছর ধরে দুই বেসামরিক সরকারের শাসনামলে পাঁচবার সেনাপ্রধান বদল হয় এবং কট্টরপন্থীদের প্রভাব অনেক কমে আসে এবং সেনাবাহিনী ইয়াহিয়া এবং জিয়াউল হক, এই দুই চরমের মাঝামাঝি একটা ব্যালান্সের দিকে এগিয়ে যায়। সর্বশেষ সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফ আইয়ুব আমলেরই একজন ধর্মনিরপেক্ষ অফিসার ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীতে এই দুইএর টানাপোড়েনে মাঝামাঝি অবস্থায় আসেন, যেখানে ইসলামী মূল্যবোধ স্বীকৃত হলেও উগ্রবাদকে (সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে) প্রশ্রয় দেয়া হয় না। বর্তমান সেনাপ্রধান ও সেই একই ধারা চালিয়ে যাচ্ছেন। পিপিপি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে হয়ত বি-ইসলামীকরণ (De-Islamaization) এর দিকেই যাবে সেনাবাহিনী তথা পাকিস্তানী সমাজ।
ভয়াবহ গোলমেলে লেখা! সুবিধাবাদী রেফারেন্সিং আর তথ্যের ছদ্মবেশে নিজের তত্ব ঢুকিয়ে দেয়ার পায়তারা চোখে পড়ার মতো। ক্রস রেফারেন্সিং নেই বললেই চলে, এবং সেটা ইচ্ছাকৃত এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। দ্যাখা যাক ২য় পর্ব কদ্দূর যায়। পুরোটা পড়ে বিস্তারিত কথা বলবো!
“এবং সেজন্যেই তিনি ভারতে থেকে গেলেন” — এটুকু বাদ দিলেন কেন?
আমি মওদুদীর একটা বই পড়েছি মাত্র, এবং সেটা স্বাধীন ভারতে মুসলিম শাসনের প্রকৃতি, হিন্দুদের অবস্থান ইত্যাদি নিয়েই আলোচনা হয়েছে। এবং সেটাই মৌলিবাদী ইসলামের সাথে যুক্তিযুক্ত।
আপনি মওদুদীর ধারণার সাথে পরিচিত নন মনে হচ্ছে। মওদুদীর পাকিস্তান-বিরোধ অন্য কারণে, পাকিস্তানের ধর্মনিরপেক্ষতা নয়।
আল্লাহ কোরানে বলেছেন তিনি নিজে সমগ্র বিশ্বের মালিক, এবং তার মধ্য থেকে পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব তিনি মুসলিমদের হাতে ন্যাস্ত করেছেন, এবং মুসলিমদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন জিহাদের মাধ্যমে তা জয় করে নিতে, যে প্রয়াসে আল্লাহ তাদেরকে ফেরেস্তা পাঠিয়ে সহায়তা করবেন। মুসলিমদের ভারত বিজয় ছিল আল্লাহর সহায়তাকৃত সফল জিহাদের পরিণামমাত্র। সুমহান জিহাদের মাধ্যমে যা বিজিত হয়েছে, তা মুসুলিমরা কখনোই কাফেরদের হাতে ফিরিয়ে দিতে পারে না। সেকারণেই মওদুদী চেয়েছিলেন ভারতকে অখন্ড রাখতে এবং সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ-পূর্ববর্তী ইসলামী শাসন কায়েমের প্রচেষ্টা চালাতে।
@আলমগীর হুসেন,
মওদুদীর একই সাথে পাকিস্তানের(জিন্নাহর) ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য পাকিস্তান বিরোধিতা করা আর ভারতকে অখন্ড রাখতে চাওয়া এবং সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ-পূর্ববর্তী ইসলামী শাসন কায়েমের স্বপ্ন দেখা সম্ভব, দুটো সাঙ্ঘর্ষিক নয়। কিন্তু ভারতকে অখন্ড রাখতে এবং সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ-পূর্ববর্তী ইসলামী শাসন কায়েমের জন্য পাকিস্তান বিরোধিতা করা কোন যুক্তিই হলনা। তাহলে মওদুদী ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেত না আর পাকিস্তানকে ইসলামী দেশ করার জন্য জেলে যাবার ভাগ্য বরন করত না। ভারতে থেকেই ভারতকে ইসলামী দেশ পরিণত করার চেষ্টাই করত। মওদুদী কেন, সব ইস্লামিস্টরাই সেই স্বপ্ন দেখত এবং দেখে। এমনকি মাউলানা আবুল কালাম আজাদও খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। খিলাফত আন্দোলন করা মানেই ভারতে তথা বিশ্বে ইসলামী শাসনের সমর্থন করা। জিন্নাহ সেটা চাইলে মওদুদীর সাথে হাত মিলিয়ে সেই চেষ্টাই করতেন। মওদুদী পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছিল কারণ ধর্মনিরপেক্ষ কাফির জিন্নাহর পাকিস্তানের চেয়ে ভারতই ভাল এটা মনে করে। তার লেখায় উক্তিতে এটা স্পষ্ট।
আমার যতটা মনে হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যাবহার দূঃখজনকভাবে সবচেয়ে আনলাইকলি সোর্স বংগবন্ধুই সূচনা করে গেছিলেন। পরবর্তিতে জিয়া এরশাদের তূলনায় যদিও তার অবদান একেবারেই ক্ষুন্ন হয়ে যায় তবে সূচনাটা অস্বীকার করা যায় না।
পাকিস্তানের সূচনাব্দে জিন্নাহর বিদায় না ঘটলে দেশটির কেমন চেহারা হত এই তত্ত্বীয় প্রশ্নটা বেশ কৌতূহ জাগায়, কারন জিন্নাহ ধর্মীয় নয়, ধর্মনিরপেক্ষ পাকিস্তানই চেয়েছিলেন যার জন্য মৌদুদী পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধী ছিল।
এটা থেকে হাস্যকর কিছু হতে পারে না । পাকিস্তানের কোন শাসকের কোনদিন ইসলাম বিরোধিতা ছিল না । পাকিস্তানি শাসকরা শুরু থেকেই সুবিধাবাদী ছিলেন । আসল কথা হচ্ছে নিজেদের সুবিধার জন্য তারা নানা ইসলামি দলকে বা তাদের সিদ্বান্তকে হেনস্তা করেছিলেন । মওদুদিকে জেলে পাঠানো বা মৃত্যুদণ্ডের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া কখনো ইসলাম বিরোধিতার প্যারিমিটার হতে পারে না । বলতে পারেন এটা ক্ষমতাই টিকে থাকার একটা কৌশল ছিল মাত্র।
এটা হয়ত সত্য কোন সামরিক নেতা ইসলাম আনেন নি , কিন্তু বেসামরিক নেতাদের অবস্থাটা দেখুন ? পাকিস্তানের রাজনীতিতে এখনো আভ্যন্তরীণ উন্নয়ন যতটা ফ্যাক্টর ,তার চেয়ে বেশী ফ্যাক্টর হিন্দু তথা ভারত বিরোধিতা ও ইসলাম প্রীতি যেটা জিন্নাহ ও ভুট্টো তাদের শিখিয়েছেন এবং জিয়াউল হক যেটা পরবর্তীতে সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন করেছেন ।জিন্নাহ বীজ ফেলেছিলেন , অনন্য শাসকরা কেউ পানি একটু কম বা বেশি ঢেলেছেন, আর জিয়াউল হক সেই গাছের নিবিড় পরিচর্যা করেছিলেন।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ইসলামায়নের ধারণাগুলোতে নতুন করে ভাবনার হাওয়া লাগলো। বড় লেখা হলেও পড়ে আনন্দ পেয়েছি। ধন্যবাদ। পরবর্তি লেখার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
প্রথমেই বলে নেই – আমার ইতিহাস সংক্রান্ত জ্ঞান খুবই সীমাবদ্ধ, উপরন্তু বেশ অনেক বছর এই বিষয়ে তেমন পড়াশোনা করা হয় নি বলে আগে যা জানতাম সেটাও অনেকখানি ভুলে গেছি বলে সন্দেহ। তারপরও কয়েকটা প্রশ্ন না করে পারছিনা –
১) আপনি ‘ইসলামীকরণ’ বলতে যে প্রক্রিয়াটার কথা বোঝাচ্ছেন, সেটা ঠিক কী? আপনার বর্ণিত এই ‘ক্রম ইসলামীকরণ’ ব্যাপারটার শেষ লক্ষ্য বা গন্তব্য কী? শরিয়া আইনের প্রবর্তন? মুসলিম-গরিষ্ঠ রাষ্ট্রের নীতিতে ‘ইসলামিক’ ধ্যান ধারণার প্রতিফলন? না, অন্য কিছু?
২) ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কী? “মুসলীম প্রধান ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ” জিনিষটাই বা কী?
৩) যদি বা আপনার দেয়া রেফারেন্সের প্রতিটা কথাকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিয়ে মনেও করি যে জিন্নাহ নিজে ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন না, এমনকি উর্দূ ভালোভাবে জানতেনও না – তাহলে তারপরও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দূকে চাপানোর কারণ কী ছিলো? দয়া করে এই প্রসঙ্গকে “অবান্তর” এবং “আলোচনাকে অন্য দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা” হিসেবে না দেখে,উত্তরটা দেবেন।
৩) আপনার ‘পাকি=জামাতি মিথ’ ভাঙ্গার প্রয়াস দেখে খুব অবাক হয়েই ভাবলাম, আপনি এতো ইতিহাস ঘেঁটে এতো রেফারেন্স জোগাড় করেছেন অথচ এটা কি আপনি সত্যিই জানেন না যে, যারা ঐ ফর্মুলাতে বিশ্বাস করে তাদের কাছে পাকিস্তানের কোন জামাতি নেতা কতবার জেলে গেছে আর কোন মওদুদ মুসলিম লীগকে ভোট দেওয়া নিয়ে কী মহার্ঘ উক্তি করে গেছে তার চাইতে বড় ব্যাপার হচ্ছে – ‘৭১ এ পাকিস্তান এবং জামাতের আঁতাত?! “তিনি ইসলামী পাকিস্তানের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ পাকিস্তান চাওয়ার জন্য মুসলীম লীগের নেতাদের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।” তখনকার প্রেক্ষাপট যদিবা ধর্মনিরপেক্ষতা হয়েও থাকে, এখন পাকিস্তানের রাজনীতি কি কোনভাবেই তা রিফ্লেক্ট করে? তাহলে এমনকি এখনকার পরিপ্রেক্ষিতেও পাকি=জামাতি ফর্মূলা ‘মিথ’ কেন হচ্ছে? জামাত আমাদের দেশের ইসলামী আইন ও শরিয়া মতাদর্শ অনুসারী পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর মধ্যে প্রধাণ। য়াপনার কি মনে হয় না, এখানে ‘জামাতি’ কথাটা Islamizationএর একটা সিম্বল হিসেবে ব্যবহার করা হয়? বিশেষ করে বাংলাদেশের কনটেক্সটে ইসলামীকরণ নিয়ে যখন লিখছেন?
৪) আপনি যদি বা বিশ্বাসও করেন যে “বাংলাদেশের রাজনীতি পাকিস্তানের উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত” (একেবারেই একমত নই) তাহলেও বা কী কারণে বাংলাদেশের রাজনীতির ইসলামীকরণ বুঝতে হলে পাকিস্তানেরটাও বুঝতে হবে? জিয়াউল হকের কথা যে বলছেন আপনি, জিয়াউল হকের শাসনামল তো স্বাধীনতার কত পরের! ওই সময়কার পাকিস্তানের রাজনীতি বা ইসলামীকরণ কেন প্রাসঙ্গিক?? আপনার “উত্তরাধিকার” ফর্মূলাও তো এখানে খাটে না? ঐ সময় দুটো আলাদা ‘স্বাধীন’ দেশের রাজনীতিতে প্যারালালি অনেক ঘটনাই ঘটতে পারে, সেগুলো পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত কীভাবে সেটা এই লেখায় একেবারেই স্পষ্ট নয়।
৫) “বলা যায় এক বামপন্থী বন্দীর রীটের বদৌলতে মওদুদী ছাড়া পান। তা না হলে আরো কতদিন জেলে থাকতেন কে জানে। একজন ইসলামিস্টের চেয়ে একজন বামপন্থীই পাক সরকারের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল!” এটা কী ধরনের রিজনিং হলো বুঝলাম না! ওই সময় পাকিস্তানের সংবিধান কী ছিলো, বা মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আইন ইত্যাদি কী ছিলো সেটা না জেনেই আপনি কীভাবে ধরে নিচ্ছেন যে একজন বামপন্থীকে প্রেফারেন্সিয়াল ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়েছিলো? আপনিই না কিছু পরে লিখলেন – “এর পর রেডিওতে আইয়ুব সরকার জামাত বিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকেন এবং জানুয়ারী ৬, ১৯৬৪ তে জামাতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। মওদুদীসহ ৬৫ জন জামাত নেতাকে আটক করে জেলে পাঠান। পরে সুপ্রীম কোর্ট জামাতকে নিষিদ্ধ করা অবৈধ ঘোষণা করলে তিনি ছাড়া পান।”!
৬) আপনার লেখা পড়ে মনে হলো আপনি বলতে চাইছেন – পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে ‘সাধারণ মানুষ’ই তাদের বিশ্বাস বা ইসলামের প্রতি ভালোলাগা থেকে ইসলাম নির্দেশিত রাষ্ট্র এবং সমাজব্যবস্থা চায়, এবং চায় বলেই এই দুই দেশে (আবারও জিজ্ঞাস্য -পাকিস্তানে কে কী চায় তা বাংলাদেশের জন্য কেন প্রাসঙ্গিক??) ইসলামীকরণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। উদাহরণঃ
৭) আপনার পুরো লেখায় এটা বেশ স্পষ্ট যে আপনি পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানকে একটা অখন্ড সংস্কৃতি এবং জাতিসত্তা হিসেবে দেখেন।
ইতিহাস কি ঠিক এর উল্টোটাই বলে না?
৮) আপনি লেখার শুরুতে নিজেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কামী একজন বলে উল্লেখ করলেও পুরো লেখাটা পড়ে, বিশেষ করে নিচের প্যারাটা পড়লে লেখক হিসেবে ‘ইসলাম ধর্মালম্বী’দের প্রতি আপনার বায়াস আছে বলে মনে হয়, অন্তত আমার মনে হয়।
তাহলে হুমায়ুন আজাদ ষাটের দশকের যে আধুনিক বাংলাদেশের কথা বলছেন, সেটা কি একেবারেই ঢাকা কেন্দ্রিক একটা চিত্র, আর বাকি মানে যারা বুদ্ধিজীবি নন এবং গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষ, তারা উলটো একটা বাংলাদেশ চাইতেন???
@স্নিগ্ধা,
আমার মতে এর কারণ মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠাতারা প্রায় সবাই ঢাকার উর্দুভাষী নবাব পরিবারের সদস্য ছিল। উত্তর ভারতেও যেখানে মুসলীম লীগের প্রভাব ছিল সেখানেও উর্দু ভাষা চলে। অর্থাৎ মুসলীম লীগ (যার জন্ম বাংলায়) উর্দুভাষীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। জিন্নাহকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দুতে তাদের সাথে কথা বলতে হত। পাকিস্তানেও উর্দু সংখ্যালঘিষ্ঠ ভাষা। পাঞ্জাবী প্রধান ভাষা। কিন্তু করাচীতে উর্দুর চল বেশি। জিন্নাহ হয়ত মনে করেছিলান উর্দুই হয়ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সাধারণ ভাষা হবে। তখন একটা ধারণা ছিল যে বাংলার মুসলমানেরা সবাই উর্দু বলে বা বলতে পারাটাকে প্রাধাণ্য দেয়। এই ধারণাটা হয়ত খাজা নাজিমুদ্দীন জিন্নাহকে দিয়েছিলেন এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জিন্নাহকে বুঝিয়েছিলেন। কেউ কেউ খাজা নাজিমুদ্দিনুকেই তাই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালাবার জন্য দায়ী করেন। যাই হোক জিন্নাহর উপরেই এই দায়িত্ব বর্তায় চূড়ান্ত বিচারে। তিনি বেচে থাকলে আমরা জানতে পারতাম জিন্নাহ কি তার ভুল বুঝতে পারতেন কি না।
আপনার বাকী সব প্রশ্নের উত্তর আপনি নিজেই দিতে পারবেন একটু চিন্তা করলে। ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
ধন্যবাদ কালযাত্রী সাহেব এ গবেষণাধর্মী লেখাটা উপহার দেওয়ার জন্য। আপনার লেখাটা আমার নিম্নোক্ত উক্তিকে কেন্দ্র মনে হচ্ছে।
দেখুন আপনি যা আলোচনা করছেন তা কিন্তু আমি যা বলেছি তা থেকে প্রায় ১৮০ ডিগ্রী ভিন্ন। যাহোক, এ বিতর্ক থেকে বিদায় নেওয়ার আগে আপনার জিন্নাহ-পছন্দ ও একপেশে গবেষণার দিকে একটু আলোকপাত করি।
আপনি লিখেছেনঃ
আপনার উদ্ধৃত প্রথম লাইনটিই কিন্তু ইসলামী সাম্প্রদায়িকতার গন্ধে দুষ্ট। আর আপনি এখানে নেহেরু, গান্ধী ও সরদার প্যাটেলকে ভিলেন বানাচ্ছেন। আসল সত্যতা আমি দিচ্ছি এখানে। ১৯৪৬ সালে যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের শেষ চেষ্টা হয়, সেখানে জিন্নাহ চেয়েছিল ৬ জন মুসলিম ও ৬ জন হিন্দু প্রতিনিধি; অন্যান্য ধর্মীয়দের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। উল্লেখ্য ভারতের মোট জনসংখ্যায় মুসলিম ছিল ২০%, হিন্দু ৭৫%, বাকী অন্যান্য ধর্মীয়। এবং এ সময় জিন্নাহর পার্টি প্রচার করে বেড়াতো যে, একজন মুসলিম পাঁচজন হিন্দুর সমান — যার মূলে রয়েছে আল্লামা ইকবালের এ বিশ্বাসঃ Democracy is a type of Government, in which people are counted not weighed । এবং এ ভিত্তিতেই জিন্নাহ এরূপ দাবী করেছিলেন নিঃসন্দেহে।
আর দেখুন মহা-ভিলেন নেহরু-পাটেল প্রমুখদের প্রস্তাব কি ছিল! তাদের প্রস্তাব ছিলঃ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ১২ জন প্রতিনিধির মধ্যে ৫ জন হবে মুসলমান, ৬ জন হিন্দু, ১ জন বাকী ধর্মীয় গোত্রের প্রতিনিধি। কি অন্যায় প্রস্তাব তাই না? যেখানে সংখ্যা অনুপাতে মুসলিমরা পায় মাত্র ২ জন প্রতিনিধি, সেখানে তাদেরকে ৫ জন দেওয়ার প্রস্তাবতো অবশ্যই চরম অন্যায়।
যাহোক, জিন্নাহ এসব হিন্দু ভিলেনদের প্রস্তাব চরম অন্যায় মনে করে ভারতকে বিভক্তকরণের প্রত্যয়ে বোম্বেতে মুসলিম লীগের সভা ডাকলেন এবং ভারত বিভাগের চূড়ান্ত দাবী সফল করণের জন্য “Direct Action”-এর ডাক দিলেন। এ প্রসংগে আপনি বলছেনঃ
আপনার উপরোক্ত বক্তব্যের বিপরীতে দেখুন, জিন্নাহ বোম্বে সভা থেকে বের হয়ে এসে “Direct Action”-এর ঘোষণা দিতে গিয়ে কী বলেনঃ
এখানে অন্তত ভারত-বিভাজন চাপিয়ে দেওয়ার কোন আভাস দেননি জিন্নাহ। বরং তিনি পাকিস্তান দাবীকে মুসলিমদের মনোবৃত্তি ও প্রত্যাশার ফসল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিভাজন চাপিয়ে দেওয়ার উক্তি যে দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর প্রচেষ্টা সেটা বুঝা কারও জন্য কঠিন হবে না। এবং এটাও সত্য যে, সর্দার পাটেল — যার উপর জিন্নাহ দোষ চাপাচ্ছেন — তিনি সঙ্খ্যার অনুপাতে মুসলিমদেরকে আড়াইগুণ বেশী প্রতিনিধি দেওয়ার প্রস্তাবে রাজী ছিলেন।
জিন্নাহ মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক ছিলেন কিনা, এ প্রশ্নে সকলেই দূর-দূর আওয়াজ তুলবেন। দেখুন জিন্নাহ তার “Direct Action”-এর ঘোষণা শেষ করেন কি বলেঃ
হিন্দুদের সম্বন্ধে জিন্নাহর উক্তি এখানে, অন্তত আমার মতে, সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদে দুষ্ট। এবং এ “সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদ”কেই তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন।
আপনি বলছেনঃ
জিন্নাহ শান্তিপূর্ণভাবে “ডাইরেক্ট এ্যাকশন” সূচনার ডাক দিয়েছিলেন, এ মর্মে জিন্নাহর উক্তিটি চেয়েছিলাম কিন্তু পেলাম না। যাহোক, আমার জানা তথ্যটুকু উপস্থাপন করে শেষ করছি। বোম্বেতে “ডাইরেক্ট এ্যাকশন” ঘোষণা দেওয়ার পর জিন্নাহকে প্রশ্ন করা হয়েছিলঃ “Direct Action”-এর প্রকৃতি কিরূপ হবে? অর্থাৎ গান্ধীপন্থী অহিংস হবে না সহিংস? আর জিন্নাহর জবাব কি ছিলঃ “I am not going to discuss ethics.”
জিন্নাহর এ উত্তরের মানে ৬-বছর-বয়সী নাঙ্গা ছেলেও বুঝতে পারবে। জিন্নাহ মুখে না বললেও তার চেলারা ঠিকই তা ব্যাখ্যা করেছিলেন। “Direct Action”-এর প্রকৃতি সম্বন্ধে আমেরিকার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস প্রশ্ন করলে নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান (যিনি পরে পাকিস্তানের প্রথম প্রধান্মন্ত্রী হন) বলেনঃ ‘‘We cannot eliminate any method. Direct Action means any action against the law.’’
সর্দার আব্দুর রব নিস্তার (যিনি পরে পাকিস্তানের যোগাযোগ মন্ত্রী হন) তিনি বলেনঃ“Pakistan could only be achieved by shedding blood and, if opportunity arose, the blood of non-Muslims must be shed, for ‘Muslims are no believers in ahimsa (non-violence).”ডাইরেক্ট এ্যাকশনের প্রকৃতি সম্পর্কে জিন্নাহর উক্তিই বলে যে, তা সহিংস হতে যাচ্ছিল। সেকথাই লিয়াকত আলী ও নিস্তার সাহেব ব্যাখ্যা করেছেন এবং কোলকাতায় ঠিক তা-ই ঘটেছিল। এবং লিয়াকত আলী ও নিস্তারের ব্যাখ্যার সাথে দ্বিমত পোষণ করে জিন্নাহ কোন বক্তব্য দিয়েছেন এমন নজীর আমার চোখে পড়েনি। সুতরাং “ডাইরেক্ট এ্যাকশন” আন্দোলনের সূচনা দিনে কোলকাতায় যা ঘটে, তাই যে জিন্নাহ-সহ মুসলীগের প্রত্যাশিত ছিল — সেটা জিন্নাহ, লিয়াকত ও নিস্তারের উক্তি থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যায়।
আমার মতে, জিন্নাহ প্রমুখরা যা চেয়েছিলেন, ঠিক তাই ঘটানো হয় কোলকাতায় ১৯৪৬ সালের ১৬ই জুলাইয়ে, যা ছিল ৬২৪ সালের রমজান মাসের সুবিখ্যাত বদর যুদ্ধের দিন, যে শুভ দিনটিকে জিন্নাহ নিজে চয়ন করেছিলেন “ডাইরেক্ট এ্যাকশন” আন্দোলনের সূচনা-দিন হিসেবে।
—
সূত্রঃ
1) http://www.allamaiqbal.com/webcont/435/genesis.htm
2) G. D. Khosla, “Stern Reckoning: : A Survey of Events Leading Up To and Following the Partition of India, Oxford University Press
@আলমগীর হুসেন,
অনেক ধন্যবাদ এই তথ্যগত অসম্পূর্ণতাগুলো তুলে ধরার জন্য! আমার এসব জ্ঞান একদম নেই বলে সাধারণত আমি ইতিহাসভিত্তিক কোন বিতর্কে যাই না, কিন্তু এই লেখাটা এমনকি আমার জন্যেও এতোটাই প্রোভোকিং ছিলো যে বিশাল এক মন্তব্য না করে আর পারলাম না 🙂
@স্নিগ্ধা,
ধন্যবাদ স্নিগ্ধা দি। আপনার মন্তব্যটাতে খুবই ন্যায্য কিছু প্রশ্ন করেছেন।
সত্য-অসত্যে পরিপূর্ণ এ অত্যন্ত বিতর্কিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। কালযাত্রী সাহেবের এ কষ্টসাধ্য প্রয়াস ও ইহার পর্যালোচনার ফল-স্বরূপ একটা ভাল বোঝাপড়া বেরিয়ে আসবে আশা করি।
তবে দুঃখজনক যে, কিছু কিছু অতিশয় ভাল মনের ঐতিহাসিকগণ মুসলিম-অমুসলিম সম্প্রীতির খাতিরে (যার অস্তিত্ব কোন দিন ছিলনা, অর্জনও অসম্ভব) ইতিহাসকে এতটাই বিকৃত বা একপেশে করে ফেলেছেন যে, যার ফলে ভাল বা মোটামুটি ভাল মানুষ — যেমন গান্ধী, নেহরু, পাটেল — ভিলেন হয়ে দাঁড়ান। অন্যদিকে জিন্নাহ কোনক্রমেই গান্ধী-নেহরুর মহানুভবতার কাছাকাছি ছিলেন না, অথচ সে জিন্নাহ হয়ে উঠেন নিষ্পাপ দেবতা।
উল্লেখ্য এ, কে, ফজলুল হক ছিলেন একমাত্র অসাম্প্রদায়িক মুসলিম নেতা, যদিও কোন কোন বিরল ক্ষেত্রে তিনিও সাম্প্রদায়িকতার উর্ধে উঠতে পারেন নি। এবং ফজলুল হকের সাথে চলে জিন্নাহর বিরোধ ও বিদ্বেষ, যার প্রধান কারণ ছিলঃ ফজলুল হক জিন্নাহপন্থীদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না।
@আলমগীর হুসেন,
এটা যে নেহরু-পাটেল প্রস্তাব ছিল সেটা কোথায় পেলেন? এটা ভারতের ভাইস রয় ওয়াভেল (Wavell) এর ছিল। এটা জিন্নাহ মেনে নিয়েছিলেন। নেহরু মেনে নিয়েছিলেন,কিন্তু গান্ধী মেনে নেননি। কিন্তু নেহরু যখন শর্ত জুড়ে দিলেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছায় ভবিষ্যৎ ভারতের রুপরেখা কেমন হবে সেটা পরিবর্তন করার এখতিয়ার তাদের থাকবে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্টের ইচ্ছার সঙ্খ্যালঘিষ্ঠের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে। আর তখনই জিন্নাহ এই প্রস্তাবের প্রতি তাঁ সমর্থন তুলে নেন। কিন্তু প্রস্তাবটা ছিল বৃটিশদের। পাটেল নিজে কোন প্রস্তাব দেননি।
এটা Khosla “Stern Reckoning এই শুধু আছে। কিন্তু এই প্রচারপত্রটা সরকারীভাবে মুসলীম লীগ এর বা জিন্নাহর ছিল না। এটা কোলকাতার মুসলীম লীগ কর্মীদের দ্বারা বিলি করা হয়েছিল গোপনে। এটার জন্য কোলকাতার মুসলীম মেয়র ওসমান আর সুহরাওয়ার্দীকে দায়ী করা যায়। যদিও অনেক সময় উৎসাহী কর্মীরা (যাদের মধ্যে অবশ্যই অনেক সাম্প্রদায়িক লোক ছিল) নিজেদের উদ্যোগেই অনেক কিছু করে নেতাদের অগোচরে। মনে রাখা দরকার শুধু বাংলাতেই মুসলীম লীগ সরকার অধিষ্ঠিত ছিল যার পুরো কর্ণধার ছিলেন সুহরাওয়ার্দী। জিন্নাহর কোন হাত ছিল না প্রাদেশিক সরকারের পরিকল্পনায়। এটা যে জিন্নাহর নিজের কোন বক্তব্য ছিল তার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই, থাকলে এতদিনে জিন্নাহর সব ঐতিহাসিকেরা সেটা উল্লেখ করতেন। এটা বেশ গুরুতর একটা ইস্যু হত জিন্নাহর জন্য। জিন্নাহর বাকী সব কর্ম/উক্তি এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
@কালযাত্রী,
দেখুন কোন প্রস্তাবই ওয়েবেল-এর ছিল না। ওয়েবেল-এর প্রথম প্রস্তাব ১২ সদস্যের মধ্যে ৬ জন মুসলিম, ৬ জন হিন্দু — এটা ছিল জিন্নাহ/মুস্ললিম লীগের প্রস্তাব — যেটা ওয়েবেল উপস্থাপন করেছিলেন মাত্র। এ প্রস্তাবের আলোচনায় কংগ্রেসের (তথা নেহরু-গান্ধী-পাটেলের) পালটা প্রস্তাব ছিল ৫ জন মুসলিম, ৬ জন হিন্দু, ১ জন অন্যান্য ধর্মীয়। যা পুনরায় ওয়েবেল উপস্থাপন করলে, জিন্নাহ তা না মেনে “ডাইরেক্ট এ্যাকশন” আন্দোলনের ডাক দিলেন।
জিন্নাহর ৬-জন-মুসলিম-৬-জন-হিন্দু প্রতিনিধির দাবীর মাঝেই তার এ মনোবৃত্তি ফুটে উঠে যে, ১ জন মুসলিম ৫ জন হিন্দু/অমুসলিমের সমান।
ভাগ্যিস খোসলা মিথ্যে বলেন নি; মুসলিম লীগের কর্মীদের মাঝে “১ জন মুসলমান = ৫ জন অমুসলমান” — এ প্রচারণা ছিল। আর জিন্নাহর এরূপ দাবী ও প্রস্তাব প্রমাণ করে যে, তিনি সে প্রচারণায় বিশ্বাস না করলেও তা গ্রহণ করেছিলেন। তা না হলে জিন্নাহর এরূপ প্রস্তাব, দাবী বা প্রত্যাশার কোনই কারণ থাকতে পারে না। এটাও লক্ষ্যনীয় যে, অন্তর্বতীকালীন সরকারের কাঠামো আলোচনার সময় মুসলিম লীগ এ প্রচারণা শুরু করে।
যাহোক, আপনি নিশ্চয়ই জানেন উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা কিভাবে চলে এবং সে ব্যবস্থাই সংখ্যালঘুদের স্বার্থ নিশ্চিতকরণের সর্বোত্তম ব্যবস্থা। এবং জিন্নাহ তাতে বিশ্বাস করতেন না, আপনার বক্তব্যই তা পুনঃপুনঃ ধ্বনিত করেছে। এবং তার কারণ যে তার ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি, এটা নাঙ্গা বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও বুঝবে। উল্লেখ্য ভারতে মুললিমরাই শুধু সংখ্যালঘু ছিল না এবং জিন্নাহর মত তাদের মাঝে এরূপ আশংকা ছিল না।
@আলমগীর হুসেন,
উপযুক্ত রেফেরেন্স দ্রকার এখানে বাক্যগুলি উদ্ধৃত করে। বিশেষ করে “পালটা” প্রস্তাব, ওয়েবেলের “প্রথম” প্রস্তাব ইত্যাদির।
জিন্নাহর দাবী ছিল সমতার (Parity), কারণ তার দ্বারাই শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবার ঝুকি এড়ান যায়। কারণ নেহরু বারবার বলছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ্যের দ্বারাই ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। ৬-জন-মুসলিম-৬-জন-হিন্দু জিন্নাহর ছিল সেটার রেফেরেন্স চাই। এটা ওয়াভেলের ছিল বলেই জানি। আর এর থেকেই আপনি ১ জন মুসলীম = ৫ জন হিন্দু কিভাবে ডিডিউস করলেন? যদি ১০-জন-মুসলিম-১০-জন-হিন্দু হত (সমতা) তাহলেও কি ১জন মুসলীম = ৫ জন হিন্দু বলতেন। এটা কি ধরণের গণিত?
আপনি এই ইউটোপিয়ার বাস্তব অস্তিত্বে বিশ্বাসী?। কোথায় তার অস্তিত্ব? কোথায় সেই শাংগ্রিলা জানতে ইচ্ছা হয়। বাংলাদেশে চাকমা বা হিন্দুদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে? এখানে তো গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপএক্ষতা আছে বলে দাবী করা হয় সব দলের থেকেই। ভারতে বর্বর মুসলমান আগ্রাসী্রা আক্রমণ চালিয়ে ভারত শাসন করেছে কয়েকশ বছর। মন্দির ধ্বংস করেছে লুঠ করেছে, হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করেছে। এরপর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা কিভাবে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে? নেহরু ধর্মনিরপেক্ষ হলেও ভারতের সাইকীতে সেই ভয়াবহ স্মৃতি তো মুছে যেতে পারে না। অতীতের মুসলমান আগ্রাসীদের কুকর্মের জন্য লক্ষ লক্ষ নিরীহ মুসলমান এই দায়ভার নিত অখণ্ড ভারতে বৃটিশদের বিদায়ের পর। জিন্নাহ আলাদা দেশ চেয়েছিলেন যাতে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা জ্ঞান শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে যেতে পারে । পূর্বসূরীদের অপকর্মের দায়ভার নিয়ে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা মানসিকভাবে ইনহিবিটেড থাকত। এখানে ধর্মান্ধতা বা সাম্প্রদায়িকতা কোন ফ্যাক্টর ছিলে না। ছিল বাস্তব এক উপলব্ধি।
দালিতদের কথা পড়ুন। আম্বেদকার কি কারণে গান্ধীকে ঘৃণা করেন পড়ুন।
@কালযাত্রী,
আপনি ভাইসরয় ওয়েবেলের ঘোষণায় এমন উদ্ধৃতি চাচ্ছেনঃ “আমি জিন্নাহ বা মুসলিম লীগের দাবী/পরামর্শ অনুসারে অনুসারে ৬ জন হিন্দু ও ৬ জন মুসলিম প্রতিনিধির সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব করছি।” এমন চাওয়াটা কি হাস্যকর না। ওয়েবেল সাহেবকে এমন গবেট হবেন?
আপনি বলতে চাচ্ছেন, ওয়েবেল সাহেব নিজ থেকেই এ প্রস্তাব করেছিলেন। ১৯০ বছরের বিদেশী ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে স্বাধীন ভারতের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হতে যাচ্ছে, এবং ব্রিটিশ ভাইসরয় ভারতের ২ প্রধান ও প্রতিদ্বন্দী রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা না করে সে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিনিধির কাঠামো ঘোষণা করেছেন — এমনই যদি হয় আপনার ইতিহাসের বোঝাপড়া, তাহলে এ বিষয়ে তর্ক বাড়িয়ে লাভ নেই। এবং আপনার এমন ধারণা বিগত দশকগুলোতে ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ইংরেজদের চর্চিত পন্থারও পরীপন্থী।
আর যদি বলেন, সমতার খাতিরে তথা সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার খাতিরে ওয়েবেল এরূপ প্রস্তাব করেছিলেন, তাহলে তিনি প্রস্তাব দিতেনঃ ৬ জন হিন্দু, ৬ জন মুসলিম, ৬ জন শিখ, ৬ জন বৌদ্ধ ও ৬ জন খৃষ্টান প্রতিনিধির সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে বাক-বিতণ্ডা চলে অনেকদিন। সে বিতণ্ডা চলাকালে লীগ ও কংগ্রেসের দাবী ও প্রত্যাশা কি ছিল, তা কি ওয়েবেল সাহেবকে জানানো হয় নি?
তবে হ্যা, ওয়েবেল সাহেব যে প্রথমে জিন্নাহ-লীগের দাবী অনুসারে প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন, এরূপ অনেকে লিখেছেন। সেটাকে কেউ কেউ Conspiracy Theory বলে উড়িয়ে দেবে, কিন্তু ঐতিহাসিক পরিস্থিতির বিচারে সে ধারনাই সঠিক। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি যে কংগ্রেস প্রথম প্রস্তাব না মানার কারণে দেওয়া হয়, সেটা সুস্পষ্ট। এবং দ্বিতীয় প্রস্তাব দেওয়ার আগে ওয়েবেলের কংগ্রেস নেতাদের সাথে কথা হয় নি — এমনটি ভাবা ঠিক হবে না।
দলিতরা হিন্দুধর্ম ও সমাজেরই অংশ ছিল, পৃথক নয়। এবং ঐতিহাসিক বৈষম্যের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ্য শ্রেণীর বিরুদ্ধে তাদের বিদ্বেষ যুক্তিযুক্ত। তবে সেটা ভিন্ন আলোচনা। এবং আম্বেদকারই কিন্তু স্বাধীন ভারতের সংবিধান লিখেছিলেন। এবং এটাও অকাট্য সত্য যে, ভারতের দলিত-সামগ্রিক হিন্দু ও অন্যান্য সকল অমুসলিমরা (বৌদ্ধ, শিখ, জৈন) কিন্তু মুসলিমদের বিরুদ্ধে একই রকম ন্যায্য বিদ্বেষের দাবীদার ছিলেন।
বাংলাদেশকে উদার গণতান্ত্রিক সেকিউলার রাষ্ট্র বানিয়ে ফেললেন? মুজিবের এক নায়কতন্ত্রের অধীনে সেকিউলারিজম হয়ত কিছুটা ছিল এবং সঙ্খ্যালঘুর নিরাপত্তাও অনেকটা ছিল তখন। তারপর থেকেই তো চলে ধর্মায়ন, নয় কি? যে হিন্দু-ভারত সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারী হবে বলে জিন্নাহরা আশংকা করেছিলেন, উদার গণতান্ত্রিক সেকিউলারিজম কিছুটা হলেও সেখানেই সফল হয়েছে। বিশ্বাস না হলে সেখানকার সংখ্যালঘু বৌদ্ধ, খৃষ্টান, শিখদেরকে জিজ্ঞাসা করে দেখা যায়।
যাহোক, এ আলোচনা জিন্নাহ সম্পর্কে আমার মূল উক্তি/বক্তব্যের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং অনেকটা হাস্যকর হয়েও উঠছে। কাজেই বাকীটা পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ক্ষান্ত দিচ্ছি।
আরেকটা কথা, আপনি বলছেনঃ “জিন্নাহর দাবী ছিল সমতার (Parity), কারণ তার দ্বারাই শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবার ঝুকি এড়ান যায়।”
এটাই যদি জিন্নাহ বিশ্বাস করতেন এবং সে বিশ্বাসেই জিন্নাহ ৬ জন মুসলিম, ৬ জন হিন্দু প্রতিনিধির সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চেয়েছিলেন বা এমন সরকারে রাজী ছিলেন, তাহলে স্বাধীন পাকিস্তানে তিনি সেটাই কার্যকর করতেন। পাকিস্তানী সরকারে সম-সংখ্যক মুসলিম-অমুসলিম প্রতিনিধি রাখতেন।
@আলমগীর হুসেন,
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটা আপনি ভুলে যাচ্ছেন বা এড়াতে চাচ্ছেন। এই চুক্তিতে মুসলীম প্রধান প্রদেশগুলি ইচ্ছে করলে একত্রিত হয়ে এক সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে তার প্রভিশান ছিল। কিন্তু নেহরু শক্তিশালী কেন্দ্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি এই ওয়াভেল প্রস্তাবকে নিজের ব্যাখ্যা দিয়ে বলছিলেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠ্যয়তার জোরে সেই অপশান নাকচ করে দেয়ার অধিকার কংগ্রেস রাখবে ভবিষ্যতে। তাই জিন্নাহ সমতা চেয়েছিলেন সেটা এড়াবার জন্য। এটা সর্বকালের জন্য নৈতিক কোন অবস্থান ছিল না জিন্নাহর। বিশেষ পরিস্থিইর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। ভারত তখনো স্বাধীন হয় নি আর কোন সংবিধানই রচন হয় নি। তাই সাংবিধানিক রক্ষাকবচের কোন নিশ্চয়তা ছিল না। একবার দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে (পাকিস্তান হোক বা ভারতই হোক) আর সংবিধান রচনা হয়ে গেলে সেই সমতার প্রয়োজন আর থাকেনা। আর এই দাবী তো সঙ্খ্যালঘু মুসলীমদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবার ভয় থেকেই উত্থাপিত। স্বাধীন পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের তো সেরকম কোন স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রভিশান ছিল না। প্রভিশান থাকলে আর মুসলীম সংখ্যাগরিষ্ঠ্যতার জোরে জিন্নাহ যদি তা নাকচ করতে পারতেন (নেহরুর মত) তাহলে হিন্দুদের কোন প্রতিনিধিও পাকিস্তান সংবিধান রচনার আগে সমতা দাবী করতে পারতেন ন্যায়সঙ্গতভাবে। কিন্তু এগুলি সবই কেবল “যদি”, আলোচনার খাতিরে।সেরকম তো ঘটেনি। আপেলের সাথে আপেলেরই তুলনা চলে। স্বাধীনতা পূর্বের ভারতের অন্তর্বর্তীকালীন সংসদ আর স্বাধীনতা পরবর্তী সার্বভৌম পাকিস্তান বা ভারতের সংসদ এক জিনিষ না।
@আলমগীর হুসেন,
আপনি ঐতিহসিক প্রেক্ষাপটটা ভুলে যাচ্ছেন বা এড়াতে চাচ্ছেন। ওয়াভেলের প্রস্তাবের একটা প্রভিশান ছিলযে মুসলীম প্রধান প্রদেশগুলি ইচ্ছে করলে গ্রুপিং এর মাধ্যমে পৃথক সার্বভৌম দেশ গঠন করতে পারবে। কিন্তু নেহরূ শকিশালী কেন্দ্রে বিশাসী ছিলেন আর দাবী করেছিলেন যে সংখ্যাগরিষ্ট্যতার জোরে কংগ্রেস সেই অপশান নাকচ করে দেবার অধিকার রাকখে ভবিষ্যতে। ভারত তখনও স্বাধীন হয় নি এবং কোন সংবিধানই রচনা হয় নি। তাই মুসলীমদের এই অপশান বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক রক্ষাকবচ ছিল না। তাই জিনাহ সমতা চেয়েছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সংসদে। এটা সর্বকালের জন্য কোন নৈতিক অবস্থান ছিল না বা থাকতে পারে না। এটা বিশেষ সময়ের বিশেষ দাবী। স্বাধীন ভারত বা পাকিস্তানে এর প্রয়োজন থাকতে পারে না। হাইপোথেটিক্যালি, যদি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় এরকম কোন প্রভিশান থাকত যে হিন্দু সংখ্যালঘুরা ইচ্ছে করলে সাধীন হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে আর জিন্নাহ যদি বলতেন যে সংখ্যাগরিষ্ট্যতার জোরে তিনি সেই অপশান বাতিল করে দিতে পারেন, তাহলে কোন হিন্দু নেট সমতার দাবী তুলতে পারতেন ন্যয়সঙ্গতভাবেই। কিন্তু সেটা তো ঘটেনি। আপেলের সাথে আপেলের তুলনা চলে।
@কালযাত্রী,
আপনার বক্তব্য মোটামুটি ঠিক আছে। তবে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের প্রভিশনটা ওয়েবেলের নিজস্ব কোন অভিব্যক্তি ছিল না। বরং সেটা বিগত কয়েক দশক ধরে মুসলিমদের ইসলামী সাম্প্রদায়িক ও হিন্দু-বিদ্বেষী কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনের ফসল, যার সূচণা করেন সৈয়দ আহমদ-স্যার সলিমুল্লাহ প্রমুখ (১৯০৬) এবং পরিপুষ্ট হয় খিলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ও আল্লামা ইকবাল প্রমুখদের হাতে — যেখান থেকে জিন্নাহ সে আন্দোলনের নেতৃত্ব হাতে নেন।
বেশ বড়সড় এবং কষ্টসাধ্য একটা কাজ হাতে নিয়েছেন। শুভকামনা রইলো।