মা

আকাশ মালিক

১৮ মার্চ রবিবার ২০১২, স্কুল ছুটির দিন। ঘরে ছেলে মেয়েদের হুলুস্থুল, বউয়ের মাথা খানিকটা গরম। সন্তানদের উপর মায়ের হালকা ধমক, বকুনি ঝাকুনি, চিল্লাচিল্লি না হলে উইকএন্ডটা পুরোপুরি জমে উঠেনা। এদিকে সন্তানদের মধ্যে ফিসফিস কানাকানি চলছে আজ মা-দিবসে স্নেহময়ী মা জননীকে কার্ড আর উপহার দেয়া হবে। এক পর্যায়ে ছোট মেয়েটি সকল গোপনীয়তা ভঙ্গ করে তার মাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো- ‘বলো মা, তোমার কোন জিনিসটা বেশী পছন্দ’। প্রতিবারের মতো যথারীতি সেই একই উত্তর-‘আমার কিচ্ছুর দরকার নাই, তোমরা ভাল থেকো, ভাল মানুষ হও, তোমরা বেঁচে থেকো অনেক অনেক দিন’। এটা একটা কথা হলো? সন্তান গর্ভে থাকতে নিজের রক্ত-মাংস খাওয়ালে, ভুমিষ্ট হওয়ার পর বুকের দুধ মুখে তুলে দিলে, এতোটা বিনিদ্র রজনী কাটালে, এতোটা বৎসর মল-মূত্র সাফ করলে, বিনিময়ে তোমার কিছুই চাওয়ার নেই? মায়ের হাতে কার্ডটা একজন তুলে দিল। মা কার্ডটা হাতে নিয়ে সন্তানদের দিকে তাকালেন। মায়ের চাহনীতে ছিল এক অকল্পনীয় মায়া, ঠোঁটে ছিল অতুলনীয় আশ্চর্য এক মধুভরা হাসি। এ হাসি শুধু মায়েরাই হাসতে জানেন। আমি নিজে আমার মাকে কোনদিন কিছু দেইনি, দেয়ার সুযোগও পাই নি। খুব ছোটকালে মা মারা যান। আমার বয়স তখন নয় কি দশ হবে। সিনেমায় দেখেছি মৃত্যু শয্যায় শায়ীত সন্তানের সামনে মাকে বিলাপ করতে- ‘আল্লাহ তুমি আমাকে নিয়ে যাও আমার সন্তানকে নিওনা’। আসলে বাস্তবেও একবার এমনটি দেখেছি। প্রায় পয়তাল্লিশ বছর পূর্বে একবার আমাদের গ্রামে কলেরা লেগেছিল। এক মায়ের পরিবারে একদিনের মধ্যে একে একে চারটি সন্তান মারা গেল। মা কখনো আকাশের পানে হাত তুলে, কখনো দুই হাতে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বারবার মিনতি করছিলেন- ‘আল্লাহ তুমি আমাকে নাও আমার সন্তানদের নিওনা’। আমার মা বোধ হয় এমনই প্রার্থনা করেছিলেন যা আল্লাহর কাছে মঞ্জুর হয়ে গিয়েছিল। মায়ের সাথে একটা ঘটনা চিরদিন মনে থাকবে। আমার মুসলমানী করানোর সময় মায়ের হাতের গোসল। সেই সুগন্ধি সাবান আর মনমাতানো তেল জীবনে দ্বিতীয়বার দেখিনি। কানটার ভেতর তোয়ালে মোড়া আঙ্গুল ঢুকিয়ে মা বলেছিলেন- এতো বড় ব্যাটা হলি, নিজের কানটাও সাফ করতে জানলিনা। আরো একবার মাকে খুব মনে পড়েছিল। বিয়ের সময় গায়ে হলুদের দিন। আমি নিশ্চিত জানি, মা জীবিত থাকলে আমাকে গোসল করাতে আসতেন, নাকে মুখে জোরেজোরে ঘসে দিতেন আর বলতেন- এতো বড় ব্যাটা হলি, নিজের কানটাও সাফ করতে জানলিনা। মায়ের মৃত্যু আমি দেখেছি, সেই মৃত্যুক্ষণটা আমার এখনও ঝাপসা মনে আছে।

ঘরে যখন মা দিবসের উৎসব চলছে, আমি এই মহান দিনটির তাৎপর্য আর ইতিহাস জানার জন্যে গুগলের স্মরণাপন্ন হলাম। ‘মা-দিবস’ এর আইডিয়াটা করেছিলেন, ১৮৭০ সালে Julia Ward Howe নামের আমেরিকান সমাজকর্মী এক মহিয়সী মহিলা। তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন, যুদ্ধে আহত, নিহিত, হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের মায়েদের বুকের ক্রন্দন, তাদের অন্তর-আত্মার বেদনা। বিশ্বকে তিনি শুনিয়েছিলেন এক সাম্যের বাণী। সন্তানের জন্যে জগতের সকল মায়ের ভালবাসায় কোন ভিন্নতা নাই। জাতি, ধর্ম, বর্ণের শ্রেষ্টত্বের বিভেদ টিকিয়ে রাখার জন্যে কোন মায়ের বুকের ধন কেড়ে নেয়া অন্যায়। তিনি এর প্রতিবাদে বিশ্বের সকল মাকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহবান করেন। যদিও তিনি তার কাজে পুরোপুরি সফলকাম হতে পারেন নি, তার এই মহান কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন Anna Jarvis এর কন্যা, দ্বিতীয় Anna Jarvis। জুলিয়া ওয়ার্ডের পথ ধরে সুদীর্ঘ ৩৭ বৎসর সংগ্রামের পর ১৯০৭ সালে প্রথমবারের মতো ‘মা দিবস’ উৎসব পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে উদযাপিত হয়। আজ সারা পৃথিবী জুড়ে এপ্রিল থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এ মহান দিনটি পালিত হয়।

পৃথিবীতে এমন অনেক শিশু আছে যাদের জন্মের পর থেকেই মা নাই। আবার এমন শিশুও আছে যাদের মা জীবিত থেকেও তাদের জন্যে নাই। মা দিবসের ইতিহাস খোঁজাখুঁজির মাঝেই এক সময় এক অনন্যা অসাধারণ মা ও তার আশির্বাদ প্রাপ্ত এক ভাগ্যবান সন্তানের সন্ধান পেয়ে যাই। সেই ঘটনায় যাওয়ার আগে গানে গানে ‘মা দিবস’ উৎসবটার সমাপ্তি টেনে নিতে চাই। শুরুতে সাদী মুহাম্মদের কণ্ঠে ‘মাকে মনে পড়ে আমার’ ঠিকই ছিল, কিন্তু শেষ মুহুর্তে মনটা আটকা পড়ে গেল মমতাজের একটি গানে। হতে পারে এ জন্যে যে, এই গানের দৃশ্যটিতে আমি দেখতে পাই বহু বছর পূর্বে দেখা মৃত্যুশয্যায় শায়ীত আমার মাকে।
http://www.youtube.com/watch?v=e3G_cP-Ry-I

মমতাজের কণ্ঠে দরদী মায়ের গানটা শুনার পর চলুন আমরা সেই অসাধারণ মায়ের আশির্বাদ প্রাপ্ত সন্তানের কিছু কথা জেনে নিই। কথাগুলো শিশুটির ভাষায়ই শুনা যাক-

আমার সবগুলো কথা মায়ের কাছ থেকে শুনা। তখন সবেমাত্র কথা বলতে শিখেছি। মা যখনই আমার কোন কাজে ‘গুড বয়’ বলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন, আমি মাকে শোধরাতাম এই বলে- ‘গুড বয়’ নয় মা, বলো ‘গুড গার্ল’। মা তখন মনে করতেন সেই বয়সে আমি ‘গার্ল’ আর ‘বয়’ এর পার্থক্য বুঝতাম না। তিনি অবাক হতেন আমি যখন বড় বোনের লিপষ্টিক, নখ পালিশ নিয়ে খেলা করতাম। দিন দিন আমার প্রতি মায়ের সন্দেহ বাড়তে থাকে। দুই বৎসর বয়সের সময় একদিন মাকে যখন বললাম- ‘মা, ফ্যারি গড মাদার তার ম্যাজিক-কাঠি নিয়ে কবে আসবে, আমার শিশ্ন (Genitalia) কেটে ফেলে আমাকে মেয়ে বানাতে’? আমার কথা শুনে মায়ের শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার উপক্রম। সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। ইত্যবসরে মা, ‘মেন্টেল ডিসওর্ডার’, ‘আইডেন্টিটি ডিসওর্ডার’ এর উপর কিছু বই-পত্র পড়লেন। শেষ পর্যন্ত আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘হোয়াট ইজ ইয়র নেইম বয়’? আমি বললাম ‘বয়’ নয় বলুন ‘গার্ল’। ডাক্তার মাকে জিজ্ঞেস করলেন- হাউ ওল্ড ইজ হি? আমি বললাম, আই এম নট ‘হি’ আই এম ‘শি’। তারপর ডাক্তার দুটো পুতুল আমার সামনে নিয়ে আসলেন। একটি ‘বয়’ আর একটি ‘গার্ল’। তিনি জিজ্ঞেস করলেন- ‘বলো তো, এদের মধ্যে তুমি কোনটা’? আমি ছেলে-পুতুল দেখিয়ে বললাম- ‘এখন আমি এইটা’। তারপর মেয়ে-পুতুল কোলে নিয়ে বললাম- ‘আমি হতে চাই এইটা’। এর কিছুদিন পর আমাকে কিছু ওষুধ-পত্র দেয়া হলো যাতে আমার গায়ে পুরুষের লোম বা দাড়ি না গজায়।

বিষয়টা পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে জানাজানি হয়ে গেল। পাপ-পুণ্যের কথাও আমার কানে আসলো। একদিন মাকে বললাম- ‘মা, ঈশ্বর নিশ্চয়ই ভুল করে আমার দেহে একটি শিশ্ন জুড়ে দিয়েছেন’। মা বললেন- ‘ভুল নয় সোনামণি। কারো ভুল নেই, না তোমার, না আমার, না তোমার বাবার, না ঈশ্বরের। ঈশ্বর তোমাকে স্পেশিয়েল করে গড়ে দিয়েছেন’। তিনি আরো বললেন- ‘দেখো, জগতে তোমার মতো আর কয়জন মেয়েশিশু আছে যার একটা শিশ্নও আছে’? শুনে আমি খুব খুশী হলাম। পাঁচ বৎসর বয়সে মা আমাকে স্কুলে, ও ক্লাবে ভর্তি করাতে গিয়ে প্রচুর অসুবিধের সম্মুখীন হয়েছিলেন। একদিন স্কুলের ক্রিস্টমাস পার্টিতে আমার ক্লাসের মিস্ আমাকে মেয়েদের পোষাক পরে ডান্স করতে দিলেন না। রাগে অভিমানে মাকে জড়িয়ে ধরে প্রচুর কেঁদেছিলাম। সেই দিনই মা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে মেয়ে হিসেবেই দুনিয়ার সামনে পরিচয় করিয়ে দিবেন।

এ ছিল আমেরিকার একটি শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নেয়া একটি হিজড়া বা Transgender শিশুর ছোট্ট কাহিনি। সে তার মায়ের আদরে সোহাগে বড় হয়েছে। তার ইচ্ছেমত জীবন যাপনের সকল সুযোগ সুবিধে ভোগ করতে তার মা, তার দেশ ও তার সমাজ থেকে সমর্থন পেয়েছে। প্রতি বৎসর মা দিবসে সে তার মাকে কার্ড উপহার দিতে পারছে, মাকে মা বলে ডাকতে পারছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্থে জন্ম নেয়া সকল হিজড়া শিশু এমন ভাগ্য নিয়ে জন্ম নেয় না। অথচ প্রত্যেক মায়ের মাতৃত্ববোধ, সন্তানের প্রতি স্নেহ-মমতায় কোন ভিন্নতা বৈষম্যতা নেই। প্রত্যেক সন্তানের অন্তরেই একজন মা সর্বক্ষণ বাস করেন। আমেরিকার শিশুটির কাহিনি পড়ার পর, হিজড়া সন্তানদের নিয়ে ইউ টিউবে কিছু ডকুমেন্টারি খুঁজছিলাম। হঠাৎ বাংলাদেশে তৈরী একটি ছবিতে চোখ পড়ে গেলো। হিজড়াদের নিয়ে বাংলাদেশে যে এমন একটি শিক্ষণীয়, অভুতপূর্ব ছবি তৈরী হয়েছে জানতাম না। অনেকেই হয়তো ইতোমধ্যে দেখেছেন। যারা দেখেন নাই, অনুরুধ রইলো তারা যেন ফিল্মটির শেষ না দেখে উঠে না যান । চলুন, আজ মা দিবসে ছবিটা আরেকবার দেখে নিই।

আর হ্যাঁ, ছবিটি দেখে কারো চোখ যদি অশ্রুজলে ঝাপসা হয়ে আসে, যদি কারো অন্তরাত্মা কেঁদে উঠে, যদি হতভাগা হিজড়াদের মায়ের বুকের চাপা ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পান, এই মা দিবসে তাদের জন্যে দু-কলম লিখুন। দুনিয়াকে জানিয়ে দিন, হিজড়া সন্তান কারো পাপের প্রায়শ্চিত্ত নয়, তাদের মা জগতের সকল মায়েরই মত্‌। প্রত্যেক হিজড়া সন্তানের তার মাকে মা ডাকার অধিকার আছে। এখানে দেখুন প্রকৃতির আরেক লীলাখেলা।