(নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের জীবনকাহিনি)

আজ ১১ মে। রিচার্ড ফাইনম্যানের জন্মদিন। ১৯১৮ সালের ১১ মে নিউ ইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ডায়নামিক পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান। এম-আই-টি থেকে বিএসসি ডিগ্রি পান ১৯৩৯ সালে। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ১৯৪২ সালে। কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত। তারপর ১৯৫০ থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ক্যালটেকে অধ্যাপনা করেছেন। কোয়ান্টাম ইলেকট্রো-ডায়নামিক্স এর অন্যতম জনক তিনি। ১৯৬৫ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন যে কাজের জন্য – মাত্র তেইশ বছর বয়সেই সে কাজের সূত্রপাত। পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক প্রকল্প – ম্যানহাটান প্রজেক্টের হিউম্যান-কম্পিউটার হিসেবে কাজ করেছেন ফাইনম্যান। যে ন্যানো-টেকনোলজির প্রয়োগ এখন ওষুধ থেকে শুরু করে জীবনের হাজারো ক্ষেত্রে সেই ন্যানো-টেকনোলজির প্রাথমিক ধারণার উৎপত্তি ফাইনম্যানের হাতে। মৌলিক কণার কার্যকলাপ বোঝার জন্য ফাইনম্যান-ডায়াগ্রাম সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি। পদার্থবিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যেখানে ফাইনম্যান কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন নি। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ফাইনম্যানের মত এমন ভালো শিক্ষক আর কখনো পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে ক্লাসিক টেক্সট বইয়ের নাম ‘ফাইনম্যান লেকচার অন ফিজিক্স’ যা রচিত হয়েছে তাঁর ক্যালটেকের ক্লাসরুমে দেয়া লেকচারগুলো থেকে। আইনস্টাইনের পরে ফাইনম্যানই ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে সৃষ্টিশীল বহুমাত্রিক পদার্থবিজ্ঞানী। ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয় ফাইনম্যানের।

ফাইনম্যানের জীবন ও বিজ্ঞান এত বিচিত্র যে অল্প কথায় তা শেষ করা যাবে না। ফাইনম্যানের সাক্ষাৎকার ও চিঠিপত্রের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে বেশ কিছু বই যা থেকে কিছুটা পরিচয় পাওয়া যাবে ফাইনম্যানের বহুমাত্রিক জীবনের। ফাইনম্যানের নিজের কথা “শিওরলি ইউ আর জোকিং মিস্টার ফাইনম্যান”, “হোয়াট ডু ইউ কেয়ার হোয়াট আদার পিপল থিংক”, “টুভা অর বাস্ট”, এবং “ডোন্ট ইউ হ্যাভ টাইম টু থিংক?” অবলম্বনে শুরু হলো ‘আপন আলোয় ফাইনম্যান”।


মা-বাবার সাথে পাঁচ বছর বয়সে বেলারুশ থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন মেলভিল ফাইনম্যান ১৮৯৫ সালে। তারপর বেড়ে উঠেছেন নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডে আরো অনেকগুলো অভিবাসী ইহুদি পরিবারের ছেলে-মেয়েদের সাথে। বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর, ইচ্ছে ছিল বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা নেবেন। কিন্তু নতুন দেশে ইহুদি অভিবাসী হিসেবে খুব একটা টাকা-পয়সা ছিল না তাঁর বাবার। তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে ডিগ্রি নেয়া সম্ভব হয়নি মেলভিল ফাইনম্যানের। কম খরচে বিজ্ঞানের কাছাকাছি যা পড়তে পারলেন তা হলো হোমিওপ্যাথি। কিন্তু উপার্জনের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি তেমন কোন কাজে লাগলো না। পুলিশ ও পোস্টাল অফিসারদের পোশাক সরবরাহের ব্যবসা শুরু করলেন কোন রকমে। ব্যবসা তেমন জমলো না। ক্লিনিং সার্ভিস শুরু করার চেষ্টা করলেন – তাও হলো না। শেষে আবার ইউনিফর্ম সরবরাহের ব্যবসাতেই ফিরে এলেন। খুবই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল তাঁর ব্যবসা।

১৯১৭ সালে মেলভিল বিয়ে করেন লুসিল ফিলিপ্‌সকে। লুসিলের সাথে মেলভিলের পরিচয় ১৯১৪ সালে বেশ নাটকীয় ভাবে। বড়লোকের মেয়ে লুসিল পড়াশোনা করেছেন অভিজাত ইহুদি স্কুলে। পাস করার পর কিন্ডারগার্টেনে পড়ানো শুরু করেছেন। অবসর সময়ে বান্ধবীদের সাথে ঘুরে বেড়ান। লুসিলের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী প্রেমে পড়েছেন। বান্ধবীর প্রেমিক প্রস্তাব দিয়েছেন লং ড্রাইভে যাবার। পরিকল্পনা মতো বান্ধবীর সাথে লুসিলও গেলেন লং ড্রাইভে। সেখানে পরিচয় হলো বান্ধবীর প্রেমিকের বন্ধু মেলভিলের সাথে। শিক্ষিত স্মার্ট বুদ্ধিমান মেলভিলকে ভালো লেগে গেলো লুসিলের। কিন্তু লুসিলের বাবা হেন্‌রি ফিলিপ্‌স এ সম্পর্ক ঝুলিয়ে রাখলেন আরো তিন বছর। ১৯১৭ সালে লুসিলের বয়স একুশ হয়ে গেলে বাবা আর বাধা দিয়ে রাখতে পারলেন না। বিয়ের পরে মেলভিন ও লুসিল বাসা নিলেন ম্যানহাটানে। পরের বছর ১৯১৮ সালের ১১ মে ম্যানহাটানের একটা হাসপাতালে জন্ম নিলো তাঁদের প্রথম সন্তান – রিচার্ড ফিলিপ্‌স ফাইনম্যান।

রিচার্ড ফাইনম্যানের নিজের কথাতেই শোনা যাক কীভাবে তাঁর বাবা মেলভিন ফাইনম্যানের কাছে হয়েছিল তাঁর বিজ্ঞানের হাতেখড়ি।

বিজ্ঞানের হাতেখড়ি

আমার একজন আর্টিস্ট বন্ধু আছে। সে মাঝে মাঝে এমন কিছু কথা বলে যা আমি ঠিক মেনে নিতে পারি না। যেমন- একটা ফুল নিয়ে এসে তার বোঁটা ধরে আমাকে বলবে, “দেখো ফুলটা কী সুন্দর”। ফুলটা যে সুন্দর সে ব্যাপারে আমি তার সাথে অবশ্যই একমত। কিন্তু যখন সে বলে- “একজন আর্টিস্ট হিসেবে আমি বুঝতে পারি ফুলের সৌন্দর্য। দেখতে পাই ফুলটা কত সুন্দর। কিন্তু তুমি? একজন সায়েন্টিস্ট হিসেবে ফুলটার সব অংশকে আলাদা আলাদা করে দেখো। ফলে ফুলটা হয়ে পড়ে সাদামাটা, সৌন্দর্যহীন, কদর্য”। তার এ জাতীয় কথা শুনলে তাকে আমার পাগল বলে মনে হয়।

এই যে ফুলের সৌন্দর্য, যেটা সে দেখতে পায়- সেটা অন্য সবাইও দেখতে পায়। আমিও পাই। আমি জানি আমি ফুলের সৌন্দর্য দেখতে পাই। হতে পারে আমি তার মত ততোটা বিশুদ্ধ সৌন্দর্য বিশারদ নই। কিন্তু তবুও তো আমি সৌন্দর্যটা দেখতে পাই। ফুলের সৌন্দর্য আমিও উপভোগ করি। এবং একই সাথে ফুলটার মধ্যে সে যতটা দেখতে পায় তার চেয়েও বেশি দেখি আমি। আমি ফুলটার ভেতরের কোষগুলোর গঠন বুঝতে পারি। ঐ সূক্ষ্ম কোষগুলোরও আলাদা সৌন্দর্য আছে। সেগুলোর সৌন্দর্য হয়তো ফুলটার মত সেন্টিমিটারের স্কেলে হবে না – হবে আরো সুক্ষ্ম মাত্রায়।

এই সূক্ষ্ম কোষগুলির জটিল ক্রিয়াকলাপ আছে। আরো অনেক সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া আছে কোষের ভেতরেও। ব্যাপার হলো এই যে রং – যেটা ফুলের সৌন্দর্যের জন্য দায়ী, সেটার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু বংশবৃদ্ধির লক্ষ্যে পতঙ্গকে আকৃষ্ট করা। তার মানে দাঁড়ায় কীটপতঙ্গও রং দেখতে পায়। এটা আরো একটা প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই যে সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধ তা কি তাহলে নিচুস্তরের কীটপতঙ্গের মধ্যেও আছে- যেমন আছে মানুষের? এরকম আরো অনেক মজার মজার প্রশ্ন আসে, যা মূলত আসে বিজ্ঞানের জ্ঞান থেকেই। এই যে মনে প্রশ্ন আসা এবং তার উত্তর খোঁজা এটা তো ফুল দেখার আনন্দকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। তাই আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না- এভাবে আলাদা করে দেখলে ফুলের সৌন্দর্য নষ্ট হয় কীভাবে?

আমি আসলেই বড় বেশি বিজ্ঞানঘেঁষা। বলা যায় বিজ্ঞানের ব্যাপারে এক চোখা। যখন আমি ছোট ছিলাম- তখন থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আমি আমার সবটুকু সময় বা সাধনা কেন্দ্রিভূত করে রেখেছি। তখন মানবতা কী জিনিস বা মানবিক ব্যাপার-স্যাপারগুলো নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময়ও আমার ছিল না, ধৈর্যও ছিল না। যদিও স্কুল পর্যায়ে ওরকম কিছু বিষয় আমাকে পড়তে হতো। ডিগ্রি পাবার জন্য ওগুলো অত্যাবশ্যক ছিল কিন্তু আমি প্রাণপণে চেষ্টা করতাম ওসব এড়িয়ে চলতে। বড় হবার পরে যখন কিছুটা সময় হাতে পেয়েছি – মানবিক বিষয়গুলোর কিছু কিছু পড়েছি। কিছু কিছু আঁকতেও শিখেছি। তবুও বিজ্ঞানের ব্যাপারে আমি এখনো ভীষণ একচোখা মানুষ, ভয়ানক একপেশে। মানবতা বা মানবিক বিষয়গুলো সম্পর্কে, শিল্পকলা সম্পর্কে এবং এরকম আরো অনেক বিষয় সম্পর্কে আমি ধরতে গেলে কিছুই জানি না। আমার জ্ঞান খুব সীমাবদ্ধ এবং যা জানি তাকেও আমি একটা সুনির্দিষ্ট দিকে ব্যবহার করি।

আমার জন্মের আগে আমার বাবা আমার মাকে বলেছিলেন, “যদি ছেলে হয়- তবে সে বিজ্ঞানী হবে”। এখানে বলা প্রয়োজন তখনকার দিনে মনে করা হতো ছেলেরাই শুধু বিজ্ঞান পড়বে। কিন্তু আমার ছোটবোন জোয়ানও ফিজিক্সে পিএইচডি করেছে।

যখন আমি খুব ছোট- একটা চেয়ারের চেয়েও ছোট আমার উচ্চতা- তখনকার কথা। বাবা একদিন অনেকগুলো টাইল্‌স নিয়ে এসেছেন। ছোট ছোট টাইল্‌স। নানা রঙের টাইল্‌স। আমরা ওগুলো নিয়ে খেলতাম। আমরা মানে আমি আর বাবা। বাবা টাইল্‌সগুলো একটার পর একটা একটা করে খাড়াভাবে মেঝের ওপর বসিয়ে দিতেন। আর আমি এক প্রান্তের একটা টাইল্‌সে ছোট্ট ধাক্কা দিয়ে পুরো লাইনকে ফেলে দিতাম। টাইল্‌সগুলো পড়ার সময় একটা ঢেউ-এর মত লাগতো।

কিছুদিন পরে আমি নিজে নিজেই টাইল্‌সগুলো ওভাবে বসাতে শিখে গেলাম- বাবার সাহায্য ছাড়াই। আস্তে আস্তে আমাদের টাইল্‌স সাজানোর প্রক্রিয়ায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হলো। এবার পরপর দুটো সাদা টাইল্‌স, তারপর একটা নীল, আবার দুটো সাদা একটা নীল এভাবে সাজাতে লাগলাম। আমি এ নিয়মের কোন ব্যতিক্রম করলে বাবা টাইল্‌স বদলে দেন। আমার মা যখন দেখলো বাবা আমাকে আমার ইচ্ছেমত টাইল্‌স বসাতে দিচ্ছে না- বিরক্ত হয়ে বললো- “কেন বাচ্চাটাকে কষ্ট দিচ্ছো? তাকে নিজের মত খেলতে দাও না। সে লাল নীল যা বসাতে চায় – দাও না বসাতে”।

কিন্তু বাবা বললেন- “না। আমি তাকে দেখাতে চাচ্ছি কোন্‌ প্যাটার্ন দেখতে কেমন লাগে। কোন্‌ প্যাটার্নে কতটা সৌন্দর্য তা খুঁজে বের করা এক ধরণের প্রাথমিক গণিতের মতো”। এভাবে আমার বাবা খুব ছোটবেলা থেকেই আমাকে পৃথিবীর বিভিন্ন মজার মজার জিনিস সম্পর্কে, মজার মজার ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বলতেন।

আমাদের বাড়িতে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’র সবগুলো ভল্যুমই ছিল। আমার একেবারে শিশু বয়স থেকেই বাবা আমাকে তাঁর কোলে বসিয়ে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা থেকে পড়ে শুনাতেন এবং তা নিজের মত করে ব্যাখ্যা করতেন। যেমন তিনি হয়তো পড়ছেন ডায়নোসর সম্পর্কে। হয়তো ‘টায়নারোসরাস রেক্স’ এবং যার সম্পর্কে বইতে হয়তো আছে – “এই ডায়নোসরটি পঁচিশ ফুট উঁচু আর তার মাথাটা ছ’ফুট চওড়া”। বাবা এখানে পড়া থামাতেন। বলতেন- “এখন আমরা দেখি এটা আসলে কী বোঝাতে চাচ্ছে। ধরো ডায়নোসরটি নিচে আমাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে তার মাথা উঠে আসবে ঠিক আমাদের এই জানালা পর্যন্ত”। আমরা তখন তিন তলায় থাকতাম। বাবা তারপর বলতেন- “কিন্তু ডায়নোসরটি জানালা দিয়ে মাথাটা ঘরের ভেতরে ঢুকাতে পারবে না। কারণ তার মাথাটা ছ’ফুট চওড়া। আমাদের জানালাটার চেয়ে অনেক বড়”। এরকমভাবে যা কিছু তিনি পড়তেন বা আমাকে পড়াতেন- সবকিছুই যতটুকু সম্ভব বাস্তব উদাহরণ দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করতেন।

ডায়নোসরের কাহিনি খুব লোমহর্ষক লাগতো। ভাবতেই কেমন যেন লাগতো যে এত বিরাট বিরাট প্রাণী এই পৃথিবীতে ছিল একসময়। এখন সব মরে গেছে। কেন মরে গেছে তা সঠিকভাবে কেউ এখনো জানে না। আমি মোটেও এরকম ভাবতাম না যে ডায়নোসরদের কেউ এখনো বেঁচে আছে এবং আমাদের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব আমার মনেও আসতো না। আমি আমার বাবার কাছ থেকে এটা ভালো ভাবে রপ্ত করেছি যে যা কিছুই আমি পড়ি- বুঝতে চেষ্টা করি যে আসলে কী বলছে বা কী বোঝাতে চাইছে।

আমরা মাঝে মাঝে ক্যাট্‌সকিল মাউন্টেনে (Catskill Mountains) যেতাম। নিউ ইয়র্ক শহরের মানুষ ওখানে যায় সামারের সময়। সারা সপ্তাহ শহরে থাকার পর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বেশ কয়েকটি পরিবার মিলে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এখানে চলে আসতেন অনেকে। এরকম একটা উইকএন্ডে বাবা আমাকে নিয়ে হাঁটছেন জঙ্গলের মধ্যে আর গাছপালা সম্পর্কে মজার মজার কথা বলছেন। অন্যান্য মায়েরা যখন এই দৃশ্য দেখলেন – তাঁরা ভাবলেন তাঁদের শিশুদের বাবাদেরও উচিত তাঁদের বাচ্চাদের এভাবে সাথে নিয়ে জঙ্গল দেখানো। তাঁরা চেষ্টা করলেন অন্যান্য বাবাদের রাজি করাতে। কিন্তু কোন বাবাই রাজি হলেন না। তখন সব মায়েরা এসে ধরলেন আমার বাবাকে- আমার বাবা যদি সবগুলো ছেলেমেয়েকে একসাথে নিয়ে জঙ্গলে হাঁটেন। কিন্তু আমার বাবা রাজি হলেন না। কারণ আমার আর বাবার সম্পর্ক ছিল অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, সাধারণ পিতাপুত্রের চেয়ে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ।

পরের সোমবার। সব বাবারা কাজে চলে গেছেন। আমরা শিশুরা খেলছিলাম মাঠে। একটা ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করলো- “ওই পাখিটা দেখছো? ওটা কী পাখি জানো?”
আমি বললাম- “ওটা কী পাখি সে সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই”।
সে বললো- “ওটা সবুজ ঠোঁটওয়ালা থ্রাস। তোমার বাবা দেখি কিছুই শেখাননি তোমাকে”।

কিন্তু আমার বাবা সম্পর্কে একথাটি মোটেও খাটে না। আমার বাবা পাখি সম্পর্কে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন- “দেখেছো পাখিটা? এটা হলো স্পেন্সার’স ওয়ার্বলার”। আমি জানতাম যে পাখিটার আসল নাম তিনি জানেন না। বাবা বললেন- “ইতালিয়ান ভাষায় এটা হলো ছুট্টু ল্যাপিটিডা। পর্তুগিজ ভাষায় বম ডা পেইডা। চায়নিজরা বলে চুং-লং-তা। জাপানিরা বলে কাতানো তেকেদা। এভাবে পৃথিবীর সবগুলো ভাষায় তুমি এই পাখিটার নাম জানতে পারো। কিন্তু এই নাম মুখস্ত করা যখন শেষ হবে – তখন? দেখবে পাখিটা সম্পর্কে তুমি কিছুই জানো না। তুমি আসলে জেনেছো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ পাখিটাকে কী নামে ডাকে। সুতরাং চলো আমরা দেখি আসলে পাখিটা কী করে এবং তার আচরণ থেকে কী বোঝা যায়”। এভাবে আমি সেই ছোটবেলাতেই জেনে গিয়েছিলাম যে কোন কিছুর নাম জানা আর আসলেই কোন কিছু জানার মধ্যে বিরাট ব্যবধান।

বাবা বলেন, “দেখো, পাখিরা প্রায় সময় তাদের পালক ঠোকরায়। দেখো দেখো- কেমন ঠোঁট দিয়ে ঠোকরাচ্ছে। দেখেছো?”
– “হ্যাঁ” – আমার উত্তর।
– “কেন পাখিরা এমন করে? তোমার ধারণা কী?”
আমি একটু ভেবে উত্তর দিলাম- “হয়তো উড়তে গিয়ে তাদের পালকগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। তাই নামার পরে ঠোঁট দিয়ে পালকগুলো ঠিক করে নেয়”।
– “ঠিক আছে। যদি তাই হয়, তাহলে তো উড়ে এসে বসার পরপরই অনেকবার ঠোকরাতো। তারপর আর ঠোকরাতো না। তুমি বুঝতে পারছো আমি কী বলতে চাচ্ছি?”
– “হ্যাঁ”।
– “চলো আমরা দেখি উড়ে নামার সাথে সাথে তারা বেশি করে পালক ঠোকরায় কি না”
অতগুলো পাখির মধ্যে কোন্‌টা এইমাত্র নামলো আর কোন্‌টা অনেকক্ষণ থেকে মাটিতে হাঁটছে তা বের করা সহজ নয়। সুতরাং আমি বললাম- “ঠিক আছে, দেখতে হবে না। তুমি বলো কেন পাখিরা এরকম করে”।

বাবা এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, “উঁকুন। উঁকুন তাদের বিরক্ত করে তো। তাই কিছুক্ষণ পর পরই ঠোঁট দিয়ে —”
“উঁকুনগুলো আসলে পালক থেকে বেরিয়ে আসা প্রোটিন খায়” – বাবা বলতে থাকেন।
“ঊঁকুনের পায়ে আছে কিছু আঁঠা জাতীয় পদার্থ। কিছু ছোট ছোট জীবাণু আছে যারা এই আঁঠা খেয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু তারা আঁঠাগুলো ঠিকমতো হজম করতে পারে না। কিছুটা বের করে দেয়। এই বের হওয়া পদার্থগুলোতে ব্যাকটেরিয়া জন্মে”।

আমাকে নিরব শ্রোতা পেয়ে বাবা বলতেই থাকেন- “সুতরাং তুমি দেখতে পাচ্ছো যেখানেই খাদ্য আছে সেখানেই কোন না কোন প্রাণী বা জীবাণু ওগুলো আবিষ্কার করে এবং তা খেয়ে বেঁচে থাকে”।

বাবার বলা কথাগুলোর সবটুকু হয়তো সঠিক নয়। পাখির পালকে হয়তো উঁকুন নয় বা উঁকুনের পায়েও কোন জীবাণূ জন্মায় না। কিন্তু যেখানেই খাদ্য আছে সেখানেই কিছু না কিছু প্রাণের অস্তিত্ব দেখা যায়। এটা নীতিগত ভাবে সঠিক।

অন্য একদিনের কথা। তখন আমি আরেকটু বড় হয়েছি। বাবা গাছ থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিলেন। পাতাটা একটু অন্যরকম। সাধারণত এমনটি দেখা যায় না। পাতাটা এক প্রকার বিধ্বস্ত- ছেঁড়া ছেঁড়া, মাঝখানে একটা বাদামি লাইন অনেকটা ইংরেজি ‘সি’ অক্ষরের মত। লাইনটা শুরু হয়েছে পাতার মাঝখান থেকে- আর শেষ হয়েছে পাতার একদম প্রান্তে গিয়ে।

“এই যে বাদামি লাইনটা দেখতে পাচ্ছো” – বাবা শুরু করলেন – “দেখো, এটা শুরুতে খুব সরু, এবং শেষের দিকে কেমন মোটা হয়ে গেছে। এটা কী আসলে? এটা আর কিছু নয়- এটা একটা মাছি। একটা নীল রঙের মাছি। হ্লুদ চোখ ও সবুজ পাখনার নীল মাছি। মাছিটি পাতায় ডিম পেড়েছিল। ডিম ফুটে যখন মাছির লার্ভা বের হয়েছে তখন থেকে এই পাতাটিই হয়েছে লার্ভার খাদ্য। পাতাটির এই লাইনটার ভেতর আস্তে আস্তে বড় হয়েছে লার্ভাটি। যতই বড় হয়েছে লাইনটি ততই মোটা হয়েছে। পাতার এই প্রান্তে আসতে আসতে লার্ভাটা পূর্ণাঙ্গ মাছি হয়ে উড়ে চলে গেছে। এই নতুন মাছিটিরও হলুদ চোখ, সবুজ ডানা আর গায়ের রঙ নীল। সেও এভাবে আর কোন গাছের কোন পাতায় ডিম পাড়বে এবং এভাবেই চলতে থাকবে”।

আমি জানতাম বাবার বিস্তারিত বর্ণনার সবটুকু হয়তো সঠিক নয়। মাছির বদলে অন্য কোন পোকাও হতে পারে- তাতে তেমন কিছু যায় আসে না। আসল যে ধারণা তিনি আমাকে দিতে চেয়েছেন তা হলো জীবনের উৎপত্তি ও বিকাশ। সবটুকুই আসলে পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়াটা কতটা জটিল তা নিয়ে কথা নয়, কিন্তু প্রক্রিয়াটি বার বার ঘটানোই প্রাকৃতিক কাজ।

অন্যদের বাবা সম্পর্কে আমার কোন অভিজ্ঞতা না থাকার দরুণ আমি ঠিক বুঝতে পারতাম না আমার বাবা কত বেশি জানেন বা তিনি এতসব বিজ্ঞান শিখলেন কীভাবে এবং কেনই বা শিখলেন? আমি তাঁকে কখনো জিজ্ঞাসা করিনি। বাবা আমাকে শিখিয়েছেন যে কোন জিনিস খুব মনযোগ দিয়ে দেখতে। একদিন আমি একটা খেলনা গাড়ি ‘এক্সপ্রেস ওয়াগন’ নিয়ে খেলছিলাম। ওটার চারপাশে রেলিং দেয়া ছিল এবং তার মাঝখানে ছোট্ট একটা
বল রেখে আমি খেলছিলাম। যখন আমি গাড়িটি টানছিলাম- দেখলাম বলটি পেছনের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বাবার কাছে গিয়ে বললাম, “বাবা, একটা নতুন ব্যাপার দেখলাম। আমি যখন গাড়িটি টানছিলাম বলটি পেছনের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছিলো। এরপর যখন আমি হঠাৎ থামলাম বলটি পেছন দিক থেকে সামনের দিকে গড়িয়ে এলো। কেন এমন ঘটছে?”

বাবা বললেন, “কেন এটা ঘটছে তা কেউ জানে না। সাধারণ নিয়ম হলো চলমান বস্তু চলতে চায়, আর যে বস্তু থেমে আছে তা থেমে থাকতেই পছন্দ করে। বস্তুর এই ধর্মটাকে বলে ‘জড়তা’। কিন্তু এটা কেন হয় তা কেউ জানে না”। বুঝলাম। তিনি সরাসরি বলে দিলেন না যে এটাকে ‘জড়তা’ বলে। তিনি বিষয়টা আরো ব্যাখ্যা করলেন। “তুমি যদি পাশ থেকে দেখো, দেখবে তুমি বলটাকে যেদিকে টানছো তা তার পেছন দিক। এখন যদি স্থির বলটা সহ গাড়িটাকে তুমি পেছন দিকেই টেনে নিয়ে যাও- দেখবে বলটা স্থির থাকছে। আসল ব্যাপার হলো ঘর্ষণ থেকে এটা সামান্য বল পায় এবং সামনের দিকে এগিয়ে আসে, পেছনের দিকে যায় না”। আমি ছুটে এলাম আমার ছোট্ট গাড়িটির কাছে। দেখলাম বাবার কথাই ঠিক। বলটা গাড়ির ওপর বসিয়ে গাড়িটা টানলাম এবং পাশ থেকে দেখলাম। বলটা সামান্য এগুলো সামনের দিকে।

এরকম ছোটখাট উদাহরণ ও প্রাণবন্ত আলোচনার মাধ্যমে এভাবেই আমি আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি অনেক কিছু। তিনি কখনো কোন কিছুর জন্য জোর করেন নি। বাবার এরকম শিক্ষার প্রভাব আমার সারাজীবন জুড়ে আছে। আমি বিজ্ঞানের সবগুলো শাখার প্রতিই অনুরক্ত, পদার্থবিজ্ঞানটা একটু বেশি করেছি এই যা।

সেসময় আমার এক মাসতুতো ভাই হাইস্কুলে পড়তো। সে আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। বীজগণিত নিয়ে ভীষণ ঝামেলায় পড়েছে সে। তাই তারজন্য একজন টিউটর রাখা হলো। টিউটর যখন পড়াতেন তখন আমিও আমার ভাইয়ের সাথে বসে থাকতাম। আমি শুনতাম তারা x নিয়ে আলোচনা করছে। আমি আমার মাসতুতো ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম “তুমি কী করতে চাচ্ছো?”
– “আমি চাচ্ছি ‘2x + 7 = 15’ থেকে x এর মান কত বের করতে”।
– “তার মানে ‘4’ বের করতে চাচ্ছো?”
– “হ্যাঁ, কিন্তু তুমি বের করেছো পাটিগণিতের নিয়মে। ওটা হবে না। তোমাকে বীজগণিতের নিয়মে করে দেখাতে হবে”।

সৌভাগ্যবশত আমি স্কুলে গিয়ে বীজগণিত শিখিনি। আমি শিখেছিলাম আমার আন্টির পুরনো বই থেকে। ঐ বীজগণিতের বই তার পুরনো বইয়ের তাক থেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি বুঝেছিলাম আসল কাজ হলো ‘x’ এর মান বের করা। তুমি কীভাবে করবে সেটা তোমার ব্যাপার। আমার কাছে ‘বীজগণিতের নিয়ম’ বা ‘পাটিগণিতের নিয়ম’ বলে আলাদা কিছু ছিল না। বীজগণিতের নিয়মে করার অর্থ হলো এমন কিছু ধরাবাঁধা নিয়ম যা তুমি অন্ধভাবে অনুসরণ করলে উত্তরটি পেয়ে যাবে। যেমন- সমীকরণের উভয় পক্ষ থেকে 7 বিয়োগ করো। তারপর উভয় পক্ষকে 2 দ্বারা ভাগ করো, ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো অনুসরণ করলে কিছু না বুঝেও উত্তরটা বের করা যায়। নিয়মগুলো এমনভাবে বানানো হয়েছে যেন বোকার মত অনুসরণ করে পাস করা যায়। আমার মাসতুতো ভাইটি নিয়মগুলো অনুসরণ করতে গিয়ে গন্ডগোল করে ফেলতো, তাই পাস করতে পারতো না।

আমাদের পাড়ার লাইব্রেরিতে অনেকগুলো গণিতের বই ছিল। ব্যবহারিক পাটিগণিত, ব্যবহারিক বীজগণিত, ব্যবহারিক ত্রিকোণমিতি। আমি ওখান থেকে ত্রিকোণমিতি শিখতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ মনে রাখতে পারতাম না। কারণ আমি ত্রিকোণমিতি ভাল বুঝতাম না। আমার যখন তের বছর বয়স তখন ঐ লাইব্রেরিতে ‘ব্যবহারিক ক্যালকুলাস’ বইটি আসে। তখন আমি জানতাম ক্যালকুলাস কী। এনসাইক্লোপিডিয়া পড়ে আমি জেনেছিলাম ক্যালকুলাস একটি দরকারি এবং মজাদার বিষয়। আমি ক্যালকুলাস শিখতে চাইলাম।

লাইব্রেরি থেকে ক্যালকুলাস বইটা যখন ইস্যু করতে গেলাম লাইব্রেরিয়ান মহিলা আমার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকালেন। বললেন, “তুমি একটা বাচ্চা ছেলে, এই বই নিয়ে কী করবে?” আমার জীবনে এরকম আরো বহুবার হয়েছে। আমাকে মিথ্যা বলতে হলো। বললাম, “এটা আমার বাবার জন্য”।

বাড়িতে বসে ক্যালকুলাস শেখা শুরু করলাম। আমার মনে হলো ক্যালকুলাস খুব সহজ এবং বেশ নিয়মনিষ্ঠ- কোন প্যাঁচট্যাচ নেই। ক্যালকুলাস খুব ভাল লেগে গেল আমার। আমার বাবাও বইটা পড়তে শুরু করলেন। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না। আমি তাঁকে ক্যালকুলাস বোঝানোর চেষ্টা করলাম। এর আগে বাবার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। তাঁকে ক্যালকুলাস বোঝাতে গিয়ে তাঁর বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারলাম এবং তাঁর ওপর সামান্য বিরক্তও হলাম। এই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম কিছু কিছু ব্যাপারে আমি বাবার চেয়েও বেশি শিখেছি।

পদার্থবিদ্যার পাশাপাশি আরেকটা জিনিস বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন। ভুল হোক শুদ্ধ হোক তিনি শিখিয়েছেন আমাকে। তা হলো কিছু কিছু ব্যাপারকে অশ্রদ্ধা করা। যেমন- যখন আমি খুবই ছোট- আমাকে কোলে বসিয়ে তিনি ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স’ থেকে ছবি দেখাতেন। একদিন আমরা পোপের ছবি দেখলাম। পোপ দাঁড়িয়ে আছেন, আর সবাই তাঁর পায়ের কাছে নত হয়ে পড়ে আছেন। বাবা বললেন, “এই মানুষগুলোর দিকে দেখো। একজন মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে আছেন, আর অনেকগুলো মানুষ তাঁর পায়ের কাছে মাথা নিচু করে বসে আছেন। এখন এখানে পার্থক্য কোথায়? মানুষ থেকে মানুষে? এই দাঁড়ানো লোকটা পোপ”। পোপকে কেন জানি বাবা ঘৃণা করতেন। “পার্থক্য হলো এই টুপিটা, যেটা পোপের মাথায় বসে আছে”।

পোশাকই তো সব। পোশাকই মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করে। পোপ যদি জেনারেল হতেন তাহলে এরকম টুপি না হয়ে অন্যরকম টুপি হতো, অন্যরকম তকমা থাকতো। যাক্‌ গে। বাবা বললেন, “কিন্তু দেখো, এই মানুষটারও অন্য মানুষের মতো সমান সমস্যা আছে। এই পোপকেও খাদ্য খেতে হয়, বাথরুমে যেতে হয়। সেও একজন সাধারণ মানুষ”। প্রসঙ্গক্রমে বলছি, আমার বাবার পোশাকের ব্যবসা ছিল। তিনি জানতেন ইউনিফর্ম পরা মানুষ আর ইউনিফর্ম ছাড়া মানুষে কী পার্থক্য। পদ বদলে গেলেও বাবা জানতেন সমস্যার দিক থেকে একই মানুষ তারা।

আমাকে নিয়ে আমার বাবা খুব খুশি ছিলেন বলে আমার ধারণা। তারপরও একদিন আমি যখন এম-আই-টি থেকে ফিরি- বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তো এখন পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে জানো, শিখেছো অনেক কিছু। আমার একটা প্রশ্ন আছে। অনেকদিন থেকে আমি ভাবছি ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছি না”।
আমি বললাম, “বিষয়টা কী?”
বাবা বললেন, “একটা পরমাণু যখন একটা শক্তিস্তর থেকে অন্য শক্তিস্তরে যায়, তখন এক ধরণের কণা বিসর্জন দেয় বা ত্যাগ করে বা নির্গমণ করে- সে যাই বলো – এই কণাগুলোর নাম ফোটন। এটুকু আমি বুঝি”।
– “হ্যাঁ, ঠিক আছে। কিন্তু সমস্যাটা কোথায়?”
– “আচ্ছা, ফোটনগুলো কি ওখানে আগে থেকে ছিল?”
– “না, আগে কোন ফোটন ছিল না”।
– “তা হলে ওগুলো ওখানে এলো কোত্থেকে? বেরুলো কোত্থেকে বা কীভাবে?”
আমি তাঁকে ব্যাপারটা বোঝাতে চাইলাম। ফোটন সংখ্যা সীমাবদ্ধ নয়। এগুলো ইলেকট্রনের গতির সাথে আপনা আপনি সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমি ব্যাপারটা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলাম না। আমি বললাম, “এগুলো আসলে শব্দের মত। এই যে আমি কথা বলছি, শব্দ তৈরি করছি- এই শব্দগুলো বলার আগে ছিল না”। বাবা সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি যা বুঝতে পারেন না, আমি শত ব্যাখ্যা করেও তাঁকে বোঝাতে পারিনি কখনো। সুতরাং এসব ব্যাপার তাঁর অজানাই রয়ে গেলো। পৃথিবীর বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে তিনি আমাকে পড়িয়েছেন এসমস্ত ব্যাপার জানার জন্য। অথচ নিজে কিছুই জানলেন না তেমন।

আমার মা যদিও বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, তবুও মায়ের একটা প্রভাব আমার ওপর আছে। বিশেষ করে আমার মায়ের ছিল অদ্ভুত সেন্স অব হিউমার। মায়ের কাছ থেকে আমি শিখেছি যে বোধশক্তির পরম অর্জনই হলো প্রাণখোলা হাসি আর পারস্পরিক সহমর্মিতা।

ক্রমশঃ—–
[আপন আলোয় ফাইনম্যান ২য় পর্ব]