আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু “প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে সাংস্কৃতিক শিক্ষার ভূমিকা” শীর্ষক বক্তব্যে কিছুটা বিভ্রম আছে। সুচয়নের তরুণ উদ্যোক্তাদের সাথে আমি আলোচনা করে বুঝেছি, উদ্যোক্তারা এখানে সাংস্কৃতিক শিক্ষা বলতে বস্তুত: নৃত্য-সঙ্গীত, নাট্যকলা, আবৃতি ইত্যাদি পারফর্মিং আর্টস এর কথা বুঝাতে চেয়েছেন। অর্থ্যাৎ তারা বলতে চেয়েছেন, আমাদের সাধারণ শিক্ষার পাঠ্যক্রমে এসব ললিতকলা বা পারফর্মিং আর্টস যুক্ত করলে তা কী ভূমিকা রাখতে পারে? ‘সাংস্কৃতিক শিক্ষা’ কথাটার অর্থ দ্ব্যর্থ বোধক। কারণ সংস্কৃতি কথাটির অর্থ কেবল নৃত্য-সঙ্গীত-ললিত কলা নয়-এর অর্থ আরো ব্যাপক-একটি জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবন ধারাই হল তার সংস্কৃতি । সে অর্থে জীবন সংশ্লিষ্ট সকল শিক্ষাই বস্তুত: সাংস্কৃতিক শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত। আমরা সাধারণত নৃত্য-সঙ্গীত-নাটক-আবৃতি ইত্যাদির অনুষ্ঠানকে সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান বলে থাকি বলে এ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে এবং কেবল সুচয়নের বন্ধুরা নহে, আমাদের দেশের অনেক বিদগ্ধজনও এ জাতীয় বিভ্রান্তিতে ভোগেন। বস্তুত: সংস্কৃতি শব্দটি নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রচুর বিভ্রান্তি আছে, তবে সে আলোচনার ক্ষেত্র এটা নহে।
আলোচনার জন্য নির্ধারিত যে বিষয়, সেখানে মূলত: আমাদের প্রচলিত যে শিক্ষা পদ্ধতি, সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গলদ অনেক এবং তা কেবল পদ্ধতিগত প্রশ্নে নয়, মূল বিষয়গত প্রশ্নেও। পদ্ধতি হল উপায় বা পন্থা, মূল বিষয় হল শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আমাদের শিক্ষার লক্ষ্য কী, কেন আমরা শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করব, সেটা বস্তুত: মূল বিষয় বা রণনীতির অন্তর্গত। পদ্ধতি হল রণকৌশল। আবার সঠিক পদ্ধতি প্রনয়ন নির্ভর করে সঠিক লক্ষ্য স্থির করার উপর। যেমন পতেঙ্গা থেকে শহরে যেতে আমি কত নাম্বার বাসে ওঠব, তা ঠিক করার আগে আমাকে ঠিক করতে হবে, আমি শহরের কোথায় যেতে চাই। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করার আগে আমি আামাদের শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করতে চাই।
আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ থেকে চার দশক পূর্বে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও যে কথাটি আমাদের স্বীকার করতেই হয়, তাহলো আমরা এখনো বিশ্বের অন্যতম একটি পশ্চাৎপদ দেশ। আরো একটি নির্মম সত্য হল, আমাদের পরে স্বাধীন হয়েও অনেক দেশ শনৈ:শনৈ উন্নতির দিকে অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের এ পশ্চাৎপদতার অনেক কারণ আছে। তবে সর্বাপেক্ষা মুখ্য কারণ হল, শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের পশ্চাৎপদতা। শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের এ পশ্চাৎপদতা দ্বি-বিধ-পরিমাণগত ও গুণগত। নেহাত অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষকে শিক্ষিত ধরলেও আমাদের শিক্ষার হার এখনো পঞ্চাশের কোটা ছুঁয়নি। এটা হল আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে পরিমাণগত পশ্চাৎপদতার উদাহরণ। আমাদের দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মদক্ষতা, আচার-আচরণ-চরিত্র সর্বোপরি তাদের মন ও মনীষিতা দেখে আমরা উপলব্ধি করতে পারি আমাদের শিক্ষার গুণগত মান কত ভয়াবহ ভাবে নিন্ম পর্যায়ে। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখতে গেলে আমাদের এ পশ্চাৎপদার একটি মৌলিক কারণ, আমাদের ভয়াবহ দারিদ্র্য। এ দারিদ্রের কারণও আবার আমাদের অশিক্ষা। অর্থ্যাৎ আমরা অশিক্ষিত বলে দরিদ্র, আবার দরিদ্র বলে অশিক্ষিত-এ যেন পশ্চাৎপদতার এক ঘূর্ণাবর্ত। যাক সে কথা।
কথা বলছিলাম আমাদের শিক্ষার লক্ষ্য নিয়ে।
অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে জীবিকা নির্বাহ করাই আমাদের শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য, আলোকিত মানুষ তৈরী করার কোন আকাঙ্ক্ষা আমাদের তেমন তাড়িত করে না। আমরা আজ একটি পণ্যভোগী সমাজের বাসিন্দা এবং অনেক কিছুর মত শিক্ষাও একটি মহার্ঘ্য পণ্যে পরিণত হয়ে গেছে। তাই অর্জনের পরিবর্তে শিক্ষা আজ চড়া দামে কিনতে হয় এবং একই কারণে শিক্ষাকে কেবল ব্যবসায়িক বিনিয়োগ হিসাবে দেখা হচ্ছে। তাই আজকের অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের চড়া দামে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবি, কারিগর, হিসাববিদ এর সনদ ক্রয় করে দিচ্ছে, তাদের সন্তান মানুষ হচ্ছে কিনা সেব্যাপারে তারা নিষ্পৃহ।
আমরা সকলে জানি, সদ্যজাত একটি মানব শিশুর সাথে নবজাতক পশু শাবকের কোন পার্থক্য থাকে না। বস্তুত: প্র্রথমতঃ পারিবারিক, অতঃপর সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একজন মানব সন্তানকে ক্রমে মানুষ করে তুলে। আমাদের প্রয়াত কথা সাহিত্যিক আবুল ফজল লিখেছিলেন-তরু লতা সহজে তরু লতা, পশুপাখী জন্মেই পশুপাখী, মানুষ অতি কষ্টে মানুষ। অর্থ্যাৎ জন্ম নিলেই মানুষ মানুষ হয় না, তাকে তিলে তিলে মানুষ হয়ে ওঠতে হয়। এ মানুষ হয়ে ওঠা একটি প্রক্রিয়া, এ প্রক্রিয়ার নাম হল শিক্ষা। বলা বাহুল্য, এ শিক্ষা কেবল বই-পুস্তক-পুঁথি পাঠের মাধ্যমে লিখতে পড়তে আর অঙ্ক কষতে জেনে অর্জন করা যায় না।
একজন শিক্ষিত মানুষ, বস্তুত: একজন আলোকিত মানুষ। আলো আর আঁধার যেমন এক সাথে থাকতে পারে না, তেমনি একজন আলোকিত মানুষ কখনো অন্ধকারের সাথে আপোষ করতে পারে না। শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে, আর আলোকিত মানুষের হৃদয়ে মানবিক গুণাবলীর বিকশিত শতদল তাকে সত্যিকার একজন মানুষে পরিণত করে। স্বেচ্ছায় বা সজ্ঞানে তার পক্ষে কোন অন্যায় করা কিংবা অন্যায়ের সাথে আপোষ করা কখনো সম্ভব হবে না।
অথচ আমরা আজ অবাক বিস্ময়ে কি দেখি! আমাদের রাষ্ট্রে বা সমাজের সবচেয়ে বড় দুর্নীত কিংবা অপকর্মে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ শিক্ষাধারীদের সংখ্যাই বেশি। অথচ একজন সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত লোক কখনো মিথ্যা বলতে পারে না, পারে না ঘুষ খেতে, দুর্নীতি করতে, সাধারণ মানুষের টাকা আত্মসাৎ করতে- যা আমাদের দেশে একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এর জন্য দায়ী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গোঁড়ায় গলদ। অর্থ উপার্জনই যেখানে আমাদের শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে-মানুষ হয়ে ওঠার তাগিদ বা প্রণোদনার স্থান কোথায়?
কিন্তু কেন এমনটি হচ্ছে? প্রথমত: আমরা আমাদের শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারি নি কিংবা ভুল লক্ষ্য নির্ধারণ করে বসে আছি। দ্বিতীয়ত গোটা শিক্ষাটাকেই আমরা কেবল কারিগরী জ্ঞানের মত মনে করি। কী করলে কী হবে, এটাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের জানান দিচ্ছে, কেন হবে? অর্থ্যাৎ শিক্ষার পেছনের দর্শন, তার কার্য-কারণ সম্পর্ক, যৌক্তিক ভিত্তি ইত্যাদি আমাদের ছাত্র ছাত্রীদের জানানো হয় না। তাই আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখি, আমাদের চুয়েট আর বুয়েট এবং মেডিকেল কলেজ গুলো থেকে ফি বছর ইজ্ঞিনিয়ার ডাক্তারের পরিবর্তে প্রচুর হুজুর বের হয়ে আসে, ইহজাগতিক দায়িত্ব পালনের চেয়ে তারা বেশি উদগ্রীব তাদের পরলৌকিক মুক্তির আশায়। এখানেও তার চিন্তা একান্ত ব্যক্তিস্বার্থ প্রণোদিত, তার নিজস্ব মুক্তি বা মোক্ষ লাভ। অথচ রাষ্ট্র ও সমাজ তার পেছনে অঢেল টাকা খরচ করেছে, যার বিনিময়ে সমাজ তার কাছে কিছু দাবী করে। আমি কিন্তু হুজুর হওয়া খারাপ কিংবা হুজুর হওয়ার বিরোধীতা করছি না, আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, হুজুর হওয়ার শিক্ষালয়ত বুয়েট চুয়েট বা মেডিকেল কলেজ নয়। এর জন্য ভিন্ন শিক্ষাঙ্গনত দেশে আছে। ফলত: এক্ষেত্রে আমাদের শুধু টাকার অপচয় হচ্ছে না, মেধারও অপচয় হচ্ছে। এর কারণও কিন্তু একটু গভীর ভাবে ভাবলে আমরা দেখব, শিক্ষার সাথে শিক্ষার দর্শনের বিচ্ছিন্নতা। বর্তমান বিশ্বায়নের এ অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমাদের এগিয়ে যেতে হলে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের কোন বিকল্প নেই। তার জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানমনষ্ক জনগোষ্ঠী যা কেবল অধিকতর বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে সম্ভব। এ বিজ্ঞান চর্চার ভিত্তিটা আমাদের শুরু করতে হবে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। তার অর্থ আবার এ নয় যে, সকলকে বিজ্ঞান পড়তে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে, যা হল যুক্তিবাদ। আমাদের সদা স্মরণ রাখতে হবে, যুক্তির কাছে ব্যক্তির বিশ্বাস মূল্যহীন-সে ব্যক্তি যেই হউন না কেন।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, আমাদের সন্তানদের প্রথম শিক্ষালয় কিন্তু আমাদের স্ব স্ব পরিবার। কোন পরিবারে যখন নতুন সন্তান আসার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখন সম্ভাব্য সন্তানদের হবু মা-দাদী-নানীরা অত্যন্ত যত্নে জামা-কাপড়-কাঁথা সেলাই করে রাখে। জন্মের পর এ সকল জামা কাপড় সদ্যজাত সন্তানকে পরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনাটি কিন্তু আমরা সকলে দেখি। কিন্তু আমরা যেটা দেখি না, তাহল যে পরিবারে সন্তানটি জন্ম নিল সে পরিবারের ভাবনা-চিন্তা-আচার-আচরণের একটি অদৃশ্য অবয়ব ও তার জন্য তৈরী হয়ে থাকে। তাকে সেটা ঘটা করে পরিয়ে দিতে হয় না। আস্তে আস্তে সে সন্তান নিজেই পরিধেয় বস্ত্রের মত সে অবয়বে প্রবেশ করে। সে অবয়বটা তৈরী হয় একান্ত পারিবারিক সংস্কৃতি, তথা সে পরিবারের লোকজন কী ভাবে কথা বলে, কোন ভাষায় কথা বলে, পরস্পরের সাথে কেমন সম্পর্ক ও কেমন আচরণ করে, বদমেজাজি ঝগড়াটে, নাকি শান্তি প্রিয়, প্রতিবেশীদের সাথে তাদের সম্পর্ক ইত্যাদির উপর। তাহলে সন্তানকে কেবল ভাল স্কুলে পাঠিয়ে আমরা যারা স্বস্তি পাই, আমার ছেলে মানুষ হবে, সে প্রত্যাশাটা ভুল। পারিবারিক পরিবেশ ছাড়িয়ে ক্রমে এ সন্তানটি প্রবেশ করে সামাজিক পরিবেশের মধ্যে। আমাদের আরো স্মরণ রাখতে হবে, একটি অসুস্থ সমাজে বসবাস করে একজন ছেলে সুশিক্ষিত হবে, তা অসম্ভব না হলে অতি কষ্টসাধ্য ব্যাপার । তাই আমরা অনেকে পরিবেশের দোহাই দিয়ে এলাকা ছাড়ি। কিন্তু এটাও কোন সঠিক উপায় বা পন্থা নয়। কোন সমাজ বস্তুত: এলাকার ভিত্তিতে বিচ্ছিন্ন নয়। আমরা পতেঙ্গার সমাজ হালিশহরের সমাজের মধ্যে কোন বড় দাগের পার্থক্য রেখা টানতে পারি না। অবশ্য যারা তাদের সন্তানকে ভিন্ দেশে পাঠাতে পারেন, তাদের কথা ভিন্ন। তাদের সংখ্যা সামগ্রিক বিচারে খুব বেশি নয়। তাই এলাকা ছেড়ে পলায়ন নয়, সামগ্রিক ভাবে সমাজকে সুস্থ রাখার প্রক্রিয়ায় আমাদের সামিল হতে হবে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আরেকটি গলদ হল শিক্ষার পদ্ধতি- যে পদ্ধতিতে যে ছাত্র যত বেশি মুখস্ত করতে পারে, সে তত মেধাবী বলে চিহ্নিত হয়। “কমিটং ইন দ্যা মেমরি এ্যান্ড ভমিটিং ইন দ্যা এক্সামিনেশন হল” সংক্ষেপে আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির স্বরূপ। ভাল শিক্ষা লাভ নয়, পরীক্ষার ফল ভাল হওয়া চাই- এ প্রতিযোগিতা থেকে অভিভাবকদের মুক্ত করার মানসে নতুন গ্রেড পদ্ধতি চালু করেও কী সেখান থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে? আমার মনে হয় না। আমাদের শিক্ষার সাথে আনন্দের কোন যোগ নেই। বৎসরে একটি ক্রীড়ানুষ্ঠান মোটেও যথেষ্ট নয়। ১৯৮৪ ইং সালে আমি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলাম। সেখানে কয়েকটি কিন্ডার গার্টেন এ যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বচ্চাদের শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি দেখে আমি রীতিমত অভিভূত। ক্লাসরুমের পাশাপাশি বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষছায়ায়ও তারা ক্লাস নিচ্ছে। তাদের শিক্ষা পদ্ধতিটা এমন আনন্দ দায়ক যে, মনে হয় শিশুরা খেলতে খেলতে লেখা পড়া করছে। আমাদের শিশুরা কিন্তু সকালে কোন কারণে স্কুলে যেতে না হলে খুশী হয়। ছোট বেলায় বৃষ্টির বায়নায় কত স্কুল কামাই করেছি। আর স্কুলে গেলে অধীর আগ্রহে সময় গুণে, কবে বাজবে ছুটির ঘন্টা। সে ঘন্টা যখন বেজে ওঠে, তখন ছেলে-মেয়েরা হুড়মুড় করে যে ভাবে ভোঁ-দৌড় দেয়, মনে হয় তারা স্কুল থেকে না, কোন কয়েদখানা থেকে মুক্তি পেল বলে। আমি আমেরিকাতেও কিছু বাঙালি পরিবারে দেখেছি, প্রতিদিন সকালে ছেলে মেয়েরা স্কুলে যাওয়ার জন্য কেমন উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এ জায়গায়ও আমাদের ভাবতে হবে। শিক্ষার বিষয়বস্তুর সাথে শিক্ষা পদ্ধতিকে এমন করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করতে ক্লান্তি বোধের পরিবর্তে আনন্দবোধ করে। কারণ আমরা সকলে জানি, পুষ্টকর হলেও যে খাদ্য অরুচিকর, তা কেউ খেতে চায় না এবং সে খাদ্য দুস্পাচ্যও বটে। তাই শিক্ষাকে আমাদের সন্তানদের জন্য যতদিন রুচিকর খাদ্যে পরিণত করতে না পারব, ততদিন তা েযমন তারা গিলতে চাইবে না,গিললেও তা আমাদের সন্তানদের হজম হবে না। এখানেই আসে আমাদের শিক্ষা পাঠ্যক্রমে চারুকলার অন্তর্ভূক্তির প্রশ্নটি।
আমরা জানি, জ্ঞানের সব বিষয় কিন্তু সহজবোধ্য নয়। অনেক নীরস ও কঠিন বিষয়ও আমাদের ছেলে-মেয়েদের আত্মস্থ করতে হয়। কিন্তু আমরা চেষ্টা করলে সে দুর্বোধ্য ও নীরস বিষয়টিকে রসালু করে পরিবেশন করতে পারি। আমাদের সাধারণ পাঠ্যক্রমে যদি বিভিন্ন বিষয়, যেমন, অঙ্ক, ইংরেজী, বাংলা ও বিজ্ঞানের সাথে নৃত্য সঙ্গীত, আবৃতি অভিনয়, বিতর্ক প্রতিযোগিতার বিষয় যোগ করি, তাহলে শিক্ষার গুরুগম্ভীর ও ক্লান্তিকর পরিবেশটা শিক্ষার্থীদের নিকট সহজে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠবে। তাছাড়া চারুকলা চর্চার সাথে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের প্রশ্নটিও জড়িত। মানুষের উপর বিশেষভাবে সুর ও সঙ্গীতের প্রভাব অত্যন্ত সর্বগ্রাসী। একটি সঙ্গীত মানুষকে যত তাড়াতাড়ি প্রভাবিত, উদ্বুদ্ধ এবং আলোকিত করতে পারে, ক্লাসরুমে শিক্ষকের কয়টা বক্তৃতা তা করতে পারবে, আমি জানি না। আমাদের বাউল সাধক লালনের সে কালজয়ী গান- সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে——- যে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে, কয়টি জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা তা করতে পারবে। মানুষ ,মানুষের জন্য- ভূপেন হাজারিকার সে কালজয়ী গানটি নিষ্কলুষ মানব প্রেমে উদ্বুদ্ধ করে না, এমন লোক কি পাওয়া যাবে? একাত্তুরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ময়ে, একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, তীর হারা এ ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে, ইত্যাদি জাগরণের গান রণাঙ্গনে আমাদের কী পরিমান উদ্বুদ্ধ করত, তা আজ ভাষায় বুঝাতে পারব না।
সুর-সঙ্গীতের এযে প্রণোদনা শক্তি, তাকে কিভাবে আমাদের সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় কাজে লাগানো যায়, যত শীঘ্রয় তা ভাবা যায়, ততই মঙ্গল।

*সুচয়ন ললিত কলা কেন্দ্র (উত্তর পতেঙ্গা,চট্টগ্রাম) আয়োজিত “প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে সাংস্কৃতিক শিক্ষার ভূমিকা” শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রদত্ত বক্তব্যের সারসংক্ষেপ।