বিজ্ঞান এবং ধর্ম নিয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত লিখব- এই ইচ্ছা বহুদিনের। তবে বয়সের সাথে যেহেতু চিন্তাভাবনার পরিবর্তন হয়, তাই বিজ্ঞান এবং ধর্ম নিয়ে যতোবারই লেখা শুরু করব ভেবেছি,- মনে হয়েছে, থাক! আরেকটু ভাবি। আরেকটু বোঝাপড়া হলে তারপরই লিখব। কিন্তু আজকে মনে হলো এইবেলা লিখে না ফেললে এই লেখা আর জীবনেও হয়ে উঠবে না আমার! যাহোক, সমসাময়িক বাংলাদেশে কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে এই বিজ্ঞান, ধর্ম এবং সংস্কৃতি: তিনটি জটিল বিষয় নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে সামাজিক এবং গণমাধ্যমগুলোতে। বিজ্ঞ লেখক-গবেষক থেকে শুরু করে ফেসবুক সেলিব্রেটিরাও বাদ যাচ্ছেননা তাদের মতামত জানাতে। বোধহয় সেই জায়গা থেকে নিতান্ত সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমিও খানিকটা তাড়িত হলাম এটা লেখার ব্যাপারে।
প্রথমেই যে বিষয়টি বলতে চাই, সেটা হলো, বিজ্ঞান এবং ধর্মের বৈশ্বিক পরিমণ্ডল নিয়ে আমি বেশি কিছু বলব না ভেবেছি। অর্থাৎ বিজ্ঞান এবং ধর্ম নিয়ে যে আদিকালের বিতর্ক, সেসব দার্শনিক দিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞান থেকে ধর্ম এলো, নাকি ধর্ম থেকে বিজ্ঞান,- এরকম জাস্টিফিকেশন আমার এই লেখাতে থাকবে না। বরং বাংলাদেশ, তথা বাঙালিদের মধ্যে বিজ্ঞান এবং ধর্ম চর্চার ছোটখাটো কয়েকটা দিক আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বলার চেষ্টা করব। সেটা শতভাগ ভুলও হতে পারে, আবার খুব ক্ষুদ্রাংশে ঠিকও হতে পারে। বিচারের দায়িত্ব পাঠক নিবেন, তবে আমাকে মত প্রকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন না, এটুকুই আমার চাওয়া।

যে প্রশ্নটা দিয়ে শুরু করতে চাই, তা হলো- ‘বাংলাদেশের মানুষ কী মনস্ক?’ অথবা আরো গভীরভাবে বললে, ‘বাঙালি কী মনস্ক জাতি?’ ছোটবেলা থেকে কয়েকটা শব্দ শুনে এসেছি, যেমন: বিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মপ্রাণ, সংস্কৃতিমনা। বাক্য সহকারে বললে এভাবে বলা যায়- বাঙালি বিজ্ঞানমনস্ক জাতি কিংবা ধর্মপ্রাণ বাঙালি (বিশেষত মুসলমান), সংস্কৃতিমনা বাঙালি। আমার ব্যক্তিগত পড়ালেখা দ্বারা যতটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে বলতে পারি- তুলনামূলক বিচারে বাঙালি যতোটা না বিজ্ঞানমস্ক, তার চেয়ে বেশি ধর্মপ্রাণ এবং সবচেয়ে বেশি সংস্কৃতিমনা। অর্থাৎ শতবছর আগে থেকে বিচার করলে যে জিনিসটা মোটামুটি স্পষ্টভাবে দেখা যায়, সেটা হলো- বাঙালিদের মধ্যে সবসময়ই একটা সহজ সরল আর্ট-কালচারের চর্চা ছিল। যেটাকে আমরা অনেক সময় গ্রাম-বাংলার আবহমান সংস্কৃতি বলে থাকি। রেনেসাঁসের পর এবং ইংরেজদের আগমনকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের মধ্যে বিজ্ঞান চর্চার ব্যাপারটা নিয়মতান্ত্রিকভাবে শুরু হয়। তবে তার্কিকদের খাতিরে এখানে বলে রাখা ভালো, বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা যে এই অঞ্চলে ছিল এবং শূন্যের আবিষ্কার ইত্যাদি বিষয়গুলো আমি আপাতত উহ্য রাখতে চাই, কারণ দিনশেষে বোধহয় আমরা সেই ঐতিহ্যটা ধরে রাখতে পারি নাই। যাহোক, এই ধারাবাহিকতায় চিন্তা করলে বাঙালির সংস্কৃতির ইতিহাস বহু পুরানো হলেও, বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস বোধকরি খুব বেশি পুরানো নয়। একইভাবে বাঙালির ধর্মের ইতিহাসও সংস্কৃতির সাথেই কমবেশি সমান্তরালে চলেছে। ফলে, শত শত বছরের পুরোনো বিশ্বাসকে প্রাণে লালন করা জাতির কাছ থেকে হঠাৎ করেই বিজ্ঞানমনস্কতা আশা করা অনুচিৎ হবে বলেই মনে করি। শুধু অনুচিৎ তা-ই নয়, ক্ষেত্র বিশেষে এটা ভুল এবং বিপদজ্জনকও হয়ে উঠতে পারে। তাহলে উপায়টা কী? বাঙালি কি সারাজীবনই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে থাকবে? তার চিন্তা চেতনায় বিজ্ঞান কি কখনোই প্রবেশ করবেনা?

১৯২১ সালে এদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর মোটামুটিভাবে জ্ঞানচর্চার একটা ধারাবাহিক এবং প্রক্রিয়াগত সূচনা হয়। সে সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউরোপ আমেরিকার অনেক প্রথিতযশ অধ্যাপকের যাতায়াত হয় এবং তাঁদের যারা ছাত্র ছিলেন, কমবেশি তাঁরাও যখন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে জীবন শুরু করেছেন, তখন শিক্ষাদানকে চাকুরির অধিক একটা ব্রত হিসেবেই নিয়েছেন। এবং তাঁদের যারা ছাত্রছাত্রী ছিল, তাঁদের মধ্যেও মোটামুটি এই অনুধাবন ছিল যে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যটা আসলে কী? চাকুরির জন্যে সার্টিফিকেট অর্জন, নাকি উন্নত এবং মানবিক জীবনবোধের দিকে নিজেকে ধাবিত করা। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ধারাটা কি এখনো অব্যহত আছে? আমার জানামতে নেই। এই ২০২২ সালে কেউ যদি দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি উচ্চমাধ্যমিক কিংবা মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করে, তোমার পড়ালেখার উদ্দেশ্য কী? আমি নিশ্চিত অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে উত্তর দিবে, ভালো চাকুরি করা। এর ব্যক্তিক্রম থাকতে পারে, অবশ্যই থাকবে, তবে এইরকম উত্তরের কাছাকাছি উত্তরই হবে কমবেশি। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার অর্থও কিন্তু এখন অধিক অর্থ-উপার্জনই, মানবসেবা করা নয়। আমাদের বাংলাদেশের একুশ শতকের কমবয়সী শিক্ষার্থীদের এই উত্তরের পেছনে আসলে কী কারণ থাকতে পারে, তা খতিয়ে দেখলে অনেক বিষয় হয়তো উঠে আসবে। তবে আমার কাছে মনে হয়, একটা সমাজে ‘ভালো চাকুরি’ তখনই সবার ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে, যখন ঐ সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থা খুব খারাপ হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্র যখন ভালো বেতনের চাকুরি ব্যতীত কারো মৌলিক চাহিদাগুলোও পূরণে ব্যর্থ হয়, সোজা বাংলায়- পেটের দায় ঠেকে, তখন শিক্ষা-শিল্প-দর্শন ইত্যাদি অভৌত ব্যাপারস্যাপার যার ভাতই জোটে না তার বিরিয়ানি খাওয়ার মতো আদিখ্যেতা হয়ে ওঠে! ফলে, শিক্ষার সত্যিকার উপযোগিতা কী এবং তা না অর্জিত হলে কী হতে পারে- এইসব তত্ত্বকথা শোনার মত স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা করার ধৈর্য্যটুকুও আমাদের আর অবশিষ্ট নেই বোধহয়। একটি দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার চিত্র যদি এরূপই হয়, তাহলে সেখানে কিভাবে কেউ চাকুরিমনস্ক বৈ বিজ্ঞানমনস্ক জাতি আশা করতে পারে!

সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞানমনস্কতা বলতে কী বুঝায়, তা আমার নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে পারি। সম্ভবত এটিই পরিপূর্ণ অনুধাবন নয়, কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত অন্তত এইভাবে চিন্তা করতে পছন্দ করি। যদি এর থেকে উন্নততর কোনো চিন্তা কোথাও পাই বা নিজে অনুভব করতে পারি, অবশ্যই তা গ্রহণের চেষ্টা করব। ধরা যাক, আমি কোনো একজনকে সাইকেল চালানো শেখাতে চাই। তো কী উপায়ে তা হতে পারে? ছোটবেলা থেকে এই উদাহরণটা শুনে এসেছি যে- বই পড়ে কখনো সাইকেল চালানো কিংবা সাঁতার শেখা যায়না। এগুলো প্র্যাক্টিসের ব্যাপার। হাতে কলমে শিখতে হয়। আমিও তাই মনে করি। সাইকেলের কোন অংশটিকে প্যাডেল বলে, কোনটি চেইন, কোনটি বিয়ারিং- এইসব বই পড়ে জানার পর কাউকে যদি সাইকেলে উঠিয়ে দেওয়া হয় সে নিশ্চিত সাইকেল উলটে পড়ে যাবে! তাহলে করণীয় কী? করণীয় হচ্ছে- তাকে সরাসরি সাইকেল উপর উঠিয়ে প্যাডেল করতে সহযোগিতা করা। এভাবে সে যখন অভিকর্ষকে ভারসাম্য করা শিখে যাবে তখন সাইকেলটি সামনের দিকে চলবে। এখন এই বিষয়টিই যদি আমি পড়ালেখার প্রসঙ্গে বলতে চাই, অর্থাৎ আমার উদ্দেশ্য যদি হয় কোনো একজন ছাত্রকে সাইকেল কিভাবে চলে সেটি বোঝানো, তাহলে তাকে শুধুমাত্র সাইকেলের উপর চড়িয়ে সাইকেল চড়া শেখানোটা হবে মূল শিক্ষার অর্ধেক। আবার সাইকেল না এনে বই হাতে দিয়ে এটা প্যাডেল, ওটা বিয়ারিং- এই শিক্ষা দেওয়াটাও হবে মূল শিক্ষার অর্ধেক। এবং তুলনামূলক বই পড়ে সাইকেল সম্পর্কে শুধুমাত্র কয়েকটা থিওরিটিক্যাল বিষয় শেখাটা নিছক সাইকেল চালানো শেখার চাইতেও কম উপযোগিতাপূর্ণ দারিদ্রপীড়িত এই দেশে। ফলে, শতভাগ শিক্ষাটা অর্জন করতে হলে, যেমন হাতেকলমে সাইকেল চালনা করা শিখতে হবে, পাশাপাশি সাইকেল কিভাবে অভিকর্ষের সাথে কাজ করে, কেন্দ্রমুখী বলের ভারসাম্য ইত্যাদি বিজ্ঞানের ব্যাপারগুলোও তাকে শিখে অনুভব করতে পারতে হবে, যাতে সে এরকম অন্যান্য যানবাহনগুলোর ভেতরের ম্যাকানিজম অনুধাবন করতে পারে এবং নতুন কিছু উদ্ভাবনের চিন্তা করতে পারে। এবং এই ‘চিন্তা’টুকু একজন ছাত্রের মধ্যে করাতে পারানোটাই একজন শিক্ষকের সার্থকতা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা সারাজীবন ধরে শুধুমাত্র ‘প্রসেস’ শিখি, ‘প্রসেস’টা কেন এভাবেই হচ্ছে, অন্য কোনোভাবে হওয়া সম্ভব ছিল কি-না, তা কখনো চিন্তা করি না। কারণ একদম ছোটবেলা থেকে যখন আমাদেরকে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ শেখানো হয়, তখন এইভাবে ‘প্রসেস’-ই শেখানো হয়। যোগ-বিয়োগ করতে গেলে ‘১ হাতে রাখো’, ‘১ উপরে তুলে আবার নিচে নামাও’, ‘উপর থেকে একটা ০ নামাও’, ‘১ ঘর বামে সরাও’- এই ধরণের প্রসেসমূলক কথাবার্তার মধ্যে দিয়েই একটা বাচ্চা গণিত শেখে। বিষয় এটা নয় যে, সে এভাবে শিখবে না। অবশ্যই শেখার প্রথম ধাপেই সে অঙ্কের স্থানাঙ্ক মান বুঝে যাবে না। হয়তো প্রথমে চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত্ব করা শিখবে। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে অবশ্যই এটা বুঝতে হবে, কেন সে ১ হাতে রাখলো। না হলে পরবর্তীতে যখন সে আরো উচ্চতর গাণিতিক সমস্যার সমাধান করবে, তখন সে তার শেখা প্রসেসের বাইরে আর কোনো কিছু চিন্তাই করতে পারবে না। এবং আদৌ যে চিন্তা করতে হয়, এই জিনিসটিই সে ভুলে যাবে। আর এই ধারা অন্য সবার মাঝে অব্যহত থাকলে সামগ্রিকভাবে যে শিক্ষার্থীরা তৈরি হবে, তারা বস্তুতই চিন্তাশূন্য মেধায় পরিণত হবে। যাদের চিন্তাভাবনা শুধু কয়েকটা শেখানো প্রসেসের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তার বাইরে আর কিছু সে ভাবতে পারে না। হতাশার শেষ শুধু এখানেই নয়, কারণ বাংলাদেশে বর্তমানে এই চিন্তাশূন্যভাবে একদম প্রথম শ্রেণি থেকে অনার্স পাস করে একটা চাকুরি পাওয়া আশ্চর্য্যের কোনোকিছু নয়। বরং এটাই সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি আউটলাইনের কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করা শুরু করে, যেটাকে এখন আদর করে ‘থিংক আউট অব দ্য বক্স’ বলা হয়, অর্থাৎ বুঝে পড়া শুরু করে, তাহলে সামগ্রিকভাবে তার পড়ালেখা তথা রেজাল্ট খারাপ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে! এবং ‘কেন পড়তেছি এটা’- এরকম চিন্তা করা মানুষজনের পক্ষে বিসিএস বা অন্যান্য তথাকথিত লুক্রেটিভ চাকুরি পাওয়া যথেষ্ট কষ্টকর হবে বোধহয়! ফলে ‘চিন্তা করে পড়া’ তথা ‘চিন্তাশীল হওয়া’, যেটা ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ হওয়ার প্রথম ধাপ, ঐ জিনিসটা বর্তমানে দেখা যাচ্ছেনা খুব একটা। তাই ‘প্রসেস’ জানে এবং কমবেশি জানা প্রসেসের মধ্যে থেকে স্কিল দিয়ে কাজ করতে পারে- এরকম শিক্ষিতের চাহিদাই বেশি এখন। বিশেষত সরকারি চাকুরিগুলোকে এত সিকিউরড বলা হয় সবসময় বোধহয় এই কারণেই যে- একজন ব্যক্তি যদি যুগের সাথে বেসিক সফট স্কিলগুলোও সেভাবে ডেভেলপ করতে না পারে, তাহলেও সে চাকুরিতে বহাল তবিয়তেই থাকবে, কিন্তু অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে আইটি প্রফেশনালদের সবসময় নতুন টেকনোলজির সাথে আপডেটেড থাকতে হয়, না হলে চাকুরি চলে যাওয়ার বা না পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সমাজে একজন বেসরকারি আইটি প্রফেশনালের চাইতে একজন মধ্যমগ্রেডের সরকারি চাকুরিজীবীর আর্থ-সামাজিক মর্যাদা অনেক বেশি। ফলে সামগ্রিকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা এখন এমনভাবে গতিশীল আছে, যেখানে ‘চিন্তা’ করার কোনো বস্তুগত উপযোগিতা নেই। গণিতের কোনো জটিল বিষয় নিয়ে কয়েকরাত মাথা খাটানো কিংবা পদার্থবিজ্ঞানের একটা সূত্র নিয়ে নদীর পাড়ে বসে নিবিড়ভাবে ভাবাটা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সাথে খুবই আদিখ্যেতাপূর্ণ। কোনো ছেলেমেয়ে যদি এইভাবে ভাবা শুরু করে এবং সেজন্যে তার সামগ্রিক রেজাল্ট খারাপ হয়, মর্যাদাপূর্ণ চাকুরি না পায়, তাহলে পরিবার এবং সমাজে এ নিয়ে তাকে এমন বিষোদগার করা হবে, যে বেঁচে থাকাটাও তার কাছে অর্থহীন হয়ে উঠতে পারে! এমতাবস্থায়, আমাদের দেশে কোনো শিক্ষার্থী যখন বিজ্ঞান শিক্ষার আসলে কারণ বুঝতে ব্যর্থ হয়, এবং সমগ্রশিক্ষাজীবনে বিজ্ঞান পড়া সত্ত্বেও ‘যুক্তিগত’ চিন্তা করতে পারে না, তখন সেই দায়ভার না চাপানো যায় তার উপর, না চাপানো যায় তার শিক্ষকদের উপর। মূলকারণটি বোধকরি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে লুকায়িত থাকে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা যেহেতু কোনো বস্তুগত এন্টিটি না, তাই তাকে তো আর বেত্রাঘাত করে ‘শিক্ষা’ দেওয়া যায়না! ফলে পুরো ব্যাপারটিই এরকম বিশৃঙ্খলভাবে গতিশীল থাকে। এবং সেই বিশৃঙ্খলার ছোট ছোট অনুষঙ্গগুলো ঢুকে পড়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলিতে। আমাদের চারপাশের সমস্ত মানুষ, পরিবেশ, প্রতিবেশকে একটা বিশৃঙ্খলতার ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা অব্যবস্থাপনা বলে বোধ হয়।

“বুদ্ধির ভীরুতাই হচ্ছে শক্তিহীনতার প্রধান আড্ডা”- কথাটা রবীন্দ্রনাথের। মূলত বিজ্ঞানমনস্ক ব্যাপারটির সাথে সরাসরি ‘বিজ্ঞান’ বলতে আমরা যা বুঝি- অর্থাৎ গণিত, পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলো জেনেবুঝে পড়াকে বোঝায় না শুধুমাত্র। বরং যখন একজন মানুষ তার চিন্তাচেতনায় অনুসন্ধানী হয়ে ওঠে, যুক্তিপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং ব্যবহারিক জীবনে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে শেখে, দেখা মাত্রই কোনো কিছুকে গ্রহণ বা বর্জন করে ফেলে না, তখন এই যুক্তিবাদী মনকে বিজ্ঞানমনস্ক বলা যেতে পারে। তবে আমার ধারণা অনেকেই ‘যুক্তিবাদী’- শব্দটা শুধুমাত্র ‘নাস্তিক’তার জন্যে ব্যবহৃত হয়, এমনটা ভেবে থাকেন। যেমন অনেকেই ভুল এবং অজ্ঞতাবশত দাঁড়িটুপি দেখা মাত্রই ‘মৌলবাদী’ শব্দটির অহরহ ব্যবহার করেন। মূলত একজন মানুষের লজিক্যাল বা র্যাবশনালি চিন্তা করতে পারাটা শুধুমাত্র বিজ্ঞান পড়ার জন্যে অপরিহার্য, এমন নয়। বরং জ্ঞানের অন্যান্য যত শাখা প্রশাখা আছে, তা বিজ্ঞান হোক, ধর্মশাস্ত্র হোক, কিংবা কলা, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা যে-কোনো কিছুই হোক না কেন, সেখানে গভীরে গিয়ে চিন্তা করা এবং র্যা শনাল চিন্তা করাটা আবশ্যকীয়। জাতি হিসেবে যে আমরা বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠতে পারি নি, তার অন্যতম কারণটি বোধহয় এখানেই নিহিত যে, আমরা প্রথম থেকে এটা ধরে নিই শুধুমাত্র বিজ্ঞানের ছাত্ররাই বুঝমান হবে, তারাই একমাত্র যুক্তিসঙ্গত চিন্তা করতে পারবে, আর আর্ট-কালচার কিংবা ধর্ম নিয়ে যারা পড়ালেখা করে এরা মুখস্তবিদ্যা ছাড়া আর কিছু করবে না। কোনো উৎকৃষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে একমুখী বিষয়ে চিন্তাশীল করে তুলতে সমর্থন করবে বলে আমার মনে হয়না। যিনি বিজ্ঞানের ছাত্র হবেন তার সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি কিংবা ধর্ম, এমনকি সংগীত, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র নিয়ে লজিক্যাল চিন্তাভাবনা থাকবে না, এমনটা হওয়ার কথা নয়। একইভাবে মাদ্রাসায় পড়া একজন ছাত্র শুধুমাত্র তার চিন্তাধারাকে ধর্মীয় পরিমণ্ডলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবেন, জগতের অন্যান্য বিবিধ বস্তুগত বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন হবেন, সেটাও সমাজ এবং তার ব্যক্তিগত জীবনে মঙ্গলজনক হবেনা। ফলে শিক্ষার যেকোনো শাখাতে যদি যুক্তিসঙ্গতভাবে চিন্তা করার বোধ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি না হয়, তাহলে চিন্তাবোধের এই শূন্যস্থানটি অন্য যে-কোনো কিছু দিয়ে পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এবং অন্য যেকোনো মানুষ, গোষ্ঠী, সমাজ, রাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থে, নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী সেই শূন্যস্থানটি পূরণ করে দেওয়ার সুযোগ পায়। বিংশ শতাব্দীতে এই বিষয়টি অতো স্পষ্টভাবে বোঝা না গেলেও, তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর এই একবিংশ শতাব্দীতে বিষয়টা খুব সহজেই অনুধাবন করা যায়। গত এক দশক জুড়ে সমগ্র বিশ্বের সাথে বাংলাদেশেও ইন্টারনেট এবং কম্পিউটার, ল্যাপটপ বিশেষত স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা আমাদেরকে অনেকাংশে অগ্রগতির দিকে নিয়ে গেলেও বৃহৎভাবে এর যথেচ্ছ ব্যবহার তরুণ এবং কিশোরদের চিন্তাভাবনায় নেগেটিভলি প্রভাব বিস্তার করেছে। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের অধিকাংশ ছেলেমেয়ের হাতেই এখন জগৎদ্বার উন্মুক্তকারী স্মার্টফোন আছে। যেহেতু আমাদের এখনকার শিক্ষাব্যবস্থাটা শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাসকেন্দ্রিক এবং জিপিএ-৫ পাওয়াটাও অতো কঠিন ব্যাপার নয়, ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের যুক্তিবোধ চর্চার শূন্যস্থানটি শিক্ষার অন্যান্য মাধ্যমগুলো দিয়ে পূরণ না করে, পূরণ করছে অনলাইনে তাদের অনুভূতি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এই অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, টিকটক ইত্যাদি যেকোনো কিছুই হতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই বিষয়টি শুধুমাত্র কিশোর-তরুণ ছেলেমেয়েদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একটা বড় অংশও এখন তাদের চিন্তাহীন মস্তিষ্কের শূন্যস্থানটি ব্যয় করে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস বা কমেন্ট করতে গিয়ে। এতে তাকে কোনোরূপ র্যািশনাল চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজনও পড়েনা, এবং বস্তুত সেই চিন্তাবোধ ছোটবেলা থেকে তারমধ্যে তৈরিও হয় নাই। বস্তুত এতদিন এইরকম চিন্তাশূন্য মানুষকে একসাথে দেখা সম্ভব ছিলনা, কারণ এখনকার মতো উন্মুক্ত স্যোসাল মিডিয়াগুলো ছিলনা। কিন্তু ফেসবুকের কল্যাণে (কিংবা অকল্যাণে!) এখন খুব সহজেই কোনো পত্রিকার নিউজ লিংকের নিচে গিয়ে কমেন্টবক্সের লেখাগুলো পড়লেই সামগ্রিক বাংলাদেশের গড় মানুষের চিন্তাভাবনা কী রকম তার একটা ছাপ পাওয়া যায়। সুতরাং আমাদের চিন্তাহীনতার বিষয়টি এখন প্রকাশ্যে ধরা দিয়েছে দেখে এটা ভেবে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত হবেনা যে- আমাদের সবার রাতারাতি কিংবা একদিনেই চিন্তামৃত্যু ঘটেছে। মূলত চিন্তাহীনতার সাগরে বিগত কয়েক দশক ধরে ডুবে থাকার পর হঠাৎ অনলাইনে আমাদের মত প্রকাশের সহজলভ্য সুযোগ,- তথা ঢেউটি এই চিন্তাশূন্য মৃতদেহগুলোকে তার উপরিভাগে বুদবুদাকারে তুলে ধরেছে। আজ থেকে কয়েক দশক আগেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকেরা ন্যূনতম হলেও জ্ঞানগর্ভ চিন্তাসমাবেশে নিজেদেরকে কর্মব্যস্ত রাখতেন। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রকৃত জ্ঞানের উচ্ছিষ্টাংশও কি উৎপাদন বা মূল্যায়ন করে? দেশের হাতেগোনা কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ভূমিকা রাখছে, তাও খোঁজ নিলে হয়ত দেখা যাবে সেখানে শিক্ষকের চাইতে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ উদ্যোগ আর পরিশ্রমই বেশি। গবেষণা কিংবা আন্তর্জাতিক একটা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য সামান্য আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করে গিয়ে তাদের জুতা-স্যান্ডেলের তলা ক্ষয় হয় যায়। ফলে বিজ্ঞান, ধর্ম এবং সংস্কৃতিতে প্রকৃত জ্ঞানের যে অনুপস্থিতি আমাদের সমাজে বেশ বড় একটা সময় ধরে চলে আসছে একদম প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত, সেটি অন্য কোনো অন্ধ চেতনা, বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল দ্বারা যদি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তাহলে খুব বেশি আশ্চর্য্য হওয়ার সুযোগ আছে কি? এবং এর প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের কিংবা ধর্মের সাথে সংস্কৃতির কী কনফ্লিক্ট, সেই আলোচনায় না গিয়ে মূল সমস্যাটির দিকে নজর দেওয়া কি অধিক গুরুত্বপূর্ণ নয়? এদেশের শতকরা দুই তৃতীয়াংশ শিক্ষিত মানুষও যদি সত্যিকার লজিক্যাল চিন্তা করতে পারত, র্যা শনাল চিন্তা করতে পারত, তাহলে যেকোনো বিষয় নিয়ে আমাদের যে হুট করে পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে যাওয়া, দলাদলি করা, দাঙ্গা ফ্যাসাদ করা, সেই জিনিসটা এত সহজে হওয়া কি সম্ভব ছিল? বর্তমানে দুনিয়ায় একদল মানুষ আছে, এবং যাদের সংখ্যাটা নিতান্ত কম নয়, তারা দাবি করে দুনিয়াটা কমলালেবুর মতো গোলাকার নয়, বরং আটার রুটির মতো চ্যাপ্টা গোলাকার! এদেরকে বলা ‘ফ্ল্যাট আর্থ স্যোসাইটি’, যাদের রিসার্চ করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষজনও আছে। অথচ মাধ্যমিক পাশ করা একজন সাধারণ ছাত্রের জ্যামিতিক পরিমাপ আর পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান দিয়ে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না যে- পৃথিবী সত্যিকার অর্থে কমলালেবুর মতোই গোলাকার! যদিও এই উদাহরণটি আমাদের জন্যে বুঝতে পারা সহজ, কিন্তু বিজ্ঞানের আরেকটু উচ্চতর জটিল কোনো বিষয় যখন ভুলভাবে আমাদের সামনে ব্যাখ্যা করা হয়, এবং কোনো গোষ্ঠী যখন উদ্দেশ্যপ্রোণদিতভাবে সেটা করে, তখন আমাদের মস্তিষ্ক আর এনালাইসিস করতে চায় না। আমরা অবলীলায় তাদের কথা মেনে নিই কিংবা মেনে নিতে বাধ্য হই। বিশ্বাস করে নিই যে- সুন্দরবনের পাশে রামপাল হলেও পরিবেশের তেমন কোনো ক্ষতি হবেনা! এটাই আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক না হতে পারার সবচেয়ে বড় ক্ষতি এবং আফসোসের জায়গা। আর এই সুযোগটাই সুযোগসন্ধানী মহল তাদের প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করে থাকে। নিত্য নতুন অর্থনৈতিক আর প্রযুক্তিগত জাড্য শব্দের ভীড়ে আমরা ভেবে ফেলি দেশ তার উন্নতির শিখর সূচকে পৌঁছে গেছে কিন্তু আদতে সেগুলো আমাদের অজ্ঞঅন্ধতার সুযোগ নিয়ে বুঝানো সম্ভব হয়। সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞানমনস্ক হলে আমরা ধর্ম-বিজ্ঞান কনফ্লিক্টে মেতে না থেকে কথা বলতাম আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে; স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও বিশ্বের অন্যতম বসবাস অযোগ্য শহর খ্যাত ঢাকার বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ, যানযট ইত্যাদি সমস্যাগুলো নিয়ে কেন রাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য দীর্ঘমেয়াদী কোনো সমাধান নেই, পদক্ষেপ নেই সে বিষয়ে। একইভাবে, ধর্মের দিকে দেখলে অচিন্তাশীল ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর একদল মানুষকে উষ্কে দেওয়া সম্ভব এটা বলে যে- তাদের প্রিয় একজন ধর্ম বক্তাকে অন্যায়ভাবে জেলখানায় আটকে রাখা হয়েছে বিধায় চাঁদে তার মুখ দেখা গেছে এবং এর প্রতিবাদ স্বরূপ অন্য ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর লুটপাট জ্বালাও-পোড়াও করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যে ব্যক্তি দুনিয়ার আর কোনো তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ ইত্যাদি পড়ে নাই, জীবনে শুধুমাত্র কোরআন শরীফের সবচেয়ে সহজ সরল কোনো একটি বঙ্গানুবাদ পড়েছে, তার পক্ষে এরকম ধর্মীয় উস্কানিতে জ্বালাও পোড়াও করা সম্ভব হবে না। মূলত আমাদের ধর্মীয়জ্ঞান নেই দেখেই স্বার্থান্বেষীমহল এই সুযোগটা নেয়, তারা জ্ঞানের ঐ শূন্যস্থানটা পূরণ করে সহিংসতার জ্ঞান কিংবা মদদ দিয়ে। তবে বর্তমানে চিন্তাহীনতার ফলে সবচেয়ে বড় যে ফাটলটি বাঙালিদের মধ্যে ধরেছে, সেটি বোধহয় আমাদের সংস্কৃতিতে। বাঙালির সংস্কৃতি কী?- এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ প্রকৃতপক্ষে আমরা মিশ্র সংস্কৃতির মানুষ। আমরা পশ্চিম থেকে যেমন নিয়েছি, পাশ্চাত্য থেকেও নিয়েছি, এবং আমাদের নিজস্ব সহজিয়া চিন্তাধারা তো ছিলই আদিকাল থেকে, সবকিছু মিলিয়ে নদীর মতো প্রবহমান একটি সংস্কৃতিই বাঙালিদের মধ্যে দেখা গেছে সবসময়। আমাদের গান, চিত্রকলা, খাদ্যাভাষ, পোষাক ইত্যাদি সকল বিষয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ছাপ আছে এবং এটিই বোধকরি আমাদের বড় শক্তি। কারণ যে জাতি অধিক গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে তার আধারে, দেওয়ার পরিসরও তার ততো বড়ই হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটাই সত্যি যে- বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতিবোধ সত্যিকার অর্থে কোনো ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক কিংবা জাতীয়তা থেকে উৎসারিত কি-না সেটা বোঝা যায়না। আজ থেকে শতবছর আগে ব্লাউজ ছাড়া একপ্রস্থ শাড়ি অধিকাংশ গ্রামীন বাঙালি নারীদের পোষাক ছিল এবং এর কারণ বোধকরি অর্থনৈতিক। সেলাই ছাড়া একপ্রস্থ শাড়ি তৈরি করা সহজ এবং তার বাজারমূল্য কম, ফলে তৎকালে সেটিই যৌক্তিকভাবে আমাদের পরিধেয় ছিল। এরপর আস্তে আস্তে বাঙালির অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে, ফলে অভিজাত সমাজের মানুষের অভিরুচি হয়ে দাঁড়িয়েছে জনসাধারণের হালের ফ্যাশান অনুষঙ্গ। কিন্তু বিগত কয়েক দশকের ক্রশম প্রসারমান উন্মুক্ত বিশ্বঅর্থনীতি আমাদের ঐ সংস্কৃতিবোধের শূন্যস্থানটিকে পূরণ করেছে তার নিজস্ব স্বার্থ বিশ্বসংস্কৃতির সাথে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মানুষের পোষাক পরিচ্ছদ গড়ে ওঠার পেছনে আরেকটি কারণ থাকে ঐ অঞ্চলের পরিবেশ তথা আবহাওয়ার নিয়ামকের উপর। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান মানুষের পোষাক অনুষঙ্গ দেখলে এই বিষয়টা খুব একটা লক্ষ্য করা যায়না। একই কথা আমাদের বর্তমান সংগীত অনুষঙ্গেও। নদীমাতৃক বাংলাদেশে একসময় নদীর বিরান শীতলতার মতো যে কোমল সুর গানের ভেতর শ্রোতাদের মোহবিষ্ট করত, সেখানে এখন রক-মেটাল-সাইকেডেলিক ইত্যাদি বহু জনরার গান শোনা যাচ্ছে। এটা ঠিক যে- আমাদের চারপাশের পরিবেশ সেই আগের মতো আর শান্ত-কোমল নেই, যেখানে বৃষ্টির দিনে টিনের চালে টুপটাপ শব্দ শুনতে শুনতে রবীন্দ্রনাথের দু’পাতা কবিতা পড়তে বা একটা বৃষ্টির গান শুনতে ভালো লাগবে। জ্যাম-জট আর দূষিত শব্দের শহর-বন্দরে গানের কথা শ্রোতার কান পর্যন্ত পৌছাতে ড্রামস-গিটার ব্যবহার করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এই ব্যান্ড সংগীতের যে ধারাটা বাংলাদেশে চলে আসছিল দীর্ঘদিন, বিগত ‘দু এক দশকে কি সেটা সেভাবেই আগাচ্ছে? নাকি সেখানে ঢুকে পড়েছে অনেক কালচারাল হেজিমনিক ব্যাপার স্যাপার? যার ফলশ্রুতিতে আমরা ভুলে গেছি যে, অন্তত বাঙালির জাতীয় দিবসগুলোতে রাস্তার মোড়ে হিন্দি গান বাজালে কিংবা কোনো স্কুল-কলেজের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে হিন্দি গানের তালে উদ্যম নৃত্য পরিবেশনা করলে আমাদের সংস্কৃতিবোধের মাত্রাটা বাড়ে না, সেটা এক লাফে মাইনাসে চলে যায়! ফেসবুকের কল্যাণে বর্তমানে এগুলো আমাদের সামনে আসে, ভাইরাল হয়। বর্তমানে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে কালচারের আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিমত, কিন্তু আমার বিশ্বাস সংখ্যায় অল্প হলেও এই ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা পাঠক ভেবে দেখবেন। বর্তমানে ফেসবুকে বিশেষত বইমেলার সময় প্রচুর পোস্ট দেখা যায়, যেটাকে এককথায় বই-শাড়ি-কফি মগ বলা যেতে পারে! সম্প্রতি নিউজফিডে একজনের এরকম মন্তব্য চোখে পড়েছিল- যখন কারো প্রোফাইলে বই-শাড়ি-কফিমগ একই ফ্রেমের মধ্যে সে এস্থেটিকভাবে পায়, তখন ধরে নেওয়া যায় যে নব্বইভাগ ক্ষেত্রে সে ঐ বইটা পড়ে নাই! আমি ব্যক্তিগতভাবে এত কঠোর জাস্টিফিকেশনে যেতে চাইনা! তবে এটা সত্যি যে, বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অনেক ধরণের সংস্কৃতি লক্ষ্য করি। তন্মধ্যে একটা ধারা আদি আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির ছাপে মূলত কলকাতামুখী সংস্কৃতি এবং আরেকটা এর বিপরীত দিকে আধুনিক কয়েকজন ইসলামিক স্কলার কিংবা ইংলামিক সেলিব্রেটি বলা যেতে পারে, তাদের সংস্কৃতি। কলকাতামুখীদের ক্ষেত্রে যদি সত্যিকার অর্থে এটা দু’ দেশের শিল্প-সংস্কৃতি আদান-প্রদানে ভূমিকা রাখে, তাহলে তা অত্যন্ত চমকপ্রদ এবং প্রশংসনীয়। কিন্তু ব্যাপারটি যদি এমন হয় যে, কেউ একজন মনে করছেন যে- তাকে জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন, মার্কেজ, কাফকা, লাকা, দেরিদা, পিংক ফ্লয়েড, ভ্যান গখ ইত্যাদি পড়া-শোনা দেখাইতেই হবে সবাইকে এবং এটা অনেকটা তার অধিকার-আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যার মাধ্যমটা অধিকক্ষেত্রেই ফেসবুক-শাড়ি-পাঞ্জাবি-গহনার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু বাস্তবে তার ঐ বিষয়ে পর্যাপ্ত বিচরণ নাই, তাহলে জিনিসটাকে ‘সিউডো-এস্থেটিক’ বললে বোধহয় ভুল হবেনা। কারণ এতে সত্যিকার অর্থে আমাদের সংস্কৃতিতে কোনো উপাদান যোগ হয়না। বরং এদের ভাইরাল পোস্টের ভিড়ে হারিয়ে যায় অনেক সত্যিকার চর্চাশীল মানুষের গল্প, আর ‘সিউডো-এস্থেটিক’নেস একটা ট্রেন্ডে পরিণত হয়, যাতে লাভবান হয় কিছু নির্দিষ্ট দিবসে ম্যাচিং-ম্যাচিং জামাকাপড় বিক্রি করা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। একইভাবে ইসলামের অন্তর্নিহিত উদারনৈতিক মর্মকথাগুলো না বুঝে, শুধুমাত্র কয়েকটি বিষয় যেমন: ডারউইন সঠিক নাকি ভুল, কোরআন বিজ্ঞানময় নাকি নয়, একাধিক বিবাহ করা যাবে কিনা, দাঁড়ি কয় হাত রাখতে হবে, নামাযে হাত বুঁকে বাঁধতে হবে নাকি পেটে ইত্যাটি নিয়ে লম্ফঝম্ফ করে ইসলামের মূল বিষয় থেকে অনেক দূরে থাকা বিষয়গুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি করে একটা প্রতিবাদ ছাত্রসমাজ বানিয়ে তা অন্য ইসলাম চর্চাকারী (অন্য মাযহাব) কিংবা নিছক শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান চর্চাকারীদের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিলে তাতে আদতে কারোর-ই কোনো লাভ হবেনা। জুলুমতের শাসনের নিচেই পড়ে থাকতে হবে আজীবন এবং দ্বন্দ্বটা রয়ে যাবে তাদের মধ্যেই, যাদের একসাথে হয়ে শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কথা ছিল। কারণ ধর্ম আর শিল্প-সাহিত্যের রাস্তা দু’টি ভিন্ন হলেও লক্ষ্য এক, সত্যের দিকে পৌঁছানো, কল্যাণের দিকে পৌঁছানো। ফলে এসবকিছুর মূলে মানুষ হিসেবে আমাদের বিচার-বিবেচনাবোধ যদি উন্নত না হয়, কোনটাকে গ্রহণ করতে হবে আর কোনটাকে সরিয়ে রাখতে হবে, এটা বুঝতে না পারার মতো শক্তি যদি আমাদের তৈরি না হয়, তাহলে কী হবে? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘শক্তিহীনতার আড্ডাখানা’ হবে। এই শক্তিহীনতা কার দিকে ইঙ্গিত করে? বলার অপেক্ষা রাখে কি রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জনগণের সোচ্চার হওয়ার সক্ষমতার দিকে?

সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাটলে এটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় যে- স্বাধীনতা উত্তর পরবর্তী সকল স্বাধিকার আন্দোলনে বাংলাদেশের তরুণ ছাত্র সমাজের অগ্রণী এবং প্রধান ভূমিকা ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলন, একনায়কতন্ত্র থেকে মুক্তির আন্দোলন সবক্ষেত্রেই বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ মূল নকশাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সবসময় এবং তাতে যোগ দিয়েছে সাধারণ মানুষ। খুব সমসাময়িক শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন, কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দিকে তাকালেও জিনিসটা পরিলক্ষিত হয়। তবে লক্ষ্যনীয় যে পূর্বের চাইতে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের যেকোনো শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্রদের এবং সাধারণ মানুষের ঐক্যমতে পৌঁছানোর ক্ষমতাটি লোপ পাচ্ছে। এর কারণ বোধহয় এখন অনেক যৌক্তিক বিষয়েও আমরা নিজেদের অযৌক্তিক মনোভাবকে প্রাধান্য দিই। অন্যদিকে এর পিছনে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নানা হিসাব নিকাশ থাকতে পারে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে কোনো জাতীয় স্খলনে জনসাধারণের প্রতিবাদহীনতা এবং ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক কিংবা বিজ্ঞানের খুব তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়াদি নিয়ে কিছুদিন কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে নিজেদের ব্যতিব্যস্ত রেখে মূল শোষণান্দোলন থেকে নিজেদেরকে অসম্পৃক্ত রাখা- এটা আমাদের একটা অভ্যাসে পরিণত হতে যাচ্ছে। বিগত কয়েক দশকে আমাদের প্রত্যকের সামাজিক জীবনে যে অর্থনীতিক, রাজনীতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং বসবাস অযোগ্য শহরেই বসত গড়া, বর্তমানে যার বিষবাষ্পে আমাদের প্রত্যেকের প্রাণ ওষ্ঠাগত, সেই দিকে যখনই আন্দোলনের সূচনা হয়, ঠিক তখনই আমাদের সামনে চলে আসে একটা একটা ধর্মীয় সংঘাত কিংবা সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা। বিষয়টা কোনো গোষ্ঠীস্বার্থের সুপরিকল্পনার অংশ কি-না, সেই আলোচনার দিকে যাচ্ছি না, কিন্তু বিজ্ঞান-ধর্ম-সংস্কৃতির আন্তঃসংঘাতকে মূলার মতো সামনে ঝুলিয়ে রেখে উদ্ভট গাধার পিঠে চড়ে শাসনতন্ত্র কায়েম কিংবা শাসনযন্ত্র ধরে রাখার খায়েশে কেউ খুব বেশিদূর এগোতে পারবে বলে মনে হয় না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক থেকে এই হিন্দু মুসলমানের মধ্যে অনেকেই ডিভাইড এণ্ড রুল মেথডে কাজ করার চেষ্টা করেছে, এতে তাৎক্ষণাত ক্ষতি হয়েছে বলা বাহুল্য, কিন্তু চিরতরে বাঙালির ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়েছে, এমনটা নয়। তবে এ কারণে আশান্বিত হয়ে ভবিষ্যতে ভালো সময় আসবে, সেই অপেক্ষা করা বোধহয় বোকামি হবে। বাঙালি আর যা-ই করুক না কেন, আত্মসমালোচনা কিংবা আত্মবিশ্লেষণ করে নিজেদের দুর্বলতাগুলো বের করা তার আদি বৈশিষ্ট্য, প্রয়োজন শুধু সে অনুসারে পদক্ষেপ নেওয়া এবং জ্ঞানের প্রতিটা শাখার প্রতিটা মানুষকে আত্মোপলব্ধিজাত জ্ঞানের চর্চা করা, যাতে যুক্তিমনের শূন্যতাকে পূঁজি করে কোনো গোষ্ঠী তার স্বার্থোদ্ধারে নীলনকশা তৈরি করতে না পারে। অন্তত এটুকু বুঝতে পারাই আশা করি এই সময়ের অন্যতম প্রধান দাবি হওয়া উচিত।