প্রথম পর্ব এখানে।
২
(লেখাটা আমি আমার প্রিয় ছোট বোনকে উৎসর্গ করলাম)
এমন হেমন্তে ছোট বোন এলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি ওর মুখে দিকে। কী সুন্দর নিস্পাপ চেহারা!
হঠাৎ রাত্রিবেলা ঘুম ভেঙ্গে গেলে জানালা দিয়ে দেখি, নারকেল গাছ যেন দৈত্যের মত লম্বা হয়ে ছায়া ফেলেছে। ভীষণ বাথরুম পেলে মা’কে ডাকি-
-মা বাইরে যাবো-
বাথরুম ঘরের ভেতরে নাই, তাই ভয়ে ভয়ে ডাকি। মা বলে-
-তুমি যাও আমি জেগে আছি,
টিপি-টিপি পায়ে দরজার হুড়কো খুলে গোসলখানায় পেচ্ছাপ করে হুড়োহুড়ি করে চলে আসি। না, ভূতের ভয় ঠিক না, তবে কিসের যেন এক ভয় তাড়া করে রাত্তিরে বাইরে গেলেই।
পড়াশনায় অমনোযোগী হবে সবাই, তাই বাবা একদিন ট্রানজিস্টারটা কাঠের আলমারিতে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিল।
সবার মন ভীষণ ভার। চা খাবার উপাই নেই বাড়িতে। বাবা বাইরে গেলে মা আমাদের লুকিয়ে চা দেয়।
আরো রাত্তির হলে আলমারির দরজা ফাঁক করে, নানান কসরত করে হাত ঢুকিয়ে রেডিও অন করা হয়। সবাই মন দিয়ে রেডিও শোনে। আকাশবাণীতে কী দুর্দান্ত নাটক হয়!
বাবা বের হবার আগে মনে করিয়ে দেয়, অংক ট্রানশ্লেসন সবাই যেন করে রাখে যার যার মত।
এইভাবে ইচ্ছেয় অনিচ্ছেয় আমাদের ছোট পৃথিবী চলতে থাকে। যে টুন-টুনি পাখি রোজ করমচা গাছে বসে, সে সেই সময়টাই এসে বসে থাকে। ডানা ঝাপ্টায়।
হামাগুড়ি দিয়ে সন্ধ্যা নামে। পাশের বাড়ির ভাঙ্গা বারান্দায় মাঝি নানা খড়ির চুলো জ্বালিয়ে রান্না শুরু করে।
এক দৃষ্টিতে গনগনে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ধোয়া কুণ্ডুলি পাকিয়ে পাকিয়ে উপরে উঠতে থাকে।
মাঝে মাঝে শুটকির গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠে। মাঝি নানা হাঁটু মুড়ে বসে থাকে। তার শুকনো হাড্ডিসার দেহ বেঁকে চুরে অদ্ভূত দেখায়। মাঝি নানার বৌ বাচ্চা কোথায় থাকে জানিনি কোনো দিন। চূলোর আগুনে তার ছায়াটা অনেক দীর্ঘ আর অদ্ভূত লাগে। তাকে যেন তখন জাগতিক জগতের মানুষ মনে হয় না।
বাতাসে বড় বড় গাছের পাতাগুলো থেকে কেমন এক হিস-হিস করে শব্দ বের হয়। আর গাছগুলোকে পেঁচিয়ে মাধবীলতা উপরে উঠছে,আর লতানো গাছের ফুল থেকে কী অপূর্ব সু-গন্ধ আসে হাওয়ায়!
গেটের কাছে যে বেলিফুলের গাছ আছে তা একদম পুরো বেড়া দেয়া জায়গাটা ছেয়ে ফেলেছে। সন্ধে বেলা পাগল হাওয়া আসে জানালা দিয়ে। আর বেলি ফুলের সুগন্ধ ঝাপ্টা মারে নাকে।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামে, মাধবীলতার ঝাড়ে, বেলিফুল গাছের পাতায়। রোদটাও কেমন মিইয়ে লালচে হয়ে যায়।
মাঝিনানা রান্না চড়ায় খড়িতে। পোড়া গন্ধ আর পাট কাঠির শব্দ পাই পট-পট করে।
সারাদিন জঙ্গলে,আদাড়ে, বাদাড়ে ঘুরে ময়লা ফ্রকের খুঁটিতে হাত মুছি, নাকের সর্দি মুছি। মা’র উগ্র মূর্তি দেখার ভয়ে ভাঙ্গা দালানে ঢুকে পড়ি। ওমনি বিড়ালটা-ম্যাও- করে ওঠে।
নাহ, কেউ টের পাবার আগেই হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসি হ্যারিকেনের আলোয়।
রাত্রি তখন দৈত্যের মত জেঁকে বসেছে।
মেজো বোনকে দেখি কলতলায় একরাশ এঁটো বাসন ধুতে। বড় বোন চলে যাবার পর খুব কম বয়সেই মেজ বোনের ঘাড়ে সব কাজের ভার পড়ে গেছে। বাসন মাজা,বাচ্চা সামলানো, মা’কে সাহায্য করা সব।
আমি দেখেছি নির্ঘাত কলপাড়ের বেড়ার ফাঁক দিয়ে পাশের বাড়ির দু’জন লোক মাঝে মাঝে উঁকি ঝুঁকি দেয়।
ভাবি মা’কে বলতে হবে যেন মাঝি নানাকে বলে বেড়ার ফুটোটা ঠিক করে দেয়।
চাঁদপুরে কেটেছে আমার দূরন্ত শৈশবের কিছুটা। একদিন কী ঝড় এলো। ঝড়ে বিষ্টিতে আকাশ কালো হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন তো চাঁদপুরে বেশির ভাগ বাড়িই টিনের ছিল। মড়-মড় করে আমাদের বাড়ির সামনে যে যে টিনের বিশাল ঘর ছিল, যাতে পিওন চাপরাশিরা থাকে- সে ঘর পড়ে গেলো কাত হয়ে।
বাবা সবাইকে নিয়ে বেশ দূরে দালানঘরের দিকে এগুতে থাকে।আমার হাত ধরে মা। সবাই ছুটছি। বাতাস মনে হয় আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে। মা আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে একসময় বসে পড়ে। বাতাসের গতি তখন ভয়ঙ্কর।
ওদিকে দালানে যারা আশ্রয় নিয়েছে সবাই হা-পিত্যেস শুরু করেছে। ততক্ষনে মা আমাকে ধরে দ্রুত দালানে পৌঁছে গেল। ঝড়ের দাপা-দাপি তখনও চলছে।
এক সময় প্রকৃ্তি ঠাণ্ডা হল। চার দিকে ধংশস্তুপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গাছ পালা উপড়ে পড়ে আছে।পুকুরের পানি টই-টই করে উপছে পড়ছে। সব মাড়িয়ে আমরা নিজ বাড়ি ফিরে এলাম।
সেদিন বিকেলে মেজ ভাই খেলছে। আমি ওদের বল এগিয়ে দিচ্ছি। এইকাজটা আমার খুব প্রিয় ছিল। যেন কৃতার্থ হয়ে যেতাম।ঈর্ষা হত ইশ! কী সুন্দর খেলা করে- অথচ আমাকে নেয়না।
তো সেদিন খেলার মাঝে ভট-ভট শব্দ শুনতে পেলাম। মেজ ভাই বলে,
-হেলিকপ্টার, চলো দেখি গিয়ে-
আমার হাত ধরে ছুট’তে শুরু করেছে। হেলিকপ্টার উড়ে আমরাও পেছন পেছন ছুটি।
উফফ! কী দৌড় না দৌড়াচ্ছি। ওমা! সামনে তাকিয়ে দেখি নদির ওপারে থামলো হেলিকপ্টার। উপায়!
এক মাঝি ছিল সে নৌকো বাইতো। তার নাম ষোলদানা। কি অদ্ভুত নাম। মানুষের কি এমন নাম হয়? কী জানি।
মেজ ভাই তাকে অনুরোধ করতেই সে আমাদের নদি পার করে দিল। ডাকাতিয়া নদি। বাপরে কী ভয়ংকর নাম!
হেলিকপ্টার দেখতে গেলাম। ভটভটানি শব্দে কানে তালা লাগার উপক্রম। আমার রুক্ষ চুল উড়তে লাগলো।
চারদিকে ধানখেতের গাছগুলো দুলতে লাগল। আমি অবাক বিস্ময়ে উঁকি-ঝুঁকি দিতে লাগলাম।
(চলবে)
চলুক।
দেরিতে হলেও পড়তে পেরে বেশ ভালো লাগছে। ১ম পর্ব আবারও পড়লাম। পরের অংশগুলোর অপেক্ষায় রইলাম।
বেশ ভাল লেগেছে। প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্ব একসাথে পড়ে ফেললাম। (F)
@সৈকত চৌধুরী,
অনেকদিন পরে মন্তব্য পেয়ে ভালোলাগলো। ফুলখানি যত্ন করে রেখে দিলাম।
দুটি পর্ব একসাথে পড়লাম। ইট কাঠের ঢাকা শহরে আমার জন্ম আর বেড়ে ওঠা। খুব ছোট বেলায় দুই/একবার গ্রামে যাওয়া হয়েছিল আর একবার মুক্তিযুদ্ধের সময়।শিশুকালের অতটুকু স্মৃতি নিয়েই যখন ভাবি তখন আপনার লেখার মতই চিত্র মনে ভাসে,তবে ধরতে পারি না। আবার একটু ধরার চেষ্টা করলাম। স্নিগ্ধ একটি লেখা। আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে যেখানে বলেছে, আপার সন্তান হবার এক বছরের মাথায় আপনার বোন হওয়ায় মা লজ্জা পেতেন,কিন্তু পড়ে তা কেটে গিয়েছিল অথবা বাবাকে লুকিয়ে আপনাদের মা আপনাদের চা দিত।খুব সুন্দর।
@সপ্তক,
সত্যি কথা বলতে কি আপনাদের আগ্রহ, এবং উৎসাহ আমাকে লিখতে আরো প্রেরণা যোগায়। এমন পাঠকসকল থাকলে বারবার লিখতে ইচ্ছে করে।
অঃটঃ যে বোন’কে দিয়ে শুরু করেছিলাম লেখা। আমার ছোট বোন দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পর
আমাদের পুরো পরিবারই শারিরীক মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। তাই নিয়মিত লিখতে পারিনা।
আপনারা সবাই তার রোগমুক্তির জন্য কামনা করবেন-
@আফরোজা আলম,
বেদনা যেখানে গভীর সান্ত্বনা সেখানে ডুবে যায়। শুধু এতটুকুই প্রত্যাশা করব যে এখন ক্যান্সারের রুগী অনেকদিন সারভাইভ করে যদি কিনা মানসিকভাবে মোকাবেলা করতে পারে,আশা করব আপনারা যারা বড় ভাইবোন তারা ছোটবোনটিকে মানসিক ভাবে শক্তি যোগাবেন। আমার বোন নেই,আপ্নার বোনের জন্য এই বড় ভাই এর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা (F)।
চোখ থাকলো সামনের পর্বের দিকে… (F)
@প্রতিফলন,
আগামী পর্ব অতি শিঘ্র হতে পারে। আবার দেরীও হতে পারে। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে লিখতে
চেষ্টা করব। ভালোলেগায় আমি আপ্লুত।
কারো বাল্যকালের মফস্বল বা গ্রাম্য জীবনের সুখস্মৃতি গুলো পড়তে বেশ লাগে। মনে হয় কত কিছুইনা মিস করেছে আমি। আমার শৈশব কেটেছে শহরে। মাঝে সাঝে পরীক্ষা শেষে গ্রামে যেতাম স্বল্প সময়ের জন্য। কি না আনন্দ লাগত গ্রামে গেলে। ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে হেটে গিয়ে গাছ থেকে বেগুন, সীম, টমেটো, মরিচ ছিড়ার মজাই ছিল আলাদা। আমাদের অনেক কাঁঠাল গাছ ছিল। গাছ থেকে পাকা কাঁঠাল পেড়ে গাছ তলাতেই কাঁঠাল খাওয়ার সে কি মজা তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। বিপত্তিটা বাধত কাঁঠাল খাওয়ার পরে। হাতে, ঠোঁটে লেগে থাকা কাঁঠালের আঠা মুছার সে কি পেরেশানি।
আপনার লেখাটা সেই দিন গুলো কথা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিল। (F)
@রাজেশ তালুকদার,
@রাজেশ তালুকদার,
দুঃখিত জবাব দিতে যাবার আগেই ক্লিক পড়ে গিয়েছিল। আমাদের শৈশব কেটেছে পুরোপুরি গ্রামে নয়।
বদলির চাকরির কারনে বিভিন্য যায়গায় আমার বাবার যেতে হোত। সেই সূত্রে আমরাও-
সেখানেই ঘটে নানান অভিজ্ঞতা। বোধ করি সবার জীবনেই এমন কম বেশি আছে। আমি আনন্দিত আপনি
কষ্ট করে পড়াতে। ধন্যবাদ।
আমাদের সবারই শৈশব বোধ হয় এমনি আনন্দ, রোমাঞ্চ আর বিস্ময়ে ভরা!
আগ্রহ নিয়ে থাকলাম পরের পর্বের।
বিভূতিভূষণ আমার প্রিয় একজন লেখক তার একটু ছোঁয়া পেলাম আপনার লেখায়।
ছোটবোনের সুস্থতা কামনা করছি! ভাল থাকুন!
@লাইজু নাহার,
ঠিক বলেছেন। শৈশব কে আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। কত মধুর আবার ছোট খাট কারনে কত দুঃখবোধ জাগত তখন। সবই ছিল যেন অপার বিস্ময়ের ব্যাপার।
বিভূতি ভূষণ আমারও প্রিয় লেখক। তার পথের পাঁচালি কতবার যে পড়েছি।
আপনার ভালোলেগেছে জেনে আনন্দিত আমি।
একবারে গিলে ফেললাম।তাড়াতাড়ি পরের পর্ব লিখুন।কে জানে বড্ড ভয় লাগে,যদি এর মধ্যেই পাঠকের মৃত্যু ঘটে? 🙁
@সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড,
এমন বলতে নেই। এই ধরাতলে এসেছি যখন যেতে তো হবেই কথায় আছে না-
‘জন্মিলে মরিতে হবে
অমর কে হবে ভবে” (ভুল থাকতে পারে)
তবু যতক্ষন আছি, আশা নিয়েই বেঁচে থাকা। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
চমৎকার হচ্ছে, এক নিঃশ্বাসে পড়লাম 🙂
@টেকি সাফি,
যখন মনে হয় একটু একটু করে লিখি। কে জানে কেমন দাঁড়াবে শেষ পর্যন্ত। আপনাকে ধন্যবাদ।
আফরোজা আমার বাল্যকাল স্মরণ করিয়ে দিল–কি চমৎকার দিনগুলি–হসি-খুশী, সুখ-দুঃখে ভরা।
আজ জীবন সায়াহ্নে আফরোজা আমাকে নিয়ে গেল সেই সব দিনগুলিতে।
আমাদের সবারই জীবনে সেই সব দিনগুলি আছে–বেঁচে থাকে।
@আবুল কাশেম,
মনে পড়ে সবই মনে পড়ে। অনেক ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়ার জন্য।
তোমার লেখায় আমি দেখতে পাই আমার বাল্যকাল, আমার গ্রাম আমার দেশ। সিরিজটা খুব ভাল হচ্ছে। (F)
@আকাশ মালিক,
আসলে কৈশরের দিনগুলো মফস্বলে কেটেছে। তাই অনেক স্মৃতি মনে গাঁথা আছে, কিছু মনের আয়নায় আসে, কিছু চিরকালের জন্যে হারিয়ে ফেলেছি। অনেকটা আত্মকথনের মতই বিষয়টা।
এটা কি গল্প!!! জানাবেন।
@গীতা দাস,
প্রথম পর্বে একরকম ভেবেছিলাম। পরের পর্বে আর এক রকম। দেখা যাক কী দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত, গল্প নাকি অন্য কিছু।