বোন আর ভগ্নিপতি বাসা থেকে বেরিয়ে যেতেই দরজার ছিটিকিনিটা আটকে দেয় রফিক। বিছানার পাশে লাজরাঙা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জুঁই। প্রত্যাশায় উন্মুখ। স্বামী যে দুবাই থেকে তাকে না বলে উড়ে চলে আসবে, সে কথা স্বপ্নেও ভাবে নি সে। ননদ নাইমা মোবাইল ফোনে কল দিয়ে বলেছিলো যে, রফিক দুবাই থেকে তার জন্য উপহার সামগ্রী পাঠিয়েছে। সেগুলো নিতেই নরসিংদী ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলো সে। আসার পরেই অবশ্য ননদ জানায় যে, “ভাইয়া কিছু পাঠায় নি। এমনিতেই আসতে বলেছি তোমাকে।” ননদের প্রতারণা রাগ হয়েছিলো খুব। বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিলো জুঁই সাথে সাথেই। সামনে পরীক্ষা। তার প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু ননদের স্বামী তার মিলিটারী গোঁফ মোচড়াতে মোচড়াতে অভিযোগের সুরে বলেছিলো, “ভাবিসাব আমগোরে পর ভাবেন। তাই থাকতে চান না।”

এরপর আর সহজে আসা যায় না। থাকতে হয়েছিলো ওখানে। কিন্তু আজ ভোরে হঠাৎ করে সুটকেস হাতে রফিককে ঘরে ঢুকতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছে সে। এই চমক দেবার জন্যই ননদ আর তার স্বামী যে মিথ্যা কথা বলে ঢাকা আনিয়েছে বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। আনন্দে তরুণী হৃদয় পূর্ণ হয়ে যায় তার। নাইমার প্রতি যে রাগ পুষে রেখেছিলো এ কদিন, তা নিমেষেই ভুলে যায় সে।

রফিক আসার পরেই তড়িঘড়ি করে ননদ আর তার স্বামী বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। ননদের চলে যাওয়াতে একদিকে লজ্জা পায় জুঁই, আবার মনে মনে খুশিও হয়। নাহ, বুদ্ধি আছে দজ্জাল ননদিনীর। দরজার কাছ থেকে জুঁইয়ের দিকে এগিয়ে আসে রফিক। লজ্জায় আরো নত হয়ে যায় জুঁইয়ের মুখ। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে তার। জুঁইয়ের একেবারে কাছে এসে গাঢ়স্বরে রফিক বলে, “তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেবো।”

না বলে দুবাই থেকে রফিকের উড়ে আসাটাই তারজন্য সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ। এটিকেই হজম করতে পারছে না সে। আর কী সারপ্রাইজ রফিক দেবে কে জানে?

“কী সারপ্রাইজ?” অস্ফুটস্বরে জিজ্ঞেস করে সে।

“চোখ বন্ধ করতে হবে আগে। তারপর দেবো।” রফিক বলে।

“ঠিক আছে চোখ বন্ধ করছি। দাও এবার।” সত্যি সত্যিই চোখ বন্ধ করে সে। চোখ বন্ধ করে অবশ্য লাভই হয়। লজ্জায় চোখ খোলা রাখতেই সমস্যা হচ্ছিলো তার এতক্ষণ। নিজের অজান্তেই বুজে যাচ্ছিলো সেগুলো।

“উঁহু, এভাবে হবে না। তুমি চোরা চোখে দেখবা।”

জুঁইয়ের গায়ের আরো কাছে চলে আসে রফিক। ঘন হয়ে নিঃস্বাস পড়ছে। উত্তপ্ত, আগুনের হল্কার মতো। জুঁইয়ের নিজেরও নিঃস্বাস গাঢ় হয়ে আসছে। পা দুটোকে দুর্বল লাগছে। মনে হচ্ছে হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে সে। অপেক্ষা আর সহ্য হচ্ছে না। গলার কাছে রফিকের পুরুষালী হাতের স্পর্শ পায় জুঁই। অজান্তেই কেঁপে উঠে শরীরটা তার। অস্ফুট গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসে কণ্ঠ দিয়ে। গলা থেকে ওড়নাটা খুলে নেয় রফিক। মনে মনে হাসে জুঁই। পুরুষ মানুষ। কী করবে সহজেই অনুমান করা যায়।

ওড়নাটা খুলে নিয়ে জুঁইয়ের চোখ বেঁধে দেয় রফিক।

“উ করে শব্দ করে জুঁই। এতো জোরে বাধছো কেনো? ব্যথা পাচ্ছি যে? ডাকাত নাকি?”

“হু, ডাকাতইতো।” শব্দ করে হাসে রফিক।

“ওরে আমার গব্বার সিং। কী ডাকাতি করবে শুনি। নিজের ঘরে কেউ ডাকাতি করে বুঝি?” ভেংচি কেটে তরল গলায় বলে জুঁই।

“বললাম না সারপ্রাইজ দেবো। বুকের অনাবৃত অংশে রফিকের হাতের স্পর্শ পায় জুঁই। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তার। শরীরের সমস্ত পশমগুলো খাড়া হয়ে গিয়েছে। রফিকের কিলবিল করা আঙুলগুলো নীচের দিকে না গিয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। গলার কাছে এসে শক্ত করে চেপে ধরে। চমকে উঠে জুঁই। এ যে ভালোবাসার নরম হাত নয়। ঘৃণার কর্কশ হাত সেটা বুঝতে বিন্দুমাত্রও অসুবিধা হয় না তার। অজানা আশংকায় কেঁপে উঠে সে। অবোধ্য একটা অর্ধ চীৎকার বেরিয়ে আসে তার গলা দিয়ে।

‘মানা করার পরেও কলেজ ছাড়িস নাই ক্যান মাগি।‘ গলায় চাপ বসিয়েই হিসহিস করে উঠে রফিক।

‘সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষাটা দিয়েও ছেড়ে দেবো। এবারের মত মাফ করে দাও।‘ আতংকিত গলায় বলে জুঁই।

‘ক্যান আগে ছাড়তে সমস্যা কী? তুই কী ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবি? আমি কী কম কামাই করি যে, তোর পড়ালেখা কইরা চাকরি করণ লাগবো?’ জুঁইয়ের চুল মুঠি করে ধরে সজোরে টান দেয় রফিক।

ব্যথায় আর্ত চীৎকার বেরিয়ে আসে জুঁইয়ের গলা থেকে। চীৎকার ঠেকাতে পকেট থেকে রুমাল বের করে রফিক। তারপর সেটা পুরে দেয় জুঁইয়ের মুখে। টেনে হিঁচড়ে তাকে নিয়ে আসে টেবিলের পাশে। জুঁইয়ের ডান হাতটাকে বিছিয়ে দেয় টেবিলের উপর। তারপর আলতো করে হাত বুলায় ওই হাতে।

‘এই হাত দিয়ে লেখাপড়া করো তুমি তাই না? খুবই খারাপ কথা। এই হাতই একদিন তোমারে বেয়াড়া বানাবে। আমার কথা শুনবা না তখন। এখনই শোনো না। আরো বড় বিদ্বান হওয়ার পরতো পাত্তাই দিবা না। তাই না? ক্ষ্যাপার মত হাসে রফিক।

মাইয়া মানুষের এত পড়ালেখা দিয়া কী হইবো? আমিতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বিয়া করি নাই। করছি কী? করতে চাইলেতো পারতামই। পারতাম না কও? কত পাবলিকে তাগো ডাক্তারি পড়া মাইয়া লইয়া ঘুরছিলো আমার লগে বিয়া দেওনের লাইগা। করি নাই। বাপের ব্যাটা আমি একখান। লাত্থি দিয়া বাইর কইরা দিছি ওইগুলারে। এখন বিয়া বসবো, কিন্তু পরে আমারে ছোটো চোখে দেখবো। তোমারে বিয়া করছিলাম এই লাইগা যে, তুমি আমার কথা শুনবা। স্কুলে পড়া মাইয়া, ওগো মত পাংখা গজায় না। এখন দেখতাছি তোমারও ডানা গজাইতাছে।‘

মাথা এদিক ওদিক করে কিছু বলতে চায় জুঁই। মুখ বাধা থাকায় শব্দ বের হয় না।

‘একটু আগে না বলছিলা আমি গব্বার সিং কি না? হ, আমি গব্বার সিং। তোমারও হাত কাইটা লমু আমি সিনেমার লাহান।‘ জুঁইয়ের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে সে।

‘মুঝে ও হাত দিয়ে দে জুঁই, মুঝে ও হাত দিয়ে দে।‘ গব্বার সিং এর মত নাটকীয় গলায় চেচিয়ে উঠে রফিক। জুঁইয়ের ডান হাতটাকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে সে টেবিলের উপরে।

কিছু বুঝে উঠার আগেই ডান হাতে তীব্র ব্যথা অনুভব করে জুঁই। ধারালো ছুরির পোঁচ বসিয়ে দিয়েছে রফিক ওখানে। হাত থেকে কবজি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেই জ্ঞান তীব্র যন্ত্রণায় জ্ঞান হারায় জুঁই।

এতক্ষণ যা বললাম, তা গল্প নয় সত্যি ঘটনা। হাত কাটার পরে সেই কর্তিত কব্জিকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করে রফিক। হাত কাটার পরেই ঘরে ফিরে আসে তার বোন এবং ভগ্নিপতি। রক্তাক্ত জুঁইকে হাসপাতালে নেবার বদলে রক্ত পরিষ্কার করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার ননদ। কাতর অনুনয় বিনয়ের পরে কয়েক ঘন্টা পরে মন গলে তাদের। নিয়ে যায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই জুঁই ডাক্তারদের মাধ্যমে খবর পাঠায় তার বাবা-মাকে। তার বাবা, মামা এবং এক মামাতো ভাই ছুটে আসে হাসপাতালে। সেখান থেকে তারা জুইকে নিয়ে যায় পঙ্গু হাসপাতালে। জুঁইয়ের স্বামীও তাদের সঙ্গ নেয়। পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তাররা যখন জিজ্ঞেস করে কী ঘটেছিলো, তখন এই গাড়ল রফিক বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তারদের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। বলে যে, তারা জুঁইয়ের হাত কেটে ফেলেছে। সবাইতো আর রফিকের মত খেঁজুর পাতা খায় না। ডাক্তারদের ধাতানি খাবার পরে অবশেষে সব স্বীকার করে রফিক। ডাক্তাররা তখন কাটা হাত উদ্ধারের জন্য সাহায্য চায় তার। তাকে সহ পঙ্গু হাসপাতালের লোকেরা সন্ধান চালায় সেই ডাস্টবিনে। তবে মাত্র চারটা আঙ্গুল খুঁজে পায় তারা সেখানে। বাকিটা পাওয়া যায় নি। চার আঙুল নিয়ে হাসপাতালে ফিরে আসার পরে অবশ্য ডাক্তাররা কোনো সুখবর দিতে ব্যর্থ হয়। দীর্ঘ সময়ের কারণে জুঁইয়ের কাটা আঙুলগুলোর কোষগুলো মরে গিয়েছে। ওই আঙুলগুলোকে আর জোড়া দেওয়া যাবে না।

বাংলাদেশে হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে যেনো নারীর উপর পুরুষের পৈশাচিক আক্রমণ বেড়ে গিয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগেই রুমানার নাক কামড়ে ছিড়ে ফেলেছে তার স্বামী সাইদ। আঙুল ঢুকিয়ে গেলে দিয়েছে তার দুই চোখ। ভদ্রমহিলা এখন চির অন্ধ। সেই ঘটনার জের কাটতে না কাটতে আবার জুঁইয়ের ঘটনা। এই সমস্ত ঘটনা কেনো ঘটছে এবং এর পিছনের কারণগুলোকে চিহ্নিত করার সময় এসে গিয়েছে জরুরী ভিত্তিতে। এইভাবে এক বদমাশ পিশাচের কবলে পড়ে সম্ভাবনাময় একেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। সমাজে যদি চিড়িয়া থাকে, তবে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করতে হবে তাদের। তারপর ঘাড়ে ধরে পাঠিয়ে দিতে হবে চিড়িয়াখানায়। সমাজটা মানুষের জন্য, জানোয়ারদের জন্য নয়।

জুঁই জানিয়েছে যে, সে লেখাপড়া ছাড়বে না। বা হাতে লিখতে শিখবে। তারপর পড়াশোনা শেষ করবে। রুমানা ইতোমধ্যেই ব্রেইল শিখতে লেগে গিয়েছেন। এর মাধ্যমেই পিএইচডি শেষ করবেন তিনি। আমি এই সাহসিকতাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু, এই সাহসিকতা আমার কাম্য নয়। আমি চাই মেয়েরা আঘাত পাবার আগেই আঘাত করা শিখুক। কেউ তাদের উপর চীৎকার করলে, দ্বিগুণ শব্দে তারাও চেচাক। ভিড়ের মধ্যে কেউ তাদের কোমল অংশে হাত দিলে, লজ্জা শরমের তোয়াক্কা না করে তারাও সেই লোকের শক্ত জায়গায় মুঠো সবল করে সজোরে আঘাত করুক। ধর্ষণ করতে আসলে ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে নিক ধর্ষণোদ্যত ধ্বজটিকে। কেউ আঙুল দিয়ে চোখ তুলতে আসলে, চুলের কাঁটা খুলে নিয়ে তারাও চোখ খুলে নিক আক্রমণকারীর।

একটা বিষয় আমাদের মেয়েরা খুব সম্ভবত জানে না। অত্যাচারী পুরুষের মত কাপুরুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। দুর্বলের উপর দুঃশাসন চালাতে এদের জুড়ি নেই। এদেরকে শায়েস্তা করতে শুধু দরকার সামান্য একটু সাহসের। ওইটুকু নিয়ে রুখে দাঁড়ান। দেখবেন বঙ্গোপসাগরের বানের জলের সাথে ভেসে যাবে ওইসব বীরপুঙ্গবেরা।