এই প্রবন্ধটা ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত সায়েন্টিফিক আমেরিকানের Mysteries of the Mind সংখ্যায় ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী রোনাল্ড মেলজ্যাকের “Phantom Limbs” এর ভাবানুবাদ। আসলে এটা ভাবানুবাদ, আক্ষরিক অনুবাদ নাকি অনুবাদের ব্যর্থ চেষ্টা তা আমি বলতে পারব না। অর্থের বিকৃতি না ঘটিয়ে আমার পক্ষে যত প্রাঞ্জলভাবে অনুবাদ করা সম্ভব, তাই করেছি। বিজ্ঞান সম্পর্কিত যেকোন লেখার একটা বড় সমস্যা হল যে নানা পরিভাষা-বিভাষার ভারে পাঠক লেখার কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। প্রবন্ধে কিছু একটা বলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কি বলা হয়েছে- বিজ্ঞানের ছাত্র ব্যতিত খুব কম পাঠকই তা ধরতে পারেন। এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রবন্ধের একদম শেষে আমি প্রত্যেকটি জার্গনের সংজ্ঞা দিয়েছি। এছাড়া অন্য কোন শব্দ বুঝতে সমস্যা হলে জানাতে পারেন, ওটার সংজ্ঞাও শেষে যুক্ত করে দিব।
:line:
১৮৬৬ সালে আমেরিকার আটলান্টিক মান্থলি পত্রিকায় বেনামে একটি গল্প ছাপা হয়েছিল- “দ্যা কেইস অব জর্জ ডেডলো”। গৃহযুদ্ধের সময় যুদ্ধাহত গল্পের নায়কের একটি হাত ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল। হাসপাতালে যখন তিনি চেতনা ফিরে পেলেন, তখনও তিনি জানেন না যে তাঁর দু’টো পাও ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে। কোন এক অদ্ভুত কারণে তিনি ব্যাপারটা তখন বুঝতে পারেননি। একজনকে ডেকে তিনি তাঁর পা’টা একটু চুলকে দিতে বলেছিলেন।
পরে জানা গিয়েছিল যে গল্পটা S. Weir Mitchell নামক সেই সময়কার একজন নামকরা স্নায়ুবিজ্ঞানীর লেখা। মিশেল পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যে অনেক সময় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলার পরও রোগী তার কেটে ফেলা অঙ্গকে অনুভব করতে পারে। এই চরম অদ্ভুত ব্যাপারটা সঙ্গত কারণেই অন্যদের বোঝানো কঠিন ছিল, তাই ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন যে তিনি আসলে গল্পটি বেনামে ছাপিয়ে তাঁর সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে চাচ্ছিলেন। এই সব অশরীরি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্তিত্ব কিন্তু খুব বিরল না, এমনকি সেসব অশরীরি অঙ্গে বেদনা অনুভব করাটাও অস্বাভাবিক কিছু না। এই ব্যাথা সময়ের সাথে হ্রাস পায়১, কিন্তু ভুক্তভোগীর জন্য এটা খুবই অস্বস্তিকর।
এই অশরীরি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একটা কৌতূহলোদ্দীপক বৈশিষ্ট্য হল যে রোগীর কাছে এই অঙ্গগুলোর অনুভূতি খুবই স্বাভাবিক মনে হয়। এই অনুভূতিগুলো এতই দৃঢ় ও সুক্ষ্ম যে অনেক সময় দেখা যায় রোগী তার অদৃশ্য পায়ের উপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে অথবা তার অদৃশ্য হাত দিয়ে চায়ের কাপ ধরার চেষ্টা করছে! এই অলীক অঙ্গগুলোর অস্তিত্ব অনেক সময় বাস্তব অঙ্গের চেয়েও বেশি বাস্তব অনুভূত হয়, বিশেষ করে যখন ব্যথাটা অসহনীয় হয়ে পড়ে। রোগী যখন বসে থাকে তখন তার অশরীরি হাত তার শরীরের পাশেই ঝুলে থাকে, সে হাটা শুরু করলে তার এই হাতটিও শরীরের অন্য সব অঙ্গের সাথে তাল মিলিয়ে চলে। তার এই অশরীরি হাতটি একদম বাস্তব হাতের মতই আচরণ করে, কিন্তু তবুও সে সবার ধরা-ছোয়ার বাইরে থাকে। রোগী বসলে তার অশরীরি পা’টি একটি সাধারণ পায়ের মতই বেঁকে যায়, শু’লে তার পা’টি একটি সাধারণ পায়ের মতই প্রসারিত হয়। মাঝে মাঝে ভুক্তভোগীর মনে হয় যে তার অদৃশ্য অঙ্গটি বুঝি কোন অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে আটকে আছে। এক ব্যক্তির মনে হচ্ছিল যে তার এক হাত দেহের সাথে ৯০ ডিগ্রী কোণে সোজা হয়ে আছে, একারণে সে সবসময় দরজা দিয়ে ঢোকার সময় পাশ ফিরে ঢুকত যাতে দেয়ালের সাথে তার “হাত” এর ধাক্কা না লাগে। আরেকজনের মনে হত তার “হাত” পেছনে বাঁকা হয়ে আছে তাই সে সবসময় পাশ ফিরে, নয়ত উপুড় হয়ে শুতো।
অশরীরি অঙ্গের এই রহস্যজনক অনুভূতিটি দৃঢ়তর হয় যখন অশরীরি অঙ্গের অনুভূতিগুলো অঙ্গবিচ্ছেদের আগের অনুভূতির সাথে হুবহু মিলে যায়। যেমন, কারও পায়ের ক্ষতটা হয়ত পা কেটে ফেলার পরও অনুভূত হয়, কিংবা আঙ্গুলের আংটিটা হাত কেটে ফেলার পরও শক্ত মনে হয়! এই অনুভুতিগুলো কিন্তু এদের স্মৃতির অংশ না, এরা এই অনুভূতিগুলো ঘটমান ঘটনার মতই অনুভব করে। কৃত্রিম হাত-পা লাগালেও এই অনুভূতির কোন পরিবর্তন ঘটে না, বরং হাতমোজার ভেতরে হাতের অনুপ্রবেশের মত এই অনুভূতিগুলোও ওই প্রস্থেটিক হাত কিংবা পায়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
এই অদৃশ্য অঙ্গগুলোর অনুভূতি বাস্তব মনে হওয়ার পেছনে কারণ আছে- শুধু ব্যথা না, তাপ, ঠান্ডা ও চাপের মত বিভিন্ন অনুভূতিও অনুভূত হয়। অশরীরি অঙ্গটির উপর পানি ঢাললে সেটি আবার ভিজেও যায়! অদৃশ্য অঙ্গগুলো যখন চুলকায় তখন বেশ বিপত্তি হয়, তবে জায়গামত চুলকে দিলে মাঝে মাঝে অনুভূতিটা চলে যায়। তবে এসব “স্বাভাবিক” অনুভূতির চেয়ে এমপ্যুটিদের জন্য ব্যথার অনুভূতিটাই বেশি দুঃসহ মনে হয়, কারণ কোন ওষুধ দিয়েই এই ব্যথা প্রশমন করা যায় না।
এই অশরীরি অঙ্গগুলোর সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বৈশিষ্ট্য হল যে ভুক্তভোগী এগুলোকে তার নিজের দেহেরই অংশ মনে করে। নড়াচড়া করলে রক্ত-মাংসের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো যেভাবে নড়ে, এই “অদৃশ্য” অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোও একইভাবে নড়াচড়া করে। অঙ্গ বিচ্ছেদ করলেই অশরীরি অঙ্গ গজিয়ে উঠবে এমন কোন কথা নেই। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও অশরীরি অঙ্গ দেখা দিতে পারে, যেমন- বাইক থেকে ছিটকে আরোহী ফুটপাথের উপর আছড়ে পড়লে তার কাঁধ অবস্থানচ্যুত হয়ে পড়ে, হাত আর মেরুদন্ডের মাঝের স্নায়ুগুলো ছিড়ে যায়। তখন এই অকার্যকর হাতের মধ্যে একটি অশরীরি হাতের অনুভূতি জন্ম নিতে পারে যা রক্ত-মাংসের হাতটির সাথে কো-অর্ডিনেটেড হবে। রক্ত-মাংসের হাতটা সম্পূর্ন অবশ হলেও এই অশরীরি হাতে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হতে পারে। হাতটা পুরোপুরি কেটে ফেললেও ব্যথা চলে যায় না। যাদের শরীরের নিচের অংশ অবশ, তারা তাদের পায়ের মধ্যে অশরীরি উপস্থিতি অনুভব করতে পারে, এমনকি যৌনাঙ্গেও! দুর্ঘটনার পরপর অশরীরি অঙ্গটি শরীরের সাথে সংযুক্ত নাও থাকতে পারে। যেমন, কারও মনে হতে পারে যে তার পা বুকের উপর খাড়া হয়ে আছে যদিও সে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে তার পা রাস্তার উপর পড়ে আছে। পরে অবশ্য তা শরীরের সাথে কোঅর্ডিনেটেড হয়ে পড়ে, অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত্য চোখ খোলা থাকে। কোন কোন শারীরিক প্রতিবন্ধী দাবি করেন তাদের পায়ে সবসময় সাইকেল চালানোর অনুভূতি কাজ করে এবং এজন্য তাঁরা সর্বক্ষণ ক্লান্ত থাকেন, যদিও তাঁদের পা বিছানায় শায়িত আছে।
নিউরোমা থেকে সোমাটোসেন্সরি করটেক্সে সিগন্যাল প্রবাহের নিউরাল পাথওয়ে
অদৃশ্য অঙ্গের সবচেয়ে পুরনো ব্যাখ্যা হল যে শরীরের যে স্থানে অঙ্গটি কর্তন করা হয়েছে, সেই স্থানের স্নায়ুগুলো নিউরোমা নামক স্নায়ুগ্রন্থি গঠণ করে তাদের মত করে ইম্পালস্(impulse) তৈরী করতে থাকে, যেন কিছুই হয়নি। স্নায়ুগুলো যখন মেরুদন্ড কিংবা মস্তিস্কে ইমপালস্ পাঠাতে সক্ষম হয়, তখনই আমরা কোন কিছু অনুভব করতে পারি। তো, এই নিউরোমাগুলো থেকে ইমপালস্ মেরুদন্ড হয়ে থালামাসের(মস্তিস্কের কেন্দ্র) ভেতর দিয়ে করটেক্সের somatosensory এলাকায়(স্নায়ুতন্ত্রের ধ্রুপদী মডেল অনুযায়ী করটেক্সের এই অঞ্চলই আমাদের যাবতীয় অনুভূতি সৃষ্টি করার জন্য দায়ী) প্রবেশ করে। এই ব্যাখ্যাকে ভিত্তি করে অদৃশ্য অঙ্গের ব্যথা দূর করার জন্য নিউরোমা থেকে এসব ইমপালসের প্রেরণ বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই উদ্দেশ্যে নিউরোমার স্নায়ুগুলো কাটা হয়েছে, মেরুদন্ডের ভেতরকার স্নায়ু কাটা হয়েছে, এমনকি করটেক্সের সংশ্লিষ্ট অংশগুলোও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এসব করার পর কয়েক মাস কিংবা বছরের জন্য ব্যথা দূর হয়ে গেলেও পরে আবার ফিরে আসে। তাছাড়া এই প্রক্রিয়ায় অদৃশ্য অঙ্গগুলোর অনুভূতিও বন্ধ করা যায় না। এখান থেকে একটা বিষয় পরিস্কার হয় যে অদৃশ্য অঙ্গগুলোতে ব্যথার জন্য নিউরোমার কার্যক্রমের ভূমিকা থাকলেও নিউরোমা একাই এই অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টির জন্য দায়ী না।
আরেকটা অনুকল্প(hypothesis) দাবি করে যে নিউরোমা নয়, মেরুদন্ডের ভেতরে কিছু স্নায়ু শরীর থেকে সাধারণত যে পরিমাণ ইনপুট আসে তা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় নিজেরা নিজেরাই অতিরিক্ত পরিমাণে সিগন্যাল প্রচার করতে থাকে। আমাদের সেন্সরী অরগানগুলো থেকে স্বাভাবিক নিয়মে কোন ইমপালস্ পেলে সেগুলো যেভাবে করটেক্সে সম্প্রচারিত হত, এই অস্বাভাবিক ইমপালস্গুলোও একইভাবে করটেক্সে সম্প্রচারিত হয়। ষাটের দশকের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল শরীরের কোথাও ঐন্দ্রিয়ক স্নায়ু কেটে ফেললে মেরুদন্ডের স্নায়ুগুলো অস্বাভাবিক পরিমাণে তড়িৎ ইমপালস্ উৎপাদন করতে থাকে। এখানেই মূলত এই অনুকল্পের উৎপত্তি।
অন্য পর্যবেক্ষণ আবার এই ব্যাখ্যাকে অপ্রতুল করে ত্তুলেছে। যেসব শারীরিক প্রতিবন্ধীর মেরুদন্ডের উপরের অংশ পুরোপুরি ভেঙ্গে গিয়েছে, তারাও মাঝে মাঝে পায়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করে, অথচ তাদের পা অবশ হওয়ার কথা! মেরুদন্ডের যেসব স্নায়ুকোষ শরীরের এই অঞ্চল থেকে সিগন্যাল মস্তিস্কে সম্প্রচার করে তাদের উৎপত্তি মেরুদন্ডের ভগ্নাংশের অনেক নিচে, অর্থাৎ, মেরুদন্ড দিয়ে তাদের মস্তিস্কে প্রবেশ করার কোনও রাস্তাই নেই। সাম্প্রতিক গবেষণা দাবি করছে যে খোদ মস্তিস্কেই হয়ত অশরীরি অঙ্গের অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন মস্তিস্কের somatosensory সার্কিটে সিগন্যালের প্রবাহের পরিবর্তনের ফলে এই অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারে।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন গবেষক ফ্রেডরিক এ লেনৎজ্ লক্ষ করেছিলেন যে এক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মেরুদন্ড গলার নিচ থেকে ভাঙ্গা থাকা সত্ত্বেও সে শরীরের নিচের অংশে যন্ত্রণা অনুভব করতে পারত এবং তার মস্তিস্কের থালামাস(মস্তিস্কের এই অঞ্চলটি অনুভূতি সংক্রান্ত সিগন্যালগুলো সেরিব্রাল করটেক্সে সঞ্চারণ করে) অঞ্চলের কোষগুলো অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। তিনি আরও লক্ষ করেছিলেন যে লোকটির মাথায় বা গলায় হাত রাখলেও ওই কোষগুলো সক্রিয় হয়ে উঠত যদিও থালামাসে তাদের অবস্থান অনুযায়ী তাদের মানবদেহের কেবল সেসব জায়গায় স্পর্শের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ার কথা যেসব জায়গা আলোচ্য ব্যক্তির দেহে অবশ(লোকটির মেরুদন্ড মাঝখান দিয়ে ভাঙ্গা থাকার কারণে শরীরের নিচের অংশগুলো স্পর্শ করলে সেগুলোর সিগন্যাল মেরুদন্ড বেয়ে মস্তিস্কে যেয়ে পৌছতে পারে না)। এই আবিস্কারটি ইঙ্গিত করে যে আগে যেসব সাইন্যাপস(সন্নিহিত দু’টো স্নায়ুকোষের মধ্যকার অতি ক্ষুদ্র একটা জায়গা যার মাধ্যমে নার্ভ ইমপালস্ এক স্নায়ুকোষ থেকে আরেক স্নায়ুকোষে ঝাপিয়ে পড়ে) দিয়ে এসব জায়গা স্পর্শের ফলে সৃষ্ট ইমপালস্গুলোর ভ্রমণ নিষিদ্ধ ছিল, এখন সেসব সাইন্যাপস্ দিয়েই ইমপালস্গুলো মস্তিস্কের থালামাসে পৌছতে পারছে। যেহেতু মেরুদন্ডের সমস্যার কারণে শরীরের নিচের অংশের ইমপালস্গুলো মস্তিস্কে পৌছতে পারছে না, তাই তারা বিকল্প রাস্তা হিসেবে মাথা আর গলার সাইন্যাপস্গুলোকে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।
যেসব অঙ্গের কোন অস্তিত্বই নেই, সেসব অঙ্গ কিভাবে মস্তিস্কে ইমপালস্ সম্প্রচার করছে তা মস্তিস্কের সোমাটোসেন্সরি করটেক্স কিংবা থালামাসে এরুপ পরিবর্তন ব্যাখ্যা করতে পারে। তবে এরুপ পরিবর্তন একাই এই ভূতুড়ে অনুভূতির জন্ম দিতে পারবে না; যদি তাই হত, তবে মস্তিস্কের সোমাটোসেন্সরি করটেক্স বা থালামাসের উক্ত অংশগুলো কেটে রেখে দিলেই কাজ হয়ে যেত।
আত্মসচেতন নিউরোম্যাট্রিক্স
আমার এবং অন্যদের গবেষণা থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে অদৃশ্য অঙ্গের জন্য মস্তিস্ক দায়ী ঠিকই, কিন্তু সোমাটোসেন্সরি সিস্টেম ছাড়াও মস্তিস্কের সেরেব্রামের বড় একটা অংশ এর সাথে জড়িত। অদৃশ্য অঙ্গ সম্পর্কিত যেকোন অনুকল্পকে অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে কেন ভুক্তভোগীরা এই অঙ্গগুলোকে এত দৃঢ় ও এত ভিন্নভাবে অনুভব করতে পারে। এমনকি, অদৃশ্য অঙ্গগুলো ভুক্তভোগীর দেহের সাথে সংযুক্ত না থাকলেও তার একটা দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে সেই অঙ্গটির মালিক। আমি একটা মডেল দাঁড়া করিয়েছি; সেটি যদিও অনেকের কাছে গৃহীত হয়েছে, তবে পরিপূর্ণভাবে মডেলটি বিচার করার জন্য মডেলটিকে ভালমত পরীক্ষা করতে হবে। তবে মডেলটি ইতিমধ্যেই অদৃশ্য অঙ্গের সাথে জড়িত ব্যথা নিরসনের জন্য নতুন নতুন ধারণাকে উৎসাহিত করেছে।
মডেলটির সারমর্ম হল- মস্তিস্কের একটা নিউরোম্যাট্রিক্স রয়েছে যা ঐন্দ্রিয়ক স্টিমুলেশনের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখানোর পাশাপাশি একটা বিশেষ প্যাটার্নের ইমপালস উৎপাদন করতে থাকে যার ফলে একজন মানুষের মনে হয় যে তার শরীর ঠিকই আছে এবং তার শরীরের উপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। আমি এই প্যাটার্নকে “নিউরোসিগনেচার” আখ্যা দিয়েছি। সেন্সোরি ইনপুটের অনুপস্থিতিতেও যদি এই নিউরোম্যাট্রিক্স তার নিউরোসিগনেচার উৎপাদন করতে থাকে, তবে ব্যক্তির কোন অঙ্গ না থাকা সত্ত্বেও তার মনে হবে যে তার অঙ্গটি অক্ষত আছে।
আমার বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলোকে ব্যাখ্যা করতে হলে আমার প্রস্তাবিত এই নিউরোম্যাট্রিক্সকে বেশ বিস্তৃত হতে হবে, মস্তিস্কের অন্তত তিনটি বৃহৎ স্নায়ু বর্তনীকে(neural circuit) এই নিউরোম্যাট্রিক্সের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এই বর্তনীগুলোর মধ্যে একটা থালামাস থেকে সোমাটসেন্সরি করটেক্সে যাবে, একটা ব্রেইনস্টেম থেকে লিম্বিক সিস্টেমের(আবেগ আর প্রণোদনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ) দিকে যাবে, আর আরেকটা সেসব গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো দিয়ে যাবে যেগুলো আত্ম-সচেতনতা ও সেন্সরী সিগন্যালগুলোর বিশ্লেষণের জন্য গুরত্বপূর্ণ। শেষোক্ত সিস্টেমের মধ্যে প্যারাইটাল লোবটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মস্তিস্কে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের উপর গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে মস্তিস্কের এই অংশটি আত্ম-সচেতনতা(আমার “আমিত্ব” বোধ) সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। যাদের প্যারাইটাল লোবের এক গোলার্ধ কেটে সরিয়ে ফেলা হয়েছে, দেখা গিয়েছে যে তাদের অনেকেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকার সময় তাদেরই এক পা বিছানা থেকে সড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত, কারণ তাদের মনে হত যে পা’টি আসলে অন্য কারওর পা। অর্থাৎ, আপনার প্যারাইটাল লোবের কোথাও ড্যামেজ হলে আপনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আপনার নিজের মনে হবে না, অন্য কারও মনে হবে। এখান থেকে বোঝা যায় যে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলটি হয়ত এমন কোন সিগন্যাল প্রচার করে, “এটা আমার শরীর; এটা আমারই অংশ”।
আমার বিশ্বাস, সেন্সরি সিগন্যালগুলো মস্তিস্কে যাওয়ার সময় এই তিনটা সিস্টেম দিয়ে সমান্তরালভাবে ভ্রমণ করে। সিগন্যালগুলো বিশ্লেষণ করার সময় এই তিনটার সিস্টেম একে অপরের সাথে তথ্য শেয়ার করে এবং একটি সামগ্রিক আউটপুট তৈরী হয়, যা মস্তিস্কের অন্য অংশগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মস্তিস্কের কোন একটা অংশে এই আউটপুটটিকে সচেতন অনুভূতিতে রুপান্তর করা হয়, ঠিক কোথায় করা হয় তা এখনও আমরা জানি না। আমি আরও মনে করি, ম্যাট্রিক্সটি সেন্সরি তথ্য বিশ্লেষণ করার সময় তার নিউরোসিগনেচার আউটপুটে মুদ্রিত করে ফেলে। এর ফলে আউটপুটের মধ্যে সেন্সরি তথ্য থাকার পাশাপাশি এই নিশ্চয়তাটাও থাকে যে অনুভূতিটি ব্যক্তির নিজ দেহেই অনুভূত হচ্ছে।
জিনগতভাবে পুনঃনির্ধারিত ম্যাট্রিক্স
একজন ব্যক্তির নিজস্ব নিউরোসিগনেচার কিরকম হবে সেটি নির্ভর করবে ম্যাট্রিক্সে তার স্নায়ুকোষগুলো কিভাবে একে অপরের সাথে সংযুক্ত রয়েছে। এছাড়া সাইন্যাপ্সের সংখ্যা, ধরণ ও শক্তিরও প্রভাব রয়েছে। ম্যাট্রিক্সের মধ্যে স্নায়ুকোষের এই নেটওয়ার্কটা জিন দ্বারা নির্ধারিত হলেও বাইরের যেকোন ফ্যাক্টর সাইন্যাপ্সগুলো জোড়া লাগাতে পারে, ধ্বংস করতে পারে, দুর্বল করতে পারে অথবাআ সবলও করতে পারে। যেমন, আলসারের ব্যথার স্মৃতি ম্যাট্রিক্সের ভেতর সংরক্ষিত থাকতে পাআরে যার ফলে ওই একই ব্যথা পরে অদৃশ্য অঙ্গগুলোতে অনুভূত হতে পারে।
এখন প্রশ্ন হল, আমি কেন ম্যাট্রিক্সটাকে পুনঃনির্ধারিত মনে করছি? আমি ও আমার সহকর্মীরা প্রচুর রোগী দেখেছি যারা হাআত-পা ছাড়া জন্ম নিলেও হাত বা পা অনুভব করতে পারছেন বলে দাবি করেন। একারণে আমার প্রস্তাবিত ম্যাট্রিক্স যদি আসলেই থেকে থাকে তবে তাকে অবশ্যই জিন দ্বারা পুনঃনির্ধারিত হতে হবে। আমার একজন আট বছর বয়স্ক বালকের কথা মনে পড়ে জন্মগতভাবেই যার পা অবশ ছিল এবং ডান হাত কনুই পর্যন্ত্য এসেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তার হুইলচেয়ার নাড়ানোর জন্য লিভারের উপরে কনুই রাখার জন্য একটা কাপ আকৃতির জায়গা ছিল। সেই জায়গাটায় হাত রাখলেই ছেলেটির মনে হত তার কনুই থেকে কিছু অদৃশ্য আঙ্গুল গজিয়ে উঠে যেন কাপটিকে শক্ত করে চেপে ধরেছে। এধরণের অনুভূতি বড়বেলা পর্যন্ত্যও থাকতে পারে; ৩২ বছর বয়স্ক এক প্রকৌশলী ছিলেন, জন্মগতভাবেই তাঁর পা হাঁটু পর্যন্ত্য সীমিত ছিল, সারা সপ্তাহ ধরেই তাঁর মনে হত তার যেন একটা অদৃশ্য পা আছে, তবে মাঝে মাঝে এক-দুই ঘন্টার জন্য এই অনুভূতি উধাও হয়ে যেত। তবে অন্যরা যেখানে এসব অদৃশ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে বেকায়দায় থাকত, তিনি সেখানে এই ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করতেন!
মানুষের সেন্সরি ইনপুটের বৈচিত্র্যের কারণেই সে এত বিচিত্র অনুভূতি অনুভব করতে পারে। আমার প্রস্তাআবিত ম্যাট্রিক্স এই ইনপুটকে বিশ্লেষণ করে নানা অনুভূতি ও আত্মসচেতনতার জন্ম দেয়। অবাক করা বিষয় হল- বাইরে থেকে কোন স্টিমুলাস না আসলেও নিউরোমা, মেরুদন্ড কিংবা স্বয়ং ম্যাট্রিক্স থেকেই লাগাতারভাবে ইমপালস উৎপাদনের কারণে একইরকম অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারে। ইমপালসের উৎস যাই হক, তা ম্যাট্রিক্সের মধ্য দিয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং অঙ্গবিহীন ব্যক্তির মধ্যেও অঙ্গ থাকার অনুভূতি সৃষ্টি করে।
আগেই বলেছি এই অশরীরি অনুভূতিগুলো চিরস্থায়ী না, তাহলে এগুলো কেন মিলিয়ে যায়? এক সম্ভাব্য উত্তর হল যে প্রাক্তন অঙ্গগুলোর সাথে সংস্লিষ্ট স্নায়ুকোষগুলো একসময় শরীরের অনুভূতিপ্রবন অংশগুলোর স্নায়ুকোষের সাথে সংযুক্ত হয়ে পড়ে এবং শুধু ওই অঞ্চলগুলো থেকেই ইমপালস গ্রহণ করা শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় নিউরোসিগনেচারের প্যাটার্নটাও পরিবর্তিত হয়, তাই অশরীরি অনুভূতিটি আর থাকে না। তবে অনুভূতিগুলো কখনও পুরোপুরি মিলিয়ে যায় না, মিলিয়ে যাওয়াআর কয়েক দশক পর আবার পুনঃউত্থিত হওয়ার নজিরও আছে। এখান থকে একটা সিদ্ধান্ত টানা যায় যে আমাদের হাইপোথিটিক্যাল ম্যাট্রিক্সটি পরিবর্তিত অবস্থায়ও তার বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিকই ধরে রাখে।
আমি ও আমার ছাত্ররা সরাসরি কিছু প্রমাণ পেয়েছি যে মস্তিস্ক ও নিউরোম্যাট্রিক্স স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। আমরা আমাদের গবেষণায় formalin pain test প্রয়োগ করেছি। আমরা ইঁদুরের থাবার নিচে ফরমালিন প্রবিষ্ট করেছিলাম, যার ফলে ব্যথার অনুভূতিটি প্রথম পাঁচ মিনিট উঠা-নামা করে(ইঁদুরের থাবা চাটা থেকে ব্যথার মাত্রা ও স্থায়িত্ব বোঝা যায়)। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার ১৫ মিনিট পর মূল যন্ত্রণা শুরু হয় এবং সাধারণত এক ঘন্টা স্থায়ী হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা আবিস্কার করেছিলাম যে তাড়াতাড়ি এনেস্থেতিক প্রবিষ্ট করে যদি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটি বন্ধ করা যায়, তবে পরবর্তীকালের যন্ত্রণাটি পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া যদি আগেই শুরু হয়ে যায়, তবে ড্রাগটি বেদনা কেবল আংশিক কমাতে পারে। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে যে বেদনার সিগনালগুলো ব্লক করে দেওয়ার পরও যেহেতু ব্যথা অনুভব হচ্ছে, তাই দীর্ঘস্থায়ী বেদনার পেছনে বহিঃস্থ স্টিমুলাস দ্বারা সৃষ্ট ইমপালসের পাশাপাশি মস্তিস্কের কার্যক্রমেরও ভূমিকা রয়েছে।
অশরীরি অঙ্গের যন্ত্রণা
ঠিক কি কারণে অশরীরি অঙ্গগুলোতে এত ব্যথা অনুভূত হয়? অনেকেই অভিযোগ করেন যে অশরীরি অঙ্গগুলোতে জ্বলুনী অনুভূত হয়। অঙ্গ থেকে নিউরোম্যাট্রিক্সের সেন্সরি সিগন্যাল না গেলে এরকম অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে। তার স্বভাবসুলভ সেন্সরি স্টিমুলেশন না পেলে নিউরোম্যাট্রিক্সে ইমপালসের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, যেমনটি লেন্তজ্ পর্যবেক্ষণ করেছেন। এধরণের সিগন্যালকে জ্বলুনির অনুভূতিতে রুপান্তর করা অস্বাভাবিক কিছু না।
নিউরোম্যাট্রিক্স যদি অঙ্গগুলোকে নাড়ানোর চেষ্টা করতে, সেক্ষেত্রেও ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এমপ্যুটি আর প্যারাপ্লেজিকদের অঙ্গ নার্ভ সিগন্যালের প্রতি প্রতিক্রিয়া না দেখালেও নিউরোম্যাট্রিক্স বারবার পেশীগুলোকে নড়ার নির্দেশ দিবে, একবার নির্দেশে কাজ না হলে দ্বিতীয়বার সিগন্যালের তীব্রতা বাড়িয়ে দিবে, নিউরোম্যাট্রিক্স তো আর জানে না যে প্যারাপ্লেজিকদের স্নায়ু অকেজো। এই তীব্র সিগন্যালগুলো অস্বস্তিকর কিংবা অত্যন্ত বেদনাদায়ক অনুভূতির জন্ম দিতে পারে।
এই ধারণাগুলোকে ব্যবহার করে যন্ত্রণা কমানোর জন্য গবেষণা সবে আরম্ভ হয়েছে, তবে ইতিমধ্যেই চাঞ্চল্যকর ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। এই মুহুর্তে ব্যথা কমানোর জন্য একাধিক থেরাপি প্রচলিত আছে। কর্তিত অঙ্গএর অধোভাগে তড়িৎ শক দেওয়া অনেক এমপ্যুটির জন্য কাজ করে। কারও কারও জন্য আবার বিশ্রাম ও সংবেশন(hypnosis) কাজ করে। মৃগী রোগের ড্রাগ এবং এন্টি-ডিপ্রেসেন্টের কার্যকারীতাও পরিলক্ষিত হয়েছে, তবে যারা দীর্ঘ দিন ধরে এই ব্যথা অনুভব করছে তারা কোন চিকিৎসাতেই লাভ করতে পারছে না।
তবে DREZ(dorsal root entry zone) নামক এক পদ্ধতিতে অদৃশ্য অঙ্গের অনুভূতি ধ্বংস না করা গেলেও যন্ত্রনাটা বন্ধ করা যাচ্ছে। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লেইন ন্যাশল্ডের উদ্ভাবিত এই পদ্ধতিতে নিউরোসার্জনরা যেসব স্নায়ুকোষ কর্তিত অঙ্গের অধোভাগ থেকে আসা সিগন্যাল গ্রহণ করে, সেগুলোকে ধ্বংস করে দেন। মূলত মেরুদন্ডের যে জায়গায় স্নায়ুগুলো প্রবেশ করে, সেই জায়গার উক্ত কোষগুলোই তাঁরা ধ্বংস করে দেন। এই DREZ পদ্ধতি এতই নতুন যে এখনও কেউ জানে না এই পদ্ধতি আসলেই স্থায়ীভাবে কার্যকরী হয় কিনা।
মস্তিস্কের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কিত আমার মডেলটির একটি অনুসিদ্ধান্ত হল যে নিউরোম্যাট্রিক্সের পুরোটাই বেদনা সৃষ্টির জন্য দায়ী, এর সাথে আমার মডেল এও দাবি করে যে এই ট্রিটমেন্টের পাশাপাশি সোমাটোসেন্সরি এলাকার বাইরের পাথওয়েগুলোকে পরিবর্তন করলেও তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকতে পারে। এক্ষেত্রে লিম্বিক সিস্টেম দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। ক্ষতিকর স্টিমুলাস লিম্বিক সিস্টেমকে সরাসরি সক্রিয় করে না দেখে ব্যথার চিকিৎসায় একে এতদিন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তবে আমার প্রস্তাবিত মডেল অনুযায়ী লিম্বিক সিস্টেম যদি আসলেই নিউরোম্যাট্রিক্সের আউটপুটের উপর প্রভাব ফেলে, তাহলে এটি ব্যথা সৃষ্টি পেছনেও ভূমিকা রাখবে। ভাচ্চারিনো, ম্যাককেনা এবং আমি ইতিমধ্যেই লিম্বিক সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যথা কমানো নিয়ে গবেষণা শুরু করেছি। আমরা দেখিয়েছি যে লিম্বিক সিস্টেমের বিভিন্ন জায়গায় লাইডোকেইন(কোকেইনের মত একটি রাসায়নিক দ্রব্য যা স্নায়ুকে সিগন্যাল ট্রান্সমিট করা হতে বিরত রাখে) প্রবিষ্ট করলে ইদুরদের মধ্যে সৃষ্ট যন্ত্রণার পরিমাণ ভিন্ন হয়। মানুষের অদৃশ্য অঙ্গগুলোতে ব্যথা কমানোর জন্যও একই পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই অদৃশ্য অঙ্গের বিষয়টা শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রের জন্যই চ্যালেঞ্জ না, এটি মনোবিজ্ঞানের কিছু মৌলিক অনুমিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এমন একটি অনুমিতি হল- অনুভূতি শুধু স্টিমুলাস দ্বারাই সৃষ্ট হয়, স্টিমুলাসের অনুপস্থিতিতে যেকোন অনুভূতিই আসলে অস্বাভাবিক। অদৃশ্য অঙ্গ এবং চোখ-কান না থাকা সত্ত্বেও দৃষ্টি ও শ্রবণের অনুভূতি এই অনুমিতিকে ভুল প্রমাণ করে। মস্তিস্ক শুধু ইনপুট গ্রহণ করে আউটপুট দেয় না, এটা নিজে থেকেই ইনপুটের অনুপস্থিতিতে ঐন্দ্রিয়ক অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ, আমাদের শরীর না থাকলেো আমরা আমাদের “শরীর”কে অনুভব করতে পারি।
আরেকটা খুব গভীরে প্রোথিত অনুমিতি হল যে সেন্সরি ইনপুট থেকে প্রাপ্ত তথ্য মস্তিস্কে স্মৃতি হিসেবে রয়ে যায়। বিভিন্ন অঙ্গ থেকে প্রাপ্ত এই “স্মৃতি”গুলো একত্রিত হলেই মস্তিস্ক আমাদের শরীর সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা সৃষ্টি করে। আপনি চোখ বন্ধ করে বলতে পারবেন আপনার শরীরের কোন অঙ্গ এই মুহুর্তে কোন অবস্থানে আছে। জন্মের পর থেকেই আপনি আপনার অঙ্গগুলো নাড়াচাড়া করছেন, সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন বস্তু স্পর্শ করছেন। এগুলোর “স্মৃতি” আপনার মস্তিস্কে জমা আছে বলেই আপনি জানেন আপনার অঙ্গ দিয়ে কি করলে কেমন অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু জন্মগতভাবেই যদি আপনার হাত না থাকে, তাহলে আপনার পক্ষে কি হাতের বিভিন্ন অনুভূতি সম্পর্কে জানা সম্ভব? প্রচলিত মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তা সম্ভব না, কিন্তু অদৃশ্য অঙ্গের এই ফেনোমেনন দেখিয়ে দিয়েছে যে জীবনে কখনও হাত না নাড়িয়েও হাত নাড়ানর অনুভূতি অনুভব করা যায়। এখান থেকে একটা বিষয় পরিস্কার হয় যে আমাদের শরীর সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা সৃষ্টি করার জন্য নিউরাল নেটওয়ার্কগুলো মস্তিস্কে জন্মগতভাবে তৈরী করা থাকে। ইনপুটের অনুপস্থিতিতে নেটওয়ার্কগুলো সিগন্যাল প্রচার করা বন্ধ করে না। আপনার হাত আছে কি নাই, তা নিয়ে নেটওয়ার্কের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নাই, সে তার মতই আজীবন সিগন্যাল প্রচার করে যাবে।
তো মোদ্দা কথা হল, আমরা যদি ধরে নেই যে মস্তিস্কের কাজ হল শরীর থেকে ইনপুট গ্রহণ করে আউটপুট তৈরী করা, তাহলে অদৃশ্য অঙ্গের ব্যাপারটা আজীবন রহস্য রয়ে যাবে। তবে রহস্যটা অনেকটাই হালকা হয়ে আসে যদি আমরা ধরে নিই যে মস্তিস্ক ইনপুট ছাড়াই আউটপুট সৃষ্টি করতে পারে। সেন্সরি ইনপুট কেবল আউপুটটিকে প্রভাবিত করতে পারে, কিন্তু তারা সরাসরি কোন আউটপুট সৃষ্টি করে না।
টীকা:-
Cerebrum-
মস্তিস্কের সবচেয়ে বড় অংশ, দু’টো cerebral hemisphere এ বিভক্ত। এটি জটিল সব নিউরাল আর সেন্সরি কর্মের সম্মবয় ঘটায়। এছাড়াও ক্ষণস্থায়ী ও দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতির মাধ্যমে নতুন কিছু শেখার পেছনে সেরিব্রামের ভূমিকা রয়েছে।
Cortex- মস্তিস্কের উপরিভাগের একটি কলার আবরণ। করটেক্সে প্রচুর পরিমাণে স্নায়ুকোষ রয়েছে। এটি স্বতঃপ্রবৃত্ত বিচলন, শ্রবণ, স্পর্শ, স্মৃতি, ভাষা, চিন্তা, বুদ্ধি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে।
Formalin pain test- ইঁদুরের শরীরে ফরমালিন ঢুকিয়ে তীব্র যন্ত্রণা সৃষ্টি করে পরীক্ষাধীন ব্যথানাশক ঔষধ খাইয়ে দেখা হয় ঔষধটি আসলে কিরকম কার্যকরী।
Limbic system- মস্তিস্কের অনেকগুলো অংশ মিলে এটি গঠিত। এর কাজ হল আবেগ, আচরণ, দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি এবং ঘ্রাণশক্তি সৃষ্টি করা।
Matrix- কলার যেই অংশে কোষ অবস্থিত থাকে। সাধারণত এটি জেলির মত হয়, তবে অস্থি কিংবা উপাস্থি(cartilage) এর মত শক্তও হতে পারে।
Neural pathway- নিউরাল পাথওয়ে হল স্নায়ুর সেই নেটওয়ার্ক যা নার্ভাস সিস্টেমের এক অংশের সাথে আরেক অংশ যোগ করে। একটা দেশের জেলাগুলো যদি আলাদা আলাদা নার্ভাস সিস্টেম হয়, তবে এই জেলেগুলোর সংযোকারী সড়কগুলোকে নিউরাল পাথওয়ে বলা যায়।
Parietal lobe-
এই অংশটির দু’টো কাজ আছে- ১) দেহের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সেন্সরি ইনপুটকে একত্রিত করে আমাদের চেতনা বা cognition সৃষ্টি করে ২) সেন্সরি ইনপুটকে ভিজুয়াল সিস্টেমের সাথে একাঙ্গীকরণ করে যার ফলে আমরা আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা রাখতে পারি। এই অংশটি দু’ভাগে বিভক্ত। প্যারাইটাল লোবের এই দু’ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত করলে ভুক্তভোগীর মধ্যে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক লক্ষণ দেখা যায়, বিস্তারিত এখানে পাবেন।
Sensory system- নার্ভাস সিস্টেমের যে অংশ সেন্সরি ইনফরমেশন(যা আমরা আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে লাভ করি) প্রসেস করে, তাকে সেন্সরি সিস্টেম বলে। সেন্সরি রিসেপটর, নিউরাল পাথওয়ে আর মস্তিস্কের কিছু অংশ মিলে এই সেন্সরি সিস্টেম গঠণ করে। উদাহরণ হিসেবে, দৃষ্টি, শ্রবণশক্তি, স্বাদ, স্পর্শ, ঘ্রাণশক্তির কথা বলা যেতে পারে। অর্থাৎ, যা বস্তুজগত থেকে ইনফরমেশন আমাদের মনের জগতে স্থানান্তর করে, তাই সেন্সরি সিস্টেম।
Somatosensory system- এই সেন্সরি সিস্টেম স্পর্শ, তাপ, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গাদির আপেক্ষিক অবস্থান সম্পর্কিত ধারণা আর ব্যথার অনুভূতি সৃষ্টি করে।
Synapse- দু’টো পাশাপাশি স্নায়ুকোষ বা নিউরোনের মাঝখানে যে ক্ষুদ্র জায়গা থাকে, তাকে সাইন্যাপ্স বলে।
Thalamus- এটি করটেক্সের নিচেই অবস্থিত। করটেক্সে সিগন্যাল ট্রান্সমিট করার পাশাপাশি এর অন্যতম কাজ হল ইমপালসকে অনুভূতিতে রুপান্তর করা।
তথ্যসূত্র:-
১) Nikolajsen, L.; Jensen, T. S. (2006), Wall & Melzack’s Textbook of Pain (5th ed.), Elsevier, pp. 961
পড়ে বেশ ভাল লাগলো।
খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ পৃথিবী।
(Y) (Y) (Y) (Y) (Y) (Y) (Y) (Y) (Y) (Y) (Y)
(Y) (Y)
অনেক দেরীতে হলেও আপনার লেখাটা পড়লাম, ভাল লাগলো।
আমি এক বিদেশী উপন্যাসে পড়েছিলাম যে যে সব সৈনিকরা বাহু অথবা পা হারায় তারাও ঐ ধরণের অশরীরি অনুভূতি পায়।
অশরীরির শরীরী অনুভূতি
নাকি জমে থাকা পুরনো স্মৃতি?
…
সত্য সে যাই হোক, আপনার অনুবাদ ভালো হয়েছে। (F)
চালিয়ে যান (Y)
খুব সুন্দর। অনুবাদ অসাধারন হয়েছে। মূল লেখকে ধন্যবাদ এত সুন্দর একটা পেপারের জন্য। আসলে নিউরোলজি সর্ম্পকে বিজ্ঞান খুববেশি দূর এগোতে পারেনি। নতুন নতুন গবেষনায় চমকপ্রদ সব তথ্য বেরিয়ে আসছে এবং প্রচলিত অনেক কিছুকে নাড়া দিচ্ছে। এই নাড়া খাওয়াতে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে মনোবিজ্ঞান।
প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি বিজ্ঞানের চমকপ্রদ একটি বিষয়কে অনুবাদের মাধ্যমে পাঠকের সামনে নিয়ে আসার জন্য। আর অনুবাদ এত ঝরঝরে হয়েছে যে, বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও আমাকে কোথাও ঠেকতে হয়নি। তাছাড়া বাড়তি হিসাবে পাওয়া গেছে টীকা ও ‘প্যারাইটাল লোব’ এর উপর লিংক।
লেখাটি পড়ে মস্তিষ্ক নিয়ে এমন অনেক কিছুই নতুন করে জানতে পারলাম। তাই অনুবাদকের পাশাপাশি মুল লেখককেও আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা!
চমৎকার অনুবাদ হয়েছে (Y) (F)
(F)
লেখাটা বেশ লম্বা।সময় নিয়ে ভাল করে পড়তে হবে। অর্ধেক পড়েই মন্তব্য করছি। অনুবাদ চমৎকার লাগছে।
ভালো লাগলো পৃথিবী। অনেক শুভেচ্ছা। (Y)
ভালো লাগলো পৃথিবী। অনেক শুভেচ্ছা। (Y)
জট্টিল জিনিস সহজ করে অনুবাদ :clap মাথা চুল্কাচুল্কি করে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেললাম। ধন্যবাদ থাঙ্কু (Y)
চমৎকার অনুবাদ পৃথিবী। (Y)
দারুণ! দুর্দান্ত একটা অনুবাদ হয়েছে। সরল এবং সাবলীল।
মানুষের মষ্তিস্কের মত সব চাইতে জটিল কার্যপ্রনালীর মত একটি অর্গানের উপর লিখিত বিষয়ের সুন্দর ও ও সহজ বোধ্য অনুবাদ করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
আমি কছু যোগ করতে চাই। রেফারেন্স এই মুহূর্তে দিতে পারবনা।
মস্তিস্কের cortex এর বেশ কিছু অংশের কার্য প্রনালী এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্য ময় ও সুপ্ত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে।অনেক বিজ্ঞানীরা মনে করেন
মানব জাতির ভবিষ্যতে পার্থিব প্রকৃতির সংগে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার প্রয়োজনের সময় বিবর্তন বাদের ধারায় এই রহস্যময় ও সুপ্ত কোষ গুলী প্রয়োজন অনুসারে হয়তো কার্যকরী হইয়া উঠিবে।
ধন্যবাদ
চমৎকার অনুবাদ। শেয়ার করছি সবার সাথে 🙂
ইংরেজী লেখাটা সায়েন্টিফিক আমেরিকানে আগেই পড়েছিলাম। পৃথিবীর প্রাঞ্জল অনুবাদ পেয়ে খুব ভাল লাগলো।
ভাল লাগলো। (Y)
অনুবাদ দারুণ লাগল। (Y)