পর্ব ৫ ও ৬

-বধ করার ভান করেছিলেন? আসলে বধ করতে চাননি? কিন্তু স্বপ্নাদেশ?

– রাখো বাপু তোমার স্বপ্নাদেশ। জগতে এমন কোন পাগল আছে স্বপ্ন দেখে নিজের পুত্রকে ধরে বলী দেয়? বুড়া বয়সে পোলাপানের সংসার, কাহাতক আর সহ্য করা যায়? সব নষ্টের গোঁড়া ঐ দেদানবাদী হুজুর।

– দেদানবাদী হুজুর? সেটা আবার কে?

– কোত্থেকে সে উদয় হল কে জানে? শোনা গেল তার কাছে গেলে নিঃসন্তান মহিলাদের সন্তান হয়। তো আমার সন্তান হয়না। কত কিছু করলাম জীবনে। বউয়ের সমস্যা আছে মনে করে বান্দী দিয়ে ট্রাই করেছি। কিছুই হয়না। শেষে যখন দেদানবাদী কবিরাজের খোজ পেলাম বান্দীরে পাঠালাম তাঁর কাছে। তিনি আবার যখন তখন চিকিৎসা দেন না। কৃষ্ণপক্ষের শেষ তিথিতে গভীর রজনীতে উনি চিকিৎসা করেন। উনার চিকিৎসায় ও ভুতেশ্বরের কৃপায় বান্দী গর্ভলাভ করল।

-তারপর?

– বান্দী তো গর্ভবতী হয়ে গেল। বউরে কি আর তখন থামাতে পারি? পরের মাসে ঐ পবিত্র রজনীতে সে ছুটল দেদানবাদীর কাছে। সেও গর্ভবতী হল।

মধুমালার কথা মনে পরে গেল। সেই পবিত্র রজনী। সেই কৃষ্ণ পক্ষের অন্ধকার তিথি। সেই একই পবিত্র চিকিৎসা। তবে কি আমার মধুমালাও ………
নাকি আবার কেলেংকারী হয়ে যায়? তার স্বামী থাকে বিদেশে। খুব কম আসে। সেখানে তার আর একটা বউ আছে বলে শোনা যায়। সেটাকে নিয়েই থাকে। মধুর কোন খোজ খবর রাখে না। বছরের পর বছর দেশে ফেরে না। হঠাৎ কখনো তার আগমন ঘটে। এসেই আদর্শ স্বামী হয়ে যায়। জুয়া খেলে। গাজা খায়। তারপর মধুকে পেটায়। যাবার সময় ‘চাকুরে মেয়েরা ছিনাল বই কিছু না’ এই গুরু ভাষণ দেয়। তারপর মধুর জমানো টাকা পয়সা নিয়ে আবার রওনা দেয়।
ধর্মবাবার একটু কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম-বাবা, আপনার পুত্রদের নিয়ে সমস্যা হয়নি?

-হয়নি আবার? বুড়া বয়েসে এক সাথে দুই দুইজন গর্ভবতী হয়ে গেল। সমাজে কি আর মুখ দেখানোর উপায় থাকে? ফেলতেও পারিনা, গিলতেও পারিনা। ছোট ছোট পোলাপান। দেখেও মায়া লাগে। তারপর আবার দুই মহিলার চুলোচুলি। দিনে রাতে ঝগড়া ফ্যাসাদ। এই সব সামাল দিতেই বান্দীরে কইলাম –তুই তোর পোলা নিয়ে চলে যা। কিন্তু সে যায় না। পোলা নিয়ে পড়ে থাকে। শেষে এক বুদ্ধি বের করলাম। বললাম- ভুতেশ্বর তোর পোলারে বলী দিতে বলছে। নিয়ে গেলাম বলীর মাঠে। পোলাটারে বলীর পাঠার মত শোয়ালাম। ধারাল খঞ্জর তার গলায় বসাতেও গেলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে কেমন একটা মায়া পরে গেল। মাসুম বাচ্চা। হাজার হোক আমিতো একজন মানুষ। ভুত তো না! তাকে আর বলী দিতে পারলাম না। লোক দেখানোর জন্যে একটা পশু বলী দিলাম। আরকটা গল্প ফাঁদলাম। বললাম- ভুতেশ্বর তার আদেশ পাল্টে দিয়েছে।

– আচ্ছা। তো দুই সতীনের ঝামেলা মেটালেন কিভাবে? ভুতেশ্বর কে দিয়ে একটা বউ পেটানো বাণী নামিয়ে নিলেই তো পারতেন।

– সেইটাই তো কথা। মাহাউন্মাদের মত পিটুনি পদ্ধতি গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বুড়া মানুষ। মার দিতে গেলে উল্টা মার খেতে হয়। কি করা যায়? দুই মহিলা কোনভাবেই একসাথে রাখা যাবে না। তাদের ঝগড়াঝাঁটিতে কখন আবার দেদানবাদীর কথাটা ফাঁস হয়ে পরে সেইটাই একটা বিরাট চিন্তার বিষয়! তাই শেষ পর্যন্ত বান্দীরে আর তার পুত্ররে ফেলে রেখে এলাম দূরে বিশাল এক ফাকা মরু মাঠে। বলে দিলাম-ভুতেশ্বরের আদেশ। তোরা এইখানেই পড়ে থাক। এখানে এক ঝরনা আছে। এই পানি মহা পবিত্র। এই খেয়ে বেচে থাক।
তার কাছ থেকেই পবিত্র পানির ব্যাপারটা খোলসা হল। জগতে একেক সম্প্রদায়ের কাছে একেক পানি মহাপবিত্র। কারও আছে পবিত্র ঝর্না। কারও নদী, কোথাও কুয়ো, পুকুর, সাগর দিঘী। আবার ঢাকা বাসীর আছে পবিত্র বুড়িগঙ্গা। বাবা জানালেন- মুল ব্যাপারটা হল ভুতেশ্বর চান যার অঞ্ছলে যে জল আছে সে সেটাই পবিত্র জ্ঞান করে তার যত্ন নিক। তাহলেই হবে। কিন্ত এক অঞ্চলের জল ঘট ভরে নিয়ে মন্ত্র পড়তে পড়তে অন্য অঞ্চলে পান করতে দেখলে স্বয়ং ভুতেশ্বরই হেসে কুটি কুটি হন।

মধুমালার ব্যাপারটা আমার মন থেকে যাচ্ছিল না। বুড়িগঙ্গা জলের প্রভাব মনে হয়ে কমতে শুরু করেছে। তিনি আমার কাছে এলেন। কিভাবে যেন বুঝতে পারলেন আমি একটু অন্য মনস্ক। তিনি আমার পিঠে আস্তে করে হাত রাখলেনঃ
-তুমি ভেব না। মধুমালা এখন থেকে তোমার হবে। তার গর্ভে যা আছে তা তোমারও।

– কিন্তু তার স্বামী?

-সে আর ফিরবে না। আমার যে নাতি পুতি হবে তাদের মর্ত্যের জ্ঞানে মানুষ করবে। তাদের ভুতেশ্বরের শিষ্য হতে দেবে না।

– কি বলেন? ভুতেশ্বর রাগ করবেন না?

– মনে হয় না। আমি তো থাকি সপ্তম আকাশে। এখান থেকে ভুতেশ্বরের মতিগতি আমি ভালই বুঝি। একটা কথা কি জান – উনি আমার কানের কাছে এসে ফিস ফিস করে বললেন- ইদানিং লক্ষ্য করছি ভুতেশ্বর কেমন ঠাণ্ডা মেরে গেছেন। কতদিন তার চেচামেচি শুনি না।

-উনি কি চেচামেচিও করেন?

-আগে তো খুব শোনা যেত। ঝড়বৃষ্টির যে দূত আছে তাকে প্রায়ই খুব বকাবাদ্য করত।

-কেন?

– সে খুব ভুল ভাল করে। এমনিতেই তার তেমন একটা ভূ-সমতল জ্ঞান খুব কম। তারপর বয়স হয়েছে। চোখে ভাল দেখে না। যেখানে দরকার বৃষ্টি নামানো, সেখানে হয়ত ভূমিকম্প পাঠিয়ে দিল। ক্ষেত জুড়ে পাকা ধান- ঝড় বৃষ্টি দিয়ে তলিয়ে দিল। ভুতেশ্বর হয়তো বলল তার সবচাইতে অপ্রিয় দেশ ফাকিস্তানে একটা ঠাডা মারতে, সে গিয়ে সেটা মেরে এলো কোন এক শান্তিপ্রিয় এলাকার পোলাপানদের উপর।

-কেন একটু দেখেশুনে মারলেই তো পারে?

– কিভাবে মারবে? স্বর্গে সব কাজ কামই তো মানুয়ালি করা হয়। নাস্তিক বিধর্মী সৃষ্ট কোনো প্রযুক্তি ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে। গুগল আর্থ ব্যবাহারের কোনো সুযোগ নাই। শুধু মাত্র তারা-ফারা দেখে ঝড় তুফান নামাতে হয়। তার দোষ দিয়েই বা লাভ কি?

-দেখি, দেখা হলে ভুতেশ্বরকে বলব। ঝড়বৃষ্টির দূতের জন্যে কিছু আধুনিক টেকনোলোজি পাশ করাতে পারি কিনা।

আমার কথায় বাবা শিষ্য খুব একটা খুশী হল বলে মনে হলনা। শুধু বললেন- তিনিই যে এখন কোথায় আছেন, কে জানে? সাড়াশব্দ তো পাইনা কোনো। আমাকে বললেন- চল, তোমারে স্বর্গ নরক দেখায়ে আনি।
ছাগীটারে একটা খোঁটায় বেধে রাখলাম। বার্তা দূতেরও দেখলাম আর যাবার ইচ্ছে নাই। তাকেও বিদায় দিলাম। এবার হাটা দিলাম।

হাঁটতে হাঁটতে আকাশটার শেষ প্রান্তে চলে এলাম। একটা দূতকে দেখালাম আকাশের প্রান্ত ধরে রেখেছে। বাবা শিষ্য বললেন- এরকম চারটা দূত আকাশের চার প্রান্ত ধরে রেখেছে। এরা খুব রাগী টাইপের দূত। কোনরকমে চেতানো যাবে না। ক্ষেপে গেলে এরা আকাশের কোনা ভেঙ্গে ছুড়ে মারে।

-ও আচ্ছা। আকাশটা ওরা আর কতদিন এভাবে ধরে রাখবে?

-মহাপ্রলয় পর্যন্ত। তারপর আকাশগুলি কম্বলের মত ভাজ করে ভুতেশ্বরের হাতে তুলে দেয়া হবে।

-সেই আকাশ কম্বল গুলি দিয়ে উনি কী করবেন?

– উনার জিনিস, উনি যা খুশী তাই করবেন। হয়তো নিজেই পরবেন। এই সাত আসমানের উপর একফোঁটা সূর্যের আলো পৌঁছে না। বেচারা খুব শীতে কষ্ট পায়।
বাবা শিষ্য আমাকে বড় একটা গাছের কাছে নিয়ে এলো। অনেক বড় গাছ। তাঁর লক্ষ লক্ষ পাতা। কোনো ফল বা ফুল নাই। পাতাগুলির কোনটি কচি, কোনটি গাঢ় সবুজ আবার কোনটি হলুদ। বাবা বললেন- এটি হল প্রাণ বৃক্ষ। এর পাতাগুলিতেই মানুষের প্রাণ । যে পাতাগুলি দেখছ হলুদ হয়েছে, ষে মানুষগুলো অচিরেই মারা পড়বে। কেউ মারা গেলে তাঁর প্রাণ পাতাটিও গাছ থেকে খুলে পরে।
বলতে বলতে একটা পাতা গাছ থেকে খুলে পড়ল। পাতাটি তুলনামূলক ছোট। অকাল পক্ক। এত ছোট পাতাটি পরে গেল! মায়া হল। পাতাটা হাতে নিয়ে উলটে দেখলাম, পেছনে লেখাঃ
প্রাণ নং- ম ঝ ০০৭৮৪৫৬৫ (নারী)
সৃষ্টিঃ ১৬ আষাঢ় ১৪০৮, হরনঃ ১ বৈশাখ ১৪১৮
মৃত্যুর কারনঃ পহেলা বৈশাখ নামক অধার্মিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশনের সময় ধর্ম যোদ্ধাদের ফাটানো বোমার আঘাতে।
কর্মনামাঃ বামহাত।
বাবা শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করলাম-অন্যান্য পশু-পাখি, জীব জন্তু, ভুতপ্রেত, স্বর্গ দুত আর ভুতেশ্বরের প্রাণ বৃক্ষ কোথায়?

– তাদের কোনো প্রাণ বৃক্ষ নেই।

– কেন? তাদের কি প্রাণ নেই?

– কি জানি? হয়ত তাদের কোনো প্রাণ নেই। কিম্বা প্রাণ থাকলেও তা ভুতেশ্বরের এখতিয়ারে নেই।

– বলেন কি? ভুতেশ্বরের এখতিয়ারে নেই এমন কিছু আছে নাকি?

– আলবৎ আছে। ভুতেশ্বর কি পারে আর একজন ভুতেশ্বর সৃষ্টি করতে? কিম্বা নিজেই তাঁর প্রাণ হরণ করতে?

– কেউ কি নিজের সমকক্ষ কিছু তৈরি করে? কিম্বা নিজের প্রাণ নিজে বিসর্জন দেয়?

– হ্যা মানুষ তা করতে পারে। সব শিক্ষক চায় তাঁর ছাত্র তাঁর চাইতে জ্ঞানী হোক। সব বিজ্ঞানী চায় তাঁর অনুজ আরও বড় কিছু আবিস্কার করুক। মানুষের চেয়ে বড় আর উদার স্রষ্টা কোথায় আছে?

-আর বিসর্জন?

– সেও মানুষই দেয়। কত মানুষ প্রাণ দিয়েছে মানুষের জন্যে তাঁর কি হিসেব আছে? কত মা নিজে উপোস থেকে সন্তানের মুখে আহার তুলে দিয়েছে- অথচ নাম হয়েছে ভুতেশ্বরের। সে কি কোনদিন নিজে একবেলা অনাহারে থেকে একটা বিড়ালকেও একমুঠো খাইয়েছে?
বাবা শিষ্যের কথাগুলো শুনে খুব খারাপ লাগছিল। ভয়ও হচ্ছিল। পাছে আবার ভুতেশ্বর শুনে ফেলে। সে অত্যন্ত রাগি প্রকৃতির ভুত। প্রশংসা শুনতে খুব পছন্দ করে। কিন্তু ক্রিটিসিজমটা ঠিক নিতে পারে না। খুব ঝামেলা করে। আসলে সমালোচনা ব্যাপারটা সে তেমন বোঝে না। ভাল স্রষ্টা যে প্রশংসার চাইতে সমালোচনাই কামনা করে বেশী, এধরনের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ভুতেশ্বরের নেই। সে পড়ে আছে সেকেলে বস্তাপচা স্তুতি বাক্যের মোহে। কে তাকে বোঝাবে আজকাল কোনো ভদ্রলোক এমন ফালতু স্তুতির আশায় থাকে না?

ভুতেশ্বরের রাজ্যের অনেক সংস্কার দরকার। নাহলে মানুষের সভ্যতা থেকে ভুত সভ্যতা অনেক পিছিয়ে পড়বে। খুব দুঃখের বিষয়।

যতটা আগ্রহ নিয়ে স্বর্গে প্রবেশ করলাম তততাই হতাশ হলাম। ঢুকেই চোখে পড়ল বিশাল বিশাল চারটি ঝর্ণা। সেগুলি পার হবার কোনো যানবাহন নেই। সবই সাতরে পার হতে হবে। তাও যদি সব গুলিতে পানি থাকত! একটি দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে দুধ। একটা টিলা মত জায়গা থেকে ঝর্ণাটার উৎপত্তি। তার উপরে কয়েক হাজার গরু বাধা আছে। ছোট ছোট বালকেরা গরু দুইয়ে বালতি বালতি দুধ ঝর্ণায় ঢেলে দিচ্ছে। দুধ পাস্তুরিত করার কোনো ব্যবস্থা নাই। তারপর পাখির বিষ্ঠা, গাছ গাছালির পাতা কি পড়ছে না সেখানে। এমন অখাদ্য দুধ স্বর্গবাসীরা কিভাবে খায় কে জানে?

আরও কুৎসিত একটা ঝর্না আছে। যা দিয়ে বয়ে চলেছে মধুর মত আঠাল তরল। ‘এটা কি স্বর্গের ডেড সী?’- বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম।

-না। মধুর সাগর।

-ছিঃ এত নোংরা মধু! কে খায়?

-কেউ খায় না। কুকুর বিড়াল অনেক সময় চাটে। তবে মানুষ জন এর ধারের কাছেও আসে না।

মদের একটি ঝর্নাও দেখলাম। কি টাইপের মদ বুঝা গেল না। ভদকাও না আবার হুইস্কিও না। সাদাও না লালও না। মনে হয় ককটেল হবে। বাবা বললেন- বোঝ তো, সরকারী মাল! কমন সাপ্লাই। তোমার হুইস্কি, ভদকা, রাম, জিন এরকম চৌদ্দ পদের সাপ্লাই এখানে কে দেবে?
স্বর্গলোকের মূল সমস্যটা হল একঘেয়েমি। এ জগতে চাওয়া পাওয়ার আসলে কিছু নেই। কিছু করার নেই। বলার নেই। ঝগড়া নেই, তাই মিলনের সুখও নেই। খিধে নেই, তাই পেট ভরার সুখও নেই। কান্না নেই, তাই হাসতেও ইচ্ছে করে না। দারিদ্র নেই, প্রাচুর্য তাই গারবেজের চাইতেও নিকৃষ্ট।

মাইলের পর মাইল হাঁটছি। একজন স্বর্গবাসীরও দেখা নেই। বাবা শিষ্যকে বললাম- কি ব্যাপার, সব কোথায়? কাউকে তো দেখিনা?

বাবা হাসলেন-এখনই! এখানে তুমি কাউকেই দেখবে না। এটা হল পুরাতন স্বর্গ। ভুতেশ্বরের প্রতিশ্রুত স্বর্গ। এখানে কেউ এখন আর থাকেনা। বলতে পার এটা পরিত্যাক্ত।

-কেন?

– কে থাকবে? ভীষণ বোরিং একটা প্লেস। ধর মিষ্টি খেতে চাইলে। যে মিষ্টি দেয়া হবে তা হবে মর্ত্যের চাইতে ৭০ গুন মিষ্টি। বোঝ ঠ্যালা। ঝাল হলে ৭০ গুন ঝাল। টক হলে ৭০ গুন, নোনতা হলেও ৭০ গুন। এটি সাধারণ স্বর্গবাসীর জন্যে। তোমার কর্মফল অনুযায়ী তা ৭০ হাজার গুনও হতে পারে। কিম্বা ধর একটু জল চাইলে। তো এমন জল দেয়া হবে মনে হবে চিনির শরবৎ। তা দিয়ে আবার মহুয়ার গন্ধ। আরে বাবা ঠাণ্ডা কুয়োর জলের মত তৃপ্তিকর জল হয় নাকি? কিন্তু কে তা বোঝাবে ঐ সব মাথা মোটা স্বর্গ বালকদের।

স্বর্গের বাথরুম গুলি দেখবার খুব ইচ্ছে হল। বাবাকে কথাটা বলতেই তিনি হাসলেন। -‘এখানে বাথরুম পাবে কোথায়? স্বর্গে হাগামুতার কোন ব্যাপার নেই। যা খাবে সব ঢেঁকুর হয়ে বের হয়ে যাবে। বাথরুম লাগবে কেন’? ঢেঁকুর সিস্টেমের ভয়ে স্বর্গের খাবার একটু খেয়ে দেখার ইচ্ছেটা মরে গেল।

বাবা থামলেন। একটু দম নিলেন। তারপর নিয়ে গেলেন এক প্রকাণ্ড হল ঘরের কাছে। জানালা দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে দেখি ঘরের মধ্য অসংখ্য স্বর্গবালা উলটা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ঝুলানো অবস্থায়ও তারা হাত নেড়ে নেড়ে একই কথা অনবরত বলে যাচ্ছেঃ ‘এসো, আমার কাছে এস। আমাকে কেউ ছোঁয় নি। না মানুষ, না ভুতের দূত। মনে হচ্ছে চাবি দেয়া পুতুল। সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা বলতে তাদের কিছু নেই। অন্য কোনো কথাও নেই। কোনো অনুভূতিও নেই। মনে হয় ঐ একটি মাত্র বাক্য ছাড়া আর কিছুই তাঁদের প্রোগ্রামে নেই। বাবা বললেন-
-আবার ঐ স্বর্গ বালা গুলার কথাই ধর। এই সব পুতুল দিয়ে তুমি কি করবে? এদেরকে তুমি সঙ্গী ভাবতে পার?

– ছিঃ! গা-টা রি রি করে উঠল। বললাম- আমার এমন সেক্স টয় লাগবে না। আমি চাই এমন একজন সঙ্গী যাকে আমি পলে-পলে, ক্ষণে-ক্ষণে, দিনে-দিনে, যুগ-যুগান্তরের তপস্যায় জয় করব। যার চোখের অন্তনীলে আমার অনুভবের নৌকা ভাসব। আমি জগত বিদীর্ণ করে তুলে আনব ১০৮টা নীল পদ্ম, ক্লান্ত হব, শ্রান্ত হব, তারপর প্রিয়তমের অকাল বোধনে নৈবদ্যের ডালী সাজাব। সে হবে আমার সেই একজন যার অল্পটাই শরীর, সবটাই অনুভবের। সে হবে আমার মধুমালা, যাকে পাওয়া যায় না। যে আপতিত হয় না। নিপতিত হয় না। তাকে শুধু মাত্র জয় করতে হয়।

একবার দেখে দ্বিতীয়বার আর ঐ স্বর্গ বেশ্যাগুলির দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করল না। তাড়াতাড়ি আগে বাড়লাম। বাবা পেছনে পড়ে গেলেন। তার কণ্ঠ শুনতে পেলামঃ
-বাপধন, পালিও না। পরকালে ঐ গুলার সাথেই থাকতে হবে।

-মাফ চাই। দোয়াও চাই। আমারে তাড়াতাড়ি স্বর্গ-বাসীদের কাছে নিয়ে চলেন। তারা সব কোথায়?

– তারা সবাই নতুন স্বর্গে। মর্ত্যের মত স্বর্গ। সেখানে হা করলেই খাবার মুখের সামনে চলে আসে না। রান্না করে খেতে হয়। আর সে খাদ্যপণ্য জমিতে ফলাতে হয়, জলাশয়ে চাষ করতে হয়, খামারে উৎপাদন করতে হয়। কুলবৃক্ষে কাঁটাও আছে। সেই কাঁটা মারিয়েই ফল পাড়তে হয়। তাদের কোনো স্বর্গবেশ্যা নেই। স্বর্গবালক নেই। তাদের কোন মদ্যের নদী নেই। দুগ্ধ নদী নেই। তারা উত্তম আঙ্গুর ফলায়, তা থেকে তৈরি করে মর্ত্য সুধা। তাদের গাভী তাদের দুধ দেয়। লাকড়ি জালিয়ে দুধ পানযোগ্য করতে হয়। স্বর্গবাসীরা শ্রান্ত ক্লান্ত হয়েই সুখ পায়।

-সেখানে তাঁরা আর কি করে?

-তারা সাহিত্য পাঠ করে। উৎকৃষ্ট শিল্প কলা সৃষ্টি করে। সঙ্গীত শ্রবণ করে। তারা যুক্তি দিয়ে তর্ক করে। তাঁরা সমালোচনা করে ও সমালোচনাকে স্বাগত জানায়।

-মর্ত্যবাসীর মধ্য কারা বেশী সংখ্যায় স্বর্গে এসেছে?

– পুরুষ অপেক্ষা নারীগন অধিক সংখ্যায়। পুরাকাল অপেক্ষা শেষকালবাসী অধিক সংখ্যায়। ভণ্ড বিশ্বাসী অপেক্ষা যুক্তিবাদী অবিশ্বাসী অধিক সংখ্যায়।

নতুন স্বর্গটা দেখবার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাবা শিষ্য জানালেন সেখানে যাওয়া সম্ভব না। সেটা ভুতেশ্বরের এক্তিয়ারের বাইরে। সেখানে তাঁর মন্ত্র পাঠ হয়না। স্তুতি নিষিদ্ধ। তাই ভুতেস্বরের বাহনে চড়ে সেখানে যাওয়া যাবে না। বাধ্য হয়ে ‘প্রতিশ্রুত’ বিরান স্বর্গ দর্শন শেষে রওনা দিলাম নরক দর্শনে।

নরকেরও অনেক সংস্কার হয়েছে। ধর্ম বাবা জানালেন তাঁর আগুন অনেক দিন হল নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। নরক বাসীদের জন্য প্রতিশ্রুত খাবার- বৃক্ষের কাঁটা, পুজ, রক্ত এসব বাদ দেয়া হয়েছে। নরককে ঠিক শাস্তির জায়গা হিসেবে না রেখে মর্ত্যের আদলে সংশোধন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তলা হয়েছে। নরকীদের জন্যে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। তাদের কামরায় এসিও লাগানো আছে। রেডিমেড খাবার দাবার, আরাম দায়ক বিছানা ও হেলান দেয়ার বালিশ দেয়া আছে।

গোলমাল আযম নামে এক বাঙালী নরকীর দেখা পেলাম। দেখলাম তাঁর সামনে রাখা সোনার প্লেট থেকে স্বর্গীয় ফল তুলে পাশের রুমের স্বর্গবালাদের দিকে ছুড়ে মারছে। ভীষণ ক্ষীপ্ত। রীতিমত চিৎকার করছে-খবরদার এদিকে আসবি না। একদম আসবিনা বলছি! আবার যদি এদিকে আসিস তো সব কটারে ধরে পুকুরে চুবাব। এখানে কি? যা স্বর্গে যা। স্বর্গের পচা দুধের নদীতে ডুবে মরগে! শালার কলের পুতুল!

বাবা দুত বললেন- এই সব স্বর্গ বালাদের নরকে ডেপুটেশনে পাঠানো হয়েছ। তাঁরা নরকবাসীদের লীলা করতে বাধ্য করে। বিশেষ করে সেই সব নরকী যারা মর্ত্যলোকে স্বর্গ বেশ্যার লোভে বিভর হয়ে থাকত। আর নারীদের অবরুদ্ধ করে রাখত।

স্বর্গ নরক ভ্রমন শেষ হলে ধর্ম বাবা বিদায় চাইলেন। বললাম- চলেন যাই, ভুতেশ্বরের সাথে দেখা করে আসি। আপনাকে তিনি খুব স্নেহ করেন বলে জানি।
তাঁর মধ্যে তেমন একাটা আগ্রহ দেখলাম না। কিসের স্নেহ? কিসের কী? ভুতেশ্বরকে বল- তাঁর এমন ঝিম মেরে যাওয়াটা মোটেই ভাল লক্ষণ না। যখন তখন তার রাজ্য শত্রু পক্ষ দখল করে নিতে পারে। মর্ত্য তো কোন দিনই জয় করা হল না, আবার স্বর্গটাও না বেহাত হয়ে যায়।

– মানে কি? কেন মর্ত্য জয় হল না?

-কিভাবে হল? আজ পর্যন্ত একটা কাল এলো না যখন তাঁর অনুসারীরা অন্যদের চাইতে সংখ্যায় বেশী হল। আদিমকে সৃষ্টির পর তাঁর প্রদান শত্রু শ’তান চ্যালেঞ্জ করেছিল মানুষকে ভুতের পথ থেকে দূরে রাখবে।

শ’তানের সাফল্য ভুতেশ্বেরের চাইতে অনেক বেশী। তার অনুসারী সর্বযুগেই সংখা গরিষ্ঠ।

– সংখ্যাই কি আসল?

– তা নয় তো কী? তুমি কি তাকে সফল কৃষক বলবে যার জমিতে ফসলের চাইতে আগাছে জন্মে বেশী?

একাটা জিনিস ক্রমেই পরিস্কার হতে লাগল। স্বর্গলোকে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। ভুতেশ্বরের কোন খবরদারি কোথাও আছে বলে মনে হল না। তাঁর সব সাবেক শিষ্য, দূত সবাই যার যার মত চলছে। সব চাইতে দুঃখ জনক বিষয় হল- সবাই বেশ যুক্তি দিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। যুক্তি হল অধর্ম। যুক্তি শ’তানের হাতিয়ার। যুক্তি যত বাড়ছে, বিশ্বাস তত কমছে। স্বর্গ লোকে ছড়িয়ে পড়ছে ঘোর অন্ধকার।

ধর্ম বাবা আমাকে স্বর্গ নরকের শেষ প্রান্তে নিয়ে এলেন। সেখানে একটা গাধা বাধা আছে। বসে বসে জাবর কাটছে। ডানাওয়ালা গাধা। তিনি বললেন-এটাতে আরোহণ কর। সেই তোমাকে আগুনের পর্দা ভেদ করে ভুতেশ্বরের কাছে নিয়ে যাবে। ধর্ম বাবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।