শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে নয় – সমগ্র বিজ্ঞানের জগতে আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে উঠেছে যে ক’জন মানুষের মৌলিক তত্ত্বের ওপর – অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা তাঁদের অন্যতম। ১৯২০ সালে মেঘনাদ সাহার তাপীয় আয়নায়নের সমীকরণ (আয়নাইজেশান ইকুয়েশান) প্রকাশিত হবার পর থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে যত গবেষণা হয়েছে তাদের প্রায় সবগুলোই সাহার সমীকরণ দ্বারা প্রভাবিত। নরওয়ের বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী সেভিন রোজল্যান্ড অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত “থিওরেটিক্যাল এস্ট্রোফিজিক্স”[1] বইতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন এ’কথা। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের পারমাণবিক তত্ত্ব থেকে শুরু করে বিগ-ব্যাং তত্ত্বের পরীক্ষণ পর্যন্ত সহজ হয়ে উঠেছে যে যন্ত্রের উদ্ভাবনের ফলে – সেই সাইক্লোট্রনের উদ্ভাবক নোবেল বিজয়ী আর্নেস্ট লরেন্স সহ অসংখ্য বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জন করেছেন মেঘনাদ সাহা তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে। নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আর্নল্ড সামারফেল্ড, নীল্‌স বোর, ম্যাক্স বর্ন, আলবার্ট আইনস্টাইন, আর্থার এডিংটন, এনরিকো ফার্মি, আর্থার কম্পটন প্রমুখ দিকপাল মুগ্ধতার সাথে স্বীকার করেছেন মেঘনাদ সাহার অনন্য প্রতিভার কথা [2]। ভারতবর্ষের বিজ্ঞানচর্চার সাথে বিশ্বের পরিচয় ঘটিয়ে দেয়ার ব্যাপারে এবং ভারতের বিজ্ঞান-গবেষণাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার ব্যাপারে মেঘনাদ সাহার অবদান অনস্বীকার্য। গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পাবার পাশাপাশি মেঘনাদ সাহা নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন চার বার। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশ্বমাপের বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে মেঘনাদ সাহার অক্লান্ত পরিশ্রমে। দেশে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান পড়ানো শুরু হয়েছে মেঘনাদ সাহার হাতে। নিরলস চেষ্টা ও পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স, ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি, ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ এসোসিয়েশান – সবগুলো সংগঠনই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই মেঘনাদ সাহার ‘টেক্সট বুক অব হিট’ বইটা পড়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মেঘনাদ সাহা মূলত পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। তিনি বিএসসি ও এমএসসি পাশ করেছেন মিশ্র গণিতে। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় পদার্থবিজ্ঞান শুধু শিখেছেন তাই নয় – ক্রমশঃ পৌঁছে গেছেন এই বিষয়ের শিখরে। উপমহাদেশে প্রথম সাইক্লোট্রন স্থাপিত হয় মেঘনাদ সাহার প্রচেষ্টায়। অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার পরও থেমে থাকেন নি তিনি। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন তিনি। দরিদ্র অশিক্ষিত মা-বাবার সন্তান হয়েও মেধা, পরিশ্রম ও নিষ্ঠার জোরে একজন মানুষ যে কত বড় হয়ে উঠতে পারেন মেঘনাদ সাহা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

ঢাকা থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে শেওড়াতলী গ্রাম। এ গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ হতদরিদ্র। তাঁদের সর্বোচ্চ শিক্ষার দৌড় বড়জোর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দু’একটি শ্রেণী পর্যন্ত। গ্রামের দরিদ্র মুদিদোকানী জগন্নাথ সাহা ও ভুবনেশ্বরী দেবীর ঘরে ১৮৯৩ সালের ৬ই অক্টোবর রাতে মেঘনাদের জন্ম। ভীষণ ঝড়বৃষ্টির মধ্যে জন্মেছিলেন বলে ঠাকুরমা নাম রেখেছিলেন মেঘনাথ। পরে স্কুলে যাবার সময় নাম বদলে মেঘনাদ করা হয়। আট ভাই-বোনের মধ্যে মেঘনাদ পঞ্চম। ছয় বছর বয়সে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করানোর পাশাপাশি মেঘনাদকে দোকানে নিজের পাশে বসিয়ে কাজও শেখাতে শুরু করলেন বাবা জগন্নাথ সাহা [3]। তিনি জানেন তাঁর ছেলেদেরকে এই দোকান চালিয়েই ভরণপোষণ চালাতে হবে। তাই ছেলে যদি স্কুলে সামান্য একটু পড়তে এবং ছোটখাট হিসেব করতে শিখে তাতেই কাজ চলবে। কিন্তু দোকানে মন বসে না মেঘনাদের, মন পড়ে থাকে স্কুলের বইতে, অংকের খাতাতে। মেঘনাদের প্রতিভায় মুগ্ধ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা। প্রাইমারি স্কুলের পড়াশোনা শেষ হবার পর তাঁরা মেঘনাদের বাবাকে অনুরোধ করলেন মেঘনাদের লেখাপড়া বন্ধ না করতে। কিন্তু বাবা ভাবলেন- অনেক হয়েছে, আর পড়াশোনার দরকার নেই। এবার পুরোপুরি দোকানে বসুক। বড়ছেলে জয়নাথকে হাইস্কুল পর্যন্ত পড়িয়ে অনেক শিক্ষা হয়েছে তাঁর। মাধ্যমিক-ই পাশ করতে পারলো না ছেলেটা। মাঝখান থেকে অতগুলো টাকা গচ্চা গেলো। ম্যাট্রিক ফেল করে ছেলে এখন জুট মিলে কাজ করে মাসে বিশ টাকা পায়। সংসারের কী লাভ হলো তাতে? জগন্নাথ সাহা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন – মেঘনাদকে আর পড়াবেন না।

অসহায় মেঘনাদ কী করবে বুঝতে পারে না। মা-কে বলে কোন লাভ নেই। কারণ সংসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে মায়ের কোন ভূমিকা নেই। দোকানে বসতে একটুও ভাল লাগে না। ইচ্ছে করে বাড়ি থেকে পালিয়ে হাইস্কুলে গিয়ে ভর্তি হতে। কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি কোথাও কোন হাইস্কুল নেই। দশ কিলোমিটার দূরে শিমুলিয়া গ্রামে একটি জুনিয়র হাইস্কুল আছে। কিন্তু নিজে নিজে সেখানে যাবার তো কোন উপায় নেই। তবে উপায় একটা হয়ে গেলো। প্রাইমারি স্কুলে মেঘনাদকে যাঁরা পড়িয়েছেন তাঁরা জানেন লেখাপড়ার সুযোগ পেলে মেঘনাদ অনেক বড় হবে একদিন। মেঘনাদের প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটুক তা তাঁরা চান নি। সবাই মিলে মেঘনাদের বাবাকে অনুরোধ করলেন মেঘনাদকে হাইস্কুলে ভর্তি করে দেয়ার জন্য। মেঘনাদ যদি ভালো না করতে পারে তাহলে লেখাপড়া বন্ধ করে দিলেই হলো। জগন্নাথ সাহা রাজী হলেন। শিমুলিয়া জুনিয়র হাই স্কুলে মেঘনাদের লেখাপড়া শুরু হলো। খুব ভোরে উঠে দুই তিন ঘন্টা ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে পৌঁছানো, ছুটির পর আবার দশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়া। বাবা ভাবলেন এভাবে চললে ছেলে দু’দিনেই স্কুল ছেড়ে দেবে। কিন্তু মেঘনাদের চেয়ে তেরো বছরের বড় দাদা জয়নাথ ভাইয়ের কষ্টে চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি শিমুলিয়া গ্রামে গিয়ে সেখানকার অবস্থাপন্ন কবিরাজ অনন্ত কুমার দাসের হাতে পায়ে ধরে মেঘনাদকে তাঁর বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করার সুযোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। কবিরাজবাবু দয়ালু মানুষ। মেঘনাদকে বাড়িতে রাখতে রাজী হলেন। থাকা খাওয়ার জন্য কোন টাকা-পয়সা দিতে হবে না। তবে বাড়ির কাজ করতে হবে। গরুর দেখাশোনা, ঘাসকাটা আর গোয়াল ঘর পরিষ্কার করা। বাকি সময়টা লেখাপড়া। তবে খাওয়ার সময় বাড়ির অন্যান্যদের সাথে বসার অনুমতি নেই মেঘনাদের। জাত-প্রথার নিয়মনীতির সাথে ইতোমধ্যেই পরিচিত হয়ে গেছে মেঘনাদ। অনন্তবাবুর বাড়িতে মেঘনাদের ছোঁয়া কেউ খান না। এঁটো থালা-বাসন নিজেকেই ধুতে হয় মেঘনাদের। মনে ক্ষোভ থাকলেও তাতে কিছুই যায় আসে না। কবিরাজবাবু যে তাকে বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন তাতেই সে কৃতজ্ঞ। মন দিয়ে লেখাপড়া করলো মেঘনাদ। নিম্ন-মাধ্যমিক পরীক্ষায় সমগ্র ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে সরকার থেকে মাসিক চার টাকা বৃত্তি পেলো মেঘনাদ।

এবার বাড়ি থেকে পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে কোন আপত্তি করলেন না মেঘনাদের বাবা। ১৯০৫ সালে বারো বছর বয়সে ঢাকায় এলো মেঘনাদ। কলেজিয়েট স্কুলের হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হলো। মাসিক চার টাকা সরকারি বৃত্তি ছাড়াও পূর্ব-বঙ্গ বৈশ্য সমিতি থেকে পাওয়া গেলো মাসিক দু’টাকা বৃত্তি। মাত্র ছয় টাকা দিয়ে সারা মাসের থাকা-খাওয়া আর লেখাপড়ার খরচ কীভাবে চালাবে মেঘনাদ? ভেবে অস্থির হয়ে গেলেন মেঘনাদের দাদা জয়নাথ। নিজে জুটমিলে কাজ করে বেতন পান মাত্র বিশ টাকা। সেখান থেকেই মাসে পাঁচ টাকা করে ভাইয়ের জন্য পাঠাতে শুরু করলেন জয়নাথ। মাসিক এগারো টাকায় ভালোভাবেই চলে যাচ্ছিলো মেঘনাদের। কিন্তু হঠাৎ করে একটা বড় রকমের সমস্যায় পড়ে গেলো মেঘনাদ।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু হয়েছে। লর্ড কার্জনের বাংলা ভাঙার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নানারকম আন্দোলন চলছে দেশব্যাপী। মেঘনাদের মনে বিপ্লবের টান আছে সত্যি, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আছে যুক্তিবোধ। পড়ালেখা ছাড়া আর কোন দিকে মন দেয়ার সময় বা ইচ্ছে কোনটাই নেই মেঘনাদের। কিন্তু তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেও অনেক কিছু ঘটে গেলো। একদিন স্কুলে যাবার পর অনেকের সাথে মেঘনাদকেও আলাদা করে লাইনে দাঁড় করানো হলো। তাদের অপরাধ – তারা খালি পায়ে স্কুলে এসেছে। মেঘনাদের জুতো কেনার টাকা নেই। সে খালি পায়েই স্কুলে আসে প্রতিদিন। কিন্তু সেদিনটা ছিল অন্যরকম। বাংলার গভর্নর ব্যামফাইল্ড ফুলারের আগমণ উপলক্ষে ঢাকায় ছাত্ররা প্রতিবাদ-মিছিল বের করেছে। পায়ে জুতো না-পরাটাও ছিল প্রতিবাদের অংশ। কলেজিয়েট স্কুলে খালি-পায়ের ছেলেদের ধরে শাস্তির ব্যবস্থা করা হলো। অনেকের সাথে মেঘনাদকেও স্কুল থেকে বহিস্কার করা হলো। বাতিল করা হলো তার বৃত্তি। এখন কোথায় যাবে মেঘনাদ?

তখন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে সারাদেশে। সরকারী স্কুল-কলেজে যে রকম বহিস্কারের ধুম চলছে – সাথে সাথে বেসরকারী স্কুল-কলেজেও চলছে বহিস্কৃত ছাত্রদের ভর্তির ব্যবস্থা। ঢাকার কিশোরী লাল জুবিলী স্কুলে বিনাবেতনে মেঘনাদের ভর্তির ব্যবস্থা হলো। একটা বৃত্তিও দেওয়া হলো থাকা-খাওয়া চালানোর জন্য। স্কুল জীবনের শেষের দিকে ঢাকা ব্যাপ্টিস্ট মিশনের বাইবেল ক্লাসে যোগ দিলো মেঘনাদ। ব্যাপ্টিস্ট মিশন পরিচালিত দেশ-ব্যাপী বাইবেল পরীক্ষায় মেঘনাদ প্রথম স্থান অধিকার করে একশ’ টাকা পুরষ্কার পেলো। টাকাটার খুব দরকার ছিল মেঘনাদের। ১৯০৯ সালে সারা পূর্ব-বাংলায় প্রথম স্থান অধিকার করে এন্ট্রান্স পাশ করলো মেঘনাদ।

এবার কলেজের পড়াশোনা শুরু হলো ঢাকা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে। তখন ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন প্রফেসর আর্চবোল্ড। রসায়ন পড়াতেন প্রফেসর হরিদাস সাহা ও ডক্টর ওয়াট্‌সন। পদার্থবিজ্ঞান পড়াতেন বি এন দাস, গণিতের অধ্যাপক ছিলেন নরেশ ঘোষ ও কে পি বসু। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় মেঘনাদ সাহার প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় কলেজ ম্যাগাজিনে – হ্যালির ধুমকেতু সম্পর্কে। তখন কলকাতায় অনেক কলেজে অতিরিক্ত একটা ঐচ্ছিক বিষয় নেয়া যেতো। কিন্তু ঢাকা কলেজে সেরকম সুযোগ ছিল না। মেঘনাদ অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে জার্মান ভাষা নিয়ে প্রাইভেটে পড়তে শুরু করলো। রসায়নের প্রফেসর নগেন্দ্রনাথ সেন ভিয়েনা থেকে ডক্টরেট করে ফিরে এসেছেন, ভালো জার্মান জানেন। তিনি মেঘনাদকে জার্মান ভাষা শেখালেন। উচ্চ-মাধ্যমিকে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে জার্মান ভাষার পরীক্ষা দিলো মেঘনাদ। ১৯১১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেন মেঘনাদ সাহা। পূর্ব-বাংলায় প্রথম স্থান এবং কলকাতা সহ সমগ্র বাংলায় তৃতীয় স্থান অধিকার করলেন মেঘনাদ।

এবার বিএসসিতে ভর্তি হলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ১৯১১ সালে। প্রেসিডেন্সি কলেজে তখন তারার মেলা। পদার্থবিজ্ঞান পড়াচ্ছেন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, রসায়নের অধ্যাপক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। সহপাঠীদের মধ্যে আছেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু – যিনি সব পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। আছেন জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নীলরতন ধর, নিখিল রঞ্জন সেন প্রমুখ – পরবর্তীতে এঁদের সবাই যার যার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রশান্ত চন্দ্র মহ্লানবীশ ছিলেন মেঘনাদের এক বছর সিনিয়র। যদিও পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন পড়াচ্ছিলেন জগদীশ বসু ও পি সি রায় নিজে – মেঘনাদের প্রিয় বিষয় কিন্তু এ’দুটোর কোনটাই নয়। তাঁর ভালো লাগে গণিত। সত্যেন বসুরও একই অবস্থা। সত্যেন বসু অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান, কলকাতায় নিজের বাড়ি থেকেই কলেজে যাতায়াত করেন। কিন্তু মেঘনাদের অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। থাকেন ইডেন হিন্দু হোস্টেলে। সেখানে জাত-প্রথার প্রচন্ড কড়াকড়ি। ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণদের জন্য আলাদা আলাদা থাকা ও খাবার ব্যবস্থা। শিক্ষিত ছেলেদের মধ্যে জাত-পাতের ক্ষুদ্রতা দেখে মন খারাপ হয়ে যায় মেঘনাদের। কিন্তু কিছুই করতে পারেন না তিনি। কারণ নীচুজাতি বলে তাঁকেও অনেক অপমান সহ্য করতে হয়। হোস্টেলের সরস্বতী পূজায় অঞ্জলি দিতে গেলে কিছু ব্রাহ্মণ সন্তান মেঘনাদকে অপমান করে মন্ডপ থেকে বের করে দেয়। যে ধর্ম-জাতি-বর্ণ মানুষে মানুষে বিভক্তি তৈরি করে সেই ধর্মের প্রতি ক্রমশ বিশ্বাস হারাতে থাকেন মেঘনাদ সাহা। হোস্টেলের পরিবেশ অসহ্য লাগতে শুরু করে মেঘনাদের। হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে কলেজ স্ট্রিটের একটা ছাত্র-মেসে গিয়ে উঠলেন ১৯১৩ সালে। সে বছরই গণিতে অনার্স সহ বিএসসি পাশ করলেন মেঘনাদ। পরীক্ষায় মেঘনাদ সাহা প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন, আর প্রথম হলেন সত্যেন বসু।

কলেজ স্ট্রিটের মেসে এসেও ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়-বৈশ্য ইত্যাদি শব্দাবলী ও তাদের অনুশাসন থেকে মুক্তি পেলেন না মেঘনাদ। এখানেও ব্রাহ্মণরা অব্রাহ্মণদের সাথে বসে খান না। আর মেঘনাদের সাথে তো কেউই খেতে বসেন না। তবে অন্য একটা ব্যাপারে মেঘনাদের মিশ্র অনুভূতি হলো। মেসে আসার পর অনেক তরুণ ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক কর্মীর সাথে পরিচয় হলো তাঁর। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন মেঘনাদের তিন বছরের জুনিয়র। মেসে যাওয়া আসা ছিল তাঁর। অনুশীলন সমিতির তরুণ নেতা পুলিন দাস, শৈলেন ঘোষ, যুগান্তরের নেতা যতীন মুখার্জি- যিনি নিজের হাতে একটা ভোজালি দিয়ে বাঘ মেরে বাঘা যতীন নামে পরিচিত হয়েছেন – সবার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো মেঘনাদ সাহার। বাঘা যতীন মেঘনাদকে প্রায়ই বলতেন বিপ্লবীদের সাথে একটা দূরত্ব রেখে চলতে। কারণ দেশের কাজে শুধু বিপ্লবীদের নয় মেঘনাদের মত মেধাবী ছাত্রদেরও দরকার আছে – যারা জাতি গঠন করবেন। ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদের পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে নজর রাখছে। মেঘনাদ নিজেও বুঝতে পারেন সেটা। সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করেন। কারণ তিনি জানেন তাঁর ওপর সংসারের অনেক দায়িত্ব। মা-বাবা ভাইবোনদের দেখতে হবে, ছোট ভাইকে লেখাপড়া করাতে হবে। এমএসসি পাশ করে ফাইনেন্সিয়াল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবার পরিকল্পনা করে রেখেছেন।

১৯১৫ সালে মিশ্র-গণিতে এমএসসি পাশ করলেন মেঘনাদ সাহা। এবারেও তিনি দ্বিতীয় হলেন আর সত্যেন বসু প্রথম। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে ইন্ডিয়ান ফাইনেন্সিয়াল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবার জন্য দরখাস্ত করলেন মেঘনাদ সাহা। এদিকে বাড়ি থেকে মেঘনাদের ছোটভাই কলকাতায় চলে এসেছে দাদার কাছে থেকে লেখাপড়া করবে বলে। ফাইনেন্সিয়াল সার্ভিসের চাকরিটা হয়ে গেলে আর কোন সমস্যা থাকবে না। বেতন ভাতা আর অন্যান্য সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি এই ফাইনেন্সিয়াল সার্ভিসে। কিন্তু পরীক্ষা দেবার অনুমতি পেলেন না মেঘনাদ সাহা। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা রিপোর্ট দিয়েছে – মেঘনাদ সাহা বিপ্লবীদের সাথে যুক্ত। ব্রিটিশ রাজত্বে সরকারী চাকরির সব সম্ভাবনাই বন্ধ হয়ে গেলো মেঘনাদের। কোন একটা চাকরি পাবার আগপর্যন্ত উপার্জনের একমাত্র রাস্তা হয়ে দাঁড়ালো টিউশনি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কলকাতার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত সাইকেল চালিয়ে দিনে তিনটি পর্যন্ত টিউশনি করতেন মেঘনাদ সাহা। অধ্যাপক হবেন, গবেষণা করবেন, বিজ্ঞানী হবেন এরকম কোন পূর্ব-পরিকল্পনা ছিল না তাঁর।

এদিকে বাংলার বিখ্যাত সব মানুষেরা বাংলার উন্নতির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন যে যেভাবে পারেন। ১৯০৬ সালে উপাচার্য হবার পর থেকে স্যার আশুতোষ মুখার্জি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন দিনরাত। ১৯১৪ সালে দু’জন নামকরা উকিল তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য প্রচুর টাকা দিয়েছেন। সেই টাকায় প্রতিষ্ঠিত হলো বিজ্ঞান কলেজ। বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করার কিছুদিন পর স্যার আশুতোষ মুখার্জির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে ছিলেন তিনি। বিজ্ঞান কলেজের জন্য উপযুক্ত শিক্ষক খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন তিনি। দেশের সেরা ছাত্রদের ডেকে এনে চাকরি দেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্যার আশুতোষ মুখার্জি ১৯১৫ সালের এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকারী সত্যেন বসু ও মেঘনাদ সাহাকে ডেকে নিলেন ১৯১৬ সালে। দু’জনেরই চাকরির দরকার ছিল তখন। দু’জনই যোগ দিলেন গণিত বিভাগের প্রভাষক পদে।

তেইশ বছরের তরুণ প্রভাষক মেঘনাদ সাহা মন-প্রাণ দিয়ে কাজ শুরু করলেন গণিত বিভাগে। কিন্তু বিভাগীয় প্রধান গনেশ প্রসাদের অসহযোগিতার কারণে কাজ করা দুরুহ হয়ে পড়লো। অধ্যাপক গনেশ প্রসাদ মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে যখন তখন অপমান করেন। বলেন – ‘পরীক্ষায় অনেক অনেক নম্বর পেয়ে ফার্স্ট সেকেন্ড হলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর যোগ্যতা হয়ে যায় না কারো। আশুবাবু কিছু না বুঝেই দুটো বাচ্চা ছেলে ধরে এনেছেন’। এত অপমান সহ্য করা যায় না। মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ আবার গেলেন স্যার আশুতোষের কাছে। সব শুনে তিনি বললেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দিতে। মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ যোগ দিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। সেখানে তাঁদের আগে যোগ দিয়েছেন দেবেন্দ্রমোহন বসু ও শিশিরকুমার মিত্র। পরের বছর যোগ দিয়েছেন সি ভি রামন।

পদার্থবিজ্ঞানের অনার্স বা মাস্টার্স না হয়েও পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক হয়ে বিরাট দায়িত্বের মুখোমুখি পড়ে গেলেন মেঘনাদ। সত্যেন্দ্রনাথেরও একই অবস্থা। প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ার সময় পদার্থবিজ্ঞান পড়েছেন মাত্র এক বছর – বিএসসি’র সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে। মেঘনাদের কাছে “জগদীশ বসুর পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্লাসের চেয়েও বেশি ভাল লাগতো প্রফেসর ডি এন মল্লিকের গণিতের ক্লাস”[4]। সাহা পদার্থবিজ্ঞানের উচ্চতর ক্লাসের ছাত্রদের পড়াতে শুরু করলেন – স্পেকট্রোস্কোপি ও থার্মোডায়নামিক্স। নিজে নিজে পড়তে পড়তে শিখতে শিখতে পড়ানো। পড়তে পড়তে পদার্থবিজ্ঞানকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেললেন মেঘনাদ সাহা। শক্ত গাণিতিক বুনিয়াদ তো আগেই ছিল – এখন পদার্থবিজ্ঞানে নতুন নতুন তত্ত্বীয় গবেষণা শুরু করতে তেমন কোন অসুবিধে হলো না। অবশ্য পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগার বলতে তেমন কিছুই শুরুতে ছিল না। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় মেঘনাদের সবচেয়ে বড় গবেষণাগার হিসেবে কাজ করেছে প্রেসিডেন্সী কলেজের লাইব্রেরি। পদার্থবিজ্ঞানের নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে কাজ চলছে ইউরোপে। বিশেষ করে জার্মানিতে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভিত্তি রচিত হচ্ছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে ১৯১৬ সালে [5]। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় মেঘনাদ যে জার্মান শিখেছিলেন তা কাজে লেগে গেলো। সত্যেন্দ্রনাথও জার্মান শিখেছেন। এর মধ্যে জার্মান প্রফেসর ব্রুলের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে তাঁদের। প্রফেসর ব্রুল শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বোটানির প্রফেসর ছিলেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে বোটানির ফিল্ডট্রিপে যেতে পারতেন না বলে ফিজিক্স পড়ানো শুরু করলেন [6]। ব্রুল জার্মানি থেকে নিয়ে আসা অনেকগুলো ফিজিক্সের বই দিয়ে সাহা ও বসুকে সাহায্য করেছেন। জার্মানি থেকে ফেরার সময় দেবেন্দ্রমোহন বসুও কিছু বই নিয়ে এসেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদের জন্য [7]। ম্যাক্স প্লাংকের থার্মোডায়নামিক্সের বই, ব্র্যামস্টারলাং এক্স-রে সম্পর্কিত বই, আইনস্টাইনের পেপার ইত্যাদি। ছাত্ররা পদার্থবিজ্ঞানের একেবারে তরতাজা বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে শুরু করলো সাহা ও বসুর কাছ থেকে।

১৯১৭ সালে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ‘পালিত প্রফেসর’ পদে যোগ দিলেন সি ভি রামন। ১৯০৭ থেকে তিনি ইন্ডিয়ান ফাইনেন্সিয়াল সার্ভিসে কাজ করার পাশাপাশি ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্স-এ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। স্যার আশুতোষ মুখার্জির আহ্বানে ফাইনেন্সিয়াল সার্ভিসের এত বড় চাকরি ছেড়ে অর্ধেকেরও কম বেতনের প্রফেসর পদে যোগ দিয়েছেন। মেঘনাদ সাহা ফাইনেন্সিয়াল সার্ভিসের জন্য পরীক্ষা দিতে না পেরে যে কষ্ট পেয়েছিলেন – রামনকে দেখে তা দূর হয়ে গেলো। বুঝতে পারলেন যে তিনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপনা ও গবেষণায় একনিষ্ঠভাবে কাজ শুরু করলেন সাহা। তবে রামনের মত পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের দিকে না গিয়ে নিজের মত করে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের দিকেই এগোলেন।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও থার্মোডায়নামিক্সের তত্ত্বগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলেন মেঘনাদ সাহা। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব, সার্বিক তত্ত্ব সহ ১৯০৫ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত সবগুলো গবেষণা-পত্র মূল জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার কাজে হাত দিলেন মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘প্রিন্সিপাল্‌স অব রিলেটিভিটি’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয় এ অনুবাদ। বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের এটাই সর্বপ্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ শুধু নয়, সারাবিশ্বে এই বইটাই আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদ। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৭৯ সালে আইনস্টাইনের জন্ম শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে উল্লেখ করা হয় যে আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল জাপানে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়াম। তিনি জানতেন সাহা ও বসুর অনুবাদের কথা। সুব্রাহ্মনিয়ামের চেষ্টায় আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদের স্বীকৃতি পাওয়া গেলো। সাহা ও বসুর অনুবাদ এখন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির আইনস্টাইন আর্কাইভে রাখা আছে। এই অনুবাদের মাধ্যমেই আইনস্টাইনের সাথে প্রথম যোগাযোগ হয় সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদের।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সম্পর্কিত গবেষণাপত্রগুলো পড়ে ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচুম্বক তত্ত্বের ওপর গবেষণা-পত্র প্রকাশ করেন মেঘনাদ সাহা। লন্ডনের ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় সাহার প্রথম গবেষণাপত্র “অন ম্যাক্সওয়েলস স্ট্রেসেস” [8]। একই বছর আমেরিকার ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত হয় “অন দি লিমিট অব ইন্টারফিয়ারেন্স ইন দি ফ্যাব্‌রে-পেরট ইন্টারফেরোমিটার” [9]। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব প্রয়োগ করে ইলেকট্রনের গতি সম্পর্কিত লিনার্ড-বিকার্ট (Lienard-Wiechert) পটেনশিয়ালের গাণিতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন সাহা। ১৯১৮ সালে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় এ গবেষণাপত্র [10]।

১৯১৮ সালে স্থিতিস্থাপকতার নতুন তত্ত্ব প্রকাশ করেন মেঘনাদ সাহা। ‘অন এ নিউ থিওরম ইন ইলাস্টিসিটি’ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে [11]। এই জার্নালের একই সংখ্যায় আলোর চাপের ওপর তাঁর আরেকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। সহকর্মী এস চক্রবর্তীর সাথে যৌথভাবে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় ‘অন দি প্রেসার অব লাইট’ শিরোনামে [12]। কোয়ান্টামে মেকানিক্স নিয়েও কাজ শুরু করেছেন তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে। সাহা ও বসুর প্রথম যৌথ-গবেষণাপত্র ‘অন দি ইনফ্লুয়েন্স অব দি ফাইনাইট ভলিয়্যুম অব মলিকিউল্‌স অন দি নিউ ইকুয়েশান অব স্টেট’ [13] প্রকাশিত হয় ১৯১৮ সালে ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে।

১৯১৭ ও ১৯১৮ সালে প্রকাশিত ছয়টি গবেষণা-পত্রের ওপর ভিত্তি করে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রির জন্য থিসিস জমা দেন মেঘনাদ সাহা ১৯১৮ সালে। কোন গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের সাহায্য ছাড়াই কাজ করতে হয়েছে মেঘনাদকে। তাঁর তড়িৎচুম্বক তত্ত্ব ও বিকিরণের চাপ সংক্রান্ত থিসিসটি পাঠানো হয় প্রফেসর রিচার্ডসন (O. W. Richardson), ক্যাম্পবেল (N. R. Campbell) ও পোর্টারের (Porter) কাছে। পরীক্ষকরা সবাই প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞানী। (রিচার্ডসন থার্মিয়নিক এমিশান আবিষ্কারের জন্য ১৯২৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।) তিনজন পরীক্ষকই ভূয়সী প্রশংসা করেন মেঘনাদের গবেষণার। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করে মেঘনাদ সাহাকে।

মেঘনাদ শক্তির বিকিরণের চাপ (radiation pressure) সংক্রান্ত মৌলিক গবেষণা শুরু করেছিলেন ১৯১৭ সালেই। ১৯১৭ সালের শেষের দিকে ‘সিলেকটিভ রেডিয়েশান প্রেসার’ শিরোনামে বেশ বড় একটি গবেষণাপত্র রচনা করেন তিনি। সৌর-পরমাণুর ওপর মাধ্যাকর্ষণ বলের বিপরীতে বিকিরণের চাপের প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন ওই গবেষণাপত্রে। এস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে প্রকাশের জন্য গবেষণাপত্রটি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু জার্নালের সম্পাদক জানালেন গবেষণাপত্রটি প্রকাশের পক্ষে বড় দীর্ঘ হয়ে গেছে। তবে প্রকাশ করা যেতে পারে একটি শর্তে। প্রকাশনার খরচ যদি মেঘনাদ সাহা দিতে পারেন তবে। সেই ১৯১৭ সালে মেঘনাদের পক্ষে শতাধিক ডলার দেয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে কোন টাকা বরাদ্দ নেই। সাহা যা বেতন পান (বছরে মাত্র ১৫০ পাউন্ড) তা দিয়ে মা-বাবাকে সাহায্য করা ছাড়াও ছোট-ভাইয়ের যাবতীয় খরচও সামলাতে হতো। সাহা এস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালের সম্পাদককে জানালেন টাকা দিতে না পারার কথা। এরপর সম্পাদকের কাছ থেকে আর কিছুই জানা যায় নি। পেপারটিও তিনি ফেরৎ পান নি। অনেক বছর পরে ১৯৩৬ সালে সাহা যখন ইয়র্কের মান-মন্দির পরিদর্শন করছিলেন তখন ডক্টর মর্গান সাহাকে তাঁর ১৯১৭ সালের পেপারের পান্ডুলিপিটি দেখান। পেপারটি ১৯১৭ সাল থেকে ওখানকার ড্রয়ারেই পড়েছিল। এস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে পেপারটির খুবই ছোট্ট একটা টীকা প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে ‘রেডিয়েশান প্রেসার’ শিরোনামে [14]। মূল পেপারটির অনেকদিন কোন খবর না পেয়ে অনুলিপিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশের জন্য পাঠান। সেখানে ‘অন সিলেকটিভ রেডিয়েশান প্রেসার এন্ড প্রোবলেম অব সোলার এটমস্ফিয়ার’ শিরোনামে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে [15]। স্বাভাবিক ভাবেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ জার্নালের খবর সবার কাছে পৌঁছায় না। ফলে বিকিরণের চাপ সংক্রান্ত মেঘনাদ সাহার মৌলিক গবেষণার কথা প্রায় অজানাই রয়ে গেলো বেশ কয়েক বছর। ১৯২১ সালে নেচার সাময়িকীতে সাহার এ সংক্রান্ত আরেকটি পেপার “দি স্টেশনারি এইচ এন্ড কে লাইন্স অব ক্যালসিয়াম ইন স্টেলার এটমস্ফিয়ার” [16] প্রকাশিত হলে তা অনেকেরই চোখে পড়ে এবং সেখান থেকে অনেকেই নতুন ধারণা হিসেবে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন – যা এক বছর আগেই মেঘনাদ প্রকাশ করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে।

এমএসসি ক্লাসে থার্মোডায়নামিক্স ও স্পেকট্রোস্কোপি পড়ানোর সময় থেকেই তাপীয় আয়নায়নের ধারণা দানা বাঁধতে থাকে মেঘনাদের মনে। জার্মান বিজ্ঞান সাময়িকীর নিয়মিত পাঠক হিসেবে সাহা জানতেন এ সংক্রান্ত কী কী গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানী নার্নস্ট এর তাপীয় তত্ত্ব ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। নার্নস্টের ছাত্র এগার্ট ১৯১৯ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে উচ্চ-তাপমাত্রার কারণে নক্ষত্রের মধ্যে অধিক হারে আয়নায়ন ঘটার কারণ ব্যাখ্যা করেন। সাহা পেপারটিতে কিছু অসংগতি লক্ষ্য করেন। বিশেষ করে তাপীয় আয়নায়নের যে সূত্র এগার্ট দিয়েছেন তাতে পরমাণুর আয়নাইজেশান পটেনশিয়েল নির্ণয়ের ব্যাপারে খুব একটা গুরুত্ব দেন নি। সাহা ঠিক করলেন আয়নাইজেশান পটেনশিয়েল সঠিক ভাবে হিসেব করবেন যেখান থেকে যেকোন তাপে ও চাপে যেকোন পরমাণুর আয়নাইজেশান বা আয়নায়ন সঠিক ভাবে নির্ণয় করা যাবে। ১৯১৯ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরপর চারটি গবেষণা-পত্র রচনা করে ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য পাঠালেন। ১৯২০ সালে গবেষণা-পত্রগুলো ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। তাঁর “আয়নাইজেশান ইন দি সোলার ক্রোমোস্ফিয়ার” [17] গবেষণাপত্রে বর্ণিত হয় তাঁর বিখ্যাত তাপীয় আয়নায়নের সূত্র যা ‘সাহা থার্মাল আয়নাইজেশান ফর্মূলা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। নোবেল বিজয়ী জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী স্যার আর্থার এডিংটন মেঘনাদ সাহার তাপীয় আয়নায়নের তত্ত্বকে জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার দশটি মহত্তম আবিষ্কারের একটি বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন [3]।

১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিএসসি ডিগ্রির পাশাপাশি ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ ও ‘গুরুপ্রসন্ন ঘোষ’ বৃত্তি লাভ করেন মেঘনাদ সাহা। এই বৃত্তির টাকায় মেঘনাদ প্রায় দু’বছর ইউরোপে ভ্রমণ ও গবেষণার সুযোগ পেলেন। ১৯১৯ সালের শেষের দিকে লন্ডনে পৌঁছলেন মেঘনাদ সাহা। ইচ্ছে ছিল কেমব্রিজ বা অক্সফোর্ডে গিয়ে কাজ করবেন। কিন্তু সেখানে খরচ এত বেশি যে দুটো বৃত্তি থাকা সত্ত্বেও তা সম্ভব হয়নি মেঘনাদের পক্ষে। মেঘনাদ গেলেন ইম্পেরিয়াল কলেজে। তাঁর কলেজ জীবনের বন্ধু জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জি তখন সেখানে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করছেন। এখানেই মেঘনাদের সাথে পরিচয় হয় শান্তিস্বরূপ ভাটনগরের সাথে। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের মধ্যে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ইম্পেরিয়াল কলেজে শুরুতে সুনির্দিষ্ট কোন অধ্যাপকের সাথে কাজ করার পূর্ব-পরিকল্পনা সাহার ছিল না। প্রথম কয়েকদিন ঠিক বুঝতেও পারছিলেন না কোত্থেকে শুরু করবেন। মেঘনাদের প্রেসিডেন্সি কলেজের সহপাঠী স্নেহময় দত্ত তখন ইম্পেরিয়াল কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করছেন। তিনি সাহাকে পরামর্শ দিলেন প্রফেসর ফাউলারের সাথে কাজ করতে। প্রফেসর ফাউলারের গবেষণার সাথে মেঘনাদ পরিচিত। বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিদ স্যার নরম্যান লক্‌ইয়ারের ছাত্র ফাউলার ছিলেন নেচার সাময়িকীর প্রথম সম্পাদক। ফাউলার নক্ষত্রের বর্ণালী নিয়ে গবেষণা করছিলেন সেসময়।

মেঘনাদ সাহাকে প্রথম দেখে প্রফেসর ফাউলার মনে করেছিলেন যে অন্যান্য ভারতীয় ছাত্রদের মত সাহাও পিএইচডি করতে এসেছেন তাঁর কাছে। কিন্তু সাহা যখন বললেন যে তিনি এসেছেন মাত্র কয়েক মাসের জন্য – নিজের তত্ত্ব যাচাই করে নিতে – তখন ফাউলার মোটেও পাত্তা দিলেন না তাঁকে। শুধু বললেন – “যাও, ল্যাবে গিয়ে কাজ করো। দেখো যা যাচাই করতে এসেছো তা পাও কি না”। কিন্তু কিছুদিন পরই ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিনে সাহার “আয়নাইজেশান ইন দি সোলার ক্রোমোস্ফিয়ার” [17] প্রকাশিত হলে ফাউলারের ব্যবহার আগাগোড়া বদলে যায়। তিনি সাহাকে খুবই গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। ফাউলারের সাথে পাঁচ মাস কাজ করেছিলেন মেঘনাদ সাহা। এসময় সাহা স্যার জে জে থমসনের কাছে অনুরোধ করেছিলেন কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে পরীক্ষা করে সাহার তত্ত্বের সত্যতা যাচাই করে দেখার জন্য। কিন্তু স্যার থমসন জানালেন সাহার পরীক্ষণের জন্য যে উচ্চ-তাপমাত্রার দরকার – সেরকম যন্ত্রপাতি তাঁর ল্যাবে নেই। তিনি পরামর্শ দিলেন বার্লিনে গিয়ে প্রফেসর নার্নস্টের সাথে যোগাযোগ করতে।

জার্মানির প্রতি মেঘনাদ সাহার একটা দুর্বলতা বরাবরই ছিল। জার্মানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতা সবসময়েই মুগ্ধ করেছে মেঘনাদকে। জার্মান ভাষা তাঁর জানা আছে। ১৯২০ সালে তিনি বার্লিনে গেলেন এক বছরের জন্য। লন্ডন থেকে যাবার সময় প্রফেসর ডোনানের কাছ থেকে একটি চিঠি নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একই সময়ে সাহার মত আরো চৌদ্দ জন ছাত্র এরকম চিঠি নিয়ে গেছেন নার্নস্টের কাছে। প্রফেসর ওয়াল্টার নার্নস্ট তখন বিশ্ববিখ্যাত। সে বছরই (১৯২০) নার্নস্ট পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। নার্নস্ট শুরুতে লন্ডন থেকে আসা কোন ছাত্রকেই তাঁর ল্যাবে ঢুকতে দিতে রাজী হন নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হেরে যাওয়ার কারণে ইংল্যান্ডের ওপর অনেক রাগ নার্নস্টের। পরে অবশ্য তিনি সাহাকে তাঁর ল্যাবে কাজ করতে দিতে রাজী হয়েছেন। কারণ হিসেবে সাহাকে তিনি বলেছেন – “ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গালে শেষ চড়টা ভারতই মারবে” [4]। বার্লিনে থাকাকালীন মেঘনাদ সাহার সুযোগ হয় ম্যাক্স প্ল্যাংক, আর্নল্ড সামারফেল্ড ও আলবার্ট আইনস্টাইনের সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হবার। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রথম অনুবাদক সাহা ও বসু। শুধু তাই নয়- ১৯১৯ সালে আইনস্টাইনের সার্বিক তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়ার পর আইনস্টাইন যখন রাতারাতি বিশ্ববিখ্যাত হয়ে গেছেন [5], তখন ভারতীয় সংবাদপত্রে আইনস্টাইনের কাজ সম্পর্কিত প্রথম রচনাটিও মেঘনাদ সাহাই লিখেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথেও সাহার ব্যক্তিগত পরিচয় হয় বার্লিনে এসে সামারফেল্ডের মাধ্যমে। বার্লিনে বসে মেঘনাদ সাহা জার্মান ভাষায় গবেষণাপত্র রচনা করেন এবং তা জার্মানির বিখ্যাত সাময়িকী Zeitschrift fur Physik-এ প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে[18]।

১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিফিথ মেমোরিয়াল প্রাইজ পান মেঘনাদ সাহা। ছদ্মনামে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ জমা দিতে হতো এই প্রাইজের জন্য। মেঘনাদ ‘হিলিওফিলাস’ ছদ্মনামে ‘অরিজিন্‌স অব লাইন্‌স ইন স্টেলার স্পেক্‌ট্রা’ প্রবন্ধটি পাঠিয়েছিলেন ইউরোপ থেকে। অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু ছিলেন গ্রিফিথ পুরষ্কারের অন্যতম বিচারক [7]।

ইতোমধ্যে স্যার আশুতোষ মুখার্জি আবার উপাচার্য পদে যোগ দিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯১৯ সালে তিনি যখন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন তখন খয়রার রাজা কুমার গুরুপ্রসাদ সিং-এর বিরুদ্ধে তাঁর রাণী বাগেশ্বরী দেবীর মামলার নিষ্পত্তি হয় ছয় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে। রাণী বাগেশ্বরী টাকাগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে দেন। স্যার আশুতোষ মুখার্জি ওই টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘খয়রা অধ্যাপক’ পদ সৃষ্টি করেন। মেঘনাদ সাহার গবেষণায় উন্নতির সব খবর তিনি রাখেন। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ‘খয়রা অধ্যাপক’ পদের জন্য তিনি মেঘনাদ সাহাকে মনোনীত করে টেলিগ্রাম পাঠালেন সাহার কাছে বার্লিনে।

১৯২১ সালের নভেম্বরে কলকাতায় ফিরে এসে খয়রা অধ্যাপক পদে যোগ দিলেন মেঘনাদ সাহা। স্যার আশুতোষ মুখার্জি বিভিন্ন জনের ব্যক্তিগত অনুদান থেকে অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করে বিভিন্ন বিভাগের সম্প্রসারণ করলেও সরকার থেকে কোন ধরণের সহযোগিতা পাচ্ছিলেন না। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। সরকারের সাথে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বিরোধও বাড়ছে। সাহার বন্ধু সত্যেন্দ্রনাথ বসু চলে গেছেন নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিশির মিত্র তখন প্যারিসে শিক্ষাছুটিতে। মেঘনাদ গবেষণাগার তৈরি করার কোন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। সরকার থেকে প্রতিশ্রুতি দেবার পরও কোন অনুদান পাওয়া যাচ্ছে না। ১৯২২ সালে আড়াই লাখ টাকার একটা রিসার্চ গ্রান্ট মঞ্জুর হবার পরে দেখা গেলো সেই গ্রান্টের সাথে যেসব শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে তা মানতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে কোন ধরনের আত্মমর্যাদা থাকে না। ফলে স্যার আশুতোষ মুখার্জি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওই টাকা নেবেন না। অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা পড়লেন উভয়সঙ্কটে। তিনি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি ও আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকে অফার পেলেন। কিন্তু তিনি দুটো অফারই বাতিল করে দিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে সাহার দু’বছরের সিনিয়র ছিলেন নীলরতন ধর। তিনি তখন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক। তিনি সাহাকে উদ্বুদ্ধ করলেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার জন্য।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করার আগে অধ্যাপক সাহা সিন্ডিকেটের কাছে লিখলেন- “আমি এখনো কাজ করতে রাজী আছি যদি আমার বেতন ৬৫০-৫০-১০০০ টাকা স্কেলে উন্নীত করা হয় এবং আরো পনের হাজার টাকা আমাকে ব্যক্তিগত গবেষণা খাতে দেয়া হয়”। সিন্ডিকেট সাহার কোন কথাতেই কান দেয় নি। ১৯২৩ সালে কলকাতা ছেড়ে অধ্যাপক সাহা যোগ দিলেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এলাহাবাদে যোগ দেবার কয়েক দিনের মধ্যেই সাহা বুঝতে পারলেন এখানের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। গবেষণাগার, গবেষণার সুযোগ কিছুই তেমন নেই। ডিপার্টমেন্টে এক শ’ বিশ জন ছাত্র অথচ মেঘনাদ একাই অধ্যাপক। সাথে আছেন মাত্র একজন সহযোগী অধ্যাপক, একজন প্রভাষক ও দু’জন প্রদর্শক। সবকিছুই একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হলো। কিন্তু তা করতে গিয়ে কারো সহযোগিতা পাওয়া তো দূরের কথা, বরং পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। ডিপার্টমেন্টের প্রায় পরিত্যক্ত লাইব্রেরির জন্য নতুন বই ও জার্নাল কেনার জন্য টাকা চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (যিনি আগে এলাহাবাদ কোর্টের বিচারক ছিলেন) খুবই তাচ্ছিল্যের সাথে সাহাকে প্রশ্ন করেন – “লাইব্রেরির সব বই কি পড়া হয়ে গেছে? যদি না হয়ে থাকে তাহলে আরো নতুন বই কিনে কী হবে?” সাহা আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলেন এরকম বুদ্ধি ও মানসিকতার মানুষেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় পদে বসে আছেন। পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে সাহা প্রচন্ড পরিশ্রম ও সংগ্রাম করে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগকে ভারতের নামকরা ডিপার্টমেন্টে উন্নীত করেন। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহার সহকর্মী ও ছাত্রদের অনেকেই পরবর্তীতে বিখ্যাত হন। তাঁদের মধ্যে আছেন এন কে সুর, পি কে কিচলু, ডি এস কোঠারি, আর সি মজুমদার, আত্মারাম, কে বি মাথুর, বি ডি নাগচৌধুরি, বি এন শ্রীবাস্তব প্রমুখ।

সাহা তাঁর তত্ত্বীয় গবেষণার ফলাফল উন্নতমানের যন্ত্রপাতির অভাবে পরীক্ষা করে দেখতে পারছিলেন না। যন্ত্রপাতি কেনার টাকার জন্য তিনি তাঁর আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও হাত পেতেছেন অনেকের কাছে। উইলসন অবজারভেটরির এইচ এন রাসেলের সাথে গবেষণা সংক্রান্ত অনেক আলোচনা হয়েছে সাহার। ১৯২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রফেসর সাহা রাসেলের কাছে লেখা এক চিঠিতে একটা ভালো কোয়ার্টজ স্পেক্ট্রোমিটার কেনার জন্য দুই হাজার পাউন্ড কোন ভাবে জোগাড় করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন[19]। কিন্তু কোন সাহায্য পাওয়া যায়নি।

১৯২৫ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে সাহা ফিজিক্স সেকশানের প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন। দেশে বিজ্ঞানীদের শক্তিশালী পেশাগত সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি অনেকদিন থেকেই অনুভব করছিলেন। দেশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সবাইকে এক সাথে কাজ করতেই হবে। ১৯২১ সালে পশ্চিম-বঙ্গের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করতে গিয়ে সাহা দেখেছেন বৈজ্ঞানিক প্লাটফরমের কত দরকার। এদিকে লন্ডনে প্রফেসর ফাউলার রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপের জন্য প্রফেসর মেঘনাদ সাহার নাম প্রস্তাব করেন। সাহার বৈজ্ঞানিক অর্জন যেটুকু হয়েছে তা রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপের জন্য যথেষ্ঠ। কিন্তু ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ গোয়েন্দারা সাহার নামে রিপোর্ট পাঠালো যে সাহা স্বদেশী আন্দোলন সহ সব ধরনের ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত। ফেলোশিপ কমিটির মেম্বাররা বিভক্ত হয়ে গেলেন। সিদ্ধান্ত ঝুলে রইলো পরবর্তী দু’বছর। ১৯২৭ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পেলেন মেঘনাদ সাহা। সাহার রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পাবার খবর এলাহাবাদের গভর্নরের কাছে পৌঁছালো। গভর্নর ছিলেন ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে লর্ড রাদারফোর্ডের সহপাঠী। তিনি সাহাকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি গবেষণার জন্য বছরে পাঁচ হাজার টাকার একটা গ্রান্টেরও ব্যবস্থা করেন। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সায়েন্স কংগ্রেসে সাহার সম্মান অনেক বেড়ে গেলো।

একই বছর সাহা ইতালি সরকারের আমন্ত্রণে কোমো কনফারেন্সে যোগ দেন। কলকাতা থেকে অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসুও যোগ দেন এই সম্মেলনে। ইতালি থেকে ফেরার পথে সাহা বার্লিন ও কোপেনহেগেনেও যান। কোপেনহেগেনে সাহার সাথে পরিচয় হলো সাইক্লোট্রনের আবিষ্কারক লরেন্সের সাথে। ১৯২৮ সালে ইউরোপ থেকে এলাহাবাদে ফিরে সাহা স্পেকট্রোমেট্রির যন্ত্রপাতি স্থাপন করে বর্ণালী তত্ত্বের কিছু পরীক্ষা শুরু করেন। প্রায় একই রকম কাজ সি ভি রামন করছিলেন তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২৮ সালের শেষের দিকে এলাহাবাদে সাহার কাজকর্ম দেখতে আসেন আর্নল্ড সামারফেল্ড। সে সময় তিনি কলকাতায় সি ভি রামনের সাথেও দেখা করেছেন। ইউরোপে ফিরে গিয়ে সামারফেল্ড রামন ও সাহার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯৩০ সালের নোবেল পুরষ্কারের জন্য অধ্যাপক মেঘনাদ সাহাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু ও শিশিরকুমার মিত্র। অবশ্য একই বছর অধ্যাপক সি ভি রামনকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন ডি ব্রগলি, রাদারফোর্ড, উইলসন, বোর প্রমুখ নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী। রামন পেয়েছেন ১৯৩০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার। এরপরে ১৯৩৭ সালে আর্থার কম্পটন, ১৯৩৯ সালে শিশিরকুমার মিত্র এবং ১৯৪০ সালে আবার আর্থার কম্পটন অধ্যাপক সাহাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের জন্য [20]।

১৯৩১ সালে সাহা তাঁর সহকর্মী শ্রীবাস্তবের সাথে যৌথভাবে প্রকাশ করলেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘এন ইন্ট্রোডাকশান টু হিট’। বইয়ের ভূমিকায় সি ভি রামন বইটার মৌলিকত্ব ব্যাখ্যার পাশাপাশি সাহার কাজের গভীরতা ও উৎকর্ষতার উচ্ছসিত প্রশংসা করেন।

বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি বিজ্ঞান সংগঠনেও মনযোগী হলেন মেঘনাদ সাহা। ১৯৩০ সালে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স ব্যাঙ্গালোরের রিভিউ কমিটির সদস্য মনোনীত হন। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ইনস্টিটিউটের কার্যনির্বাহী পদে এতদিন শুধু ব্রিটিশরাই কাজ করতেন। সাহা হলেন প্রথম ভারতীয় যিনি কমিটিতে স্থান পেলেন। সাহা উপলব্ধি করলেন ভারতীয়দের নিয়েই জাতীয় পর্যায়ের বিজ্ঞান সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। ১৯৩১ সালে তাঁর নেতৃত্বে এলাহাবাদে গঠিত হলো ইউনাইটেড প্রভিন্স একাডেমি অব সায়েন্সেস। পরবর্তীতে তা রূপান্তরিত হয় ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সে। ১৯৩২ সালের ১লা মার্চ থেকে একাডেমির কাজকর্ম শুরু হয়। অধ্যাপক সাহা হলেন একাডেমির প্রথম প্রেসিডেন্ট। ১৯৩৩ সালে সাহার উদ্যোগে কলকাতায় গঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি’। ফিজিক্যাল সোসাইটি থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’। সাহার উদ্যোগে গঠিত হয় ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেস অব ইন্ডিয়া’। ১৯৩৪ সালে বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সভাপতির বক্তৃতায় সাহা জাতীয় পর্যায়ে সায়েন্স ইনস্টিটিউটের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে ১৯৩৫ সালে এই ইনস্টিটিউটের প্রথম অধিবেশন বসে। পরে অবশ্য এই ইনস্টিটিউটের নাম বদলে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স’ করা হয় এবং এর সদর দপ্তর কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়।

১৯৩০ সালের পর থেকেই সাহা চাচ্ছিলেন এলাহাবাদ থেকে কলকাতায় ফিরে যেতে। ১৯৩২ সালে সি ভি রামন যখন কলকাতা ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন কলকাতার ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশান ফর দি কাল্টিভেশান অব সায়েন্সে ‘মহেন্দ্রলাল সরকার অধ্যাপক’ পদ সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া চলছিলো। মেঘনাদ সাহা সেই পদের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে সি ভি রামনকে চিঠি লেখেন। কিন্তু রামন পদটি অধ্যাপক সাহাকে না দিয়ে অধ্যাপক কৃষ্ণানকে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে রামনের ওপর ভীষণ রেগে যান মেঘনাদ সাহা। রামনের সাথে একটা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিত্বের সংঘাত দানা বাঁধতে থাকে মেঘনাদের। ১৯৩৩ সালে রামন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পালিত প্রফেসর’ পদ ছেড়ে দিলে সেই পদে যোগ দেন অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু। ফলে মেঘনাদের কলকাতায় ফেরা হয়ে ওঠে না। এদিকে রামন কলকাতা ছেড়ে ব্যাঙ্গালোরে এসে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের প্রথম ভারতীয় পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। রিভিউ কমিটির মেম্বার হিসেবে মেঘনাদ সাহা পরিচালক রামনের সাথে কাজ করে খুব একটা আনন্দ পাননি। ১৯৩৮ সালে সি ভি রামনকে যে অনেকটা বাধ্য হয়ে পরিচালক পদ থেকে সরে আসতে হয়েছিলো তার পেছনে অধ্যাপক মেঘনাদের ভূমিকাও ছিল।

১৯৩৫ সালে মেঘনাদ সাহা লন্ডনের ‘নেচার’ সাময়িকী এবং আমেরিকার ‘সায়েন্স’ সাময়িকীর আদলে বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য করে তোলার জন্য ‘ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ এসোসিয়েশান’ গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে নিয়মিত ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’ জার্নাল প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমৃত্যু তিনি এই জার্নালে নিয়মিত ভাবে লিখে গেছেন।

১৯৩২ সালে নিউট্রন আবিষ্কৃত হলে সাহা নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে দৌলতরাম সিং কোঠারির সাথে নিয়মিত আলোচনা করতে শুরু করেন কৃত্রিম আইসোটোপের ব্যাপারে। বিটা কণা বিকিরণের ব্যাপারেও অনেকদূর এগিয়েছিলেন – যা এনরিকো ফার্মি আবিষ্কার করে বিখ্যাত হয়েছেন আরো পরে।

১৯৩৬ সালে সাহা এক বছরের জন্য কার্নেগী ফেলোশিপ পান। পুরো এক বছরের জন্য তিনি বৈজ্ঞানিক-ভ্রমণে বের হন। তিনি ইরান, ইরাক, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ড ও আমেরিকা ভ্রমণ করেন এ সময়। কোপেনহেগেনে নীল্‌স বোরের ইনস্টিটিউশানে কিছুদিন কাজ করেন। সেখানেই সাহার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার। ইউরোপ থেকে আমেরিকা যান সাহা দু’মাসের জন্য। কাজ করেন হার্ভার্ড অবজারভেটরিতে। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি বার্কলেতে প্রফেসর লরেন্সের সাথেও কাজ করেন কিছুদিন। সাহা তাঁর ছাত্র বি ডি নাগচৌধুরিকে লরেন্সের ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করে আসেন এ সময়।

১৯৩৭ সালের নভেম্বরে স্যার জগদীশ বসুর মৃত্যুর পর ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ এর পরিচালক পদে যোগ দেন অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু। ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পালিত প্রফেসর’ পদটি খালি হয়। ১৯৩৮ সালে সেই পদে যোগ দেন অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা। পনের বছর পর আবার কলকাতায় ফিরে এলেন সাহা। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের সম্ভাবনা দেখে তার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে সাহার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স পড়ানোর ব্যবস্থা করেন। দেশের প্রথম সাইক্লোট্রন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তিনি। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের গবেষণার জন্য একটি আলাদা ‘ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন সাহা।

কলকাতায় ফিরে আসার পর বিজ্ঞানের পাশাপাশি রাজনীতিতেও কিছুটা উৎসাহিত হয়ে ওঠেন অধ্যাপক সাহা। ১৯৩৮ সালে ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন নেতাজী সুভাষ বসু। ইডেন হিন্দু হোস্টেলে থাকতে সুভাষ বসুর সাথে পরিচয় ছিলো সাহার। কলেজ স্ট্রিটের মেসেও আসা-যাওয়া ছিল সুভাষ বসুর। সাহা তাঁর ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’ জার্নালে প্রবন্ধ লিখলেন ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে। নেতাজী সুভাষ বসু মেঘনাদ সাহাকে অনুরোধ করলেন ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি গড়ে তোলার ব্যাপারে কাজ করার জন্য। কাজ শুরু করলেন মেঘনাদ সাহা। জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা ও শিল্পপতিদের সাথে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে মেঘনাদ সাহার। ১৯৩৯ সালে জাতীয় জ্বালানী নীতিতে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেন মেঘনাদ। জওহর লাল নেহেরু তাঁকে সমর্থন করেন। ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ও দুটো সাব-কমিটির সভাপতি ছিলেন মেঘনাদ সাহা। ‘শিক্ষা’ এবং ‘জ্বালানি ও শক্তি’ উপকমিটির সভাপতি হিসেবে অধ্যাপক সাহা দেশের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা-ব্যবস্থা ও জ্বালানি ও শক্তি সমস্যা সমাধানের বিস্তারিত পরিকল্পনা জাতীয় কমিটিতে পেশ করেন। নৌপরিবহন ও সেচ-প্রকল্পের উপ-কমিটিরও সদস্য ছিলেন মেঘনাদ সাহা। সেচ প্রকল্পের কমিটির সদস্য হিসেবে মেঘনাদ সাহা বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদী শাসনে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর জোর দেন। আমেরিকার টেনেসি নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মত করে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশান গঠন করার জন্য সাহার প্রস্তাব ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে গৃহীত হয়।

কংগ্রেসে সুভাষ বসু ও জওহর লাল নেহেরুর মধ্যে আদর্শগত বিরোধ না থাকলেও পদ্ধতিগত বিরোধ ছিল। সুভাষবসু ছিলেন সরাসরি এবং দ্রুত ফল লাভের পক্ষে, আর নেহেরুর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল অনেক বেশি গান্ধী দ্বারা প্রভাবিত। মেঘনাদ সাহা রাজনৈতিক আচার-ব্যবহারে অভ্যস্ত নন। তিনি রেখে ঢেকে কথা বলতে জানতেন না। যা বলার সরাসরি মুখের উপর বলে দিতেন। গান্ধীর যে নীতি কংগ্রেস মেনে চলতো – যেমন বিদেশী বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বদলে দেশীয় চরকায় সুতো কেটে খদ্দর তৈরি করা – এগুলোর প্রশংসা করা মেঘনাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হয়নি। তিনি সুট-কোট পরাকে অন্যায় মনে করেন নি কখনো। চরকায় সুতো কেটে যে ভারতের উন্নতি ঘটানো যাবে না তা তিনি প্রকাশ্যেই বলতেন। ফলে নেহেরু সহ আরো অনেক কংগ্রেসী নেতার সাথে তাঁর মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। বৃহৎ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার জন্য কংগ্রেসের ধীর নীতির সমালোচনা করে প্রবন্ধ লেখেন মেঘনাদ সাহা তাঁর ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’এর সম্পাদকীয়তে। এসময় পদার্থবিজ্ঞানী হোমি ভাবাও ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পায়নের পরিকল্পনা নিয়ে নেহেরুর সাথে কাজ শুরু করেন। এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে নেহেরু ভাবাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন সাহার চেয়ে বেশি। তবুও নেহেরু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার জন্য এবং সাইক্লোট্রন স্থাপন করার জন্য সাহাকে টাটা ও বিড়লা গোষ্ঠীর কাছ থেকে টাকার ব্যবস্থা করে দেন।

অধ্যাপক লরেঞ্জ এর কাছ থেকে সাহার ছাত্র নাগচৌধুরি সাইক্লোট্রনের কাজ শিখে এসেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইক্লোট্রন প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। তিনি সাইক্লোট্রন স্থাপনের জন্য দোতলা ভবন তৈরি করে দিলেন। নেহেরুর সাহায্যে টাটা শিল্পগোষ্ঠীর কাছ থেকে ষাট হাজার রুপি পাওয়া গেছে। বিড়লা গোষ্ঠীও প্রায় সমপরিমাণ টাকা দিয়েছে। কিন্তু সাইক্লোট্রনের যন্ত্রপাতির যা দাম তাতে এই টাকা খুব সামান্য। তবুও কাজ থেমে থাকলো না। কলকাতায় স্থাপিত হলো ভারতবর্ষের প্রথম সাইক্লোট্রন। এবং তার সাথে প্রতিষ্ঠিত হলো ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর দু’বছর পর ১৯৫০ সালের ১১ই জানুয়ারি নোবেল বিজয়ী নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী আইরিন কুরি ইনস্টিটিউটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। অধ্যাপক সাহা আমৃত্যু পরিচালক ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের। সাহার মৃত্যুর পর এর নাম হয় ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স”।

১৯৪৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন মেঘনাদ সাহা। একই বছর কাল্টিভেশান সেন্টারের দায়িত্বও নেন তিনি। ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত একাডেমি অব সায়েন্সের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে ভারতের প্রতিনিধি হয়ে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রনীতি দেখে মুগ্ধ হন তিনি। সোভিয়েত মডেলকেই তাঁর কাছে শ্রেষ্ঠ মডেল বলে মনে হয়। ১৯৪৭ সালে সোভিয়েত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বই লিখেন ‘মাই এক্সপেরিয়েন্স ইন সোভিয়েত রাশিয়া’।

১৯৪৬ সালের ১০ই মে এটমিক রিসার্চ কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় হোমি ভাবার সভাপতিত্বে। সিদ্ধান্ত হয় ভারত সরকার পারমাণবিক গবেষণাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে এবং এ সংক্রান্ত সব কাজ ও গবেষণা নিয়ন্ত্রিত হবে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। অধ্যাপক সাহা চেয়েছিলেন তাঁর নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ইনস্টিটিউটই হবে সেই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু যখন দেখা গেলো সেই নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে হোমি ভাবার প্রতিষ্ঠা করা বোম্বের ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’-কে ঠিক করা হয়েছে – সাহা ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন। তিনি এর বিরোধিতা করলেন। কিন্তু কোন কাজ হলো না।

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর দেখা গেলো রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণী কোন কমিটিতেই অধ্যাপক সাহাকে রাখা হয়নি। কিন্তু সাহা থেমে থাকেন নি। স্বাধীনতার পর হাজার হাজার শরনার্থীকে পুনর্বাসনের জন্য তিনি ‘বেঙ্গল রিলিফ কমিটি’ গঠন করলেন। ‘সায়েন্স এন্ড কালচারে’ সরকারের কাজের আলোচনা ও সমালোচনা চলতেই থাকলো। হোমি ভাবাকে প্রেসিডেন্ট করে যখন এটমিক এনার্জি কমিশন গঠন করা হলো – সাহা তার তীব্র বিরোধিতা করলেন। তিনি যুক্তি দিলেন দেশে প্রয়োজনীয় পরমাণু-জনশক্তির অভাব যেরকম রয়েছে, তেমনি এখনো কোন সুষ্ঠু শিল্পনীতি গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় পরমাণু শক্তি কমিশন গড়ে তোলার কোন দরকার নেই। সাহার বিরোধিতা কমিশন গঠনে কোন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি বরং সাহা-ই অনেকটা একঘরে হয়ে গেছেন তাঁর সোজাসাপ্টা কথার জন্য।

রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা অনুভব করে সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিলেন অধ্যাপক সাহা ১৯৫১ সালে। কংগ্রেসের রাজনীতির কঠোর সমালোচক তিনি। ১৯৫১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লোকসভার নির্বাচনে দাঁড়ালেন। কংগ্রেসের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে উত্তর-পশ্চিম কলকাতা আসনে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হলেন অধ্যাপক সাহা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লম্বা ছুটি নিলেন। লোকসভায় তিনি সক্রিয় সদস্য হিসেবে ভূমিকা রাখেন শিক্ষায়, শিল্প-নীতিতে, নদী ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে এবং বিশেষ করে পারমাণবিক শক্তি সংক্রান্ত নীতিতে।

১৯৫২ সালে ভারত সরকারের সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ কাউন্সিলের অধীনে পরিচালিত দিনপঞ্জিকা সংস্কার কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক সাহা। সারা ভারতে তিরিশ রকমের ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিল সেই সময়। বিভিন্ন ধর্মের, সংস্কৃতির এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন ছিল এই দিন-পঞ্জিকাগুলোতে। এগুলোকে বিচার বিশ্লেষণ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য প্রমিত দিন-পঞ্জিকা তৈরি করার দুরুহ কাজ সফল ভাবে সম্পাদনা করেছিলেন অধ্যাপক সাহা ও তাঁর কমিটি।

সরকারের যেকোন ভুল-সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে সায়েন্স এন্ড কালচারে সাহার প্রবন্ধ অব্যাহত ভাবে প্রকাশিত হতে থাকলো। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সাহার সমালোচনায় খুব একটা খুশি ছিলেন না। শুধু সমালোচনা করেই থেমে থাকেন নি প্রফেসর সাহা। তিনি নেহেরুকে ব্যক্তিগত ভাবেও চিঠি লিখেছেন অনেক ব্যাপারে। কোন কোন চিঠিতে কারো কারো ব্যাপারে সাহার ব্যক্তিগত মনোভাবও গোপন থাকেনি। যেমন ১৯৫৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী নেহেরুকে লেখা ব্যক্তিগত চিঠিতে প্রফেসর সাহা লিখেছেন, “রামন, ভাটনগর, ভাবা, কৃষ্ণন এরা সবাই কোন না কোন অজুহাতে আপনাকে এড়িয়ে চলেছে। কিন্তু যেই আপনি ক্ষমতায় এলেন সাথে সাথে তারা সবাই মধুর চাঁকে মৌমাছির মত আপনার চারপাশে ঘুরঘুর করতে শুরু করেছে” [21]। একই চিঠির আরেক জায়গায় লিখলেন, “আমাকে একের পর এক অপমানজনক পরিস্থিতিতে ফেলা হচ্ছে। আমাকে ভাটনগরের আদেশ মেনে চলতে হচ্ছে – যে ভাটনগরকে আমি বিজ্ঞানী হিসেবে খুব একটা ভালো বলে মনে করি না। ভাবার আদেশ আমাকে মানতে হচ্ছে – ভাবা যদিও একজন ভাল বিজ্ঞানী – কিন্তু সে আমার চেয়ে আঠারো বছরের ছোট”। এই চিঠিগুলো মেঘনাদ সাহার ব্যক্তিত্বকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দেয়।

কর্মী ও বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার পরিচয়ের তুলনায় ব্যক্তিগত মেঘনাদ অনেকটাই আড়ালে রয়ে যান। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত মেঘনাদ সাহার তৃতীয় কন্যা চিত্রা রায়ের লেখা থেকে মেঘনাদ সাহার কিছুটা ব্যক্তিগত পরিচয় পাওয়া যায় [22]। ১৯১৮ সালে বিক্রমপুরের রাধারাণীর সাথে বিয়ে হয় মেঘনাদের। মেঘনাদের বয়স তখন ২৬, আর রাধারাণীর মাত্র ১৪। মেঘনাদ তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার, ডিএসসি’র থিসিস জমা দিয়েছেন। আর রাধারাণীর পড়াশোনা ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। রাধারাণী ও মেঘনাদের তিনটি ছেলে ও চারটি মেয়ে। বড় ছেলে অজিত পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করে সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের অধ্যাপক ছিলেন (মৃত্যু- ১৯৯১), মেজ ছেলে রঞ্জিত ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বোম্বের টাটা হাইড্রোইলেকট্রিক্‌সে কাজ করতেন (মৃত্যু – ১৯৯৩)। ছোট ছেলে প্রসেনজিৎ – সেন্ট্রাল গ্লাস এন্ড সিরামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডেপুটি ডিরেক্টার ছিলেন। বড় মেয়ে ঊষা পদার্থবিজ্ঞান পড়ার সময় ১৯ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর এমএসসি পাশ করেন। কিন্তু গৃহবধু হিসেবেই জীবন কাটে (মৃত্যু- ১৯৯৭)। দ্বিতীয় মেয়ে কৃষ্ণা – ডাক্তারি পড়ার সময়ে বিশ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর এমবিবিএস পাশ করেন। কিন্তু ডাক্তারি করেন নি কখনো – গৃহবধু হিসেবেই জীবন কাটে তারও। তৃতীয়া কন্যা চিত্রা ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচডি করেছেন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ছোট মেয়ে সংঘমিত্রা দিল্লিতে ইতিহাসের অধ্যাপিকা।

ছেলেমেয়েদের সাথে খুব একটা সহজভাবে মিশতেন না মেঘনাদ। সবসময় একটা দূরত্ব রেখে চলতেন। ছেলেমেয়েদের কিছু বলতে হলে তা স্ত্রীকে বলতেন। দেশের বাইরে যাবার সময় স্ত্রী বা ছেলে-মেয়েদের সাথে নিয়ে যাননি কখনো। শুধু একবার ইউরোপে যাবার সময় বড় ছেলে অজিতকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। মেঘনাদ সাহা নাস্তিক ছিলেন। বাড়িতে কোন পূজার ঘর ছিল না। তবে রাধারাণী ঈশ্বর-বিশ্বাসী ছিলেন। ঘরের কোণে বসে নিজের মত করে ঈশ্বরকে ডাকতেন। ছেলে-মেয়েদেরও কেউ কেউ আস্তিক হয়েছেন। মেঘনাদ খুব মুডি ছিলেন। কখনো মেজাজ ভালো থাকতো, কখনো খারাপ। ফলে কখনো উদার, আবার কখনো খুবই কঠোর। গান-বাজনা শোনা বা গল্পের বই পড়াকে ‘সময় নষ্ট’ বলে মনে করতেন।

অনেক দিন থেকেই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন মেঘনাদ সাহা। শরীরের জন্য বিশ্রামের দরকার হলেও তিনি বিশ্রাম নেন নি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করেছেন। ১৯৫৬ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে প্ল্যানিং কমিটির অফিসে যাবার পথে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান মেঘনাদ সাহা। উপমহাদেশে বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রযুক্তির
উন্নয়নে মেঘনাদ সাহার অবদানের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরদিন।

তথ্যসূত্রঃ
1. S. Rosseland, Theoretical Astrophysics. 1939, U.K.: Oxford University Press.
2. G. Venkatraraman, Saha and His Formula. 1995, Delhi: Sangam Books Ltd.
3. শ্যামল চক্রবর্তী, বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী. ১৯৯৯, কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ
4. Robert S. Anderson, Building scientific institutions in India: Saha and Bhabha. 1975, Montreal: McGill University.
5. প্রদীপ দেব, আইনস্টাইনের কাল. ২০০৬, ঢাকা: মীরা প্রকাশন.
6. Pranab Bandyopadhyay, Great Indian Scientists. 1993, Delhi: Book Club.
7. D. M. Bose, Meghnad Saha Memorial Lecture, 1965. Proceedings of the National Institute of Sciences of India, 1967. 33A(3 & 4): p. 111-132.
8. M. N. Saha, On Maxwell’s stresses. Philosophical Magazine, 1917. 33: p. 256.
9. M. N. Saha, On the limit of interference in the Fabry-Perot interferometer. Physical Review, 1917. 10: p. 782.
10. M. N. Saha, On the dynamics of the electron. Philosophical Magazine, 1918. 36: p. 76.
11. M. N. Saha, On a new theorm in elasticity. Journal of Asiatic Society Bengal, 1918. 14: p. 421.
12. M. N. Saha and S. Chakravarti, On the pressure of light. Journal of Asiatic Society Bengal, 1918. 14: p. 425.
13. M. N. Saha and S. N. Bose, On the influence of the finite volume of molecules on the new equation of state. Philosophical Magazine, 1918. 36: p. 199.
14. M. N. Saha, Radiation Pressure. Astrophysics Journal, 1919. 50: p. 220.
15. M. N. Saha, On selective radiation pressure and problems of the solar atmosphere. Journal of Department of Science Calcutta University,, 1920. 2: p. 51.
16. M. N. Saha, The stationary H and K lines of calcium in stellar atmospheres. Nature, 1921. 107: p. 488.
17. M. N. Saha, Ionization in the solar chromosphere. Philosophical Magazine, 1920. 40: p. 472.
18. M. N. Saha, Versuch einer Theorie der Physikalischen Erscheinungen bei hohen Temperaturen, etc. Z. f. Physik, 1921. 6: p. 40.
19. Santimay Chatterjee, Meghnad Saha – The scientist and the institution builder. Indian Journal of History of Science, 1994. 29(1): p. 99-110.
20. Rajinder Singh, India’s physics and chemistry nobel prize nominators and nominees in colonial and international context. Notes and Records of the Royal Society, 2007. 61: p. 333-345.
21. Abha Sur, Scientism and social justice: Meghnad Saha’s critique of the state of science in India. Historical Studies in the Natural Sciences, 2002. 33(1): p. 87-105.
22. Chitra Roy. Life with Meghnad Saha, http://www.lifestylemac.com/life-with-meghnad-saha. 2011 [cited.