১.
গান শোনা আমার প্রিয় কাজ।
ছেলেবেলায় আমার ঠাকুরদা গান করতেন উঠোনের পেয়ারাগাছের নিচে মাদুর বিছিয়ে। পাড়ার ছেলেমেয়েরা আমার বোনদের সঙ্গে ঠাকুরদার গান গাইত। আর শুনতাম আমাদের পাথুরে কালীবাড়িতে পদাবলী কীর্তন। অষ্টপ্রহর জুড়ে নানা সম্প্রদায় গান করত। সারা বছর জুড়েই বোষ্টমরা আমার মাকে গান শুনিয়ে যেত। তার বিনিয়ে চালকলা। বারুনীতে শোনা যেত নমোশুদ্রদের মতুয়াগান। আর নাম-কীর্তন। এর সঙ্গে আলাই গান। আগমনী গান। জারি গান। সারি গান। কাইজা গানও শুনছি।

বাড়িতে একটা রেডিও ছিল। থাপ্পড় দিলে চলত। আবার থাপ্পড় দিলে বন্ধ হয়ে যেত। তখন শুনতাম বিবিধভারতী। দুপুরে চাষীভাইদের অনুষ্ঠান। ওটা দুপুর একটায়। এরপরই পঞ্চকবির গান। সাড়ে চারটায় শুনতাম গ্রামোফোন রেকর্ডের গান। এর মধ্য পুরাতনী গান আর রম্য গীতি। রেডিও বাংলাদেশ শুনতাম সৈনিক ভাইদের জন্য দুর্বার। বাড়িতে একটা গ্রামোফোন রেকর্ডার ছিল। সেটা ভাঙা। কখনো বাজিয়ে শোনা হয়নি। তবে অসংখ্য রেকর্ড ছিল হিজ মাস্টার্স ভয়েসের। তার গায়ে, প্যাকেটে গান লেখা থাকত। সেগুলো পড়ে আরাম পেতাম।

আর ছিল পূজার সময় মান্নাদের ললিতা। ললিতা আমাদের দেখিয়ে ও ঘাটে জল আনতে যেত। কারো মানা শুনত না। আর জগন্ময় মিত্র চিঠি শুনতে হত হাহকারের মত।
যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি–তখনতো জুতো কেনারই পয়সা ছিল না। তবে ফ্রি গান শোনা যেত হলের টিভিতে। সংগঠনের অনুষ্ঠানে। একতা পত্রিকা ফেরী করে একটা ছোটো ক্যাসেট প্লেয়ার কিনেছিলাম। এই-ই আমার একমাত্র নিজের যন্ত্র। এই সময়ই আমার শিক্ষক আ বা ম নূরুল আনোয়ার জ্যোৎস্না রাতে শোনাতেন ব্রহ্মপুত্রে ডেকে নিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত। ফাহমিদা খাতুনের কাছে শোনা হত–কাদের কুলের বউ গো তুমি। পুরাতনী। আর রাগ সঙ্গীত চেনাতেন নাইবচাচা। এই গান কখনো থেমে নেই।

২. অমর পাল আমার খুব প্রিয় শিল্পী। তার লোক সঙ্গীত আমার সব সময় কানে লেগে থাকে। তাঁর একটা প্রভাত কীর্তন শুনতে শুনতে আমার ভোর হত। অমর পালের আরেকটি প্রিয় গান–আমার সোনার গৌর কেনে কেঁদে এলো কোন অনুরাগে। লিংক। আমাদের রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গাওয়া গান আমার ভাল লাগে। তার গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা শুনে দেখি–অনেকটা অমর পালের আমার সোনার গৌর কেনে কেঁদে এলো গানটির জড়ুয়া ভাই। লিংক
অমর পালের আরেকটি গানটি শুনেছি। গানটি লিখেছেন শেখ ভানু। শেখ ভানুর আর কোনো গান আমি শুনিনি। সুরকারের নামও জানিনা। সে সময় লোক সঙ্গীতের গীতিকাররাই অনেকাংশে সুর দিতেন। তবে পদাবলী কীর্তনের ক্ষেত্রে সুরকার অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় কখনো কখনো। কাজী নজরুল ইসলামই সম্ভবতই শেষ সঙ্গীতকার যিনি গীতিকার এবং সুরকার একই সঙ্গে। এরপরে পেশাদার সুরকাররাই গীতিকারদের বানীতে সুর বসান। এই ধারাই এখন চলছে। অমর পালের গাওয়া গানটির কথাগুলো নিম্নরূপ–
ভানু শেখের গানটি–

শিল্পী : অমর পাল
গীতিকার : শেখ ভানু
————————–
নিশিতে যাইও ফুল বনে
জ্বালাইয়া দিলের বাতি
কত রঙ্গে ধরবে ফুলের কলি রে ভোমরা
নিশিতে যাইও ফুলবনে।।

নয় দরোজা করিয়া বন্ধ
লইও ফুলের গন্ধ,
জপিও ফুলের নাম রে ভোমরা
নিশিতে যাইও ফুলবনে।।

দল পাতা বৃক্ষ নাই
এমন ফুল ফুটাইছে সাঁই,
ভাবুক ছাড়া না বুঝে পণ্ডিতে রে ভোমরা
নিশিতে যাইও ফুলবনে।।

অধিন শেখ ভানু বলে
ঢেউ খেলাইও আপন দিলে রে,
পদ্ম যেমন ভাসবে গঙ্গার জলে রে ভোমরা
নিশিতে যাইও ফুলবনে।।

গানটির শুনতে ক্লিক করুন।

শচীন কর্তার গান শুনে আমাদের পাড়ার হান্নান ভাই দিওয়ানা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি পরীক্ষার পাশ করতে পারতেন না। পড়ালেখা তার মনে থাকত না। তবে শচীন কর্তার সব গান তিনি গাইতে পারতেন। এমন কি শোনো গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি–এই গানটির শোনোগো দখিন হাওয়ার পরে গিটারের ক্রং করে একটা ছোট্ট তানও তিনি হুবহু মনে রাখকে পারতেন। শচীন কর্তার আরেকটি গান তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে সত্তর দশকে বিটিভিতে নজরুল সঙ্গীত নামে গীত হত। আমি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে জেনেছি –গানটির গীতিকার কাজী নজরুল ইসলাম নয়। এটা আজয় ভট্টাচার্যের রচনা।

এরশাদের আমলে শিল্প সাহিত্যের বেশ একটা জোয়ার এসেছিল। মশামাছিও তখন কবিতা লিখত। গান গাইত। নাটক করত। সে সময় একটা প্যারোডি গানের অনুষ্ঠান হয়েছিল ময়মনসিংহে কৃষি বিশ্বিবিদ্যালয়ে। অধম লিখেছিল নিশিতে যাইও ক্যান্টনমেন্টে নামে একটা প্যারোডি গান। নূরুল আনোয়ার স্যার শুনে ডেকে ধমকে দিয়েছিলেন। আর কখনো এই অপকর্ম করতে যাইনি। একটি গীতিকার অকাল মৃত্যু হয়েছিল। শচীন কর্তার গানটি নিম্নরূপ-

জসীমউদ্দিনের রচনা
শিল্পী : এসডি বর্মন
———————

নিশিতে যাইও ফুলবনে
জ্বালাইয়া চান্দেরও বাতি রে
জেগে রব সারা রাতি গো
আমি কব কথা শিশিরের সনে রে ভোমরা
নিশিতে যাইও ফুলবনে।।

যদিবা ঘুমাইয়ে পড়ি
স্বপনেরও পথ ধরি গো
তুমি তুমি নীরবে চরণে যাইও গো রে
নিশিতে যাইও ফুলবনে।।
আমার ডাল যেন ভাঙে না
আমার ফুল যেন ভাঙে না
ফুলের ঘুম যেন ভাঙে না
তুমি তুমি নীরবে চরণে যাইও গো রে
নিশিতে যাইও ফুলবনে।।

ভানু শেখের গানটি সান্ধ্যভাষায় রচিত একটি দেহতত্বের গান। আর শচীন কর্তার গাওযা গানটি লিখেছেন কবি জসীমউদ্দিন। সহজ সরল প্রেমের গান। লিংক । অমর পালের গাওয়া শেখ ভানুর গানটি এবং শচীন কর্তার গাওয়া কবি জসীমউদ্দিনের গানটির ভাষার নিয়ে এক ধরনের ধন্ধ তৈরি হতে পারে। দুটোর সুরই প্রায় এক।

৩.
বড়ো গোলাম আলী খাঁ সাহেবের ক্যা করু সজনী আয়ে না বালাম ঠুমরিটি মাঝে মাঝে শুনি। এটি স্বামী নামে একটি হিন্দি সিনেমায় গীত হয়েছে। গেয়েছেন যেশু দাস। লিংক। পদ্মা তলোয়ারকরও অসাধারণ গেয়েছেন এই ঠুমরিটি। লিংক

বড়ে গোলাম আলী খাঁ সাহেবের আরেকটি ঠুমরী আমাকে আকর্ষণ করে। সাইয়া গেয়ে পরদেশ। লিংক। বেগম আখতারের গোটা দশেক বাংলা রাগ প্রধান গান আছে। রচনা ও সুর জ্ঞানপ্রকাশের। মাঝে মাঝে অনেক রাতে আমি ময়মনসিংহে বেগম আখতার চালিয়ে দিতাম। তিনি সেই গুরু গম্ভীর গলায় গেয়ে উঠতেন–পিয়া ভোলো অভিমান, নিশি রাত বয়ে যায়। আমার ফ্লোরের সবারই ঘুম ভেঙে যেত। সবাই গুটি শুটি এসে জুটত আমার রুমে। এটা দেখে শুনে আমাদের পিয়া আর কখনো অভিমান করে থাকতে পারে নি। সব ক্রেডিট গোস টু বেগম বাখতার। বেগম আখতারের ঠুমরিটির লিংক। এই একই গান শুনেছিলাম পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠে। লিংক
বড়ো গোলাম আলী খাঁ সাহেব করছেন হিন্দিতে ঠুমরিটি। তাঁর বানী আলাদা। কিন্তু বেগম আখতার আর পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী করছেন বাংলায়। বড়ো গোলাম আলীর ঠুমরীর সুর। তবে তার বানী গেছে পাল্টে। অদ্ভুত কাণ্ড।

নূরুল আনোয়ার স্যার এই কাণ্ডটির একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন–বড়ে গোলাম আলী খায়ের পাতিয়ালা ঘরানার এই ঠুমরীটি জ্ঞানপ্রকাশ যখন বাংলায় করলেন তার নাম দেওয়া হল রাগাশ্রয়ী বাংলা গান। সুরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলা কথা। আবার বাংলায় যখন আসছে তখন কিন্তু ধীরে ধীরে পাতিয়ালা ঘরানা অনেকটা পাল্টে যাচ্ছে। বেগম আখতার যখন করছেন, তিনি মূলত হিন্দুস্থানী ঠুমরী গায়িকা, তিনি যখন জ্ঞানপ্রকাশের সুরে বাংলায় গাইছেন–তখন তার গায়কীতে পাতিয়ালার মূল ফ্লেবারটা থাকছে। কথার চেয়ে সুরের প্রতাপ কাজ করছে। কিন্তু অজয় চক্রবর্তী যখন গাইছেন–তখন তা বাংলার বাণীর হাত ধরে মাধুর্য এবং লাবণ্য এসে যাচ্ছে। সেখানে সুর প্রধান নয়–বানী এসে সুরকে মুক্তি দিচ্ছে।
সুরের মুক্তি? খুব কঠিন কঠিন কথাবার্তা। মাথার এদিক দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে যেতে চায়। তার মানে সুরও জেলে যায়। তার মুক্তি হয়। বটে।

৪.
বছর দুএক আগে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে অধম একটি গল্প লিখেছিল। গল্পটির নাম শুয়াচান পাখি। তার এক বছর পরে ডঃ ইউনুস ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে বড়ো গাড্ডায় পড়ে গেলেন। শুয়া চান পাখি শব্দটির অর্জিনাল অর্থ জানার বাসনায় অধম নেত্রকোণার কবি সৌনক দত্ত তনুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তনু মোহনগঞ্জে গায়ক বারী সিদ্দিকির কাছে গেল। তখন সিদ্দিকী সাহেবের তুরীয় অবস্থা। গিলে নিজেই শুয়া চান পাখি হয়ে আকাশে উড়ছেন। তনু বলল, দাদা–এখন জানা সম্ভব নয় জানা। ওস্তাদের ঘোর কাটলে জানা যাবে। বললাম, ভ্রাত:, তাইলে তুমি এখন কি করবা? তুমি মোহনগঞ্জ থিকা নেত্রকোণায় ফিরা যাইবা? তনু বলল, নাগো দাদা। ফিরা যামু না। ফিরা গেলেই ওস্তাদ আবার তুরীয় হবেন। তার চাইয়া আমি ওনার দরোজায় খাড়ায়া আছি– পায়রা দিতাছি। তাইনে যেন আর জিনিসপত্রের নাগাল না পান।
তারপর পরদিন কবি সৌনক অধমকে একটি ইউটিউব ক্লিপ পাঠিয়েছিল। শুনে দেখি–বারী সিদ্দিকী এনটিভি চ্যানেলের গাওয়া গান আছে। সেখানে শুয়া চান পাখির মানে বারী সিদ্দাকী বলছেন–শুয়ে থাকা পাখিকে শুয়া চান পাখি। সেখানে আরেকটা গান মনে টানল। আমার গায়ে যত দুঃখ। লিংক। গাওয়ার গোড়ায় বলছেন বারী সাহেব–এই গানটি তিনি মীরার একটি ভজনের সুর নিয়ে করেছেন। ভজনটির কিছু অংশ তিনি গেয়েওছেন। এইবার কিছুমিছু বোঝা গেল সঙ্গীতের মুক্তির বিষয়টি কি? এগুলো চুরি টুরি জাতীয় নয় তো?

৫.
সনদ পিয়ার লেখা একটি বিখ্যাত ঠুমরী গান ভেঙে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ঠুমরী গান লিখেছেন। মুল ঠুমরীটি গিরিজা দেবী গেয়েছেন। আর রবীন্দ্রনাথের গানটি নীলিমা সেনের গলায় শুনলেও এর মাধুর্য টের পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ এভাবেই বাংলায় ঠুমরীর রসটি সফলভাবে বাঙালির করে রবীন্দ্রনাথ সনদ পিয়ার ঠুমরীটি ভেঙে যখন খেলার সাথী গানটি করলেন, তখন কিন্তু বাঙালি ঠুমরীর আস্বাদটি নিজের করে পেল। ঠুমরী তো এক সময় দরবারী সঙ্গীত ছিল। সেখানে বাঙালির পরিচয় খুব বেশি ছিল না। রবীন্দ্রনাথ যখন এই ঠুমরীর সুরে বাণী বসালেন–দেখেন কী বিষাদ আর হাহাকার আমাদের মনে পৌঁছে দিলেন। ঠুমরীর দরবার মনের প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ল। লিংক।

খেলার সাথি, বিদায়দ্বার খোলো–
এবার বিদায় দাও।
গেল যে খেলার বেলা।।
ডাকিল পথিকে দিকে বিদিকে,
ভাঙিল রে সুখমেলা।।

৬.
আমাদের কুষ্টিয়ার গগন হরকরার আমি কোথায় পাব তারে গানটি অমর পাল করেছেন। গানটি সঙ্গীত শিল্পী গবেষক ডঃ স্বপন বসুও করেছেন। শুনে দেখি–আমি কোথায় পাব’র পরে তিনি রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি গানটি করছেন। দুটো গানেরই অনেক মিল আছে। শুধু কথা আলাদা। লিংক। তবে দুটো গানের স্বরলিপি নিয়ে সূক্ষভাবে দেখলে কিন্তু অনেক পার্থক্য মেলে। তাহলে রবীন্দ্রনাথ কি এই গানটির সুর কি চুরি করেছেন গগন হরকরার কাছ থেকে? জসীমউদ্দিন চুরি করেছেন শেখ ভানুর কাছ থেকে? বেগম আখতার চুরি করেছেন বড়ো গোলাম আলী খাঁর সাহেবের গান থেকে? বারী সিদ্দিকী চুরি করেছেন মীরাজীর কাছ থেকে? এইসব প্রশ্নে বড়ো ধন্ধ পড়ে যাইহে প্রভু।

আমার বন্ধু শিল্পী সুজন চৌধুরী কানাডা থেকে জানালেন–না, এটা চুরি নয়।
অন্যের সুরকে আশ্রয় করে নতুন বাণী বা বন্দিশ বসিয়ে অসংখ্য বাংলা গান আমরা তখন পাই বিশেষ করে রাগ-রাগিনী এবং “প্রচলিত” পল্লীগীতির সুর ভেঙ্গে তৈরী করা, এরই ধারাবাহিকতায় ১টা গান রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা” যেটার সুর গগন হরকরার গানের সুরকে আশ্রয় করে তৈরী করা ( ঐ সুরের স্রষ্ঠা গগন হরকরা এমন কোন প্রমাণও বস্তুত নাই) এবং “আমার সোনার বংলা” গানটির স্বরলিপি যদি আপনি দেখেন বুঝতে পারবেন গগন হরকরার সুর থেকে রবীন্দ্রনাথের সুরটা কতটা আলাদা… রাগকে আশ্রয় করে যখন কোন গান তৈরী হয় সেটাকে আমরা রাগাশ্রয়ী গান বলি, রাগাশ্রয়ে সুরটি যিনি তৈরী করেন সুরটি তার… একইভাবে প্রচলিত পল্লীগীতির সুরের কোন মালিকানা হয় না …. লালনের কয়টা গান তার গুরুর সুরে করা সেটার কোন হিসাব নাই, তাতে লালনগীতির মালিকানা তার গুরুর হয়না লালনেরই থাকে।
ঐ সময়টাতে বাংলায় প্রচলিত রামপ্রসাদি গান, কীর্তনের সবকটা ধারার সুর, কাওয়ালি, জারি সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালিসহ আরো ভারতের বিভিন্ন এলাকার সুর ভেঙ্গে নতুন বাংলা গান তৈরী হয়, সুরগুলো এখনও আমরা বিভিন্নভাবে শুনতে পাই এবং ঐ নতুন সুরের মালিক যিনি সুরটিকে ভাঙলেন তিনি, পূর্ব-প্রচলিত সুরের সুরকার নন।
এই কারণেই “আমার সোনার বাংলা” গানটির সুরকার রবীন্দ্রনাথ, গগন হরকরা নন। স্বরলিপিটি দেখুন গান ২টি পাশাপাশি শুনুন পরিষ্কার বুঝতে পারবেন এটি গগন মণ্ডলের সুরাশ্রয়ী নতুন সুরের গান যেটার মালিকানা যৌক্তিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের।

গান রচনার ইতিহাসটি না জেনে চুরি বলাটা যুক্তুবাদি কম্ম নহে। তাহলে গীতগোবিন্দর কবি জয়দেব, নিধুবাবু, দাশরথী, রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ, গিরীশ চন্দ্র ঘোষ, রজনীকান্ত, কাজী নজরুল, সত্যজিৎ রায়, জসীমউদ্দিন, সলিল চৌধুরী, –মায় সবাইকেই চোর ঠাওরাতে হয়। তার মানে পুরো বাংলা গানকেই চুরির মাল ঘোষণা করতে হয়। হালের এরআর রহমানকেও কাঠগড়ায় তোলা ছাড়া উপায় থাকে না।

৭.
শেষবেলায় বাউল গান নিয়ে কিছু ধার করা বিদ্যে কহে যাই দয়াল বন্ধুগণ।

বাউল সঙ্গীত হল মধ্যবঙ্গের একটি বিশেষ ধরনের লোকগীতি, যাকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভাষায় বলা হয়েছে ‘ ভাটিয়ালি’ সুর। ভাটিয়ালি রাগিণীর কথা চর্যাপদে আছে। উত্তর ভারতীয় ভাটিয়ালির সে-সুরই বাউল সুরের ভিত্তি। কিন্তু এর উপর কীর্ত্তনের প্রভাবও পড়েছে।

বিলেত থেকে ফেরার দশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ কমবেশী স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন পূর্ব বাংলার গ্রামে। সেখানে তিনি বৃহত্তর বাঙালি সমাজের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি কুষ্টিয়ার বাউলদের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বাউলদের সহজ প্রেমের ধর্ম এবং মনের মানুষ তাঁকে যেমন আকৃষ্ট করেছিল, তেমনি আকৃষ্ট করেছিল বাউলদের সরল এবং আবেগপ্রধান সুর। কুষ্টিয়ার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু তিনি বাউল গান লিখতে শুরু করেননি। তিনি তখন অনুভব করেছিলেন রাগরাগিণীর কঠোর কাঠামোর বাইরেও সহজ সুর দিয়ে মনকে আকৃষ্ট করা যায়। এই বিষয়টাকেই তিনি বলেছিলেন সঙ্গীতের মুক্ত বা বন্ধন মুক্তি। বাউল সুর তাকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং ইউরোপীয় সঙ্গীতের নিয়মের বাইরে সৃজনের মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। তিনি বুঝেছিলেন, বাউল সুর হল সঙ্গীতশাস্ত্রের জ্ঞানবর্জিত সাধারণ মানুষের অন্তরের সুর।

শিলাইদহে যাওয়ার প্রায় ১৫ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ বাউল সুরে গান লিখতে শুরু করেন। প্রথম বাউল সুরে লেখেন সেই গানগুলো যে গুলো সাধারণ মানুষ খুব সহজেই বুঝতে পারেন–গাইতে পারেন, গাইলে সংগঠিত হতে পারেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় এই বাউল সুরের গানগুলি লোকের মুখে মুখে ফিরেছে। প্রাণের গান করে নিয়েছে। এর আগে তিনি যে দেশাত্মবোধক গান লিখেছিলেন–সেগুলো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কাঠামো মেনেই লিখেছিলেন। এ গানগুলো আম জনতাকে তেমন আকর্ষণ করেনি, করলেও সময় লেগেছে; যতটা করেছে সঙ্গে সঙ্গে বাউল সুরে তাঁর রচিত গানগুলো।

এই যে দীর্ঘদিন পরে তিনি বাউল সুরে লিখলেন, সেটা কিন্তু তার শ্রুত বাউল সুরের চেয়ে অনেকটাই বদলে গেছে। কি রকম বদলে গেছে–সেটা বলেছেন সুজন চৌধুরী স্বরলিপির পার্থক্য দেখিয়ে। মনে রাখা দরকার যে কোন মহৎ শিল্পেরই একটা সৃজনশীলতা থাকে। এর ভোক্তাকে উদ্বুদ্ধ করে আরেকটি মহৎ শিল্প রচনায়।

বেয়াদবী হইলে ক্ষমা করিবেন।
আমিন।

সূত্র : সচলায়তনের একটি পোস্ট। লিংক