(১)

ফেসবুক বা স্যোশাল নেটওয়ার্কের রাজনৈতিক চর্চাকারীদের মধ্যে বাম বা ডান মনোভাবা সম্পন্ন লোকেদের একবল্গা লজিকের সাথে আমরা কমবেশী সবাই পরিচিত। পার্টিভক্ত অন্ধ, ধর্মান্ধ, তাত্বিক অন্ধ ইত্যাদি ভক্তিভাবের প্রকাশ শুধু বাঙালী না পৃথিবীর সব দেশে, সব সমাজেই দৃশ্যমান। ধর্মে অন্ধ হয়ে বিবর্তনকে অস্বীকার করা বা পার্টিতে অন্ধ হয়ে স্টালিন বা কমিনিউজমের নৃশংস ইতিহাসকে বুর্জোয়া মিডিয়ার ছল বলা, মূলত একই মানসিক ব্যধির দুই পিঠ।

কিছুদিন আগে ব্রেভিককে নিয়ে লিখতে গিয়ে,আমাকে অনেকের কাছেই ব্যখ্যা করতে হয়েছে কেন দক্ষিনপন্থী হিন্দুত্ববাদি বা ইসলামিস্টদের সাথে “বামপন্থী” কমিনিউস্টদের একসারিতে রেখেছি। এদের অনেকেই বামঘেঁসা বা কমিনিউস্ট প্রীতির আঁতুরঘরের গন্ধমাখা লোকজন। এদের বক্তব্য কমিনিউস্টরা যদি খারাপ কিছু করেও থাকে তা মেহনতি মানুষের জন্যেই করেছে। সেখানে ধর্ম শোষক শ্রেনীর সহায়ক ছারা অন্য কিছুত না!

সমস্যা হচ্ছে, যারা সিপিএমের এই ৩৫ বছরের দুস্বপ্নের দিনগুলি পশ্চিম বঙ্গে কাটিয়েছেন, তারা নিশ্চিতভাবেই মানবেন পার্টি এই রাজ্যে শোষক শ্রেনীর শত্রু না, বন্ধুই ছিল। অন্যথা, কিছু সম্ভব ছিল না। হয় ও নি। এটা ত সাম্প্রতিক বাস্তব।

ইতিহাসে তাকালে দেখা যাবে, ধর্ম মাত্রেই প্রতিবাদি আন্দোলন হিসাবে ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে। স্যোশাল জাস্টিস এবং ইনজাস্টিস সব কিছুই হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মগ্রন্থগুলির উপপাদ্য। আমেরিকার রিপাবলিকান বা টি পার্টি ছারা আর কোন সামাজিক আন্দোলন বা আদর্শবাদ আমার জানা নেই যা গরীব দরদি না। বস্তত ধর্ম গ্রন্থগুলির মধ্যে ধর্মীয় সমাজতন্ত্রের বা ভাববাদি সমাজতন্ত্রের ছোঁয়া সব সময় ছিল-এবং তার পরেও তারা শাসক শ্রেনীয় সহায়ক হিসাবেই আবির্ভূত। মার্ক্স কথিত বস্তুবাদি সমাজতন্ত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি-লেনিনিজম সব থেকে কুখ্যত শাসক এবং অত্যাচারীদেরই জন্মদাত্রী। এবং একটু ভাবলে দেখা যাবে, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরনের জন্যে এমনটা হওয়ারই কথা।
এই নিয়েও আগেই বিস্তারিত লিখেছি-কিভাবে একটি বাম আন্দোলন আস্তে আস্তে দক্ষিন পন্থী আন্দোলনে ইউ টার্ন নিয়ে থাকে ( যা ধর্ম, লেনিনবাদ , মাওবাদ সবার জন্যেই প্রযোজ্য )।

(২)

আমি এই প্রবন্ধ লিখছি সম্পূর্ন অন্য কারনে। বহুদিন থেকেই দেখছিলাম, কমিনিউস্টরা কমিনিউস্ট ইতিহাসের সব নির্মম দিক নিয়ে গর্ব করে। সাঁইবাড়ির খুনী থেকে স্টালিনের খুন গুলিকে এরা শ্রেণীযুদ্ধে ” প্রয়োজনীয়” মনে করে। এবং এটাই পার্টি লাইন।

সমস্যার শুরু এখান থেকেই। কারন এদের মতবাদ বা কমিনিউজমের শাস্বত মতবাদ হচ্ছে কমিনিউজমই আসল
মানবতাবাদ। মার্ক্স ব্যাপারটাকে এভাবে লিখেছিলেনঃ

“… communism, as fully developed naturalism, equals humanism, and as fully developed humanism equals naturalism; it is the genuine resolution of the conflict between man and nature and between man and man – the true resolution of the strife between existence and essence, between objectification and self-confirmation, between freedom and necessity, between the individual and the species. Communism is the riddle of history solved, and it knows itself to be this solution”..

কমিনিউজমের উৎস সন্ধানে, বা মানুষ কেন কমিনিউস্ট হতে চায়, তার মূলে ঢুকতে গেলে, এই বাক্যটির গুরুত্ব অপরিসীম।

কারন যারা কমিনিউজমের বিশ্বাস করে, তারা মনে করে কমিনিউজমই হচ্ছে একমাত্র রাজনৈতিক আদর্শবাদ যা মানুষের সাথে মানুষের, মানুষের সাথে প্রকৃতির, অস্তিত্বের সাথে প্রয়োজনীয়তার, স্বাধীনতার সাথে প্রয়োজনীয়তার, ব্যাক্তির সাথে প্রজাতির দ্বন্দের অবসান ঘটাতে সক্ষম। এবং কমিনিউজম হচ্ছে সেই প্রাকৃতিক দর্শন ( যা প্রকৃতি বিজ্ঞানকে অনুসরণ করে আসে)।

কমিনিউস্টরা ধর্মীয় বা ব্যক্তি স্বতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে যে মানবতার সংজ্ঞা তাতে “বিশ্বাস” করে না। মানুষ তাদের কাছে সমাজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। লুইস আলথুজার নামে একজন ফ্রেঞ্চ স্ট্রাকচারালিস্ট ( যিনি একজন অন্ধ স্টালিন ভক্ত ছিলেন), বুর্জোয়া দের দেওয়া মানবতার সংজ্ঞাকে ( অর্থাৎ সবার ওপর মানুষ সত্য ) মানবিক বিভ্রম বলে আখ্যায়িত করেছেন!

“humanism” means the illusion that individual human beings are autonomous, thinking subjects, whereas for structuralists (and poststructuralists), individual human beings are nothing but unconscious agents of structural forces, in much the same way as organisms are agents for the spread of a disease. Thus structuralists associate humanism with a naive and unproblematic conceptions of language and consciousness, and illusory belief in the autonomy of human beings.

অর্থাৎ হে কমিনিউস্ট বৃন্দ- বর্তমান সমাজের মানবিকতার ব্যখাতে ভুলিও না-কমিনিউজমের সেই সোনার ম্যাজিক বলই আসল মানবিকতা! সাঁইবাড়ির প্রনব সাঁই বা ষষ্টি দুলেদের কুপিয়ে কাটা সেই মহান মানবিক সমাজের প্রতিষ্ঠার জন্যেই দরকার!

(৩)

আলথুজারকে নিয়ে চিন্তা নেই-ভদ্রলোক বিজ্ঞানের দর্শন বিশেষ কিছু বুঝতেন না। যা লিখেছেন, তা বিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক দার্শনিকদের চোখে বালখিল্যই হবে। এই প্রবন্ধ লেখা এই কারনে, যে মার্ক্সের ওই মারাত্মক দাবি-কমিনিউজম হচ্ছে সকল বিভেদের সমাধান, সেটা কতটা বালখিল্যতা বা হাস্যকর তা বিচার করা।

প্রথমেই বিশ্লেষণ করা দরকার বিভেদ কেন?

মার্ক্সত, ইয়ে মানে হেভিওয়েট দার্শনিক। তার একবাক্যের ওজন চোদ্দমন। সাধারন মাথাতে ঢোকাতে গেলে কিলোতে ঢোকানোই ভাল। উনার দাবীগুলিকে ১, ২, ৩…এইভাবে ভাংলে গোঁজামিল, বা যুক্তির বৃত্তীয় ভুল খুব সহজে ধরা যাবে,

উনার প্রথম দাবী-কমিনিউজম একধরনের ন্যাচারালাজিজম বা প্রাকৃতিক দর্শন। যেসব দর্শন ভাবে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে যাবতীয় প্রশ্নের মিমাংসা করা যায়, তাদের বলে প্রাকৃতিক দর্শন। প্রথম দাবীটিই ভুল। কমিনিউজম বিজ্ঞানের দর্শনের প্রথম ধাপ-ফলসিফিকেশন উপপাদ্যটিই মানে না। ফলসিফিকেশনের সাদামাটা মানে আ) সব তত্ত্বই ভুল হতে পারে ক) তাই সব তত্ত্বের বাতিলযোগ্যতার পরীক্ষা দরকার। মার্ক্সীয় বিপ্লবের তত্ত্ব সর্বত্রই ভুল প্রমাণিত-তবুও কমিনিউস্টদের চোখে তা বাতিলযোগ্য না! এটি বহুচর্চিত -স্যার কার্ল পপার এবং মার্ক্সীয় অপবিজ্ঞান নিয়ে আগে অনেক লিখেছি।

এরপরে যদি ধরেও নিই, কমিনিউজম বিজ্ঞানভব (!), তারপরে রাউন্ড টুতে প্রশ্ন আসবে, মানুষে মানুষে বিভেদের কি কোন বৈজ্ঞানিক সূত্র -বা কার্য কারন সূত্র সম্ভব?

খুব সহজ ব্যপার। বাইরে চোখ রাখুন-দেখবেন দুজন পুরুষ মারামারি করে মূলত সম্পদ এবং নারীর অধিকার নিয়ে। “শ্রেণী” যুদ্ধের একমাত্র কারন না-নারী, জাতি, প্রজাতি-আরো অনেক কিছুই বিবাদের কারন হতে পারে। এই জটিল সিস্টেমকে কোন বৈজ্ঞানিক সূত্রে বাঁধা সম্ভব না।

আরেকটা উদাহরন দিচ্ছি। পাওলি দাম নামে এক বাঙালী “মেইনস্ট্রুম” অভিনেত্রী, ছত্রাক নামে এক সিনেমাতে সম্পূর্ন নগ্ন শয্যদৃশ্যে অভিনয় করে বেশ সামাজিক ঝড় তুলেছেন। রক্ষণশীল বনাম প্রগতিশীল বাঙালীরা দ্বিধাভিকক্ত।

কে ঠিক? এর বিচারে কোন বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদ চলে না। কারন পাওলি দাম নগ্ন হয়ে ঠিক করেছেন না ভুল করেছেন, তার ফলসিফিকেশন সম্ভব না। কারন এটা ব্যক্তিগত রুচির প্রশ্ন। অর্থাৎ এই বিভেদের মূলে যেতে “একক” কোন বৈজ্ঞানিক সূত্র ব্যর্থ।

আরো উদাহরণ দিচ্ছি। ধরা যাক কমিনিউজম এসেই গেল। কিন্ত তার মানে ত এই নয় রক্তমাংসের মানুষগুলো সব রোবট হয়ে গেল। তখন কমিনিউস্ট সমাজে যদি একজন সুন্দরী মেয়েকে দশজনের ভাল লাগে, তাহলে কি হবে? তাহলে দশজনের মধ্যে গন্ডোগলের সম্ভাবনা নেই? নাকি কমিনিউজমে সাম্যবাদের সূত্র মেনে দশপুরুষই নারীটিকে ভোগ করবে? বা “কমিউন” ম্যারেজ চালু হবে? মানে দশটা পুরুষ দশটা নারীকে বিয়ে করবে! তাতেও কি গন্ডোগল কমবে বলে মনে হয়?

মোদ্দা কথা এমন এক জটিল সামাজিক সিস্টেমের কোন বৈজ্ঞানিক সূত্র হয় না। সেখানে সমাজের কার্যকারন সব বুঝিয়াছি এবং তার বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিস্কার করিয়াছি এমন দাবী বেশ বালখিল্যতাই বটে।

এবার আসি রাউন্ড তিনে। মার্ক্স আরো দাবী করছেন, কমিনিউজম মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য এবং বিধেয়র মধ্যে বিভেদ মেটাবে। এটা সত্যই আরো বড় গোলা।

জীবনের উদ্দেশ্য কি এই প্রশ্নটা যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানের বাইরে। যদি ধরে নেওয়া যায়, জীবনে উদ্দেশ্য বিজ্ঞান দিয়ে ব্যখ্যা করা যায়, অর্থাৎ জেনেটিক সারভাইভালই আমাদের উদ্দেশ্য, তাহলে বিজ্ঞান কিন্ত মানব সমাজ এবং মানবতার অনেক কিছুই ব্যখ্যা করতে পারবে না। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখি যদি, দুই সন্তানের মধ্যে একজন পঙ্গু হয়ে জন্মায়, মা কিন্ত পঙ্গু সন্তানকেই বেশী যত্ন করে যদিও এটা জেনেই যে সে প্রজননে অক্ষম। আলট্রুইজম বা উপকারিতা বেঁচে থাকার উপায় বটে কিন্ত অনেক ধরনের আলট্রুইজম বা উপকারীতার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যাই সম্ভব না। এটা ঠিক যে জীবনের উদ্দেশ্যের ৯০% জীববিজ্ঞানদিয়ে ব্যখ্যা করা যায়-কিন্ত যে সন্নাসী হতে চাইছে-তার ব্যখ্যা কি? অনেক দম্পতিই আজকাল চাইল্ডলেস বাই চয়েস থাকছে-তার পেছনেই বা কি যুক্তি?

তাদের জীবনের উদ্দেশ্যকি ভুল যেহেতু তা “ন্যাচারালাজিম” না???

যে ড্রাগ, নারী আসক্ত হয়ে জীবন কাটাচ্ছে সেও কি ভুল?

এই ঠিক বা ভুলের মাপকাঠি কি করে ঠিক করবে? আর ৫০০ মিলিয়ান বছর বাদে সৌর জগত সম্পূর্ন ধ্বংস হবে-আরো সূদূরে এই মহাবিশ্ব সংকুচিত হতে হতে, আবার বিন্দুতেই শেষ হবে। সুতরাং কে কি করল, তাতে মহাবিশ্বের ইতিহাস বদলাচ্ছে না। জীবনটা সাময়িক,সময়ের খুব ক্ষুদ্র স্কেলে করা জ্যাঠামি। কে সন্নাসী হয়ে কাটাল, কে পরকিয়া করে কাটাল-কে বেশ্যাগৃহে কাটাল-তাতে মানুষ এবং মহাবিশ্বের ভবিষ্যত কিছুই বদলাবে না।

সুতরাং ঘুরেফিরে আমরা সেই বৃত্তেই ফিরে আসি-সেখানে মানুষই একমাত্র সত্য। মানুষের হাতে তৈরী ধর্ম বিজ্ঞান কমিনিউজম, ক্যাপিটালিজম কোন তত্ত্বই মানুষের থেকে বড় হতে পারে না। অন্তিম বিচারে এর সবকিছুর ওপরেই মানবতার জয় ঘোষিত হবেই। সুতরাং কোন আদর্শবাদের দোহাই দিয়ে অমানবিক কোন কাজই সমর্থনযোগ্য না-এবং তা সব থেকে বড় অশিক্ষার ও কুশিক্ষার পরিচয়।