মানুষ যে কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের ফল এ বিষয়ে এ বিষয়টি আজকের পৃথিবীতে প্রমাণিত প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু ‘‘মানুষের কি এখনো বিবর্তন হচ্ছে?’’- এই প্রশ্নটি সকল মানুষের কাছে এক বড় প্রশ্ন। ডঃ এলিস রবার্টস তার ‘‘Are we still evolving?’’ ডকুমেন্টারিতে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজার চেষ্ঠা করেছেন। ডঃ এলিস জানতে চেষ্ঠা করেছেন-বতর্মান সভ্যতার সংস্কৃতিগত, প্রযুক্তিগত ও চিকিৎসার উৎকর্ষতার ফলে মানুষ যেভাবে প্রাকৃতির উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করেছে তা কি মানুষকে ডারউইন বণির্ত প্রাকৃতিক নিবার্চন প্রক্রিয়া এড়াতে সাহায্য করার মাধ্যমে মানুষের বিবর্তন প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিচ্ছে? সেই সাথে তিনি আমাদের এই প্রজাতির বিবর্তনের ভবিষ্যতই বা কি হতে পারে তাও জানতে চেষ্ঠা করেছেন।

ডঃ এলিসের ‘‘Are we still evolving?’’ ডকুমেন্টারিটি তৈরি হয়েছে অনেকগুলো ইন্টারভিউয়ের সমন্বয়ে। ডকুমেন্টারিটিতে প্রথম ভাগে তিনি প্রাকৃতিক নিবার্চন প্রক্রিয়ার ফলে কিভাবে নতুন প্রজাতির উদ্ভব হতে পারে ও মানুষের বিবর্তন হয় তা তুলে ধরেন। পরিবতির্ত অবস্থায় কত দ্রুত নতুন প্রজাতির উদ্ভব হতে পারে তা দেখাতে তিনি উপস্থাপন করেন ডাবির্সায়ারের এক কপার ফিল্ডের এক নতুন প্রজাতি কেঁচো, যেগুলো মাত্র ১৭০ বছরে মধ্যে নতুন প্রজাতিতে রুপান্তর হয়ে আর্সেনিকযুক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকার যোগ্যতা অর্জন করেছে।

ডকুমেন্টারিটিতে পরবর্তি ভাগে তিনি বর্তমানে কিভাবে মানুষের বিবতির্ত হচ্ছে তা তুলে ধরার সাথে সাথে ভবিষ্যত বিবর্তনের গতি কি হতে পারে তাও তুলে ধরার চেষ্ঠা করেছেন। ডঃ এলিসের সাথে ইউনিভার্সিট কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ষ্টিভ জোনসের(Steve Jones) ইন্টারভিউতে জোনস এই মত প্রকাশ করেন যে ,”প্রযুক্তিগত ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উৎকর্ষতার ফলে মানুষের বিবর্তন পেছেনে প্রাকৃতিক নিবার্চনের প্রভাব একদম বন্ধ হয়ে না গেলেও এর প্রভাব কমে এসেছে।” এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে তিনি সেক্সপিয়ারের সময়কার ইংল্যান্ডের শিশু মৃত্যুর হারের সাথে বর্তমান সময়ের শিশু মৃত্যুর হারের তুলনা করে দেখিয়েছেন। সেক্সপিয়ারের সময় যেখানে ৩ জন শিশুর ২ জন ২১শে পৌছান আগেই মারা যেত। আর এর পিছনে কারণ হিসেবে ছিলো নেচারেল সিলেকশন ও তাদের বহণকৃ্ত জীণ।অন্যদিকে বতর্মানের ৯৯% শিশু ২১ শে পৌছাচ্ছে।

জীববিজ্ঞানী ষ্টিফেন ষ্টিয়ার্ন্সের (Stephen Stearns) ফার্মিংহামের (Framingham, Massachusetts) অধিবাসীদের উপর পরিচালিত তার দীর্ঘ মেয়াদী গবেষনার আলোকে দেখিয়েছেন-মানুষ এখনও বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তার মতে মানুষ তার প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন আনছে সে পরিবর্তনই তার বিবর্তন তরান্বিত করছে।এই বিবর্তন দ্রুত হচ্ছে যখন আমরা আমাদের প্রাকৃতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটাচ্ছি। আর সংস্কৃতিই হচ্ছে প্রকৃতির সবচেয়ে বড় অংশ যার দ্রুত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে মানুষ এবং সংস্কৃতিই আমাদের বিবির্তনের পেছনে অনেক বড় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু আমাদের চোখে এই বিবর্তন তেমনভাবে ধরা পড়ছে না কারণ আমরা এই মুহুর্তে এই বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে আটকে আছি। ষ্টিফেন ষ্টিয়ার্নের ভাষায়-

The direction of our future evolution is likely to be driven as much by us as by nature. It may be less dependent on how the world changes us, but ever more so on our growing ability to change the world.

মানব সভ্যতার এই পর্যায়ে, বিবর্তনের প্রক্রিয়া এক নতুন মোড় নিচ্ছে। আক্ষরিক অর্থে মানুষ তার জেনেটিক ভবিষ্যত নিজেই লিখছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কতদূর এগিয়ে গেছে তার নিদর্শন পাওয়া যায় লস এঞ্জেলাসে ডঃ জেফ স্টাইনবার্গের সাথে ডঃ এলিসের কথোপকথোন থেকে। প্রসংগ ক্রমে বলে রাখা ভালো ১৯৭৮ সালে ডঃ জেফ স্টাইনবার্গের হাতে প্রথম টেষ্ট টিউব বেবির সৃষ্টি হয়। এখন তিনি সান্তান গ্রহণে ইচ্ছুক যুগলদের তাদের অনাগত সন্তানের ডিজাইন করতে সাহায্য করছে। ডকুমেন্টারির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশে ডঃ স্টাইনবার্গের বায়োপ্সির মাধ্যমে কিভাবে একটি এম্ব্রিয় থেকে সেল অপসারনের মাধ্যমে ভবিষ্যত শিশুদের জেনেটিক পরিবর্তন সাধন করেন তা দর্শকদের কাছে তুলে ধরেন। এভাবে এম্ব্রিয় বায়োপ্সির মাধ্যমে তিনি এম্ব্রিয় থেকে জেনেটিক রোগাক্রান্ত সেল অপসারন করতে পারেন, নির্ধারন করে দিতে পারেন তাদের সেক্সও সহ তাদের চোখ ও চুলের রঙ পর্যন্ত। ডঃ স্টাইনবার্গ আশা ব্যক্ত করেন- খুব শিঘ্রই বিজ্ঞানিরা জীনের কোন অংশটি মানুষের মেধার নির্ধারণ করে তা সনাক্ত করে তাকে পরিবর্তন করার মাধ্যমে ভবিষ্যত মানুষকে মেধাবি করতে ভূমিকা রাখতে পারবে। তিনি মনে করেন মানুষের ভবিষ্যত বিবর্তনে এই প্রক্রিয়া এক বড় ভূমিকা রাখবে।

ডকুমেন্টারির একদম শেষ ভাগে ডঃ এলিস রবার্ট ভবিষ্যত বিবর্তনের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে তার মতামত দেন। তার মতে- ”যদিও এই পর্যায়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর উন্নতির ক্ষেত্রে টেকনোলজিকাল ও নৈতিক অনেক বাধা রয়েছে, কিন্তু তার পরও বলা যায় আমাদের জিনম পরিবর্তনের এই সক্ষমতা আমাদের ভবিষ্যত বিবর্তণের পেছনে বড় ভূমিকা রাখবে এবং এটা আমাদের প্রজাতির বিবর্তনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটা স্পষ্ট যে প্রাণের উদ্ভবের পর থেকে আমাদের বিবর্তন কখনো বন্ধ থাকে নি। কিন্তু এই বিবর্তন কি হবে তা নির্ভর করে কিভাবে আমাদের পৃথিবী পরিবর্তন হচ্ছে বা আমরা আমাদের পৃথিবীকে কিভাবে পরিবর্তন করছি তার উপর। আর এখন পৃথিবী যে ভাবে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে সেভাবে কখনই পরিবর্তন হয় নি; আর এর মানে আমাদের বিবর্তনও সম্ভবত হচ্ছে অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক দ্রুত। কে জানে আমাদের এই বিবর্তন আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে!! কিন্তু সুদূর ভবিষ্যতে একটা ব্যাপার এড়ানো যাবে আর তা হচ্ছে- আমাদের এই পৃথিবী নাটকিয়ভাবে পরিবর্তন হবে। আর এটা যখন হবে তখন দুটো জিনিস ঘটতে পারে-
১) হয় আমাদের এই প্রজাতির ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হবে
২) না হয় আমাদের মৃত্যু ঘটবে, অর্থ্যাৎ প্রজাতি হিসেবে মানুষের বিলুপ্তি ঘটবে।

আমরা যেমন প্রাণের বিবর্তনের কোন সর্বোৎকৃষ্ট রুপ নই তেমনি নই এর শেষ বিন্দু, আমরা শুধুমাত্র পৃথিবীতে প্রাণের যাত্রার অংশ মাত্র। এবং প্রাণের বিবর্তন সেই পর্যন্ত চলতে থাকবে যতক্ষণ না এই গ্রহ প্রাণের বিকাশে সহায়তা করে যাবে। আমাদের প্রজাতি ট্রি অব নামক বিশাল বৃক্ষটির একটি ক্ষুদ্র পল্লব মাত্র। আর এই পল্লবটি এখনও বেড়ে চলছে- চলছে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। আর আমি একথা মনে করি না এর পূর্ণাংগ বিকাশ হয়ে গেছে।

ইংলেন্ডের কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি থেকে মেডিসিন ও এনাটমিতে পড়াশুনা করা ডঃ এলিস রবার্টস NHS এর Severn Deanery School of Surgery তে ডাইরেক্টর অব এনাটমি হিসেবে নিযুক্ত আছেন। ডঃ এলিস রবার্টসের তৈরি উল্লেখ যোগ্য ডকুমেন্টারির মধ্যে আছে- Don’t Die Young, The Incredible Human Journey, Wild Swimming। ডঃ এলিস রবার্টস সম্পর্কে আরো জানতে ভিজিট করতে পারেন তার ওয়েব সাইট- http://www.alice-roberts.co.uk/index.html

‘‘Are we still evolving’’ ডকুমেন্টারিটির লিংক-(part 1,3 & 4)

http://www.youtube.com/watch?v=CkxuMX9iIq0

part-2