গত ৯ জুন ২০১১ আমরা ভ্রমণের জন্য নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। আমি আমার পরিবারসহ ধানমন্ডি থেকে কমলাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেই এবং রাত ৭:৫০টার মধ্যে পৌছে যাই।কমলাপুর থেকে আমরা দীনাজপুরের শোভন চেয়ারে (ফাস্ট ক্লাস) যাবো। সময় সীমিত বলে দ্রুত স্টেশনে কর্তব্যরত তথ্যকেন্দ্রে জানতে চাইলাম ট্রেন কি যথাসময়েই ছাড়বে। কারণ আমাদের দেশের ট্রেনের সময় জ্ঞান আগেও দেখেছি।তথ্যকেন্দ্র থেকে নিশ্চিতভাবে বলল হ্যা, আপনি ট্রেনে উঠে যান।এরই মধ্যে দলের একজন চলে আসলেও বাকীরা সপরিবারে পৌছাতে পারেনি প্রচণ্ড জ্যামের কারণে। টেনশনে ফোনে যোগাযোগ করতে লাগলাম এবং আবারো তথ্যকেন্দ্রে গিয়ে যোগাযোগ করলাম। তারা প্রশ্ন করে উঠলেন আপনি এখনও উঠেন নাই, ট্রেনতো ছেড়ে দিবে। কী আর করা ৩নং প্লাটফর্মে গিয়ে নির্ধারিত ট্রেন দ্রুতযানে উঠে গেলাম। আমাদের দলের মধ্যে ছিলাম আমি ও আমার ভাই পরবিারসহ এবং নারায়ণগঞ্জের একজন ফটোসাংবাদিক।

একসময় মনে হল ভাইাদের নিয়ে মনে হয় আর যাওয়া হবে না।ক্রমাগত ফোন করে যেতে লাগলাম।৮:০০টার সময় দেখলাম ওরা রীতিমতো দৌড়ে আসছে প্রচণ্ড উতকণ্ঠায় ওদের অবস্থাও নাকাল। যাই হোক এবার অন্তত নিশ্চিত হওয়া গেল। আমরা দুটো কামরায় প্রথম শ্রেণিতে সিট পেয়েছি। কামরা এবং সিটগুলোর অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন অবস্থা দেখে দলের একজনের মনের অবস্থা খুবই খারাপ। কারণ তার এটাই প্রথম ট্রেন ভ্রমণ। এরপর যেই ট্রেন ছাড়ার কথা ছিল ৭:৫০-এ তা ছাড়ল ৮:৫০টায়। এই হল আমাদের যথাসময়ে ট্রেন ছাড়ার অবস্থা। যাই হোক দ্রুতযান ছেড়েছে এটাই বড় বিষয়। আমাদের চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি।বাচ্চারা খেলতে শুরু করল আনন্দে। ইতোমধ্যে জানলাম বিরোধী দল হরতাল ডেকেছে ১২ এবং ১৩ জুন। এর মানে ১১জুন রাতে যেভাবেই হোক আমাদের ফিরে আসতে হবে।

যখন ট্রেন এয়ারপোর্ট স্টেশনে থামলো মুহুর্তেই সকল সিট ভরে অনেককেই দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম। এরপর টঙ্গী স্টেশন থেকে আরো যাত্রী, ট্রেনে এখন তিল ধরার স্থান নেই। যত না সিট তার চারগুণ যাত্রী, সকলেই সারারাত কী করে দাড়িয়ে যাবে তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। কীসের খাওয়া কীসের ঘুম? শুরু হল নানা মানুষের নানা ধরণের বাক-বিতণ্ডা। আমাদের সিটের পাশে একটি যুবক দল দাড়িয়ে গেল এবং আমাদের সিটের উপর ঝুকে আপত্তিকর ভঙ্গীতে এমন উচ্চস্বরে আড্ডা দিতে লাগল যে বাধ্য হয়ে প্রতিবাদ করে উঠছিলাম। যদিও তাতে কোনো কাজ হচ্ছিল না এমন বিরূপ পরিবেশে।এত মানুষের ভিড়ে আমাদের পাশের কামড়ার দুজনের সাথেও যোগাযোগ করতে পারলাম না। কারণ ভিড় সামলাতে না পেরে কতৃপক্ষ কামড়ার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এমন এক অবস্থা খাওয়ার পানি নেই, কিন্তূ কেনারও কোনো উপায় নেই। প্রচণ্ড ভীরে যুবা-বৃদ্ধ-নারী সকলেই দাড়িয়ে রাত কাটাল। নির্ঘুম রাতে ভাবতে লাগলাম এই হল আমাদের ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা, আর যাই হোক ফেরার সময় বাসে ফিরবো। আর অপেক্ষায় থাকলাম কখন পার্বতীপুর স্টেশনে পৌছাবো। সকাল ৬:০০টায় পৌছানোর কথা থাকলেও আমরা সকাল ৮:০০টায় পৌছালাম।

ট্রেন থেকে মনে হল আমরা এক সবুজ গালিচার রাজ্যে এসেছি। শুধু বিস্তীর্ণ সবুজ আর সমভূমি। আমরা পার্বতীপুর থেকে সৈয়দপুর রেলওয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বাংলোতে গিয়ে উঠলাম। তার পরিবারের আতিথেয়তায় এবং তার তত্ত্বাবধানে আমরা দীনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, রামসাগর, সৈয়দপুরের জীর্ণকায় ধ্বংসের মুখে চলে আসা রেলওয়ে ওার্কশপ, পার্বতীপুরের অত্বাধুনিক রেলওয়ে ওয়ার্কশপ, হাজার মানুষের অমানুষিক শ্রমের দৃশ্য স্বচক্ষে দেখা এবং বড়পুকুরিয়ার খনি থেকে কয়লার উত্তোলন ও প্রক্রিয়াকরণ দেখে দুদিন সময় কীভাবে পার হয়ে গেল টেরই পেলাম না। আসার পথে ট্রেনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলার পর তিনি বললেন ফেরার পথের ট্রেন ভালো এবং হরতাল বিধায় ট্রেনেই যাওয়া ভালো।
দলের সকলের মতে আবারো ট্রেন ভ্রমণ এবং আমরা ১১জুন রাত ১১টায় যেয়ে সৈয়দপুর স্টেশনে আন্তনগর ট্রেন নীল সাগর-এর অপেক্ষায় রইলাম। ১১:৩০টায় ট্রেন ছাড়ল সকলের কাছে বিদায় নিয়ে আসার সময় মনে হচ্ছিল এত অল্প সময়ে এত মায়া আর ভালোবাসা পাওয়া সত্যিই অসম্ভব। আর আমাদের ঢাকা শহরেতো বিরল।এই ট্রেনটি যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন এবং আধুনিক যেমনটি দেখেছিলাম ওার্কশপে। মনটা ভালো হয়ে গেল, আমরা ফার্স্ট ক্লাসে একসাথেই আটটি আসনে বসলাম। আমরা ভীষন খুশিতে চা-খেয়ে গল্প জুড়ে দিলাম। নীল সাগর দ্রুত গতিতে ছুটে চলল। এরই মধ্যে আমরা একটি স্টেশন পার হলাম। সম্ভবত ফুলবাড়ি, আবারও সেই ভিড়ের তোড়। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেনটা আবারও একটা স্টেশনে থামল বলে মনে হল। আর মুহুর্তের মধ্যে আমাদের কামড়ায় ৪০-৫০জন লোক উঠে পড়ল যার অধিকাংশই মধ্যবয়স্ক নারী। যাদের পুরো শরীর কিছু একটা দিয়ে মোড়ানো। এরই মধ্যে অনভিজ্ঞ একজন বলে উঠল তারা অন্তসত্ত্বা কি না। আমি ততক্ষণে বুঝে গেলাম আমরা বহুল আলোচিত সীমান্ত এলাকা হিলি পার হচ্ছি। আর প্রতিটি নারীর শরীরই চোরাচালানের জিনিস দিয়ে পেচানো এবং চাহনীতে তাদের ভীষণ উৎকণ্ঠা। তাদের সাথে সহোযোগী হিসেবে কিছু যুবক আছে যাদের নেতৃত্বে তারা চলছে এবং তারা সিটের ফাকে ফাকে বসে যাচ্ছে। আমি কোনো রিস্ক নিতে চাইলাম না এবং কোনোভাবেই তাদের আমাদের কাছে-ধারে বসতে দিতে চাইলাম না। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূলে, কিছুই করার নেই। রাত তখন একটা হঠাৎ দুজন বিডিআর আমাদের কামড়ায় উঠল।মুহুর্তেই যেন উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা বেড়ে গেল।কিছু বুঝে উঠার আগেই বিডিআর দুজন চোরাই মাল বহনকারী নারীদুজনকে টেনে হিচরে নিয়ে যেতে লাগল, তারাও নাছোড় বান্দা কোনভাবেই আত্মসমর্পন করবে না। এরই মধ্যে বিডিআরদের পা জড়িয়ে ক্ষমা চাইছে।সীমান্ত প্রহরীরা তাদের টানতে টানতে কামরার আরেক প্রান্তে নিয়ে যেতে লাগল এবং দেহ তল্লাশী করতে লাগল। একসময় প্রায় বিবস্র অবস্থা করে, অশ্লীল গালাগালি করে তাদের শরীর থেকে পেকেটগুলো বের করে নিল। অধিকাংশ যাত্রীই এ দৃশ্য উপভোগ করছিল কারণ তারা এই পথে ট্রেন চলাচলে এ দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু আমি এবং আমরা কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না। কারণ একদিকে এই ধরনের চোরাচালান আইনবিরোধী তাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা বাঞ্চনীয় আবার সচেতন মানুষ হিসেবে নারীদের জনসমক্ষে এভাবে বিবস্র করে ফেলা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না।

প্যাকেটগুলোতে কী আছে জানিনা শুধু ভাবছিলাম নারীরা কীভাবে অপরাধ জগতে ব্যবহৃত হচ্ছে, কত অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে! কত অসহায় অবস্থা আমাদের দেশের নারীদের।তারা শুধু দুজন নারীকে ধরে নিয়ে যেতে পারলেও পুরো কামড়া জুড়ে এক বিশাল সিন্ডিকেট। বিডিআররা তাদের তল্লাশী শেষে যখন আরেক কামড়ায় গেল যুবকদের দলটি উদগ্রীব হয়ে ঐ নারীদের শরীর থেকে প্যাকেটগুলো বের করে যাত্রীদের আসনের নিচে রাখতে লাগল।মুহুর্তের মধ্যে আমার চোখ ফাকি দিয়ে আমাদের সিটের নিচে প্যাকেট রাখতে একটি যুবকের যতক্ষণ তাকে পাকড়াও করতে ততক্ষণ। এবার নিজেদের রক্ষা বলে কথা। এতক্ষণ সকল যাত্রী চুপ থাকলেও এবার তেড়ে বসল, তারপর ধোলাই এবং যুবকটিকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়া হল পরের স্টেশনে।এরই মধ্যে সকলের মধ্যে উত্তেজনা আমাদের দলের কেউ ফোন করছিলেন বিভিন্ন জনকে এই পরিস্থিতি জানিয়ে। আমাদের ফটো সাংবাদিক ভাই এই সুযোগে যখন ক্যামেরায় ক্লিক করল পুরো সিন্ডিকেট আতঙ্কিত হয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আমাদের কামড়া ছেড়ে অন্য কামড়ায় চলে গেল।

এরই মধ্যে ট্রেনের পাহাড়া পুলিশ আসল, কিন্তু টিটির আর দেখা পেলাম না। আমি দায়িত্বরত পুলিশের কাছে জানতে চাইলাম বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত কিনা? উত্তরে তিনি বললেন এটা হিলি বন্দর, এখানে আসলে স্টেশন না থাকা সত্ত্বেও রাতে চালক ট্রেন থামাবেই। কারণ চোরাইমাল বহনকারী অনেক নারী অপেক্ষায থাকে রাতের এই ট্রেনের। এই দলের সাথে ট্রেনের চালক টিটিসহ অনেকেই জড়িত। আমি জানতে চাইলাম তারা জানা সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? উত্তরে তিনি নির্বিকার চিত্তে বললেন যেখানে বিডিআররাই কিছু করতে পারছে না সেখানে তারা কী করবে। আমি বললাম এরকম চোরাচালানীর সিন্ডিকেটরা যেভাবে ট্রেনে উঠে যাচ্ছে, ডাকাত উঠলেও কী এরকম নির্বিকার থাকেন। পুলিশ কর্মকর্তা আমার দিকে তাকিয়ে পরিহাসের হাসি হাসলেন আর হয়তো বোঝাতে চাইলেন আমি এবং আমরা কত অনভিজ্ঞ এই দেশ এবং সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে। আমাদেরও বুঝে উঠতে বাকি রইল না যে পুলিশ স্বয়ং এই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত। আমার মনে পড়ছিল সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে জীবনের ঝুকি নিয়ে ১০০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে ঘর্মাক্ত কর্মরত সকালের সেই বৃদ্ধ শ্রমিকদের কথা, রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার এই ওয়ার্কশপ নিয়ে অক্লান্ত শ্রম আর স্বপ্নের কথা।সবই কী ব্যর্থ হবে এই অসাধু কর্মকতা আর সিন্ডিকেটের ক্ষমতাবলে! অর্থাত পার্বতীপুর স্টেষণ থেকে ঢাকার কিছুটা আগ পর্যন্ত ট্রেন থাকে স্বাধীন চোরাচালানীর স্বর্গরাজ্যে রূপান্তরিত হয়। আমরা এ কোন দুস্বপ্নের রাজ্যে বাস করছি। আমরা সাধারণ মানুষেরা কত অসহায় আর নির্লিপ্ত। কিন্তু এভাবে আর কতদিন! আমাদের গন্তব্য কোথায়? এর একটা বিহীত হওয়া উচিত। সারারাত ট্রেনে বিষন্নতায় আর ক্লান্তিতে ঘুমাতে পারলাম না।সিদ্ধান্ত নিলাম বিষয়টি তুলে ধরা উচিত । তাই এই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা। তাতেও যদি অন্তত কেউ সচেতন হয়। যদি উর্দ্ধতন কোনো সৎ কর্মকর্তার চোখে এই লেখাটি পড়ে এবং সামান্য কোনো উদ্যোগ নিতে সচেষ্ঠ হন এই দেশের কথা ভেবে, দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

খালেদা ইয়াসমিন ইতি
(বিজ্ঞান লেখক ও উন্নয়ন কর্মী)
ডিসকাশন প্রজেক্ট