[এই লেখাটা গত ২৬ মে ২০১১, ফেসবুক নোটে শেয়ার করেছিলাম। এছাড়া প্রথমআলো ব্লগেও প্রকাশ করেছিলাম। অনেকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। অমিত হিল মুক্তমনাতে পাহাড়ের রাজনৈতিক দলগুলোর ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত নিয়ে একটা লেখা দিয়েছিলেন। সেই আলোচনার সাথে আরো কিছু বিষয় যোগ করার উদ্দেশ্যে মুক্তমনা’র বন্ধুদের উদ্দেশ্যে আমার এ লেখাটা এখানে আবারও পত্রস্থ করলাম। ]

রাঙামাটির বরকল উপজেলাধীন সুবলং ইউনিয়নে জেএসএস-র সশস্ত্র গ্রুপের হামলায় ইউপিডিএফ-এর চার কর্মী নিহত হওয়ার প্রেক্ষিতে ফেসবুক গ্রুপগুলোতে উত্তপ্ত আলোচনা চলছে।উভয় পার্টির প্রতি সাধারণ মানুষের তীব্র ঘৃণা-ক্ষোভ-নিন্দা ঝরে পড়ছে ফেসবুকের দেওয়ালে দেওয়ালে।কেউ কেউ পশুর সাথে তুলনা করে গালি দিচ্ছে উভয় পার্টিকে।এসব ঘৃণা ক্ষোভ দেখে স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায় সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম কতটা জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর প্রতি ক্ষুব্ধ।তীব্র ঘৃণা-ক্ষোভ-নিন্দার মাঝেও মোটামুটিভাবে সবাই একটা জায়গায় একমত – জুম্মজনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে অবশ্যই উভয় পার্টিকে এক হতে হবে।এমনকি জেএসএস-র তরুণ কর্মী বা জেএসএস ঘরানার ফেসবুকবন্ধুদেরও উভয় পার্টির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই।তবে কিছু কিছু তরুণ জেএসএস কর্মী ইউপিডিএফ-র সাথে রাজনৈতিক সংঘাতের জন্যে প্রবীণ নেতাদের একগুঁয়েমীকে দায়ী করছেন। অন্যদিকে, ইউপিডিএফ-র কর্মীরা তো অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের স্বার্থে তারা জেএসএস-র সাথে সমঝোতা করতে প্রস্তুত। এককথায়, অনেক জেএসএস-ইউপিডিএফ কর্মীসহ সাধারণ জুম্মজনগণ পাহাড়ের দুই রাজনৈতিক দলের ঐক্যের ব্যাপারে সোচ্চার এবং প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মাধ্যমে বিশেষকরে ফেসবুক ও ব্লগের মাধ্যমে তাদের কাছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আকুল আবেদন জানিয়ে যাচ্ছেন।কিন্তু এত আবেদন নিবেদন সত্ত্বেও উভয় দল বিভিন্ন ছলছুতোয় নিজেদের মধ্যে মারামারি ও খুনোখুনি এখনো বন্ধ করেনি।স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, উভয় দল কী জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল?রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংঘাত বন্ধে তারা সত্যিই কী আন্তরিক?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিস্তারিত বিশ্লেষণে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।সহজভাবে বললে বলতে হয়, উভয় দলই জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়।ওরা যদি সত্যি সত্যিই জনমত ও জনগণের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে থাকতো তাহলে তারা এতদিন আন্তরিকভাবে চেষ্টা করতো রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংঘাত বন্ধের জন্যে।কিন্তু তা করার জন্যে কোন কার্যকর পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত চোখে পড়েনি (যদিও ইউপিডিএফ মাঝে মাঝে জেএসএসকে ঐক্যের আহবান জানিয়েছিলো)।এই দুই দলের মধ্যেকার সংঘাতের কারণে কত লোকের জীবন হানি ঘটেছে, কত লোকের সংসার তছনছ হয়ে গেছে, কত মায়ের অশ্রু ঝরেছে, কত শিশু অনাথ হয়েছে, অর্কির মত নিরীহ শিশুকে নির্মমভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে মরতে হয়েছে – এসব জঘন্যতম ঘটনার জন্যে কোন দলই কখনো জনগণের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেনি।দুঃখ প্রকাশ তো দূরের কথা, নির্লজ্জভাবে দুই দল বরাবরই এসব ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে আসছে।দু’দলই দাবী করে আসছে তাদের কোন সশস্ত্র দল নেই। যদি উভয় দলের কোন সশস্ত্র দল না থাকে, তাহলে কারা অস্ত্র নিয়ে মারামারি করছে? দুঃখের বিষয়, দু’দলই পার্টিগতভাবে “কোন সশস্ত্র দল নেই” এরকম কথাবার্তা বলে সহিংসতা ও অপরাধ প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে।এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, দুই উদাসীন দলের মাধ্যমে জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে সে সম্ভাবনা খুবই কম। তারপরেও সাধারণ মানুষের একান্ত চাওয়া হলো জেএসএস-ইউপিডিএফ ঐক্যবদ্ধ হোক।জনগণের এ চাওয়ার প্রেক্ষিতে আরো একটি প্রশ্ন এসে যায় – জেএসএস-ইউপিডিএফ কী কখনো এক হতে পারবে? হলে কীভাবে? নিচে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক তাদের মধ্যে ঐক্য সম্ভব হতে পারে কি না।

অধিকারের লাগি জুম্মজনগণ চাহে ঐক্য, ঐক্য মিলে নাঃ কেন মিলে না?
রবি ঠাকুরের গানের সুর স্মরণ করতে হয়, “এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মিলে না/শুধু সুখ চলে যায়”। ঠিক তেমনিভাবে বলতে হয়, “এরা (জুম্ম জনগণ) অধিকারের লাগি চাহে ঐক্য, ঐক্য মিলে না।শুধু সুখ চলে যায়”।অন্যদের বেলায় জানি না, তবে আমার বেলায় পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন দুর্ভাগা নাগরিক হিসেবে সুখহীন মনে জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর মধ্যেকার ঐক্য হবে সে ব্যাপারে আমি কখনো আশাবাদী হতে পারি না।আশাবাদী হতে না পারার কিছু কারণও রয়েছে।যেমন,

১) ঐক্যের ন্যূনতম শর্ত হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস।দুই দলের, সহজ করে বললে জেএসএস প্রধান সন্তু লারমা ও ইউপিডিএফ প্রধান প্রসিত খীসার মধ্যে এ দু’টো জিনিস চরমভাবে অনুপস্থিত।এছাড়া বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে ইউপিডিএফ একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা হলেও সন্তু লারমা সে বাস্তবতা মানতে রাজী নন। অর্থাৎ, ইউপিডিএফ তো দূরের কথা সন্তু লারমা জেএসএস বাদে অন্য কোন পাহাড়ী রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব মানেন না।যার অস্তিত্ব তিনি মানেন না, তার সাথে কীভাবে জেএসএস-এর ঐক্য হবে?

অন্যদিকে, জেএসএস-র সাথে ঐক্যের আহবান জানালেও ইউপিডিএফ-এর আহবান খুবই আন্তরিক বলে মনে হয় না।কেননা, তারা একদিকে জেএসএস-এর প্রতি ঐক্যের আহবান জানান, অন্যদিকে তারা তাদের মুখপত্র ও বিভিন্ন লিফলেট-বিবৃতির মাধ্যমে জেএসএস-এর প্রধান সন্তু লারমাকে “গণদুশমন”, “সরকারের দালাল” ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করে অসৌজন্যমূলক ভাষায় গালিগালাজ করে থাকেন। সন্তু লারমার গাড়ী বহরে ইটপালকেল নিক্ষেপ করে।“গণদুশমন”-এর সাথে ইউপিডিএফ-এর ঐক্য কীভাবে সম্ভব? এরকম শ্রদ্ধাহীন-ভালবাসাহীন পরিবেশে কী দুই পার্টির মধ্যে কোলাকুলি হবে?

(২) জেএসএস ও ইউপিডিএফ প্রধানগণের ব্যক্তিগত অহংবোধ ও স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতাও বর্তমান সমস্যার অন্যতম কারণ।ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক কর্মী না হলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সাথে আলাপক্রমে যতটুকু জানতে পেরেছিলাম সেটা হলো সরকারের সাথে সংলাপ চলার সময় তৎকালীন পাহাড়ী গণপরিষদের নেতা ও বর্তমান ইউপিডিএফ প্রধান প্রসিত খীসা সংলাপে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। এর পেছনে প্রসিতের যুক্তি ছিলো, আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার সময় জেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে পারেনি। সেই জায়গায় পাহাড়ী ছাত্রপরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ী গণপরিষদ এ তিন সংগঠন মিলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলো। কাজেই সংলাপে এই তিন সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব থাকা চাই। সেই হিসেবে প্রসিত খীসা সরকারের সাথে সংলাপ প্রক্রিয়ায় প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু জেএসএস নেতৃত্ব তার এ চাওয়াকে ভিন্ন চোখে দেখেছিলেন।যার কারণে তারা প্রসিতের প্রস্তাবে রাজী হননি।এতে প্রসিত খীসা অপমানিত বোধ করেন।সন্তু বলেন, “প্রসিত, তুমি কে?” আর প্রসিত বলেন, “আমি কম কীসের?” এই অহংবোধের ফলশ্রুতিতে সংলাপের শুরু থেকেই পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ধুয়া তুলে জেএসএস-এর নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন প্রসিত।

অন্যদিকে, সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসও প্রসিতদের পুরোপুরি উপেক্ষা করে সংলাপ চালিয়ে যান এবং অবশেষে ’৯৭ সালে পার্বত্যচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।চুক্তি স্বাক্ষরের পর দিনই ঢাকার রাজপথে প্রসিতরা চুক্তির বিরোধিতা করে চুক্তির কপিতে আগুন ধরিয়ে দেন। এছাড়া যেদিন সন্তু লারমা অস্ত্র জমা দেন, সেদিন প্রসিতরা সন্তু লারমাদের কালো পতাকা প্রদর্শন করেন।এভাবে দু’জনের ব্যক্তিগত অহংবোধ ও অপ্রতিরোধ্য জেদাজেদি ক্রমে ক্রমে চরম সংঘাতের দিকে এগিয়ে যায়। সেই সংঘাতের চরমরূপ হলো “শান্তিচুক্তির পক্ষ” ও “শান্তিচুক্তির বিপক্ষ” এবং তাদের মধ্যে খুনোখুনি ও অস্ত্রের ঝনঝনানি। তাই, সন্তু ও প্রসিতের ব্যক্তিগত অহংবোধ ও আহতমনের বেদনাবোধের অবসান না হলে জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর ঐক্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা আছে কী?

(৩) একটা চাকমা প্রবাদ আছে, এক জঙ্গলে দুই বাঘ থাকতে পারে না।সেই চাকমা সমাজের দুই বাঘ সন্তু আর প্রসিত এক সঙ্গে বসবাস করতে পারবেন এমন সম্ভাবনা খুবই কম।এ প্রসঙ্গে বাস্তব উদাহরণ টানতে হয়, প্রসিত বাঘকে পাহাড়ের রাজনীতির জঙ্গল থেকে তাড়ানোর জন্যে সন্তু বাঘ সরকারের কাছে বারবার দাবী জানাচ্ছেন সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ করা হোক।অন্যদিকে, প্রসিত বাঘের দল ইউপিডিএফও সন্তু লারমাকে “দন্তহীন বুড়োবাঘ”, “গণদুশমন”, “জাতীয় বেঈমান”, “সরকারের দালাল” ইত্যাদি উপাধি দিয়ে তাকে নিশ্চিহ্ন করার আহবান জানিয়ে আসছে।মাঝে মাঝে সন্তু বাঘের গাড়ী বহরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে নিজেদের পেশিশক্তির পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়।

প্রসঙ্গক্রমে আরো একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারি না। দুই বাঘই বিশ্বাস করে বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস।সেই ক্ষমতা সুসংহত করতে দু’জনই বন্দুকের নল ব্যবহারের পক্ষে।যেহেতু দুই বাঘই ‘একাদাজ্জে’ (একক কর্তৃত্বপরায়ন), সেহেতু বন্দুকের নলের মাধ্যমে কে ‘একাদাজ্জে’ থাকতে চান না? ‘একাদাজ্জে’ থাকার জন্যে দু’জনেরই বন্দুকের নল খুবই প্রিয়।

(৪) জুম্মদের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঐক্যের নজির নেই।দূর অতীতে না গিয়ে জেএসএস-এর “লাম্বা-বাদি”র ইতিহাসটা দেখলেই চলে। জেএসএস “লাম্বা-বাদি”তে বিভক্ত হওয়ার পর যখন এক হতে চাইলো তখন তার কী পরিণতি হয়েছিলো সেটা আমাদের সবার জানা।সেখানে আমরা হারিয়েছিলাম জুম্মজাতির অগ্রদূত এম.এন লারমাকে।এই নজিরবিহীন জুম্ম ইতিহাসে দুই ‘একাদাজ্জে’ বাঘ ঐক্যের নজির সৃষ্টি করতে পারবেন কী? তবে আমার বড়ই সন্দেহ হয়।

জেএসএস-ইউপিডিএফ ঐক্য কখনো কী সম্ভব হবে?
উপরে কিছু নেতিবাচক দিকের কথা বললাম। আমাদের সমাজে ও রাজনীতিতে আরো অনেক নেতিবাচক দিক আছে। কেবল জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর চোখ দিয়ে নয়, সমাজ-মনস্তাত্বিক, দার্শনিক ও ধর্মীয় লেন্স দিয়েও সেসব নেতিবাচক দিকগুলোর বিস্তারিত বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।তবে এই জাতীয় দুর্যোগ মুহুর্তে এসব নেতিবাচক কথাবার্তা শুনে অনেকে হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে কী জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর মধ্যে কখনো ঐক্য সম্ভব হবে না?
এ প্রশ্নের সহজ সরল উত্তর নেই। উত্তর পেতে হলে ঐক্যের ধরনটা কী হতে পারে সে ব্যাপারে আগে স্পষ্ট হতে হবে।জেএসএস্-ইউপিডিএফ-এর ঐক্যের ব্যাপারে সবাই এক রা হলেও ফেসবুকবন্ধু ও ব্লগারদের আলোচনা থেকে এ ব্যাপারে কোন স্পষ্ট ধারনা পাইনি।তবে রাধামন ধনপুদি (Radhamon Donpudi)নামে জনৈক ফেসবুক বন্ধু জুম্ম ঐক্যের ব্যাপারে আবেগময়ী নোট দিয়েছিলেন কিছুদিন আগে।স্বাভাবিকভাবে তার লেখাতে আবেগ ছিলো।কিন্তু কীভাবে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সে ব্যাপারে কোন দিক নির্দেশনা খুঁজে পাইনি। শান্তিচুক্তির প্রতি শোকগাথা লিখে রাধামন বলেছিলেন, যারা “পক্ষে” ছিলেন আর যারা “বিপক্ষে” ছিলেন তাদের কারোর জন্যেই চুক্তিটা কোন সুফল বয়ে আনতে পারেনি ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি ও খুনোখুনি ছাড়া।তাই তিনি চুক্তির “পক্ষ” ও “বিপক্ষ” কাউকে দোষারোপ না করে চুক্তিটাকে ইতিহাসের এক বাঁকে রেখে দিয়ে নতুন করে শুরু করার আহবান জানিয়েছিলেন। অত্যন্ত যৌক্তিক আহবান। কিন্তু ঐক্য কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে সেটা এখনো বড় প্রশ্ন।

তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, “ঐক্য” বলতে যদি সবাই জেএসএস্-ইউপিডিএফ এই দু’দলের একটা সংগঠনে একীভূত হওয়াকে বুঝে থাকেন, তাহলে সেই ঐক্য কখনো সম্ভব হবে না।সেটা অবাস্তব ধারনাও বটে।কেননা, যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে পরস্পরকে ধাওয়া-ধাওয়ি করেছিলেন এবং গুলি ছুঁড়েছিলেন, তারা ভবিষ্যতে পরস্পরের সাথে শ্রদ্ধায়-ভালবাসায়-বিশ্বাসে কোলাকুলি করবেন সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, জুম্মজাতির ইতিহাসে বিরলও বটে।এ অবস্থায় তাদের মধ্যে ঐক্য কোন উপায়ে হতে পারে?

আমার সাধারণ জ্ঞান বলে, জেএসএস্-ইউপিডিএফ একটি সংগঠনে একীভূত না হলেও তাদের মধ্যে ঐক্য সম্ভব হতে পারে যদি নিম্নে উল্লেখিত শর্তাবলী পূরণ করা সম্ভব হয়।

এক, এত মারামারির পরও দুই দলের দুই ‘একাদাজ্জে’ বাঘ সন্তু লারমা ও প্রসিত খীসার মনের মধ্যে জুম্মজাতির ঐক্যের ব্যাপারে বিবেকের তাড়নাবোধ বা উপলব্দি হয়েছে কী না। যদি না হয়, তাহলে তাদের মধ্যে সেই তাড়নাবোধ বা উপলব্দি সৃষ্টি করতে হবে।

দুই, উভয়কে পরস্পরের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে হবে ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে যার যার কাজ করতে হবে।
তিন, দলীয়ভাবে জুম্মর বিরুদ্ধে জুম্ম লেলিয়ে দেওয়া – এরকম বল প্রয়োগের নীতি থেকে তাদের সরে আসতে হবে।অর্থাৎ দলীয়ভাবে পরস্পরের প্রতি অনাক্রম নীতি কঠিনভাবে অনুসরণ করতে হবে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, জেএসএস-ইউপিডিএফ তাদের ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এ তিনটি শর্ত পুরণে কী আগ্রহী?

জেএসএস-ইউপিডিএফ ঐক্য কোন পথে হতে পারে?
আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্ব দিয়ে জেএসএস-ইউপিডিএফ ঐক্যের সম্ভাবনা আলোচনা করতাম। তবে অধম কাঁচা নাগরিক হিসেবে তাদের ঐক্যের ব্যাপারে দু’টো উপায় দেখতে পাই। একটা হলো শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া, আর অন্যটা বেদনাদায়ক প্রক্রিয়া। এবার এ দু’টো প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই।

শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ঐক্যঃ এ প্রক্রিয়ায় নিজেদের মধ্যে ঐক্য বা সহাবস্থান বজায় রাখার জন্যে আপাতত: দু’টো উপায় খোলা আছে। একটা হলো, যার যার সংগঠনের অস্তিত্ব বজায় রেখে কর্মসূচী ভিত্তিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা; আর অন্যটি হলো অহিংসা প্রক্রিয়ার মাধমে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা।

১) কর্মসূচী ভিত্তিক ঐক্য
জেএসএস-ইউপিডিএফ-র দাবীসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাদের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই।শুধু পথের ভিন্নতা রয়েছে। প্রথমোক্ত দল মনে করছে, “পার্বত্য চুক্তি” বাস্তবায়নের মাধ্যমে জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা; আর অন্যদল মনে করছে, “পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের” মাধ্যমে তা করতে হবে।দু’দল দু’টো পরিভাষায় কথা বললেও জুম্ম জনগণের মৌলিক দাবীসমূহ একই। যেমন, (১) পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মজনগণের জন্যে সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ স্বশাসন ব্যবস্থার কায়েম করা; (২)জুম্মজনগণের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা; (৩) সেটেলার বাঙালিদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা এবং তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করা; (৪) সেনাশাসন প্রত্যাহার করা; এবং (৫)আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।উভয় দলের রাজনৈতিক সাহিত্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এগুলোই হলো দু’দলেরই মৌলিক দাবী।তাহলে দু’দল কেন “পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন” ও “পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের” নামে শুধু শুধু মারামারি করছে?নিজেদের মধ্যে হানাহানি না করে, শক্তিক্ষয় না করে দু’দলই এসব দাবীর সাথে সংগতি রেখে নিজ নিজ দলের রাজনৈতিক কর্মসূচী নির্ধারণ করতে পারে।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয়, ইউপিডিএফ ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে জেএসএস-এর সাথে ঐক্যের আহবান জানিয়েছিল।সর্বশেষ, ইউপিডিএফ তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসে জেএসএসকে চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতা দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলো।ইউপিডিএফ-এর এসব ঘোষণা কতটুকু আন্তরিকতাপূর্ণ ছিলো সেটা বিতর্কের বিষয়। তবে ইউপিডিএফ-এর এসব ঘোষণা সত্বেও জেএসএসকে উদাসীন থাকতে দেখা গেছে, যা জুম্মজাতির জন্যে অত্যন্ত বেদনাদায়ক।এখানে জেএসএস-এর একধরনের অহংবোধ কাজ করছে বলে মনে হয়।

এটাও জুম্মজাতির জন্যে চরম দুর্ভাগ্য, ইউপিডিএফ-এর অস্তিত্বকে জেএসএস স্বীকার করে না।জেএসএস-এর “মনোকালচার”(জেএসএসই সব) নীতি এই অনৈক্যের পেছনে অনেকাংশে দায়ী।তবে জেএসএস ইউপিডিএফকে রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকার করুক বা না করুক, ইউপিডিএফ এখন পার্বত্য রাজনীতিতে একটি বাস্তবতা।পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষ নিয়ে যদি জেএসএস আন্দোলন করতে চায় তাহলে অবশ্যই ইউপিডিএফ-এর বাস্তবতাকে তার উপেক্ষা করার কোন উপায় নেই।

আর এটাও সত্য, একপাক্ষিকভাবে কখনো ঐক্য বা সমঝোতা সম্ভব নয়।একদিকে জেএসএস-এর “এক বনে দুই বাঘ থাকতে পারে না”-এরকম একরোখা মানসিকতা, অন্যদিকে ইউপিডিএফ-র সমঝোতা বা ঐক্যের আহবান – এই দু’য়ের মধ্যে কী ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব? এই রাজনৈতিক ধাঁধার উত্তর দু’দলকে বের করতে হবে।তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা মারামারি-খুনোখুনি চালিয়ে যাবে নাকি ঐক্যের পথ খুঁজে বের করবে; তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে মারামারি-খুনোখুনির জন্যে পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকবে নাকি নিজেরা নিজেদের সমাধানের পথ শান্তিপূর্ণ উপায়ে খুঁজবেন।

২) রাজনৈতিক সহিংসতার পথে নয়, অহিংসার পথে ঐক্য খুঁজতে হবে
জেএসএস-ইউপিডিএফ পরস্পরের সাথে মারামারি করে অনেক নেতা-কর্মীকে হারিয়েছে (প্রথম আলোর সূত্রমতে, ৭০০-এর অধিক নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন)।অসংখ্য লোককে অপহরণ করা হয়েছে, জিম্মি করে চাঁদা আদায় করা হয়েছে। এছাড়া অস্ত্র কেনা ও নিজেদের পার্টির লোকজনের খাওয়া-পরা নিশ্চিত করতে সাধারণ জনগণের উপর চাঁদার জগদ্দল পাথর চাপানো হচ্ছে। অস্ত্রকেনা ও জেএসএস-ইউপিডিএফ চালানোর জন্যে সাধারণ জনগণ আর চাঁদার বোঝা বইতে পারে না। দুই দলের (এখন হয়েছে তিন দল) সহিংস রাজনীতির কারণে জনগণ যেমন ধনে-জনে চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছে, ঠিক তেমনি মনস্তাত্তিকভাবেও জুম্মসমাজ বিশেষ করে যুব সমাজ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।যুবসমাজের এ হতাশার ভবিষ্যত পরিণতি কী হতে পারে রাজনৈতিক দল হিসেবে জেএসএস-ইউপিডিএফকে এখনই ভাবতে হবে।তাই জেএসএস-ইউপিডিএফের কাছে উদাত্ত আহবান সহিংসতার পথে নয়, অহিংসার পথে সমাধান আনতে আপনাদের আন্তরিক হতে হবে।

অহিংসা আন্দোলনের অনেক সফল উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক কেবল মহামতি গৌতম বুদ্ধ নন, আরো অনেক উজ্জ্বল কিংবদন্তী ব্যক্তির দৃষ্টান্ত আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে।দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আমাদের কাছের মানুষ মহাত্মা গান্ধী, অংসান সূচি ও দালাইলামার দৃষ্টান্ত দেখেও আমাদের নেতারা শিক্ষা নিতে পারেন। সাদাসিধে কথায়, অহিংসা চর্চার জন্যে মনের বিরুদ্ধে দু’দলের একীভূত হওয়ার প্রয়োজন নেই, একসাথে যৌথ কর্মসূচী দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দু’দলের কাছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা দু’পার্টিই নিজ নিজ দলের মধ্যে অহিংসার চর্চা করুক।অহিংসা চর্চার জন্যে কঠিন কিছু করতে হবে না। কেবল এ তিনটি নীতি পালন করতে হলো: ১)রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা জনগণের প্রতি নিজেদের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থাকবেন; (২) একে অপরকে মারার বা ক্ষতি করার অভিপ্রায় থেকে বিরত থাকবেন এবং নিজ নিজ দলের কর্মীদেরও মারামারি থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেবেন; (৩)সব ধরনের সহিংসতা বন্ধে দলীয়ভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবেন।এ ত্রিশরণ পালনের জন্যে কেবল প্রয়োজন দু’দলের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

আরো একটা কথা এখানে উল্লেখ করতে হয়।দু’দলই সাধারণ জনগণের কাছে রাজনৈতিক আহবান জানায় তাদের মধ্যেকার মারামারি বন্ধে উদ্যোগ নিতে এবং সোচ্চার হতে।জনগণ নয়, দু’দলের মধ্যেকার এই মারামারির সমাধান দু’দলকেই করতে হবে।এর সমাধানসূত্র বৌদ্ধধর্মের ধম্মপদে পাওয়া যাবে। আর সেই সমাধান নিজ নিজ দলের মধ্যে আছে।দু’দলের নেতা-কর্মীরা সংযত ও সহনশীল হলে মারামারি আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। ধম্মপদে বলা হয়েছে,

“The others do not understand that we should restrain ourselves here.
Those who understand that, therefore appease their quarrels.” (DhP 6)
(অনেকে জানেন না নিজেদেরই সহনশীল হতে হয়।আর যারা এই সত্য অনুধাবন করতে পারেন, তারা নিজেদের ঝগড়া প্রশমিত করতে পারেন)।

কাজেই নিজেদের মধ্যেকার মারামারি বন্ধ করতে হলে দু’দলের নেতাকর্মীদের পরমতসহনশীল ও সংযত হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই।এই সত্য উপলব্দি করতে না পারলে জেএসএস-ইউপিডিএফ সবসময় পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকবে। এতে জুম্মজনগণের তো উপকার হবে না, তাদের মধ্যেকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুনও কখনো নিভবে না।ধম্মপদের (ধম্মপদ:৬) আরো একটি চিরন্তন বাণী “শত্রুতা দিয়ে শত্রুতার অবসান হয় না, মিত্রতা দিয়ে শত্রুতার অবসান হয়”। এই সত্য জেএসএস ও ইউপিডিএফ যত তাড়াতাড়ি উপলব্দি করতে পারবে, তত তাড়াতাড়ি জুম্মজনগণ সহিংস রাজনীতির করালগ্রাস হতে মুক্ত হতে পারবে।

জেএসএস-ইউপিডিএফ কী বেদনাদায়ক প্রক্রিয়ায় ঐক্য খুঁজবে?
উপরে উল্লেখিত শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় সমস্যার সমাধান বা ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হলে জেএসএস-ইউপিডিএফকে বেদনাদায়ক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। এর অর্থ হলো অস্ত্রের মাধ্যমে আপোসরফা করতে হবে। অস্ত্রই ঠিক করবে কে থাকবে – জেএসএস নাকি ইউপিডিএফ?কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, এই পথে চূড়ান্ত সমাধান আসবে কী? অবশ্য, দু’দল তো গত এক যুগ ধরে এই বেদনাদায়ক পথে হাঁটছে।অনেক খুনোখুনি ও রক্তারক্তি করেও কেউই কাউকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। বরং নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আরো একটি নতুন সংযোজন হয়েছে জেএসএস (এমএন লারমা)। সন্তু-প্রসিত-রূপায়ন নেতৃত্বাধীন তিনটি রাজনৈতিক দল এখন জনসাধারণের কাছে “সন্তুজ, গুন্ডুষ ও ফান্ডুজ” হিসেবে পরিচিত। “ফান্ডুজ” নতুন সংযোজন হলেও ইতোমধ্যে এর কিছু নেতাকর্মী “সন্তুজের” হাতে মারা গেছে। অনুমান করা যাচ্ছে, আগামীতে “ফান্ডুজরা”ও বেদনাদায়ক পথে হাঁটতে পারে।“সন্তুজ-গুন্ডুষ-ফান্ডুজ”-এ ত্রিশক্তির সংঘর্ষে জুম্মজাতির অস্তিত্ব কী টিকে থাকবে?

এ প্রশ্নের উত্তরে বেদনাদায়ক পরিসংখ্যানটা দেখে নিলে ভালো হয়। গত ২২ মে ‘প্রথম আলো’র প্রতিবেদন অনুসারে, পার্বত্য চুক্তির পর থেকে গত এক যুগ সময়ে জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর মধ্যেকার সংঘাতে ৭০০-এর অধিক নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক।অপহৃত হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি।খুনোখুনির ব্যালেন্সশিট এখনো মেলানো শেষ হয়নি। এছাড়া এই ব্যালেন্সশিটে শুধু মানুষের সংখ্যার হিসেবটা দেওয়া হয়েছে। এখানে পুরো জুম্মজাতির মন ও মানসিক বেদনার হিসেবটা দেয়া হয়নি।দেওয়া হয়নি জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর মারামারিতে কী পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়।হিসেব নেই “সন্তুজ-গুন্ডুষ-ফান্ডুজ”-এর চাঁদাবাজিতে সাধারণ মানুষ কী পরিমাণ ক্ষতির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই ক্ষতি, এই বেদনা জুম্মজনগণ কতদিন বহন করতে পারবে?এ প্রেক্ষিতে “সন্তুজ-গুন্ডুষ-ফান্ডুজ”দের ভাবতে হবে এই বেদনাদায়ক প্রক্রিয়ায় তারা সমাধান চান কী না।তবে তাদের লড়াইয়ের গতিপ্রকৃতি দেখে আমার ভয় হয়, তারা চাকমা রূপকথার রোঙ্যাবেঙার দুই বনমোরগের লড়াই* শুরু করে দিয়েছে কী না।যদি তাই হয়, তাহলে জুম্মজনগণকে, বিশেষকরে তরুণ প্রজন্মকে ভাবতে হবে, “সন্তুজ-গুন্ডুষ-ফান্ডুজ”দের বেদনাদায়ক পথে তাদের সমস্যার সমাধান হতে দেবে কী না।যদি ‘না’ হয়, তাহলে জেএসএস-ইউপিডিএফকে চূড়ান্তভাবে বয়কট করতে হবে।

শেষকথা
জুম্মজাতির অধিকারের নামে জেএসএস-ইউপিডিএফ নিজেদের স্বার্থে যে সংকট সৃষ্টি করেছে সেটা পুরো জুম্মজাতির ঐক্যের সংকট নয়।বরং তাদের স্বার্থের জন্যে পুরো জুম্মজাতিকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এটা হতে পারে না।জেএসএস-ইউপিডিএফ ছাড়াও জুম্মজনগণ নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্যে লড়াই করতে পারে। যেমন, জেএসএস-ইউপিডিএফ নিজেদের মারামারিতে মশগুল তখন বান্দরবানের রুমার জনসাধারণ গত ৩ মে সেনাবাহিনী কর্তৃক ভূমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে ৪০ কিমি. পথ পায়ে হেঁটে লংমার্চ করেছিলো (যদিও পত্র-পত্রিকায় এ খবর তেমন গুরুত্ব পায়নি)।জনগণের এই চেতনা থেকেও জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর শিক্ষা নিতে হবে।

জেএসএস-ইউপিডিএফ নিজেদের ব্যর্থতাগুলো কখনো জনগণের কাছে স্বীকার করেনি। তাদের সৃষ্ট দুর্ভোগের জন্যে জনগণের কাছে কখনো দুঃখ প্রকাশ করেনি। বরং তাদের ব্যর্থতার জন্যে তারা অন্যকে দায়ী করে থাকে। ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আবিষ্কার করে থাকে নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করে। অন্যকে দোষারোপ করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উভয় দলকে নিজেদের বিকৃত চেহারাগুলো দেখতে হবে।তাদের মনে রাখতে হবে, তাদের মারামারি সমস্যার সমাধান অন্য কেউ করে দেবে না, নিজেদেরকেই করতে হবে।জেএসএস সমাধান চায় না কিংবা ইউপিডিএফ সমাধান চায় না – এরকম খোঁড়া যুক্তি বাদ দিতে হবে। মারামারি সমস্যার সমাধান নিজেদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। নিজের মধ্যেই শান্তি নিহিত আছে। এ প্রেক্ষিতে আবারও তাদেরকে মহামতি গৌতম বুদ্ধের চিরন্তনবাণী স্মরণ করিয়ে দিতে চাই,

“Peace comes from WITHIN, don’t seek it WITHOUT” (শান্তি আসে নিজের ভেতর থেকে, একে খুঁজতে যেও না নিজেকে বাদ রেখে)।

অতএব, জেএসএস-ইউপিডিএফ মারামারি-খুনোখুনি বাদ দিন, পরমতসহিঞ্চু হতে শিখুন। নিজের মধ্যে ঐক্য-শান্তিু খুঁজে নিন।নচেত আপনাদের মুখে জুম্মজনগণের অধিকারের পক্ষে কথা বলা মানাবে না।জুম্মজনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে কোন অধিকার আপনাদের দেয়া হয়নি।

—————————–
পাদটীকাঃ রোঙ্যাবেঙার দুই বনমোরগের লড়াইয়ের কাহিনী ছোটবেলায় গ্রামের এক দাদুর কাছে শুনেছিলাম। অল্প কথায় গল্পটা হলো এইঃ একদিন চৈত্রের ভরদুপুরে জুমঘরে বসে রোঙ্যাবেঙার হুকা টানতে ইচ্ছা হলো।কিন্তু আগুন জ্বালানোর মত ম্যাচ-শলাকা জাতীয় তার হাতে কিছুই ছিলো না। মনে মনে ভাবছিলো যদি আগুন জ্বালানো যায় মনভরে হুকা টানা যেতো।ঠিক সেই সময় দুই বনমোরগ লড়াই শুরু করলো। এমন তুমুল লড়াই সে জীবনে দেখেনি। প্রথমে দুই মোরগের পালকগুলো খসে পড়লো। একটাও অবশিষ্ট নেই। তারপরও দু’জনের লড়াই থামে না।মাংসে মাংসে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু হলো।একসময় সব মাংসও খসে পড়লো। তবুও লড়াই থেমে নেই। তারপর শুরু হলো হাড়ে হাড়ে লড়াই। টুসটাস্ টুসটাস্।এমনি শব্দ করতে করতে স্যাঁৎ করে আগুন জ্বলে উঠলো। চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদ। তখন কী আর আগুন থামানো যায়?পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো পুরো জুম আর ছয়কুড়ি ঘরের আদাম (গ্রাম)।

রোঙ্যাবেঙার দুই বনমোরগের লড়াইয়ের সাথে জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর লড়াইয়ের মধ্যে সাদৃশ্য দেখতে পাচ্ছি।একযুগ লড়াই করেও এখনো তাদের মধ্যেকার খুনোখুনি, রক্তারক্তি থামেনি। এ অবস্থায় সরকার, সেনাবাহিনী ও সেটেলার লাগবে না। জেএসএস-ইউপিডিএফই মারামারি করে পুরো জুম্মজাতিকে লেলিহান শিখায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে পারে।
অতএব, জনগণ জেএসএস-ইউপিডিএফ হতে সাবধান।
*******
অডঙ চাকমা, ২৬ মে ২০১১