দার্শনিক পটভূমি ও চর্যাপদের দর্শনঃ
ভারতবর্ষের,বিশেষত বাংলা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের,বস্তুবাদী চেতনার অবিকশিত ও ব্যার্থ ধারার ফসল হচ্ছে চর্‍যাপদ।তন্ত্রবিশ্বাসী বৌদ্ধ সাধকদের ইশতিহার হিসেবে কমপক্ষে তিন শতাব্দী ধরে গঠন করা হয়েছিল এর আন্তর কাঠামো-আঁধার ও আধেয়।প্রথম থেকেই এই চর্যাগুলো ব্যস্ত ছিল দেহের নানা ধরণের ইন্দ্রিয় ও এদের নিয়ন্রণের ব্যবস্থাপত্র তৈরীতে;এবং এ ব্যাবস্থাপত্র যারা রচনা করেছিল ও যাদের উদ্দেশ্যে রচিত হতো তারা মূলত ছিল গ্রামের প্রান্তীয় জনগোষ্ঠী।এর পদকর্তারা ছিল দুঃস্থ ও নিরীহ;এবং এরা ছিল তান্ত্রিক ও তন্ত্রপ্রিয়। তন্র কাজ করে মানবদেহ নিয়ে;স্থূল ও অশ্লীলভাবে চিত্রিত করে দেহকে এবং সম্ভোগ-মিলনের পথকেই আধ্যাত্ন-মুক্তির প্রধান প্রপঞ্চ করে তোলে।ফলে চর্যার ভাষায় প্রকট হয়ে উঠে গ্রাম্য সরসতা;যদিও শেষের দিকের চর্যাগুলোতে এ প্রবণতা কমতে দেখা যায়।মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাগুলোকে উদ্ধার করে এনে ঘোষণা করেছিলেন যে চর্যা বাংগালীর জন্য জরুরী শুধু এর সাহিত্যগুণের জন্য-এর দার্শনিক দিক নিয়ে তর্ক করার জন্য নয়।কেননা চর্যাপদ দাবি করে এর ভাষা হচ্ছে সান্ধ্যভাষা অর্থ্যাৎ একে খানিকটা বুঝা যাবে খানিকটা যাবে না;তবে যারা তান্ত্রিক কেবলমাত্র তারাই এর সব কিছু বুঝতে পারবে।দ্বিতীয় চর্যায় তো কুক্কুরীপাদ দাবিই করেছেন যে কোটিজনের মাঝে কেবল একজন বুঝতে পারবে এর ভাষা।হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সাথে সকলেই একমত।তবুও মাঝে মাঝে ইতিহাস উল্টিয়ে দেখতে হয় কী দৃষ্টিভংগী লালন করত চর্যার পদকর্তারা ;আর কীভাবে তারা অন্ধকারে থেকেও আলোকিত করে গেছে বাংলা সাহিত্যকে।

৫৬৩(খ্রিঃপূঃ)সালে জন্মগ্রহণ করা গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের যা কিছু শিখিয়েছিলেন সেগুলোর মধ্যে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে যায় এমন সব মতবাদ বাদ দিলে যা কিছু প্রধান থাকে তা হচ্ছে অনাত্নাবাদ, প্রতীত্য সমুৎপাদ ও ক্ষণিকবাদ।এখানে ঈশ্বরের স্থান নেই।ফলে বৌদ্ধ দশর্ন অনীশ্বরবাদী দর্শনও বটে।বৌদ্ধ দর্শনের প্রধানতম ভাষ্যকার হলেন নাগসেন,নাগার্জুন,অসঙ্গ,দিগনাঙ্গ ও ধর্মকীর্তি।এদের উদ্ভব ও বিলয় ১৫০ খ্রিঃপূঃ থেকে শুরু করে ৬০০ খ্রিঃ এর মধ্যে। এর পর আর কোন প্রধান বা গুরূত্বপূর্ণ ভাষ্যকারের নাম পাওয়া যায় না।শুধু পাওয়া যায় বৌদ্ধধর্মের নানা ধরনের শাখা ও উপশাখা কিংবা প্রশাখার নাম।অবশ্য এরও আগে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে বা ঐ সময়ে (২৬৯ খিঃপূঃ )বৌদ্ধধর্ম ভাগ হয়ে যায় কমপক্ষে আঠারোটি ভাগে যেগুলো কি-না আবার দুটি প্রধান বিভাগ-মহাসাংঘিক ও স্থবিরবাদ-হতে সৃষ্ট।এ দুটি বিভাগ পরবতীর্তে(৭৮ খ্রিঃ)মহাযান ও হীনযান নামে আত্নপ্রকাশ করে।হীনযানীদের ধর্ম-সাহিত্য রচিত হয় পালি ভাষায় আর মহাযানীদের সাহিত্য পাওয়া যায় মূলত সংস্কৃত ভাষায়।পালি ছিল তখনকার সাধারণ বা প্রাকৃত জনের ভাষা। মহাযানী মতবাদ ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্ম প্রভাবিত হওয়ায় ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের প্রভাবে পরবর্তীতে এটি ভারতবর্ষ থেকে লোপ পায়।হীনযানীরা মূল পালি ত্রিপিটককে তাদের মূলগ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করে।এ অঞ্চলের বৌদ্ধরা মূলত হীনযানী বা স্থবিরবাদী।পরবর্তী আলোচনায় আমাদের ব্যস্ত থাকতে হবে হীনযানীদের নিয়েই কেননা এ শাখার নানা পথ পরিক্রমায় তৈরী হয়েছে চর্‍যাপদের সৃষ্টিকর্তাদের বা সহজিয়াদের।বুদ্ধত্ব লাভের পর বৌদ্ধ যে বাণী দিয়েছেন তা অনুসরণ করতে আগ্রহী হীনযানীরা।অর্থ্যাৎ বুদ্ধত্ব লাভই হীনযানীদের মূলকথা।কিন্তু মহাযানীরা মনে করে জগতে সকলের বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত না হওয়া পর্‍যন্ত বোধিসত্ত্ব অর্থ্যাৎ বুদ্ধত্ব সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞানী হয়ে থাকাই শ্রেয়।এদিক থেকে বিচার করলে মহাযানীরা সকলের জন্য বুদ্ধত্ব চান;অন্যদিকে হীনযানীরা ‘ব্যক্তি আলাদা আলাদা ভাবে বুদ্ধত্ব বা মোক্ষ লাভ করবে’ এ মতে বিশ্বাসী।হীনযানীদের এ আকাংখাই, অর্থ্যাৎ শূন্যতা লাভের আকাঙ্ক্ষা, পরবর্তীতে ভিন্ন পরিস্থিতিতে তান্ত্রিকতার প্রভাবে সহজিয়া মতবাদে রূপ নেয়।এবং সহজিয়ারা আশা করতে থাকে যে চরমসুখ(নির্বাণ লাভের বিকৃত রূপ)লাভ করা যায় তন্ত্র ও যোগ নির্দেশিত পথ ধরে অর্থ্যাৎ ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করে।

তন্ত্র কী?সহজ কথায় ‘যাহা আছে দেহভান্ডে তাহাই আছে ব্রক্ষ্মান্ডে’-এ মতই মোটামুটি সকল তন্ত্রের সিদ্ধান্ত ।তান্ত্রিক কিয়া-কর্ম বা আচরণ বাংলায় বহু আগে থেকেই বর্তমান।শশীভূষণ দাশগুপ্ত বলেন-“Tantrism is neither Buddhist nor Hindu in origin ,it seems to be a religious under-current,originally independent of any obstruse speculation flowing from an obscure point of time in the religious history of India with these practices and Yogic processes,which characterize Tantrism as a whole,different philosophical,or rather theological systems got closely associated in different times……………….[This]when associated with the Buddhistic speculations have given rise to the composite religious system of Buddhist Trantrism”.(The obscure religious cults as background for Bengali literature;Dr S.B.Dasgupta)ডঃ আহমদ শরীফ বলেন-“ আমাদের ভুললে চলবে না যে বাংগালী মুখে বর্হিদেশীয় ধর্ম ও দর্শন গ্রহণ করেছে বটে কিন্তু নিজের জীবন-জীবিকার অনুকূল না হলে তা কখনো বুকের সত্য কিংবা মর্মের তত্ত্ব রূপে বরণ করেনি।তাই এখানে বৌদ্ধ,ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্ম ও ইসলাম বিকৃত হয়েছে।বাংগালী সাংখ্যসম্মত ‘যোগতন্ত্রভিত্তিক জীবন-চর্যা গ্রহণ করে নামসার বৌদ্ধমতের আবরণে।কালক্রমে তারই বিবর্তিত রূপ পাই বজ্র-সহজ কালচক্র-মন্ত্র প্রভৃতি বিকৃত বৌদ্ধযানে বা মতে।(বাউল ও সূফী সাহিত্য;আহমদ শরীফ/সংকলকঃডঃ নেহাল করিম)
কৃষিজীবি অনার্য বাংগালীর দর্শন মূলত গড়ে উঠেছে মৈথুন,টোটেম ও পরবর্তীতে তন্ত্র ও যোগাচারকে কেন্দ্র করে।যেমন পাঁচকড়ি ব্যানার্জী বলছেন-‘তন্ত্র অতি প্রাচীন,তন্ত্র ধর্মই বাংলার আদিম ধর্ম এবং ইহা অবৈদিক ও অনার্য।হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে বৌদ্ধমত সাংখ্যমত হতে উৎপন্ন হয়েছে।(বৌদ্ধধর্মঃহরপ্রসাদ শাস্ত্রী)।শশীভূষণ দাশগুপ্ত আরো বলেন যে বাংলাদেশ ও পূর্ব-ভারতীয় অঞ্চলগুলোতে এই তন্ত্র প্রভাব খ্রীস্টীয় ৮ম হতে ১২শ সাল পর্‍যন্ত মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে একে বজ্রযান,সহজযান প্রভৃতি তান্ত্রিক ধর্মে রূপান্তর করেছে।তাঁর মতে এই তন্ত্র সাধনার একটি বিশেষ ধারা বৌদ্ধ দোহা কোষ এবং চর্‍যাগীতিগুলির ভিতর দিয়ে সহজিয়ারূপ ধারণ করেছে।(শাক্ত সাহিত্য;শশীভূষণ দাশগুপ্ত)।আদি মৈথুনতত্ত্ব থেকে কীভাবে তন্ত্র সাধনার বিভিন্ন মত উদ্ভূত হয়েছে তা অবশ্য ধাপে ধাপে বর্ণনা করার মত মাল-মসলা পাওয়া যায় না।তবে ইতিহাসে দেখা যায় পাল আমলে আদি অনার্য-সংস্কার ব্রাক্ষ্মণ্যমত আর মহাযান বৌদ্ধমতের সমন্বয়ে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম,মন্ত্রযান-বজ্রযান-কালচক্রযান ও শেষে সহজযান সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে।(বাউল তত্ত্ব;আহমদ শরীফ)

সহজযানীরা দেব-দেবী,পূজা,মন্ত্র এ সমস্ত আচার আচরণের বিরোধী।বৌদ্ধ সহজিয়া মতে ‘প্রজ্ঞা ও উপায়ের’( যা কিনা মহাযানীদের শূন্যতা ও করূনা)মিলনে একটি পরম সুখময় অদ্বয় অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া যায়।এটিই পরবর্তীতে তন্ত্র শাস্তের ইড়া-পিঙ্গলা,ললনা-রসনা,আলি-কালি ইত্যাদি প্রতীকে রূপ নিয়েছে।যেমন ৭ নং চর্যায় আছে-“আলিএ কালিএ বাট রুন্ধেলা/তা দেখি কাহ্ন বিমনা ভইলা”।চর্যাপদের চর্যাগুলো পড়ে অনেকে এ ধারণা করেন যে সহজযানীদের মধ্যে দুরকম সাধন পদ্ধতি চালু ছিল-একটি মৈথুনাত্নক তান্ত্রিকপদ্ধতি ও অপরটি প্রকৃতিবর্জিত বিশুদ্ধ যোগ-প্রণালী বা কায়াসাধন।

বৌদ্ধ সহজিয়াদে তন্ত্রের মূল কর্মকান্ড কী?সোজা কথায় এরা শুক্রের ধ্বংস চায় না।কেননা শুক্র নির্গত হলে শক্তি ক্ষয় হয়।শুক্রের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হল এটি ডিম্বাণুর সাথে মিলে আরেকটি সত্তা তৈরী করতে পারে।সুতরাং শুক্ররূপী এ শক্তি যদি দেহের বাইরে নির্গমিত হয় তবে মোক্ষলাভ করা যাবে না।কেননা তাতে দেহের শক্তি নষ্ট হয়ে যায়।সুতরাং এ শক্তিকে দেহের ভেতরে জমিয়ে রাখা চাই।আর তা করতে গেলে,সহজিয়াদের মতে,কিছু প্রক্রিয়ার মখ্য দিয়ে যেতে হয়।এ সাধকেরা দেহে চারটি চক্র নির্দেশ করেন-১)নির্মাণ চক্র(জননেন্দ্রিয় থেকে নাভি পর্‍যন্ত)২)ধর্মচক্র(হৃদয়) ৩) সম্ভোগ চক্র(কন্ঠ) ৪) মহাসুখ চক্র।(মস্তক)।কী অবস্থা দেখছেন!! হিন্দু তন্ত্রে দেখা যায় ইড়া-পিঙ্গলা বা গংগা-যমুনা দেহের দুপাশে অবস্থান করে।যোগ সাধনার মাধ্যমে একে সুষুম্নাকান্ডের দিকে নিয়ে যেতে হয়।এটিই পরমানন্দ লাভের পথ।বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকেরা বলেন ললনা ও রসনার মিলনে সংবৃত-বোধিচিত্ত উৎপন্ন হয়।এবং এটি অবস্থান করে নির্মাণ কায়ে।নির্মাণ কায়ে অবস্থান কালে এটি নিচের দিকে ধাবিত হতে চায় শুধু।যোগসাধনা বলে একে উর্ধ্বগামী করতে পারলে সে রূপান্তরিত হয় পারমার্থিক বোধিচিত্তে।এই পারমার্থিক বোধিচিত্তকেই চর্যাপদে সহজসুন্দরী,নৈরামণি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়।(চর্যাগীতিকা;সম্পাঃআবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা)।তবে তন্ত্র দ্বারা প্রভাবিত হলেও চর্যাপদে বশীকরণ,মারণ,ঊচাটন ইত্যাদি তান্ত্রিক কিয়াকলাপের হদিস পাওয়া যায় না।

(চলবে)