এহন দ বালা ঐ। বাচুনের কোনো কতা আচিল না। হিদ্ধ ধানে গেরা জ্বালাইছে।
প্রভাতীর এ কথায় মা বুঝতে পারেন তিনি মরণ পথ থেকে ফিরে এসেছেন। এ নিয়ে অবশ্য তার মনে কোন আনন্দ বা বিষাদ অথবা ক্ষোভ কিংবা উল্লাসবোধ কোন কিছুরই উদ্রেক হচ্ছে না। বেঁচে আছেন। এই বেঁচে থাকা নিয়ে আবেগ প্রকাশ করার মত কোন কারণ বা যুক্তি আছে বলে তার আর মনে হয় না। তিনি ভাবছেন, মরে গেলে যেতাম। বেঁচে আছি যখন তখন বেশ আছি। ভালইতো আছি। হাসপাতালে ছেলে অতল ও ছেলে বউ আদ্রতার আদর যত্নে আছি। প্রভাতী তো আছেই। আমার না মরলেও সমস্যা নেই।কিন্তু বেঁচে থাকলেও তো কেউ উপকৃত হচ্ছে না। তবে বাঁচব কেন! আবার কারও জন্য যখন অসুবিধা বা সুবিধা কিছুই সৃষ্টি করছি না তখন বেঁচে থেকে লাভ কি? আমার তো কোন কিছুতে কোন ভূমিকাই নেই।
পরক্ষণেই ভাবছেন, নাকি, ভুল ভাবছেন। একটু আছে। আমার বেঁচে থাকায় অতল ওআদ্রতার সময় দখল করছি। অথবা দখল করিনি। তারাই আমার সময়ে বসবাস করছে।
এলোমেলো ভাবনায় সকাল অতিবাহিত হচ্ছে। মরে যেতে হবে বলে হাপিত্যেশ বোধ —- এমন কোনও অনুভূতি মায়ের নেই। আছি তো আছি। মরব কেন? আবার বাঁচবই বা কেন? জানি না। অনুভূতি কোনটাই সায় দেয় না। মনে হয় সাহিত্যের সৃষ্ট চরিত্রের মত জীবন। লেখক চাইলে বাঁচবেন। মারলে মরবেন। চরিত্রের কি? কোন কোন চরিত্র মরলে পাঠক কাঁদে। এখানে পাঠক তার ছেলে মেয়ে। ছেলের বউয়ের কান্না শূন্যতার জন্য নয়। সামাজিকতার জন্য হবে। নাতনিটি কাঁদবে মিশ্র অনুভুতিতে। কিছুটা মা বাবার দেখাদেখি। কিছুটা দিদার অনুপস্থিতিকে মনে নিয়ে—- দিদাকে আর দেখতে পাবে না বলে।
ছেলে মেয়ের মধ্যে কি মায়ের অনুপস্থিতিতে শূন্যতার সৃষ্টি হবে! মায়ের ধারণা ততটা হবে না। পরিণত বয়সে মরছেন বলে মায়ের গল্প শেষ। কম বয়সে মরলে মায়ের অভাব ছেলেমেয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেত আজীবন । শোকের ডালপালা আরেকটু বেশি মেলতো। এখন তার গাছের গুঁড়িতে অন্য গাছ,অন্য ফসল। তার জমি অন্য প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে। কাহিনী আর ডালপালা মেলবে না।
কাছের দূরের সবারই একটা অনিবার্য সংলাপ হবে, ভালই হয়েছে, উনি ভাগ্যবতী। নিজেও ভোগেননি, অন্যকেও ভোগাননি।
অর্থাৎ কষ্ট করে ও কষ্ট দিয়ে বাঁচা পরিবার, সমাজ কেউ চায় না। অথচ নেদারল্যান্ডের ইচ্ছামৃত্যুর আইনী স্বীকৃতিকে এদেশে নিন্দা করা হয়।
মা ভাবছেন, আসলে বাঁচি আর মরি না কেন — আমার কাহিনী ফুরাল নটে গাছটি মুরাল।
মা এমনিতে রবীন্দ্র সংগীত ভালবাসেন। শু্নেন। কিছু কিছু নজরুলগীতিও। অন্য কোন গান যে একেবারে শুনেন না তা নয়। তবে বেছে বেছে। এমনি একটি আধুনিক গান একাকী বিকেল ক্লান্ত দুপুর বেলা …।। গানটি মাকে একটু কষ্ট দেয়। কারণ তার কোন ক্লান্ত দুপুর ছিল না। ব্যস্ত। ব্যস্ততা ছাড়া প্রহর কাটেনি।
চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত ছেলে মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত। কাজেই সকালে হাঁটতে বের হওয়ার সময় বের করতে পারেননি।এরপর পাঠ্যাভাসের ব্যস্ততার জন্য অধিক রাত জেগে সকালে উঠতে পারতেন না। তাছাড়া তো ছিল সকাল আটটায় অফিস ধরা।
এখন নির্ঘুম ভোর কাটে। জানালা খুলে তা উপভোগ করতে পারেন না। সামনের দালানে চোখ আটকে যায়। সরকারী নিয়ম নীতির জন্য সব একই মাপের উচ্চতার দালান। তাছাড়া জানালা খুললে ভোরের ঠান্ডা বাতাস নিজের শরীর শুষে নেয়। ঠান্ডা লেগে যায়। ।
জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে তার অনুভূতির তীক্ষ্ণতম সূক্ষ্মতম তার আর বাজে না। এখন শুধুই সময় বইয়ে দেয়া। এরপর কি জানেন না। জানতে চানও না। আলো না অন্ধকার? আলোই মনে হয়। মন থেকে— দেহ থেকে একটা ফোঁটা আলো বিচ্ছুরিত হয়ে পড়বে আলোর সমুদ্রে। বিলীন হয়ে যাবে। নাকি অন্ধকারের গহীনে? জানেন না। এ ই তো প্রকৃতির স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। এখন আছি। তখনও হয়তো বা থাকবে অন্য কোন অবয়বে। অথবা থাকবে না।
অতল অফিস থেকে এসে মায়ের কাছে বসে। সারাদিনের খোঁজ খবর নেয়। ভাল লাগে। কোন কোনদিন কাছে আসে না। মা ধরেই নেন আসতে পারেনি। এ নিয়ে ভেতরে কোন রকম আক্ষেপ হয় না। নিশ্চয়ই আজ ক্লান্ত। অথবা অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে গেছে। যাহোক একটা কিছু।
ঢাকার বাইরে গেলে বলে যায়। ঐদিন সারা সন্ধ্যা অতলের অপেক্ষায় ছিলেন। আসেনি। পরের দিন এসে বলার পর মনে হল সে বলেই গেছিল ঢাকায় থাকবে না।
অথচ একটু আধটু অভিমান জমা হতে গিয়েও পাত্তা দেননি। মা চান না তার কোন দীর্ঘশ্বাস ছেলের জীবনে পড়ুক।
কাজেই মায়ের মনই যে মনে রাখে না তা মাকেই বুঝতে হবে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলের ব্যস্ত জীবনের মায়ের দায় জড়িয়ে গেছে। এমনই যায়। ছেলেকে কষ্ট দেওয়া বা বিব্রত করা তার ইচ্ছের বিপরীতে মাঝে মাঝে ঘটে এবং ঘটছে।
মেয়ে প্রতিদিন কানাডা থেকে ফোন করে। খবর নেয় মা কি এবং কী খেয়েছে। ঘুম হয়েছে কি না। প্রভাতীর সাথে কথা বলে।
মা তাদের প্রশ্নোত্তরে বুঝতে পারে মেয়ে প্রভাতীকে জিজ্ঞেস করে, আদ্রতা কি বলে? দাদা কাছে বসে তো?
মা এসব প্রশ্নকে প্রশ্রয় দেন না। তার উপযোগিতা যে তলানিতে তা তার থেকে আর কে বেশি জানে!
ছিলেন নিজের বাসায়। সময়ও ভালই কাটত। সেই কবে ঢাকায় এসেছিলেন। উঠেছিলেন এক কক্ষের ভাড়া বাসায়। সাবলেট। পরে দুই কক্ষ একটা বাথরুম। পরে ড্রয়িং, ডাইনিং ছাড়াও তিন কক্ষ এবং সাথে দুটো বাথরুম। ধীরে ধীরে বেতনের টাকা হিসেব করে করে বাসা বদল। প্রথমে ট্রেন থেকে নেমে রিকসা করেই মালামাল নিয়ে বাসায় ওঠা। পরে ঠেলা গাড়ী। আরও পরে ট্রাক। শেষবার ভাড়া বাসা থেকে মালামাল আনতে ট্রাক ভাড়া করেছিলেন। আরেকবার অতলের বাবার মৃতদেহ গ্রামের বাড়ি নিতে। এখন আরেকবার নিজের মৃত দেহ বাসা থেকে কোথাও নিতে ট্রাক লাগবে।
মা এখন তৃতীয়বার এ পরিবারের ট্রাক ভাড়া করার জন্য অপেক্ষায় আছেন।
নিজের করা বাসায় দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর কাটিয়ে গত সপ্তাহে অবচেতন অবস্থায় হাসপাতালে। বউমা আদ্রতার কর্তব্যে কোন অবহেলা নেই। কর্তব্য করছে ভেবে তৃপ্ত যে আছে তার মুখ দেখলে মনে হয়। তবে আবেগে আপ্লুত নয়। মা জানে এটাই স্বাভাবিক। মায়ের অসুস্থ্যতা আর শাশুড়ির অসুস্থ্যতা এক নয়। ছেলে অতলও নিশ্চয়ই তার শাশুড়ির জন্য আপ্লুত হয় না। তাহলে মা কেন তার ছেলের বউয়ের কাছে তা আশা করবেন?
ছেলের বউ খাওয়া দাওয়ার খবর নেয়। কিন্তু সকালে দেখতে আসতে পারে না। অফিসে যাবার তাড়া থাকে। ফলের রস ছেলেকে দিয়ে পাঠায়। তবুও সকালে উঠে ঝটপট ফলের রস বানাতে ও পাঠাতে ভুলে না। বিকালে ডাক্তারের পরামর্শ মত একটা আপেল সিদ্ধ। বউই নিয়ে আসে। ছেলে ও বউ আলাদা সময়ে বাসায় ফেরে। বউই ফল কিনে আনে। মায়ের পছন্দের ফলই আনে। আনার। আম, ছোট শবরি কলা। আপেল পছন্দ না হলেও খান। সিদ্ধ আপেল খেতে হয়।
ছেলের বউ ছুটির দিন একটু বেশি খবর নেয়। বিকেলে এক সাথে চা খায়।দুপুরটা শাশুড়ির সাথে কাটায়। মায়ের কাছে তা যথেষ্ট মনে হয়। মা তার পছন্দের রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে চলে যেতে বলেন। যায় না। বিছানার কাছেই বসে বই পড়ে। মায়ের পছন্দের হলে দুয়েক লাইন পড়েও শুনায়। এক সময়ে কবিতা শুনাত। এখন মনে হয় বউ নিজেই কবিতা পড়ে কম।
ছেলে ও বউ মায়ের অসুস্থতায় যত্নবান না হলেও মা অবাক হতেন না। জীবনের অগ্রাধিকারে মা না থাকলে মাকে সেখানে জোর করে বসাতে তিনি চান না। আবার নিজেকে নিয়ে তাদের আবেগ মাকে মথিত করলেও তিনি তা প্রশ্রয় দেন না। এখন আর কষ্ট বাড়িয়ে লাভ নেই।
নিজের বাসায় প্রভাতীকে নিয়ে ভালই ছিলেন। স্বাধীনভাবে। মায়ের অন্তর্জগতে অলোড়িত হতো — শোধ নয়, বোধ নয়, শুধু বয়ে চলা কি জীবন? খাও, ঘুমাও আর এর যোগান দিতে ছেলে মেয়ে ও বউমা ব্যস্ত। জীবিকা হিসেবে কিছু একটা করার বয়স শেষ। এই কি জীবনের লক্ষ্য? এ চেতনা মাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।এ অনুভূতি থেকে মুক্তি পেতে নিজের বাসায় স্বাধীনভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মা নিজের সময় মত বই পড়ে, গান শুনে সময় যেত। এ সবকে অনেকেই কোন কাজ বলে মনে করে না। মা শুধু কাজ মনে করে না, যত্ন সহকারে করে এবং খাওয়া আর হাগার মত জীবনের অনিবার্য অংশ হিসেবে মনে করে। তাই এক সময়ে নিজের মত করে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
ছেলের বউ সরকারী বাসা পাওয়ার পর মায়েরটা ভাড়া দিয়ে ওখানে উঠার প্রস্তাব দিতেই সুযোগ পান।
বলেন,তোমরা ওখানে উঠো, বউয়ের অফিস কাছে। যানজটে এত দূর থেকে যাওয়ার সময় বাঁচবে। নাতনীটারও স্কুল কাছে। আমি প্রভাতীকে নিয়ে এখানেই থাকি।
তখন আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে অহেতুক উপদেশ পেয়েছিলেন, একা একা এক বাসায় পড়ে আছেন কেন?
মা কিন্তু পড়ে ছিলেন না। মায়ের দৈনন্দিন জীবনে কোন হেরফের হয়নি। পঁয়ত্রিশ বছরের ব্যবহৃত রুমটা ছেড়ে যেতে মন চায়নি। হাসপাতালে এসে বরং এর অভাববোধ করছেন।
সরকারী বাসা পাওয়ার পরপরই এক বিকেলে মাকে নিয়েই অতল ও আদ্রতা বাসা দেখতে গেছে। পরে বাসা ঘুরে এসে মা বলেছেন, জানোই তো আমার তো উঁচু কমোট ছাড়া বসতে অসুবিধা হয়। আর্থাইটিজের রুগী আমি।
অজুহাত হলেও এটাও ছিল বাস্তব সমস্যা। বরাদ্ধ পাওয়ার পরও দখল নিতে ও ছোট খাট সংস্কার করে বাসায় উঠাতে তাদের সময় লেগেছিল মাস তিনেক। পায়খানায় গেলে সমতল কমোটে দুইবার জল ঢালতে হয়। উঁচু কমোট হলে দুইবার ফ্লাশ করতে হয়। এখন ঢাকা শহরে জলের অভাব। পাইপে জল না থাকলে উঁচু কমোট ব্যবহার অসম্ভব। তবুও এরই মধ্যে দুটো বাথরুমে উঁচু কমোট লাগানোও শেষ। প্রতি সপ্তাহেই ছেলে ও বউ সেধেছ। পরে নাতনীকে দিয়ে গো ধরিয়েছে। তবুও যাননি। তবে না ও করেননি।
বলেছেন, তোমরা উঠো, সব ঠিকঠাক কর। আমি পরে সুযোগ বুঝে যাব।
সে সুযোগ বছর ঘুরলেও হয়ে উঠেনি। এরই মধ্যে তো অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে।
এখন মায়ের কাছ থেকে কেউ কিছু চায় না। তাদের ধারণা এবং তা ই সত্য যে মায়ের বস্তুগত কিছু দেয়ার নেই। নেই। বেশিক্ষণ কথাও বলতে পারেন না। বেশি কথা বললে দম নিতে কষ্ট হয়।
হাসপাতাল থেকে মাকে সরাসরি সরকারী বাসায় নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু যে সক্ষমতার সময় স্বেচ্ছায় আসেননি তাকে এখন নিয়ে যাওয়াটা ছেলের ভাল লাগেনি। ছেলের বউ আদ্রতা চেয়েছিল নিয়ে আসতে। এক বাসায় থেকে আরেক বাসায় রোগীর দেখাশুনা তাদের জন্য ব্যয় সাধ্য হলেও সময় ও যোগাযোগ অসাধ্য বিষয়। তবুও অতল মায়ের বাসায়ই মাকে উঠিয়েছে। নিজেরাও উঠেছে। উঠেছে বলতে ছুটির দিন নাতনি ও আদ্রতা আসে। অতল এখান থেকেই অফিস করে।
দরজাটা মা লাগিয়েছে। এতেই অতল বুঝতে পারছে উপরের ছিটকিনি লাগিয়েছে। নুইয়ে নীচের ছিটকিনি লাগানোর মত কোমড়ের বয়স নেই। তাই বাতি না জ্বেলে প্রথমে উপরের ছিটকিনিতেই হাত লাগায়। দেখে ছিটকিনিটি আসলে লাগানো হয়নি। লাগানো যে হয়নি তা ও মাকে বুঝতে দেয়নি। অতল ইচ্ছে করেই শব্দ করে যেন ছিটকিনি খুলছে। তা না হলে ছিটকিনি না লাগিয়ে যে ঘুমিয়েছে তা প্রকাশ হয়ে গেলে মা নিজেকে অসহায় ভাববেন। মনে মনে কষ্ট তো পাবেনই আর সারাদিন এ নিয়ে বার বার আফসোস করবেন।
ছিটকিনি খোলার শব্দেই মা জেগে উঠল। অথবা জেগেই ছিলেন। বললেন, এতরাতে বারান্দায় যাচ্ছিস কেন?
সকাল হয়েছে। দরজা জানালা খুলে দিলে তোমার ভাল লাগবে।
বাইরে পাশের নির্মাণাধীন বিল্ডিং এ দুহাজার পাওয়ারের বাল্ব জ্বালানো। নতুন এপার্টমেন্টের কাজ চলছে। আজানের একটু আগে কাজ বন্ধ করেছে। কাজ বলতে ছাদ ঢালাই করেছে আর প্রায় প্রতিরাতেই ইট সিমেন্ট বালি আনে। ভি আই পি রাস্তার পাশে বলে দিনের বেলা ট্রাক চলাচল নিষেধ। রাতে মাল এনে দিনের যানজট কমানোর সাথে সাথে রাতে পাড়ার সবার ঘুমও কমিয়ে দেয়। পুরানো বাড়ি ভাঙ্গার পর অনেকদিন কাজ বন্ধ ছিল। এখন রাতদিন কাজ করছে, যার শব্দে দক্ষিণের দরজা জানালা খোলা দায়। শব্দ আর বালি ঘর আর কানকে বিধ্বস্থ করছে।
অতল মায়ের অসুখ নিয়ে মাকে কিছুই জানায়নি। মা জানে না তিনি আর মাত্র মাস খানেক বাঁচবেন। পড়তে পারেন না। কিছু পড়ে শুনাতে বললেও শুনতে চান না। গান বাজালে বিরক্ত হন। তা রবীন্দ্র সংগীত হলেও। এমনিই শুয়ে থাকেন। ঘরে পায়চারি করেন।
অতল ছোটবোনকে আসতে বলেছে। মাকে তা জানাতেই বললেন, মাত্র ছয়মাস আগে এসে গেল। এখন আর আসার দরকার কি? বাচ্চার স্কুল খোলা।
অতলকে বলেছে, আমি তো এখন নিজেই চলাফেরা করতে পারি। আদ্রতা একলা সব সামলায়। ওই বাসায়ই গিয়ে থাক। প্রভাতী তো আছেই। কোন সমস্যা হলে ফোন করা যাবে।
মা শাশুড়ি হয়েও আদ্রতার প্রতি বরাবরই দুর্বল। বুদ্ধিমতি শাশুড়ি তিনি। জানেন উনার ছেলের সুখের সাথে বউমা আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িত। আদ্রতা খুশি তো অতলও সুখী। বউ হয়েও আদ্রতা শুরু থেকে বরাবরই জামাই আদর পেয়ে এসেছে।
আদ্রতা বুঝতে পারে যে শাশুড়ি বুঝে গেছেন যে উনি কি অসুখে ভুগছেন। কিন্তু অতল ও ননদ তা জানে না। আদ্রতাও তা ওদের দুজনের কাউকে বলে না যে মা জানে। বলে তাদের স্বস্তিটুকু নষ্ট করতে চায় না।
মা মাস খানেক আগেই বুঝেছে তিনি এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত। ছেলে মেয়ে ও বউমার ধারণা মা বুঝতে পারেনি। মেয়ে মাকে শুধায়, পাসপোর্ট নবায়নসহ ভিসার কাজ নিজে এসেই করবে। মা না বুঝার ভান করে সারাক্ষণ। মা না জেনে, না শুনে সুখে মরছে ভেবে ছেলে মেয়ে যদি স্বস্থিতে থাকে এতেই মায়ের শান্তি।
ইস, যখন আমি এইভাবে ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াতে পারবো না, কাজ করতে পারবো না, লিখতে পারবো না, তখন আমি টুপ করে মরে গেলে অনেক ভালো লাগবে আমার।
গল্পটা অনেক ভালো লেগেছে। আপনার সবগুলো লেখা একসাথে করে একটা সংকলন করতে হবে। তার নাম দিতে হবে, “জীবন থেকে নেয়া”। (F)
@নীল রোদ্দুর,
আমার মত আরেকজনও আছে দেখি 😛 ৬০ পার করার ইচ্ছা নাই আমার। হয়ত পার করে দিতে পারি কিন্তু এখনকার ইচ্ছা না করারই। জীবনের টাইম বাজেট।
@টেকি সাফি,
এখনই এ নিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে লাভ নেই। এ মুহূর্তে বড়দের, বৃদ্ধদের অনুভতি অনুভব করা ও সেভাবে আচরণ করার আশা করছি।
@গীতা দাস,
হেঃহেঃ এটা আপনার পোষ্টের জন্য করা কমেন্ট নয়। এখনো পড়েই শেষ করা হয়নি 😛
আর দুঃখ? নাতো! আমি মনে করিনা আমার ৬০ পার হবার পর কাউকে কিছু দেয়ার থাকবে। একান্ত, একান্ত এবং একান্তই ব্যক্তিগত দর্শন।
@টেকি সাফি,
text না পড়েও মন্তব্য করার চর্চাও আছে নাকি! তবে নীল রোদ্দুরের উদ্দেশ্যে করা মন্তব্যে আমি দুঃখু দুঃখু ভাব পেয়েছিলাম ৬০ এর পরের জীবন যাপন নিয়ে।
আমি জীবনকে ভালবাসি। ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে”
যাহোক, আপনার হেঃ হেঃ এর জবাবে আপনি চাইলে আমার আগের করা মন্তব্য উঠিয়ে নিতে পারি।
@গীতা দাস,
আছে বলতে পারেন। হাতে সময় কম থাকলে বা ক্লান্ত থাকলে শুধু কমেন্ট পড়ে ধারানো নিতে চেষ্টা করি, টপিকটা কী। তবে আমার করা কমেন্টটা নীল রোদ্দুর কে উদ্দেশ্য করে।
আসলে আমার এ ধরণের বোধের কিছু অভাব রয়েছে। এই ধরুন কেও কেনো সুন্দর পৃথিবীতে দীর্ঘদিন থাকতে চাই তা খুব বুঝিনা আবার কেও কেনো আনন্দের মত পালিয়ে যায় তাও বুঝিনা :-s
আমি জীবনে খুব উপভোগ করি, কিন্তু ভালবাসি কিনা জানিনা। মনে হয় … “না।” 🙂
মন্তব্য উঠিয়ে নেয়ার মততো কিছু হয়নি দিদি। :-O
@নীল রোদ্দুে ভাবতর,
আমার ‘তখন ও এখন” বইটি মুক্ত-মনার পাঠকদেরই অবদান। গল্প সংকলনও বোধ হয় আপনার মত কারও কারও অবদান ও উদ্ধুদ্ধকরণেই সম্ভব হবে। তবে নামটা নিয়ে ভাবতে হবে আর কি। ধন্যবাদ ।
লেখাটি অনেক অনেক ভালো লাগলো। হৃদয় স্পর্শ করে গেল।
@মোজাফফর হোসেন,
এক গল্প লেখকের ভাল লেগেছে জেনে ”দ্বি ধা” মুক্ত হলাম।
@গীতা দাস, হা হা । দিদি, আপনি বেশ মজার মানুষ। এ জন্যই আপনাকে আমার এত ভালো লাগে…!
কথাগুলো বেশি সত্যি… নিজের জীবনে এক্কেবারে এমনটিই দেখেছি বলে পুরো গল্প জুড়েই মনে হচ্ছিলো – আপনি বুঝি আমার চোখ দিয়ে দেখেছেন, কিংবা আপনার চোখ দিয়ে আমি। সালাম!
@প্রতিফলন,
ধন্যবাদ সম অনুভবের জন্য।
মুদির দোকানে কাজ করি, অনেক বুড়ো-বুড়ি আসে। ঠিকঠাক মত হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না, তবুও বাজার করতে একা একা চলে আসে।
আর্থ-সামাজিক কাঠামোই হয়তো নির্ধারণ করে দেয়, আমাদের দৈনন্দিন আচরণ, আমাদের সম্পর্ক। এই কাঠামো যদ্দিন থাকবে, তদ্দিন উজান স্রোতের যাত্রীদের দীর্ঘশ্বাস, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে।
@স্বপন মাঝি,
হয়তো বা।
@গীতা দাস,
পুরোপুরি বুঝি নাই। কোন এলাকার ভাষা দিদি?
জীবনটা যে একটা নির্দিষ্ট সময়ের কাহিনি, আমরা সবাই যে জীবন নামক নাট্যমঞ্চের ক্ষণিকের চরিত্র, তা এই বয়স সায়াহ্নে এসে বুঝতে মোটেই অসুবিধে হচ্ছেনা। কিন্তু এটাই যে প্রকৃতির বিধান। প্রকৃতির এই লীলা খেলায় জীব জগতের অন্যান্য সকল সদস্যের মাঝে আমরাও কয়েক সদস্য মাত্র।
মনে দাগ কাটার মত, চিন্তাজাগানিয়া কঠিন বাস্তব কিছু কিছু কথা গল্পে আছে, যেমন- শাশুড়ির জন্যে পুত্রবধুর সমাজ দেখানো কান্না, ভি আই পি নামক বিশেষ মানুষের কারণে পাড়ার সাধারণ মানুষের ঘুম কেড়ে নেয়া।
বাস্তবধর্মী গল্পটি দারুণ হয়েছে। (F)
@আকাশ মালিক,
নরসিংদী অঞ্চলের ভাষা।মানে হল
এখন তো ভালই। বাঁচা র কোন কথা ছিল না। সিদ্ধ ধানে ঘেরা
( অঙুরোদগম) হয়েছে।
ভাল লেগেছে গল্পটি।
@তামান্না ঝুমু,
ধন্যবাদ, তবে ভাল লাগার একটু ক্লু দিলে আমার জন্য প্রেরণার কাজ করতো।
তবু মন্তব্য করা ও পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
গীতাদি,
পৃথিবীর সব মা’র চরিত্রই কি আপনার গল্পের মার মতো ?
মা সব বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকে সন্তানের সুখের আশায় !!
মা’র দশ মাস দশদিন সন্তানের পেটে ধারন করার এমনই জ্বালা,সে সুখের জ্বালা মা তার সারাজীবন হাজার বঞ্চনা,গঞ্জনার পরেও (স্থান,কাল ও পাত্রভেদে) সন্তানের সুখের আশায় দিন গুনতে গুনতে জীবন জীবনের তরে বিলিয়ে দিয়ে এই ধরা থেকে চিরবিদায় নেন।এমন পরোপোকারী মনোভাবের জীব প্রকৃতিতে আর নাই বললেই চলে।
আজ সামির অকাল প্রয়ানে তার মায়ের কি যে নিদারুন কষ্ট ও হদয়বিদারক হাহাকার যাচ্ছে তা আপনার গল্প পড়ার পর দারুন অনুভূত হচ্ছে।
@মাহবুব সাঈদ মামুন,
আমার তো তাই ধারণা।