পঠিত বলিয়া গণ্য হইল

এক বড় খামার বাড়ির মালিকের কাছে চাকরির জন্য একজন বেকার তরুণ ও একজন বেকার তরুণী এসেছে । খামার বাড়ির মালিক তাদেরকে বললো, আমার এখানে একজনকে চাকরি দিতে পারব। তোমাদের পরীক্ষা নেব। যে ভাল করবে তাকে আমি আমার এখানে চাকরি দেব।

তরুণ তরুণী দুজনেই পরীক্ষা দিতে রাজি। খামারের মালিক বললো, যাও, আমার খামার বাড়ি থেকে দুইজনে দুটো গাধা নিয়ে এসো।
তরুণ তরুণী খামার বাড়িতে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে তরুণটি একটি ঘোড়া নিয়ে এলো আর তরুণীটি কিছুই না নিয়ে ফিরে এলো।
লোকটি তরুণীটিকে চাকরিটি দিল। কেন দিল? কারণ কি?

তরুণীটির চাকরি হওয়ার কারণ হিসেবে তরুণটি বললো, জ়েন্ডার। নারী বলেই তরুণীটি চাকরি পেল।আমার কপাল পোড়া। পর জনমে হব রাধা। নারীকূলে জন্ম নেব।
একজন আমলা বললো, আরে, কোটা। কোটা পদ্ধতি। তার খামারে নারী পুরুষের ভারসাম্য রক্ষা করলো।
একজন পুরুষবাদী বললো, আরে, সুন্দর নারীর কদর সর্বত্র।
সাংবাদিকরা খবর ছাপলো, ফোন। উপরতলা থেকে টেলিফোন। সাথে অন্যান্যদের মন্তব্যেরও উদ্ধৃতি দিল।

খামার মালিকের কানে সবার মন্তব্যই পৌঁছেছে। তিনি এতে খুবই কষ্ট পেলেন এবং সংবাদ সম্মেলন করে ব্যাখ্যা দিলেন, তিনি দুজনের সাথেই পরে কথা বলেছিলেন। তরুণীটিকে তার কাছে বেশী বুদ্ধিমান মনে হয়েছে। কারণ তরুণটিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি গাধা চেনো না? তুমি ঘোড়া নিয়ে এলে কেন?
তরুণটি উত্তর দিয়েছিল, না, আমি গাধাও চিনি না, ঘোড়াও চিনি না। তবে অনুমানে একটা জন্তু নিয়ে এলাম। যদি মিলে যায়।তাছাড়া একটা কিছু নিয়ে এসেছি বলে নম্বর পাব।
মালিক পরে তরুণীটিকে বললো, তুমি কিছুই না নিয়ে এলে কেন?
তরুণীটির উত্তর, আমি গাধা চিনি না, তবে ঘোড়া চিনি। তাই গাধার পরিবর্তে ঘোড়া নিয়ে আসিনি।
কাজেই স্বাভাবিক কারণেই তরুণীটিকে চাকরিটি দেওয়া হলো। তরুণীটি গাধা না চিললেও ঘোড়া চিনে, কিন্তু তরুণটি ঘোড়া ও গাধা কোনটাই চিনে না। তবে গাধার বদলে ঘোড়া এনে একটা কিছু এনেছি বলে কৃতিত্ব নিতে চায়।

গল্পটি পড়েই অনেকে মনে মনে আমাকে নারীবাদী বলে গালি দেবেন। কেউ কেউ প্রকাশ্যে গালি না দিলেও নারীবাদী আখ্যা দিয়ে বুলি ছড়াবেন।
নারীবাদী কারও কারও কাছে কুখ্যাতি। আবার কারও কারও কাছে সুখ্যাতি তো বটেই, নারীবাদী পরিচয়ে গর্ব অনুভব করেন এবং আমিও তাদের সমর্থন করি। এরই অনুসরণে আমাকে নারীবাদী শব্দটি শুনতে হয় কখনও গালি হিসেবে, কখনও বুলি হিসেবে মানে নারী অধিকার নিয়ে কোন কথা বললে পাল্টা যুক্তি খুঁজে না পেয়ে বলেন, এ তো নারীবাদীদের যুক্তি। যদিও আমার যুক্তি বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংগৃহীত ।
আমার চাকরির সুবাদ আমাকে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বেসরকারী সংগঠনসমূহের কর্মী নিয়োগের কমিটিতে থাকতে হয়। আমার মতে বেসরকারী সংগঠনের জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ বিষয়টি ‘পঠিত বলিয়া গণ্য হইল’ এর মত। যদিও আমার শক্তিশালী ভূমিকার জন্য পঠনকটূ বিষয়কে প্রায়শঃই তারা পড়তে বাধ্য হয়।
পঠিত বলিয়া গণ্য হইল বাক্যটি বেসরকারী ও সরকারী অফিসের বহুল প্রচলিত। নিয়মিত সভাগুলোতে আগের মাসের রেজ্যুলেসন পরের মাসের সভায় পড়ে সময় অপচয় করতে চায় না বা সময়ের স্বল্পতার জন্য পড়ে না। অথবা পড়ার প্রয়োজন অনুভব করে না কিংবা পড়ার যৌক্তিকতা নেই। অথবা পড়তে গেলে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিমত হবে জেনেই এড়িয়ে যাওয়া। কারণ, কিছু সিদ্ধান্ত তো নির্বাহী আদেশে লিখিত হয়। তাছাড়া সভা শুরুই হয় সাধারণত নির্ধারিত সময়ের অন্তত ঘন্টা খানেক পরে। তখন সভার সভাপতি মহোদয় কৌশলে একুটু ভূমিকা দেন এবং অন্য একজন অত্যন্ত স্মার্টলি প্রস্তাব করেন, গত সভার রেজ্যুলেসন পঠিত বলে গণ্য হোক। সাথে সাথে দুয়েকজন তা সমর্থন করলেই না পড়েও পঠিত বলে গণ্য হয়ে অনুমোদন লাভ করে। পঠনকটূ অনেক বিষয় অপঠিত ও অনালোচিত থেকে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ইস্যু জায়েজ করা হয়।

বেসরকারী সংস্থার জেন্ডার নীতি নিয়েও এ কথা খাটে। তাদের ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সবার জেন্ডার বিষয়ক জ্ঞান পঠিত বলে গণ্য হয়। মেনে চলছে বলে সাব্যস্ত হয়। চর্চা হচ্ছে বলে প্রতিবেদিত হয়। জেন্ডার শুধু কাজীর গরুর মত কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই। কাজেই জেন্ডার বিষয়ক নীতি কাগজেই থাকে। প্রকল্প অনুমোদন পেতে দাতাদের কাছে জমা দিতে হয়।
সংস্থার লিখিত জেন্ডার নীতি আছে। জেন্ডার বৈষম্য বিলোপ মানে অর্গানোগ্রামে স্টাফের আনুপাতিক হারে নারীর সংখ্যা দেখাতে পারলেই নির্বাহী পরিচালকরা খুশী —— দাতাদের বলা যায়। অনেকেই জেন্ডার বলতে বুঝে কোন সভায় নারী পুরুষের পাশাপাশি বসা। কোন কর্মশালায় দলীয় আলোচনায় কোন টেবিলে নারী অংশগ্রহণকারী না থাকলে প্রশিক্ষক বা সহায়ক বসার ব্যবস্থা পুনর্বন্টন করে প্রত্যেক টেবিলে নারী অংশগ্রহণকারী বসান। নারী যেন বাহারী খন্ড। ডেকোরেসন পিস।

জেন্ডার বৈষম্য নিয়ে চারদিকে শত্রু শত্রু খেলা খেলে সবাই। ঘরে এবং বাইরে।সর্বত্র। খেলাতেও চায় এবং আমি তা বুঝি। তবে মুখে বা আচরণে অনেক সময় তা প্রকাশ করি না। এড়িয়ে যাই। অনর্থক পরিবেশকে অসুস্থ করতে চাই না। তবে এড়িয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। কারণ অনেকেরই ধারণা নারী ঘর থেকে বের হতে পারছে, চাকরি করতে পারছে, আর কি চায়? বক বাঘের গলায় মুখ ঢুকাইয়া হাড় বাহির করিয়াছে। বাঘ যে বককে চিবাইয়া খায় নাই তা কি বকের পুরষ্কার নয়! এ হল তাদের নারী ভাবনা।
অন্য আরেকটি দল কিশোরীদের বখাটেদের উপদ্রবে আত্মহত্যার খবর পড়ে অফিস কেন্টিনে দুপুরে খাবার সময়ে উঃ আঃ করে। এতে যে এর কোন প্রতিরোধ বা প্রতিষেধক নেই তা ভাবে না। শুধু নিজের থালার খাবার হয়তো এতে সুস্বাদু হয়। মহিমা, রুমী, তৃষা, ইলোরা,সিনিথিয়াদের আত্মহত্যা শুধুই টেবিল কথার বিষয়বস্থু হবে! এ নিয়ে উচ্যবাচ্য করা কি নারীবাদ। যদি হয়, তবে হোক। হেনার মৃত্যু নিয়ে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের বাতাস গরম করে ঠান্ডা বাড়িয়ে দিতে বলে কি নারীবাদী হওয়া যায়?

অনেকেই দৈনিক পত্রিকার খবর পড়ে ঝাল টক মিষ্টি খাওয়ার স্বাদ নেয়। আর এ নিয়ে যদি সক্রিয়ভাবে এর প্রতিবাদ করতে বলি, যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর যৌথভাবে স্মারক লিপি দিতে বলি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে সংঘটিত বিষয়টি নিয়ে ফলো আপ করতে উদ্যোগী হতে বলি তাহলে অন্যরা আমাকে নারীবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে। নারীবাদী হওয়া যে মেধার ব্যাপার নয়, কোন আকর্ষণীয় চাকরি পাওয়া নয়, কোন কৌশল বা দক্ষতা আয়ত্বে আনা নয় তা কিভাবে কাকে বুঝাবো! তবে নারীবাদী মাটি ফুঁড়ে আসবে না,গাছ থেকেও ফলবে না। সমাজ থেকেই সৃষ্টি হবে।
নারীবাদ এক বোধের নাম। নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির নাম। এক আদর্শের নাম। নারীকে নিপীড়ণ, বৈষম্য ও সহিংসতা থেকে মুক্ত করার সংগ্রামের নাম নারীবাদ। নারীকে শোষণের শিকার হতে ও বন্দিত্ব থেকে স্বাধীন করার ব্রতের নাম নারীবাদ। নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার নাম নারীবাদ।