পঠিত বলিয়া গণ্য হইল
এক বড় খামার বাড়ির মালিকের কাছে চাকরির জন্য একজন বেকার তরুণ ও একজন বেকার তরুণী এসেছে । খামার বাড়ির মালিক তাদেরকে বললো, আমার এখানে একজনকে চাকরি দিতে পারব। তোমাদের পরীক্ষা নেব। যে ভাল করবে তাকে আমি আমার এখানে চাকরি দেব।
তরুণ তরুণী দুজনেই পরীক্ষা দিতে রাজি। খামারের মালিক বললো, যাও, আমার খামার বাড়ি থেকে দুইজনে দুটো গাধা নিয়ে এসো।
তরুণ তরুণী খামার বাড়িতে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে তরুণটি একটি ঘোড়া নিয়ে এলো আর তরুণীটি কিছুই না নিয়ে ফিরে এলো।
লোকটি তরুণীটিকে চাকরিটি দিল। কেন দিল? কারণ কি?
তরুণীটির চাকরি হওয়ার কারণ হিসেবে তরুণটি বললো, জ়েন্ডার। নারী বলেই তরুণীটি চাকরি পেল।আমার কপাল পোড়া। পর জনমে হব রাধা। নারীকূলে জন্ম নেব।
একজন আমলা বললো, আরে, কোটা। কোটা পদ্ধতি। তার খামারে নারী পুরুষের ভারসাম্য রক্ষা করলো।
একজন পুরুষবাদী বললো, আরে, সুন্দর নারীর কদর সর্বত্র।
সাংবাদিকরা খবর ছাপলো, ফোন। উপরতলা থেকে টেলিফোন। সাথে অন্যান্যদের মন্তব্যেরও উদ্ধৃতি দিল।
খামার মালিকের কানে সবার মন্তব্যই পৌঁছেছে। তিনি এতে খুবই কষ্ট পেলেন এবং সংবাদ সম্মেলন করে ব্যাখ্যা দিলেন, তিনি দুজনের সাথেই পরে কথা বলেছিলেন। তরুণীটিকে তার কাছে বেশী বুদ্ধিমান মনে হয়েছে। কারণ তরুণটিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি গাধা চেনো না? তুমি ঘোড়া নিয়ে এলে কেন?
তরুণটি উত্তর দিয়েছিল, না, আমি গাধাও চিনি না, ঘোড়াও চিনি না। তবে অনুমানে একটা জন্তু নিয়ে এলাম। যদি মিলে যায়।তাছাড়া একটা কিছু নিয়ে এসেছি বলে নম্বর পাব।
মালিক পরে তরুণীটিকে বললো, তুমি কিছুই না নিয়ে এলে কেন?
তরুণীটির উত্তর, আমি গাধা চিনি না, তবে ঘোড়া চিনি। তাই গাধার পরিবর্তে ঘোড়া নিয়ে আসিনি।
কাজেই স্বাভাবিক কারণেই তরুণীটিকে চাকরিটি দেওয়া হলো। তরুণীটি গাধা না চিললেও ঘোড়া চিনে, কিন্তু তরুণটি ঘোড়া ও গাধা কোনটাই চিনে না। তবে গাধার বদলে ঘোড়া এনে একটা কিছু এনেছি বলে কৃতিত্ব নিতে চায়।
গল্পটি পড়েই অনেকে মনে মনে আমাকে নারীবাদী বলে গালি দেবেন। কেউ কেউ প্রকাশ্যে গালি না দিলেও নারীবাদী আখ্যা দিয়ে বুলি ছড়াবেন।
নারীবাদী কারও কারও কাছে কুখ্যাতি। আবার কারও কারও কাছে সুখ্যাতি তো বটেই, নারীবাদী পরিচয়ে গর্ব অনুভব করেন এবং আমিও তাদের সমর্থন করি। এরই অনুসরণে আমাকে নারীবাদী শব্দটি শুনতে হয় কখনও গালি হিসেবে, কখনও বুলি হিসেবে মানে নারী অধিকার নিয়ে কোন কথা বললে পাল্টা যুক্তি খুঁজে না পেয়ে বলেন, এ তো নারীবাদীদের যুক্তি। যদিও আমার যুক্তি বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংগৃহীত ।
আমার চাকরির সুবাদ আমাকে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বেসরকারী সংগঠনসমূহের কর্মী নিয়োগের কমিটিতে থাকতে হয়। আমার মতে বেসরকারী সংগঠনের জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ বিষয়টি ‘পঠিত বলিয়া গণ্য হইল’ এর মত। যদিও আমার শক্তিশালী ভূমিকার জন্য পঠনকটূ বিষয়কে প্রায়শঃই তারা পড়তে বাধ্য হয়।
পঠিত বলিয়া গণ্য হইল বাক্যটি বেসরকারী ও সরকারী অফিসের বহুল প্রচলিত। নিয়মিত সভাগুলোতে আগের মাসের রেজ্যুলেসন পরের মাসের সভায় পড়ে সময় অপচয় করতে চায় না বা সময়ের স্বল্পতার জন্য পড়ে না। অথবা পড়ার প্রয়োজন অনুভব করে না কিংবা পড়ার যৌক্তিকতা নেই। অথবা পড়তে গেলে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিমত হবে জেনেই এড়িয়ে যাওয়া। কারণ, কিছু সিদ্ধান্ত তো নির্বাহী আদেশে লিখিত হয়। তাছাড়া সভা শুরুই হয় সাধারণত নির্ধারিত সময়ের অন্তত ঘন্টা খানেক পরে। তখন সভার সভাপতি মহোদয় কৌশলে একুটু ভূমিকা দেন এবং অন্য একজন অত্যন্ত স্মার্টলি প্রস্তাব করেন, গত সভার রেজ্যুলেসন পঠিত বলে গণ্য হোক। সাথে সাথে দুয়েকজন তা সমর্থন করলেই না পড়েও পঠিত বলে গণ্য হয়ে অনুমোদন লাভ করে। পঠনকটূ অনেক বিষয় অপঠিত ও অনালোচিত থেকে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ইস্যু জায়েজ করা হয়।
বেসরকারী সংস্থার জেন্ডার নীতি নিয়েও এ কথা খাটে। তাদের ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সবার জেন্ডার বিষয়ক জ্ঞান পঠিত বলে গণ্য হয়। মেনে চলছে বলে সাব্যস্ত হয়। চর্চা হচ্ছে বলে প্রতিবেদিত হয়। জেন্ডার শুধু কাজীর গরুর মত কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই। কাজেই জেন্ডার বিষয়ক নীতি কাগজেই থাকে। প্রকল্প অনুমোদন পেতে দাতাদের কাছে জমা দিতে হয়।
সংস্থার লিখিত জেন্ডার নীতি আছে। জেন্ডার বৈষম্য বিলোপ মানে অর্গানোগ্রামে স্টাফের আনুপাতিক হারে নারীর সংখ্যা দেখাতে পারলেই নির্বাহী পরিচালকরা খুশী —— দাতাদের বলা যায়। অনেকেই জেন্ডার বলতে বুঝে কোন সভায় নারী পুরুষের পাশাপাশি বসা। কোন কর্মশালায় দলীয় আলোচনায় কোন টেবিলে নারী অংশগ্রহণকারী না থাকলে প্রশিক্ষক বা সহায়ক বসার ব্যবস্থা পুনর্বন্টন করে প্রত্যেক টেবিলে নারী অংশগ্রহণকারী বসান। নারী যেন বাহারী খন্ড। ডেকোরেসন পিস।
জেন্ডার বৈষম্য নিয়ে চারদিকে শত্রু শত্রু খেলা খেলে সবাই। ঘরে এবং বাইরে।সর্বত্র। খেলাতেও চায় এবং আমি তা বুঝি। তবে মুখে বা আচরণে অনেক সময় তা প্রকাশ করি না। এড়িয়ে যাই। অনর্থক পরিবেশকে অসুস্থ করতে চাই না। তবে এড়িয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। কারণ অনেকেরই ধারণা নারী ঘর থেকে বের হতে পারছে, চাকরি করতে পারছে, আর কি চায়? বক বাঘের গলায় মুখ ঢুকাইয়া হাড় বাহির করিয়াছে। বাঘ যে বককে চিবাইয়া খায় নাই তা কি বকের পুরষ্কার নয়! এ হল তাদের নারী ভাবনা।
অন্য আরেকটি দল কিশোরীদের বখাটেদের উপদ্রবে আত্মহত্যার খবর পড়ে অফিস কেন্টিনে দুপুরে খাবার সময়ে উঃ আঃ করে। এতে যে এর কোন প্রতিরোধ বা প্রতিষেধক নেই তা ভাবে না। শুধু নিজের থালার খাবার হয়তো এতে সুস্বাদু হয়। মহিমা, রুমী, তৃষা, ইলোরা,সিনিথিয়াদের আত্মহত্যা শুধুই টেবিল কথার বিষয়বস্থু হবে! এ নিয়ে উচ্যবাচ্য করা কি নারীবাদ। যদি হয়, তবে হোক। হেনার মৃত্যু নিয়ে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের বাতাস গরম করে ঠান্ডা বাড়িয়ে দিতে বলে কি নারীবাদী হওয়া যায়?
অনেকেই দৈনিক পত্রিকার খবর পড়ে ঝাল টক মিষ্টি খাওয়ার স্বাদ নেয়। আর এ নিয়ে যদি সক্রিয়ভাবে এর প্রতিবাদ করতে বলি, যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর যৌথভাবে স্মারক লিপি দিতে বলি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে সংঘটিত বিষয়টি নিয়ে ফলো আপ করতে উদ্যোগী হতে বলি তাহলে অন্যরা আমাকে নারীবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে। নারীবাদী হওয়া যে মেধার ব্যাপার নয়, কোন আকর্ষণীয় চাকরি পাওয়া নয়, কোন কৌশল বা দক্ষতা আয়ত্বে আনা নয় তা কিভাবে কাকে বুঝাবো! তবে নারীবাদী মাটি ফুঁড়ে আসবে না,গাছ থেকেও ফলবে না। সমাজ থেকেই সৃষ্টি হবে।
নারীবাদ এক বোধের নাম। নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির নাম। এক আদর্শের নাম। নারীকে নিপীড়ণ, বৈষম্য ও সহিংসতা থেকে মুক্ত করার সংগ্রামের নাম নারীবাদ। নারীকে শোষণের শিকার হতে ও বন্দিত্ব থেকে স্বাধীন করার ব্রতের নাম নারীবাদ। নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার নাম নারীবাদ।
আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা অবশ্য ভিন্ন। ছেলেরা গাধার জায়গায় গাধা এনেও চাকরি পায় না, অন্যদিকে মেয়েরা গাধা, ঘোড়া, ছাগল কোনোটা না চেনার পরেও চাকরি পেয়ে যায় শুধুমাত্র মেয়ে হবার সুবিধায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর মেধাবী একজন ছাত্রকে বাদ দিয়ে তুলনামূলকভাবে কম মেধাবী বাকশোভিত ছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষকদের আহ্লাদিপনাতো আর কম দেখি নি।
লুলপুরুষময় এই পৃথিবীতে প্রমীলারাই সুবিধাভোগীগো দিদি, পুরুষেরা নয়। 😛
@ফরিদ আহমেদ,
দুয়েকটা ঘটনা হতেই পারে। তবে আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন । অবশ্য বিশ্লেষণের মাপকাঠিও ব্যক্তিভেদে আলাদা। ।
@ফরিদ আহমেদ,
আমাদের দেশে হয়তো হতে পারে, তাই বলে লুলপুরুষময় পৃথিবী?
ইংল্যান্ডে কিছু যায়গায় এর উল্টোটা দেখেছি। গীতা দি ঠিকই বলেছেন- বিশ্লেষণের মাপকাঠিও ব্যক্তিভেদে আলাদা।
@আকাশ মালিক,
@আকাশ মালিক,
লুলপুরুষ সব বাংলাদেশে আর বাকি বিশ্বের সব পুরুষেরা লুলবিহীন এরকম ধারণাটাই মনে হয় সঠিক নয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সারা দুনিয়াটাকে মাথার উপর চাপিয়ে কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝেও যখন অসুন্দরী সেক্রেটারীর জন্য অকাতরে লুল ঝরানোর লোভ সামলাতে পারেন না, তখন শুধু এই অলস অকর্মণ্য বাঙালিদের একার ঘাড়ে দোষ চাপাই ক্যামনে? 🙂
বিশ্লেষণের মাপকাঠিতো আলাদা হবেই। আপনি একজন নারীবাদী, স্বাভাবিকভাবেই আপনার দৃষ্টিভঙ্গি হবে নারীর প্রতি সহানুভূতিপ্রবন। আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন পুরুষবাদী মানুষ, নারীবাদের আদিখেত্যা আমার মধ্যে নেই। তাই, নারীবাদের রঙিন চশমা পরে চলি না। খোলা চোখে নারী পুরষের সামাজিক অবস্থানকে যাচাই বাছাই করতে অভ্যস্ত আমি। শুধু নারী বলেই নারীর সবকিছু ভাল, সবকিছুতেই সে সুবিধাবঞ্চিত আর পুরুষ বলেই পুরুষের সবকিছু খারাপ, সবকিছুতেই সে সুবিধাভোগী, এই দৃষ্টিভঙ্গির মোটেও সমর্থক নই আমি। দুষ্টু পুরুষের মত দুষ্টু নারীও কম দেখি নি এই জীবনে।
নারীরা কীভাবে পুরষদের তুলনায় অহেতুক সুযোগ-সুবিধা পায় পুরুষদের কাছ থেকে তার কয়েকটা ছোট ছোট দৃশ্যপট দিয়ে যাচ্ছি এখানে নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। কোনদিন কোনো নারীকে বা নারীবাদীকে শুনবেন না এগুলো স্বীকার করতে।
দৃশ্যপট একঃ সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেছি। অধীত কোর্সের ক্লাস চলছে। শিক্ষক মহোদয় অত্যন্ত বন্ধুসূলভভাবে পড়িয়ে চলেছেন। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা আমার জন্য। সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে পড়ার সময়ে শিক্ষকেরা পিটিয়ে চামড়া তুলে দিতেন আমার। ফলে, নিয়মিত স্কুল পালানো ছিল আমার অভ্যাস। নটরডেম কলেজে পড়ার সময়ে পিটুনি দিত না শিক্ষকেরা তবে তাঁদের রক্তচক্ষু কড়া শাসন, পিটুনির চেয়ে কম কিছু ছিল না। এই শিক্ষক মহোদয় ক্লাসের শেষ পর্যায়ে এসে বার বার বললেন যে, আমরা যদি কিছু না বুঝি তবে নির্দ্বিধায় যেন তার চেম্বারে আসি যখন খুশি। আঠারো বছরের সদ্য কৈশোর পেরোনো মুখচোরা তরুণ আমি ক্লাসে সবার সামনে জিজ্ঞেস না করতে পারা একটা সমস্যা নিয়ে দুরুদুরু বক্ষে হাজির হই সেই শিক্ষকের চেম্বারে। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে অন্য আরেক শিক্ষককে আবিষ্কার করি। আমাকে দেখে মহা বিরক্ত এবং ক্ষিপ্ত তিনি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। আমার প্রশ্নের উত্তরে পালটা প্রশ্ন করে করে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকেন তিনি আমাকে আমার দিকে না তাকিয়েই। এর মধ্যেই আমার ক্লাসেরই দুটো মেয়ে উপস্থিত হয় দরজায়। সাথে সাথে জাদুমন্ত্রের মত পালটে যায় শিক্ষকের চেহারা। অনাবিল লুলহাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে তাঁর চোখ মুখ। আমাকে সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে ওই দুই তরুণীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। তীব্র অপমানে দগ্ধ আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি সেখানে কিছুক্ষণ। তারপর ছাত্রীদ্বয় এবং শিক্ষকের হাস্যরসের মধ্যে নীরবে প্রস্থান করি। বাস্তব অভিজ্ঞতাহীন আমি বুঝে যাই যে, কোনো শিক্ষক যখন ক্লাসরুমে ছাত্র-ছাত্রীদের তাঁর চেম্বারে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানান, তখন তিনি আসলে একটা জিনিস উহ্য রাখেন। এই আমন্ত্রণ শুধুমাত্র ছাত্রীদের জন্য, ছাত্রদের জন্য নয়। এই ঘটনার পরে উপেক্ষিত, অপমানিত এবং অভিমানাহত আমি পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টাতে আর কোনো শিক্ষকের কক্ষে যাই নি কোনো কিছু শেখার জন্য।
দৃশ্যপট দুইঃ পরের বছরের ঘটনা। আমার বিভাগের দু’বছরের সিনিয়র লিজা আপু আমাকে একদিন সাথে করে নিয়ে যান এশিয়াটিক মার্কেটিং এ। লিভার ব্রাদার্সের বিভিন্ন প্রডাক্টের মার্কেটিং রিসার্চের তথ্য সংগ্রহের কাজে তারা ছাত্রদের ব্যবহার করে থাকে। লিজা আপু সেখানে কাজ করেন মাঝে সাঝে। আপু আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন এক তরুণ কর্মকর্তার সাথে। ভদ্রলোক আপুর সাথে হাসিমুখে হাসি-ঠাট্টা করতে থাকেন। আমাকে বলেন, কয়েকদিন পরে ওনার সাথে দেখা করতে। অফিস থেকে বের হয়ে আপু আমাকে বলেন যে, এই ভাইয়া খুব মজার আর ভাল মানুষ। তুমি আসলেই তোমার কাজের ব্যবস্থা করে দেবেন। কয়েকদিন পরে আমি একা হাজির হই এশিয়াটিকে ভদ্রলোকের সাথে দেখা করার জন্য। অবাক বিস্ময়ে দেখি মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে সেই হাসিখুশি মজার মানুষটি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে গম্ভীর হয়ে গিয়েছেন। আমার কথা শুনে হু হা করছেন। শেষে যা বললেন, তার মর্মার্থ হচ্ছে যে, এই মুহুর্তে তিনি আমাকে কোনো কাজ দিতে পারছেন না, ভবিষ্যতে যদি কোনদিন সুযোগ হয় তবে আমাকে দেবেন। মাঝে মাঝে এসে খোঁজ নিয়ে যেতে বললেন। সেই সাথে এটাও জানাতে ভুললেন না যে, আজকে তিনি খুবই ব্যস্ত। হতাশ হয়ে ফিরে আসার ছাড়া আর কোনো গতি ছিল না আমার সেদিন। কিছুদিন পরে আপুর সাথে দেখা হলো আমার। জিজ্ঞেস করলেন যে, কাজ শুরু করেছি কি না। সবকিছু বললাম ওনাকে। শুনে তিনিতো আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন যে, তোমার পরে আমি অন্য একটা মেয়েকে পাঠিয়েছিলাম ভাইয়ার কাছে। সেতো ঠিকই কাজ পেয়েছে। আপুকে কী করে বোঝাই যে, আমার জন্মগত লিঙ্গ পরিচয়ই এখানে কাজ না পাবার অন্যতম কারণ।
দৃশ্যপট তিনঃ ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে যাব ট্রেনে করে। কী এক শখে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট করে ফেলেছি। আন্না শুনে বলে যে, দুই পয়সার মাস্টার, তার আবার ফার্স্ট ক্লাশে চড়ার শখ। ভাত খাবা কী দিয়ে শুনি? রক্তচক্ষু করে ধমকে উঠে আমাকে, যাও পাল্টে শোভন ক্লাসের টিকেট নিয়ে এসো। ওর ধমক খেয়ে কাউন্টারে ফিরে যাই আমি। কিন্তু কাউন্টারের লোকটা কাঠখোট্টা ভঙ্গিতে জানিয়ে দেয় যে, টিকেট ফেরত দেবার কোনো নিয়ম তাদের নেই। অবশ্য আমি ইচ্ছা করলে শোভন ক্লাসের দুটো টিকেট কাটতে পারি। এতে তার কোনো আপত্তি নেই। হাজার অনুরোধেও মন গলে না তার। ভগ্ন মনোরথে ফিরে এসে আ্মি। সব ঘটনা জানাই আন্নাকে। আমার হাত থেকে টিকেট দুটো ছিনিয়ে নেয় আন্না। সরোষে বলে ওঠে, ‘অপদার্থ একটা, তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না এই জীবনে’। আমার চোখের সামনে এক মিনিটের মধ্যে একই কাউন্টারে বসা একই লোকের কাছ থেকে টিকেট দুটো পালটিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে ফিরে আসে সে।
দৃশ্যপট চারঃ সহকারী অধ্যাপক পদের জন্য সার্ক্যুলার দিয়েছে বিভাগ। আমি এবং আমার এক সহকর্মিনী আবেদনপত্র জমা দিয়েছি একই পদের জন্য। সহকারী অধ্যাপক পদের জন্য সায়েন্টিফিক জার্নালে নূন্যতম যে সংখ্যক পেপার পাবলিকেশন প্রয়োজন তা আমার ছিল। কিন্তু, আমার সহকর্মিনীর ছিল না। বিভাগীয় প্রধানের আলস্যের কারণে একাধিক পদ তৈরি করাও সম্ভবপর হয় নি। আমার সহকর্মিনী যাতে একই সাথে পদোন্নতি পায় সে কারণে প্রচুর চেষ্টা করেছিলাম বিভাগীয় প্রধানের আলস্য ভাঙাতে। কোনো কাজ হয় নি। ইন্টারভিউয়ের পরে প্রবল বিস্ময়ে জানতে পারলাম যে সিলেকশন কমিটি আমার সহকর্মিনীকে আমার চেয়ে যোগ্য বলে মনে করেছে কোনো কারণ ছাড়াই। ফলে, তাকে অনুমোদন দিয়েছে আমাকে বাদ দিয়ে। এর পরের ইতিহাস বড় তিক্ততার ইতিহাস। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই অনুমোদনকে চ্যালেঞ্জ করে থামাতে হয়েছিল আমার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হয় যে, আরেকটা পদ তৈরি করে দুজনকে একসাথে সহকারী অধ্যাপক করা হবে। এতে করে আমার প্রভাষক জীবন অযাচিতভাবে দীর্ঘায়িত হয়। যে সহকর্মিনীর সঙ্গে আমার অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল, সেটা পর্যবসিত হয় কথা না বলার সম্পর্কে।
এরকম আরো অসংখ্য অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। তবে, এই অভিজ্ঞতাগুলো শুধু একান্তই আমার ভাবলে ভুল করবেন। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পুরুষদের সঙ্গে একান্তে কথা বলে দেখুন। প্রায় সব পুরুষই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এই ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। প্রকাশ্যে অনেকেই স্বীকার করতে রাজি হবেন না। কারণ, নারীবাদ অনেক আকর্ষণীয় পুরুষবাদের তুলনায়। নিজেকে নারীবাদী বলতে পারলে বেশ জাতে উঠা জাতে উঠা বলে মনে হয় পুরুষদের কাছে। মেয়েদের কাছ থেকে বেশ বাহবাও পাওয়া যায়। ফলে, অন্তরে একেকটা পুরুষবাদী পুরুষ চোখ লাল করে দাঁড়িয়ে থাকার পরেও আমরা প্রকাশ্যে সবাই হয়ে পড়ি নুয়ে পড়া নারীবাদী। :))
কেয়া, বন্যা আর স্নিগ্ধা মুক্তমনায় আপাত নেই বলে, সাহস করে এই কথাগুলো বলছি। নাহলে হয়তো পিঠে ছালা বেঁধে চলতে হতো বেশ কিছু দিন। 😛
@ফরিদ আহমেদ,
আপনার দ্বীর্ঘ মন্তব্য পড়ে কী বলবো বুঝতে পারছিনা। প্রথমেই এই বৈষম্যমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা জানাই, আর আপনার অভিজ্ঞতা জেনে বড় করে বলি- স্যরি। কথাগুলো শুনে অন্তরে দুঃখ পেয়েছি। আপনার মত আরো অনেকেরই জীবনে এমনটি ঘটেছে তা বিশ্বাস করতে আমার মোটেই অসুবিধে হয়না, কারণ এই রাস্তায় আমার চলাচল আছে, আমি এই পথের সাথে পরিচিত।
এই জেন্ডার ইস্যু, এই বৈষম্যবাদ নিয়ে সারা বিশ্বে প্রচুর তর্ক হয়েছে, এখনও হচ্ছে, আমরা নারী পুরুষ যতদিন পৃথিবীতে আছি হয়তো তা কোন না কোন ভাবে চলতে থাকবে। এর অন্যতম কারণ হয়তো আমদের মাঝে বিদ্যমান সেলফিস জিন।
আপনার সাথে যা ঘটেছে তা পুরোপুরি সেক্সিজম, এটা অন্যায়, এটা দন্ডনীয় অপরাধ। অপরাধ নিবেন না, আমি যদি বলি ঘটনা ঠিক উলটোভাবেও ঘটতে পারে। হাজার ঘটনার একটা ঘটনা এখানে দেখুন-
এবার সংক্ষেপে বলি, আপনি পুরুষবাদী নন আর আমিও নারীবাদী নই। এখানে দুটো পক্ষ নেই, আছে সাম্যবাদের শ্লোগান। সেটা পুরুষ এবং নারীর উভয়ের কল্যাণে উভয়ের সমতা, সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার যৌথ প্রচেষ্টা।
আচ্ছা ফরিদ ভাই, মনিকাকে অসুন্দরী বললেন কেন? তার মাঝে সুন্দরের কোন অভাব ছিল? :-O :-s
@আকাশ মালিক,
চমৎকার প্রতিত্তোর। যৌক্তিক মন্তব্য। অনর্থক বির্তকের ঝড় তোলার চেষ্টা নেই। ধন্যবাদ।
@আকাশ মালিক,
অভাব কী বলছেন? আমিতো কোনো সৌন্দর্যই খুঁজে পাই না এই মহিলার মধ্যে। অবশ্য পাবোই বা কী করে? আমারতো আর ক্লিনটনের মত লুল মাখানো চোখে নেই, তাই না? 😛
@ফরিদ আহমেদ,
শুধু ফরিদের প্রতি নয় যে কারও প্রতি যে কোন বৈষম্যমূলক আচরণের আমি ঘোর বিরোধী। কাজেই তোমার ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতার সাথে আমিও সমবব্যথী ।
আর লুলপুরুষদের কার্যকলাপ কিন্তু নারীবাদীরা সমর্থণ করে না। বরং ঘৃণা করে।
বর্ণিত দৃশ্যপট এক ও দুই লুলপুরুষ কর্তৃক সংঘটিত। (বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক লুলপুরুষ শিক্ষকদের আচরণের প্রতিবাদ এখনও আমরা করছি।)
তিন, আন্না ম্যাডামের দক্ষতা।
চার? এক নারীর প্রতি পক্ষপাত করতে গিয়ে পুরুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ। নাকি রাজনীতি? অথবা Nepotism ? যেটাই হোক বিষয়টি নিঃসন্দেহে অন্যায় ছিল।
উনারা দল বেঁধে কোথায় ডুব দিল?
@গীতা দাস,
নারী হয়ে জন্মানোর সৌভাগ্য হলে আমারও এই দক্ষতা থাকতো। 🙂
অনেক বছর আগে ঈদ আনন্দমেলায় আনিসুল হককে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছিলেন যে, পরজন্মে তিনি সুন্দরী নারী হয়ে জন্মাতে চান। আমারও সেই একইতর ইচ্ছা। এই জন্মেতো আর হলো না। পরজন্মে যেন সুন্দরী, সুহাসিনী, মায়াবিনী, কোমলিনী কোনো কামিনী হয়ে যামিনী যাপন করতে পারি। 😛
@গীতা দাস,
এখানে-
তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে-মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবে—( কিতাবুল আল-ফরিদ, অধ্যায়- অবরোধবাসিনী, শ্লোক নং ৩৩)
গীতাদি,
এই চিহ্নিত হওয়া অপবাদ কি কোন খারাপ জিনিস ?
ভালো থাকবেন।
@মাহবুব সাঈদ মামুন,
না, মোটেই নয়। এজন্যই তো আমি বলেছি—-
বাহ! সুন্দর। কাব্যময় একটি বাক্যমালা। নারীবাদের একটি সংজ্ঞা।
@নৃপেন্দ্র সরকার,
পড়া ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।