(০১)
ইদানিং মোবাইলের ম্যাসেজ টোনটা মাঝেমধ্যেই চিৎকার করে ওঠে পেটের ভেতরে চমৎকার কিছু শ্লোগানের এসএমএস নিয়ে। আমিও আয়েশ করে বিটিআরসি বা গভট ইনফো প্রেরিত ইংরেজি হরফের বাংলা উচ্চারণে লিখিত শ্লোগানগুলো পড়ে পড়ে মুগ্ধ হই। কিছু কিছু ম্যাসেজে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য থাকে যা থেকে মেসেজ প্রাপকদের উদ্যোগ নিতে সুবিধা হয়, সেগুলোকে অবশ্যই ওয়েলকাম। কিন্তু আবার কিছু কিছু মেসেজ পড়ে মেসেজদাতার উদ্দেশ্য সম্পর্কেই এক ধরনের ধোয়াশাচ্ছন্নতা তৈরি হয়। যেমন-
‘দারিদ্র্য হটাতে হলে দুর্নীতি রুখতে হবে। – প্রধানমন্ত্রী’
‘সবাই মিলে লড়বো দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়বো। – দুদক’
‘তথ্য জানা ও পাওয়া আপনার মৌলিক অধিকার। তথ্য অধিকার আইন অনুসারে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা তথ্য প্রদানে বাধ্য। – সরকারি তথ্য বিবরণী’
‘ইভটিজিং প্রতিরোধে সোচ্চার হোন। – মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়’
ইত্যাদি।

এই আদর্শ শ্লোগানগুলো পড়তে পড়তে আমার নিজের মধ্যেও একটা ইচ্ছেবোধ জেগে ওঠে- বাংলার লোকায়ত খনি থেকে প্রতিষ্ঠিত ও বহুলপ্রচারিত একটা প্রবাদ তুলে এনে এসএমএস করে এই প্রেরকদের বরাবরে পাঠিয়ে দিতে। প্রবাদটা হলো- ‘চোরায় না-শুনে ধর্মের কাহিনী।’ পৃথিবীতে এতো আইন-আদালত, জেল-পুলিশ, এবং সিস্টেম বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় এতো নিয়ম-কানুন বিধি-নিষেধ কী জন্যে তৈরি হয়েছে ? সিস্টেমের মধ্যে জেনে-না-জেনে ফাঁক-ফোকর থেকে থাকলে অপব্যবহার রোধকল্পে তা বন্ধ করায় সুনির্দিষ্টভাবে দৃষ্টি না দিয়ে সাধারণ জনগণের কাছে এসব ললিত বাণী প্রচারও কি একটা ফাঁক নয় ? যে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় সে ব্যাপারেই তো জনগণকে অবগত ও সতর্ক করা এবং তাঁদের সহযোগিতা চাওয়া কাম্য। রাষ্ট্রের কোথায় কোথায় কী কী দুর্নীতি কার মাধ্যমে সংঘটিত হচ্ছে তা না জেনে জনগণ কিভাবে কোন্ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করবে এটা আমরা জানবো কী করে ? এই এসএমএস শ্লোগান প্রাপকরা তথা সাধারণ জনগণ শ্লোগানের বক্তব্য বিষয়ে কার্যকর কিছু করে ওঠতে পারবে এটা কি এসএমএস প্রেরকরা আদৌ বিশ্বাস করেন ? এটা যদি শুধুই জনমত তৈরির কারণে হয়ে থাকে তাহলে আরেকটা লোকায়ত প্রবাদের কথা মনে এসে যায়- ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও।’

(০২)
মানবচরিত্রের একটা আকর্ষণীয় বিষয়, চরিত্রের স্খলন বা নষ্ট হওয়ার কোন সুযোগই যদি না থাকে মানুষ কি নষ্ট হয় ? হয় না। সে চাইলেও নষ্ট হতে পারে না, কারণ, নষ্ট হবার সেই উপকরণ তার আয়ত্তে থাকে না। আবার সে নষ্ট হতে পারছে না বলে যদি নিজেকে নির্মল চরিত্রের অধিকারী হিসেবেই দাবী করে বসে সেটাই বা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত হবে ? আইনগতভাবে তার দাবী হয়তো সঠিক, কেননা এই দাবীর বিপক্ষে কোন সংঘটিত প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। যেহেতু তার নষ্ট হবার সুযোগই ছিলো না, ফলে সে নষ্ট হবে কী করে ! তাহলে সে কি চরিত্রবান ? কেউ এমন দাবী করলেও কার্যত এটাকেই বলা হয় ‘সুযোগের অভাবে চরিত্রবান ’।

চমৎকার তাৎপর্যপূর্ণ এই কথাটি প্রথম কে উক্তি করেছিলেন জানি না। তবে মানুষের জটিল মনস্তত্ত্বের এক অদ্ভুত বিশ্লেষণ এই সহজ-সরল তীর্যক বাক্যটির মধ্য দিয়ে যেভাবে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে, এক কথায় অনবদ্য। অমোঘ সত্যও। কেননা খুব সাধারণ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যক্তির প্রকৃত চেহারা বা ব্যক্তিত্বের অবয়ব প্রকাশের সুযোগ পায় না বলে আমরা বুঝতে পারি না আসলে ব্যক্তিটি কেমন। আর বুঝবোই বা কী করে ? ভালোমানুষী চেহারার ভেতরের প্রকৃত রূপটি তো আর আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কেবল সময়-সুযোগ এলেই তার ভেতরের সেই আশ্চর্য রূপটি বেরিয়ে আসে। অতএব এটা ধারণা করে নিতে হয় যে, ব্যক্তি-চরিত্র আসলে একটা আপেক্ষিক বিষয়। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন, নষ্ট হবার কিংবা নিজেকে নীতিহীনতায় ভাসিয়ে দেবার সবরকম সুযোগ ও সহায় থাকা সত্ত্বেও নিজেকে অটল রাখায় সক্ষম এমন আদর্শ ব্যক্তিত্ব কি আদৌ আছেন আমাদের সমাজে ? এর উত্তর খুঁজতে একটু দ্বিধায় পড়ে যেতে হয়। হয়তো আছেন, কিন্তু আমরা পাচ্ছি না। কিংবা আসলেই নেই।

আবার নাই এটা বলিই বা কী করে ! আমরা কি কখনো তা খোঁজ করার উদ্যোগ নিয়েছি ? এখানেও প্রশ্ন, উদ্যোগ নিলেই কি সহজে এর যথাযথ খোঁজ পাওয়া সম্ভব ? কেননা এ ধরনের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বরা তো তাঁদের ব্যক্তিত্বের সাথে সাংঘর্ষিক স্বভাব নিয়ে বুকে একটা নেমপ্লেট ধারণ করে জনে জনে মাইকিং করে বেড়াবেন না যে- এই দ্যাখো, সুযোগ পেয়েও আমি কেমন চরিত্রবান রয়েছি ! স্বভাবসুলভভাবেই তাঁরা এক্ষেত্রে হন আত্মপ্রচারবিমুখ এবং আত্মঅহমিকামুক্ত অসাধারণ বিনয়স্বভাবী। ফলে জীবৎকালে তাঁদের খোঁজ পাওয়া বা দেখা পাওয়া অনেকটাই সুদূরপরাহত বলা যায়। আর ভাগ্যক্রমে এমন ব্যক্তিত্বের দেখা তাঁর জীবৎকালে পাওয়া গেলেও তাঁকে চিরকালীন ট্যাগ করে ফেলাতেও অনেক সমস্যা থেকে যায়। কারণ মোহের ভয়ঙ্কর প্রলোভন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর নষ্ট হবার আশঙ্কাকে কোনভাবেই উড়িয়ে দেয়ার উপায় কি আছে ? সম্ভবত শুধু এই একটিমাত্র আশঙ্কার কারণে আমাদের অনেক আত্মত্যাগী ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব তাঁদের জীবৎকালে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি পাওয়া থেকেও বঞ্চিত থেকে যান। হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর এই অবদানের সুযোগ বা সুবিধা পেতে পারেন ঠিকই, কিন্তু অন্য এক আপতিক দৃষ্টিকোণে দেখলে ওই অবদানকারী ব্যক্তির জীবন তো আসলে এক বঞ্চনার ইতিহাসই। এটাও মানবেতিহাসের এক নির্মম ট্র্যাজেডিই বলা যায়।

ব্যক্তি মরে গেলে নাম অমর হয়ে থাকায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বস্তুগত কোন লাভ কি আদৌ আছে ? কিংবা নিজেকে ত্যাগী বঞ্চিত রেখে অন্যকে সুযোগ ও সাচ্ছন্দ্য দানে যতই ভাববাদী মাহাত্ম্য থাক, অবিকল্প একটামাত্র জীবনে ব্যক্তিগত সুখ ও সমৃদ্ধিহীন ব্যক্তিজীবন আসলেই কতোটা গ্রহণযোগ্য ? অথবা যোগ্যতার মানদণ্ডে কোনভাবে পিছিয়ে না থেকেও তুলনামূলক প্রেক্ষাপটে নিজেকে নিম্নতর অবস্থানে আবিষ্কার করায় আত্মপ্রসাদের কিছু কি আছে ? এসব আত্মবিশ্লেষণী প্রশ্ন যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে, তখনই বোধকরি চরিত্রে ব্যক্তিত্ববান ব্যক্তিও ক্রমেই সুযোগ সন্ধানী হয়ে ওঠেন বা ওঠতে বাধ্য হন। এবং একটা পর্যায়ে এসে আমাদের স্বকল্পিত বঞ্চিত দৃষ্টিও নবরূপধারী তাঁকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একরোখা হয়ে ওঠে- নিশ্চয়ই তিনি এতোকাল সুযোগের অভাবেই চরিত্রবান ছিলেন ! এই নতুন রূপ ধরার আগের ব্যক্তিটি প্রকৃতই কতোটা সৎ ও যোগ্য ছিলেন তা খতিয়ে দেখার মতো ধৈর্য্য ও মানসিকতা সম্ভবত আমাদের আর থাকে না। এবং এটা বলাবাহুল্য হবে না, এখানেও যে একটা মজার স্ববিরোধিতা মোহনীয়ভাবেই প্রবল হয়ে ওঠে তাও বোধকরি ভেবে দেখার অবকাশ পাই না আমরা। কারণ, মন্তব্যকারী আমরাও যে অত্যন্ত অসহায়ভাবে সুযোগের অভাবে চরিত্রবান নই এ কথাটা ক’জন বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি ?

আজকাল হঠাৎ করে ভোল পাল্টে যাওয়া অনেক ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বদের নতুন নতুন স্বরূপ দেখে আমরা অনেকে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। কেউ কেউ অহেতুক নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কাতড়ে ওঠি- আহা, কী ছিলো, এখন কী দেখছি! তরল আবেগে তাড়িত হয়ে আমরা কেউ নায়ককে খলনায়ক বানাই, আবার খলনায়ককে নায়ক বানানোর আতিশয্যে ভেসে যাই। এসব দেখেশুনে কেউ আবার নিজের বিবেচনাবোধকে সম্বল করে ভাবেন- এই চর্মচক্ষে যা দেখছি যা শুনছি তা কি সত্যি ! হয়তো কালান্তরের অনাগত কোন সত্যসন্ধানী গবেষকের নির্মোহ চোখের উপর সত্য উদ্ঘাটনের আগাম আস্থা রেখে কেউ কেউ সময়ের হাতে সমকালীন ঘটনাপুঞ্জকে সমর্পণ করে নিজেকে ভারমুক্ত করায় উদ্যোগী হই। যে যেভাবেই দেখি না কেন, এটা যে আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার গুরুতর সংকট তা বোধকরি অস্বীকারের উপায় নেই। এই সংকট আজ ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, ব্যক্তির সাথে সমাজের, ব্যক্তির সাথে রাষ্ট্রের, সমাজের সাথে রাষ্ট্রের ইত্যাদি। মোটকথা সার্বিকভাবেই এই আস্থার সংকট ইদানিং এতোটাই প্রকট হয়ে ওঠছে যে, ক্রমে ক্রমে আমরা বুঝি একান্ত নির্ভরতার জায়গাটুকুও হারিয়ে ফেলছি। ফলে নিজেকেই নিজের অপলাপ করার সুযোগ ও ঝুঁকি নিতেও কার্পণ্য করছি না আমরা। এ থেকে মুক্তির কোন উপায়ই কি নেই আমাদের ?

এই সংকটে আজ আটকা পড়ে গেছে আমাদের সৃজনশীল চিন্তা, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড, প্রাত্যহিক জীবনে পারিবারিক ও সামাজিক আবহের ছোটখাট ঘটনা ও একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কও। অন্যের অবস্থানে আমাদের তীর্যক দৃষ্টি যতোটা মারমুখি, নিজের ক্ষেত্রে ততটাই অন্ধ আমরা। মানুষ নিজের মুখই সবচেয়ে কম দেখে, চিনে তারচেও কম। তাই নিজেকে ভিকটিমের অবস্থানে কল্পনা করার অক্ষমতার কারণে আমাদের যুক্তিবোধহীন স্বকৃত এই অন্ধতাকে দেখার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছি আমরা। এই অন্ধচক্রভরা অন্ধকার সুড়ঙ্গে অবস্থিত আমাদের অজানা অবস্থান থেকে সুড়ঙ্গের আলোকিত বহির্মুখ কোন্ দিকে তা-ই হয়তো চিহ্নিত করা জরুরি এখন। রাজনীতি সমাজনীতি মানবিকতা আইন আদর্শ নিয়ম ও তত্ত্বকথার বহু জটিল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে জ্ঞানগম্যিহীন সাধারণ মানুষ সত্যিই ক্লান্ত ও বীতশ্রদ্ধ এখন। অনিবার্য ভোগ্যপণ্যের কাছে সাধারণজনের সাধ্যানুযায়ী উপার্জিত বিনিময়মুদ্রা পরিত্যক্ত কাগজের মানে নেমে এসেছে প্রায়। এসবের তোয়াক্কা না করে কার কাছে কী চাইছি আমরা ? অভুক্ত পেট ও শরীরের কাছে চারিত্রিক দৃঢ়তা আশা করা ভণ্ডামো। এই অসহ্য ভণ্ডামো থেকে আমরা কি কখনোই মুক্ত হবো না !

ক্ষমতায় অনুগত সমাজ, শ্রমবঞ্চনায় সমৃদ্ধ সভ্যতা আর শাসকের সেবাদাস সংস্কৃতির বেড়াজাল চক্রে আবদ্ধ কর্ম ও চিন্তাজগৎ থেকে মানবমূল্যায়নের মুক্তির স্বপ্ন কি শুধুই কষ্টকল্পনা মাত্র ?