আকমল হোসেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আগত মুসুল্লীদের দিকে। তার চোখে মুখে উচ্ছ্বাস। একজন দু’জন করে আসছে তো আসছেই। দেখতে দেখতে ছোট হলঘরটা প্রায় ভরে গেলো। জায়গা হবে কি-না ভেবে তিনি শংকিত হলেন। এই বেলেল্লাপনার দেশে এত মুসুল্লী! উত্তেজনায় তাঁর শরীরে কাঁপুনি ওঠে। নিজেকে স্থির রাখা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। কঠিন প্রকৃতির মানুষ আকমল হোসেন মুহুর্তে শিশু বনে যান। আদুরে কন্ঠে সবাইকে আরো একটু সামনে এগিয়ে এসে গাদাগাদি করে বসবার অনুরোধ জানান। তাঁর আহবাণে সাড়া দিয়ে সবাই নড়েচড়ে বসে। একজন আরেকজনকে কাছে ডাকে, যেন জন্ম-জন্মান্তরের আত্মীয়। আর এই অনুভূতি তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে, তাদের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তাদের মধ্যে ফুটে ওঠে অহংকার। আর দশটা ধর্মের সাথে পার্থকটা আরো একটু মাথা-চাড়া দিয়ে ওঠে আকমল হোসেনের কন্ঠে গীত ঐশ্বরিক বাণীতে।
উত্তেজনায় মুসুল্লীদের ফিসফিসানি বেড়ে যায়, আর তা থামে আকমল হোসেনের মধুর তিরস্কতারে, “আপনারা চুপ করেন, এত গুলমাল করলে আল্লা নারাজ হইব।“
আল্লা নারাজ হবে, এ কথায় কাজ হয়। চারদিকে নেমে আসে পিন-পতন নীরবতা। এই নীরবতায় তিনি স্বস্তিবোধ করেন।
তারপর তিনি ঘোষণা করলেন, “আল্লাহ অবাধ্যকে পছন্দ করেন না”।
এ ঘোষণায় মুসুল্লিরা আরো ভয় পেয়ে যায়। তারা স্তব্ধতায় তলিয়ে যেতে যেতে মৃত মানুষের মত, লাশের মত পড়ে থাকে মেঝের ওপর। আল্লা’তালার সাধনা করতে গিয়ে মরে যাবার আগেই এই যে লাশ হয়ে যাওয়া, এই দৃশ্য আকমল হোসেনের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়।
মরে যাবার আগে মরে যাওয়ার এ দৃশ্য দেখে, তাঁর মনে হলো, এই পাপের দেশে এসে মানুষগুলো যেন ধর্মের মর্মটা আরো বেশি বেশি করে বুঝতে পারছে, আল্লাতালা কুদরতটাও বেশি বেশি টের পাচ্ছে। দেশে থাকতে তো এতটা মন দেয়নি।
“আল্লার কুদরত বুঝা বড় দায়”, সবাই বলেন, “আলহামদুলিল্লা”।
সংগে সংগে আওয়াজ ওঠে, “আলহামদুলিল্লা”।
এটা যদি আল্লার কুদরত-ই না হবে, তাহলে এদেরকে এ দেশে নিয়ে আসবে কেন? সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়, যেদিন এই দেশটাতেও ইসলামের চাঁদ ওঠবে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে ভাবতে, ইসলামের চাঁদ দেখার জন্য আকমল হোসেন চোখের পাতা খুলেন। চাঁদ নয়, অসংখ্য টুপি তারার মত ফুটে আছে। খুশির জোয়ারে ভাসতে ভাসতে, মুসুল্লিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন কি-না, বুঝতে পারেন না। উচ্ছ্বাসের তীব্রতায়, আকমল হোসেন বিড়বিড় করে জপতপ করতে করতে, নিজেকে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে বিরত রাখেন। এটা বেলেল্লাদের দেশ। এদেশের প্রভাব মুসুল্লিদের ওপর পড়তেই পারে। তিনি আপন ভেবে বুকে টেনে নেবেন, দেখা গেল কেউ একজন সমকামিতার অভিযোগে মামলা ঠুকে দিল।
সমকামিতার ধারণা মাথায় আসবার সংগে সংগে তাঁর হলো, এটা হয়তো শয়তানের কোন চালাকি হবে। তা না হলে এসব চিন্তা এখন তাঁর মনে উদয় হবে কেন? তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, “নাউজুবিল্লাহ”।
মুসুল্লিরাও সংগে সংগে বলে ওঠলো, “নাউজুবিল্লা”।
আকমল হোসেন একটুখানি ভড়কে গেলেন, মুসুল্লিরা টের পেল কি করে? এই শংকা ও দ্বিধায় সমবেত মুসুল্লিদের চোখ বুলিয়ে, চোখ বুঁজেন। চোখ বুঁজেই তিনি ডুব সাঁতার দেন। সাঁতার কেটে কেঁটে প্রথম সারিতে বসে থাকা মুসুল্লিদের অতিক্রম করে চলে যান দ্বিতীয় সারিতে, আলতোভাবে তাদের অজান্তে দাড়িতে হাত বুলান। দ্বিতীয় সারি পেরিয়ে তৃতীয়, তারপর চতুর্থ, পঞ্চম…., তিনি সাঁতার কাটতে থাকেন। ধনী, দরিদ্র, বাঙ্গালী, পাকিস্তানি, আমেরিকান, আফ্রিকান সব এক কাতারে। সাম্যের এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এ দুনিয়ার আর কোন ধর্মে আছে? সাম্যের জন্য দেশে দেশে এত যে লড়াই, এত যে রক্তপাত, তারা কি সব অন্ধ? বিনা রক্তপাতে যা হাতের মুঠোয়, তাকে পায়ে ঠেলে মরছে কি-না হানাহানি করে। এই রাজনৈতিক তত্ত্বায়ণ মুহুর্তে তাঁকে আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করে।
“ আলহামদুলিল্লাহ”, বলে তিনি চোখের পাতা খুলেন।
অসংখ্য কন্ঠে উচ্চারিত হয়, “আলহামদুলিল্লা”।
আকমল হোসেন বেশ পুলকিত হয়ে ওঠেন। তিনি এখন আর শুধু একটি দেশের মুসুল্লিদের নেতা নন। সারা দুনিয়ার মুসুল্লিদের নেতা। আজ তাকে অনুসরণ করবে চার-পাঁচটি দেশের মুসুল্লি, তিনি তাদের নেতৃত্ব দেবেন। সাদা, কালো, ধনী, গরীবসহ বিভিন্ন ভাষা-র মুসুল্লিরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করবে। তিনি এখন আন্তর্জাতিক নেতা।
আকমল হোসেন চোখ খুলেন। গোটা হল ঘর গমগম করছে। কিচিরমিচির আওয়াজ শুনে তিনি বুঝতে পারেন, পর্দার আড়ালে মহিলা আর বাচ্চা-কাচ্চাদের উপস্থিতিও কম নয়।
“আপনারা চুপ করেন মা বোনেরা, আল্লা নারাজ হবে”। তার কথা শেষ হতে না হতে হটাৎ ভাবগম্ভীর পুরুষদের মধ্যেও শুরু হয়ে যায় গুঞ্জন। গুঞ্জন আর কিচিরমিচির জাতীয় শব্দগুলোকে গুড়িয়ে, স্তব্ধতায় রপান্তর করতে গিয়ে আকমল হোসেনের চোখ স্থির হয়ে যায় বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম থেকে আগত সংবাদকর্মীদের ওপর। ততক্ষণে গুঞ্জনরত পুরুষ ও কিচিরমিচির শব্দ উৎপাদনকারী নারীদের মধ্যে( বাচ্চা-কাচ্চারাই অবাধ্য, ভয়-ভাবনহীন, কলকাকলিতে মুখরিত) নেমে আসে গভীরতর মৌনতা এবং মৌনতার প্রতিযোগিতায় জয়ী হ’তে গিয়ে তারা তাদের বাচ্চা-কাচ্চাদেরও আগুনের ভয় দেখায়। তখন হলঘরে নেমে আসে কবরের নীরবতা।
আকমল হোসেন সবার ওপর চোখ বুলান। সবাই আল্লার ধ্যানে গভীরভাবে মগ্ন। তখন তাঁর মনে হলো, শুধু পরকালের কাজ করলেই হবে না, ইহকালের কাজও করতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি সবাইকে মনে করিয়ে দে’য়ার জন্য, এবার তিনি আল্লার ভাষাকে পরিত্যাগ করে, ইংরেজীতেই বলতে শুরু করলেন।

আকমল হোসেনের কন্ঠে ইংরেজী শুনে সবাই ইহজগতে ফিরে আসে এবং আগত সংবাদকর্মীদের দিকে তাকিয়ে একধরণের গর্ব অনুভব করে।
আকমল হোসেনের কন্ঠে তখনো ইংরেজীর জোয়ার, “ এই যে টেলিভিশনের সম্মানিত ভাইয়েরা এসেছেন, আপনারা অনুষ্ঠানটি দেখবেন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে বলবেন দেখার জন্য।“ এ কথা বলতে বলতে তাঁর বক্ষ-স্ফিতি ঘটে। বাম হাতটা আকাশে উড়িয়ে দিয়ে তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করলেন, “ ইসলাম অইলো শান্তির ধর্ম। এই ধর্মে সন্ত্রাসের স্থান নাই। আজ সারা দুনিয়াতে ইসলাম ধর্মকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হইতাছে। এইডার বিরুদ্ধে আপনারা সজাগ থাকবেন।“
কথাগুলো বলতে বলতে তিনি আড়চোখে সাংবাদিকদের দিকে তাকালেন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন, পত্রিকার পাতায় পাতায় তাঁর ছবি, টিলিভিশনের রঙ্গিন পর্দায় তাঁর ছবি। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, “আলহামদুলিল্লাহ”।
মুসুল্লিরাও সমস্বরে বলে ওঠে, “ আলহামদুলিল্লা”।
সাংবাদিকরা চলে গেলে তিনি খুব আমোদিত হয়ে ওঠেন। তার মনে হলো, আগামীকালের পরই এ দেশে নতুন এক ঝড় ওঠবে। আর সে ঝড়ের কবলে পড়ে বেলেল্লারা তাদের ন্যাংটি ছেড়ে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে ফেলবে কালো কাপড়ে। পুরুষরা হয়ে ওঠবে শ্মশ্রুমণ্ডিত, আলখেল্লা পরিহিত সেইসব পুরুষরা আদিম কাফেলার মত হেঁটে যাবে মক্কার পথে। আল্লার পথে তারা হয়ে ওঠবে শৃঙ্খলিত, তাদের মনে কোন প্রশ্ন থাকবে না, কোন কৌতূহল থাকবে না। আর নারীরা হয়ে ওঠবে পুরুষের অনুগত। ধনী-গরীব, সাদা-কালো, ভিন্ন ভাষাভাষী, সব দাঁড়াবে এক কাতারে। শুধু নারীরাই থাকবে কালো পর্দার আড়ালে। কেননা নারীর শরীর হলো পাপের ফাঁদ। এসব তত্ত্ব ও তথ্যের আনাগোনায় হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সমুদ্র সৈকতে দেখা, স্বল্প বসনা সাদা চামড়ার শরীর।
আর অমনি তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, “নাউজুবিল্লা”।
তাঁর বলা শেষ হ’তে না হ’তেই সবাই একসঙ্গে বলে ওঠে, “নাউজুবিল্লা”।
সমবেত মুসুল্লিদের কাছ থেকে নাউজুবিল্লা শুনে তিনি ভড়কে যান। তিনি সবার ওপর চোখ বুলাতে থাকেন। সবাই খুব চোখ বুঁজে আছে, যেন তারা আর এ জগতে নেই। তিনি আশ্বস্ত হন। তিনি আরামবোধ করেন। এটাই হলো খাঁটি মুসুল্লির গুণ। কোন প্রশ্ন না করে অনুসরণ করে যাও। এ সু্যোগে তিনি তাদের একটু সাবধান করে দেবার তাগিদ অনুভব করেন। তারা ধর্ম-কর্মের কতটুকুইবা জানে? এরা না আলেম, না মুফতি, তবে জানার মধ্যে একটু ইংরেজী জানে। সে আজকাল আলেমরাও জানে। আকমল হোসেন আলেম, হাফেজ এবং ইংরেজীও জানেন। তিনি এবার ইংরেজীতেই বলেন, বলার আগে ভাল করে চোখ বুলিয়ে নেন, সংবাদকর্মীদের কেউ রয়ে গেল কি-না। ওদের অনুপস্থিতিতে এবার আসল কথাটা বলার জোর পান, “ আপনারা মুখে ইসলামের কথা বলবেন, আর দোকানে গিয়ে মদ বিক্রি করবেন, শুয়োরের গোস্ত বিক্রি করবেন, এটা তো মুনাফেকি”।
তিনি একটুখানি দম নিয়ে সবার দিকে তাকালেন। সবার মাথা অবনত। তাদের চোখে-মুখে অপরধের ছায়ায় তিনি এক নতুন যুগ দেখতে পান। চারদিকে ইসলামী বিপ্লবের ঢেউ। সারা দেশ জুড়ে ব্যাপক আন্দোলন, হাউকাউ। মদ আর শুয়োরের গোস্ত নিষিদ্ধ করার দাবীতে দেশ অচল। আর এ আন্দোলন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ছে নতুন নতুন শর্ত আরোপ করে। আকমল হোসেন বেশ উৎফুল্ল বোধ করেন। চোখ বন্ধ করে বিপ্লবের এই গোপন ঢেউ দেখতে দেখতে ভাবতে থাকেন, অমোঘ প্রতিজ্ঞাটা আজই করিয়ে নেবেন কি-না? যদি কেউ না শুনে? যদি এখানে আসা বন্ধ করে দেয়? সমবেত মুসুল্লিদের ভাব-প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য তিনি এবার চোখের পাতা খুললেন, দেখলেন, সবাই ঝিমাচ্ছে। তার সন্দেহ হলো, সবাই কি আসলে ঘুমাচ্ছে? তিনি এতক্ষণ কার উদ্দেশ্যে এতগুলো মূল্যবান কথা খরচ করলেন। ধর্মের ওপর থেকে কি এদের মন ওঠে গেল? তিনি একটু ভয় পেলেন। নিজের মনের ভয়টাকে দূর করার জন্য তিনি হুংকার দিয়ে ঘোষণা করলেন, “ কোরান হল সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের যা কিছু আবিষ্কার, প্রযুক্তির এই যে অগ্রযাত্রা, সবই হলো কোরানের অবদান।“
শিশুদের মধ্যে কেউ কেউ চিৎকার জুড়ে দেয়। মুসুল্লিদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। হল ঘর আবার প্রাণ ফিরে পায়।
আকমল হোসেন আশাবাদী হয়ে ওঠেন। এখনো প্রাণ আছে। হয়তো তন্দ্রা এসেছিল। কে জানে হয়তো অনেকেই রাতের শিফটে কাজ করে এসেছে। ‘কিন্তু’ এসে আবার সামনে দাঁড়ায়। যারা রাতের শিফটে কাজ করেনি, তারাও তো ঝিমাচ্ছিল। আর ঈমানের জোর থাকলে এক রাত না ঘুমালেই বা কী আসে যায়? তাদের ঈমান আকিদাও কী খসে পড়েছে? তাঁর মন অস্থির হয়ে ওঠে। আর কতদিন লাগবে জেগে ওঠতে? যে দেশে পানির চেয়ে মদ সস্তা, সে দেশের মানুষ মদ খাবে না তো খাবে কী। আর এদেরকে মদ খাইয়েই ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে, যাতে আল্লার কদরত বুঝতে না পারে।
তিনি উপস্থিত মুসুল্লিদের এই ঘোরতর বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য ওষ্ঠদ্বয় দ্রুত সঞ্চালনের পাশাপাশি হাতের সঞ্চালনও সমান তালে চালিয়ে যান। তার হাত শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে ওপরে ওঠে যায়, আবার নিচে নেমে আসে। অত্যন্ত ছন্দোময় গতি। তার কণ্ঠ দ্রুত তালে ওঠা-নামা করতে থাকে। কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে কখনো ইংরেজী, কখনো আরবী, তাঁর এই অনর্গল বয়ান, মুসুল্লিদের মনে বিস্ময় জাগায়। তারা জেগে ওঠে। আকমল হোসেন বয়ান দিতে দিতেই দ্রুত চোখ বুলান। তাঁর মনে হলো, মুসুল্লিরা সবকিছুই এখন গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। তা তাদের মাথা দোলানো আর বিজ্ঞের মত তাকিয়ে থাকার ভঙ্গি দেখেই বুঝা যায়। বিশ্বাসটাকে গাঢ় করার জন্য হুংকার ছাড়েন,
“ এত যে বিজ্ঞান বিজ্ঞান করা হচ্ছে, পারবে তারা একখান আয়াত রচনা করতে”?
মাথাটা একদিকে হেলিয়ে, হাত দু’টো পাশ্চাত্য কায়দায় ওপরের দিকে তুলে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন মুসুল্লিদের দিকে। সবাই নীরব। তিনি মুচকি মুচকি হাসেন। এ এক অবিস্মরণীয় বিজয়। এ বিজয় তাঁর সামনে খুলে দেয় অপার সম্ভাবনার এক নতুন জগৎ। তিনি স্পষ্ট দেখতে পান ধূ ধূ মরুভূমি থেকে টগবগিয় ছুটে আসছে ঘোড়া, নাঙ্গা তলোয়ারের ঝলসানো আলোয় কাঁপছে, বেদ্বীন, বিধর্মী, মুরতাদ।
“আলহামদুলিল্লা”।
সমস্বরে সবাই বলে ওঠে, “আলহামদুলিল্লা”।
বিজ্ঞানীরাও আজকাল ইসলামে আলোর সন্ধান পেয়ে ফিরে আসছে ধর্মের পথে।
“আলহামদুলিল্লা”।
হলঘরে আওয়াজ ওঠে, “ আলহামদুলিল্লা”।
“কেন ফিরে আসছে”?
সবাই নীরব। তিনি জানতেন এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারবে না। তিনি বিজ্ঞের মত মাথা দুলাতে দুলাতে বললেন, “ সবই আল্লার কুদরত, তাঁর কুদরত বুঝার ক্ষমতা কী আপনার আমার আছে”?
সবাই বলেন, “সোবহানাল্লা”।
সমস্বরে আওয়াজ ওঠে, “সোবহানাল্লা”।
“হুজুর আমাদের বউ-বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে কিছু ক’ন, যাতে তারা বিপথে না যায়”। ভিড়ের ভেতর থেকে একজনের কন্ঠ থেকে এ কথা ভেসে আসা মাত্রই , সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, “হ্‌, হুজুর আমাগো বউ-বাচ্চাদের কিছু ওয়াজ নসিয়ত কইরা দেন”।
আকমল হোসেন যেনো শুনতে পাননি, এমনি ভঙ্গিতে বলে যান, “ এই যে দেশটার এত টাকা-পয়সা, অথচ মানুষগুলোর গায়ে কাপড় নেই। আর মেয়েলোকদের দিকে তো তাকানোই যায় না”। কথাটা বলতে নিজেও কেমন আড়ষ্ট হয়ে যান। সাক্ষাৎ শয়তান! ভাবতে ভাবতে তাঁর কন্ঠ থেকে ক্ষীণ স্রোতের মত বেরিয়ে আসে,
“ এসবই হলো শয়তানের কাজ”।
হঠাৎ তাঁর মনে হলো, তিনি যেনো নিজের কথাই শুনতে পাচ্ছেন না। তিনি আলতোভাবে নিজের গলায় হাত বুলান। চোখ বোজা। ঠোঁট নড়ছে।
সবাই ভাবলো, হুজুর গভীর ধ্যানে মগ্ন।
আকমল হোসেন দম নিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, “ ইসলামই একমাত্র সত্য”।
তাঁর এ কথা শুনে সবাই বলে ওঠলো, “আলহামদুলিল্লা”।
তিনি ভাবছেন। তিনি ভাবতে থাকেন। কোথা থেকে এবার শুরু করা করবেন?
পেছন থেকে কে একজন অধৈর্য হয়ে বলে ওঠলো, “হুজুর, আমাদের বউ-বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে কিছু ক’ন”।
“আপনারা ধৈর্য হারাবেন না, আমি সবকিছুই বয়ান করিব”। এই বলে তিনি একটা ছোট্ট কাশি দিয়ে শুরু করেন, “ পারিবারিক সমস্যা সমাধানের জন্য এখানকার আইনজীবিদের কাছে যাবার কোন প্রয়োজন নাই। এরা যায়, এরা বিয়ে করলেই কী, না করলেই বা কী, সবই সমান। আদালত-আইনজীবির কাছে দৌড়ায় দুইটা পয়সার ধান্ধায়”। এবার তিনি পর্দার ওপারে অবস্থিত নারীদের উদ্দেশ্যে হুংকার ছাড়েন, “ আপনারাও কি এদেশের ন্যাংটি পড়া মেয়েদের মত হইতে চান”?
ওপারে তখন ভয়াবহ নীরবতা। আতংকে অস্থির নারীদের শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত বইতে থাকে। তারা ঘেমে ওঠে, চিৎকার করে বলতে চায়, “আমরা খানদানি ঘরের মেয়ে, আমাদের ধর্ম-কর্ম আছে”। কিন্তু গলার স্বর উঁচুতে তোলা ধর্মে নিষেধ বলেই তারা মিহি কন্ঠে এক সঙ্গে বলে ওঠে, “না”।
“আরো জোরে ক’ন”?
পর্দানশীল নারীরা দ্বিধাগ্রস্ত, তারা কতটুকু জোরে বলবে ভেবে ঠিক করতে সময় বয়ে যায়।
নারীদের এই দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় তিনি স্বস্তিবোধ করেন। খুব ধীরে ধীরে, যেন কোন গভীর খাদ থেকে ওঠে আসে তাঁর কন্ঠ, “মা-বোনেরা আর একটা প্রশ্ন,” তিনি বিরতি নেন। সবাই স্তব্ধ, উৎকন্ঠিত।
“আপনারা কি আল্লা মানেন”?
অস্তিত্বের প্রশ্ন। তাদের কন্ঠের বাধ ভেঙে যায়, “মাআআনিই, মাআনি, মানিইইই”।
তাল লয়হীন এক গভীর ঐক্য ফুটে ওঠে।
“শরিয়া আইন চালু করতে পারলে আজ পৃথিবীতে এত অশান্তি থাকতো না। মা-বোনেরা বাচ্চা-কাচ্চাগুলোকে কচি বয়সেই ইসলামি এলেম শিখাইবার জন্য মসজিদে পাঠাইবেন, এইখানে প্রত্যেকটা মসজিদে আরবী শিক্ষা দে’য়া হয়, ইসলামি আদর্শে গড়ে তোলা হয়, যাতে বড় হইয়া বেদ্বীনদের মত মদ-মেয়ে আর শুয়োরের গোস্তে ডুইব্যা না থাকে”।
আর সব রকম বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কি সবাই আপনাদের বাচ্চা-কাচ্চাদের এলেম শিখাইতে পাঠাইবেন”?
এবার নারী পুরুষের কন্ঠ ভেসে আসে অভিন্ন স্রোতে, তাদের কন্ঠ সংহত, ঐক্যব্ধ আওয়াজ ওঠে, “ হ্যাঁ, আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের পাঠাইবো”।
“আলহামদুলিল্লা”।
আকমল হোসেনের কন্ঠ থেকে নির্গত হয়ে আলহামদুলিল্লা উর্ধাকাশে পৌঁছবার আগেই, হাওয়া থেকেই যেন নেমে আসেন শ্মশ্রুমন্ডিত এক নওজোয়ান। বিনম্র ভঙ্গিতে আকমল হোসেনের সামনে এসে একখানা প্রচারপত্র হাতে গুঁজে দিয়ে, হারিয়ে যায় মুসুল্লিদের ভিড়ে। মুসুল্লিদের মধ্যে হঠাৎ চাঞ্চল্য দেখা দিল। কে আগে নেবে, তাই নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো।
আকমল হোসেন আসন্ন ঝুড়ের পূর্বাভাস দেখতে পেলেন। মুসুল্লিদের ছোড়া পাথরে রাস্তাঘাট, বড় বড় দালান সব ঢাকা পড়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে হারাম মাংসের দোকান, মদ-বিয়ারের দোকানগুলোর কোন চিহ্ন নেই। অর্ধ নগ্ন নারীরা সব চাপা পড়ে আছে নিক্ষিপ্ত পাথরে। সব মূর্তি ধুলায় নিশ্চিহ্ন। নাস্তিকদের পাঠাগারগুলোতে আগুন।
নিজেও তিনি এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে পাথর ছোড়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কতদিন হলো, এমন একটা স্বপ্ন দেখে যাচ্ছেন, সেই স্বপ্ন যেনো আজ বাস্তব হ’তে চলেছে। তিনি চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলে ওঠেন, “সোবহানাল্লা”।
হলঘর থেকে জড়ানো কন্ঠের ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসে, “সোবহানাল্লা”।
বিস্মিত আকমল হোসেন চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলেন, গোটা হলঘর প্রায় খালি, বয়সের ভারে ন্যূজ্ব মাত্র চারজন মুসুল্লি বসে বসে ঝিমাচ্ছে।
“আপনারা?”
“আমরা?” তারা ভাবলো, হুজুর হয়তো তাদেরকে ফেলে যেতে পারছেন না। মুখ কাচুমাচু করে একজন জবাব দিল, “কি করবো, আমরা তো এখন আর গাড়ি চালাইতে পারি না, ছেলেদের আসবার কথা, তাই তাদের অপেক্ষায় বইস্যা আছি।“
১৯৯৮