সখি, ভালবাসা কারে কয়?


 

মুক্তমনায় আমরা প্রতি বছর ডারউইন দিবস পালন করি। সেই বিশেষ দিনটিতে চার্লস ডারউইন এবং তার যুগান্তকারী বিবর্তন তত্ত্বকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার চেষ্টা করা হয়।  এরকম ঘটা করে স্মরণ করার নিঃসন্দেহে একটা বড় কারণ আছে। আসলে পৃথিবীতে খুব কম বৈজ্ঞানিক ধারণাই কিন্তু জনসাধারণের মানসপটে স্থায়ীভাবে বিপ্লব ঘটাতে পেরেছে। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব এমনি বিপ্লবী তত্ত্ব, তেমনি জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডারউইন আর রাসেল ওয়ালেস প্রস্তাবিত বিবর্তনতত্ত্ব।  দার্শনিক ডেনিয়েল ডেনেট তার একটি বইয়ে বলেছিলেন[1],

‘আমাকে যদি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধারণাটির জন্য কাউকে পুরষ্কৃত করতে বলা হয়, আমি নিউটন, আইনস্টাইনদের কথা মনে রেখেও নির্দ্বিধায় ডারউইনকেই বেছে নেব।’

কাজেই এমন যুগান্তকারী একটি তত্ত্ব, তার সঠিক উদযাপন না হলে কি চলে!  বলা বাহুল্য, মুক্তমনাই প্রথম বারের মতো ডারউইন দিবসকে বাঙ্গালী পাঠকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্বটুকু কাঁধে তুলে নিয়েছিলো ২০০৬ সালে। আন্তর্জালের বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা সে বছর ডারউইন দিবস পালন করে প্রথমবারের মতো। এর পর থেকে প্রতি বছরই পালন করা হচ্ছে।  সবচেয়ে বড় আকারে পালন করেছিলাম আমরা ২০০৯ সালে। কারণ ঐ বছরটাই  ছিলো ডারউইনের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী আর  সেই সাথে তার জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্রজাতির উদ্ভব’ বা ‘অরিজিন অব স্পিশিজ’-এর প্রকাশেরও দেড়শত বছর। এখন তো বাংলাদেশে বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ, যুক্তিবাদী কাউন্সিল সহ বহু সংগঠনই ঘটা করে ডারউইন দিবস পালন করে, সারা দিন ব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠান কিংবা র‍্যালির আয়োজন করে। বলা নিষ্প্রয়োজন, আমাদের জন্য ডারউইন দিবস ডারউইনের দীর্ঘ শশ্রুমন্ডিত মুখচ্ছবির কোন স্তব ছিলো না, বরং তাঁর যুগান্তকারী আবিস্কারের যথাযথ স্বীকৃতি, তাঁর বৈজ্ঞানিক অবদানের প্রতি নির্মোহ আর বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ডারউইন দিবস পালন করা হয় প্রতি বছর ১২ই ফেব্রুয়ারী। বাংলাদেশের প্রায় কেউই এই বিশেষ দিনটির সাথে পরিচিত না হলেও এর দু দিন পরের ১৪ই ফেব্রুয়ারী তারিখটির সাথে  প্রায় সবাই পরিচিত।  সেই যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে – বিশ্ব ভালবাসা দিবস। এই ভালবাসা দিবস কী, কিংবা কাহাকে বলে তা নিয়ে বোধ হয় বিশদ না বললেও চলবে। কারণ এ ব্যাপারটি কারোরই এখন অজানা কিছু নয়।  কিন্তু যেটি অজানা তা হল, এই ভালবাসা দিবসের উদযাপিত ভালবাসার সাথে  ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা! আমার আজকের এই লেখাটি সেই ঘনিষ্ট প্রেমময় সম্পর্কেরই নিঃশঙ্ক উন্মোচন।

গত বছর ২০১০ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী আমাদের মুক্তমনা সদস্য অপার্থিব একটি চমৎকার প্রবন্ধ লেখেছিলেন ‘ভালবাসা ও বিবর্তন’ শিরোনামে[2]। দুই দিবসের তাৎপর্যকে বিনি সুতার মালায় তিনি গাঁথলেন এক অনুপম ছন্দে। তিনি তার প্রবন্ধ শুরুই করলেন এই বলে –

‘রসকষহীন ডারউইন দিবসের পর আসে রসে ভরপুর ভালবাসা দিবস প্রেমিকদের ডারউইন দিবসের কঠিন শীতল শিক্ষা থেকে রেহাই দিয়ে ভালবাসার মিষ্টি আমেজের ছোঁয়া নিয়ে। দুটো দিবসের প্রায় একই সময় পালন করাটা হয়ত এক যোগসূত্রহীন কাকতালীয় ব্যাপার। ডারউইনের জন্মদিন আর রোমান পাদ্রী সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদিবসের মধ্যে কি যোগসূত্রই বা থাকতে পারে। কিন্তু ডারউইনের তত্ত্ব তথা বিবর্তনের সঙ্গে সত্যই ভালবাসার এক গভীর যোগসূত্র আছে, যা মোটেই কাকতালীয় নয়। ডারউইনের “প্রজাতির উৎস (Origin of Species)’’ আর “মানুষের উৎপত্তি (The Descent of man)’’ বই দুটি প্রকাশিত হবার পর থেকে আজ অবধি ডারউইনের সেই মূল তত্ত্বকে ভিত্তি করে ও নূতন সাক্ষ্য প্রমাণ আর পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান এর দ্বারা সেই তত্ত্বকে পরিশীলিত ও সংশোধিত করে মানব প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টায় জীববিজ্ঞানীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। ‘প্রেম কি?’, ‘মানব নৈতিকতার উৎস কি?’  এ ধরণের সনাতন প্রশ্নগুলোর উত্তর এখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে আসছে সামাজিক-জীববিজ্ঞানী আর বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার বদৌলতে, বিশেষ করে বিংশ শতকের শেষ দুই দশকে প্রখ্যাত গবেষকদের বিভিন্ন গবেষণা থেকে। তাঁদের গবেষণা মানব অনূভুতির সকল দিকেরই কারণ হিসেবে আমাদের বৈবর্তনিক ইতিহাসের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। অন্য সব অনূভুতির মত প্রেমানূভুতির মূলও বিবর্তনে নিহিত’।
 

অপার্থিব ভুল কিছু বলেননি।  বিবর্তনের কল্যাণে প্রেম ভালোবাসার অন্তিম রহস্যগুলোর অনেক কিছুই এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। তবে কিছু কথা আছে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে,  বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা প্রেম শব্দটিকে কেবল আধো আধো প্লেটোনিক কিংবা স্বর্গীয়  পরিমণ্ডলে আবদ্ধ না থেকে এটাকে অনেক ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেন।  ফস্টি নস্টি কিংবা টক ঝাল মিস্টি ভালবাসার অনুভুতির বাইরে আছে পারষ্পরিক মনোদৈহিক আকর্ষণ। পাশাপাশি থাকে রাগ, অভিমান, ঈর্ষা । এর সাথে থাকে সঙ্গী নির্বাচনের কৌশল, আনন্দ, ভয়, ঘৃণা, বিচ্ছেদ এমনকি যৌনমিলনের উদগ্র আকাংক্ষাও।

শুরু করা যাক সেই চিরপুরাতন অথচ সদা নতুন প্রশ্নটি দিয়ে।  প্রেম কি?  শেক্সপিয়র তার একটি নাটিকায় তার সৃষ্ট চরিত্রের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছিলেন, “what ’tis to love?”[3]। আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও তার একটি বিখ্যাত গানে একই ধরণের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন  –

 
সখি, ভাবনা কাহারে বলে।
সখি, যাতনা কাহারে বলে।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী – ‘ভালোবাসা’, ‘ভালোবাসা’
সখি, ভালোবাসা কারে কয়!
সেকি কেবলি যাতনাময়।
সেকি কেবলই চোখের জল?
সেকি কেবলই দুখের শ্বাস? …

গানটি শোনা যাক শ্রাবনী সেনের কণ্ঠে –
httpv://www.youtube.com/watch?v=emvIYPWbqDk
 
ভালবাসা নিয়ে ইংরেজীতেও অনেক ধরনের গান আছে।  এর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গানটি হচ্ছে – I’ll Never Fall in Love Again। গানের কথাগুলো এরকমের –

What do you get when you fall in love?
A guy with a pin to burst your bubble
That’s what you get for all your trouble
I’ll never fall in love again
I’ll never fall in love again
 
What do you get when you kiss a girl
You get enough germs to catch pneumonia
After you do, she’ll never phone you
I’ll never fall in love again
I’ll never fall in love again
 

এই মজাদার গানটি আমরা শুনবো Gail Blanco’র কন্ঠে –
httpv://www.youtube.com/watch?v=vUHx6UE_U1w
 
কিন্তু কবিগুরু যখন ‘সখি ভালবাসা কাহারে বলে?’ বলে গানে গানে প্রশ্ন করেছিলেন  কিংবা শেক্সপিয়র তার নাটকে সংলাপ দিয়েছিলেন, “what ’tis to love?” বলে,  তখন কি তারা একবারের জন্যও ভাবতে পেরেছিলেন তাঁর এই প্রশ্নের কি উত্তর অপেক্ষা করছে তাঁদের মৃত্যুর অনেক বছর পরে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে? বিবর্তন মনোবিজ্ঞান সহ বিবর্তনের বিভিন্ন শাখা থেকে  পাওয়া প্রান্তিক জ্ঞানের বদৌলতে প্রেমের এক সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কিন্তু দেয়া সম্ভব।

কিছুদিন আগেও আমরা ঢালাও ভাবে আমরা বলে দিতাম ভালবাসার কোন সংজ্ঞা নেই, বিজ্ঞান ভালবাসার কোন ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম ইত্যাদি। সেই দিন আর নেই। বিজ্ঞান এখন চোরের মত সিঁদ কেটে ঢুকে পড়েছে ভালবাসার গোপন কুঠুরিতে।  চলুন আমরাও সে কুঠুরিতে পা রাখি…
 

 
কুদ্দুছ ‘লবে’ পড়িয়াছে। তাহার মন উড়ু উড়ু।  পড়ালেখায় মন নেই।  বই খুললেই কেবল সিমির মুখ ভেসে উঠে।  আনমনে গাইতে থাকে আগুনের গান –

ফিজিক্স কেমিস্ট্রিতে মন বসে না
বই খুললেই দেখি তার মুখখানা
অস্থির মন আর বাধা মানে না।
 
একা পথে চললেই পাশে চলে সে
নিবিড় হয়ে সে বলে সে মোরে
ভালবাসি  ভালবাসি ..। 

ক্যামন যেন ঘোরের মধ্যে থাকে কুদ্দুস সর্বক্ষণ।  একটা পাখি দেখলে মনে হয় – ইস পাখির মত ডানা মেলে যদি সিমির সাথে উড়ে বেড়ানো যেতো। একটা গোলাপ ফুল দেখলেই মনে হয় – আহা যদি সিমির হাতে তুলে দেয়া যেত! রাস্তার পাশে চটপটির গাড়ি দেখলে মনে হয় – আহা সিমির সাথে মিলে ফুচকা খাওয়া যেত!

না সিমির সাথে ফুচকা খাওয়া আর কুদ্দুসের হয়ে উঠে না। কারণ সিমি রাস্তার আজে বাজে জিনিস খায় না। সিমি মহা বড়লোকের মেয়ে। বসুন্ধরার আলীশান ফ্ল্যাটে থাকে।  পাজেরো জিপে করে ভার্সিটিতে আসে। ড্রাইভার সাহেব দরজা খুলে দেয়, আর সিমি আলতো পায়ে গাড়ি থেকে নেমে সটান হাটা দেয় ক্লাসের দিকে।   স্টিফেনি মেয়র কিংবা লিসি হ্যারিসনের ইংরেজী উপন্যাসের বই বগলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ‘হাবি জাবি পোলাপাইনরে’ পাত্তাই দেয় না সিমি। মোটের উপর সিমি জানেই না তার জন্য কোন এক মজনু দিওয়ানা!
আর ওদিকে তো মজনু কুদ্দুসের অবস্থা আসলেই কেরোসিন। সারক্ষণই ঘোরের মধ্যে থাকে। মনে মনে আকাশ  কুসুম কল্পনা।  ভাবে কোনদিন হয়তো চলতে গিয়ে কিংবা সিড়ি ভেঙ্গে নামতে গিয়ে সিমি উষ্ঠা খেয়ে পড়বে, স্টেফানি মেয়ারের বইগুলো বগল থেকে ছিটকে পড়ে যাবে, আর ঠিক সেসময়ই বীর পুরুষের মতো রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটবে নায়করাজ কুদ্দুসের। পড়ে যাওয়া বইগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সিমির হাতে তুলে দিবে, সিমি প্রথম বারের মতো অবাক নয়নে তাকাবে কুদ্দুসের দিকে, সে দৃষ্টিতে থাকবে আধো কৃতজ্ঞতা, আধো প্রেম, আর আধো রহস্যের ছোয়া…
 
নিশা লাগিলো রে,
বাঁকা দু’ নয়নে নিশা লাআগিলো রে … (8)

httpv://www.youtube.com/watch?v=z6AJy7qb3gE
 
কিন্তু সাতমন ঘিও পুড়ে না, আর সিমিও উষ্ঠা খায় না।  আর কুদ্দুসের প্রেমের শিকেও ছিঁড়ে না।  কিন্তু ছিঁড়ে না ছিঁড়ে না বলেও শেষ পর্যন্ত ছিঁড়লো একদিন।  ক্যামনে?  ক্যামনে আর, এমনে –

চোখ থাকলেই চোখাচোখি হবে।
হল!
এখানেই শেষ হতে পারতো –
না, প্রেম হয়ে গেল!

 তা কুদ্দুস-সিমির প্রেম ক্যামনে হল, আর তারপর আর কী কী হল আমরা আর সেখানে এখন না যাই। আমরা বরং চিন্তা করি – কুদ্দুসের এই সদা ঘোর লাগা অবস্থার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি? এ নিয়ে  রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ হেলেন ফিশার এবং স্নায়ুচিকিৎসক লুসি ব্রাউন, আর্থার অ্যারোন প্রমুখ বিজ্ঞানীরা প্রায় ৪০ জন  প্রেমে পড়া ছাত্রছাত্রীদের উপর এক গবেষণা চালান[4]। তাদের গবেষণার ধরণটি ছিলো এরকমের। প্রেমিক-প্রেমিকাদের সামনে তাদের ভালবাসার মানুষটির ছবি রাখা হল, এবং তাদের মস্তিষ্কের ফাংশনাল এমআরআই (fMRI) করা হলো।  দেখা গেলো, এ সময় তাদের মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল এবং কডেট অংশ উদ্দিপ্ত হচ্ছে, আর সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে ডোপামিন নামক এক রাসয়ায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটছে। অবশ্য কারো দেহে ডোপামিন বেশি পাওয়া গেলেই যে সে প্রেমে পড়েছে তা নাও হতে পারে। আসলে নন-রোমান্টিক অন্যান্য কারণেও কিন্তু ডোপামিনের নিঃসরণ বাড়তে পারে।  যেমন, গাঁজা কিংবা কোকেইন সেবন করলে।  সেজন্যই আমরা অনেক সময়ই দেখি ভালবাসায় আক্রান্ত মানুষদের আচরণও অনেকটা  কোকেইনসেবী ঘোরলাগা অবস্থার মতোই টালমাটাল হয় অনেক সময়ই।
 
তবে ভালবাসার এই রসায়নে কেবল ডোপামিনই নয় সেই সাথে জড়িত থাকে অক্সিটাইসিন, ভেসোপ্রেসিন  সহ নানা ধরণের বিতিকিচ্ছিরি নামের কিছু হরমোন। বিজ্ঞানীরা বলেন, এই হরমোনগুলো  নাকি ‘ভালবাসা টিয়ে রাখতে’ মানে প্রেমিক প্রেমিকার বন্ধন দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে। এমনকি বিজ্ঞানীরা এও বলেন কেউ মনোগামী হবে না বহুগামী হবে – তা অনেকটাই কিন্তু নির্ভর করছে এই হরমোনগুলোর তারতম্যের উপর।  দেখা গেছে রিসেপটর বা গ্রাহক জিনে ভেসোপ্রেসিন হরমোনের আধিক্য থাকলে তা পুরুষের একগামী মনোবৃত্তিকে ত্বরান্বিত করে।  বিজ্ঞানীরা প্রেইরি ভোলস আর মোন্টেইন ভোলস নামক দুই ধরণের ইঁদুরের উপর গবেষণা চালিয়ে তারা দেখেছেন, একগামিতা এবং বহুগামিতার মত ব্যাপারগুলো অনেকাংশেই হরমোনের ক্রিয়াশীলতার উপর নির্ভরশীল। এমনকি বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম উপায়ে ভেসোপ্রেসিনের প্রবাহকে আটকে দিয়ে একগামী ইদুঁরকে বহুগামী, কিংবা অতিরিক্ত ভেসোপ্রেসিন প্রবেশ করিয়ে বহুগামী ইঁদুরকে একগামী করে ফেলতে সমর্থ হয়েছেন। তবে  ইঁদুরের ক্ষেত্রে যেটা সত্য তার পুরোটুকু  মানুষের ক্ষেত্রে সত্য কিনা তা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। অন্ততঃ আমার মনেই হয় এরশাদসাহেবের মতো বিশ্বপ্রেমী বহুগামী লুলপুরুষদের লোলুপতাকে মনে হয় না কেবল ইঁদুরের মতো হরমোন চিকিৎসার সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।  
 
কিন্তু কথা হচ্ছে তীব্র প্রেমের সময়গুলোতে কেন দ্বিগবিদ্বিগশুন্য  নেশার ঘোর লাগা ভাবের উদয় হয়, কেন বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারেই লোপ পায়?  কেনই বা ভয়ভীতি উবে যায় রাতারাতি? এ সময় বন্ধুদের পরামর্শও মাথায় ঢোকে না। যদি কেউ কুদ্দুসকে বলতো ‘ঐ ব্যাটা কুদ্দুস – সিমির পিছে অযথা ঘুইরা লাভ নাই, ওর জগৎ আর তোর জগৎ আলাদা…’ কুদ্দুসের মাথার দেওয়াল সেই তথ্য পৌঁছুবেই না।  কিন্তু কেউ যদি আবার  উলটো বলে যে, ‘সিমি আজকে তোর সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলো …’ সাথে সাথেই কুদ্দুসের মনে হবে এ যেন ‘মক্কা বিজয়’! আসলে তীব্রপ্রেমের সময়গুলোতে কেন মানুষজনের বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পায় তার একটা ভাল ব্যাখ্যা আছে বিজ্ঞানীদের কাছে। আমাদের মস্তিস্কে অ্যামাগডালা বলে একটি বাদাম আকৃতির প্রত্যঙ্গ আছে।  সেটা এবং মস্তিস্কের কর্টেক্সের কিছু এলাকা আমাদের ভয় ভীতি নিয়ন্ত্রণ করে, অকস্ম্যাৎ বিপজ্জনক পরিস্থিতি আসলে আমাদের আগাম সতর্ক করে দিতে পারে।  দেখা গেছে প্রেমের রোমাঞ্চকর এবং উত্তাল সময়গুলোতে মস্তিকের এ এলাকাগুলোর কাজ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।  ফলে ভয় ভীতি কিংবা ‘ক্রিটিকালি’ চিন্তাকরার ব্যাপার স্যাপারগুলো পুরোপুরি লোপ পায় তখন। দুর্মুখেরা বলে, বেশি পরিমানে গাঁজাভাঙ খেলেও নাকি ঠিক এমনটিই হয়।  

 
কিন্তু কথা হচ্ছে কুদ্দুসের এই কোকেইন মার্কা  প্রেমানুভূতির মূল উৎস বা কারণ কি? উত্তরটা কিন্তু খুব সোজা।  ঘুরে ফিরে সেই একই ব্যাপার, যা বিবর্তনের একেবারে গোড়ার কথা – বংশাণু রক্ষার তাগিদ বা নিজের জিনকে টিকিয়ে রাখার অবচেতন প্রয়াস।  আসলে প্রতিলিপি, পরিব্যক্তি এবং প্রকারণের সমন্বয়ে গঠিত প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটা বিবর্তন শুধু প্রেমানুভূতিই নয়, বস্তুত এটি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কামনা, বাসনা, প্রণয়, আকাঙ্ক্ষা সহ মানুষের সবধরণের অনুভূতি ও আচরণেরই জন্ম দেয়।

আসলে বংশাণু রক্ষার জন্য যে কোন প্রাণী অন্ততঃ প্রজননক্ষম বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চায়, আর  সঠিক যৌনসঙ্গি নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের বংশানু পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে চায়।  সঠিক সঙ্গি নির্বাচন করাটা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটিই প্রধাণতঃ প্রণয়াকাংখার পেছনে মূল উপলক্ষ্য হিসেবে কাজ করে। ডারউইন নিজেও ব্যাপারগুলো নিয়ে অনেক চিন্তা করেছিলেন এবং সেজন্যই তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনের (Natural selection) পাশাপাশি যৌনতার নির্বাচন (sexual selection)কেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন তার বিবর্তন তত্ত্বে। না দিয়ে তো উপায় ছিলো না। ডারউইন লক্ষ্য করেছিলেন যে,  প্রানী জগতে বেশ কিছু বৈশিষ্ট পাওয়া যাচ্ছে যা কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। কারণ  এ বৈশিষ্টগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলশ্রুতিতে টিকে থাকার কথা নয়।  এগুলো টিকে আছে, কারণ এই বৈশিষ্টগুলো বিপরীত লিঙ্গের যৌনসঙ্গির  দ্বারা বংশপরম্পরায় দিনের পর দিন আদৃত হয়েছে।  একটি ক্লাসিক উদাহরণ হচ্ছে পুরুষ ময়ুরের দীর্ঘ পেখম থাকার উদাহরণ।  এমন নয় যে দীর্ঘ পেখম পুরুষ ময়ুরকে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে কোন বাড়তি উপযোগিতা দিয়েছিলো।  বরং দীর্ঘ পেখমটি ময়ূরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যহতই করার কথা। এবং করেছেও। তাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাহায্যে ময়ুরের দীর্ঘ পেখমকে ব্যাখ্যা করা যায় না। ময়ুরের দীর্ঘ পেখম টিকে আছে মূলতঃ  নারী ময়ূর বা ময়ূরীর পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে।  লম্বা পেখমকে ভাল বংশাণুর নির্দেশক হিসেবে ময়ূরীরা দেখত। কাজেই দীর্ঘ পেখমের ঢেউ তোলা  সুশ্রী ময়ূরেরা যৌনসঙ্গি হিসেবে নির্বাচিত হতে পেরেছিলো, কারণ বিপরীত লিঙ্গের যৌনসঙ্গিদের কাছে তারা ছিলো একেকজন ‘ব্রাড পিট’ কিংবা টম ক্রুজ!  তারাই শেষপর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছিলো ময়ূরীদের যৌনাকর্ষণের ভিত্তিতে।

এই ‘মেটিং সিলেকশনের’ মায়াবী খেলা চলে কম বেশী সব প্রাণীর মধ্যেই।  স্তন্যপায়ী প্রানীর প্রায় সব প্রজাতিতেই দেখা যায় পুরুষেরা সাধারণত অনেক বড় এবং বলশালী হয়, সেই সাথে তাদের মধ্যে দেখা যায় অনেক আকর্ষনীয় বৈশিষ্টের সমাহার (যেমন, উজ্জ্বল রঙ, শিং, কেশর, দ্রুতগামিতা, ক্ষিপ্রতা, নৃত্য এবং সঙ্গিতে পারদর্শিতা ইত্যাদি)। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। বড় চুল রাখা, দামী সানগ্লাস, কেতাদুরস্ত কাপড় পরা থেকে শুরু করে দামী গাড়ি, বাড়ি, শিক্ষা, বাকচাতুর্য, প্রতিভা, নাচ, গান, বুদ্ধিমত্তা  সবকিছুই মানুষ কাজে লাগায় বিপরীত লিঙ্গকে  আকর্ষণের কাজে। মানব সমাজের নারীপুরুষের বহু বৈশিষ্ট এবং অভিব্যক্তিই মোটাদাগে সম্ভবতঃ যৌনতার নির্বাচনের ফল বলে মনে করেন অনেক গবেষকই।  আমি এ নিয়ে মুক্তমনা ব্লগে বেশ কিছু লেখা আগে লিখেছি (যেমন দেখুন এখানে কিংবা এখানে); সংশপ্তক  কিছুদিন আগে মেটিং সিলেকশনে পুরুষের নাচের গুরুত্ব তুলে ধরে একটি চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘পুরুষের নৃত্য এবং নারী’ শিরোনামে। এগুলো সবই মানব সমাজে যৌনতার নির্বাচনের গুরুত্বকে সুচারুভাবে তুলে ধরে। অপার্থিব  তার ‘ভালবাসা ও বিবর্তন’ (পূর্বোক্ত) লেখায় লীন মার্গুলিস ও ডরিয়ান সেগানের “Mystery Dance: On the Evolution of Human Sexuality” বই থেকে একটি চমৎকার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন –

“প্রযুক্তি কিংবা সভ্যতা আমাদেরকে আমাদের পশুত্ব থেকে খুব দূরে সরাতে পারেনি, বরং তা আরও জোরাল ভাবে সেটা অধিষ্ঠিত করেছে। সৌখীন চশমা, স্কন্ধালঙ্কার ইত্যাদি যেন অনেকটা ময়ূরের পুচ্ছের মতই।” 

যৌনতার নির্বাচন আমাদের মানসপটে কাজ করে বলেই কারো সুন্দর চেহারা কিংবা মনোহারী ব্যক্তিত্ব দেখলে আমরা সবাই মনের অজান্তেই আন্দোলিত  হয়ে উঠি।  বঙ্কিমচন্দ্র যে একসময় বলেছিলেন, ‘সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র’ – ব্যাপারটা কিন্তু মিথ্যে নয় একেবারে।  বিজ্ঞানীরা দেখেছেন ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ কিংবা সংস্কৃতিভেদে সবাই বিপরীত লিঙ্গের যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে ‘আকর্ষনীয়’ বলে মনে করে সেগুলো হল – পরিস্কার চামড়া এবং প্রতিসাম্যময় মুখ, স্বচ্ছ চোখ, সুন্দর এবং সুগঠিত দাঁত,  সতেজ এবং সুকেশী চুল এবং ‘গড়পরতা’ চেহারা। 

পরিস্কার চামড়া, স্বচ্ছ চোখ, সুন্দর এবং সুগঠিত দাঁত,  সতেজ চুল কেন পছন্দনীয় তা বোঝা কঠিন কিছু নয়। এগুলো তারুন্য, সুস্বাস্থ্য এবং সর্বোপরি প্রজনন ক্ষমতার বাহ্যিক প্রকাশ ছিলো আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের কাছে।  একই ব্যাপার খাটে প্রতিসাম্যময় মুখের ক্ষেত্রেও। এ ধরণের সুগঠিত চেহারা বিপরীত লিঙ্গের কাছে প্রমাণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো যে তার পছন্দনীয় মানুষটি অপুষ্টির শিকার নয়, কিংবা জীবানু কিংবা পরজীবীদের আবাসস্থল নয়। অর্থাৎ এ বৈশিষ্টগুলো ছিলো সঠিক যৌনসঙ্গি নির্বাচনের একধরণের সফল মার্কার তাদের চোখে।
 
চেহারার গড়পরতা ব্যাপারটা সাদা দৃষ্টিতে বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে।  কেন গড়পরতা চেহারাকে ‘আকর্ষনীয়’ বলে মনে হবে? এটা মনে হয় কারণ, ‘গড়পরতা চেহারা’ একটা বিশেষ ব্যাপারকে সামনে তুলে ধরে।  সেটা হচ্ছে  ‘জেনেটিক ডাইভার্সিটি’ বা বংশানুগত বৈচিত্র। এই বৈচিত্র বজায় থাকা মানে বাহক অধিকতর রোগ প্রতিরোধে সক্ষম এবং প্রতিকূল পরিবেশে সহজে অভিযোজিত হবার ক্ষমতা সম্পন্ন বলে ধরে নেয়া হয়। আসলে আমরা যে গড়পরতা চেহারাকে ‘সুন্দর’ বলে রায় দেই, তা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন একটি ছোট পরীক্ষার মাধ্যমে। নির্বিচারে ১০ টি চেহারা নিয়ে ফটোশপ কিংবা কোন প্রফেশনাল সফটওয়্যারে চেহারাগুলো মিশ্রিত (blend) করে  উপস্থাপন করলে মিশ্রিত চেহারাটিকে অধিকতর আকর্ষনীয় বলে মনে হয়।  নীচের ছবিটি লক্ষ্য করুন। প্রথম দুটো ছবিকে মিশ্রিত করে তৃতীয় ছবিটি তৈরি করা হয়ছে।  মনঃস্তাত্বিক জরিপে অধিকাংশ লোকই তৃতীয় ছবিটিকে অন্য দুটো ছবির চেয়ে অধিকতর আকর্ষনীয় বলে রায় দেয়!
 

 
চিত্রঃ  যখন একাধিক আসল চেহারাকে মিশ্রিত করে গড়পরতা চেহারাতে পরিণত করা হয়, সেটি অধিকাংশ মানুষের চোখে আকর্ষনীয় হয়ে উঠে।
 
 
তবে যৌনতার নির্বাচন শুধু অভিন্ন মানব প্রকৃতি গঠন করেছে ভাবলে কিন্তু ভুল হবে।  বহুক্ষেত্রেই এটি পার্থক্য সূচিত করেছে নারী পুরুষের পছন্দ অপছন্দে। অভিন্ন কিছু বৈশিষ্টের পাশাপাশি যৌনতার নির্বাচন আবার কাজ করেছে নারী-পুরুষের পার্থক্যসূচক মানস জগৎ তৈরিতেও – পলে পলে একটু একটু করে। আসলে সত্যি বলতে কি যৌনতার নির্বাচনকে পুঁজি করে  পুরুষ যেমন গড়েছে নারীকে, তেমনি নারীও গড়েছে পুরুষের মানসপটকে।  এক লৈঙ্গিক বৈশিষ্টগুলোর আবেদন তৈরি করেছে আরেক লিঙ্গের চাহিদা।  তৈরি এবং ত্বরান্বিত হয়েছে বিভিন্ন লিংগ-ভিত্তিক নানা পছন্দ অপছন্দ।  পুরুষ দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছে বলে স্বভাবে হয়ে উঠেছে অনেক সহিংস। আবার নারীরাও একটা সময় পুরুষদের এই সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, কারণ এ ধরণের পুরুষেরা নিজ নিজ ট্রাইবকে রক্ষা করতে পারত বহিঃশত্রুর হাত থেকে।  এ ধরণের সমর দক্ষ পুরুষেরা ছিলো সবার হার্টথ্রব – এরা দিয়েছিলো নিজের এবং পরিবারের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা। এ ধরণের সাহসী পুরুষেরা নিজেদের জিন ছড়াতে পেরেছে অনেক সহজে, আমার মত কাপুরুষদের তুলনায়!  ফলে নারীরাও চেয়েছে তার সঙ্গিটি কাপুরুষ না হয়ে সাহসী হোক, হোক বীরপুরুষ!  এই ধরণের চাহিদার প্রভাব এখনো সমাজে দৃশ্যমান। ডেট করতে যাওয়ার সময় কোন নারীই চায় না তার সঙ্গি পুরুষটি উচ্চতায় তার চেয়ে খাটো হোক।  সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে এ যেন এক অলিখিত নিয়ম, শুধু আমেরিকায় নয়, সব দেশেই! বাংলাদেশে বিয়ে করতে গেলে পাত্রের উচ্চতা বউয়ের উচ্চতার চেয়ে কম দেখা গেলেই আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে গাই-গুই শুরু হয়ে যায় মুহূর্তেই।  খাটো স্বামীকে বিয়ে করতে হলে স্ত্রীরও মনোকষ্টের সীমা থাকেনা। হাই হিল জুতো আর তার পরা হয়ে ওঠে না।  আসলে দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় প্রভাব মানসপটে রাজত্ব করার কারণেই এটি ঘটে। লম্বা চওড়া  জামাই সবার আদরনীয়, কারণ একটা সময় লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যবান এই সব পূর্বপুরুষেরা রক্ষা করতে পেরেছিলো স্বীয় গোত্রকে, রক্ষা করেছিলো উত্তরপুরুষের জিনকে – অন্যদের তুলনায় অনেকে ভালভাবে। সেই আদিম মানসপট আধুনিক মেয়েদের মনে রাজত্ব করে তাদের অজান্তেই!
 
আবার পুরুষদের মানসজগতেও নারীদেহের কিছু বৈশিষ্ট নিয়ে উদ্গ্র আগ্রহ দেখা যায় সম্ভবতঃ বিবর্তনীয় তথা যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে মানসপট তৈরি হবার কারণেই। যে কোন দেশের সাহিত্যের পাতা উল্টালেই দেখা যাবে – নারীর পিনোন্নত স্তন, সুডোল নিতম্ব আর ক্ষীন ক’টিদেশ নিয়ে যুগের পর যুগ কাব্য করেছে পুরুষ – সকল সংস্কৃতিতেই।  কারণ নারীদেহের এই বৈশিষ্টগুলোই সকল পুরুষের কাছে মহার্ঘ্য বস্তু। কিন্তু কেন? কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলেন, আদিম সমাজে পুরুষদের কাছে বৃহৎ স্তন এবং নিতম্বের মেয়েরা অধিকতর আদৃত ছিলো প্রাকৃতিক কারণেই। বিপদ সঙ্কুল জঙ্গুলে পরিবশে মেয়েদের বাচ্চা কোলে নিয়ে পুরুষদের সাথে ঘুরতে হত, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাইয়ে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখতে হত এলাকায় খাদ্যস্বল্পতা দেখা দিলে।  অতি আধুনিক কালের কৃষিবিপ্লবের কথা বাদ দিলে মানুষকে আসলেই শতকরা নব্বই ভাগ  সময় যুদ্ধ করতে হয়েছে খাদ্যস্বল্পতার বিরুদ্ধে। যে নারী দীর্ঘদিন খাদ্যস্বল্পতার প্রকোপ এড়িয়ে বুকের দুধ খাইয়ে বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে, তারা টিকে গেছে অনেক বেশি হারে। কাজেই কোন নারীর বৃহৎ স্তন পুরুষদের  কাছে প্রতিভাত হয়েছে ভবিষ্যত-প্রজন্মের জন্য ‘অফুরন্ত খ্যাদ্যের ভান্ডার’  হিসবে। এ এক অদ্ভুত বিভ্রম যেন। এই বিভ্রম দীর্ঘদিন ধরে পুরুষকে করে তুলেছে পৃত্থুল স্তনের প্রতি আকর্ষিত। তারা লালায়িত হয়েছে, লুব্ধ হয়েছে – এ ধরণের দৈহিক বৈশিষ্ট সম্পন্ন নারীর সাথে সম্পর্ক করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে জৈবিক তাড়নায়।  ঠিক একই ভাবে, বহিঃশত্রু যখন আক্রমণ করেছে তখন যে নারী বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে বাঁচতে পেরেছে, তাদের জিন রক্ষা পেয়ছে অনেক সহজে। এই পরিস্থিতির সাথে তাল মিলাতে গিয়ে নারীর কোমড় হয়েছে ক্ষীণ, আর নিতম্ব হয়েছে সুদৃঢ়।  আর এ বৈশিষ্টগুলো পুরুষদের কাছে হয়ে উঠেছে অনেক বেশি আদরনীয়।  
 
নারীর সুদৃঢ় নিতম্বের প্রতি পুরুষদের আগ্রহের অবশ্য আরো একটি বড় কারণ আছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন বিগত পাঁচ মিলিয়ন বছরে  মানুষের মস্তিস্কের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে অবিশ্বস্য দ্রুততায়। ফলে এটি বাচ্চার জন্মের সময় তৈরি করেছে জন্মসংক্রান্ত জটিলতার।  এই কিছুদিন আগেও সাড়া পৃথিবীতেই বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাওয়া মায়েদের সংখ্যা ছিলো খুবই উদ্বেগজনকভাবে বেশি। আজকের দিনের সিসেক অপারেশন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি এই জটিলতা থেকে নারীকে অনেকটাই মুক্তি দিয়েছে।  কিন্তু আদিম সমাজে তো আর সিসেকশন বলে কিছু ছিলো না। ধারণা করা হয়,  সভ্যতার উষালগ্নে ক্ষীণ নিতম্ববিশিষ্ট নারীদের মৃত্যু অনেক বেশি হয়েছে বড় মাথাওয়ালা বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে। টিকে থাকতে পেরেছে  সুডোল এবং সুদৃঢ় নিতম্ব-বিশিষ্ট মেয়েরাই।  কারণ তারা অধিক হারে জন্ম দিতে পেরেছে স্বাস্থ্যবান শিশুর। ফলে দীর্ঘদিনের এই নির্বাচনীয় চাপ তৈরি করেছে নারী দেহের সুদৃঢ় নিতম্বের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক উদগ্র কামনা!

চিত্রঃ অধ্যাপক দেবেন্দ্র সিংহ তার গবেষণায় দেখিয়েছেন,  কোমর এবং নিতম্বের অনুপাত মটামুটি   ০.৭ এর মধ্যে থাকলে তা তৈরি করে মেয়েদের  ‘classic hourglass figure’, এবং এটি পুরুষদের মনে তৈরী করে আদি অকৃত্রিম যৌনবাসনা।
 
পুরুষের চোখে নারীর দেহগত সৌন্দর্যের ব্যাপারটাকে এতদিন পুরোপুরি ‘সাংস্কৃতিক’ ব্যাপার বলে মনে করা হলেও আমেরিকার টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়(অস্টিন শহরে) এর মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক দেবেন্দ্র সিংহ তার গবেষণা থেকে দেখিয়েছেন যে, সংস্কৃতি নির্বিশেষে নারীর কোমর এবং নিতম্বের অনুপাত ০.৬ থেকে ০.৮ মধ্যে থাকলে  সার্বজনীনভাবে আকর্ষণীয় বলে মনে করে পুরুষেরা।  অধ্যাপক সিংহের মতে মোটামুটি কোমর : নিতম্ব  = ০.৭ – এই অনুপাতই তৈরী করে মেয়েদের  ‘classic hourglass figure’, যা পুরুষদের মনে তৈরী করেছে আদি অকৃত্রিম যৌনবাসনা ।  সংস্কৃতি নির্বিশেষে এই উপাত্তের পেছনে সত্যতা পাওয়া গেছে বলে দাবী করা হয়[5]।   সম্প্রতি পোলিশ একটি গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, সুডোল স্তন, সরু কোমড় এবং হৃষ্ট নিতম্ব মেয়েদের সর্বচ্চ উর্বরতা প্রকাশ করে, যার পরিমাপ পাওয়া গেছে দুটো প্রধান যৌনোদ্দীপক হরমোনের (17-β-estradiol & progesterone) আধিক্য বিশ্লেষণ করে[6]। পুরুষের মনে প্রথিত হওয়া কোমর/নিতম্বের এই যৌনোদ্দীপক অনুপাত আসলে তারুন্য, গর্ভধারণক্ষমতা(Fertility) এবং সাধারণভাবে সুসাস্থ্যের প্রতীক। কাজেই এটিও পুরুষের কাছে প্রতিভাত হয় এক ধরণের ‘ফিটনেস মার্কার’ হিসেবে।  বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী ভিক্টর জন্সটন তাঁর ‘Why We Feel? The Science of Emotions’ বইয়ে বলেন যে মেয়েদের কোমর ও নিতম্বের অনুপাত ০.৭ হলে এন্ড্রোজেন ও এস্ট্রোজেন হর্মোনের যে অনুপাত গর্ভধারণের জন্য সবচেয়ে অনুকুল সেই অনুপাতকে প্রকাশ করে।  এরকম আরেকটি নিদর্শক হল সুডৌল ওষ্ঠ। সেজন্যই গড়পরতা পুরুষেরা এঞ্জেলিনা জোলি কিংবা ঐশ্বরিয়া রাইয়ের পুরুষ্ট ওষ্ঠ ছবিতে দেখে লালায়িত হয়ে ওঠে। কাজেই দেখা যাচ্ছে সৌন্দর্য্যের উপলব্ধি কোন বিমূর্ত ব্যাপার নয়।  এর সাথে যৌন আকর্ষণ এবং সর্বোপরি গর্ভধারণক্ষমতার একটা গভীর সম্পর্ক আছে, আর আছে আমাদের দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় পথপরিক্রমার সুস্পষ্ট ছাপ।

সবাইকে ভ্যালেন্টাইন্স ডের শভেচ্ছা এবং সেই সাথে মহীনের ঘোরাগুলি থেকে আমার একটি প্রিয় গান – “ভালবাসা মানে“:

ভালোবাসা মানে ধোঁয়া ছাড়ার প্রতিশ্রুতি
ভালোবাসা মানে এলোচুল মাতোয়ারা
ভালোবাসা মানে সময় থামার আগে
ভালোবাসা মানে তোমার শুরু আমার সারা

ভালোবাসা মানে আর্চিস গ্যালারি
ভালোবাসা মানে গোপন গোপন খেলা
ভালোবাসা মানে কান্নাভেজা চোখে
ভালোবাসা মানে নীল খামেদের মেলা

ভালোবাসা মানে দূরভাষ নিশ্চুপে
শুনে ফেলে অনুভূতির হাসি
ভালোবাসা নান্দনিক যাতায়াতে
ভালোবাসা মানে চৌরাসিয়ার বাঁশি

ভালোবাসা মানে আগাম চলার সুর
ভালোবাসা মানে অবিরাম চলাবসা
ভালোবাসা মানে আঁখিপল্লব ছুঁয়ে
চিনতে শেখা শেষ কাব্যের ভাষা …

httpv://www.youtube.com/watch?v=wHRSB7hHexQ
 

(পাঠকদের পছন্দ হলে সিরিজটা চলতেও পারে…)

[২য় পর্ব]
 

 

তথ্যসূত্র
[1] Daniel C. Dennett, Darwin’s Dangerous Idea: Evolution and the Meanings of Life, Simon & Schuster, 1996, p 21.
[2] অপার্থিব, ভালবাসা ও বিবর্তন, ২৯ মাঘ ১৪১৬ (ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১০)
[3] William Shakespeare (1564–1616), Dialogue between Phebe and Silvius, in As You Like It, act 5, sc. 2, l. 83-98.
 
[4] Helen Fisher, What is Love?, On Air, BBC International Magazine 98:12-15
[5] Singh, D. (2002) Female Mate Value at a Glance: Relationship of Waist-to-Hip Ratio to Health, Fecundity, and Attractiveness. Neuroendocrinology Letters. Special Issue, 23, 81-91.
[6] Jasienska, G., Ziomkiewicz, A., Ellison, P.T., Lipson, S.F., Thune, I. (2004)“Large breasts and narrow waists indicate high reproductive potential in women.” Proceedings of the Royal Society of London “B”, 271: 1213-1217

সখি, ভালবাসা কারে কয়? < পর্ব -১ । পর্ব -২  পরের পর্ব … >