পূর্ববর্তী পর্ব (পর্ব ৮)

আজ ঈদ! মদীনার ঘরে ঘরে আনন্দ। ছোটবেলায় পড়ে আসা এই লাইন দু’টো কেন জানি এখনো মনে পড়ে যায়। কিন্তু, আজতো ঈদ নয়, তবু আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সবার মুখে মুখে এত আনন্দ কেন। যে-দিকে তাকাচ্ছি সবার হাসি হাসি মুখ। কেন জানি সবাই খুব ফুরফুরে মেজাজে আছে। কানাকানি করছে, হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে পড়ে যাচ্ছে। কিছুদূর এগিয়েই বুঝতে পারি, হলের ভিতর শ্যুটিং হচ্ছে। ‘হঠাৎ বৃষ্টি’-খ্যাত নায়িকা হলের ভিতর এসেছেন হঠাৎ করে যেন বৃষ্টি হয়েই। স্বল্পবসনা এই তথাকথিত সুন্দরী নায়িকার আবির্ভাবে বাংলার দামাল ছেলেদের সামাল দিতে ছবির পরিচালককে রীতিমত টাকার বিনিময়ে পলিটিক্যাল ক্যাডার ম্যানেজ করে সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু ছাত্রকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় বাংলা সিনেমা দেখে না-কি, তারা দিব্যি দিয়ে বলবে, বাংলা সিনেমা বলে যে কিছু একটা আছে সেটাই তারা জানে না। কিন্তু কোন সে অজানা কারণে পরিচালক শরফুদ্দীন দীপুর সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খালি হয়ে যায় সেটা এখানে উদ্‌ঘাটন নাই-বা করলাম।

যদি করতেই হয়, তাহলে উদ্‌ঘাটন করতে হবে, তথাকথিত কিছু পলিটিক্যাল ক্যাডারদের উচ্ছৃঙ্খলতায় যেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মগুলো একে একে বাক্সবন্দী, সেখানে একটা অবাক ব্যাপার কি করে না ঘটে থাকতে পারে। দুষ্টু রাজনৈতিক চক্রের অশিষ্ট গুটিকয়েক ছাত্র নামধারী নির্লজ্জের কাছে অসহায় যেখানে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা সবাই। একটা গঠনমূলক কাজ করতে যেখানে দশ জন লাগে, আর ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য একজন লাগে। কথা হচ্ছে, সে বীরপুরুষদের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও কেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শত সহস্র পরীক্ষায় আশ্চর্যজনকভাবে কখনোই নকল হয় না। অন্য আর সবকিছু বাদ দিয়ে দিলেও এই একটা বিষয়ে সত্যিকার অর্থেই এখনো গর্ব করতে পারে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। হয়তো বলা যেতে পারে, এতে অবাক হবার কি আছে, এটাইতো স্বাভাবিক। না, এটা স্বাভাবিক না। অন্য আর আট দশটা স্বাভাবিক কাজ যেখানে স্বাভাবিকভাবে হয় না, সেখানে একটা স্বাভাবিক কাজ স্বাভাবিকভাবে হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক।

বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক পরীক্ষা শেষ করে অন্য আর সবার মত আমিও অবধারিতভাবে চাকুরী জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে। মাস্টার্সের স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় একটা সফট্ওয়্যার ফার্ম-এ জয়েন করেছি। এরা অযথাই অনেক টাকা দেয়, আর সাথে সাথে অযথাই দেয় ‘যন্ত্রণা’। এরই মাঝে কোন এক অলস বিকেলে আমার স্থায়ী ঠিকানার থানার ওসি সাহেব ফোন করে জানতে চাইলেন, আমি কোথা থেকে পাস করেছি, কি করে কিভাবে করেছি। এক পর্যায়ে তাঁর যৌক্তিক প্রশ্নের জবাবে আমি অত্যন্ত রাগতস্বরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিভাবে করেছি মানে…’। তিনি শুধু নরম স্বরে বললেন, ‘না এমনি জিজ্ঞেস করলাম, সরি’। বাংলায় এমন কোনো ওসির জন্ম হয়নি যে, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট এর গরম স্বরের উত্তরে নরম স্বরে সরি সরি বলবে। নম্রতার কারণ কিছুই না, আমি তখন বিসিএস উত্তীর্ণ, তথাকথিত ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ভ্যারিফিকেশান এর জন্য তিনি আমাকে ফোন করেছেন। নিজের মনে মনে বলি, তবে এই আমার শিক্ষা আর এই আমার প্রাপ্তি। যে স্টুডেন্ট আমি দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয় হলের অমানুষদের অন্তঃসারশূণ্য অসহ্য কর্কশ বাক্য হাসি মুখে হজম করেছি, সেই একই স্টুডেন্ট আমি মিথ্যে এক ক্ষমতা পাবার সংবাদেই উদ্ধত হয়ে উঠেছি। বুঝতে পারি, ক্ষমতার কখনো ব্যবহার সম্ভব না, সম্ভব ক্ষমতার অপব্যবহার ।

বুঝতে পারি, আমার শিক্ষা পরিপূর্ণ হয়নি। আমাকে শিক্ষিত করার জন্যই বুঝি বাতিল হল সেই বিসিএস পরীক্ষার ভাইভার ফলাফল। নিজের মনেই ভাবি, ছোট্র এই জীবন আর কত রকমে আমাকে তার রূপ দেখাবে। কোথাও যেন পড়েছিলাম, ‘জনগণ হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক’। শুধু ম্যাজিস্ট্রেট হবার খবরেই যে সাধারণ মানুষ আমাকে দেখলে হাত-পা নামিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে, ফলাফল বাতিলের খবরে সেই একই মানুষ আমাকে দেখে আবার দুই-পা চেয়ারের উপর তুলে দিয়ে হিন্দি সিনেমার গান শুনিয়েছে। আমি শুধুই হেসে গেছি। এরা সবাই আমার শিক্ষক। জীবনের একশ-একটা দিক এদের মত একশ-একজন সাধারণ মানুষই আমাকে শিখিয়েছে। আমি কিছুই চাইনি এদের কাছে। সন্মান চাইনি, আমাকে দেখলে ভয় করুক সেটাও চাইনি। আবার অসন্মানও চাইনি। এরা যা করে নিজ থেকে করে। এই মানুষগুলো প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতিই এদের বলে দেয় কি করতে হবে। প্রকৃতির মতই এরা কখনো বশীভূত, কখনো নির্মম। প্রকৃতির মত এদেরকেও আমার ভালো লাগে প্রাকৃতিকভাবেই ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষের দিনগুলোতে বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা আর ইন্টারভিউ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেলাম। ‘বাতিল ম্যাজিস্ট্রেট’ হবার পর কিছু দিন যেতে না যেতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর’ হিসেবে পরীক্ষা দিলাম। আমার রুমমেটের সাথে একই পদে পরীক্ষা দিতে পারব সে আনন্দে লিখিত পরীক্ষা দিলাম। কোনো ধরণের প্রস্তুতি ছাড়া পরীক্ষা দিতে গিয়ে আশাতীত ফল লাভ করলাম। লিখিত পরীক্ষায় যত কম নাম্বার পাওয়া সম্ভব, তার থেকেও কম অর্থাৎ আশাতীত রকমের কম নাম্বার পেয়ে পাস করলাম। আমার বন্ধু বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা, সে নাম্বার বের করে দেখে বলল, একমাত্র ভাইভাতে অপ্রত্যাশিত রকমের ভালো নাম্বার পেলে চান্স পাওয়া সম্ভব। ভাইভা দিতে গিয়ে দেখি, আমার বোর্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর। আইটিতে উনার নলেজ প্রায় শূন্য দশমিক শূণ্য এর কাছাকাছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য অনেকগুলো সফট্‌ওয়্যার কিনতে হবে, সে-জন্য যে সব ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে তা নিয়ে আমাকে দীর্ঘ এক উপদেশনামা রচনা করতে হলো ভাইভা বোর্ডে। কিছুদিন পর আমার বন্ধু ফোন করে ভাইভায় আমার বোর্ডে সর্বোচ্চ নাম্বার পাবার কথা বলে অল্পদিনের মধ্যে যোগদান পত্র হাতে পাবার কথা জানালো। পরবর্তীতে ব্যাক্তিগত অপছন্দের কারণে সেখানে আমার আর যোগদান করা হয়নি।

এদিকে বাতিল হওয়া বিসিএস ভাইভার তারিখ হল আবার। আবার সেই পুরোনো নাটকের নতুন অভিনয়। “হুগো শাভেজ কে? তিনি কেন বিখ্যাত।” এটা পারলে আমি যোগ্য প্রার্থী, না পারলে অযোগ্য। সে যাই হোক, ‘অত্যাশ্চর্য রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ এর সরকার তিন বছরেরো অধিক সময় নষ্ট করে একজন স্টুডেন্ট এর চাকুরী পাবার যোগ্যতার পরীক্ষা, কুখ্যাত বিসিএস এর ফলাফল ঘোষণা করল। নতুন ফলাফলে আগের থেকে সিরিয়াল আরো সামনে এসে একেবারে প্রথম দিকে চলে আসলাম। কিন্তু ইন্ডিয়া যতই বিমাতাসুলভ আচরণ করুক না কেন, ততদিনে পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক জল গড়িয়ে গেছে, আর সাথে সাথে আমারো নষ্ট হয়ে গেছে সরকারী চাকুরীর করবার একদা অদম্য স্পৃহা।

রাষ্ট্র-সরকার-পৃথিবী জীবন-ডিগ্রি-ক্যারিয়ার, তা তারা যেদিকেই ছুটে যাক-না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিন পর্যন্ত আমি কিংবা আমরা ছুটে গেছি ক্রিকেট মাঠের দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়াম মাঠ, দুপরের উত্তপ্ত সূর্য মাথায় করে নিয়ে আমরা খেলে চলছি। প্রথম বাউন্ডারির সাথে সাথে, চিৎকার করে উঠে সমর্থক সহপাঠীরা। কিছুক্ষণ যেতেই তাদের চিৎকার আস্তে আস্তে থেমে যায়। কিন্তু একটি চিৎকার আর থামে না। জীবনের অসহায়তম মুহুর্তে সবার আগে মানুষ কোন এক অজানা কারণে তার মায়ের নাম ধরে চিৎকার করে। আমরা পাথর হয়ে শুনতে থাকি মা মা করে ডেকে উঠে, কোনো এক মায়ের কোনো এক সন্তানের আর্তচিৎকার; সাথে সাথে সশব্দ লাঠির নির্বিচার-নির্মম আঘাত। বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে আর্মি ক্যাম্প হয়েছে। চারপাশের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তারা জানিয়ে দিচ্ছে তাদের অবস্থানের কথা। কিন্তু এ-অত্যাচার আমরা সিভিলিয়ানরা কি করে সইবো, আমাদেরতো অভ্যাস নেই। এই নির্মমতা থামানোর ক্ষমতাও নেই। তবে একটা ক্ষমতা নিশ্চয় আছে। নষ্ট এই সমাজের অমার্জিত, দুর্বিনীত সব রীতি-নীতি মুখ বুজে সহ্য করার; চোখের সামনে ঘটতে থাকা বর্বর আচার-আচরণ দেখেও না দেখার ভান করার, শুনেও না শুনার ভান করার বিরল ক্ষমতা আমাদের ঠিকই আছে। তাই আমরা পাশ কাটিয়ে চলে যাই, দূরে চলে যাই, দূরে গিয়ে তৈরী করতে থাকি আমাদের সামনে এগিয়ে চলার পথ; অগোচরে, ধ্বংস হতে হতে পিছনে হারিয়ে যায় আমাদের সুপ্ত বিবেক।

পরবর্তী পর্ব (শেষ পর্ব)

(চলবে…)

[email protected]
February 09, 2011