আপনার বাসায় জমিয়ে রাখা পুরানো,বাসি দৈনিক পত্রিকা থেকে চোখ বুজে যে কোন একটি কপি নিয়ে চোখ বুলান। দেখবেন নারীর প্রতি সহিংসতার সচিত্র প্রতিবেদন। ধর্ষণের শিকার নারী, নির্যাতনের শিকার নারী, যৌন হয়রানির শিকার নারী, উত্যক্তকরণে অতীষ্ট নারীর নাম ঠিকানাসহ প্রতিবেদন, যা বাংলাদেশের আইন পরিপন্থী।

বিষয়টি যে আইনের পরিপন্থী তা সাংবাদিকসহ আমরা অনেকেই জানি না। এর ব্যতিক্রম পেলাম গত ২৩ জানুয়ারি ২০১১ তারিখে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত ‘যৌন নিপীড়নের অভিযোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চিকিৎসককে বরখাস্ত’ জাতীয় সংবাদ শিরোনামে। ২৩ জানুয়ারি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও সচিত্র খবর ছিল — বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাসপাতালের পরিচালক সাহেবের ক্যামেরার সামনে অভিযুক্ত চিকিৎসককে বরখাস্ত করার ঘোষণা দেওয়া। দৈনিক পত্রিকাগুলোর খবর অনুযায়ী ২২ জানুয়ারি সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তাঁর দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছোট বোনকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের বহির্বিভাগের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. সাইফুল ইসলামের কাছে আসেন। রোগী দেখিয়ে বেরিয়ে বড় বোন অভিযোগ তোলেন, ডাক্তার সাইফুল ইসলাম চোখ দেখার সময় তাঁর ছোট বোনের শরীরে আপত্তিকরভাবে হাত দেন।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, ঘটনার পর ছাত্রীটি টেলিফোনে একটি টেলিভিশনের এক সাংবাদিককে বিষয়টি জানান। একই সঙ্গে ছাত্রীটি তার সহপাঠীদের খবর দিলে প্রায় ৩০ জন হাসপাতালের সি ব্লকের বাইরে অবস্থান নেন। সাংবাদিক এসে সংশ্লিষ্ট কক্ষ ও আউটডোরের চিত্র ধারণের এক পর্যায়ে আনসার সদস্যরা বাধা দেন।

এর সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় একটি টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরা বি এস এম এম ইউ কর্তৃপক্ষ আটক করায় পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে ওঠে। পরে অভিযুক্ত ডাক্তার সাইফুল ইসলামকে সাময়িকভাবে বরখাস্তসহ উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করার মধ্য দিয়ে অচলাবস্থার অবসান ঘটে।

এ ঘটনায় রোগীর বড় বোন এবং সাংবাদিক মাজহারুল ইসলাম শাহবাগ থানায় পৃথক দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। খবর অনুযায়ী ২২ জানুয়ারি থানায় কর্তব্যরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুরুল হুদা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘সকালে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় দুটি জিডি (১১৪৫ ও ১১৪৬) হয়েছে। রোগীর বড় বোনের জিডিতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ইভ টিজিংয়ের শিকার হওয়া এবং মাজহারের জিডিতে ক্যামেরাসহ যন্ত্রপাতি চার ঘণ্টা আটকে রাখার কথা বলা হয়েছে।’
খবরটি এখানেই শেষ নয়। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল মজিদ ভূঁইয়া বলেছেন, “ওই স্কুলছাত্রী নিজে লিখিত অভিযোগ করেননি। অভিযোগটি করেছেন তার বড় বোন, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি কোন বিভাগে পড়েন তা অভিযোগপত্রে লেখার অনুরোধ করলেও তা তিনি করেননি।”

অভিযোগ জমা দেওয়ার সময় অভিযোগকারীকেও নিয়ে আসা হয়নি জানিয়ে পরিচালক বলেন, ঘটনার ভিকটিমকে এক বারের জন্যও কর্তৃপক্ষের সামনে আনেননি। অভিযোগপত্রে কোনো ঠিকানা দেওয়া হয়নি। যোগাযোগের জন্য শুধু একটি মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে।

এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটি যে অভিযোগকারী সে নিজে এবং সাংবাদিকবৃন্দ অত্যন্ত সচেতনতার সাথে নির্যাতনের শিকার এবং তার বড় বোনের পরিচয় গোপন করেছেন। থানাও এ নিয়ে অভিযোগকারীর পরিচয় বলেননি। বিষয়টি প্রশংসাযোগ্য নিঃসন্দেহে। এ নিয়ে পাঠক হিসেবে আমাদের এ ঘটনার সত্যতা নিয়ে কিন্তু ঘুণাক্ষরেও মনের অবচেতনে কোন সন্দেহের উদ্রেক হয়নি। যদিও হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ নিয়ে বাঁকা ইঙ্গিত করেছেন। বিগ্রেডিয়ার সাহেব অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন করা সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে কথা বললেও আমি অভিযোগকারী ও সাংবাদিকবৃন্দকে বাহবা দিচ্ছি নির্যাতনের শিকার কিশোরীটির ও অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রাখতে পারার জন্য ।
আমরা অনেকেই পরিবারে, অফিসে, আড্ডায় কোন ঘটনার চেয়ে ঘটনাটির পাত্রপাত্রীর চরিত্র কেন্দ্রিক বিশ্লেষণ করে থাকি। এতে ঘটনার মূল বিষয় হারিয়ে যায়। এখানে এর ব্যতিক্রম। যদিও বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০এর ধারা ১৪ তে আছে ——–
সংবাদ মাধ্যমে নির্যাতিতা নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধা- নিষেধঃ
(১) এই আইনে বর্ণিত অপরাধের শিকার হইয়াছেন এইরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তৎসম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম -ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদ পত্রে বা অন্য কোন সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাইবে যাহাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়।
(২) উপ-ধারা (১) এর বিধান লংঘন করা হইলে, উক্ত লংঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকে অনধিক দুই বৎসর কারাদন্ডে বা অনুর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হইবেন।

আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বলয় এমন ঘূর্ণিপাকে ঘোরে যে নির্যাতনের ঘটনাটি আজীবন নারীটির জীবন যাপনে তা আবর্তিত হয়। দেশে আইন আছে। কিন্তু কে শোনে, কে জানে, কে বলে আর কে মানে কার কথা? এমনকি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাহেব হাসপাতালের পরিচালক পদের মত গুরুত্বপূর্ণ , দায়িত্বপূর্ণ পদে বহাল থেকেও বিষয়টি সম্বন্ধে অজ্ঞ।

এই আইনের লংঘন আমরা প্রতিদিনই প্রচার মাধ্যমে দেখতে পাই। কাজেই এ ব্যাপারে শাস্তি দিতে গেলে পরিস্থিতি কি হতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে সাংবাদিক সমাজের রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাদের সচেতন সংবাদ পরিবেশন তথাকথিত হলেও নারীকে লজ্জার হাত থেকে আড়ালে রাখতে পারে। যদিও বিতর্ক হতেই পারে যে নারী তো আর অন্যায় করেনি, অপরাধ করেনি, তার উপর অন্যায়, জুলুম বা অত্যাচার করা হয়েছে। নারীকে কেন নাম প্রকাশ করলে লজ্জায় পড়তে হবে, অনাকাংক্ষিত বোঝা বইতে হবে! কিন্তু যতদিন পর্যন্ত সমাজ না বদলায় ততদিন পর্যন্ত তো সাংবাদিকদের কলম একটু কম খরচ করলেই হয়।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কোন নারীকে নিয়ে পত্র পত্রিকায় একবার খবর প্রকাশিত হলে ঐ নারীর অবস্থা ও অবস্থান যে কোথায় যায় তা আমরা সবাই জানি। নারীটিকে হেয় হতে হয় সমাজের চোখে, অপদস্ত হতে হয় লোকজীবনের সর্বত্র, অপবাদ বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন এবং অসহনীয়ভাবে।

নারী যদি ধর্ষণের শিকার হয় তবে সে নারীকে আজীবন ধর্ষিতা হিসেবেই সমাজে পরিচিত হতে হয়। এতে সংবাদপত্রে নারীর পরিচিতিসহ সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের ভূমিকাও কম নয়। আপনি যে কোন একদিনের যে কোন একটা দৈনিক পত্রিকা নিয়ে সংবাদ পর্যালোচনা করলেই দেখবেন সংবাদে নারীর অবস্থান কোথায়? এবং কীভাবে এর ঘটনা পরম্পয়ায় সাজানো। কিংবা আপনি ইন্টারনেটে নারী বিষয়ক সংবাদ খুঁজতে গেলেও নারীর নাম ঠিকানার অভাব নেই।

এ সামাজিক প্রেক্ষাপট জানার পরও এবং এ সম্পর্কিত আইন থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রতিদিন ডজনে ডজনে/ কুড়িতে কাড়িতে সহিংসতার শিকার নারীদের নাম ধাম ঠিকানা ছাপা হয়। আর নির্যাতনকারী অনেক সময় থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পরিচয়হীন। আবার পরিচিত হলেও প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে অপরাধীদের নাম লেখার সময় সাংবাদিকদের কলমের কালি শুকিয়ে থাকে। কলম ঝেড়ে ঝেড়েও লেখা যায় না। নির্যাতন অথবা সহিংসতার শিকার নারী অপরাধীকে সনাক্ত করতে পারলেও তার কথায় সংবাদ পত্রে অপরাধীর নাম ছাপায় না।

তা ছাড়া নারী অপরাধের শিকার না নারী নিজে অপরাধী তা নিশ্চিত না হয়েও নারীকে অপরাধী হিসেবে প্রকাশের সুযোগ পেলে প্রচার মাধ্যম হুমড়ি খেয়ে পড়ে। নারী বলে কথা। পাঠক খায়। নারী সম্পর্কিত খবর মানেই টক ঝাল মিষ্টি খাবার।

নারীর প্রতি সংবেদনশীল আইনও নারীকে আশ্রয় দিতে, ছায়া দিতে, রক্ষা করতে পারছে না। কারণ সমাজে পুরুষ এবং নারীর অবস্থা ও অবস্থান যে সম পর্যায়ের নয় এবং তার নাম ঠিকানা পত্রিকায় প্রকাশ যে তার জন্য আজীবন অভিশাপ বয়ে আনে এ বোধ সাংবাদিকদের ভাবনায় কাজ করে না। সাংবাদিকদের এ বিষয়ে নিজেদের পেশার প্রতি আরও দায়িত্বশীল হতে হবে বলেই আমার ধারণা।

কিন্তু আমাদের দেশে আইন থাকা সত্ত্বেও নারীদের নাম ধামসহ যে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয় এর কি প্রতিকার হবে? এ নিয়ে জনস্বার্থে মামলা ঠোকা যায়। কিন্তু বিড়ালের গলায় এ ঘন্টা বাঁধবে কে?