প্রথম অধ্যায়
দ্বিতীয় অধ্যায়
===================================
অমর অজর শিকল
আমরা মূলত টিকে থাকা জীব, আর ‘আমরা’ বলতে কেবল মানুষকে বুঝানো হচ্ছে না। এর মাঝে সকল পশু, উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস চলে আসে। পৃথিবীতে বিদ্যমান মোট টিকে থাকা জীবের সংখ্যা হিসাব করা খুবই কঠিন, এমনকি মোট প্রজাতির সংখ্যাও আমাদের অজানা। শুধুমাত্র কীটপতঙ্গকে হিসাবে আনলে, বর্তমানে বেঁচে থাকা প্রজাতির সংখ্যা প্রায় তিরিশ লাখের মতো, আর একক কীটপতঙ্গের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার কোটি কোটির সমান
বিভিন্ন টিকে থাকা যন্ত্র বাইরে থেকে এবং ভিতর থেকে দেখতে অনেক অন্যরকম হয়ে থাকে। একটি অক্টোপাসের সাথে একটি ইঁদুরের কোনই মিল নেই, আবার তারা দুজনেই একটি ওক গাছ থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। কিন্তু একদম ভিত্তিতে রাসায়নিক গঠনের দিক থেকে এদের মাঝে খুব বেশি অমিল নেই। নির্দিষ্ট করে বললে, যে অনুলিপিকারকদের তারা ধারণ করে, যাকে আমরা জিন বলি, সেগুলো একই ধরনের অণু দিয়ে গঠিত, ব্যাকটেরিয়া থেকে হাতি পর্যন্ত। আমরা সবাই একই ধরনের অনুলিপিকারক দিয়ে তৈরি টিকে থাকা যন্ত্র – যাদেরকে বলা হয় ডিএনএ – কিন্তু পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্যে নানা উপায় আছে, ঠিক তেমনি এই অনুলিপিকারকেরা বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র বানিয়েছে সেসব উপায়কে কাজে লাগিয়ে। বানর যেমন এক ধরনের যন্ত্র যারা গাছের ওপরে জিন সংরক্ষণ করছে, তেমনি মাছ আরেক ধরনের যন্ত্র যারা পানির নিচে জিন সংরক্ষণ করছে। এমনকি এক ধরনের ক্ষুদ্র কৃমি আছে যেগুলো জার্মান বিয়ার-ম্যাটের ভেতরে বসবাস করে। ডিএনএ’র কাজকর্ম খুবই রহস্যময়।
বুঝানোর সুবিধার্থে আমি এমন একটা ধারণা দিয়েছি যে ডিএনএ নির্মিত আধুনিক জিনগুলো প্রাগৈতিহাসিক স্যুপের ভেতরে আদি অনুলিপিকারকদের থেকে খুব একটা আলাদা নয়। যদিও যুক্তি-তর্কে খুব একটা পার্থক্য হবে না, তবু এই কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। আদি অনুলিপিকারক অণুগুলো হয়তো ডিএনএ অণুর কাছাকাছি গঠনের ছিল, অথবা হয়তো একেবারেই ভিন্ন ছিল। দ্বিতীয় সম্ভাবনা সত্যি হলে আমরা বলতে পারি যে তাদের টিকে থাকার যন্ত্রকে ডিএনএ অণুর যন্ত্র পরবর্তীতে দখল করেছে। যদি সেটা ঘটে থাকে, তাহলে আদি অনুলিপিকারক সমূলে ধ্বংস হয়েছিলো, কারণ এখন সেগুলোর কোন চিহ্ন আধুনিক টিকে থাকা যন্ত্রে দেখা যায় না। পাশাপাশি এ জি কেয়ার্নস-স্মিথের (A. G. Cairns-Smith) একটি দুর্দান্ত প্রস্তাবনা হলো আমাদের পূর্বপুরুষ এই আদি অনুলিপিকারকেরা হয়তো জৈব অণুই ছিলো না, হয়তো তারা ছিলো অজৈব কেলাস – খনিজ লবণ, খানিকটা কাদামাটি, এরকম। যেমনটা আমি প্রস্তাব করেছি দ্বিতীয় অধ্যায়ে, হয়তো ক্ষমতার এক নতুন দখল সবে শুরু হতে যাচ্ছে, তেমন সম্ভাবনাকে বাদ দিলে, ডিএনএ অণুই এখন অবিসংবাদিত নেতৃত্বে, তা সে দখল-বাজ হোক আর না হোক।
একটি ডিএনএ অণু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গাঠনিক ব্লকের লম্বা শিকলে তৈরি হয়, এই ক্ষুদ্র অণুগুলোকে নিউক্লিওটাইড বলে। ঠিক যেমন আমিষ হলো অ্যামাইনো এসিডের দীর্ঘ শিকল, তেমনি ডিএনএ হলো নিউক্লিওটাইডের দীর্ঘ শিকল। ডিএনএ এতো ক্ষুদ্র যে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু খুব বিচক্ষণতার সাথে পরোক্ষভাবে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ গঠন বের করা হয়েছে। এটি গঠিত হয়েছে এক জোড়া নিউক্লিওটাইড শিকল সর্পিলাকারে প্যাঁচানোর মাধ্যমে; ‘দ্যা ডাবল হেলিক্স’, ‘অমর শিকল’। নিউক্লিওটাইডের গাঠনিক অণুগুলো মাত্র চার রকমের হয়ে থাকে, যাদের সংক্ষেপে বলা হয় A, T, C এবং G। এগুলো সব পশু ও উদ্ভিদে একই। যা পার্থক্য তা হলো এদের সাজানোর ক্রমে। মানুষের শরীরে বিদ্যমান একটি G ব্লকের সকল অংশই একটি শামুকের শরীরের G ব্লকের সকল অংশের সাথে মিলে যায়। কিন্তু মানুষের শরীরের এই গাঠনিক ব্লকগুলোর অনুক্রমের সাথে শামুকের শরীরের ব্লকগুলোর অনুক্রমে কোন মিল নেই। শুধু তাই না, এই অনুক্রম প্রতিটি মানুষের শরীরেই আলাদা – যদিও তা খুব অল্প পরিমাণে (কেবল অভিন্ন যমজের ক্ষেত্র ব্যতীত)।
আমাদের শরীরের ভেতর ডিএনএ থাকে। এটি শরীরের কোন অংশে ঘনীভূত হয়ে থাকে না, বরং সারা শরীরে সব কোষে ছড়িয়ে থাকে। একটি সাধারণ মানবদেহে প্রায় দশ কোটি কোটি কোষ থাকে, আর কিছু ব্যতিক্রমকে উপেক্ষা করলে প্রতিটি কোষে ওই মানবদেহের ডিএনএ’র একটি প্রতিলিপি থাকে। এই ডিএনএকে দেহগঠনের নিয়মাবলী হিসেবে কল্পনা করা যায়, যে নিয়মাবলী লেখা হয়েছে A, T, C, G নিউক্লিওটাইড অক্ষরে। এভাবে চিন্তা করা যায় যে একটা প্রকাণ্ড দালানের প্রতিটা ঘরে একটি করে বইয়ের তাক আছে, যেখানে স্থপতির বানানো নকশাটি রাখা আছে। কোষের ভেতরে এই ‘বইয়ের তাক’ হলো নিউক্লিয়াস। মানুষের দেহের জন্য স্থপতির নকশাটি ৪৬ খণ্ডের – অন্যান্য প্রজাতির জন্যে খণ্ডের সংখ্যা ভিন্ন। এই খণ্ডগুলোকে (Volumes) আমরা বলি ক্রোমোজোম। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে দেখলে এগুলোকে লম্বা সুতার মতো মনে হয়। জিনগুলো এই সুতা বরাবর নির্দিষ্ট ক্রমে সাজানো থাকে। ঠিক কোন খানে একটি জিন শুরু আর কোথায় শেষ, সেটা ঠিক করা মোটেই সোজা না, বলা চলে কিছুটা অর্থহীনই বটে, সৌভাগ্যক্রমে তা আমাদের উদ্দেশ্য পূরণে কাজে আসবে না। আমরা এই অধ্যায়ে সেটা দেখতে পাবো।
স্থপতির নকশার উদাহরণটা আমি এখানে অনেকবার ব্যবহার করবো, উদাহরণের শব্দের সাথে আসল বিষয়ের শব্দকে মিলিয়ে বলবো। ‘খণ্ড’ বললে বুঝা যাবে যে ক্রোমোজোমের কথা বলা হচ্ছে। জিন বুঝাতে যেমন ‘পৃষ্ঠা’ বলা হবে, যদিও জিনগুলোর মধ্যে বিভাজন একেক পৃষ্ঠার বিভাজনের মতো এতোটা স্পষ্ট নয়। এই উদাহরণটা আমাদের বুঝতে বেশ সাহায্য করবে। এর পরে আমি অন্যান্য উদাহরণে যাবো। তবে ঘটনাক্রমে, এখানে আদৌ কোন ‘স্থপতি’ নেই। ডিএনএ নির্দেশিকা সম্পূর্ণভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের তৈরি।
ডিএনএ অণুসমূহ দুটি জরুরি কাজ করে থাকে। প্রথমত তারা অনুলিপি তৈরি করে, যার মানে হলো তারা নিজেদের নকল তৈরি করে। এটা প্রাণের উদ্ভবের পর থেকে বিরতিহীন চলছে তো চলছেই, একারণে ডিএনএ অণুগুলো এখন এই কাজে খুব পারদর্শীও বটে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে আপনি প্রায় দশ কোটি কোটি কোষ দিয়ে তৈরি, কিন্তু যখন আপনি প্রথম মায়ের গর্ভে সৃষ্টি হয়েছিলেন, তখন শুধুমাত্র একটি কোষই ছিলো। এই একটি কোষের ভেতর স্থপতির মূল নকশা সজ্জিত ছিলো। কোষটি প্রথমে দুই ভাগে বিভাজিত হয়েছে, এবং প্রতিটি কোষ মূল নকশার একটি করে হুবহু নকল তৈরি করেছে। উপর্যুপরি বিভাজনের ফলে কোষের সংখ্যা ক্রমশ ৪, ৮, ১৬, ৩২, এভাবে বাড়তে বাড়তে কোটি কোটিতে পৌঁছে গেছে। প্রতিবার বিভাজনের সময় ডিএনএ নকশা সফলভাবে নকল করা হয়েছে, যে প্রক্রিয়ায় খুব কমই ভুল ঘটে থাকে।
ডিএনএ’র অনুলিপি নিয়ে কথা বলা একটা ব্যাপার। কিন্তু যদি সত্যিই ডিএনএ শরীর গঠনের মূল নকশা হয়ে থাকে, তাহলে এই নকশাকে কীভাবে কাজে লাগানো হয়? দেহের কাঠামো তৈরিতে এই নকশা কীভাবে অনূদিত হয়? এই প্রশ্নের জবাবেই ডিএনএ’র দ্বিতীয় কাজটির কথা চলে আসে। ডিএনএ পরোক্ষভাবে আরেকটি অণুর গঠন-প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে – যার নাম আমিষ। আগের অধ্যায়ে আমরা যে হিমোগ্লোবিনের কথা বলেছি, সেটা অসংখ্য আমিষের মাঝে একটি আমিষের উদাহরণ ছিলো। চার-অক্ষরের নিউক্লিওটাইডের ভাষায় লিখিত ডিএনএ’র তথ্য মূলত একটি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয়ে নতুন আরেকটি অক্ষরে পরিণত হয়। অ্যামাইনো এসিড নামের এই অক্ষর দিয়েই আমিষের অণুসমূহের ভাষা লিখিত হয়।
আমিষ তৈরি প্রক্রিয়াকে একটি দেহগঠনের প্রক্রিয়ার কাছে ছেলেখেলা মনে হতে পারে। তবে এটা সেই লক্ষ্যের দিকেই একটি ছোট পদক্ষেপ। আমিষ আমাদের দৈহিক কাঠামোর একটি বড়ো অংশকে কেবল নির্মাণই করে না, পাশাপাশি কোষের ভেতরের রাসায়নিক ক্রিয়াসমূহকে সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণও করে। নির্দিষ্ট সময়ে কোষের নির্দিষ্ট স্থানে প্রক্রিয়াগুলোকে চালু বা বন্ধ করতে থাকে। ঠিক কীভাবে এই পুরো কর্মযজ্ঞ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ দেহ তৈরি হয়ে ওঠে সেটা বর্ণনা করতে গেলে দশক তো দশক, শতাব্দীও পেরিয়ে যেতে পারে। ভ্রূণ-বিজ্ঞানীরা সেই গবেষণাতেই মশগুল। কিন্তু আমিষের এই নিয়ন্ত্রণের ঘটনাটি সত্য। জিন পরোক্ষভাবে দেহগঠন নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই প্রভাব কেবল একমুখী: আহৃত বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায় না। আপনি যতোই জ্ঞান আহরণ করুন না কেন, যতো বিদ্যাই শিখুন না কেন, তার এক বর্ণও আপনার সন্তান জিনগত পদ্ধতিতে পাবে না। সব নতুন প্রজন্মের হাতেখড়ি হয় শূন্য থেকে। মানবদেহ কেবল জিনের বৈশিষ্ট্য অবিকলভাবে সংরক্ষণের উপায় মাত্র।
ভ্রূণগত উন্নয়নে জিনের প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণের বিবর্তনিক গুরুত্বটি নিম্নরূপ: জিনের ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের জন্য তারা নিজেরাই কিছুটা দায়ী, কারণ তাদের টিকে থাকা নির্ভর করে তাদের বাসস্থান, মানবদেহের কার্যকারিতার ওপর। আর এই মানবদেহ তৈরি হয় তাদের সাহায্যেই। আদি পৃথিবীতে, প্রাকৃতিক নির্বাচন কেবল আদিম স্যুপে মুক্তাবস্থায় ভাসমান অনুলিপিকারকদের ব্যবকলনীয় টিকে থাকার (differential survival) মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এখন, প্রাকৃতিক নির্বাচন সেইসব অনুলিপিদের দিকে সুনজর দেয় যারা ভালো টিকে থাকা যন্ত্র বানাতে সক্ষম, সে সকল জিনকে সমর্থন দেয় যারা ভ্রূণগত উন্নতি নিয়ন্ত্রণের শিল্পে চৌকস। এই প্রক্রিয়ায় অনুলিপিগণ ততোটাই সজাগ বা উদ্দেশ্যপূর্ণ যতোটা তারা আদিযুগে ছিলো। প্রাচীনকালে যে স্বয়ংক্রিয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া অন্ধভাবে এবং অনিবার্যভাবে চলতো, ঠিক তেমনিভাবেই এখন প্রতিদ্বন্দ্বী অণুসমূহের মধ্য থেকে স্থায়িত্ব, উর্বরতা ও নকল-করার সক্ষমতার ভিত্তিতে অণু নির্বাচিত হয়। জিনদের কোন দিব্যদৃষ্টি নেই। নেই কোন পূর্ব-পরিকল্পনা। জিনেরা কেবলমাত্র অস্তিত্বমান, কোন কোন জিন অন্য জিনদের চাইতে একটু বেশি অস্তিত্বমান, কিন্তু সেটুকুই যা ঘটনা। খালি এই যে এখন জিনের টিকে থাকা বা স্থায়িত্বের গুণসমূহ আগের মতো অতোটা সরল নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে – ধরুন মোটামুটি গত ষাট কোটি বছরে অনুলিপিকারকেরা বেশ উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব অর্জন করেছে। টিকে থাকা যন্ত্রের উন্নয়নে প্রযুক্তিগত সাফল্য এসেছে পেশী, হৃৎপিণ্ড, এবং চোখ (যা স্বতন্ত্র উপায়ে বহুবার বিবর্তিত হয়েছে) গঠনে। এর আগে, অনুলিপিকারক হিসেবে তারা জীবনযাত্রার প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যগুলো আমূল বদলে ফেলত। এটা ধরে নিতে হবে যদি আমরা আমাদের বিষয়টিকে এগিয়ে নিতে চাই।
আধুনিক অনুলিপিকারকের ব্যাপারে যে ব্যাপারটি প্রথমেই ধারণায় ভালোমতো নিয়ে আসতে হবে তা হলো এরা বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ, বন্ধুবৎসল (gregarious)। একটি টিকে থাকা যন্ত্র কেবল একটি জিনের বাহক না, বরং তার মধ্যে কয়েক হাজার জিনের বসবাস। দেহের গঠনকার্য অসংখ্য জিনের সমবায়ে এমনই এক জটিল প্রক্রিয়া, সেখানে এক জিন থেকে আরেক জিনের অবদানকে আলাদা করা খুবই কঠিন। একটি নির্দিষ্ট জিন শরীরের বিভিন্ন অংশের ওপর আলাদা আলাদা প্রভাব ফেলবে, এবং একটি জিনের প্রভাব নির্ভর করে অন্যান্য অনেক জিনের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ওপর। কোন কোন প্রভু-জিন বেশ কিছু গুচ্ছ-জিনের কার্যনিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। উদাহরণ থেকে বললে, নকশার যে কোন পৃষ্ঠায় দালানের অনেক অংশের রেফারেন্স থাকতে পারে; এবং প্রতিটা পৃষ্ঠার অর্থ অন্যান্য সকল সম্পর্কিত পৃষ্ঠার সাথে মিলানোর পরে বুঝা যায়।
জিনসমূহের এই জটিল আন্তঃ নির্ভরশীলতা থেকে আপনার মনে হতে পারে কেন আমরা ‘জিন’ শব্দটাকে আদৌ আলাদাভাবে ব্যবহার করি। কেন একটি শ্রেণী বিশেষ্য কেন ব্যবহার করা হয় না ‘জিন কমপ্লেক্স’ এর মতো? জবাবটা হলো অনেকসময় জিনগুলোকে এভাবে ভাবাটা ভালো পন্থা। তবে আমরা যদি অন্যভাবে দেখি, জিন কমপ্লেক্সকে ভাগ করে বিচ্ছিন্ন অনুলিপিকারক বা একক জিন হিসেবে দেখাটাও অর্থবোধক হয়। এটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন সেক্স বা লিঙ্গের প্রসঙ্গ আসে। যৌন-জনন জিনের মিশ্রণ ও রদবদল ঘটিয়ে থাকে। এর মানে হলো যে কোন মানবদেহ মূলত নির্দিষ্ট সমন্বয়ের জিনের অনুক্রমের জন্য অস্থায়ী একটি বাহক মাত্র। এই জিনের নির্দিষ্ট সমন্বয় বা যাকে আমরা মানুষ বলি তা স্বল্পায়ু হতে পারে, কিন্তু জিনগুলো প্রকৃতপক্ষে অনেক দীর্ঘজীবী। প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে তাদের পথ ক্রমশ মিশতে থাকে, বদলে যেতে থাকে। একটি জিনকে বহুসংখ্যক দেহ পরম্পরায় পেরিয়ে আসা একক অস্তিত্ব হিসেবে চিন্তা করা যায়। এই অধ্যায়ের বক্তব্যের এটাই কেন্দ্রীয় বিষয়। এটা এমন এক বিষয়, যাতে আমার কিছু সম্মানিত সহকর্মী বেশ একগুঁয়েমির সাথেই দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাই আমি যদি বিষয়টাকে লম্বা করি তাহলে মার্জনা করবেন! তবে প্রথমে আমি লিঙ্গের বিষয়গুলো সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করবো।
আমি বলেছি যে মানবদেহ গঠনের নকশাটি ৪৬টি খণ্ডে বর্ণিত হয়েছে। এটা আসলে একটু অতি-সরলীকরণ হয়ে গেছে। মূল সত্য এর চাইতে উদ্ভট। ৪৬টি ক্রোমোজোম মোট ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমে তৈরি। আমরা বলতে পারি যে প্রতিটি কোষের নিউক্লিয়াসে দুইটি বিকল্প নকশার ২৩ টি খণ্ড ছড়ানো আছে। তাদেরকে খণ্ড ১ক এবং ১খ, খণ্ড ২ক এবং ২খ, এভাবে খণ্ড ২৩ক এবং ২৩খ পর্যন্ত এভাবে নাম দেয়া যেতে পারে। এই সনাক্তকরণে খণ্ডগুলোকে নম্বর দেয়ার পদ্ধতি পুরোপুরি এলোমেলোভাবে ঠিক করা হয়েছে।
প্রতিটি ক্রোমোজোম আমরা আমাদের পিতা ও মাতা থেকে অক্ষত অবস্থায় লাভ করি, যাদের অণ্ডকোষ ও ডিম্বকোষে এগুলো সাজানো হয়। ধরা যাক, খণ্ড ১ক, ২ক, ৩ক, … আসে আমাদের পিতার কাছ থেকে এবং খণ্ড ১খ, ২খ, ৩খ, … আসে আমাদের মাতার কাছ থেকে। ব্যবহারিক ভাবে একাজ বেশ কঠিন, তবে তাত্ত্বিকভাবে আমরা যে কোন কোষের ৪৬টি ক্রোমোজোমকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে দেখতে পারি এবং সেখান থেকে পিতার ২৩টি ও মাতার ২৩টি ক্রোমোজোমকে আলাদা করতে পারি।
জোড়াকৃত ক্রোমোজোমগুলো বাস্তবিক ভাবে তাদের সারাজীবন একে অপরের সান্নিধ্যে জোড় বেঁধে কাটায় না, এমনকি কাছাকাছিও থাকে না। তাহলে কিসের ভিত্তিতে তাদেরকে ‘জোড়া’ বাঁধা হচ্ছে? ভিত্তিটি হলো পিতার নিকট হতে পাওয়া প্রতিটি খণ্ডকে পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা মিলিয়ে মাতার নিকট হতে পাওয়া কোন না কোন খণ্ডের বিকল্প হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন খণ্ড ১৩ক এর ৬ নং পৃষ্ঠা আর খণ্ড ১৩খ এর ৬ নং পৃষ্ঠার দুটাই চোখের রঙ ‘বিষয়ে’ হতে পারে; হয়তো একটিতে লেখা ‘নীল’, আরেকটিতে লেখা ‘খয়েরি’।
মাঝে মাঝে এই দুইটা পৃষ্ঠা একেবারে মিলে যায়, কিন্তু অন্যান্য সময়ে – যেমন আমাদের এই উদাহরণের মতো, তারা আলাদা হয়ে থাকে। যখন তারা এরকম ‘বিরুদ্ধ-মত’ জানায়, তখন দেহ কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়? উত্তর বিভিন্ন। কখনো কখনো একটি পৃষ্ঠার পাঠ অন্যটিকে ছাপিয়ে যায়। যেমন চোখের রঙের উদাহরণে, লোকটির চোখের রঙ হবে খয়েরি। শরীর গঠনের সময় নীল রঙের নির্দেশনাটি উপেক্ষিত হবে, যদিও সেই নির্দেশনা পরের প্রজন্মে প্রবাহিত হতে কোন বাধা নেই। যে জিনটি এভাবে উপেক্ষিত হলো, তাকে বলে প্রচ্ছন্ন জিন (recessive)। প্রচ্ছন্ন জিনের উল্টো হচ্ছে প্রকট জিন (dominant)। চোখের খয়েরি রঙের জিন নীল রঙের জিনের চাইতে প্রকট। একজনের চোখের রঙ নীল হবে শুধুমাত্র তখনই যখন দুই প্রাসঙ্গিক পৃষ্ঠার নির্দেশনা একইসাথে নীল রঙ হতে বলবে। এছাড়া বেশিরভাগ সময়েই যখন বিকল্প জিনগুলো আলাদা বৈশিষ্ট্যের হয় তখন তাদের মাঝে একটা সমঝোতা ঘটে থাকে – দেহগঠনের সময় মধ্যবর্তী কোন নকশা বা একেবারেই ভিন্ন কোন আদল গড়ে ওঠে। যখন দুটো জিন, যেমন খয়েরি ও নীল রঙের চোখের জিন একই ক্রোমোজোমের স্থানের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তখন তাদেরকে একে অপরের অ্যালিল (alleles) বলা হয়। আমাদের আলোচনায় আমরা অ্যালিলের সমার্থক শব্দ ধরে নিচ্ছি প্রতিদ্বন্দ্বী। স্থপতির নকশার খণ্ডগুলোকে একটা লিজ-লিফ বাইন্ডার হিসেবে চিন্তা করুন, যার পৃষ্ঠাগুলো খোলা বা বদলে নেয়া যায়। প্রতিটি ত্রয়োদশ খণ্ডে ষষ্ঠ পৃষ্ঠার স্থান থাকবে যেখানে ৫ ও ৭ নম্বর পৃষ্ঠার মাঝখানে যে কোন ৬ নম্বর পৃষ্ঠা বসতে পারে। বেশ কিছু সম্ভাব্য ষষ্ঠ পৃষ্ঠা রয়েছে, যার মাঝে একটি ভার্সনে ‘নীল’ লেখা, আরেকটি ভার্সনে ‘খয়েরি’ লেখা আছে; এখানে বাকি আরও অনেকগুলো ভার্সনের ষষ্ঠ পৃষ্ঠা থাকতে পারে পুরো সমষ্টির মধ্যে, যাতে সবুজ বা অন্যান্য রঙ লেখা থাকবে। হয়তো এখানে আধা ডজন বিকল্প অ্যালিল ১৩শ খণ্ডের পৃষ্ঠা ৬-এর জায়গায় বসে আছে এবং সেগুলো পুরো সমষ্টিতে (population) ছড়ানো রয়েছে। যে কোন মানুষ মাত্র দুইটি ১৩শ খণ্ড ক্রোমোজোম পাবে। সুতরাং সে ষষ্ঠ পৃষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ দুইটি অ্যালিল পাবে। সে একই অ্যালিলের দুইটি প্রতিলিপি পেতে পারে, নীল চোখের মানুষের মতো। অথবা সে পুরো সমষ্টির আধা ডজন বিকল্প অ্যালিল থেকে যে কোন দুইটি অ্যালিল পেতে পারে।
অবশ্য আপনি জিনের সমষ্টির বিশাল পুল থেকে এভাবে জিন পছন্দ করে নিতে পারেন না। যে কোন নির্দিষ্ট সময়ে সব জিনগুলো একেকজন টিকে থাকা যন্ত্রের ভেতর তোড়ায় বাঁধা থাকে। গর্ভধারণের সময়ে আমাদের জিনগুলো বন্টিত হয়, আর এই ব্যাপারে আমাদের কিছুই করার নেই। যদিও একভাবে দেখলে সমষ্টির জিনগুলোকে একসাথে জিন পুল বিবেচনা করা হয়। এই শব্দ-গুচ্ছটি প্রায়োগিক দিক থেকেই জিনবিদদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। জিন পুল আসলে একটা সার্থক পৃথকীকরণ, কারণ যৌন-জনন জিনের মিশ্রণ ঘটায়, বেশ সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় হলেও। বিশেষ করে লুজ-লিফ বাইন্ডার থেকে কোন পৃষ্ঠা খুলে নেয়ার মতো বা এক থোকা পৃষ্ঠা অদলবদল করার মতো ঘটনা আদতেই ঘটতে থাকে, যেটা আমরা এখন দেখতে পাবো।
আমি একটি কোষ থেকে দুইটি নতুন কোষে বিভাজনের সাধারণ প্রক্রিয়াটি বর্ণনা করেছি, যেখানে প্রতিটি নতুন কোষ ৪৬টি ক্রোমোজোমের সম্পূর্ণ প্রতিলিপি পেয়ে থাকে। এধরণের বিভাজনের নাম মাইটোসিস (mitosis)। এছাড়াও আরও এক ধরণের কোষ বিভাজন আছে যার নাম মায়োসিস (meiosis)। এই বিভাজন শুধুমাত্র লিঙ্গ-কোষ, যেমন শুক্রাণু বা ডিম্বাণু উৎপাদনেই ঘটে থাকে। শুক্রাণু বা ডিম্বাণু আমাদের কোষগুলোর মধ্যে আলাদা কারণ ৪৬টি ক্রোমোজোমের বদলে তাদের মধ্যে কেবল ২৩টি ক্রোমোজোম থাকে। ৪৬টির ঠিক অর্ধেক থাকার কারণে একজন নতুন মানুষ বানাতে যৌন নিষেকের সময় জোড়া তৈরিতে খুবই সুবিধা হয়! মায়োসিস একটি বিশেষ ধরণের কোষ বিভাজন যা কেবল অণ্ডকোষ আর ডিম্বকোষেই ঘটে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় ৪৬টি ক্রোমোজোমের সম্পূর্ণ দুইটি সেট ভেঙে ২৩ ক্রোমোজোমের একক সেটের লিঙ্গ কোষ তৈরি হতে থাকে (সুবিধার জন্য আমরা প্রতিবার মানুষের ক্রোমোজোমের সংখ্যা ব্যবহার করছি)।
২৩টি ক্রোমোজোমে গঠিত একটি শুক্রাণু মায়োসিসের মাধ্যমে অণ্ডকোষে বিদ্যমান ৪৬-ক্রোমোজোমী কোষ ভেঙে তৈরি হয়েছে। কোন ২৩টি ক্রোমোজোম একটি শুক্রাণুতে স্থান পাবে? স্পষ্টতই একটি শুক্রাণু যেন কেবল পুরানো ২৩টি ক্রোমোজোম দিয়ে তৈরি না হয়, সেটা দেখা জরুরি। এটি যেন ত্রয়োদশ খণ্ডের দুই প্রতিলিপি আর সপ্তদশ খণ্ডের কোন প্রতিলিপি না নিয়েই তৈরি না হয়। তাত্ত্বিকভাবে, একজন মানুষের পক্ষে এমন শুক্রাণু তৈরি করা সম্ভব যার সবগুলো ক্রোমোজোম তার মায়ের কাছ থেকে এসেছে। অর্থাৎ শুক্রাণুটি খণ্ড ১খ, ২খ, ৩খ,… এভাবে ২৩খ পর্যন্ত খণ্ড দিয়ে তৈরি। এরকম অসম্ভাবনীয় ঘটনার ক্ষেত্রে এই শুক্রাণু দ্বারা জন্মানো শিশুটি তার দাদীর সকল বৈশিষ্ট্য নিজের অর্ধেক জিন হিসেবে পাবে, আর দাদার কোন বৈশিষ্ট্যই পাবে না। কিন্তু বাস্তবে এমন পাইকারি, সম্পূর্ণ-ক্রোমোজোম বণ্টন ঘটে না। আসল ঘটনা এর চাইতে জটিল। মনে রাখবেন যে খণ্ডগুলো (ক্রোমোজোমগুলো) লুজ-লিফ বাইন্ডারের সাথে তুলনা করেছি। শুক্রাণু তৈরি সময় যা ঘটে, তা হলো একক পৃষ্ঠা, বা একগোছা পৃষ্ঠা খুলে নিয়ে বিকল্প খণ্ডের একগোছার সাথে রদবদল করা হয়। তাই একটি নির্দিষ্ট শুক্রাণু হয়তো প্রথম খণ্ডের শুরুর ৬৫ পৃষ্ঠা নিবে ১ক খণ্ড থেকে, আর ৬৬তম থেকে বাকি অংশ তৈরি করবে ১খ খণ্ড থেকে নিয়ে। এই শুক্রাণুর বাকি ২২টি খণ্ডও একইভাবে তৈরি হবে। এর ফলে একজন মানুষের তৈরি সকল শুক্রাণু বৈশিষ্ট্যে অনন্য হয়ে ওঠে, যদিও সেগুলোর ২৩ ক্রোমোজোমের সব একই ৪৬ ক্রোমোজোমের সেট থেকে তৈরিকৃত। ডিম্বাণুগুলোও একইভাবে ডিম্বকোষে তৈরি হয়, আর সেগুলোও অনন্য।
এই মিশ্রণের বাস্তব-জীবন প্রক্রিয়াটি বেশ সহজেই বুঝা যায়। একটি শুক্রাণু (বা ডিম্বাণু) গঠনের সময়ে পিতৃ-ক্রোমোজোমের কিছু অংশ আক্ষরিক ভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং বিকল্প মাতৃ-ক্রোমোজোমের অবিকল অংশটির সাথে জায়গাবদল করে ( মনে রাখবেন আমরা মূল শুক্রাণু-নির্মাতার পিতামাতার ক্রোমোজোম, অর্থাৎ এই শুক্রাণু থেকে জন্মাতে যাওয়া শিশুর দাদা-দাদীর ক্রোমোজোম নিয়ে কথা বলছি।)। এভাবে ক্রোমোজোমের টুকরো বদলে নেয়াকে ক্রসিং-ওভার বলে। এই বইয়ের প্রধান যুক্তির জন্য এই বিষয়টি খুবই জরুরি। তার মানে হলো আপনি যদি অণুবীক্ষণ যন্ত্র বের করে নিজের কোন শুক্রাণুর (বা আপনি মহিলা হলে ডিম্বাণুর) ক্রোমোজোম দেখতে যান, তাহলে সেখানে কোনটা আপনার বাবার থেকে আর কোনটা আপনার মায়ের থেকে এসেছে তা বের করার চেষ্টা একেবারেই অসার, এতে কেবলই সময় নষ্ট হবে। (পূর্বে এই কথাটি সাধারণ দেহকোষের উদাহরণ দেয়ার সময়ে বিপরীতভাবে বলা হয়েছিলো (পৃষ্ঠা নং))। শুক্রাণুর যে কোন একটি ক্রোমোজোম আসলে এক মিশ্র-চিত্র, মাতৃ-জিন ও পিতৃ-জিনের মোজাইক।
আগে জিনের রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করা পৃষ্ঠার ছবিটা এখানেই ভেঙে পড়তে শুরু করে। একটি লুজ-লিফ বাইন্ডারে একটি পুরো পৃষ্ঠা ঢোকানো যায়, সরিয়ে ফেলা যায় বা বদলাবদলি করা যায়, কিন্তু পৃষ্ঠাকে ভগ্নাংশে ভাঙা যায় না। কিন্তু আমাদের জিন কমপ্লেক্স তো নিউক্লিওটাইড অক্ষরের এক দীর্ঘ সুতা। যাকে কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন পৃষ্ঠার মতো করে ভাগ করা যায় না। নিশ্চিত করার জন্য “আমিষ শিকলের সমাপ্তি তথ্য” এবং “আমিষ শিকলের আরম্ভ তথ্য” নামের বিশেষ চিহ্ন রয়েছে। যা ওই একই চার-অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ দিয়ে আমিষ তথ্য হিসেবে লেখা হয়। এই দুই ধরণের যতিচিহ্নের মাঝখানে একটি আমিষ তৈরির নির্দেশিকা সংকেতাকারে দেয়া থাকে। আমরা যদি চাই, তাহলে “আরম্ভ” আর “সমাপ্তি” চিহ্নের মাঝখানে নিউক্লিওটাইডের অনুক্রমটিকে একটি একক জিন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। চাইলে আমিষ শিকল তৈরির এই সংকেতটিকেও জিন ধরা যায়। cistron শব্দটিকে এভাবেই একক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনেকেই জিনের বদলে সিসট্রন ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু সিসট্রনের এই সীমানাকে ক্রসিং-ওভার গোনায় ধরে না। সিসট্রনের মধ্যেই ভাঙন ঘটতে পারে, কিংবা দুই সিসট্রনের মাঝখানেও ভাঙতে পারে। যেন স্থপতির নকশাখানা আলাদা আলাদা পাতায় লেখা হয় নি, বরং ৪৬ রোল টিকার-টেপের ওপরে লেখা হয়েছে। সিসট্রনের দৈর্ঘ্যও ধ্রুব না। কোথায় একটা সিসট্রন শেষ হয়েছে আর কোথায় পরবর্তীটি শুরু হয়েছে তা বলার একমাত্র উপায় টেপ পড়তে পড়তে “তথ্যের সমাপ্তি” আর “তথ্যের আরম্ভ” এই চিহ্নগুলো খোঁজা। ক্রসিং-ওভার বললে বুঝায় সাদৃশ্যপূর্ণ পিতৃ-টেপ ও মাতৃ-টেপ নিয়ে কেটে সমিল-অংশগুলোর রদবদল ঘটানো, টেপের ওপর যাই লেখা থাকুক না কেন।
এই বইয়ের শিরোনামে জিন শব্দটি দিয়ে কোন একক সিসট্রন বুঝানো হয় নি, বরং তার অর্থ আরও সূক্ষ্ম। আমার সংজ্ঞাতে হয়তো সবার রুচবে না, কিন্তু জিনের সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। যদি থেকেও থাকে, সেটা অপরিবর্তনীয় পবিত্র কিছু নয়। একটি শব্দকে আমাদের সুবিধা মত আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি, তবে তা অবশ্যই স্পষ্ট এবং অভ্রান্ত হতে হবে। আমি যে সংজ্ঞাটি ব্যবহার করতে চাই, সেটি দিয়েছেন জি. সি. উইলিয়ামস। একটি জিন হলো ক্রোমোজোম বস্তুর এমন অংশ যা বহু প্রজন্ম টিকে থাকার পরে প্রাকৃতিক নির্বাচনে একটি একক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। আগের অধ্যায়ের কথানুযায়ী, জিন হলো একটি অনুলিপিকারক যার উচ্চ নকল-বিশ্বস্ততা রয়েছে। নকল-করার-দিক-থেকে-স্থায়িত্ব-থাকাকেই ঘুরিয়ে নকল-বিশ্বস্ততা বলা যায়। এবং একে সংক্ষেপে আমি স্থায়িত্ব বলবো। এই সংজ্ঞাটি কিছু ব্যাখ্যা দাবি করে।
যে কোন সংজ্ঞানুযায়ী, একটি জিনকে অবশ্যই ক্রোমোজোমের অংশ হতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, কতো বড়ো অংশ – টিকার-টেপের কতোখানি? মনে মনে টেপের ওপরে যে কোন অনুক্রমের সন্নিহিত অক্ষরকে সংকেত ভেবে নিন। এখন এই ক্রমকে একটি জিনগত একক ধরি। এই অনুক্রম একটি সিসট্রনের মাত্র দশটি অক্ষরও হতে পারে, অথবা আটটি সিসট্রন দিয়েও গঠিত হতে পারে। আবার এটি কোন সিসট্রনের মাঝখানে শুরু ও শেষও হতে পারে। এই এককটি অন্যান্য জিনগত এককের ওপর দিয়ে চলে যেতে পারে। এর মাঝে আরও ছোট একক থাকতে পারে, এবং এটি আরও বড়ো এককের অংশবিশেষও হতে পারে। বর্তমান আলোচনার খাতিরে, এটি যতো বড়ো বা ছোটই হোক না কেন, আমরা এটিকে জিনগত একক বলবো। এটি ক্রোমোজোমের যে কোন দৈর্ঘ্য, যা বাকি অংশের সাথে কোন বৈশিষ্ট্যেই আলাদা না।
এখন আসি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে। জিনগত একক যতো ছোট হবে, প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ততোই বাড়বে। ঠিকভাবে বললে ক্রসিং-ওভারে কাটা পড়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে। মনে করি, প্রতি শুক্রাণু বা ডিম্বাণু তৈরির সময় মায়োসিস বিভাজনে পুরো ক্রোমোজোমের গড়ে একবার ক্রসিং-ওভার ঘটার কথা, আর এই ক্রসিং-ওভার তার দৈর্ঘ্যের যে কোন স্থানে ঘটতে পারে। আমরা যদি বৃহদাকারের জিনগত একক কল্পনা করি, যেমন ক্রোমোজোমের অর্ধেক, তাহলে ৫০ ভাগ সম্ভাবনা থাকে যে প্রতি মায়োসিসের সময় তা ক্রসিং-ওভারে কাটা পড়বে। যদি জিনগত এককের দৈর্ঘ্য শতকরা এক ভাগ হয়, তাহলে প্রতি মায়োসিসে তার ভেঙে যাবার সম্ভাবনা হবে শতকরা এক ভাগ। তার মানে আশা করা যায় যে এই এককটি প্রাণীটির বেশ কিছু বংশধর পর্যন্ত অক্ষত থাকতে পারবে। একটি সিসট্রন ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্যের শতকরা এক ভাগের চাইতেও অনেক অনেক ছোট হবার সম্ভাবনা আছে। এমনকি পাশাপাশি থাকে সিসট্রনের একটি গ্রুপ অনেক বংশ ধরে ক্রসিং-ওভার ঘটার পরেও অবিকৃত থাকার সম্ভাবনা থাকে।
একটি জিনগত এককের জীবন-সম্ভাবনাকে প্রজন্মের সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়, যা কিনা আবার বছরে নিয়ে যাওয়া যায়। আমরা যদি একটি পুরো ক্রোমোজোমকে অনুমিত জিনগত একক ধরি, তাহলে এর জীবনকাল কেবল এক প্রজন্ম। যদি ধরি এটি আপনার পিতা থেকে আসা ক্রোমোজোম নং ৮ক, যা আপনার পিতার অণ্ডকোষে তৈরি হয়েছিলো, আপনার জন্মের অল্প কিছু সময় আগে। এই পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে এর কোনই অস্তিত্ব ছিলো না। এটি তৈরি হয়েছে মায়োটিক রদবদলের মাধ্যমে, গঠিত হয়েছে আপনার দাদা ও দাদী থেকে আসা ক্রোমোজোমের অনেকগুলো টুকরো জোড়া লেগে লেগে। এটি একটি নির্দিষ্ট শুক্রাণুর ভেতরে জায়গা করে নিয়েছিলো, আর সবদিক থেকেই এটি অনন্য। এই শুক্রাণুটি আরও লক্ষাধিক শুক্রাণুর সাথে তৈরি হয়েছিলো, এ যেন এক অতিক্ষুদ্র রণতরীর বৃহদায়তন বহর, যা মাতৃ-জঠরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলো। পুরো বহর থেকে এই নির্দিষ্ট শুক্রাণুটিই কেবল আপনার মায়ের ডিম্বাণুগুলোর মধ্যে একটিতে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে – এ কারণেই আপনি জন্মেছেন। আমাদের বিবেচ্য জিনগত একক, আপনার ৮ক নম্বর ক্রোমোজোমটি এখন আপনার অন্যান্য জিনগত বৈশিষ্ট্যের সাথে অনুলিপিত হতে শুরু করবে। এখন এটি আপনার সারা শরীরে প্রতিলিপি আকারে কোষে কোষে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু যখন আপনি আবার সন্তান জন্ম দিতে ডিম্বাণু (বা শুক্রাণু) তৈরি করা শুরু করবেন, তখন এই ক্রোমোজোমটি ভেঙে যাবে। এর কিছু অংশ আপনার মাতৃ-ক্রোমোজোম নম্বর ৮খ-এর কিছু অংশের সাথে বদলাবদলি করবে। যে কোন লিঙ্গ-কোষে একটি নতুন ৮ নং ক্রোমোজোম তৈরি হবে, হয়তো মূল কোষের চাইতে উন্নত, হয়তো মূল কোষের চাইতে অনুন্নত হবে। কাকতালীয় ভাবে মিলে যাওয়া প্রায় অসম্ভাব্য, নিশ্চিতভাবেই ভিন্ন, নিশ্চিতভাবেই অদ্বিতীয়। ক্রোমোজোমের জীবনকাল হলো এক প্রজন্ম।
===================================
(চলবে)
পরের পর্বগুলো আর পেলাম না……………
অনেকদিন পরে আসলো মনে হয়। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আশাকরি এরপরের পর্ব দ্রুতই চলে আসবে।
@Atiqur Rahman Sumon, আমিও আশা করছি পরের পর্ব দ্রুতই চলে আসবে। 🙂
আমার মনে হয় কিছু টেকনিকালিটির কারনে কিছু শব্দ যেমন বাংলা প্রতিশব্দ করার দরকার সীমিত, আবার বেশ কিছু বাংলা শব্দগুচ্ছ সমন্বয় কয়েকটি আপাতদৃষ্টিতে অনুবাদ-দুষ্কর ইংরেজী শব্দকে প্রতিস্থাপিত করা যেতে পারে। ডকিন্স বাংলায় অনুবাদ করার সহজ নয়, এজন্য সাহসের প্রশংসা করছি। ইংরেজী ভাষা এত আটসাট, এবং লেখকের ইংরেজী ভাষার পাঠক সম্পর্কে প্রাকধারনা ভাষাটাকে অন্য একটা মাত্রা দেয়। খুব ভালো কাজ হচ্ছে, চমৎকার, পরবর্তীতে আসলে অতিরিক্ত কিছু সম্পাদনা আরো বেশী পাঠযোগ্য করবে আপনার কাজকে। এই কঠিন পরিশ্রমের জন্য সাধুবাদ।
@কাজী মাহবুব হাসান, এই দুটো বিষয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখা অনেকটাই ট্র্যাপিজের ওপর কসরৎ দেখানো মতো মনে হচ্ছে। বাংলা পরিভাষার অপ্রচলিত হওয়া/ কঠিন হওয়া যেমন মুশকিলে ফেলে, তেমনি প্রচলিত শব্দ ব্যবহারে বৈজ্ঞানিক শব্দের ভুল অর্থ দাঁড়াতে পারে।
কোথাও তেমন মনে হলেই জানাবেন। অনেকসময় নিজের লেখার ভুলভাল চোখে পড়ে না।
উৎসাহের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
@আন্দালিব, একমত অবশ্যই। এমনিতেই বাংলাভাষায় বিজ্ঞানের লেখা খুবই কম, ফলাফল, বিজ্ঞান লেখার পাঠক তেমন তৈরী হয়নি। অনুবাদের আগে কাদের জন্য করা হচ্ছে ভাবতেই অনেকধরনের সীমাবদ্ধতা চলে আসে । বিজ্ঞানের ছাত্র আর তারপর মাষ্টারী করে বুঝেছি কি ধরনের ঝাপসা একটা ধারনা সর্বত্র বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে, তার উপর সামাজিক আর ধর্মীয় প্রভাবতো আছেই। ডকিন্স বা কার্ল সাগানের সব বইগুলোরই বাংলা অনুবাদ হওয়া উচিৎ, আর পাঠক কারা হবেন তার পরিধিও বাড়াতে হবে। ভাষাটাকে আমাদের ঠিক করতেই হবে। আমার মনে হয় আমরা একটা অনুবাদকের প্যানেল তৈরী করে কোলাবরেশনের মাধ্যমে সব বইগুলো অনুবাদ করে প্রকাশের চিন্তা করতে পারি – হয়তো আপনারা তাই করছেন। খুব সহজ ভাষায় অসাধারন কিছু কাজ সৃষ্টি হতো, এছাড়া যত দ্রুত হবে তত ভালো, যদি একজন মানুষও সত্যটা উপলব্ধি করতে পারে সেই লেখা পড়ে তাহলে সার্থক। নব্বই এর দশকে আমি যেমন কাল সাগান পড়ে দেখতে শিখেছিলাম। The God delusion নিয়ে কাজ করছি আমি, যদিও মুক্তমনায় প্রথম অধ্যায়টি কেউ করেছেন। অন্যপ্রসঙ্গে একটি কথা, ক্যাডেট কলেজ ব্লগেও আপনাকে দেখেছি, আমি ৮১-৮৭ এফসিসি, so really proud of you for doing this…
@কাজী মাহবুব হাসান ভাই, আলাদা আলাদা ভাবেই কাজ শুরু করে এখন সবাই একে একে চিনপরিচয় হচ্ছি। বিজ্ঞানের এই বইগুলো এখন ইন্টারনেটের সুবাদে আমাদের হাতের নাগালে এসে গেছে। আমারও মনে হয় অবসরে বা কাজের ফাঁকে সময় বের করে এগুলো অনুবাদ করা দরকার যাতে যারা এখনও পড়ে নাই তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। জ্ঞানের দুই পাতাও যদি জানা যায়, জানানো যায় তাহলে আর কী লাগে!
খুব সাংগঠনিক উপায়ে কিছু হচ্ছে না। তবে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে কাজ হচ্ছে। গড ডিল্যুশনের কথা শুনেছিলাম, অনেকে মিলে করছেন আপনারা – এটাও খুব চমৎকার উদ্যোগ! সেলফিশ জিনও মনে হয় অনেকের সমবায় উদ্যোগেই অনূদিত হবে।
আপনি তো আমার অনেক সিনিয়র ভাই। আমাকে ‘তুমি’ করে বললে খুব খুশি হবো। ভালো থাকুন। 🙂
মন দিয়ে অর্ধেক পড়ছি। বাকীটা রাতে। প্রথম দিকে বেশ সহজবোধ্য থাকলেও ভাষাটা মনে হয় একটু কাটখোট্টা হয়ে গেছে মাঝের দিকে এসে। যেমন অনুলিপিকারক শব্দটা যখনই আসছে বাক্যে তখনই হোঁচট খাচ্ছি সামান্য। এটা বদলানোর পক্ষে মত দিলাম 🙂
দ্বিতীয় সম্ভাবনা সত্যি হলে আমরা বলতে পারি যে তাদের টিকে থাকার যন্ত্রকে ডিএনএ অণুর যন্ত্র পরবর্তীতে দখল করেছে। যদি সেটা ঘটে থাকে, তাহলে আদি অনুলিপিকারক সমূলে ধ্বংস হয়েছিলো, কারণ এখন সেগুলোর কোন চিহ্ন আধুনিক টিকে থাকা যন্ত্রে দেখা যায় না
বোল্ড অংশটুকু প্রয়োজন আছে?
দশ কোটি কোটি কোষ থাকে- একটা কোটি বাদ যাবে মনে হয়।
পুরা লেখায় প্রচণ্ড যত্নের ছাপ লক্ষ্যনীয়। শুভকামনা, সমবায় অনুবাদ প্রকল্পের জন্য…
@রায়হান আবীর, আন্দালিব, তানভীরুলঃ
survival machine এর অন্য কোন সুন্দর বাংলা কি করা যায়? টিকে থাকা যন্ত্র… কেমন কেমন লাগে :S
@রায়হান আবীর, মাঝের দিক মানে কি ডিএনএ’র গঠনের অংশ নাকি তারো পরে ক্রোমোজোমের মিশ্রণের ব্যাখ্যার অংশ? কিছু কিছু জায়গা রিরাইট করতে হবে। উদাহরণের ভাষাটা একটু খোলাসা করে বলতে হবে। ওটা আমার নিজের মাথাতেও আছে।
এই অনুলিপিকারক নিয়ে হয়েছে সমস্যা। রেপ্লিকেটরের ভালো বাংলা কী? মাথায় নতুন কিছু আসছে না বলে এই বিদ্ঘুটে শব্দটাই রাখতে হলো। ঠিক তেমনি “সারভাইভাল মেশিনে”র ভালো বাংলা নাই। আগের অধ্যায়ের অনুবাদে উত্তরজীবিতার যন্ত্র লিখেছিলাম, সেটা আরো বাজে শোনায়/দেখায়। তোমার সাজেশনে অন্য কোন শব্দ হতে পারে এখানে?
বাড়তি মনে হচ্ছে। বইয়ে সারভাইভাল মেশিন থাকায় রেখেছিলাম। মূল ফাইলে বাদ দিয়ে দিচ্ছি। 🙂
বইয়ে লেখা এ থাউজ্যান্ড মিলিয়ন মিলিয়ন = ১০০০,০০০,০০০,০০০,০০০। এটাকে কোটিতে নিলে তো দশ কোটি কোটিই হয়। নাকি ভুল গুনলাম! (বিবর্তন পড়তে পড়তে গণিত ভুলে যাচ্ছি মনে হয় 😕 )
@আন্দালিব, যদিও আমি অনুবাদ-অজ্ঞ, তারপরও, Survival Machine–> জ়ীবনযন্ত্র।
কেমন শোনায়? আক্ষরিক অনুবাদ না, ভাবার্থে প্রস্তাব করলাম। 🙂
@নীল রোদ্দুর, হুম, ভাবার্থ হিসেবে ভালো। বেশ কাব্যিক শোনায়। দেখা যাক, আর কি কি শব্দার্থ পাওয়া যায়। 🙂
@আন্দালিব ভাই,
বইয়ের সাথে মিলাই নাই বলে কোটি কোটি নিয়ে ডাউট দিলাম। তবে ব্যাপারটা মনে হয় লক্ষ রাখা দরকার। কারণ কোটি কোটি একসাথে থাকলে আমরা অন্য মিন করে ফেলি। মিলিয়ন, বিলিয়ন ব্যবহার করলে কি সমস্যা হবে। আমার মনে এটাই ভালো।
ভাইয়া টিকে থাকা যন্ত্র, অনুলিপিকারকদের ব্যবহারের আগে এদের একটা বর্ণনা করে দেন। তাহলে পাঠকের সুবিধা হবে। নাকি মূল বই থেকে পার্থক্য হয়ে যাবে সেটা করা উচিত না? সেটা হলে ফুটনোট আকারে দিন।
@রায়হান আবীর, এটা অবশ্য খেয়াল করি নাই। ‘কোটি কোটি’ বললে একদম অনির্দিষ্ট সংখ্যা বুঝাচ্ছে।
মিলিয়ন বিলিয়ন ব্যবহার করাই যায়। কিন্তু শুরু থেকে লাখ কোটি ব্যবহার করছিলাম ‘বাংলায়িত’ করার জন্য। এখন তাহলে সবগুলো বদলানো লাগবে যে! 🙁
আচ্ছা এটাও মাথায় রাখলাম, পরে একবারে বদলে দিবো যদি বদলাতে চাই।
টিকে থাকা যন্ত্র, অনুলিপিকারকের পাশে ইংরেজি লিখে দিলে কেমন হয়? তাহলে কারো খটমটে লাগলেও, অর্থ ঠিকমত বুঝা যাবে। (ফুটনোট আকারেও দেয়া যায়)
পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল , জেনেটিক্সের উপরে উচ্চতর লেভেলের ছাত্রদের জন্য লেখা কোন লেকচার পড়ছি। বিজ্ঞান মনস্ক সাধারন পাঠকরা কি কিছু বুঝবে এটা পড়ে?
একটি প্রশ্ন অনেকদিন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে , যার যথাযথ জবাব এখনো পাইনি। প্রশ্নটি হলো – প্রাণী জগৎের শুরুটা ডিএনএ(জিন) নাকি আমিষ দিয়ে শুরু হয়েছিল?
@ফারুক, এই অধ্যায়ে এসে বইয়ের বক্তব্য পুরোপুরি বিষয়ের ভিতরে চলে গেছে। এজন্য যেমন খুব টেকনিক্যাল কিছু জিনিস ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। তবে টেকনিক্যাল হলেও এগুলো এখনও প্রাথমিক জীববিজ্ঞানেই আছে – কোষ বিভাজন, ডিএনএ’র গঠন, ডিএনএ’র বৈশিষ্ট্য মোটামুটি সকল বিজ্ঞানের ছাত্র (যাদের উচ্চমাধ্যমিকে জীববিজ্ঞান ছিলো) জানার কথা। লিঙ্গ-কোষের অংশে এসে কিছু বিস্তারিত আলোচনা এসেছে, যা আমরা উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ি নাই। এই অংশটা আনকোরা।
তবে আমার মনে হয় বিবর্তন তত্ত্বে আগ্রহী সকলের জন্যই বইটা তেমন কঠিন ভাষায় লিখিত না। খুঁটিনাটি বুঝতে ডকিন্সের উদাহরণগুলোও চমৎকার সাহায্য করে।
এই প্রশ্নের জবাব আগের অধ্যায়ে দেয়া হয়েছে। অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি –
“…পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির সময়ে ঠিক কোন রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যেতো তা আমরা জানি না। তবে সম্ভাব্য পদার্থগুলো হলো পানি, কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, এবং এমোনিয়া: সবগুলো খুব সাধারণ প্রাকৃতিক যৌগ, যেগুলো সৌরজগতের অন্য কয়েকটি গ্রহেও পাওয়া যায়। রসায়নবিদেরা আদি পৃথিবীর রাসায়নিক পরিবেশ পুনরায় তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। পরীক্ষাগারে এই সাধারণ যৌগগুলোকে একটা ফ্লাস্কে ভরে তার ভেতরে নির্দিষ্ট শক্তি উৎস দেয়া হলো অতিবেগুনি রশ্মি বা বৈদ্যুতিক ক্ষরণের (আদি পৃথিবীর বিদ্যুৎচমকের কৃত্রিম সিমুলেশানের) মাধ্যমে। বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে ফ্লাস্কের ভেতরে মূল অণুগুলোর চাইতেও অনেক জটিল গঠনের কিছু যৌগের অণুর এক ধরণের হাল্কা খয়েরি স্যুপ পাওয়া গেলো। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, ফ্লাস্কে এমাইনো এসিড পাওয়া গেলো – যা প্রোটিনের গাঠনিক একক, জৈবিক অণুর দুই মহান শ্রেণীর একটি। এই পরীক্ষার আগে মনে করা হতো এমাইনো এসিডই কেবল প্রাণের সনাক্তকারী চিহ্ন। এই অণুটি যদি মঙ্গল গ্রহে পাওয়া যায়, তাহলে ধরে নেয়া যাবে যে অচিরেই সেই গ্রহে প্রাণের উদ্ভব ঘটবে। যাক, এই পরীক্ষা থেকে বলা যায় যে আদি পৃথিবীতে এমাইনো এসিডের উপস্থিতি প্রমাণের জন্যে সেই সময়ের পরিবেশে কিছু সরল গ্যাস, আগ্নেয়গিরি, সূর্যালোক বা ঝড়ো অবহাওয়া থাকলেই চলবে। অতি সম্প্রতি, পরীক্ষাগারে রসায়নবিদেরা আদি পৃথিবীর পরিবেশ সিম্যুলেট করে একইভাবে পিউরিন এবং পাইরিমিডিন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, যা কিনা ডিএনএ’র গাঠনিক একক।
একই ধরণের প্রক্রিয়ায় নিশ্চয়ই সেই ‘আদি স্যুপ’ তৈরি হয়েছিলো, জীববিজ্ঞানী ও রসায়নবিদেরা মনে করছেন, ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার লক্ষ বছর আগের সমুদ্রে এই স্যুপ পাওয়া যেতো। এই জৈবিক পদার্থ ধীরে ধীরে সম্পৃক্ত এবং ঘন হয়ে, মূলত সমুদ্রের তীরে শুষ্কভূমিতে ছোট ছোট বিন্দুকণায় জমা পড়তো। অতিবেগুনি রশ্মির মতো শক্তির উপস্থিতিতে এই বিন্দুগুলো জড়ো হয়ে আরো বৃহৎ অণু তৈরি করতো। এখনকার সময়ে এমন বৃহৎ অণু খুব বেশিক্ষণ টিকবে না বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য জীবাণুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কারণে। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য জীবাণু সেই সময়ে প্রকৃতিতে ছিলো না, এবং এই বৃহৎ অণুগুলো ধীরে ধীরে জমা হবার সুযোগ পেতো।
ঘটনাক্রমে, এক পর্যায়ে একটি বিশেষ অণু সৃষ্টি হয়েছিলো। আমরা এই অণুটিকে বলবো অনুলিপিকারক। এই অণুই যে সবচেয়ে জটিল গঠনের বা সবচেয়ে বৃহদাকারের ছিলো তেমন না, তবে এটার বিশেষত্ব ছিলো যে তা নিজেই নিজের কপি তৈরি করতে পারতো।…”
@আন্দালিব, ‘আদি স্যুপ’নিয়ে আর কিছু বল্লাম না। কি জানি , হলেও হতে পারে (এটা নিয়ে অনেক লেখা পড়েছি , যেখানে এমন কিছু না হওয়ার সম্ভাবনার কথায় বলেছে)।
প্রকৃতিতে জীবন্ত কোষের বাইরে কি এমন কোন অনুলিপিকারক আছে , যা নিজেই নিজের কপি তৈরি করতে পারে? করলেও সেটা কিভাবে করে জানাবেন কি? অনুলিপিকারক কি আমিষবিহীন অবস্থায় থাকতে পারে?
@ফারুক, হ্যাঁ, এরকম বেশ কিছু একই রকম ধারণা আছে। প্রাগৈতিহাসিক সময়ে প্রাণ সৃষ্টির তত্ত্ব নিয়ে কেউই পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হতে পারবে না কারণ সেসময়ের কোন প্রমাণ বা চিহ্ন এখন নেই। এই বইয়ে বর্ণিত ইতিহাসটিকে আমি সেভাবেই পাঠ করি।
আমার জানা মতে নেই। আমিষ থেকেই যে প্রাণের সৃষ্টি সেটা কিন্তু প্রথম প্যারাতেই উল্লেখ করা হয়েছে। আদিম পরিবেশে আমিষ সৃষ্টির সম্ভাবনাই সব থেকে বেশি। তবে, সে সময়ে সৃষ্ট অনুলিপিকারকও এখন টিকে নেই বলে ধারণা করা হয়। আর অনুলিপিকারক কিন্তু আমিষবিহীন হতেই পারে।
যাক পোস্ট করলে অবশেষে। আমি অবশ্য আগামী দু-তিনদিন পড়তে পারবো না। তারপর বিশদ মন্তব্য করবো।
@তানভীরুল ইসলাম, হুম অসুবিধা নেই। একদিন দেরি হলো আমার পোস্ট করতে। কালকে আশা করি বাকি অংশ দিয়ে দিবো।
তুমি কি ৫ম পর্ব শুরু করেছো?
@আন্দালিব,
বাকি অংশ দিয়ে বসে থেকো না, চতুর্থ অধ্যায় শুরু করে দাও। আমি পঞ্চম অধ্যায় শুরু করে দিয়েছি। যদিও প্রচণ্ড দৌড়ের উপরে আছি তারপরও প্রতিদিনই দুয়েক পাতা করে করছি। হয়ে যাবে একটা সময় পরে। তার আগে তুমি চতুর্থ অধ্যায়টাও নামিয়ে ফেলার চেষ্টা করো। 🙂
রিচার্ড ডকিন্সের The Selfish Gene এর মত কালোত্তীর্ণ আনবিক জীববিজ্ঞানের উচ্চতর বিষয়ভিত্তিক বই বাংলায় অনুবাদ করাটা যে কারও জন্য একটা ভীতিকর ব্যপার । অনুবাদকের যেমন ইংরাজী এবং বাংলা উভয় ভাষার উপরই তুমুল দক্ষতা থাকা দরকার , তেমনি আনবিক জীববিজ্ঞানের উচ্চতর বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্যক ধারনা থাকা অপরিহার্য। এর ব্যত্যয় ঘটলে কি ঘটবে ? রিচার্ড ডকিন্সের ভাষায় এর উত্তর হবে , আধা পাক মাংসের তরকারী। অনুবাদক কি এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন বলা যায় ?
এটা সত্য যে মুক্তমনায় অনেক সময়ই অনেকে না জেনে এবং বুঝে ভদ্রতার খাতিরে ফুলের ফোয়ারা বর্ষণ করেন যাতে লেখকের উপকারের বদলে ক্ষতিই বেশী হয় এবং লেখক স্বকর্ম সংশোধনের সূযোগ থেকে বঞ্চিত হন। আশা করি এক্ষেত্রে তা হবে না। আমি অনুবাদক আন্দালিবকে অনুরোধ করবো এ লেখাটা আরও একবার মূল বইটার সাথে মিলিয়ে দেখার।
@সংশপ্তক, আমি মূল বই পড়তে পড়তেই অনুবাদ করছি। একদম সাম্প্রতিক সংস্করণ। ভদ্রতার চাইতে জরুরি মনে হয় ভুলচুক বের করে লেখাটিকে নিখুঁত করে তোলা। আর নিজের কাজ নিয়ে আত্মতুষ্টি কখনই হয় না, সুতরাং সংশোধনের পথটাও বন্ধ নাই।
আপনি লেখাটি পড়ে জানাবেন কোথাও ভুল থাকলে, অনুবাদ অস্বচ্ছন্দ মনে হলে পরামর্শ দিবেন। তাতে প্রচ্ছন্ন ভীতিটুকু কেটে যাবে আশা করি। 🙂
@সংশপ্তক,
মুক্তমনায় পোস্ট করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এক ধরনের ‘পিয়ার রিভিউ’ হয়ে যায়। এখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদচারণাকারী পাঠক ও লেখক রয়েছেন। আপনা গবেষণা ক্ষেত্র আনবিক জীববিজ্ঞান বা এ সংশ্লিষ্ঠ কিছু বলেই জানি। অনুবাদের কোনো অংশে দুর্বলতা চোখে পড়লে ধরিয়ে দেবেন প্লিজ। আমার নিজের অনুবাদ অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অনেক সময়ই নিজের অনুবাদে ভুলগুলো চোখ এড়িয়ে যায়। আমরা সবাই সহযোগিতা করলে এই অনুবাদটা নিশ্চই বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য একটা অমূল্য উপহারে পরিণত হবে।
শুভেচ্ছা…
ওমা! মুক্তমনায় দ্য সেলফিশ জিনের অনুবাদ শুরু হয়ছে, আর সেটা আমার চোখে পড়ল এতোদিনে! :Y
শুরুতেই আপনাকে অনেক অনেক অভিনন্দন। অনেক অনেক। :rose2:
সেলফিশ জিনকে চর্বিত চর্বন করার মত মানুষ এই ব্লগে মেলা আছে। :rotflol:
দৌড় ঝাপ একটু কমলে তিন পর্ব একসাথে নিয়ে বসব। নিজের আগ্রহেই প্রত্যেক লাইনের লেজ ধরে মাইক্রোস্কোপের নীচে ফেলব। :[
ইসস, আমি যে কেন অনুবাদ করতে পারিনা। 😥
@নীল রোদ্দুর, আসলেই নিয়মিতভাবে কাজটি করতে পারছি না। বেশ গ্যাপ পড়ে গেছে এক এক পোস্টের মাঝে এজন্য হয়তো আপনার চোখে পড়ে নি। ব্যাপার না, আজকে তো পড়লো! 🙂
সেলফিশ জিনের একটা ভালো অনুবাদ বাংলায় থাকা খুবই জরুরি। আর একা একা এই গুরুভার নিয়ে পার হওয়া একটু গুরুভার হয়ে যাচ্ছিলো। সম্প্রতি তানভীরুলের সাথে কিছু কথা হলো এ’ব্যাপারে। কয়েকজন মিলে হাত চালিয়ে হয়তো বইটির অনুবাদ দাঁড়া করানো যাবে। 🙂
মাইক্রোস্কোপের নিচেই ফেলুন। তাতে আমার এবং অনুবাদের উপকার হবে। সেইসাথে খোলা চোখেও দেখবেন কিন্তু। অনেক সময় অতিক্ষুদ্র কণা দেখতে গিয়ে মূল ছবির সৌন্দর্য বুঝা যায় না।
আর অনুবাদ তেমন কঠিন কর্ম না। খালি একটু সাহস আর কোমর বাঁধা লাগে। 🙂