টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আছড়ে পড়ে উইন্ডশিল্ডের উপরে। তা দেখেই দরজা খুলে ছেলেটা নেমে আসে বাইরে। চোখ তুলে তাকায় আকাশের দিকে। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে পুরোটা আকাশ। গাড়ির পিছন ঘুরে অন্য পাশে চলে আসে সে। প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খুলে গাড়ির ভিতরে উঁকি দিয়ে মোলায়েম স্বরে বলে, এসো

 

মেয়েটা যেমন ছিল ঠিক তেমনি বসে থাকে। পাথরে গড়া কোনো মূর্তি যেন। আবারো কোমল কণ্ঠে ছেলেটা আকুতি জানায়, কই এসো, বৃষ্টি পড়ছেতো।

 

মিলপুকুরে অসংখ্যবার বৃষ্টিতে ভিজেছে তারা। কখনোই মেয়েটিকে অনুরোধ করতে হয় নি। বৃষ্টির শব্দ পাওয়ামাত্রই চপলা হরিণীর মত ঘাসের উপর খালি পায়ে নেমে যেত সে। একা বৃষ্টিতে নেমেই ক্ষান্ত হতো না। জোর করে ছেলেটিকেও ডেকে নিত। বৃষ্টির চাদর গায়ে মেখে পাগলের মত ছুটোছুটি করতো এদিক সেদিক। জলে ভিজতে ভিজতে গুনগুন করে সুরেলা কণ্ঠে গান ধরতো। মেয়েটির এই পাগলামিকে হাসিমুখে প্রশ্রয় দিত ছেলেটি। মাঝে মাঝে জড়িয়ে ধরে নাকের সাথে নাক ঘষে শুধু বলতো, পাগলি কোথাকার। জবাবে মুখ গোল করে জিভ বের করে ভেংচি কাটতো মেয়েটি। বলতো, তুমি-ই একটা পাগল। নইলে কি আর আমার মত একটা পাগলিকে ভালবাসতে

 

অনিচ্ছুক মেয়েটিকে হাত ধরে গাড়ি থেকে বের করে আনে ছেলেটি। দুবাহুতে হাত রেখে মুখোমুখি দাঁড় করায়। মেয়েটির মাথা ঝুঁকে আছে মাটির দিকে। বাহু ছেড়ে দিয়ে নিজের করতলে মেয়েটির মুখটাকে নিয়ে নেয় ছেলেটি। কালো চোখ দুটোতে মুক্তোদানার মত অশ্রুবিন্দু টলমল করছে। গভীর ভালবাসায় মেয়েটির দুই চোখে চুমু খায় ছেলেটি। সারা কপাল, সারা মুখে আলতো করে ঠোঁটের আদর ছুঁইয়ে দেয়।

 

কেঁপে কেঁপে উঠে মেয়েটির সমস্ত শরীর। মোলায়েম আদর, নাকি বৃষ্টির শীতল স্পর্শে বোঝা যায় না। দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে ছেলেটির একহারা দীর্ঘ শরীরটাকে। মুখ গুঁজে দেয় চওড়া বুকে। জামার উপর দিয়েই ছেলেটির বুকে মুখ ঘষতে থাকে মেয়েটি। পরিচিত গন্ধটা নাকে আসতেই টলে উঠে মাথাটা। অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ আছে ছেলেটার বুকে, শরীরে। অনেকটা দীর্ঘ খরার পরে পলিমাটির উপর প্রথম বৃষ্টি পড়ার পরে যেরকম একটা মেটে সোঁদা গন্ধ বের হয় সেরকম। এই গন্ধ নাকে যাওয়ামাত্র নেশার ঘোর লাগে মেয়েটির। মহুয়া ফুলের গন্ধে যেমন নেশা জাগে সাঁওতাল রমণীদের, ছেলেটির শরীরের মাটি মাটি গন্ধটাও মেয়েটিকে সেরকমই মাতাল করে তোলে। 

 

মণি, তোমার সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না আমার, তাই না? ছেলেটির বুকে মুখ ঘষতে ঘষতেই কষ্টমাখা অস্ফুট স্বরে বলে মেয়েটি।

 

মেয়েটির কথা শুনে আচমকা স্থির হয়ে যায় ছেলেটির শরীর। ডান হাতটা মেয়েটির রেশম কোমল ভেজা চুলের ভিতরে আদরের চিরুনি বুলোচ্ছিল। সেটাও থেমে যায় কিছুক্ষণের জন্যে। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে শান্ত কণ্ঠে বলে সে, কে বলেছে দেখা হবে না? নিশ্চয়ই হবে।

 

ছেলেটির বুকের মধ্যে মেয়েটি মাথা এদিক ওদিক নাড়ে। আরো জোরে আঁকড়ে ধরে ছেলেটিকে। ছেলেটির পিঠে বসে যায় মেয়েটির কম্পমান আঙুলগুলো।

 

আমি জানি, আর কোনোদিন দেখা হবে না আমাদের। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে সে।

 

মেয়েটির চুলের অরণ্যে চুমু খায় ছেলেটি। নাক ডুবিয়ে বড় করে ঘ্রাণ নেয়। এই রেশমের মত চুলগুলো তার বড় প্রিয়। বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ায় ভিজে গিয়েছে চুলগুলো। কিন্তু তারপরেও পরিচিত সুগন্ধটা পেতে কোনো অসুবিধে হয় না তার। নিকষ কালো আঁধারেও  মেয়েটিকে চিনতে তার কোনোদিনই সমস্যা হবে না। এই চুলের গন্ধ দিয়ে ঠিকই সে চিনে নিতে পারবে তাকে। এরকম মিষ্টি গন্ধ আর কোনো মেয়ের চুলে আছে বলে মনে হয় না।

 

দেখো ঠিকই দেখা হবে আমাদের আবার।আগের মতই আবারও আশ্বাস দেয় সে।

 

তুমি আমার হলে কার কী ক্ষতি হতো বলো? ব্যাকুল কণ্ঠে মেয়েটি বলে। কান্নার দমক আরো বেড়ে যায় মেয়েটির। মেয়েটির কান্নার সাথে পাল্লা দিতেই যেন আকাশের কান্নাও আরো তীব্রতা পায়। প্রবল বর্ষণে ভেসে যেতে থাকে চারদিক।

 

তার এই দীর্ঘ জীবনে ভালবাসা কাকে বলে জানতো না সে। অনাদর আর অবহেলা পেয়েই অভ্যস্ত। বুকের ভিতরে জমে থাকা ভালবাসার নদীটা কখন যে মরে গিয়েছিল নিজেও জানতো না। খয়েরি চোখের এই শান্ত ছেলেটিই তার মরা নদীকে অশান্ত করে তুলেছে। তাকে ভালবাসা শিখিয়েছে, গভীরভাবে ভালবেসেছে, তার ভিতরের ভালবাসাকে জাগিয়ে তুলেছে। মানুষ হিসাবে তাকে মর্যাদা দিয়েছে, পরিপূর্ণতা দিয়েছে।

 

কত কিছু স্বপ্ন ছিল তার একে জড়িয়ে। কোনো কিছুই হলো না। ইচ্ছে ছিল একদিন সূর্যোদয়ের ভোরে ধূসর সাগরবেলা ধরে লাল টকটকে বিশাল সূর্যের দিকে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাবে তারা দুজনে। ইচ্ছে ছিল দুজনে মিলে রক্তরাঙা সূর্যাস্ত দেখবে। ইচ্ছে ছিল একটা সন্ধ্যা ছেলেটির কোলে মাথা রেখে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেবে সে। ইচ্ছে ছিল অচেনা কোনো অরণ্যের বুনোপথে সোঁদামাটির গন্ধ মেখে হেটে যাবে অজানার দিকে। এক বরষাভেজা রাতে হঠাৎ করেই যে দেখা হয়েছিল দুজনের, আজকে আরেক বরষার দিনেই বোধহয় শেষ হতে চলেছে তা। কেন এমন হয়? এত নিষ্ঠুর কেন পৃথিবীটা?

 

ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে দুঃখি মেয়েটি। নিজের শক্ত দুই হাত দিয়ে সজোরে মেয়েটিকে বুকের গভীরে আঁকড়ে ধরে মুখ উঁচু করে বিষণ্ণ আকাশের দিকে তাকায় ছেলেটি। কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। কিশোরী মেয়ের মত অভিমানে ফুলে ফুলে উঠা ক্রন্দনরত নীলিমার অশ্রুবিন্দু আর নিজের চোখের জলে মাখামাখি হয়ে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে তার চশমার কাঁচ দুটো। 

 

বৃষ্টির তোড় থেকে বাঁচার জন্য পাশের একটা গাছের ডালে পাতার আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিল একজোড়া ছোট্ট মকিং বার্ড। গায়ের সাথে গা লাগিয়ে কৌতুহলহীন উদাস চোখে তারা তাকিয়ে থাকে প্রবল বৃষ্টিতে কাকভেজা হওয়া মানবযুগলের দিকে। বৃষ্টির ঝাপটা এড়াতে আর কিছুটা উষ্ণতার জন্য হয়তো মেয়ে পাখিটি আরেকটু গুটিসুটি মেরে পুরুষটির বুকের নীচে ঢুকে যেতে চায়। পুরুষটিও তার ডানা কিছুটা উঠিয়ে জায়গা করে দেয় মেয়েটির জন্য।

 

ধূসর নীলিমা কেঁদে চলে তার সমস্ত অভিমান আর দুঃখ নিয়ে।

 

 


httpv://www.youtube.com/watch?v=1fIOm4R9_TE&feature=related

 

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

 

____________________________________

 

স্বাধীন এবং ব্রাইটস্মাইলের উদ্দেশ্যে নিবেদিত।