যখনি শৈশবের সবচেয়ে পুরোনো কোনো স্মৃতির কথা মনে করতে চেষ্টা করেছি, মনে পড়ে গেছে- ‘আমার মা সবকিছু ফেলে রেখে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন, আর আমি স্কুল থেকে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বাড়ি ফিরছি মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য। বাংলার তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থার কারণে এই ভদ্রমহিলার উঁচু ক্লাসে পড়বার সুযোগ খুব একটা হয়ে উঠেনি। জানি না, তাই বলেই হয়তো নিজের সন্তানের ভেতর দিয়ে সেটা পূরণ করবার স্বপ্ন দেখেছেন।

আর পাঁচ-দশটা জনপদের মত বিদ্যুতের আলো আমার ঘরেও তখন পৌঁছায়নি। কেরোসিনের প্রদীপের নিচে বসে বসে আমি বই নিয়ে পড়ছি, আর যতটুকু সম্ভব মা ভুলগুলো আদর করে করে ঠিক করে দিয়েছেন। মা’র একটা জিনিসই খালি বুঝতে পারতাম না, মা আমার সাথে একসাথে স্কুলে যায় না কেন? আবদার শুনে মা’তো হেসেই অস্থির হয়ে যেতেন। সে হাসির কোনো অর্থ তখন আমি বুঝতে পারতাম না। রাতের বেলা কখনো দেখতাম, মা মাটির চুলোর পাশে বসে রান্না করছেন, আর আমি পাশে বসে বসে পেন্সিল কলম ধরে খাতায় লিখছি, আঁকছি। মা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে কি যেন একটা দেখতেন। তারপর চুলোর উপরে রান্না হতে থাকা ডাল উপচে পড়তে শুরু করলে হঠাৎ করে ব্যস্তসমস্ত হয়ে আগুন কমাতে শুরু করতন।

রান্নাঘরের সে ছড়িয়ে পড়া আলোয় বসে আমার মা সে-দিন হয়তো ভেবেছিলো, তার সন্তানের ভেতর ছড়িয়ে পড়া সেই আলোর মত করেই যেন ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষার আলো। আজ অনেক অনেক বছর পর। আলোর সমস্ত সমীকরণ আমার জানা হয়ে গেছে। আমি জানি আলোর সব তত্ত্ব আর তথ্য। কিন্তু আমার মা আজও সেই একইভাবে রান্না ঘরের চুলোর আলোয় বসে রান্না করেন। শুধু তাকিয়ে থাকবার জন্য তার কাছে আমি নেই। তার স্বপ্নের আলোর খোঁজে আলোর গতিতেই আমি চলে গেছি অনেক দূরে। আমি জানি, যত আগুনই জ্বলুক না কেন, চুলোর উপর রান্না হতে থাকা উত্তপ্ত ডাল, তার চোখের পানির চেয়ে দ্রুতগতিতে উপচে পড়তে পারবে না।

জীবনের পিছনে ছুটতে ছুটতে আমরা চলে যাই দূরে, স্বপ্ন দেখি জীবনকে ঘিরে। আমাদের স্বপ্ন অনেক উঁচু, স্বপ্ন আমাদের আকাশ ছোঁয়ার। কিন্তু মাটিতে দাঁড়িয়ে কখনো আকাশ ছোঁয়া যায় না। আকাশ ছুঁতে হলে মাটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়। সেটা না করলে হয়তো জীবনে এগিয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার পথে কখনো কি মাটির দিকে ফিরে তাকিয়েছি? পিছনে যে শিকড় রেখে এসেছি, যে শিকড় ছিঁড়ে, যে শিকড় ছেড়ে উপরে উঠে যাচ্ছি কতটুকু তাকিয়ে দেখেছি তার দিকে। না তাকাইনি। কেউ তাকায় না, তাকাতে চায় না। কি অবর্ণনীয় কষ্টে মা তার সন্তানকে দূরে যেতে দেয়, কতটুকু সেটা অনুভব করার চেষ্টা করেছি আমি কিংবা আমরা?

সমস্ত জীবন শুধু দেখেছি নিজের সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে উপরে টেনে তুলছেন। মনে হয় মাঝসমুদ্রে জলের নীচে ডুবে থেকে, প্রাণপণ চেষ্টায় অনবরত পানির উপর তুলে ধরে আছেন নিজের শিশু সন্তানকে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে হঠাৎ হঠাৎ মা ফোন করেন। ঘুম ভাঙ্গা কণ্ঠে আস্তে আস্তে বলেন, ‘না এমনি ফোন করলাম’। কিন্তু তথাকথিত আলোকিত, জটিল, আধুনিক এই আমরা বুঝে যাই, এই আমি বুঝে যাই, স্বপ্ন দেখে প্রচন্ড মন খারাপ করে ফোন করেছেন। অন্যদিকে, জীবনে এমন অনেক সময় এসেছে যখন অসম্ভব রকমের অসহায় বোধ করে, নির্ভেজাল স্নেহ আর আন্তরিকতার খোঁজ করেছি, তখন মায়ের কাছে ফোন করেছি। মা হয়তো হাসতে হাসতে বলে উঠতেন, ‘কি খবর?’। জিজ্ঞেস করত, ‘কেমন আছি’। বলতাম, ‘ভালো আছি’। মায়ের জন্য বুঝা সম্ভব ছিল না, ক্লান্ত-ভারাক্রান্ত এই আমি কিসের আশায় মায়ের কাছে ছুটে গিয়েছি, ফোন করে কথা বলেছি; বুঝা সম্ভব ছিল না, তাঁর নির্ভেজাল মমতাময়ী কণ্ঠের কাছে চৈত্র মাসের শিমুল তুলোর মত উড়ে গেছে, যত সব অবসাদ, মন খারাপ আর স্বার্থপরতা।

আজ আমার জন্মদিন। জন্মদিন কখনোই আমার কাছে অর্থবহ হয়ে ধরা দেয়নি। এই দিনে আমি কখনোই বিশেষ ভাবে কিছু অনুভব করিনি। তবু মানুষের অন্তরিকতাকে উপেক্ষা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। এত এত কাছের মানুষদের অভিনন্দনের উষ্ণতা আমাকে না ছুঁয়ে পারে না। বছরের পর বছর চারপাশের মানুষগুলিকে জন্মদিনে খুশি রাখতে চেয়েছি, আমি কৃতজ্ঞ যে, তারাও আমাকে তাদের আন্তরিকতা দিয়ে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু যার অসম্ভব রকমের আগ্রহ, স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া আর মমতার মধ্য দিয়ে আমার এই জন্ম, সেই মা’কে হয়তো খুব কমই মনে করেছি। আমার জন্ম তারিখের হিসেব রাখা আমার মায়ের পক্ষে কখনোই সম্ভব হয়নি। কিন্তু ঠিকই আশপাশের কারো কাছ থেকে জেনেছেন বা শুনেছেন। আমি জানি তারপর কি হয়েছে; দ্রুত হেঁটে আমার মা ফোন সেটের কাছে গিয়েছেন, আমাকে কল করেছেন, তারপর মা হাসতে হাসতে শেষ, তার সে হাসি যে আর শেষ হতে চায় না; মধুর আমার মায়ের হাসি।

উৎসর্গঃ আমার মায়ের মতনই আরেকজন মা, শ্রদ্ধেয় তাসনিম করিম’কে, যাঁকে কথা দিয়েছি বলে আজকের এই লেখাটি।

Nov 05, 2010
poroshpathor81[email protected]