পর্যবেক্ষণের জগত ও বাস্তবতার অস্তিত্ব
বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দর্শনমতে – যা কিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচাই করা যায় না, তা নিয়ে কথা বলা অর্থহীন। অর্থাৎ অধিবিদ্যা নিয়ে কথা বলা অর্থহীন। গণিত কষে একটা কাল্পনিক মহাবিশ্ব দেখালাম, যাকে পর্যবেক্ষণ করার কোনোই উপায় নাই, সেটার অস্তিত্বকে সত্য দাবী করে কথা চালানোও অর্থহীন।
এখানে, এই অর্থহীন শব্দটি কি অর্থে ব্যবহৃত? সেটা নিয়ে দ্বিধা বিভক্তি আছে। অনেকে একে ব্যবহার করেন অর্থশূন্যতা (meaningless) অর্থে। মানে এমন যেন অন্য কিছুর অর্থ আছে, কিন্তু এসব আলাপ, যেগুলো পর্যবেক্ষণ সংশ্লিষ্ট না, কেবল এদেরই কোনো অর্থ নেই। এখানে প্যাঁচ হচ্ছে যে, অর্থকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। আর অবজেক্টিভ-ভাবে একটা জিনিসকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়? এই অর্থহীনতার আরেকটি বিদ্যমান অর্থ করা হয় – অযথা, অবান্তর (pointless)। মানে কাজের কিছু না। ঈশ্বর সংক্রান্ত দাবীর সত্যাসত্য পর্যবেক্ষণ দিয়ে যেহেতু যাচাই করা যাবে না, তাই তার আছে নাই এর তর্ক অকাজের। সারা জীবন তর্ক করেও এর আগা মাথা কোনো কিছুতে পৌঁছানো যাবে না।
কিন্তু ঈশ্বর আছে দাবী করাটাতো দেখা যায় খুব কাজের। মানে এটা দাবী করে অনেক দুর্বল মানুষ সাহস নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, এটাতে বিশ্বাস করাতে পারলে পুরোহিতরা দু পয়সা করে খেতে পারে, কিছু মানুষের উপর প্রভাবও খাটাতে পারে। ব্যাপারটা কি তাহলে? এখানে “ঈশ্বর আছে” কথাটাকে দুইভাবে দেখতে হবে। ঈশ্বর আছে এই কথাটার সত্য মূল্য নির্ধারণ করা অকাজের, কারণ তা পর্যবেক্ষণগতভাবে সম্ভব নয়। কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাস বিশ্বাসীদের জগতে পর্যবেক্ষণগত পরিবর্তন সাধন করতে পারে। তার সাথে কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্বের সত্যমূল্যের কোনো সম্পর্ক নেই। উইচ বা ডাইনিতে বিশ্বাসেরও ভৌত প্রভাব আছে। ডাইনিতে বিশ্বাসের কারণ মধ্যযুগে ইউরোপে হাজার হাজার নারীর মৃত্যু হয়েছে, যেটা একটা পর্যবেক্ষণ-সাধ্য প্রভাব। কিন্তু এ কারণে ডাইনির অস্তিত্ব সত্য হয়ে যায় না।
তাহলে পর্যবেক্ষণের বাইরের বিষয়ের সত্যাসত্য নির্ধারণ অসম্ভব ও তাই অকাজের। এখন পর্যবেক্ষণ সাধ্য জগতটা কতটা সত্য? কারো মতে এই পর্যবেক্ষণ-সাধ্য জগতটাই বাস্তব। কারো মতে এই জগত আসলে বাস্তব নয়, বাস্তবতার চিত্র আসলে ভিন্ন। আবার কারো মতে বাস্তবতা নির্ধারণ অসম্ভব। শেষেরটি অর্থহীনতার অবান্তর হবার সংজ্ঞার সাথে যায়। কারণ পর্যবেক্ষণ এখানে সত্যাসত্য নির্ধারণের পরশপাথর। পর্যবেক্ষণের নিজের সত্যাসত্য বা বাস্তবতা যাচাইয়ের অন্য আরেকটি পরশপাথর নেই, তাই পর্যবেক্ষণ-সাধ্য এই জগত বাস্তব কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর অসম্ভব ও অবান্তর।
দর্শকের আকাঙ্ক্ষা
এই পর্যবেক্ষণ-সাধ্য জগতটা বাস্তব কিনা সেটাই জানি না, তাহলে পর্যবেক্ষণ আমাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? কারণ আমাদের মাঝে আছে প্রবল আকাঙ্ক্ষা। প্রতি নিয়ত যেহেতু আমরা পর্যবেক্ষণ গ্রহণ করি, আমাদের পর্যবেক্ষণ-সংশ্লিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করেই আমাদের বেশিরভাগ আকাঙ্ক্ষা তৈরী হয়। আমরা অনেককিছু দেখি, এবং সেখান থেকেই কিছু একটা পাবার একটা আকাঙ্ক্ষা আমাদের মাঝে তৈরী হয়। না দেখলে সেটা পাবার আকাঙ্ক্ষাও তৈরী হত না। এবং পর্যবেক্ষণ-অসংশ্লিষ্ট আকাঙ্ক্ষাও মানুষের আছে। যেমন মাদকাসক্তের ভিন্ন বাস্তবতার আকাঙ্ক্ষা। তথাপি, সাধারণভাবে আমাদের আকাঙ্ক্ষা পর্যবেক্ষণ-সাধ্য জগতকে ঘিরেই।
ফলে এই পর্যবেক্ষণ-সাধ্য জগতকে বাস্তব ধরে নিলে ক্ষতি নেই, ব্যাপারটা কেবল এই ধরাধরির। শুধু কেউ যদি দাবী করতে আসে, এই জগত আসলে এমন নয়, এই জগতের আরো দশটা পাখা আছে যেগুলো দেখা যায় না, অথবা আমরা আসলে হয়ত একজন গবেষকের ল্যাবরেটরির কম্পিউটারের র্যামে বসবাস করি, তাহলে আমি বাগড়া দেব, এধরনের স্টেটমেন্ট-এর পর্যবেক্ষণগতভাবে যাচাইয়ের উপায় জানতে চাইব। এবং সঙ্গত কারণেই আমি মনে করি, এধরনের কোনো স্টেটমেন্ট-এরই যাচাই সম্ভব নয়, তাই বলাটাও অবান্তর।
আর পর্যবেক্ষণ-সাধ্য জগত নিয়ে আমাদের যেসব আকাঙ্ক্ষা তৈরী হয়, সেগুলো পূরণ করা যে সহজ নয়, সেটা আমরা উপলবদ্ধি করি। যেমন চাঁদ দেখে সেখানে যাবার শখ হলেও আমরা চাইলেই সেখানে যেতে পারি না। অনেকে মনের জোরে চলে যান। কিন্তু সেটার পক্ষে তার কোনো পর্যবেক্ষণগত প্রমাণ থাকে না। সমাজে প্রভাব থাকলে, চরিত্রগত ক্যারিশমা থাকলে কিছু মানুষ হয়ত মুখের কথাতেই বিশ্বাস করে নেয়। কিন্তু পর্যবেক্ষণগত প্রমাণ সে দাবীতে অনুপস্থিত।
তাই, পর্যবেক্ষণ-সাধ্য জগতে কিছু একটা দেখে সেটা পেতে চাইলে সহজে পাওয়া যায় না। উড়তে চাইলেই (পর্যবেক্ষণ-সাধ্যভাবে, মনে মনে নয়) ওড়া যায় না। কাউকে দেখতে চাইলেই দেখা যায় না। কারো সাথে কথা বলতে চাইলেই বলা যায় না। তবে একেবারে উপায় নেই তাই না। এই পর্যবেক্ষণ-সাধ্য জগতের পর্যবেক্ষণে কিছু নিয়ম বা রেগুলারিটি বিদ্যমান থাকতে দেখা যায়। কার্যকারণ বিদ্যমান থাকতে দেখা যায়। আমাদের দেখা অধিকাংশ পর্যবেক্ষণই র্যান্ডম নয়। তাদের মাঝে কিছু সাধারণ নিয়ম বা সূত্রের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পানিকে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। ফলে পাত্র থেকে পানি ঢাললে আমরা প্রতিবার আশা করতে পারি পানিটা নিচে চলে যাবে। এই সূত্রটি জানা আমাদের জন্য অনেক কাজের। এই সূত্রটি জানি দেখে গোসল করার সময় আমরা নিজেদেরকে পানি ভরা পাত্রের নিচে রাখি। পানি যদি একেকবার একেক দিকে গড়াতো, আমরা কোনো সাধারণ সূত্র পেতাম না, গোসল করাও একটা কঠিন কাজ হয়ে যেত, অন্তত পানির পাত্রের নিচে নিজেদের সমবসময় রাখতাম না।
প্রকৃতির পর্যবেক্ষণের এই সূত্র সবগুলো এমন সহজ নয়। এমন কি পানির এই গড়িয়ে পড়ার সূত্রটির বিস্তারিতও এমন সহজ নয়। যখন বৃহদাকারে এই পানিকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন পড়ে, যেমন নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ, তখন পানি সম্পর্কে আরো বিস্তর জানতে হয়। এবং সেই জ্ঞান পানির গড়িয়ে পড়ার মত এত সহজ নয়। আর এখানে চলে আসে বিজ্ঞান আর বৈজ্ঞানিক গবেষণা।
বিজ্ঞান: পূর্বাভাসের ক্ষমতা, ব্যাখ্যা নয়
বিজ্ঞান হচ্ছে পর্যবেক্ষণের সূত্র বের করার সাধনা। তার মানে প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার সাধনা? আমি এখানে আবার সতর্ক হয়ে যাই। বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণের সূত্র বের করবে। কিন্তু বিজ্ঞানের সূত্র আবার পর্যবেক্ষণগতভাবে যাচাইযোগ্যও হতে হবে। বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা বললে এই ব্যাপারটাকে উপেক্ষা করা হয়। সেখানে কোনো কিছু ঘটে যাবার পর অংকের সূত্র দিয়ে একটা গ্রহণযোগ্য ও সুসংগত মডেল উপস্থাপন করা হয় এবং তাকে দাবী করা হয় ঘটনাটার ব্যাখ্যা হিসেবে, পর্যবেক্ষণগত যাচাই ছাড়াই। বিজ্ঞানের যে রূপটি মিডিয়ায় জনপ্রিয়, সেখানে অহরহ নিত্যনতুন গাণিতিক মডেলকে প্রকৃতির স্বরূপ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় পাঠকের সামনে। অনেক গবেষকও এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন নন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানের মূল কাজ পর্যবেক্ষণ নিয়ে, এখানে লব্ধ কোনো জ্ঞানও পর্যবেক্ষণ দ্বারাই যাচাই করতে হবে। আর পর্যবেক্ষণে রেগুলারিটি থাকার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিলো না। এবং একটি অংশে রেগুলারিটি আছে বলে অন্য অংশে থাকবে এমন সাধারণীকরণও এখানে ফ্যালাসি। ফলে পর্যবেক্ষণের বিশ্ব সদাসর্বদা গণিত মেনে চলে, এই পূর্ব-ধারণা প্রমাদযুক্ত। প্রকৃতি গণিত মেনে চলে, এটা একটা ত্রুটিপূর্ণ বা অবান্তর ধারণা। বরং আমরা গণিত ব্যবহার করি প্রকৃতির পর্যবেক্ষণকে বোঝার জন্য।
এখন কি করে বুঝব যে একটা গাণিতিক মডেল পর্যবেক্ষণকে ঠিক মত বুঝতে পেরেছে? একমাত্র উপায়, মডেলটা আবার পর্যবেক্ষণের উপরে যাচাই করে নেয়া। ফলে ঘটে যাবার পর একটা সুসংহত মডেল তৈরী করে সেটাকে পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা দাবী করা চলবে না। পুনরায় তদ্রূপ অবস্থা পুনর্নির্মাণ করতে হবে, পর্যবেক্ষণ নেয়ার আগে মডেলটিকে বলতে পারতে হবে পরিমাপক যন্ত্রে কি পরিমাপ করা হবে বা চোখে কি দেখা যাবে। মানে মডেলের পূর্বাভাসযোগ্যতা থাকতে হবে। যে মডেল পর্যবেক্ষণের উপর পূর্বাভাস দিতে পারে না, সেটা বৈজ্ঞানিক মডেল নয়, প্রকৃতির সেই ব্যাখ্যা কোনো বৈজ্ঞানিক প্রকল্প নয়। আর পূর্বাভাসক্ষম মডেলগুলোর মধ্যে যে মডেলের পূর্বাভাস ভুল হয়, সে মডেল ভুল মডেল। আর যে মডেল পর্যবেক্ষণের সঠিক পূর্বাভাস দেয়, সেটা প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।
অনেক পূর্বাভাসক্ষম বৈজ্ঞানিক মডেল এরকম ভুল-ঠিক টাইপের হয় না। পর্যবেক্ষণের যে পরিমাপ পরিমাপক যন্ত্রে পাওয়া যাবে, সে পরিমাপ সম্পর্কে একটা পূর্বাভাস মডেলটা দেয়, কিন্তু দেখা যায় পূর্বাভাসের সাথে পরিমাপের রিডিংয়ের পার্থক্য থাকে। এসব ক্ষেত্রে মডেলটাকে বাইনারি ভুল ঠিক না বলে পূর্বাভাস কতটা ভুল সে হিসাব করা হয় এবং এর চেয়ে নিঁখুত পূর্বাভাস দেয়া মডেলের অবর্তমানে এই মডেলকে অনেকসময় ফেলে দেয়া যায় না। কেনো? পূর্বাভাসে যেহেতু (আংশিক) ভুল আছে, এটাতো নিশ্চিত যে এই মডেল সংশ্লিষ্ট-পর্যবেক্ষণটার সার্বিক মডেল না? কারণ ওই যে, মানুষের অনেক আকাঙ্ক্ষা আছে, আর পর্যবেক্ষণ নিয়ে মানুষের একটি বড় উদ্দেশ্য হলো পর্যবেক্ষণের রেগুলারিটিকে কাজে লাগিয়ে তার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা। ফলে ওই মডেল অন্তত আংশিক কাজের। পর্যবেক্ষণের একটা কাছাকাছি আভাস এই মডেল দিতে পারে। এই মডেল ছাড়া খালি হাতে সেই পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে মানুষ হয়ত কোনো আঁচই করতে পারে না। আর তার সাথে এই ব্যাপারটিতো আছেই যে প্রকৃতির সকল অংশের একশভাগ রেগুলারিটি থাকবে এমন কোনো কথা নেই। কে জানে কি নিয়ম মেনে এই সব পর্যবেক্ষণ তৈরী হচ্ছে। আমার হাতের মডেল বা সূত্রগুলো সেই পর্যবেক্ষণেরই গতি-প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাই বলে এই সূত্রটিই প্রকৃতির অন্তর্নিহিত সূত্র, এমন স্টেটমেন্ট আধিবিদ্যিক, যাচাইঅযোগ্য ও অবান্তর। যেমনভাবে, কোনো ঈশ্বর এই রেগুলার বা ইররেগুলার পর্যবেক্ষণ তৈরী করেছেন এমন দাবী করা যাচাইঅযোগ্য ও অবান্তর।
ফলে এই পর্যবেক্ষণকে নিয়েই মানুষের অধিকাংশ আশা আকাঙ্ক্ষা পরিব্যাপ্ত হয়। এর অনেকগুলো হলো দেখা গেছে বা দেখা যায় এমন কিছু একটা পেতে চাওয়া, আর একটা বড় আকাঙ্ক্ষা হলো, এই পর্যবেক্ষণগুলোকে নেহায়েত তার নিজের আগ্রহের কারণে বুঝতে চাওয়া, এর কোনো দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে। দুটার জন্যই মানুষের একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে পূর্বাভাস তৈরির ক্ষমতা অর্জন। পূর্বাভাস করতে পারলেই বলা যায়, পর্যবেক্ষণগুলোকে আমি বুঝতে পেরেছি। “বুঝতে পারার” বা জ্ঞানের এটাই হলো বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা। (জ্ঞান হলো পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত পূর্বাভাস করার ক্ষমতা)। পূর্বাভাস করতে পারলেই বলা যায়, পর্যবেক্ষণগুলোর উপর আমার জ্ঞান হয়েছে। আর পর্যবেক্ষণ-সাধ্য কোনো কিছু পাবার যে আকাঙ্ক্ষা, সেটা বাস্তবায়নের জন্যও পর্যবেক্ষণের উপর পূর্বাভাসের ক্ষমতা অপরিহার্য।
পর্যবেক্ষণের এই জগতে কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা পূরণে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ যে জ্ঞান, সেটা হলো ক্রিয়া-শর্তাধীন জ্ঞান। পানি নিচের দিকে পড়ে, এটা হলো ক্রিয়া-`অ’শর্তাধীন জ্ঞান। আমার ক্রিয়ার উপর এই (পর্যবেক্ষণ-সংক্রান্ত) সত্য নির্ভর করে না। আর পাত্র থেকে পানি ঢাললে পানি নিচের দিকে পড়ে, এটা ক্রিয়া-শর্তাধীন জ্ঞান। বলে লাথি দিলে বল কোনদিকে যাবে সেই জ্ঞান ক্রিয়া-শর্তাধীন জ্ঞান। নদীতে বিশ ফুট বাঁধ দিলে পানির গতি-প্রকৃতি কেমন হবে সেই জ্ঞান ক্রিয়া-শর্তাধীন জ্ঞান। একটা এটমে একটা ইলেকট্রন সজোরে ছুঁড়ে দিলে কি হবে সে জ্ঞান ক্রিয়া-শর্তাধীন জ্ঞান। মানে এখানে (পর্যবেক্ষণ-সংক্রান্ত) সত্য আমার ক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। কৌতুহলের বিজ্ঞান সবসময়ে ক্রিয়া-শর্তাধীন জ্ঞান নিয়ে চিন্তিত না। কিন্তু কিছু পেতে চাওয়ার যে বিজ্ঞান, সেটাতে এগুতে হলে নতুন কোনো হাতিয়ার সৃষ্টি জরুরি, যেটা সাহায্য করবে আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পেতে। যেমন, নদীর গতি-প্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য বাঁধ তৈরী জরুরি, ড্রেজ করা জরুরি, নিউক্লিয়ার শক্তি পাবার জন্য রিয়াক্টর তৈরী জরুরি, চাঁদে যাবার জন্য রকেট তৈরী জরুরি, দূরের মানুষের সাথে কথা বলার জন্য টেলিফোন তৈরী জরুরি, আমার জটিল গণনাগুলো করে দেবার জন্য কম্পিউটার সৃষ্টি জরুরি। আর কিছু সৃষ্টি করার জন্য ক্রিয়া-শর্তাধীন জ্ঞান অপরিহার্য। কারণ মানুষের ক্রিয়া-সাধন ব্যতিত নিজে নিজে প্রাকৃতিক নিয়মে বা কেবল ইচ্ছাশক্তি দ্বারা এগুলো সৃষ্টি সম্ভব না।
পর্যবেক্ষণের দুনিয়ায় ক্রিয়া-শর্তাধীন অথবা ক্রিয়া-অশর্তাধীন ঘটনার পূর্বাভাস করার যে প্রক্রিয়া, সেটাই বিজ্ঞান। পর্যবেক্ষণের দুনিয়া নিয়ে একমাত্র কাজের জ্ঞান।
অধিবিদ্যা, বিজ্ঞান এবং আমরা
মানুষের মনে রয়েছে প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা। মানুষ তা কিভাবে পূরণ করবে সে তার নিজের উপর। যে পর্যবেক্ষণ-সাধ্য জগতকে সে দেখছে, সেটা বাস্তব কিনা সে জানে না, জানার উপায় নেই। তার নিজের অস্তিত্ব বাস্তব কিনা, সে জানার কোনো উপায় নেই। সত্যিকারের বাস্তবতা আসলে কোনটা, সেটা জানারও কোনো পথ নেই। তবে তার ইন্দ্রিয় আর অনুভূতির জগতে পর্যবেক্ষণ বলে সুন্দর একটি জিনিস আপতিত হয়। সেই পর্যবেক্ষণের জগত নিয়ে কিছু স্টেটমেন্ট রাখা যায়, যেগুলো ওই পর্যবেক্ষণের উপরই যাচাই করা যায়। আর সেজন্য তার হাতে রয়েছে বিজ্ঞান। এই পর্যবেক্ষণের জগত এমন কি মিথ্যা হলেও দর্শকের কাছে স্বকীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে মানুষের পর্যবেক্ষণ-অসাধ্য, কল্পনার জগত, সেখানে বিচরণ করে মানুষের অধিবিদ্যা। সেগুলোও অসংখ্য স্টেটমেন্ট তৈরী করে, ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা, উচিত-অনুচিত। কিন্তু সেগুলোর কোনো প্রকারেরই কোনো যাচাই নেই, সেটা সম্ভব না। এসব স্টেটমেন্টের যাচাইয়ে এমনকি বিজ্ঞানের আনয়নও অসম্ভব, কেননা এগুলোতো পর্যবেক্ষণই করা যায় না। যাচাই কিভাবে হবে? এগুলোকে বিদায় করার কোনো উপায় নেই, মানুষের আকাঙ্ক্ষার বদল হওয়া ছাড়া।
মানুষ কি আকাঙ্ক্ষা করবে সেটা তার নিজের ব্যাপার। কোন জগতকে বাস্তবতা হিসেবে স্বীকার করে নিবে, বা গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে সে তার নিজের ইচ্ছা। তবে পর্যবেক্ষণের এই জগতকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে, পর্যবেক্ষণ-সাধ্য কিছু নিয়ে আকাঙ্ক্ষা করলে সেটা পূরণের জন্য বিজ্ঞানের কাছে ফিরে আসতে হবে। মুখের বুলিতে কাজ হবে না। আপনি আর পিটার যদি একই জিনিস চান, আপনি যদি সেটা পাবার জন্য চব্বিশ ঘন্টা প্রার্থনা করেন আর পিটার যদি সেটা পাবার জন্যে বিজ্ঞান, নতুন তৈরী হাতিয়ার ইত্যাদি ব্যবহার করে, ওই জিনিস নির্ঘাত পিটার পাবে আপনি নন। সে নিউক্লিয়ার শক্তি হোক, মঙ্গল গ্রহে যাওয়া হোক, আর ভেসে ভেসে অফিস যাওয়া হোক। এবার আপনার জায়গায় মুসলমান জাতি বা বাঙালি জাতি বা বাঙালি মুসলমান জাতিকে বসান, আর পিটারের জায়গায় পশ্চিমাদের। চিত্রটা তখন মোটামুটি এরকমই। মুসলমানেরা মোটের উপর মুখের তুড়ি ছুটিয়েই নতুন সহস্রাব্দে পা রাখল। তাদের বিজ্ঞানী ইবন আল হাশেম যদিও এক হাজার বছর আগেই বলেছিলেন “কেতাবিরা নয়, বরং যুক্তি আর উপাত্ত যাচাইকারীরাই প্রকৃত সত্যের সন্ধানী”, জাতি হিসেবে তারা বিজ্ঞানের এই দর্শনকে কখনই কদর করে নি। তাই এই দর্শনের ধারাবাহিকতাও মুসলমান বিজ্ঞানীদের মধ্যে থাকে নি। অথচ তাদের জাতিগত একটা বড় আকাঙ্ক্ষা পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত: পৃথিবীতে শরীয়তি শাসন কায়েম করা। শরীয়তি শাসনই উত্তম, এই স্টেটমেন্ট নৈর্ব্যক্তিকভাবে যাচাই অসম্ভব। একটা যাচাই-অযোগ্য, ব্যক্তিক বিশ্বাস সকল মানুষের উপর জোরপূর্বক চাপানোর এই ইচ্ছাটাই দুঃখজনক, তার ওপর আবার সেটা অর্জনের জন্য মারেফতের উপর ভরসা করা। যেনো সোনায় সোহাগা!
বাঙালিও জাতিগতভাবে খুব মারেফতি। আধ্যাত্মিকতা তার মজ্জাগত। পর্যবেক্ষণগত জগতটা নিয়ে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা কম। তা থাকুক না বাঙালি তার আধ্যাতিক জগতের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, পিটার থাকুক পর্যবেক্ষণের জগত নিয়ে। ক্ষতি কি? পর্যবেক্ষণ জগতে যখন আঘাত আসে, আধ্যাত্মিক জগতের ভিতরে বসবাস প্রলম্বিত করা তখন কঠিন হয়ে যায়। এবং আঘাত আসতে পারে, কারণ প্রাপ্তিসাধ্য পর্যবেক্ষণের জগত সীমিত। রসদ সীমিত। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অবশ্যম্ভাবী। আপনি প্রতিযোগিতায় নাম না লেখালেও আপনি একজন প্রতিদ্বন্দ্বী। কারণ আপনি অন্তত পর্যবেক্ষণ-সাধ্য জগতের একটা স্থান দখল করে আছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। সেটার দখল ধরে রাখতে হলে, অচিরেই মাটিতে বিশ্লিষ্ট ও অক্রিয়াশীল হতে না চাইলে আপনাকে পর্যবেক্ষণ জগতের কৌশল জানতে হবে, বিজ্ঞান জানতে হবে। আধ্যাত্মিকতা দিয়ে পর্যবেক্ষণ জগতের কিছুই লাভ করা সম্ভব নয়। যদি মনে করেন অন্যায্য তারপরেও একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা পর্যবেক্ষণ জগতে বিদ্যমান আছে। এখানে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু অন্য মানুষেরা নয়, বরং প্রকৃতি নিজেই, সেটা মনে রাখতে হবে। এখানে পিছিয়ে পড়ারাই হেরে যায়। এই হারাটা হেরে যেতে যদি না চান, এখানে আধ্যাত্মিকতা তবে কোনোই সহায় নয়।
বাঙালি যদি আধ্যাত্মিকতা ভালবাসে, যদি তার অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষায় আধ্যাত্মিকতা মজ্জাগত হয়, সে আধ্যাত্মিকতা করেই যাবে। কিন্তু এই পর্যবেক্ষণের জগতে আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য না হোক, টিকে থাকার জন্যে হলেও বিজ্ঞান জানতে হবে। আমরা ছোটবেলায় সবাই যে আলাউদ্দিনের চেরাগ কল্পনা করি, মনে মনে – আধ্যাত্মিক জগতে যে আলাউদ্দিনের চেরাগ আমরা হাজারবার পেতে পারি, পর্যবেক্ষণের এই জগতে সেটা এনে দিতে পারে কেবল বিজ্ঞান। আর সেটা চর্চার প্রথম পদক্ষেপ হলো পর্যবেক্ষণ-অসাধ্য তথা অর্থহীন সকল তত্ত্ব/প্রকল্পকে পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা হিসেবে বাতিল করতে শেখা এবং এমন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা যা পূর্বাভাস দিতে পারে (can predict observation), এমন হাতিয়ার তৈরী করা যা পর্যবেক্ষণের জগতটাকে তার নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। পর্যবেক্ষণের জগতে ভবিষ্যত বলতে পারার ক্ষমতাই সবচেয়ে বড় ক্ষমতা। এটাই আমরা সবাই চাই। আমরা জানতে চাই, কি করলে আমরা প্রমোশন পাবো, কি করলে বোনাস পাবো, কি করলে আয় বাড়বে, জানতে চাই টাকা ব্যাংকে রাখলে ভালো হবে না ব্যবসায় খাটালে। রাজনীতিবিদরা জানতে চায় কি করলে মানুষ ভোট দিবে, সংখ্যালঘুর পক্ষে বললে ভোট বাড়বে না কমবে। রাষ্ট্র জানতে চায়, প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ বাঁধলে কে জিতবে, জনসংখ্যা বাড়লে কি লাভ, কি ক্ষতি। পর্যবেক্ষণের দুনিয়াসংক্রান্ত আমাদের সকল প্রশ্নই এক অর্থে ভবিষ্যত জানতে চাওয়া। কি ঘটবে আগে থেকে বলে দিতে পারা, এটা কোনো দৈব-শক্তি দ্বারা সম্ভব নয়, সম্ভব হলে কেবলমাত্র সম্ভব বিজ্ঞান দ্বারা।
কেউ যদি জিগ্গেস করেন আমি আস্তিক নাস্তিক না অজ্ঞেয়বাদী, সে প্রশ্নের উত্তর হবে এই পুরো প্রবন্ধটি। এটাই হলো আমার অবস্থান। আসলে এই প্রশ্নের উত্তর আস্তিক নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী এই তিনটির যেকোনো একটি হলেই কিন্তু এক অর্থে মেনে নেয়া হলো যে ঈশ্বর আছে কিনা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি প্রশ্নটিকেই অবান্তর মনে করি, তখন আমার পরিচয় কি?
জন্মে মানুষ চান্ডাল কিংবা ব্রাক্ষণ হয় না; কর্ম দ্বারা মানুষ চান্ডাল কিংবা ব্রাক্ষণ হয় ।
ডঃ আমেড্করের কথা আদৌ ভুলে যাওয়ার নয় যার জন্য মহারাষ্ট্রে দালিদ্দের অর্থনীতিক চাকা ঘুরে যায়; শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে যায় সব হয়েছে হিন্দুধর্মের বর্বর শ্রেণীর প্রথা বলিদানের পর । বাস্তবিক দিক দিয়ে যদি দেখি অধিবিদ্যা এক ধরণের সময়ক্ষেপণ ব্যতীত কিছু নয়; অযথা সময় নষ্ট করা যদিও আবার অনেকক্ষেত্রে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারও বটে । বিজ্ঞান এত দ্রুত এগুতে পারছে কিন্তু দর্শনের আশির্বাদে ।
– দারুন বলেছেন। আমি নিজেও একদম এই রকমই মনে করি। ঈশ্বর আছে কি নেই এই প্রশ্ন নিয়ে বেহুদা বড় বড় তর্ক নিতান্তই এখন সময়ের অপচয় মনে হয়। এই তর্কের অনিবার্য পরিনতি মোটামুটি এই রকম। এক পক্ষের যুক্তি হবে ঈশ্বরের স্বপক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক প্রমান নেই, প্রমান পেলে তারা মেনে নেবেন। অন্য পক্ষের দাবী হল ঈশ্বর নেই তাও নাকি কেউ প্রমান করতে পারেনি তাই তারা মনে করেন যে তর্কে তারাই জিতেছেন। বিশেষ করে এই দ্বিতীয় পক্ষের এহেন যুক্তির পরে আর কোন তর্ক চলে না (যুক্তি অকাট্য তা নয়, বরং যুক্তির চোখে এই ধারনার কোন মূল্য নেই বলে)।
ঈশ্বর বিতর্কের থেকে কোন প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের অনুসৃত বিধিবিধান মূল্যবোধ এসব নিয়ে আলোচনাই বেশী দরকার বলে মনে করি।
@আদিল মাহমুদ,
ভালো বলেছেন। আলোচনাটা বস্তুবাদী হওয়া উচিত। যেমন অমুক বিধানটা মানলে আমাদের কি লাভ কি ক্ষতি। সহজ হিসাব। ধর্মের বিধান বলে পালন করা যাবেই না, এরকম হওয়া ঠিক না। সমস্যা হচ্ছে, ইসলামি ধর্মবাদীরা বস্তুবাদী আলাপে অভ্যস্ত না। একটা বিধান মানলে কি লাভ কি ক্ষতি, বা ক্ষতি হলে মানবো না, এমন চিন্তা তারা করেই না। তারা ভাবে, এটা সহি হাদিস কিনা। সহি হলে লাভ ক্ষতি চুলে যাক, মানতে হবে।
@ধ্রুব,
আমিও তেমন মনে করি। ঈশ্বর আছে কি নেই এই বিতর্ক জয়লাভে জগত সংসারের বিন্দুমাত্র কিছু আসবে যাবে বলে মনে হয় না।
মানুষের পরিচয় যেমন কর্মে, বংশে নয় তেমনি যেকোন বিধিবিধানের মূল্যায়ন হওয়া উচিত যুক্তিতর্কের ভিত্তিতেই। উৎসের ভিত্তিতে নয়। ধর্মীয় কোন বিধিবিধান যদি ভাল হয় তো মানতে সমস্যা কোথায়?
তেমনি ধর্মীয় বিধিবিধান অচল হলে তাও স্বীকার করতে হবে। আগেই সহি ধরে নিয়ে তারপক্ষে কুযুক্তি সাজানো হল আপত্তিকর।
বাঙালীর আধ্যাত্মিকতা আলাদা কিছু না। জীবন জিজ্ঞাসা সবার থাকা উচিত-না থাকাটাই খারাপ। কিন্ত এই জিজ্ঞাসার উত্তর বিজ্ঞান দিয়ে না দিলে, সমস্যার সূত্রপাত হয়।
আর ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং প্রত্যক্ষ জগতকে যে কাজে লাগাতে পারবে-সেই বস্তুবাদি উন্নতি করবে। ব্যাবসায়ীরা হিন্দুদের কাছে হিন্দু, মুসলমানদের কাছে মুসলমান, নাস্তিকদের কাছে নাস্তিক-তাদের যুক্তিবাদ আরো বেশী লাভে। অধিকাংশ ধার্মিক মুসলমান গোঁড়া বলে, তাদের দ্বারা ব্যাবসা হয় না। যার জন্যে বিদেশে হিন্দুরা ব্যাবসায়ী হিসাবে অনেক বেশী সফল কারন তারা অনেক বেশী ফ্লেক্সিবল-মুসলমানদের মধ্যে তারাই ব্যাবসায় সফল যারা ধর্মটাকে অনেকটা ছাড়তে পেরেছে।
ধনতান্ত্রিক বিকাশ ধর্মমুখী জীবন থেকে উত্তোরনের একটা প্রাথমিক অবস্থান।
@বিপ্লব পাল,
সেটাই। যেমন আমার এই লেখাটাও একটা জীবন ও জগত জিজ্ঞাসা।
:yes: অধিবিদ্যার জগতে ডুবে থাকা মুসলমান ব্যবসায় ভালো করবে ভাবাটা কষ্টকর। কিন্তু কি আর করা। এটা তো তাদের চয়েজ। তারাই তো এই অধিবিদ্যার আরাধনা বেছে নিয়েছে। তাদের রক্ষণশীলরা মানে কাঠমোল্লারা নির্ভর করে আধিবিদ্যিক নির্দেশের উপর আর তাদের উদাররা উদারচেতা হন সেই আধিবিদ্যিক বোধের (বা সুফিত্বের) উপরেই। প্রত্যক্ষ জগত তুচ্ছ। যার যা পছন্দ।
তবে প্রত্যক্ষ জগতের উপর এত ন্যুনতম জোর দেয়ার পর আর তাদের মানায় না অভিযোগ করতে যে তাদের অন্য জাতিরা মারছে, ঠকাচ্ছে, থাকতে দিচ্ছে না, পরতে দিচ্ছে না। মুসলমানের ইদানিংকার এই সংগ্রামও যদি তাকে কিছুটা প্রত্যক্ষ জগতের উপর আগ্রহী করে। কিন্তু বাস্তবে তো দেখ যাচ্ছে উল্টো। এদের দার্শনিকরা এখন পশ্চিম বনাম মুসলিম সংঘাতের উত্তরে ইসলামি সাম্যবাদ নামে আরেকটা আধিবিদ্যিক প্রপঞ্চ হাজির করেছে। যেন বিজ্ঞান থেকে একশ হাত দূরে থাকার একটা শপথ নিয়ে বসেছে। মধ্যযুগের মুসলমান দার্শনিকদের চিন্তাও তো এত অনুর্বর ছিল বলে মনে হয় না।
হয়ত একটা শর্ত। কিন্তু ধনের বিকাশের আগে বিজ্ঞান নির্ভর চিন্তার বিকাশ কি অসম্ভব/অকাজের?
@ধ্রুব
একমাত্র আমেরিকা বাদ দিলে পৃথিবীর সর্বত্র মুসলমানরা অন্য ধর্মের লোকেদের থেকে গরীব। ইংল্যান্ডে একজন হিন্দুর আয় একজন মুসলমানের প্রায় ২-৩ গুন। গোটা ইউরোপেই প্রায় একই অবস্থা। সুতরাং তাদের দারিদ্রের পেছনে তাদের ধর্মের একটা ভূমিকা আছে। আবার যেহেতু আমেরিকাতে মুসলমানরা গড় জন সংখ্যার থেকে ভাল করছে, সেহেতু বলা চলে প্রকৃত ধনতন্ত্রের বিকাশ হলে মুসলিমরাও
তাদের ধর্মান্ধতা থেকে আস্তে আস্তে বেড়োবে।
আবার এটাও লক্ষ্যনীয় হিন্দুরা প্রায় পৃথিবীর সব জায়গাতেই ব্যাবসাতে উন্নতি করেছে-এবং সেটা তাদের ধর্মান্ধতা থাকা স্বত্ত্বেও। লক্ষীকান্ত মিত্তল থেকে মুকেশ আম্বানী-এরা সবাই ধর্মান্ধ না হলেও, ধর্মভীরু লোক। হিন্দু ব্যাবসায়ীদের অধিকাংশই ধর্ম ভীরু। তাহলে এরা যৌত্বিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কি করে?
@বিপ্লব পাল,
কারণ হয়ত কর্মই ধর্ম মানার সুযোগ হিন্দু ধর্মে আছে, ইসলামে নেই। ইসলামে ভাববাদ বাদ দেয়া ভয়ানক অনৈতিক ব্যাপার।
@ধ্রুব,
হজরত মহম্মদ এবং আরবরা ভাল ব্যাবসায়ী ছিল। আরবরা পিছিয়ে পড়লে কি হবে এক সময় ত ব্যাবসা করেই খেত-মরুভূমিতে ফসল হয় না। ইসলাম ব্যাবসা বিরুদ্ধ না। সমস্যা হচ্ছে একজন মুসলিম কি করে ইসলামকে মানছে। এখন ব্যাবসা করতে গিয়ে সে যদি দাঁড়ি রাখে, কাস্টমারের সামনে বার বার ইনশাল্লা বা বিসমিল্লা বলে-আর মিটিং থেকে বেড়িয়ে গিয়ে বাথরুমে নামাজ পড়ে বা নামাজ পড়ে কাস্টমার আসবে সেই আশায় বসে থাকে-তার ব্যাবসাতে লালবাতি জ্বলবে। হিন্দুরা প্রায় সম পরিমান ধর্মান্ধ হলেও এই সব উটকো ধর্মীয় উৎপাত মুক্ত। আমার মনে হয় না, ইসলামে এসব করা বাধ্যতা মূলক। আসলে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমরা ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্কটে ভোগে বলে, এক ধরনের অদ্ভুত আরবীয় হনুকরন করে। আরবী সংস্কৃতির হনুকরন আর ইসলামকে এক করা উচিত না।
@বিপ্লব পাল,
অথবা, কৃষকদের কাছে ইসলাম এই রূপটাই ধারণ করেছে।
ইসলাম বলতে অনেকে একটা বিশেষ ধারণার কথা ভাবে। যেটা প্রকৃত বা আদি। সাধারণত মুহাম্মদ বেঁচে থাকার সময়ে প্রচারিত ধর্মটা। আর ইসলামের পালনকারীর ধর্মকে সর্বদাই দেখায় যে সেটা ইসলাম থেকে ভিন্ন। আমার মত, ইসলামকে একটা বিশেষ আদি রূপ হিসেবে কল্পনা করা ভ্রান্ত। ইসলাম হলো মুসলিমের আচার। মুসলিম তার ধর্মটাকে যেভাবে পালন করে, যেভাবে ব্যাখ্যা করে, সেটাই ইসলাম। কারণ সেই কথিত আদি রূপ দেখার কোনো উপায় নাই। কোরান থেকে শুরু করে হাদীস, ইসলামের ইতিহাস, গল্প যা কিছু আমাদের কাছে এসেছে, কোনটাই আদি অবস্থায় আসে নি, মানে সপ্তম শতক থেকে আমাদের কোলে এসে পড়ে নি। মানুষের হাত ঘুরে, মানুষের ব্যাখ্যা দ্বারা বিবৃত হয়েই এসেছে। শানে নুজুল থেকে শুরু করে আর যা যা কল্পনা করা যায়। সবই মাঝের লিংক হিসেবে যারা অবস্থান করেছে, তাদের ব্যাখ্যা দ্বারা ফিল্টার কৃত। মুহাম্মদের সময়ের আদি ইসলাম বলে কিছুর অস্তিত্ব নাই বর্তমান সময়ে। থাকলে হয়ত ভালো হত। আমরা হয়ত আরো ভালো বুঝতাম যে একটা সাধারণ বস্তুবাদী লড়াই ছিল ওটা। ওটার উপর যত মাহাত্ম্য আরোপ, সব পরেই হয়েছে।
যাহোক, সে হিসেবে আরবের ইসলাম আর উপমহাদেশের ইসলাম প্রকারে ধরনে আলাদা বোঝা যাচ্ছে।
@ধ্রুব,
ইসলাম যে একটা বস্তুবাদি লড়াই ছিল-সেটা বুঝতে ত এত জানতে হয় না। আল ইসলামে কারা ছিল প্রথমে? সবাই গরীব, চোর, মুটে শ্রেনীর লোকেরা, যার ধনী প্যাগান কতৃক নির্যাতি। সুরা ৯ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় মহম্মদ বড়লোকদের ধন সম্পতি বৌ বাচ্চা লুট করার জন্যে ইন্ধন দিচ্ছেন-যাতে আল ইসলামের গরীব সেনারা আরো চাঙ্গা থাকে। এটা ছিল ইতিহাসের সব সময়ের মিলিটারী ট্যাকটিক্স। সুরা ৯ এ যা আছে, সেটা পৃথিবীর প্রায় সব ঐতিহাসিক মিলিটারি ম্যানুয়ালেই পাবে-এমন কি সেই ম্যানুয়ালটা ঈশ্বরের নামে চালানো পর্যন্ত। কোন কিছুই নতুন না।
@বিপ্লব পাল,
ইসলাম আরব দেশ থেকেই উদ্ভুত। ইসলাম পালন করতে গেলে জান্তে অজান্তে আরবী সংস্কৃতি পালন করা হবেই, সেটা পছন্দ হউক বা না হউক।
আসলে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমরা ধর্ম (অন্য দেশের সংস্কৃতি) এবং নিজেদের সংস্কৃতির একটা জগা-খিচুরী মিশেল পালন করতে যেয়ে এক উদ্ভট সঙ্কটে ভোগে। না ঘরকা না ঘটকা।
@বিপ্লব পাল, (Y)
@বিপ্লব পাল,
এটা খুব ভাল প্রশ্ন করেছেন। আসলে বিজ্ঞানমনস্কতা, জাগতিক সাফল্য আর ধার্মিকতার মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল এবং সরল কজ এন্ড এফেক্ট ধরনের সম্পর্ক টানা যায়না। বড়জোর সমষ্টিগতভাবে বা ম্যাক্রো লেভেলে সংখ্যাতাত্বিক কোরিলেশন আছে বলা যায়। আর ব্যাক্তিগত পর্যায়ে ব্যাপারটা আরো কনফিউজিং। একই লোককে দেখা যাবে জীবনের এক ক্ষেত্রে অত্যন্ত যুক্তিবাদি আবার অন্য আর এক ক্ষেত্রে গোঁয়ারগোবিন্দ ষাঁঢের মত আচরন করছেন। নিউটনের মত একজন বিজ্ঞানী জ্যোতিষশাস্ত্র এবং হস্তরেখাবিদ্যা জাতীয় কুসংষ্কারে বিশ্বাসী ছিলেন্। আমেরিকার অনেক সফল ব্যাবসায়ী রীতিমত চার্চে যান।
@মোঃ হারুন উজ জামান,
ইসলাম সহ প্রতিটা ধর্মের অনুসারীরাই মুখে যাইই বলে থাকুন, কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধিবিধানের সাথে তাদের আপোষ করতেই হয়। এটা অনেকে মেনে নেন, স্বীকার করেন যে এই যুগে অনেক কিছুই অচল হয়ে গেছে, আবার অনেকে সরাসরি স্বীকার করেন না নানান রকমের তাল বাহানা করেন যা চরম স্ববিরোধী শোনায়।
ইসলাম যেহেতু সবচেয়ে আধুনিক ধর্ম তাই এই তালিকায় বিশুদ্ধ ধর্মীয় প্র্যাক্টিসের মধ্যে ইসলামই এগিয়ে। তারপরেও বিশ্বের এমন একটি দেশ বা সমাজ নেই যেখানে কেউ আক্ষরিক অর্থে ১০০% কোরান মেনে চলতে পারে (হাদীস তো বাদই দিলাম)। এই সোজা সরল সত্য মুসলমানদের মাঝে এখনো সেভাবে রেখাপাত করেনি। বেশীরভাগই উপরে বলা দ্বিতীয় দলভুক্ত।
অন্য ধর্মের লোকেরা ধর্মকে জীবন যাত্রা নিয়ন্ত্রনের একমাত্র স্কেল হিসেবে চিন্তা না করে মানসিক শান্তির উপাদান হিসেবে মূলত পালন করে। এখানেই মৌলিক তফাত। হিন্দুরা বিশেষ করে ভারতের বাইরে যারা পশ্চীমা দেশে উন্নতি করছে তাদের উন্নতির পথে এইজন্য ধর্ম বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে না। ব্যাক্তি জীবনে তারা ধর্মান্ধ হলেও তারা সমষ্টিগত জীবনে তার প্রভাব সেভাবে টানার চেষ্টা করে না। যার জন্য পশ্চীমা দেশগুলিতে মুসলমানদের সাথে কালচারাল ক্ল্যাশ হলেও হিন্দুদের সাথে এই ক্ল্যাশ নেই। কোন হিন্দু পিতামাতা কোনদিন দাবী করবে না যে স্কুল থেকে হলি ক্রশ সরানো হোক কারন তাতে তাদের ধর্ম বিশ্বাসের সমস্যা হয়, কিংবা তাদের মহিলাদের পর্দার খাতিরে নেকাব পরিহিত অবস্থায় ইমিগ্রেশন পার হতে দিতে হবে।
@আদিল মাহমুদ,
আপনার মন্তব্যটা আমার মন্তব্যের জবাব কিনা তা বুঝতে পারছিনা। কারন আপনার মন্তব্যতে আমি যা লিখেছি সে সম্বন্ধে কিছু নেই। আপনি কি আর কারো মন্তব্যের উত্তর দিতে গিয়ে প্রথম লাইনে ভুল করে আমার নাম লিখে ফেলেছেন?
ধ্রুব, আপনার লেখাটা পড়তে পড়তে মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। কিন্তু গতবার আপনার সাথে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল বলে কয়েক কাপ চায়ের বিরতি নিয়ে নিয়েও লেখাটা পড়ে শেষ করলাম। আতিক রাঢ়ীর মন্তব্যের উত্তরে যেরকম বলেছেন সেরকমভাবে প্রত্যেকটা অংশ নিয়ে আলাদা করে একেকটা লেখা লিখলে কিন্তু খুবই ভালো হয়। তবে চিন্তার খোরাক জোগানো এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ লেখা উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না।
এই জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা এবং পর্যবেক্ষণের ইচ্ছাটা কি অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে কোনভাবে যুক্ত? আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় এরা ডিরেক্টলি প্রপোরশানাল। মানব সভ্যতা ইতিহাসে আমরা কি দেখেছি? প্রত্যকটা সার্থক এবং বিত্তশালী সভ্যতা জ্ঞান বিজ্ঞা্নের (তথা পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান) চর্চা করেছে আর পিছিয়ে পড়া জাতিগুলো আরও বেশী করে আধ্যাত্মিকতায় ডুবে গেছে। এখানে কি রিসোর্সের ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ নাকি শুধু মানসিকতাটাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয়? নাকি একটা আরেকটাকে চক্রাকারে প্রভাবিত করছে?
@ফাহিম রেজা,
ধন্যবাদ! 🙂
আমার মতটা অনেকটা এরকম। পশ্চিমে শিল্প বিপ্লব হয়েছিল বলে ওখানে বিজ্ঞানের কদর বেড়েছে এমনটা চিন্তা করা যায়। আবার এমনটা ভাবা যায় যে শিল্প বিপ্লব এসেছিল রেনেঁসাকালীন সময়ে বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে দার্শনিকদের চিন্তা ক্রমান্বয়ে পর্যবেক্ষণ-নির্ভর হয়ে আসার একটা ধীর প্রভাবের কারণে।
মুসলিম জগতেও বিত্তবৈভব ছিল। তাদের বিজ্ঞানীরাও জ্ঞান চর্চা করেছে। পরবর্তী বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্যে তাদের অবদান অসামান্য। ফলে আপনার কথাটাও ঠিকই আছে।
তবে আমাদের দেশে শিক্ষিত যুবসমাজ, তাদেরকে তো সচ্ছলই মনে হয়। তাদের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার এত প্রকোপ কেন? মাত্র দারিদ্র থেকে উঠে আসল দেখে? অর্থনৈতিক মনস্তত্ত্ব নিয়ে আমাকে সাহায্য করতে পারেন।
তদুপরি, দর্শনের খোঁজে ঘোরাঘুরি করা বাঙালিতো কম নয় এখন, এই দৃষ্টিভঙ্গির আহ্বান তাদের কাজে দিবে বৈকি।
@ধ্রুব,
বিষয়টা অর্থনৈতিক নয়। পাঁচ পুরুষ ধরে কোটিপতি এমন আধ্যাত্মিক ব্যক্তির সংখ্যা কম নয়। তারা আমার আশে পাশেরই মানুষ। বিষয়টা আসলে জ্ঞান সম্পর্কীত। এসব আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা তাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে পর্যবেক্ষন নির্ভর বিজ্ঞানের চেয়ে অনেক উঁচু স্তরের বলে দাবী করেন কিন্তু তাদের এই আধ্যাত্মিকতাকে পর্যবেক্ষন দিয়ে প্রমাণসিদ্ধ করা যাবে না বিধায় পর্যবেক্ষন নির্ভর বিজ্ঞানের সাথে সাধারনত সকল সংযোগ এড়িয়ে চলেন। তাদের বক্তব্যের সাথে পঞ্চ ইন্দ্রিয়গোচর পর্যবেক্ষণের কোন সম্পর্ক নেই। আধ্যাত্মিকতাবাদীরা আপনাকে বলবে , “চোখ বুজে শুনুন আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করুন।” এখন এই সবের একটা বিরাট বাজার থাকায় প্রচুর মানুষ কষ্ট করে আর বিজ্ঞান ও যুক্তি শিখতে চায় না ।
চিন্তাবিদ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যুক্তির প্রয়োজন হয় না। তাই শ্রদ্ধেয় হকিং সাহেবও অধিবিদ্যাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়ে বলেছেন, ” দর্শন এখন মৃত” অথবা সুপ্রিয় সহব্লগার অভিজিৎ রায়ের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে পারি ” দর্শন এখন বিবাহিত”।
@সংশপ্তক,
:hahahee:
@সংশপ্তক, এ নিয়ে একটু দ্বিমত পোষন করছি। আমার কিন্তু মনে হয় ব্যাপারটাতে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক প্রভাব থাকলেও মূল সমস্যাটা আর্থ সামাজিক। আমাকে আরেকটা তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশ ( এবং অবশ্যই সামন্ততন্ত্রের আখড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকেও এর মধ্যে জুড়ে দিতে পারেন ) দেখান যেখানে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হচ্ছে বা হয়েছে? আজকের বিশ্বের কোন গরীব দেশের অধিবাসীরা বিজ্ঞানমনষ্ক হয়ে উঠতে পেরেছে? দুই একজন বা ১% ‘ইতর টাইপের’ ধনীদের (দুঃখিত, দেশের ফালুদের মত বড় বড় ধনী রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের কথা মনে পড়ে গেল 🙂 ) দিয়ে তো একটা দেশের জনগনের চিন্তাচেতনার পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।
আমাদের দেশের প্রসঙ্গেই আসি।। আমরা হাজার বছর ধরে কৃষিকাজ করেছি যার ফলে আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক বা চেতনাগত ভিত্তিই হয়ে গেছে আধ্যাত্মিকতা। তারপর এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে আধা-সামন্ততান্ত্রিক, অনুন্নত, চরমভাবে দূর্নীতিপরায়ণ একটি সমাজ ব্যবস্থা। আরো আছে হিন্দু এবং মুসলমান ধর্মের মত ভয়াবহ মধ্যযুগীয় এবং অপরিবর্তিত দুটি ধর্মের প্রবল প্রতাপ। আজকে বিজ্ঞানের চর্চা করতে হলে যে ফ্যাসিলিটিগুলোর প্রয়োজন পড়ে সেগুলোই তো নেই আমাদের, আমাদের দেশে কি কোথাও বিজ্ঞানের কোন গবেষণা হয়? আজকের বিজ্ঞানের গবেষণাগুলো তো বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারী বা কর্পোরেট অনুদানের উপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞান তো বিমূর্ত একটা জিনিস নয়, বিজ্ঞানীরা এর চর্চা করেন এবং সেখান থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বিজ্ঞানমনষ্ক মানসিকতা গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে।
আজকে ইউরোপের অর্থনৈতিকভাবে তুলনায় উন্নততর হওয়া স্বত্তেও আমেরিকা কেন এত রক্ষণশীল এবং অ-বিজ্ঞানমনষ্ক ( ওভারঅলভাবে বলছি) তার ব্যাখ্যাও আমার মতে লুকিয়ে আছে তাদের বিশেষ আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক ভিত্তির উপরেই।
সকাল থেকেই ভাবছিলাম ধ্রুবর লেখাটায় মন্তব্য করবো কিন্তু সময় পাচ্ছিলাম না, এ নিয়ে আরো অনেক বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে। সমায়াভাবে করতে পারছি না, তাই আজকের মত এখানেই থামছি। আপনাদের উত্তরটা দেখি তারপর কালকে সময় করা আলোচনা করা যাবে।
@বন্যা আহমেদ,
এখানে লড়াইটা বিজ্ঞান বনাম অধিবিদ্যার। বৃহত্তর পর্যায়ে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মতাদর্শের চাইতে প্রকল্প বাস্তবায়ন,পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কৌশল ইত্যাদি মূল ভুমিকা পালন করে। কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিজ্ঞান নির্ভর চেতনা তাতে প্রতিফলিত হয় না। প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিজ্ঞান চর্চা কিন্তু এক জিনিষ নয় যদিও শিল্প এবং প্রযুক্তির উদ্ভাবনে বিজ্ঞানের সাহায্য নেয়া হয় ।
এখন আমাদের দেখতে হবে যে, শুধুমাত্র বিজ্ঞানমনস্কতা সরাসরি অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের ক্ষেত্রে মূখ্য ভুমিকা পালন করে কি না যেখানে বহুমূখী প্রকল্প বাস্তবায়নের মত ‘শিল্প’ জড়িত। আমাদের এটাও বিবেচনা করতে হবে যে একজন বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হতে পারেন অথবা অস্বচ্ছলও হতে পারেন। অর্থাৎ বিজ্ঞানমনস্কতা নির্ধারনে অর্থনৈতিক অবস্থান কোন মানদণ্ড নয়।
পরিশেষে, বিজ্ঞাননির্ভর মতাদর্শ বলতে বোঝায় পর্যবেক্ষনগত বিশ্লেষণনির্ভর পূর্বাভাসযোগ্যতা যা অধিবিদ্যার বিপরীত। অধিবিদ্যার চর্চা কেবল ধার্মিকদের মাঝে সীমিত নয় । বিপুল সংখ্যক অধার্মিক ব্যক্তিরাও অধিবিদ্যা চর্চা করেন যারা ‘আত্মা’ বা ‘পরমাত্মা’ কিংবা ইউটোপিয় ভাববাদে বিশ্বাস করেন । এসকল কিছুই বিজ্ঞানের নীতিমালার সম্পূর্ন বিপরীত। প্রকৃত বিজ্ঞানের চেতনার ধারকেরা আসলে জাতি রাষ্ট্র নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্বেই সংখ্যালঘু ।
@সংশপ্তক,
হা হা হা, তাহলে তো দেশে যে হারে সেল ফোনের ব্যবহার দেখে আসলাম তাতে করে আমরা অন্যতম বিজ্ঞানমনষ্ক জাতি না হয়েই যাই না। এই দুটোর পার্থক্য মনে হয় বুঝি 🙁
আপনার সাথে আমার দ্বিমতটা এখানেই। আমি মনে করি দুই একজন মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে বিজ্ঞানমনষ্ক হতে পারে, এখানে অর্থনৈতিক নির্ভরতা নাও কাজ করতে পারে। তবে আপনি যদি জাতিগতভাবে যদি বলেন তাহলে অর্থনৈতিক কাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকে পাশ্চাত্যে আপনি যে বিজ্ঞানমনষ্কতা ( অপেক্ষাকৃত বেশী) দেখেন তার পিছনে একটা অবকাঠামো কাজ করে। এই এক বিবর্তন নিয়েই আমি গত ২০-৩০ বছরে যা দেখেছি, তাতে করে এই ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। এদেশের বিজ্ঞানীরা যেভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন গনসচেতনতা তৈরি করে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের আক্রমণ থেকে বিজ্ঞানকে বাঁচাতে তা খুবই লক্ষ্যনীয়। এদের মধ্যে বেশীরভাগই কিন্তু ছিলেন গবেষণাগারে থেকে সরাসরি উঠে আসা বিজ্ঞানী। এজন্যেই আপনাকে বলেছিলাম একটা তৃতীয় বিশ্ববাসী গরীব দেশের উদাহরণ দেখাতে যেখানে বিজ্ঞান চর্চা এবং গনমানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনষ্কতা ছড়ানোর কাজ হয়।
@বন্যা আহমেদ,
ম্যাক্রো বিবেচনায় আপনার সাথে আমি একমত। বাংলাদেশ থেকে আমি পশ্চিমে চলে আসি প্রায় ৩২ বছর আগে এবং সেই আমি আর এখনকার আমির মধ্যে মৌলিক তফাৎটা গড়ে দিয়েছে এই পশ্চিমের অবকাঠামো এবং তার পুরো সুবিধা গ্রহন করায় । এটা ঠিক যে ব্যক্তি পর্যায়ে পশ্চিমে অনেকেই বিজ্ঞাননির্ভর যুক্তিবাদ চর্চা করেন না , তবে তারা মূলধারায় পাত্তা পান না। এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন। একজন মন্ত্রীকে বিবর্তনবিরোধী কোন পুস্তকের প্রকাশনা উৎসবে নেয়া পশ্চিমের যে কোন দেশে খুবই কঠিন। উন্নয়নশীল দেশের মাঝে ব্রাজিল ও চীনের শিক্ষা ও বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব অগ্রগতির পেছনে ম্যাক্রো পর্যায়ের অবকাঠামো এবং মূলধারার সাথে অধিবিদ্যার বিচ্ছেদ মূখ্য ভুমিকা পালন করছে। মুক্তমনা ব্যতীত অন্যান্য বাংলা ব্লগে চোখ বুলালে একই জিনিষ চোখে পড়ে।
@বন্যা আহমেদ,
:-/আপনার এই বক্তব্যটির ডজনখানেক স্ক্রীনশট সংগ্রহ করে রাখা হলো। যথাসময়ে আপনার উক্তিটি লাল গোল্লা দ্বারা বেষ্টিত করে, এর পেছনে দুটি বাক্য ও তেত্রিশটি ইউটিউব ভিডিও যোগ করে একটি বিনোদন পোস্ট ছাপানো হবে অন্য একটি ব্লগে। এবং যেই ব্লগে ছাপানো হবে সেই ব্লগ কিন্তু যেনো তেনো কোন ব্লগ নয়, অন্তত পাঁচ জনের অধিক সক্রিয় সদস্য রয়েছে সেই ব্লগে হু………
@আল্লাচালাইনা, আপনি তো দেখি আমার জন্য শরীয়া মতে পাথরাঘাতে মৃত্যুবরণের পথ সুগম করেই ছাড়বেন।
চমৎকার লেখা।
আতিক বাই মানুষ বালা না। এত্তা সুন্দার লেহাডারে কয় ভাল লাগে নাই? ধুর মিয়া। আমনে মোনে অয় মাদারীপুরের না। তাইলে এই সমেস্যা অইতে না। 😀 😀
লেখার ব্যাপারে আসিঃ
ঈশ্বর সম্পর্কিত প্রশ্নটা আমার কাছে আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ন মনে হয়। অর্থহীন হোক আর যাই হোক দর্শনের দৃষ্টিতে, এটার সামাজিক গুরুত্ব কিন্তু আমি বলব ব্যাপক।
অনেক ধন্যবাদ এত চমৎকার একটা লেখা আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।
@সাইফুল ইসলাম,
আমার মনে হয় আপনি বলতে চাচ্ছেন, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের সামাজিক প্রভাব বা গুরুত্ব আছে। অবশ্যই একমত। কিন্তু তার মানে কিন্তু এই না যে `ঈশ্বরের অস্তিত্বের’ সত্যমূল্য নির্ধারণের কোনো গুরুত্ব আছে। যেমন একটা হচ্ছে, যে সমাজ ডাইনিতে বিশ্বাস করে, সে সমাজে এই বিশ্বাসের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু ডাইনি সত্যি আছে কি নাই, এই প্রশ্নটা কি গুরুত্বপূর্ণ? এ কথাটিই এভাবে বলেছিলাম লেখায়:
বিশ্বাসগুলোর পর্যবেক্ষণের জগতে প্রভাব আছে, কিন্তু অস্তিত্বগুলোর নেই। তাই আমাকে যদি কেউ জিগ্গেস করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে আমার কি মত, আমি বলব প্রশ্নটি অগুরুত্বপূর্ণ, ইন ফ্যাক্ট অবান্তর। কিন্তু কেউ যদি জানতে চায় ঈশ্বরে বিশ্বাসের সামাজিক প্রভাব নিয়ে আমার কি মত, আমি বলব – ইম্পর্টেন্ট প্রশ্ন, চলেন চা খাই।
ধন্যবাদ!
@ধ্রুব,
আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনার কথা।
আবার জিগায়। 😀
লন লন বাই :coffee: :coffee:
আফাতত কফি দিয়াই চালাই। 😀
পাঠ বড়ই ক্লান্তিকর ঠেকল। আমারই সীমাবদ্ধতা। উপস্থাপনা কি আরেকটু মজাদার করা যায় না ? হয়তো এই বিষয়ে এর চেয়ে বেশি মজা হয় না। 😀 বা সবার জন্য সব মজা না। শুভেচ্ছা।
@আতিক রাঢ়ী,
নাহ। পুরোপুরি আমার দোষ। এখানে মোটামুটি এ যাবৎকালে দর্শন নিয়ে আমার সকল চিন্তা বিশ প্যারাতে লেখার একটা প্ল্যান করেছিলাম। সেটা বাস্তবায়ন করতে গিয়েই উপস্থাপনার এই বলি। ভালো উপস্থাপনা দেয়া মানে একটা প্যারা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ লেখা হয়ে ওঠা। এই লেখাটাকে সেরকম কিছুরই একটা প্রারম্ভে হিসেবে ধরে নিতে চাচ্ছি। এটাকে আমার দর্শনের সামারি ধরে নিয়ে ভিতরের অংশগুলো একে একে ব্যাখ্যায় যাওয়া যায়।
:yes:
গৌতম বুদ্ধ ;)?
দুর্দান্ত লেখা, এরকম আরো চাই :yes:
@রৌরব,
তাই নাকি? 🙂
@ধ্রুব,
অতীব গুরুত্বপূর্ন একটা বিষয়ের অবতারণা করার জন্য ধন্যবাদ জানাই। বিজ্ঞানের মুল স্তম্ভই যাচাইযোগ্য পর্যবেক্ষনগত বিশ্লেষণনির্ভর পূর্ভাবাসযোগ্যতা। এর ব্যত্যয় ঘটলে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা হতে পারি তা নিম্নের চিত্রের সাহায্যে কিছুটা হলেও প্রকাশ পায় :
[img]http://samsonblinded.org/images/head-in-the-sand.gif[/img]
@সংশপ্তক,
ওমর ভাই আর তার উট নাকি?