পূর্ববর্তী পর্বের পর …
স্বার্থপর জিন এবং বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল
রিচার্ড ডকিন্সের সেলফিশ জিন বইটির কথা আমরা আগেও বলেছি। ডকিন্স বইটি লেখেন ১৯৭৬ সালে। এটি রিচার্ড ডকিন্সের প্রথম বই এবং তার শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোর একটি। এই বইয়ের মাধ্যমেই ডকিন্স সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করলেন যে, বিবর্তন কাজ করে জিনের উপর, একক কোন জীবের উপর নয়। আমাদের দেহ যাই করুক শেষ পর্যন্ত ‘অত্যন্ত স্বার্থপর’ভাবে জিনকে রক্ষা করা আর জিনকে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দেয়াতেই উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে বাধ্য করে, বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোন থেকে জীবনের কোন ‘উদ্দেশ্য’ যদি থেকে থাকে তবে সেটাই সে উদ্দেশ্য। বইটির নাম ‘সেলফিশ জিন’ হলেও বইটির মূল লক্ষ্য ছিলো ঠিক বিপরীত। জিনগত স্বার্থপরতা থেকেই ক্রমান্বয়ে কীভাবে উদ্ভব হয় পরার্থিতার মত একটি বিপরীতমুখী অভিব্যক্তির – তা ব্যাখ্যা করাই ছিলো বইয়ের মূল উদ্দেশ্য। ডকিন্স কিন্তু নতুন কিছু লেখেননি, বরং জর্জ উইলিয়ামস এবং উইলিয়াম হ্যামিলটনের কাজ গুলোকেই জনপ্রিয় বিজ্ঞানের মোড়কে মলাটবন্দী করেছেন।তথ্যে নতুনত্ব না থাকলেও নিঃসন্দেহে নতুনত্ব আর অভিনবত্ব ছিলো উপস্থাপনায়। উইলিয়ামস এবং হ্যামিলটনের কাজ ছিলো একেবারেই কাঠখোট্টা একাডেমিক লেভেলে। ডকিন্স তাদের কাজকেই সাধারণ মানুষের দরবারে নিয়ে গেলেন একাডেমিক জার্গন সরিয়ে। আসলে এমনকি একাডেমিক স্তরেও ডকিন্সের বইটি প্রকাশের আগে এত ব্যাপকভাবে উইলিয়ামস এবং হ্যামিলটনের কাজ সম্বন্ধে কারও এতো জানাশোনা কিংবা গ্রহণযোগ্যতা ছিলো না। এই বইয়ের মাধ্যমেই আসলে জীববিজ্ঞানীরা সমাজ এবং জীবনকে ভিন্নভাবে দেখা শুরু করলেন। পরার্থিতা, আত্মত্যাগের মত যে বিষয়গুলো আগে বিজ্ঞানীরা পরিস্কার করে ব্যাখ্যা করতে পারতেন না, সেগুলো আরো বলিষ্ঠভাবে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে ব্যখ্যা করতে পারলেন তারা। ডকিন্সের বইটি প্রকাশের আগে জীববিজ্ঞানীরা পরার্থিতা এবং আত্মত্যাগকে ব্যাখ্যা করতেন গ্রুপ সিলেকশন বা দলগত নির্বাচনের মাধ্যমে। অর্থাৎ, আত্মত্যাগ ব্যাপারটি ব্যক্তির জন্য খারাপ হলেও পুরো দলের জন্য ভালো – এটাই ছিলো আত্মত্যাগের মত প্রবৃত্তিগুলো টিকে থাকার কারণ- এভাবেই ভাবতেন জীববিজ্ঞানীরা। কিন্তু ডকিন্সের সেলফিশ জিন বইটি এসে দাবার ছক একেবারেই উলটে দিলো। ডকিন্স দেখালেন যে, দলের কথা মাথায় রেখে বিবর্তন কখনোই কাজ করে না। আসলে দলগত নির্বাচন ব্যাপারটাই বিবর্তনের পরিভাষা থেকে উঠিয়ে দেয়া উচিৎ। যে ব্যাপারগুলোকে আপাতঃভাবে দলগত নির্বাচনের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে, তার সবগুলোকেই আসলে স্বার্থপর জিন তত্ত্বের মাধ্যমে আরো অনেক ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ, নির্বাচন হয় জিন লেভেলে, গ্রুপ লেভেলে নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জীববিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন নিজের জিনকে রক্ষা কিংবা যাদের সাথে জিনের নৈকট্য বেশি থাকে, তাদেরকেই রক্ষার তাগিদ প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। আর তা থেকেই ঘটে বৃহৎ স্কেলে পরার্থিতার সূত্রপাত। পিঁপড়া, মৌমাছি,উইপোকা থেকে শুরু করে বানর, শিম্পাঞ্জি কিংবা মানুষ – সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে জিনগত স্বার্থপরতা থেকেই উদ্ভব ঘটে পরার্থিতার, যা এতোদিন ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা হতো দলগত নির্বাচনের মাধ্যমে। জীববিজ্ঞানে এ এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। মানবসমাজের বিভিন্ন সামাজিক প্যাটার্ন ব্যখ্যা করার নতুন এক দুয়ার খুলে দিলো ডকিন্সের স্বার্থপর জিন তত্ত্ব। স্বার্থপর জিনতত্ত্বই দলগত নির্বাচনকে সার্থকভাবে প্রতিস্থাপন করলো উইলিয়ামস- হ্যামিলটন-স্মিথের প্রস্তাবিত স্বজাতি নির্বাচন (Kin selection) দিয়ে।
ডকিন্স তার বইয়ে দেখিয়েছেন স্বার্থপর জিন তত্ত্বের মাধ্যমে খুব সফলভাবে জীবজগতে পরার্থিতার উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করা যায়। শুধু তাই নয়, জীবগগতে সবসময়ই স্বার্থপরতা আর পরার্থিতার মধ্যে এক ধরণের ‘দড়ি টানাটানির’ খেলা চলতে থাকে। সেই টানাটানি থেকেই শেষপর্যন্ত নির্ধারিত হয় বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল (Evolutionary Stable Strategy)। কিভাবে স্থিতিশীল কৌশল জীবজগতে রাজত্ব করে, তা বাংলায় একটি চমৎকার প্রবন্ধের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন মুক্তমনা লেখক দিগন্ত সরকার[1]। দিগন্ত লেখা শুরু করেছিলেন একটি মজার উদাহরণ দিয়ে –
‘ধরা যাক মুক্তমনায় অপার্থিব আর বন্যা আমার প্রতিযোগী দুই সদস্য। এটা ভাবা খুবই স্বাভাবিক যে আমি এখন অপার্থিবের মুখোমুখী হলেই তাকে মেরে ফেলতে উদ্যত হব। কিন্তু, এমন যদি হয় যে অপার্থিব আবার বন্যারও প্রতিযোগী, তাহলে অপার্থিবকে মারলে আদপে বন্যার সুবিধাই হয়ে যাবে। বরং, বন্যা আর অপার্থিবের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্র হলেই আমার লাভ বেশী। তাই, প্রতিযোগিতার জটিল ঘূর্ণাবর্তে প্রতিযোগীদের নির্বিচারে হত্যা করাটা নির্বাচিত হবার জন্য খুব একটা ভাল কৌশল নাও হতে পারে’।
অর্থাৎ কেবল মার মার কাট কাট করলেই লাভ হবে না। কারণ ‘মার মার কাট কাট’ স্ট্র্যাটিজি অনেক সময়ই টিকে থাকার জন্য কোন ভাল স্ট্র্যাটিজি নয়। মারামারির পাশাপাশি রপ্ত করতে হবে সহযোগিতার কৌশলও। ব্যাপারটা গাণিতিকভাবেই সহজে প্রমাণ করা যায়। দিগন্ত তার লেখায় এই আকর্ষনীয় বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন ডকিন্সের বইয়ের একটি চমৎকার উদাহরণ হাজির করে।আমি কিছুটা পরিবর্তিত আকারে উদাহরণটি পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। বলা বাহুল্য, এই উদাহরণটি মূলতঃ মায়নার্ড স্মিথের দেয়া কাল্পণিক ‘Hawk and Dove’ এর ঈষৎ পরিবর্তিত উদাহরণ[2]।
ধরা যাক, একটি জীবগোষ্ঠীর মধ্যে দুই ধরণের পরষ্পরবিরোধী কৌশল অবলম্বনকারী জীব রয়েছে। প্রথমটি আগ্রাসী নীতি (আনী), আরেকটি ধান্দাবাজ-বিবাদ নীতি (ধানী)। আনীরা হচ্ছে আগ্রাসী, এরা মার মার কাট কাট। তারা সবসময় শেষ রক্তবিন্দু অবধি লড়াই করে, মৃতপ্রায় না হলে রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে না। অপরদিকে ধানীরাও বিবাদী, কিন্তু একটু ধান্দাবাজ টাইপের। এরা মারামারি না করে অন্য উপায়ে লড়াই করে। এরা ঝগড়া করে, রক্তচক্ষু দেখায়, আক্রমণের ভাব করে কিন্তু রক্তপাত করেনা।কিন্তু তারপরেও দুই ধানীতে লড়াই বাধলে শেষপর্যন্ত একজন জিতে আরেকজন হারে। এদের পার্থক্যটা অনেকটা অনেকটা ডিপ্লোম্যাট আর আর্মির পার্থক্যের মত। আনীর সাথে ধানীর লড়াই হয়না, কারণ ধানী পালিয়ে যায়। কিন্তু দুই আনীর লড়াইতে সর্বদা কোনো না কোনো একজন মারা যায় (বা গুরুতর আহত হয়)।
এবারে লড়াইয়ের কৌশলটি গাণিতিকভাবে হিসেব করা যাক। হিসাবের সুবিধার্থে আমরা ধরে নিব, কোনো জীবই জীবদ্দশায় তার কৌশল বদলায় না, এবং এমনকি প্রতিযোগিতার শুরুতে একে অন্যের কৌশল সম্বন্ধেও অবগত থাকে না। আমাদের এই মডেলের কাল্পনিক পয়েন্ট সিস্টেমে ধরা যাক :
প্রতিযোগিতায় জিতলে ৫০ পয়েণ্ট,
প্রতিযোগিতায় হারলে ০ পয়েন্ট,
সময় নষ্টের জন্য -১০,
গুরুতর আহত হলে -১০০ পয়েন্ট বরাদ্দ করা হলো।
– জিনের নির্বাচনের সম্ভাবনার সাথে মিল রেখেই এরকম পয়েন্ট সিস্টেম।
আমরা হিসাব করতে চাই যে এদের মধ্যে কোন্ কৌশলটি (বা এদের কোনো সংমিশ্রণ) স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
মনে করা যাক, জীবগোষ্ঠীর সব জীবই প্রথমে ধানী (ধান্দাবাজ বিবাদী নীতি) ছিলো। তাহলে তাদের মধ্যে প্রতিটি প্রতিযোগিতায়, একজন জেতে (+৫০), একজন হারে (০); আর দুজনেই সময় নষ্ট করে (-১০x২ = -২০), কিন্তু কেউই আহত হয় না। সমষ্টিগতভাবে লাভ হয় ৩০ পয়েন্ট, প্রত্যেকের ভাগে যায় ১৫ পয়েন্ট করে। এবার ধরা যাক একটা আনী (আগ্রাসী নীতি) জীব হঠাৎ এসে হাজির হল এই গোষ্ঠীতে। সে ধানীদের সহজেই লড়াইতে হারিয়ে দেবে, প্রতি যুদ্ধে +৫০ পয়েণ্ট হাসিল করবে। তার ফলে তার আগ্রাসী জিন খুব সহজেই জীবগোষ্ঠীতে বিস্তার লাভ করবে। বিস্তার লাভ করতে করতে, ধরা যাক, একটা সময় পরে জীবগোষ্ঠীতে ধানীদের সংখ্যা একেবারেই কমে যাবে আর গোষ্ঠীর প্রায় সবাই আনী হয়ে যাবে। এখন স্বভাবতই দুই আনীতে লড়াই বাধবে। দুটি আগ্রাসী জীবের লড়াইয়ে প্রত্যেকে গড়ে -২৫ পয়েণ্ট পায় (জেতায় +৫০, আর গুরুতর আহত হওয়ায় -১০০)। একটি বিবাদী সেই দলে থাকলে সে সব লড়াইতে হারে, কিন্তু গড়ে সে ০ পয়েণ্ট পায় (আগের গণনা থেকে )। -২৫ পয়েণ্ট এর চেয়ে ০ পয়েন্ট অনেক ভাল। +৩৫ পয়েন্টের সুবিধা থাকায় সহজেই ধানী কৌশল নিয়ন্ত্রক জিন জনপুঞ্জে বিস্তার লাভ করতে থাকবে।
এতদূর পর্যন্ত গল্পটা শুনে মনে হতে পারে যে জীবগোষ্ঠীতে সবসময় এই দুই কৌশলের জীবেদের মধ্যে একটা বাড়াকমা চলবে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা অংক কষে দেখেছেন যে ধানী আর আনীদের অনুপাত ৫:৭ অনুপাতে পৌঁছলে সমাজ স্থিতিশীলতা লাভ করবে! মানে, ওই অনুপাতে পৌঁছনর পরে প্রতিটি আগ্রাসী (আনী) আর প্রতিটি ধান্দাবাজ বিবাদী (ধানী)র গড়পরতা লাভ-ক্ষতির তুলনামূলক হিসাব মিলে যায়। অর্থাৎ ধানী : আনী = ৫:৭ হয়ে গেলে নির্বাচনে আর কেউই অন্যের তুলনায় সুবিধা পায় না। এই অনুপাতই এক্ষেত্রে বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল (Evolutionary stable strategy )।
স্থিতিশীল কৌশল কেবল আনী-ধানীর ক্ষেত্রেই নয়, চমৎকারভাবে কাজ করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মানব সমাজে নারী পুরুষের অনুপাত থাকে ১০০ : ১০৫ অনুপাতে। ক্রীড়াতত্ত্বের সাম্যাবস্থার জন্যই এটি ঘটে। রিচার্ড ডকিন্স তার সেলফিশ জিন বইয়ের ‘ব্যাটেল অব সেক্স’ অধ্যায়ে উপরের আনী-ধানীর মতোই নারীপুরুষের মধ্যে প্রতারণা এবং বিশ্বস্ততা নিয়েও একটি সরল ‘গেম থিওরীর’ অবতারণা করে দেখিয়েছেন যে, সেখানেও দড়িটানা টানির একটা খেলা চলে, ফলে পূর্ণ বিশ্বস্ত নারী-পুরুষে ভর্তি সমাজ যেমন আমরা পাইনা, তেমনি এমনো পাইনা এমন সমাজও যেখানে সবাই অবিশ্বস্ত। বরং সমাজে দেখা যাবে- বিশ্বস্ততা এবং প্রতারণা রাজত্ব করে একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে যা শেষ পর্যন্ত বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল বা Evolutionary stable strategy তৈরি করে।
একই ধরণের মডেল তৈরি করা যায় সত্যবাদী আর মিথ্যাবাদীদের মিথস্ক্রিয়ার মধ্যেও। বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশলের কারণেই পরিপূর্ণ সত্যবাদী সমাজ যেমন আমরা পাই না, ঠিক তেমনি এমন সমাজও আমরা পাব না যেখানে সবাই মিথ্যা কথা বলছে। এমনকি একই মানুষের মধ্যেও দেখা যাবে কারো পক্ষেই জীবনের সবসময় সত্য কথা বলা যেমন সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি সম্ভব নয় সর্বদা মিথ্যে কথা বলাও। পদার্থবিদ হাইন্য পেগেল্স তাঁর ‘‘যুক্তির স্বপ্ন” বইয়ে এজন্যই বলেছেন[3] –
“জটিলতার নতুন বিজ্ঞান আর কম্পিউটারের প্রতিরূপ (মডেল) তৈরির মাধ্যমে আমরা মূল্যবোধ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছি, যা আগে কখনোই সম্ভব ছিলো না। নৈতিকতা নিয়ে বিতর্কের সুরাহা করতে না পারুক, বিজ্ঞান অন্ততঃ মডেলের সাহায্যে ব্যাপারগুলোর একটা যৌক্তিক কাঠামো তৈরি করতে পারে। একটা উদাহরণ নেয়া যাক। যেমন মিথ্যা বলা। আমরা সত্যবলাকে একটা পুণ্য বলে মনে করি আর মিথ্যা বলাকে পাপ হিসেবে গণ্য করি। এখন একটি সমাজ কল্পণা করি – যেখানে সবাই সর্বদা সত্য কথা বলছে। এখন সেই সমাজে কোন এক মিথ্যেবাদী এসে হাজির হল (অনেকটা উপরের ধানী সমাজে আনীর আগমনের মতো)। এখন সত্যবাদী সমাজে এরকম একজন মিথ্যা বললে তার বিপুলভাবে লাভবান হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু এই সম্ভাবনা সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষার জন্য সহায়ক নয়। অপরদিকে যে সমাজে সবাই সর্বদা মিথ্যা বলে, সেই সমাজও বেশিদিন স্থিতাবস্থায় থাকতে পারে না এবং একসময় ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। সবচেয়ে স্থিতাবস্থার দশা হল যখন সবাই অধিকাংশ সময় সত্য বলে কিন্তু মাঝে মধ্যে মিথ্যা বলে, যা বাস্তব জগতে দেখা যায়। এক অর্থে বলা যায় যে আমাদের মধ্যে যারা মিথ্যাবাদী তারাই আমাদের বাকি সবাইকে সত্যবাদী ও সতর্ক থাকতে সহায়তা বা বাধ্য করে। মিথ্যাকথনের এই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আমরা কেন মিথ্যা বলি সেটা বুঝতে আমাদের সাহায্য করতে পারে।’’
ক্রীড়াতত্ত্ব এইরকম বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে সমর্থন দেয়, শুধু জীববিজ্ঞানে নয়, বিজ্ঞানের নানা শাখাতেই। যেমন অর্থনীতি নিয়ে যারা পড়াশুনা করেছেন তারা জানেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তথা বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে, গেম থিয়োরী প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করে। প্রথমে কোন দ্রব্যের মনোপলি বাজার থাকলে দ্রব্য প্রস্তুতকারীর একচেটিয়া মুনাফা থাকে। দ্রব্যের দামও হয়তো বসাতে পারে ইচ্ছেমতো। কিন্তু একটা সময় পরে অন্য প্রতিযোগীরাও একই দ্রব্য তৈরিতে নেমে পড়লে কারো একতরফা মুনাফা থাকে না। দ্রব্যের মূল্য নির্ধারিত হয় গেম থিয়োরীর মাধ্যমে বোঝাপড়ার নিরিখে। আবার কোনো ব্যবসায়ী একই দ্রব্য কমদামে বিক্রি শুরু করলে তার সাময়িকভাবে লাভ হয় বটে, কিন্তু তার অন্য প্রতিযোগীরাও সাথে সাথেই দাম কমিয়ে ফেললে তার আখেরে অনেক লোকসানই হবে। তাই শেষমেষ নিজেদের মধ্যে এক ধরণের বোঝাপড়ার মাধ্যমে বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রিত হওয়া শুরু করে। স্বার্থপরতা আর পরার্থিতাও ঠিক একইভাবে কাজ করে। তারা মিলেমিশে এক হয়ে থাকে ক্রীড়াতত্ত্বের দড়ি টানাটানির মাঝখানে। চীনের অধিবাসীদের অনেকেই ইন এবং অ্যান (Yin and yang)নামক দুই পরষ্পরবিরোধী শক্তিতে বিশ্বাস করে। তারা মনে করে মানুষ সহ সবকিছুই আসলে ইন এবং অ্যান-এর সুষম মিশ্রণ। শুধু চীনারা কেন, আমরাও ছোটবেলেয় স্কুলে ভাব সম্প্রসারণ করতে গিয়ে শিখেছিলাম – শুভ এর জন্যই অশুভের দরকার, কিংবা আলোর জন্যই অন্ধকারের প্রয়োজন। নিরঙ্কুষ সত্যবাদী সমাজ তৈরির মতো প্রদীপ জ্বেলে আঁধার দূর করার চেষ্টা হলেও দেখা যায় – প্রদীপের নীচেই থেকে যাচ্ছে গাঢ় অন্ধকার। ঠিক একইভাবে বলা যায়, আমরা পরার্থিতার যতোই বিজয় কেতন উড়াই না কেন, স্বার্থপরতাকে বাদ দিয়ে তা সম্ভব নয়। প্রদীপের অন্ধকারের মতোই তা নীচের স্তরে থেকে যাবে। কারণ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন পরার্থিতার মূল উৎস আসলে স্বার্থপর জিনের উপস্থিতির কারণেই। ক্রীড়াতত্ত্বের আধুনিক মডেলগুলো যেন তারই বাস্তব প্রতিধ্বনি। সেজন্যই ম্যাট রিডলী তার ‘নৈতিকতার উদ্ভব’ বইয়ে বলেন[4] –
Cooperation was first used, not for virtuous reasons, but as a tool to achieve selfish results. And if we are to celebrate the unusually cooperative result of the societies, we must first recognize the base metal from which it was forged.
এই স্বার্থপরতার উপস্থিতির কারণেই কিভাবে পরার্থিতার উদ্ভব ঘটে তা আরো স্পষ্ট হবে নীচের কিছু উদাহরণে।
ইট-পাটকেল এবং পিঠ চুলকোচুলকির খেলা
জীবজগতে গেম থিওরী এবং বিবর্তনীয় স্থিতিশীল তত্ত্ব কিভাবে কাজ করে তা না হয় জানা গেল। কিন্তু একটি জীব কি করে বুঝবে কখন তাকে স্বার্থপর হতে হবে,আর কখন পরার্থ? কিভাবে বুঝবে কখন সত্যবাদী যুধিষ্ঠির সাজতে হবে, আর কখন হতে হবে বিশ্বাসঘাতক বিভীষণ? এর উত্তর পাওয়া গেছে দুই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী রবার্ট এক্সেলরড (Robert Axelrod) এবং রবার্ট ট্রাইভার্স (Robert Trivers)-এর পৃথক দুটি গবেষণায়। দু’জন বিজ্ঞানী আলাদা দুটি তত্ত্ব দিয়েছেন। নামে আলাদা হলেও তত্ত্বের বিষয়বস্তু মোটামুটি একই। তুমি আমার পিঠটি চুলকালে আমিও এক সময় তোমার পিঠটি চুলকে দিব। আর তুমি ইট মারলে আমিও দেব পাটকেলটি মেরে। কাজেই বাপু যা করবে – বুঝে কোর। এই হল তত্ত্বদুটির মোদ্দা কথা।
ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হবে – এই তত্ত্বের ইংরেজী ‘টিট ফর ট্যাট’ (Tit for tat)। এটি দিয়েছেন এক্সেলরড। আর রবার্ট ট্রাইভার্সের ‘পিঠ চুলকাচুলকি’ সংক্রান্ত তত্ত্বের নাম – বিনিময়ী পরার্থিতা (Reciprocal Altruism)। দুটি তত্ত্বই ইঙ্গিত করছে- অতীতে আমার প্রতি তুমি কী আচরণ করেছ সেটা মনে করে আমি তোমার প্রতি আচরণ করব। ভাল আচরণ করে থাকলে আমার থেকেও ভাল আচরণ পাবে, আর ঝামেলা করে থাকলে আমার দিক থেকেও তাই পাবে।কাজ কর্মে এক হলেও তত্ত্ব দুটিতে সূক্ষ কিছু পার্থক্য থেকে গেছে। টিট ফর ট্যাট ঘটে একই প্রজাতিতে। এক ভার্ভেট বানর ক্ষিদার সময় আরেক বানরকে কলা দিলে, সেই বানরও পরবর্তীতে কলা দিয়ে প্রথম বানরকে সাহায্য করবে। শিকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হবার মুহূর্তে কোন পরোপকারী বানর বন্ধু যদি চীৎকার করে সতর্ক করে দেয়, তবে পরোপকারী বানরটি কখনো বিপদে পড়লেও ঠিক একইভাবে সেই আক্রান্ত বানরটি চীৎকার করে তাকে বিপদে সাহায্য করবে। টিট ফর ট্যাট বিদ্যমান থাকে একই প্রজাতির মধ্যে। বানর কেবল চীৎকার করে সতর্ক করবে আরেকটি বানর বিপদে পড়লেই, কোন খরগোশ বিপদে পড়লে নয়। আর তাদের সাহায্যের ধরণও একই ধরনের হবে। কলার বিনিময়ে কলা, কিংবা চীৎকারের বিনিময়ে চিৎকার। অন্য কিছু নয়। কিন্তু অন্য দিকে রেসিপ্রোকাল অলট্রুইজম বা বিনিময়ী পরার্থিতার ক্ষেত্রে পরার্থিতা প্রজাতির স্তর অতিক্রম করে যায়। এক প্রজাতি অন্য প্রজাতিকে সহায়তা করে। আমরা আগে আমরা আগে ক্লাউন মাছ আর এনিমোন, হামিং বার্ডের সাথে অর্নিথোপথিলাস ফুলের, কিংবা এংরাকোয়িড অর্কিডের সাথে আফ্রিকান মথের সহবিবরতনের উদাহরণের সাথে পরিচিত হয়েছি যেগুলো প্রজাতির স্তর অতিক্রম করে পরার্থিতার বিকাশ ঘটিয়েছে। সাহায্যের ধরণও ভিন্ন হতে পারে। আমি পুজা উপলক্ষে প্রতিবেশীকে পায়েশ পাঠলে, প্রতিবেশীও যে পায়েশই পাঠাবে তা নয়, হয়তো ঈদের দিন পাঠাবে কোরমা – এই ধরণের!
ইট-পাটকেল তথা টিট ফর ট্যাট তত্ত্বের উদ্ভবটা বেশ মজার। আশির দশকের প্রথমভাগে কম্পিউটারের শক্তি বাড়তে শুরু করেছে হু হু করে। পার্সোনাল কম্পিউটারও বাজারে আসতে শুরু করেছে। এই সময় রবার্ট এক্সেলরড নামের এক তরুণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর শখ হল কম্পিউটারের সাহায্যে আসামীর সঙ্কটের একটা সিমুলেশন পরীক্ষা করবেন। তিনি একটি মজার প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন যেখানে প্রতিযোগীরা আসামীর সংকট সমাধানের জন্য একটা ভাল এলগরিদম সাবমিট করবে। প্রায় দুশবার একে অপরের মধ্যে ক্রমান্বয়ে খেলা চলবে।এর মধ্যে যার পয়েন্ট সবচেয়ে বেশি হবে সেই এলগোরিদমই বিবেচিত হবে শ্রেষ্ঠ হিসেবে। চোদ্দজন প্রতিযোগী সেই প্রোগ্রামিং এর খেলায় অংশ নেন – তারা সহজ সরল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জটিল জটিল এলগোরিদম সাবমিট করলেন। এনাতল র্যাপোর্ট (Anatol Rapoport) নামে এক তরুণ প্রোগ্রামারের এলগোরিদম সর্বোচ্চ পয়েন্ট পেয়ে জয়লাভ করল – আর সেই প্রোগ্রামের স্ট্র্যাটেজি ছিলো সবচেয়ে সরল – সেই টিট ফর ট্যাট। প্রথমে সহযোগিতা করে সে খেলা শুরু করবে, আর মনে রাখবে তার প্রতিপক্ষ ঠিক কি করেছিলো তার সাথে – সহযোগিতা নাকি বিরোধিতা। প্রতিপক্ষ সহযোগিতা করে থাকলে সেও সহযোগিতা করবে, আর বিরোধিতা করলে সেও করবে বিরোধিতা। এভাবেই এগুতে থাকবে। এভাবেই সে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট অর্জন করে প্রথম স্থানে পৌঁছিয়ে গেল। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই বেরিয়ে এলো যে, টিট ফর ট্যাট – বা ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয় – এইটিই আসামীর সংকট মোকাবেলার জন্য সর্বোত্তম সমাধান।
কয়েক বছর পরে রবার্ট এক্সেলরড আবারো আরেকটি টুর্নামেন্টের আয়োজন করলেন টিট ফর ট্যাট আলগোরিদমকে কেউ হারাতে পারে কিনা সেটা পুনর্বার পরীক্ষা করার জন্য। এবারেও শীর্ষস্থান অধিকার করে বসে রইলো সেই আদি অকৃত্রিম টিট ফর ট্যাট!তিনি ১৯৮১ সালে বিষয়টি ফোকাস করে হ্যামিলটনের সাথে মিলে সায়েন্স পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লেখেন ‘দ্য ইভোলুশন অব কোঅপারেশন’ নামে[5], এবং বছরখানেক পরে একটি বই লেখেন সেই একই শিরোনামে[6]। এভাবেই টিট ফর ট্যাট অ্যালগরিদম বিবর্তনীয় গেম থিওরীর এক রাজকীয় স্থান অধিকার করে নিলো।
রক্তচোষা বাদুড়দের কথা
খাতায় কলমে আর কম্পিউটার সিমুলেশনে না হয় ইট-পাটকেল তথা টিট ফর ট্যাট এক বাস্তব সমাধান হিসেবে হাজির হল, কিন্তু কথা হচ্ছে প্রকৃতিতে কি আসলেই ইট-পাটকেল কিংবা বিনিময়ী পরার্থিতার প্রয়োগ দেখা যায়, নাকি এগুলো কেবলই কিছু আঁতেলেকচুয়াল বিজ্ঞানীদের অলস মস্তিষ্কের প্যাচপ্যাচানি?
এর উত্তর পাওয়া গেলো ১৯৮৩ সালে ভ্যাম্পায়ার বাদুড় নিয়ে জীববিজ্ঞানী গেরাল্ড উইলকিনসনের (Gerald Wilkinson)একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায়। ভদ্রলোক কোস্টারিকায় এই বাদুড়দের নিয়ে অনেকদিন ধরেই রিসার্চ করছিলেন। এই সমস্ত বাদুড়েরা খুবই অদ্ভুত। বাদুড়দের অন্য প্রজাতিদের মত এদের ফলমূলে কোন রুচি নেই। এদের আহার হল কেবল তাজা রক্ত। এরা গাছের ডালে ঝুলে থাকে আর অপেক্ষা করে থাকে কোন ঘুমন্ত স্তন্যপায়ী জীবের গা থেকে রক্তপানের জন্য। তারপর গভীর রাত্রিতে বের হয় শিকারের সন্ধানে। নিঃসন্দেহে এ ভাবে খাদ্য সংগ্রহের ব্যাপারটি বাদুড়দের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর বহুসময়ই তারা পর্যাপ্ত আহার যোগাড় করতে পারে না। কারণটি বোঝা কঠিন কিছু নয়। খাবার মানে রক্ত সংগ্রহের জন্য শিকারকে জায়গা মতো পেতে তো হবে, আর যার দেহ থেকে রক্ত যোগাড় করতে যাচ্ছে, সেই বা রাজি থাকবে কেন। টের পেয়ে বাধা দিলে তো আর রক্ত খাবার উপায় নেই। জান নিয়ে পালানোটাই তখন বুদ্ধিমানের কাজ। সেজন্য দেখা যায় এই বাদুড়েরা অনেক সময়ই দুই তিন দিন পর্যন্ত অভুক্ত থেকে যায় কোন কিছু যোগাড় না করতে পেরে। পঞ্চাশ -ষাট ঘন্টা না খেয়ে থাকার পর তাদের বাদুড়দের কী অবস্থা হয় তা বোধহয় সহজেই অনুমেয়।
সৌভাগ্যক্রমে এই দূরাবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটা রাস্তা তারা নিজেরাই বাতলে নিয়েছে। তারা যখন খাবার পায় তখন তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেয়ে নেয়। রক্ত খেয়ে একেবারে পেট ফুলিয়ে বসে থাকে। কিন্তু পেট ফুলায় এমনি এমনি না। তারা গোত্রের অভুক্ত বাদুড়দের রক্ত খাইয়ে সাহায্য করে। তারা পরার্থতা প্রদর্শন করে সমগোত্রীয়দের প্রতি। তারা এই পরার্থতাপরায়ণ সামাজিক আচরণের মাধ্যমেই সফলভাবে টিকে থাকে।
মজার ব্যাপার হলো বাদুড়দের সবাই যে নিঃস্বার্থ তা কিন্তু নয়। তাদের মধ্যে অনেকে পেট ফুলিয়ে রক্ত খাওয়ার পরেও এমন ভান করে যে সে খায়নি। পরার্থপরায়ণ এই বাদুড় সমাজে কোন বাদুড়কে যদি বিপদের সময় কাউকে রক্তপান না করাতে হয়, কিন্তু নিজে বিপদে পড়লে যদি কেউ না কেউ তাকে খেতে দেয়, তাহলে সে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। আবার অন্যদিকে এমন যদি হয় যে কোন বাদুড় কারো বিপদের সময় অন্যকে রক্ত খাইয়ে সাহায্য করছে, কিন্তু নিজে বিপদে কেউ তাকে খাওয়াতে এগিয়ে আসছে না – তা হলে সে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
চিত্র: ভ্যাম্পায়ার বাদুড় নিয়ে জীববিজ্ঞানী গেরাল্ড উইলকিনসনের গবেষণায় দেখা গেছে যে,তারা ইট-পাটকেল আর বিনিময়ী পরার্থতাপরায়ণতা প্রদর্শন করে একে অন্যকে সাহায্য করে।
এই ডাইনামিক্স-এর ধরণটা আসামীর সংকটের আলোকে বুঝার চেষ্টা করা যাক। নিঃসন্দেহে কোন বাদুড়ই চাইবে না ক্ষতির বোঝা বাড়াতে, বরং বাদুড় সমাজে ‘অতি চালাক’ এমন কেউ না কেউ থাকবে যে ধোঁকাবাজি করে সবচেয়ে বেশি লাভবান থাকতে চাইবে। অর্থাৎ এ সমস্ত বাদুরেরা রক্ত খেয়ে এসে মুখ টুখ মুছে এমনভাবে চলাফেরা করবে যে তারা রক্ত খায়নি; ফলে অন্য কাউকে তার রক্ত খাওয়াতে হবে না। সত্যই এরকম কিছু বাদুড় দেখা যায় গোত্রে। যারা চালাকি করে প্রতারণার পথ নেয়। কিন্তু অতি চালাকের গলায় দড়ি পড়তে সময় লাগে না। তার ফোলা পেটের ধরণ দেখেই অন্য অভিজ্ঞ বাদুর সদস্যদের কেউ কেউ বুঝে ফেলে ব্যাটা ‘সাধু বেশে পাকা চোর অতিশয়’। ফলে তাকে একঘরে করে ফেলা হয়, কেউ তাকে তার বিপদের সময় রক্ত খেতে দিয়ে সাহায্য করে না। মূলতঃ বাদুড়েরা তাদের নিজেদের মধ্যে খেলতে থাকে ‘ইট-পাটকেল’ বা ‘টিট-ফর ট্যাট’-এর মায়াবী খেলা – কেউ তাকে রক্ত খেতে দিলে সেও তার বিপদে নিজের ভাগের রক্ত খেতে দেয়। কিন্তু কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সেও প্রত্যাখ্যান করে। এভাবেই ইট-পাটকেল এবং বিনিময়ী পরার্থিতা নীতি বাদুড় সমাজে রাজত্ব করে চলে অত্যন্ত সফলভাবে[7]।
এই সমস্ত রক্তচোষা বাদুরদের মত আফ্রিকান ভার্ভেট বানরদের মধ্যেও কিন্তু বিনিময়ী পরার্থতা দেখতে পাওয়া যায়। সেখানেও বানর সদস্যরা টিট ফর ট্যাটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয় অপর বানরকে সাহায্য করা হবে নাকি প্রতাখ্যান করা হবে। যদি অতীতে সাহায্য পেয়ে থাকে কারো কাছ থেকে, বিপদের সময় তাকে সাহায্য করে। আর যদি উল্টোভাবে সাহায্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়, তবে বিপদের সময় তাকেও কাঁচকলা দেখিয়ে দেয়া হয়। এই ইট-পাটকেলের পাশাপাশি স্বজাতি নির্বাচনও খুব জোড়ালোভাবে কাজ করে ভার্ভেট বানরদের মধ্যে। শুধু জোড়ালো বললে ভুল হবে, স্বজাতি নির্বাচনের সম্পর্ক অনেক সময় ছাপিয়ে যায় ইট-পাটকেল এবং বিনিময়ী পরার্থপরায়ণতাকেও। যেমন, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, দুই বানরের মধ্যে যদি রক্তের সম্পর্ক থাকে তাহলে অতীতে সাহায্য পাক না পাক, তার বিপদে অন্য সদস্য সাহায্য করে। অর্থাৎ রক্তের সম্পর্ক ছাড়িয়ে যায় ইট-পাটকেলের খেলাকে। মা বানর তার শিশু বিপদে পড়লে এমনিতেই সাহায্য করে, কোন কিছুর বিনিময়ের দাবীতে নয়। ঠিক একই ব্যাপার ঘটে ভাই বোনদের মধ্যেও। কিন্তু রক্তের সম্পর্কের বাইরে কাউকে সাহায্য সহযোগিতার প্রশ্ন আসলে সেই ইট-পাটকেলেরই শরণাপন্ন হয় সবাই। সাধে কি আর বলে – Blood is thicker than water!
ভ্যাম্পায়ার বাদুর আর ভার্ভেট বানরের ক্ষেত্রে যা দেখা গেলো সেরকম ব্যাপার তো মানুষের জন্যও খাটে, তাই না? বিপদের সময় কারো কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে থাকলে আমরাও প্রাণপণে সেটা শোধ করে দিতে চেষ্টা করি। আর বিশ্বাসঘাতক কিংবা কৃতঘ্ন লোকজনকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। এ ধরণের লোককে অনেকসময় সামাজিকভাবেও একঘরে করে ফেলা হয়। এটা কিন্তু ঘুরেফিরে উপরের টিট ফর ট্যাট আর রেসিপ্রোকাল অল্ট্রুইজমেরই প্রতিফলন। আবার, ভার্ভেট বানরদের মতো মানব সমাজেও দেখা যায় এই টিট ফর ট্যাট নীতিকে বহু সময়ই অতিক্রম করে যায় স্বজাতি নির্বাচন তথা রক্তের সম্পর্ক। ছেলে মেয়ে বিপদে পড়লে ‘রক্তের টান’ই মূখ্য হয়ে উঠে ইট-পাটকেলের চেয়ে। বিপদ থেকে সন্তানকে রক্ষার চিন্তাই প্রাধান্য পায় তখন।অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভার্ভেট বানরের মধ্যে স্বজাতি নির্বাচনের সম্পর্ক যেভাবে অনেক সময় ছাপিয়ে যায় ইট-পাটকেল এবং বিনিময়ী পরার্থপরায়ণতাকে, ঠিক সে ধরনের প্যাটার্ণ কাজ করে মানব সমাজেও।
বিজ্ঞানীরা আরো দেখেছেন, ইট-পাটকেল আর বিনিময়ী পরার্থতার খেলা ভাল জমে যদি সদস্যরা খুব ‘ক্লোজড কমিউনিটি’তে বাস করে। ভার্ভেট বানরেরা আর ভ্যাম্পায়ার বাদুড়েরা দীর্ঘদিন ধরে একই জায়গায় বাস করে একই সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাই তাদের মধ্যে সহজাতভাবেই এক ধরণের সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠে।ব্যাপারটা মানব সমাজের জন্যও ঠিক একইভাবে প্রযোজ্য। আমরা প্রায় সময়ই অনেকের মুখেই বলতে শুনি যে, শহরের লোকেরা অনেক বাটপার, তার তুলনায় গ্রামের লোকেরা অনেক ভালো – সহজ সরল। আসলে এটার কারণ হলো, গ্রামের লোকেরা একটা ক্লোজড কমিউনিটিতে বাস করে।সেখানে সবাই সবাইকে চেনে, আর প্রায়ই হাটে মাঠে একে অপরের সাথে দেখা হয়ে যায়। ফলে কারো পক্ষে বাটপারি কিংবা চুরি চামারি করে খুব বেশি সুবিধা সেখানে পাওয়া সম্ভব নয়।কিন্তু ঢাকা শহরের মত জায়গায় যেখানে লক্ষ লোকের বাস, সেখানে একজন বাটপার জানে যে, আজকে বাসে একটি অপরিচিত লোকের পকেট মেরে দিলে পরের দিন তার সাথে দেখা হবার সম্ভাবনা একেবারেই কম। তাই গ্রামের চেয়ে শহরে ছিনতাইকারী, পকেটমার, চোর ছ্যাচর বেশি দেখা যায়, মানুষ আক্রান্তও হয় তুলনামুলক বেশী। এটাও ক্রীড়াতত্ত্বের সিমুলেশনেরই একটি বাস্তব ফলাফল।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট এক্সেলর্ড তার ‘সহযোগিতার বিবর্তন’ বইয়ে টিট ফর ট্যাটের একটি বাস্তব উদাহরণ হাজির করছেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সৈন্যরা বেলজিয়াম দখল করে নেয়। স্বভাবতই পশ্চিমা শক্তি (western front) আর অক্ষশক্তির মধ্যে শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ আর সঙ্ঘাত। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, এই সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতিতেও একটা সময় পরে দেখা গেল, রেলজিয়ামের একটি পরিখার দুই পাশে জার্মান সৈন্য আর পশ্চিমা শক্তির (ফ্রান্স এবং বেলজিয়াম) কিছু ট্রুপের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমরা আগের কিছু উদাহরণে দেখেছি যে, দীর্ঘদিন ধরে একই জায়গায় বাস করতে থাকলে সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতার পাশাপাশি সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠে।আসামীর সংকট থেকে উদ্ভুত টিট ফর ট্যাটের কারণেই এটি ঘটে। রবার্ট এক্সেলর্ডের মতে, ঠিক একই কারণে বেলজিয়ামের একটি পরিখার দুই পাশে অবস্থিত দুই বিরোধীপক্ষের সৈন্যদের মধ্যে এক ধরণের সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। কারণ একই জায়গায় দুই দলের সৈন্যদের একই ট্রুপকে বেশ কয়েকবার একে অপরের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। প্রাথমিক সময়গুলোতে সঙ্ঘাত আর সংঘর্ষ চললেও একটা সময় পরে গেম থিওরীর নিয়মেই ‘আসামীর সংকটের’ মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। তারা পারতপক্ষে শত্রুদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতো না, অতর্কিতে পেছন থেকে আক্রমণ করে জয়লাভের চেষ্টা করতো না, কিংবা যত কম হত্যাকাণ্ডের মধ্যে নিজেদের নিয়োজিত রাখা যায়, তার সর্বাত্মক চেষ্টা করতো। বিনিময়ে তারা প্রত্যাশা করতো যে শত্রুপক্ষও প্রতিদানে তাদের প্রতি অনুরূপ ব্যবহার করবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছিলো যে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছিলো। এমনি শত্রুপক্ষ খুব সহজ নিশানায় কাউকে পাওয়ার পরেও গুলি করেনি কিংবা ভুল দিকে গুলি ছুঁড়েছে –এমন দৃষ্টান্তও আছে। টনি এশওয়ার্থ সহ অনেক ইতিহাসবিদই ব্যতিক্রমী ব্যপারটি উল্লেখ করে বই লিখেছেন। স্বার্থের কারণে ঘোর শত্রুদের মধ্যে আপাতঃ সমঝোতার ব্যাপার কিন্তু রণক্ষেত্রের ইতিহাসে অনেক পাওয়া যায়। এমনি একটি উদাহরণ ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘটা ‘মলোটোভ-রিবেন্ট্রোপ’ চুক্তি (কমিউনাৎসী চুক্তি হিসেবে কুখ্যাত), যার ফলশ্রুতিতে নাৎসী জার্মানী আর স্ট্যালিনিস্ট রাশিয়ার মধ্যে একধরণের সমঝোতা স্থাপিত হয়।
চিত্রঃ ১৯৩৯ সালের ২৩ শে আগাস্ট – ‘মলোটোভ-রিবেন্ট্রোপ’ চুক্তির দৃশ্য
এই সমঝোতার ফলশ্রুতিতে নাৎসী জার্মাণ সৈন্যরা পোল্যাণ্ডের একাংশ নিরাপদে অধিকার করে নেয়, আর অন্য অংশ স্ট্যালিনিস্ট রাশিয়া দ্বারা অধিকৃত হয়। পিসা, নারেভ, ভিস্টুলা আর সান নদীর অববাহিকার কিয়দংশ রাশিয়ার ভাগে পড়ে, আর পশ্চিমাংশ থাকে জার্মানীর পদতলে। জার্মানী ফ্রান্স অধিকার করে নেয়, লিথুনিয়া এবং পশ্চিম প্রুসিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকে, আর অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়া থাবা বসায় পূর্ব ফিনিল্যাণ্ড, এস্টোনিয়া আর লাটভিয়ার উপর। নিঃসন্দেহে মানবেতিহাসের প্রেক্ষাপটে স্বার্থপর সহযোগিতার (কিংবা সঠিকভাবে বললে দুই স্বার্থপর রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যকার সহযোগিতা) নির্জলা সত্য এটি। মানুষের জন্য ‘স্বার্থপর সহযোগিতার’ ব্যাপারটি আমাদের অনেকের মধ্যেই অস্বস্তি তৈরি করলেও জীবজগতে এ ধরণের সহযোগিতার উদাহরণই দৃশ্যমান। বেবুনদের মধ্যে গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, দুই পুরুষ বেবুনের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠে নারী বেবুনের দখল নিতে গিয়ে অপর কোন শক্তিশালী বেবুনকে বিতারিত করতে[8]। এই সহযোগিতার চুক্তি অনেকটা ‘মলোটোভ-রিবেন্ট্রোপ’ চুক্তির মতোই হয় সাময়িক[9]। হিটলার যেমন চুক্তি ভেঙ্গে এক সময় সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ঠিক তেমনি বেবুন সমাজেও শক্তিশালী বেবুনটি বিতারিত হবার পরে চুক্তি ভেঙ্গে শুরু হয় সহযোগী দুই বেবুনের মধ্যে প্রতিযোগিতা – কে সবার আগে নারী বেবুনটির দখল নিতে পারে! একই ধরণের স্ট্র্যাটিজি বিজ্ঞানীরা প্রবলভাবেই প্রত্যক্ষ করেছেন বটলনেক ডলফিনদের মধ্যেও[10]। চুক্তির কথা না হয় বাদ দেই, আমরা যে সহবিবর্তন এবং মিথোজীবীতার উদাহরণগুলো জানি – যেমন, শিকারী মাছদের থেকে বাঁচার জন্য ক্লাউন মাছদের সাথে এনিমোনের সহবিবর্তন, হামিং বার্ডের সাথে অর্নিথোপথিলাস ফুলের সহবিবর্তন, এংরাকোয়িড অর্কিডের সাথে আফ্রিকান মথের সহবিবর্তন সেগুলো কিন্তু সবই প্রকারন্তরে স্বার্থপর সহযোগিতারই উদাহরণ। আসলে এ ব্যাপারগুলো প্রকৃতিতে এতোই স্পষ্ট যে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স তার ‘আনউইভিং দ্য রেইনবো’বইয়ের নবম অধ্যায়ের শিরোনামই দিয়েছেন – স্বার্থপর সহযোগী (The selfish cooperator)। তিনি পুরো ব্যাপারটিকে দেখেছেন অনেকটা এভাবে[11] –
‘আমি বরাবরই মনে করেছি যে, জীবজগতের প্রকৃতি বহুলাংশেই পরার্থপরায়ণ, সহযোগিতাপ্রাবণ, এমনি অনেকসময় আবেগপ্রবণও। এগুলো কিন্তু তাদের স্বার্থপর জেনেটিক স্তর থেকেই উদ্ভুত হয়। প্রানীরা কখনো খুব ভাল (পরার্থ), আবার কখনো খুবই খারাপ (স্বার্থপর)আচরণ করে, আর কখন কোনটা করবে তা নির্ধারিত হয় জেনেটিক স্তরে সর্বোচ্চ হিস্যা আদায়ের নিরিখে।… প্রানীজগতে পরার্থতা আসলে একটি সুচারু মাধ্যম যার ফলশ্রুতিতে অতলস্পর্শী জিনগুলো নিজ নিজ স্বার্থ সর্বোত্তম উপায়ে চরিতার্থ করতে পারে।’
যৌনতা, যৌনতার নির্বাচন এবং পরার্থিতা
আমাদের বিবর্তনীয় যাত্রাপথের খুব কাছের আত্মীয় শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলেন গবেষকেরা। তারা দেখলেন শিম্পাঞ্জিদের মধ্যেও সহযোগিতা দৃশ্যমান, কিন্তু সেটার পেছনে কাজ করে এক ধরণের যৌনাভিলাস। শিম্পাঞ্জিরা শিকার করে, কিন্তু অনেক সময়ই সেই শিকার নিজেদের বা গোত্রের পুষ্টির জন্য নয়, বরং নারীদের আকর্ষণ করে যৌনসঙ্গমে প্রবৃত্ত করার জন্য।
ধরা যাক একদল শিম্পাঞ্জি জঙ্গলে ঘুরতে ফিরতে গিয়ে কলোবাস বানরদের একটা দলের দেখা পেলো। অনেক সময় তারা কলোবাসদের আক্রমণ করে, কখনো বা আবার করে না। আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই নির্ভর করে দলে নারী শিম্পাঞ্জিদের উপস্থিতি এবং আধিক্যের উপর। দলে কোন যৌনান্মুখ শিম্পাঞ্জি (swollen female chimp)থাকলে নির্ঘাত আক্রমণের সূচনা ঘটে। দক্ষ শিকারীরা সফল অভিযানের পর সাথে করে মাংস নিয়ে আসে সেই সব যৌনান্মুখ নারী শিম্পাঞ্জির জন্য। দেখা গেছে নারী শিম্পাঞ্জিরা সেই সব পুরুষদের প্রতিই থাকে উদার যারা মাংসের ব্যাপারে কোন কৃপণতা করে না।
ব্যাপারটা কি মানব সমাজের জন্যও প্রযোজ্য? বলা মুশকিল। মাংসের জন্য না হলেও অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রির পেশা তো মানব সমাজে আছে, তা সবারই জানা। শিম্পাঞ্জিদের সমাজে যৌনতার বিপননের মাধ্যম মাংস, মানব সমাজে অর্থ কড়ি। এখন, আদিম মানব সমাজে নৈতিকতার উদ্ভবের পেছনে এ ধরণের কোন ধরণের যৌনাভিলাস কাজ করেছিলো কিনা সেটা পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞানীরা কিছু আদিম ট্রাইবে গবেষণাকাজ চালিয়েছেন। তাঞ্জানিয়ার অদূরে হাডজা (Hadza) নামে একটি ট্রাইবে গবেষণা চালিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই হাডজা মানুষেরা এখনো শিকারী-সংগ্রাহক হিসেবে জীবন যাপন করে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সেখানে যে সব পুরুষেরা শিকারে অধিকতর দক্ষ হয়,তারা আবার একই সাথে বহু নারীর প্রণয় অর্জনে সক্ষম হয়।
মনোবিজ্ঞানী জিওফ্রি মিলার তার ‘সঙ্গমী মন’ বইয়ে[12] এবং একটি গবেষণাপত্রে[13] সম্প্রতি প্রস্তাব করেছেন যে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের মত গুণাবলীগুলো আসলে যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে মানব সমাজে বিকশিত হয়েছিলো। ব্যাপারগুলো ঘটা অসম্ভব কিছু নয়। সততা, দয়া, মমতা এবং সহমর্মিতার মত গুণ গুলো জাতি, লিঙ্গ এবং সংস্কৃতি নির্বিশেষে মানুষের কাছে আদৃত। আমরা বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে ডেভিড বাসের জরিপের গবেষণার কথা জেনেছি। সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ৩৭ টি দেশের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে ছেলে এবং মেয়েদের পছন্দের উপর জরিপ চালিয়েছিলেন তিনি[14]। সেই গবেষণায় নারী-পুরুষ – দুই লিঙ্গের কাছেই যে বৈশিষ্টটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে তা হলো দয়া। অর্থাৎ, পছন্দের তালিকায় দয়ার স্থান বুদ্ধিমত্তা, সৌন্দর্যসহ অন্যান্য সব কিছুর উপরে। এটা হতেই পারে যে, আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যাদের এই দয়া, মমতা, বিশ্বস্ততার মতো গুণগুলো ছিলো তারাই খুব বেশি করে বিপরীত লিঙ্গের মনোযোগ এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল, এবং তারাই অধিক হারে এ পৃথিবীতে সন্তান সন্ততি রেখে গেছে। সেজন্যই এখনো যে কোন সমাজেই দেখা যাবে ভাল মানুষের সংখ্যাই বেশি – যারা অন্য মানুষের দুঃখ দুর্দশার প্রতি সংবেদনশীল এবং সহানুভূতিশীল; চোর ছ্যাচোর, গুণ্ডা, বদমায়েশ এবং স্বার্থপরদের সংখ্যাই সমাজে তুলনামূলকভাবে কম থাকে, এবং এ ধরণের লোকজনকে সাধারণতঃ কেউই সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করতে চায় না।
মরাল ল্যান্ডস্কেপ
একটা সময়ে ধর্মবাদীরা একচেটিয়াভাবে নৈতিকতার উৎসের জন্য ধর্ম এবং ঈশ্বরকে সাক্ষীগোপাল হিসেবে উপস্থাপন করতেন। তারা বহুকাল ধরেই নৈতিকতার পুরো ব্যাপারটাকে ঈশ্বরিক প্রলেপ লাগিয়ে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন এবং দাবী করেছেন (এবং এখনো অনেকে করেন) যে, জৈববৈজ্ঞানিকভাবে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের উদ্ভবের মতো ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যা করা যাবে না। এগুলোর কোন জৈবিক ব্যাখ্যা নেই। এগুলোর ব্যাখ্যা একমাত্র ঈশ্বর। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা বৈজ্ঞানিক মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়নি মোটেই, বরং জৈবিক উৎস তথা বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কীভাবে পরার্থিতা কিংবা সহযোগিতার মতো ব্যাপারগুলো প্রাণীজগতে উদ্ভুত হয়েছে – এটা যখন থেকে বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করেছেন, তখন থেকেই ব্যাপারগুলো বরং অনেক বিজ্ঞানভিত্তিক হয়ে উঠেছে।
শুধু ধার্মিকেরাই নয়, অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তিরাও ধার্মিকদের মতো একই ফাঁদে পা দিয়ে বলেন, মানব সমাজের নৈতিকতা ভিন্ন। বিবর্তন দিয়ে এটিকে ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই। এরাও আসলে ধার্মিকদের মতোই অবচেতন মনে ধরে নেন যে, মানুষ আসলে অন্যান্য প্রানী জগত থেকে আলাদা, যেন স্বর্গীয় কোন সৃষ্টি! কিন্তু এটি তো ঠিক নয়। মানুষ তো শেষ বিচারে এই জীবজগতেরই অংশ। অন্য প্রানীতে পরার্থিতা আর নৈতিকতা যে জৈবিক নিয়মে উদ্ভুত হয়েছে, মানুষের মধ্যেও সেই একই উৎসই কাজ করছে, তা এখন যতই অস্বাভাবিক লাগুক না কেন। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, মানব সমাজ অনেক জটিল। কিন্তু সেই জটিলতা ব্যাখ্যার জন্য জীববিজ্ঞানকে বাদ দেয়ার দরকার নেই। পিঁপড়ে, মৌমাছি কিংবা ডলফিনদের সমাজও জটিল। জটিল শিম্পাঞ্জিদের সমাজও। তাদেরও ভিন্ন ভিন্ন জটিল সোশাল স্ট্রাকচার আছে। সেগুলো বিজ্ঞানীরা জৈববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াতেই বিশ্লেষণ করে চলেছেন। মানব সমাজের বিবিধ জটিলতার উৎসের কারণে নৈতিকতার স্তরে যে পার্থক্যগুলো আছে তা বিভিন্নভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় স্বর্গীয় উৎস সরিয়ে রেখে। সম্প্রতি (২০১০ সালে প্রকাশিত) স্যাম হ্যারিস একটি চমৎকার বই লিখেছেন ‘দ্য মরাল ল্যান্ডস্কেপ’ শিরোনামে। বইটিতে হ্যারিস দাবী করেছেন যে, নৈতিকতা নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো আসলে বিজ্ঞানের একটি ‘অবিকশিত শাখা’ (undeveloped branch of science)র ই অংশ। তাই নৈতিকতার ঔচিত্য কিংবা অনুচিত্য নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার এখন বিজ্ঞানের কাঁধেই থাকা উচিৎ, অশিক্ষিত মোল্লা-পাদ্রী-পুরুতদের কাঁধে নয়। তিনি বলেন,
‘বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা প্রতিদিনই জানতে পারছি কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক, কোনটা মানবিক, কোনটা অমানবিক, কোনটা পরিবেশ সম্মত কিংবা কোনটা স্বাস্থ্যসম্মত। শতাব্দীপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থে লেখা ভুল ভাল বাণী থেকে উঠে আসা মূল্যবোধের চেয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া নৈতিকতাই অধিকতর নির্ভরযোগ্য। …পৃথিবীতে যেমন খ্রীষ্টান পদার্থবিদ্যা কিংবা মুসলিম বীজগণিত বলে কিছু নেই ঠিক তেমনি মুসলিম নৈতিকতা কিংবা খ্রীষ্টান নৈতিকতা বলাটাও হাস্যকর। আমি দাবী করব, নৈতিকতার গবেষণা বিজ্ঞানেরই অংশ, বিজ্ঞানের এক অবিকশিত শাখা এটি’।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে জীববিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক এবং বিবর্তনীয় উৎসের সন্ধান করে বহু বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ এবং গবেষনাপত্র প্রকাশিত হয়েছে[15]। এমনকি ডারউইন নিজেও সে সময় জেনেটিক্সের কোন জ্ঞান ছাড়াই কেবল জীবজগৎ পর্যবেক্ষণ করে সহযোগিতা এবং পরার্থতার বিবর্তনীয় উপযোগিতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।আধুনিক বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং চিন্তাবিদেরা বহুভাবে দেখিয়েছেন যে এই ডারউইনীয় পদ্ধতিতে প্রাকৃতিকভাবেই পরার্থপ্রায়ণতা, সহযোগিতা, নৈতিকতা আর মূল্যবোধের মতো অভিব্যক্তিগুলো জীবজগতে উদ্ভুত হতে পারে, যা বিবর্তনের পথ ধরে মানব সমাজে এসে আরো বিবর্ধিত আর বিকশিত হয়েছে।গবেষক এলিয়ট সোবার তার একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন,
‘যদি আমরা বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোন থেকেও নৈতিকতার ব্যাপারগুলো চিন্তা করি, তারপরেও এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে বিবর্তন মানুষকে কেবল স্বার্থপর এবং অহঙ্কারী হিসেবে গড়ে তুলবে। বরং উল্টোভাবে এটা বরং খুবই সম্ভব যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন তাদেরকেই বাড়তি উপযোগিতা দিয়েছিলো যারা আত্মম্ভরী কিংবা স্বার্থপর না হয়ে গোত্রের মধ্যে সহযোগিতামূলক ব্যবহার প্রদর্শন করেছিলো’।
আমরা অধ্যায়ের শুরুতে স্যামুয়েল বাওয়েলের বিবর্তন মনোবিজ্ঞান নিয়ে একটি মজার কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ গবেষণার উল্লেখ করেছিলাম। সেখানে আবারো ফিরে যেতে হচ্ছে। বাওয়েলের গবেষণায় বেড়িয়ে এসেছিলো যে, মূঢ় সহিংসতা থেকেই সম্ভবতঃ একসময় জন্ম হয়েছে মূঢ় পরার্থিতার। এলিয়ট সোবারের মত স্যামুয়েল বাওয়েলও মনে করেন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যে গোত্রের সদস্যরা অনেক বেশি নিজেদের মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা করেছে, তারাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের ছাকুঁনিতে তারাই টিকতে পেরেছে অন্যদের চেয়ে বেশি। কাজেই পরার্থিতার মত অভিব্যক্তিগুলো সমাজে এক সময় না একসময় উদ্ভুত না হবার কোন কারণ নেই। মানব সমাজে এটির উদ্ভবের পরে সেটার বিকাশ এবং বৃদ্ধি তো স্রেফ সময়ের ব্যাপার। সমাজে সুগুণের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা, দুর্বলদের রক্ষার জন্য এক সময় রাষ্ট্রের উদ্ভব, গণতান্ত্রিক আইনের প্রয়োগ, শিক্ষার প্রসার, নারী অধিকার, সাংস্কৃতিক অগ্রসরতা প্রভৃতি মানব নৈতিকতাকে ভিন্ন একটি মাত্রায় নিয়ে গেছে নিঃসন্দেহে। আমাদের আধুনিক মূল্যবোধগুলো যে প্রতিদিনের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকেই উদ্ভুত এবং উৎসারিত, দার্শনিক পল কার্জের ‘নিষিদ্ধ ফল : মানবিকতার মূল্যবোধ’ গ্রন্থে এই মতের সুস্পষ্ট সমর্থন মেলে[16]।
প্রখ্যাত মনোবিদ, বিজ্ঞানের দার্শনিক এবং স্কেপটিক ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা ড. মাইকেল শারমার মানব সমাজে মুল্যবোধ এবং নৈতিকতার অভিব্যক্তি নিয়ে আলাদা করে ভেবেছেন এবং এ নিয়ে লিখেছেন। তিনি তার ‘দ্য সায়েন্স অব গুড এণ্ড এভিল’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন সমাজ বিকাশের প্রয়োজনেই মানুষ কিছু নীতিকে প্রথম থেকে ‘গোল্ডেন রুল’ হিসেবে গ্রহন করেছিল[17] :
Do unto others, as you would have them do unto you.
(অন্যদের প্রতি সেরকম ব্যবহারই করো যা তুমি তাদের থেকে পেতে চাও)
কারণ এই নীতির অনুশীলন ছাড়া কোন সমাজ ব্যবস্থা টিকে থাকবে না। মাইকেল শারমার তার গবেষনায় দেখিয়েছেন যে, মানব বিবর্তনের ধারাতেই পারষ্পরিক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি আবার নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সহনশীলতা, উদারতা, স্বার্থত্যাগ, সহানুভূতি, সমবেদনা প্রভৃতি গুনাবলির চর্চা হয়েছে। সভ্যতার প্রতিনিয়ত সংঘাত ও সংঘর্ষেই গড়ে উঠেছে মানবীয় ‘প্রোভিশনাল এথিক্স’, যা মানুষকে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। আমরা এখনো মানবিকতার কষ্টিপাথরে নিজেদের মূল্যবোধ প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে চলেছি। বিগত কয়েক শতকের সামাজিক বিবর্তন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আমরা আমাদের মানবিক মূল্যবোধ গুলোকে বাড়িয়ে নিতে পেরেছি বহুক্ষেত্রেই। এখন আর কালো মানুষদের দেখলে ‘নিগ্রো’ শব্দটি উচ্চারণ করি না, বাংলাদেশে ‘উপজাতি’র বদলে লিখি ‘পাহাড়ী জনগোষ্ঠি’। আমরা জীর্ণ শীর্ণ পুরাতন মূল্যবোধগুলোকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করে সেগুলোর সংস্কার করতে পেরেছি।সাড়া বিশ্বজুড়েই নারীবাদী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে জেণ্ডার সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়ছে, বৃদ্ধি পেয়েছে বৃদ্ধ কিংবা শিশু অধিকারের প্রতি দায় দায়িত্বও। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার-সচেতনতা, সমকামী এবং রূপান্তরকামীদের প্রতি সহমর্মিতাসহ অনেক মূল্যবোধই আজকে খুব ভালভাবে চোখে পড়ে, যেগুলো কয়েক দশক আগেও ছিলো একেবারেই অনুপস্থিত। রিচার্ড ডকিন্স তার ‘গড ডিলুশন’ গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে ‘Natural Selection as a consciousness Raiser’ অংশে মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, আসলে ডারউইনীয় সিলেকশনের মতোই এক ধরণের নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের মূল্যবোধগুলোকে ক্রমশঃ বাড়িয়ে তুলছি, ঠিক যেভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন নামের ডারউইনীয় সিলেকশন প্রক্রিয়ায় সরল জীব থেকে উদ্ভুত হয়েছে জটিল জীবজগতের[18]। নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের ক্রমিক চর্চার মাধ্যমে জৈববৈজ্ঞানিক পথেই আমরা প্রতিদিনই বাড়িয়ে তুলছি, জাগিয়ে তুলছি আমাদের সুপ্ত মানবতাবোধ।
তথ্যসূত্র :
[1] দিগন্ত সরকার, ‘স্বার্থপর জিন’ -এর আলোকে সহযোগিতা এবং আত্মত্যাগ, বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়, মুক্তমনা ই-বুক, মুক্তমনা দ্রষ্টব্য
[2] In the biological literature, this game of game theory is referred to as Hawk-Dove. The earliest presentation of a form of the Hawk-Dove game was by John Maynard Smith and George Price in their 1973 Nature paper, “The logic of animal conflict”, Nature 246: 15–18.
[3] Heinz R. Pagels, The Dreams of Reason: The Computer and the Rise of the Sciences of Complexity, Bantam, 1989; অনুবাদের কিয়দংশ অপার্থিব জামান, বিবর্তনের দৃষ্টিতে নৈতিকতার উদ্ভব, বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়, মুক্তমনা ই-বুক।
[4] Matt Ridley, The Origins of Virtue: Human Instincts and the Evolution of Cooperation, Penguin; 1998
[5] Axelrod, Robert; Hamilton, William D, “The Evolution of Cooperation”, Science 211: 1390–96, 1981
[6] Axelrod, Robert, The Evolution of Cooperation, Basic Books, 1984
[7] Gerald S. Wilkinson, Reciprocal food sharing in the vampire bat, Nature, 308, 181 – 184, 1984
[8] Craig Packer, Reciprocal Altruism In Olive Baboon, Nature, 265: 441-3
[9] R Noë, Alliance formation among male baboons: shopping for profitable partners. In: Harcourt AH, de Waal FBM, editors. Coalitions and alliances in humans and other animals. Oxford: Oxford University Press. pp. 285–321, 1992
[10] R.C. Connor, R.A. Smolker, and A.F. Richards, Dolphin alliances and coalitions. In A.H. Harcourt and F.B.M. de Waal (Eds.), Coalitions and alliances in animals and humans (pp. 415-443). New York: Oxford University Press, 1992.
[11] Richard dawkins, Unweaving the Rainbow: Science, Delusion and the Appetite for Wonder, Mariner Books; First Edition edition, 2000
[12] Geoffrey Miller, The Mating Mind: How Sexual Choice Shaped the Evolution of Human Nature, Anchor, 2001
[13] Geoffrey Miller, Sexual Selection for Moral Virtues, The Quarterly Review of Biology, 82(2) : 2007
[14] D.M. Buss, Sex differences in human mate preferences: evolutionary hypotheses tested in 37 cultures. Behavioral and Brain Sciences 12, pp. 1–49, 1989.
[15] সাম্প্রতিক সময়গুলোতে জীববিজ্ঞান, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং বিবর্তনীয় উৎসের সন্ধান করে বহু বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ এবং গবেষনাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়:
* Robert Axelrod, The Evolution of Cooperation, Basic Books, 1985
* Richard Alexander, The Biology of Moral Systems, Aldine Transaction, 1987
* Robert Wright, The Moral Animal : Why We Are, the Way We Are: The New Science of Evolutionary Psychology, Vintage, 1995
* Frans B. M. de Waal, Good Natured: The Origins of Right and Wrong in Humans and Other Animals, Harvard University Press, 1997
* Larry Arnhart, Darwinian Natural Right: The Biological Ethics of Human Nature, State University of New York Press, 1998
* Leonard D. Katz, Evolutionary Origins of Morality : Cross-Disciplinary Perspectives, Imprint Academic, 2000
* Donald M. Broom, The Evolution of Morality and Religion, Cambridge University Press, 2004 ইত্যাদি
[16] Paul Kurtz, Forbidden Fruit: The Ethics of Humanism, Prometheus Books, 1988
[17] Michael Shermer, The Science of Good & Evil: Why People Cheat, Gossip, Care, Share, and Follow the Golden Rule, Holt Paperbacks, 2004
[18] Richard Dawkins, The God Delusion, Houghton Mifflin Harcourt; 2006
খুবই তথ্যবহুল
@অভিজিত। জীবিত বিবাহিত এর বেপারটা কি?
আগের লেখাটা পড়ার জন্য হয়তো সহজে বুঝতে পরেছি।
না হলে, এই লেখাটা প্রথম পর্বের তুলনায় সুন্দর হয়েছে। :yes:
অভিজিৎ দা,
আপনি লিখেছেন , ভালই হবে।
১টি মন্তব্যর উওর চাইছি,দয়া করে দিবেন পিল্লিজ…বির্বতন কি করে স্রষ্টাকে বাতিল করে? :-Y
http://blog.mukto-mona.com/?p=936#respond
@সত্তুক,
ভাই, এটাতো একজন মুসলমানের জন্য জলবৎ তরলং হবার কথা। বির্বতন কুরাণের কথিত “লেখক” আল্লাহকে সহজেই বাতিল করে। কুরাণের 4:1, 7:189, 39:6 আয়াত সমূহে আল্লাহ বলেছেন হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক আদি মানুষ আদম হতে সৃষ্টি করেছি, আর বিবি হাওয়াকে সৃষ্টি করেছি আদমের হাড় থেকে। আর বিবর্তন বলছে আদি এক এককোষী জীবের লক্ষ লক্ষ বছরের পরিবর্তিত হওয়া রূপ এই বর্তমান মানুষ। এখন বলুন বিবর্তন আর কুরান একই সাথে সত্যি হতে পারে?
@যাযাবর,
আপনার রেফারেন্স গুল এই মাত্র পরলাম,ঠিক ই লিখেছেন,তবে হঠাৎ ৭ঃ৭৭-৮২ পর্যন্ত পরলাম,খুব ই বিপদ লেখা,বোধ হয় ইআপনাদের কথা বলছে,যাই হোক ৩৯ঃ৬ এ আছে আর জটিলস কিছু কথা যা বিজ্ঞান হয়ত আবিস্কার করবে অদুর ভবিষ্যতে।
বাকি কথা অভি দা কে বলছি,প্রে নিন।
@সত্তুক,
এটা নির্ভর করে আপনি স্রষ্টাকে কী হিসেবে দেখেন বা সংজ্ঞায়িত করবেন তার উপর । আপনি যদি আক্ষরিক অর্থেই মনে করেন যে কোন স্রষ্টা আলাদা আলাদা ভাবে বাঘ সিংহ, হরিণ, বানর, মানুষ তৈরি করেছে, তাহলে সেই স্রষ্টাকে অবশ্যই বাতিল করে। কারণ বিবর্তন তত্ত্ব বলছে কোন প্রজাতিই আলাদা আলাদা ভাবে তৈরি হয়নি, বরং পূর্ববর্তী প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়ছে। কোরানে আর বাইবেলে এমন আয়াতও আছে যে স্রষ্টা আদমকে ডেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রানীর নাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, স্রষ্টা জীবজগতকে স্থির বা স্ট্যাটিক কিছু একটা ধরে নিয়েছিলেন (চিন্তা করে দেখুন ম্যামথ ডায়নোসারের মত প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, প্রতিমুহূর্তেই নতুন প্রজাতি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে অনুজীব থেকে শুরু করে বড় সড় স্কেলেও, কয়টার নাম আপনি মনে রাখতে বলবেন?) । আর আদমের পাঁজর থেকে হাওয়া তৈরির রূপকথা, গন্ধম ফল ইত্যাদির কথা না হয় বাদই দিলাম। বিবর্তন এগুলো সবই বাতিল করে দেয়।
তবে আপনি যদি মনে করেন, ঐধরনের রূপকথার মাধ্যমে প্রজাতি তৈরি হয়নি, হয়েছে বিবর্তনের ফলশ্রুতিতে, আর স্রষ্টা তার সৃষ্টিতে হস্তক্ষেপ করে না – সেই স্রষ্টাকে বিবর্তন বাতিল করে না। কিন্তু সে ধরণের কোন স্রষ্টা আছে কিনা তা প্রমানের দায়িত্ব দাবীদারের (যিনি এরকম কোন স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন), বিবর্তনের নয়। বিবর্তন ট্যাশগররু, ডিব্বা ডাব্বা, রাবণ, জিউস, থর কিংবা মামদো ভুতের অস্তিত্বও বাতিল করতে পারে না। কিন্তু ওগুলো আছে কিনা তা প্রমাণের দায়িত্ব দাবীদারের , বিবর্তনের নয়।
@অভিজিৎ,
আপনি যদি আক্ষরিক অর্থেই মনে করেন যে কোন স্রষ্টা আলাদা আলাদা ভাবে বাঘ সিংহ, হরিণ, বানর, মানুষ তৈরি করেছে, তাহলে সেই স্রষ্টাকে অবশ্যই বাতিল করে। কারণ বিবর্তন তত্ত্ব বলছে কোন প্রজাতিই আলাদা আলাদা ভাবে তৈরি হয়নি, বরং পূর্ববর্তী প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়ছ
অর্থাৎ ১ ই সুত্র থেকে সব জীব তৈরি,আমরা ও তাই বিশ্বাস করি,আলাদা আলাদা না,স্রষ্টা বলেছে হও ,সব হয়ে গেসে, এবং তা হতে কোরান মতে সময় লেগেসে ৬ টি বৃহৎ কাল/সময়।ধারনা করা যায়। এই ৬ কালে step by step গ্যালাক্সি, নক্ষত্র,সুর্য প্পৃথিবি হয়েছে।তার পর পৃথিবির প্রানী বিকাশ হয়েছে।কারন দেখুন,কোরান যেমন বলে পৃথিবির সব জীব ও প্রানীর সৃষ্টি পানি থেকে,মানে প্রানের মুল বিকাশের শুরু পানি থেকে।এখন আসুন ১ জোরা থেকে সকল মানুষ এর সৃষ্টি,কিভাবে?আমি জানি না,তবে বিবর্ত্ন কিন্তু প্রমান করে না যে,মানুষের সৃষ্টি ১ জোরা থেকে নয়,হাজার জোরা একসাথে বিবর্তিত হল তার থেকে লাখো কোটি মানুষ,এটা প্রমান সম্ভব ও নয়।
বলার আছে আমার আর ও অনেক ইতিহাস,যেমন ইসলাম এমোন বলে না যে মানুষ পৃথিবিতে, পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে আছে।তবে আগে আপনার বক্তব্য শুনি। :rose:
@সত্তুক,
সবকিছু জোড়া থেকে সৃষ্টি হয়নি। আমি জানি আপনি কেন ‘জোড়ায় জোড়ায়’ ব্যাপারটা নিয়ে এসেছেন, এর কারণ কোরাণে একটা আয়াত আছে। 🙂 ভাই কোরান কোন বিজ্ঞানগ্রন্থ না, কোরাণে লেখা থাকলেই সব কিছু জোড়ায় জোড়ায় হয়ে যাবে তা ভাবা ভুল। কিছু উদাহরণ দেই। কেঁচো উভলিঙ্গ প্রানী, প্রানীজগতের একেবারে গোড়ার দিকে কিছু পর্ব হল – প্রটোজোয়া, পরিফেরা, সিলেনটেরেটা, প্লাটিহেলমিনথিস, অ্যানিলিডা, মোলাস্কা ও কর্ডাটা। এই সমস্ত প্রাণিদের বেশিরভাগই উভলিঙ্গ বা হার্মাফ্রোডাইট। আবার হুইপটেল গিরগিটি পার্থোজেনেসিস প্রক্রিয়া থেকে জন্মায়, কোন ধরণের জোড়া ছাড়াই। এখনো পৃথিবীতে বহু এসেক্সুয়াল প্রজাতির অস্তিত্ব আছে। আপনার এগুলো বুঝতে হলে, বিবর্তনের বই পড়তে হবে, ধর্মগ্রন্থের আয়াত দিয়ে জাস্টিফাই করে বেশিদূর যেতে পারবেন না।
যা হোক, এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য আল্লাহ কিংবা ইসলামের সাথে কতটুকু মিল বা বিরোধ আছে সেটা দেখানো নয়। প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য জৈবিকভাবে নৈতিকতার উদ্ভবের উৎস সন্ধান। সেটা নিয়ে কথা বলতে চাইলে আসুন, নাইলে পোস্ট বহির্ভুত অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই। আপনি যদি মনে করেন, ছয় দিনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি, আদম হাওয়া গন্ধম ফলের রূপকথাগুলোর সাথে সাথে কিংবা উপরে যাযাবর যে আয়াতগুলোর কথা বলেছেন সেগুলোর সাথে বিবর্তনের কোন বিরোধ নাই, তা হলে তো মিটে গেল। তাহলে আপনার উচিৎ আমাকে না রিফিউট করে যারা বিবর্তন অস্বীকার করেন, তাদেরকে গিয়ে বোঝানো। যেমন, জাকির নায়েক আর হারুন ইয়াহিয়াকে গিয়ে বলা যে বিবর্তন ইসলামবিরোধী নয়, বরং কতটা ইসলামসম্মত। সেটাই করতে পারেন বরং।
অভিজিৎদা,
আমি মুক্ত মনার আনেক পুরোনো পাঠকদের একজন হলেও নব্য আলোচনা-সমালোচনা ও কমেন্টে অংশ গ্রহণকারীদের একজন। আপনার প্রায় সব লেখাই আমি পড়েছি। আপনার লিখার বিষয় বস্তুর বাহিরেও যে জিনিষটা আমাকে বেশ আকৃষ্ট করে তা হলো ‘স্বাবলীল উপস্থাপনা’। পড়া শুরু করার পর তা শেষ না করে আর উঠা হয় না। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মজার মজার বিষয়ের উপর চমৎকার সব লিখার জন্য।
@Golap,
আপনি হয়তো জানেন না আপনার মন্তব্যেরও একজন ভক্ত আমি।
এবার মন্তব্যের পাশাপাশি লেখাও শুরু করে দিন (ইমেইল চেক করুন)। আর এত সুন্দর একটা নাম নিয়েছেন, বাংলায় লিখলেই ভাল লাগবে!
গ্রুপ সিলেকশনের সমস্যাগুলো কী কী? উদাহরণ দিয়ে বুঝাবেন প্লিজ!
@আতীক রাঢ়ী
মানুষ এটা করে অনেক সময় সেটা মানি, কিন্তু ভুল করে। অন্য কোন ব্যাখ্যা না থাকায় মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে এসেছে, বহু কুসংস্কারে বিশ্বাস করে এসেছে। আমার বক্তব্য হল, কোন দাবির সত্যাসত্য আপেক্ষিক হতে পারে না। হ্যাঁ, approximate হতে পারে। কিন্তু সেই approximation এরও একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রা থাকা চাই। প্রিজম তত্ত্বু যদি রংধনু সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যের ৬০ শতাংশ ব্যাখ্যা দিতে পারে, আর অন্য কোন তত্ব তার ধার কাছেও না থাকে, তাহলে হয়ত প্রিজম তত্বকে আপাতত মানা যায়। কিন্তু প্রিজম তত্ব যদি ০.১ শতাংশের ব্যাখ্যা দেয় তাহলে ওই তত্বকে ভুল বলে সমস্যাটিকে open problem হিসেবে গণ্য করাই শ্রেয়, অন্য তত্ব থাকুক বা নাই থাকুক।
@রৌরব,
সর্বশেষ গ্রহন যোগ্য ব্যাখ্যা মেনে নেয়াটাকে ভুল বলা ঠিক হবে কিনা, ভেবে দেখতে হবে। অতীত সম্পর্কে আমরা যত সহজে বলে দিতে পারি কোন কিছু ঠিক না বেঠিক, বর্তমান সম্পর্কে পারি না। কারনটা সহজ। অতীতকে বিশ্লষণ করার জন্য যে সময় আমরা পাই, বর্তমানের ক্ষেত্রে তা পাই না।
কাউকে যখন আমরা ভুল বলি, নিশ্চই কোন কিছুর সাপেক্ষে সেটা বলি। কোন এক সময়ে ইশ্বরের ধারনাও আধুনিক ও প্রগতিশীল ধারনা ছিল। এই ধারনা মানুষকে অনেক ভাল কিছুও দিয়েছে।
@আতিক রাঢ়ী,
ধর্ম প্রগতিশীল ছিল, এবং ভুলও ছিল। এ দুই সিদ্ধান্ত পরস্পর বিরোধী নয়।
আমার মূল কথাটা হল, “এই মুহূর্তে কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই” এই অবস্থানে আমি কোন সমস্যা দেখি না। দুর্বল ব্যাখ্যার চেয়ে এই অবস্থান সৎ ও গ্রহণযোগ্য।
@রৌরব,
ধর্ম যখন বলেছে প্রতিবেশীর উপকার কর, পিতা-মাতার সেবা কর, সৎ জীবিন যাপন কর এপর্যন্ত এটা ভুল ছিল না। অদ্বৈতবাদে স্রষ্টাকে কল্পনা করা হয়েছে সৃষ্টিতে বিলীন হিসাবে। আলাদা ইশ্বর সেখানে নেই। বুদ্ধের ধর্মে ইশ্বরই নেই। পুরোহিত শ্রেনীর আবির্ভাবের মধ্যেদিয়ে ধর্মের প্রগতিশীলতা পরিনত হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলতায়। তাই আমার মনে হয় যতদিন ধর্মের ভূমিকা ছিল প্রগতিশীল ততদিন তা ভুল ছিল না।
আপনার কথার সাথে সম্পূর্ন একমত।
আমার একটা বাক্স দরকার যেখানে এইসব লেখাগুলো সজোরে নিক্ষেপ করতে পারব।
বাক্সটার নাম দিব “প্রিয় পোস্টের বাক্স” 😀 লেখা নিয়ে আর কিছু বলার দরকার আছে কি? 😉
@লীনা রহমান,
বাক্সটার নাম গার্বেজ বাক্স রাখলে কেমন হয়? 🙂
আর বাক্সটা তৈরির দায়দায়িত্ব রামগড়ুড়ের ছানাের! 🙂
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
@অভিজিৎ, শাফায়েতরে তো আমি বলসি। আপনারাঅ সাথে যোগ দেন যাতে “প্রিয় পোস্ট” বলে একটা অপশন দেয়া যায়।
:-/ আপনার সাহস তো কম না! আমার প্রিয় পোস্টের বাক্সের এমন বিকৃত নাম প্রস্তাব করেন! 😛
আমার কাছেও তাই মনে হয়!
বিজ্ঞান সব সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করে।
বুঝতে বা ভাবতে শেখায়।
লেখাটা খটমটে লাগলো; মূলত স্কিমই করলাম। 🙂 তবে জীবনের উদ্দেশ্য বিষয়ক আলোচনাটা বেশ ইন্টারেস্টিং।
@সিরাত,
এই লেখা স্কিম করে পড়লে কিছু বুঝবে না। অনুরোধ রইল হাতে সময় নিয়ে পড়ো। তাহলে পুরোটাই ইন্টেরেস্টিং লাগবে 😉 ।
@সিরাত,
আপনিই দেখলাম তানভীরুলের পস্টে (হকিং এর গ্রাণ্ড ডিজাইনের অনুবাদে) মন্তব্য করেছেন যে, আপনি বুঝতে পেরেছেন যে, মুক্তমনায় স্কিম করে পড়লে চলবে না! নিজেদের লেখাকে অযথা বড় করছি না, কিন্তু অন্য ব্লগের মতো মুক্তমনার লেখাগুলো স্কিম করে পড়ে গেলে অনেক কিছুই অধরা থেকে যাবে, এটুকু বলতে পারি। আপনাকে অনুরোধ করছি সময় নিয়ে পড়ুন। তাই উপরে স্বাধীনের সাথে একমত পোষণ করে বলছি, সময় নিন, প্রথমে প্রথম পর্ব দিয়ে শুরু করুন, তারপর এটিতে আসুন। আমার ধারণা অনেক স্পষ্ট হবে তখন। তারপরেও খটমটে কিছু থাকলে, জানাতে কার্পণ্য করবেন না। যথাসাধ্য চেষ্টা করব খটমটে খাট্টাসকে হাতুরি সহযোগে সমান করে ফেলতে… 🙂
বিবর্তনবাদের সব চাইতে নিষ্ঠুর দিক বোধ হয় এটা আবিষ্কার করা যে মানব জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই। মানুষের জীবনের সাথে আর দশটা পশু পাখীর জীবনের কোন তফাৎ নেই। আমার মনে হয় ঠিক এ পয়েন্টে এসে মানুষ অতিন্দ্রীয়বাদী হয়ে পড়ে। তৎপর হয়ে পরে একটা কৃত্রিম উদ্দেশ্য সৃষ্টির। আর ধর্মীয় মতবাদগুলো গড়ে ওঠে এটার ওপর ভিত্তি করেই। বুদ্ধিমান মানুষ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে যখন দেখে তার জীবনের কোন লক্ষ্য নেই।
@ভবঘুরে,
মানব জীবন সৃষ্টিতে আলাদা কো্ন উদ্দেশ্য থাকলেই আমি বেশী আশ্চর্যানিত হতাম। মানব জাতির সার্থকতা নির্ভর করছে তার এই ‘Superior Intelligence’ এর সৎব্যাবহারের বিষয়টিতেই।
বিবর্তনবাদ নিয়ে ভাবতে গেলে একটা বিষয় আমাকে বেশ ভাবায়। সেটা হলো নৈতিকতা ও জীবনের উদ্দেশ্য। বিবর্তন নৈতিকতার ব্যখ্যা দিল ঠিকই আর তা বোঝাও যায়। লড়াইই যে টিকে থাকার মূল উপায় নয়, সহযোগীতাও যে দরকার তা প্রকৃতি রাজ্যের দিকে তাকালে ভাল মতো বোঝা যায়। কিন্তু তাহলে জীবনের উদ্দেশ্য টা কি ? যদি কোন উদ্দেশ্য না থাকে তাহলে মানুষের একসময় স্বৈরাচারী, হতাশাবাদী এসব হওয়া অসম্ভব নয়। আর আমরা দেখিও তাই।
লেখাটা দারুন ছিল ও জ্ঞানগর্ভ।
@ভবঘুরে,
ভাই, জীবনের উদ্দেশ্য খুব সোজা। জীবনকে উপভোগ করাই জীবনের উদ্দেশ্য। এখন সেটা মদ-জুয়া হতে পারে আবার বই পড়া বা ব্লগে আড্ডা দেয়া হতে পারে।
@আতিক রাঢ়ী,
:yes:
@আতিক রাঢ়ী,
সচলে আমার একটি লেখার লিঙ্ক দিলাম জীবনের উদ্দেশ্য এবং Inception, যা আপনার এই কথার সাথে খুব মিলে যায়। আমার কাছে আমার জীবনের উদ্দেশ্য আমার মস্তিষ্কের সুখের অনুভূতিগুলোকে ম্যাক্সিমাইজ করা। এখন সেটা মদ-জুয়া হতে পারে আবার বই পড়া বা ব্লগে আড্ডা দেয়া হতে পারে 😀 (কপিরাইট উপরে আতিক ভাই)।
@স্বাধীন,
লিংক অনুসরন করে আপনার লেখাটা পড়লাম। দারুণ। শুনেন কথায় আছে না গ্রেট ম্যান থিংক………এক রকম। 😀
নৈতিকতার আধুনিক সংজ্ঞাঃ এমন যাবতীয় নীতি ও কৌশল যেগুলোকে মনে করা হয় আমাদের টিকে থাকার জন্য সহায়ক।
আরো ভাল সংজ্ঞা আহভান করছি, আপনারা যোগ দিন।
@আতিক রাঢ়ী,
“টিকে থাকা” মানে কি? বেশিদিন বাঁচা, এক প্রজন্মে বেশি সন্তান, ১১৮ প্রজন্ম পরে বেশি বংশধরের সম্ভাবনা, “জীনের কপি” বাড়ানো (এটি আর বংশধরের সংখ্যা এক নাও হতে পারে) ইত্যাদি অসংখ্য সম্ভাবনার কোনটি? যেসব ক্ষেত্রে সম্ভাবনা তত্ব চলে আসে সেখানে কোন ফাংশন বাছব? প্রত্যাশা বাড়াব, নাকি প্রত্যাশা একটু কমিয়ে হলেও ভেরিয়ান্স নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করব? (এবং এরকম আরো অসংখ্য মানদণ্ড নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায়)
@রৌরব,
আমার না বলছি আমাদের, আমাদের প্রজাতির টিকে থাকা বললেই ভাল হয়। আর বলেছি
কারন আমাদের টিকে থাকার জন্য কোন কাজটা ভাল সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিৎ না।
তার পরে কোন গুলো টিকে থাকার জন্য দরকারি কাজ বা নীতি সেগুলি নিয়ে বিতর্ক, পরিক্ষা-নিরিক্ষাতো চলতেই থাকবে।
@আতিক রাঢ়ী,
আমাদের প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখাকে আধুনিক নৈতিকতা করা মানে বিবর্তনকে অথরিটি মানা। এবং একটা বিজ্ঞানকেন্দ্রিক বৈশ্বিক কর্তৃপক্ষ কল্পনা করা, যে এই নৈতিকতা নিশ্চিত করবে। ঠিক কোন নীতি বা কৌশলগুলো আমাদের প্রজাতির টিকে থাকার সম্ভাবনা বর্ধন ও সর্বোচ্চ বিস্তার নিশ্চিত করে সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে যাচাইযোগ্যও হয়ত। এখন যদি বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে দেখা যায়, একটা লিবারেল এবং ডাইভারস বিশ্বই হলো এই লক্ষ্যের জন্য সবচেয়ে সহায়ক, তখন আমরা এখানের অধিকাংশই খুব খুশি হব। কিন্তু যদি বৈজ্ঞানিক গবেষণা বের করে যে, কিছু উন্নত জাতির বিস্তার, অনুন্নত অনুর্বর জাতির বিলোপ, ইউজেনিক্স, এগুলোই হলো আমাদের প্রজাতির টিকে থাকার লক্ষ্যের জন্য সবচেয়ে সহায়ক, তখন কিন্তু আমি, হয়ত আপনিও এবং আমাদের অনেকেই, সেই নীতিকে প্রত্যাখ্যান করব। সে নীতি যতই মানব প্রজাতিকে শক্তিশালী করুক।
এই উদাহরণ দিলাম এটা বোঝানোর জন্য যে প্রজাতির টিকে থাকাটাকেই একটা সর্বসম্মত আধুনিক নৈতিকতা হিসেবে দাঁড় করাতে পারবেন না। দাঁড় করানোটা এক অর্থে মারাত্মকও। এধরনের নৈতিকতা বা লক্ষ্য, সেটা যতই বিবর্তন বা প্রকৃতি-বান্ধব হোক, সর্বজন স্বীকৃত হতে পারে না। আর এসব নৈতিকতার পক্ষে ব্যাপকভিত্তিক জাজমেন্ট দেয়া সম্ভব। যেমন, আপনার আধুনিক নৈতিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো বৈশ্বিক কর্তৃপক্ষকে ভার দিয়ে দিলে সে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে করে মানুষের প্রতিটি কাজ কর্মকে এই নৈতিকতার নিরীক্ষে বিচার করে ফেলতে, মানে একটা ভালো বা খারাপ জাজমেন্ট দিতে সক্ষম হবে। হিসাব কষে হয়ত দেখাতে পারবে, নাস্তিকতা প্রজাতির বর্ধনে অসহায়ক, অন্ধবিশ্বাস সহায়ক, ঠিক এগুলিই না হলেও এধরনের স্পেসিফিক কিছু। তখন ওই কর্তৃপক্ষ তার জাজমেন্ট অনুযায়ী নৈতিকতা বাস্তবায়ন করতে চাইবে। যেগুলো তার নৈতিকতার স্ট্যান্ডার্ডে বৈজ্ঞানিকভাবে খারাপ প্রতিষ্ঠিত হবে, ওগুলোকে সে দমন করবে, আর সহায়কগুলোর লালন পালন করবে। সেটা প্রজাতির বর্ধন সর্বোচ্চীকরণ করলেও সেটা একটা নরক।
আমি তাই প্রজাতির সর্বোচ্চ বর্ধনকে আধুনিক নৈতিকতার সংজ্ঞা মানি না। এমন কোনপ্রকার নৈতিকতা প্রতিষ্ঠাই অসম্ভব। সে চেষ্টা না করাই উত্তম।
@ধ্রুব,
আপনার মতে নৈতিকতার প্রচলিত সংজ্ঞা কি, জানতে পারলে ভাল হত। বা কোন সংজ্ঞা্টা আপনার কাছে আধিকতর গ্রহন যোগ্য বললে আলোচনায় সুবিধা হত। মূলত সেটাই আমি চাইছিলাম। আমার সংজ্ঞার দূর্বলতাগুলো বলেছেন কিন্তু মজবুত সংজ্ঞা কি হওয়া উচিৎ সেটা বলেন নি।
বিবর্তন যদিও ফ্যাক্ট কিন্তু এখনও এক্ষেত্রে অনুমানই ভরসা। যেমন ঠিক কত বছর আগে সিম্পাজ্ঞি না বানর থেকে আমাদের মানুষ প্রজাতি আলাদা হয়েছে তা ১০০% সঠিক ভাবে বলে দেয়া সম্বভ না। আবার বিবর্তন ভবিষ্যতবানীও করতে পারেনা। তাই অথোরিটি হিসাবে সে খুব মারাক্তক কিছু না।
প্রচলিত নৈতিকতার ধারনার অনেক খানি জুড়ে আছে ধর্ম, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, গনতন্ত্র, ন্যায়বিচার, ব্যাক্তি স্বাধীনতা, সম্পদের বন্টন ইত্যাদি। এই প্রতিষ্ঠান গুলোকে মানূষ দরকারি মনে করেছে কারন এগুলি তার আস্তিত্ত্বের জন্য সহায়ক হবে বলে সে ভেবেছে।
বিজ্ঞানের ধারনা জন্মানোর বহু আগেই সবল জাতি -দূর্বল জাতিকে পরাধিন করেছে। বিজ্ঞানতো নিয়ম তৈ্রি করেনা। বরং বিদ্যমান নিয়মের প্রকৃতিকে আমাদের কাছে তুলে ধরে।
বিজ্ঞানের আবিস্কার যেহেতু একটা চলমান প্রক্রিয়া ফলে এর দ্বা্রা নৈ্তিকতার রায় দেয়ার জন্য একক কোন সংগঠন হয়ে উঠা সম্ভব না। বরং অনেক গুলি কেন্দ্রের মধ্যে বিতর্কের মাধ্যমেই তাকে পথ চলতে হবে। একে বলতে হবে তার অনুমানের সম্ভাব্যতার কথা। ফলে মানুষের উপরে কোন কিছু চাপিয়ে দেয়ার মত মনের জোর তার কই ?
@আতিক রাঢ়ী, নৈতিকতাকে কোন সংজ্ঞার বেষ্টনীতে বাঁধার কি দরকার? একে প্রয়োজনে পরিবর্তনশীল বহমানএকতা প্রক্রিয়া হিসেবে দেখলেই তো হয়। অন্যান্য প্রাণীর জন্য এটা সত্যি হলেও মানুষের জন্য জন্য শুধুমাত্র প্রজাতির বর্ধনকে আমিও শেষ কথা বলে মনে করি না। প্রাকৃতিক নির্বাচন আমাদেরকে মস্তিষ্ক, বুদ্ধিমত্তা এবং চেতনার সমাহারে এমন এক জটিল প্রাণীতে পরিণত করেছে যে আমরা অনেক সময়েই বিবর্তনের পায়ে বেড়ি পড়াতেও দ্বিধা করি না, এমনকি কখনও কখনও এর বিরুদ্ধেও অবস্থান নেই। আমি আসলে মনে করি আমরা বিবর্তনের ফসল হলেও, বিবর্তনই আমাদেরকে এমনভাবে প্রকৃতিতে সুস্থিত করেছে যে মানুষ হিসেবে আমাদের সার্বিক বিকাশকে আর শুধুমাত্র জৈবিক বিবর্তন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। আমার কাছে মনে হয় প্রজাতিগতভাবে টিকে থাকাটা আমাদের জন্য এখন আর কোন বড় চ্যালেঞ্জ নয় বলেই এগুলো সম্ভব হয়েছে।
ধ্রুবর সাথে আমি একমত যে, প্রজাতির বর্ধনই নৈতিকতার একমাত্র মানদন্ড হতে পারে না আমাদের ক্ষেত্রে। বিবর্তন নৈতিকতার উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করছে কিন্তু বিবর্তনকে নৈতিকতার অথরিটি ভাবার কোন কারণ নেই। আমাদের তো কোন অথরিটির প্রয়োজন নেই। আর একই সাথে ‘পরম উদ্দেশ্য’ বা ‘পরম লক্ষ্য’ বলেও কিছু থাকা উচিত নয়, আমি এগুলোকে আসলে অবৈজ্ঞানিক বলেই মনে করি। জৈবিকভাবে চিন্তা করলে টিকে থাকাটা অবশ্যই প্রধান উদ্দেশ্য, কিন্তু সমষ্টিগতভাবে বিভিন্ন কারণেই টিকে থাকাটা যদি আর ইমিডিয়েট সমস্যা না হয়, তখন আমাদের মত বুদ্ধিমত্তা এবং চেতনাসম্পন্ন একটা প্রজাতি জৈবিক বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় তৈরি করে দেওয়া বাউন্ডারি লাইনের বাইরেও রঙ-তুলির আঁচড় দিতে দ্বিধা বোধ করবে না। আর আমরা সেটাই করছি……
@বন্যা আহমেদ,
আমিও না। টিকে থাকার জন্য বর্ধন সব সময় কাজ নাও করতে পারে। বরং কখন কখন হ্রাস প্রাপ্তি টিকে থাকার জন্য দরকার হয়ে পড়তে পারে।
আল-কায়েদার হাতে পারমানবিক অস্ত্র যেতে দেন, তারপরে বুঝবেন চ্যালেঞ্চ আছে না নাই।
না। আমদের অস্তিত্ত্ব বিপন্ন হয় এমন কাজকে আমরা অবশ্যই বাঁধা দেব। অতীতেও আমরা তাই করেছি। ফলে আমরা টিকে আছি। তেলাপোকাও টিকে আছে। বিবর্তন আগেও আথোরিটি ছিল এখনও আছে। পার্থক্য কেবল আগে আমরা ব্যাপারটা জানতাম না। ফলে বিভিন্ন নাম দিয়ে রেখেছিলাম।
জৈবিক বা অজৈবিক কোন বিবর্তনই আমাদের অস্তিত্ত্বের বিপক্ষে গেলে আমরা তাকে প্রতি্রোধ করবই।ধরুন আমেরিকানরা আর যুদ্ধে যেতে চাইছে না, ফলে সৈ্নিকের চাহিদা পুরনের জন্য সে ভাবলো ভাল সৈ্নিকের ক্লোন করার কথা। এখন এর ফলাফল যাই হোক, আমরা কিন্তু দ্বি্ধা বিভক্ত হব। যারা মনে করবে এটা মানবতার জন্য হুমকি তার এর বিপক্ষে অবস্থান নেবে। নৈ্তিকতা তৈ্রী হতে থাকবে। কিন্তু কিসের সাপেক্ষে সেটা হবে, সেটাই আসল প্রশ্ন ? টিকে থাকার নীতির সাপেক্ষে তা যদি না হয় তাহলে কিসের সাপেক্ষে সেটা হবে, সেটাতো বলে যান।
@আতিক রাঢ়ী,
এখানে অনিশ্চয়তা বোধ হয় একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে। বাস্তবতা হল, ক্লোনিং এর ফল শেষ অবদি কি হবে সেটা আমরা জানিনা। ফলে বাস্তব ক্ষেত্রে নৈতিকতার যেকোন সিদ্ধান্তই অসংখ্য অজানা ভেরিয়েবলের ধোঁয়শায় আচ্ছন্ন। এসব ক্ষেত্রে আমরা দীর্ঘ বিবর্তনীয় ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা প্রসূত যেসব rule of thumb ব্যবহার করি, সেগুলোই নৈতিকতার ভিত্তি। জ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে আগে যা rule of thumb ছিল তা বৈজ্ঞানিক ভাবে সমর্থিত বা অসমর্থিত হয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের এমন পর্যায়ে প্রবেশ করিনি যাতে এই rule of thumb বা heuristic গুলিকে সম্পূর্ণ বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে পারি। বিজ্ঞানের সাথে তাই মানবিক বোধ, আবেগ সব কিছুরই মিশেল প্রয়োজন।
@রৌরব,
খাইসে! এইতো একটা জাজমেন্ট দিয়ে দিলেন। 🙂
দাঁড়ান, সামনে মস্তিষ্কে অপরেশনের ব্যবস্থা করা হবে। মানবিক বোধ আবেগ এগুলোকে উপড়ে ফেলার জন্য। অধিক সংখ্যক মানুষকে এই সার্জারী করতে প্রলুব্ধ করা হবে। তখন আপনার কি অবস্থা হবে দেখতাম চাই। :laugh:
@ধ্রুব,
বাঁচাও!
তবে…
প্রলুব্ধ? কেমন একটা মানবিক আবেগের গন্ধ পাচ্ছি? 😉
@রৌরব,
মহেজ্ঞদারো ও হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ থেকে আমরা শিক্ষা নেই যে সভ্যতা ধ্বংস হয়। কিভাবে বা কেন সেটা হয় তাও জানার চেষ্টা করি। এই জানার উদ্দেশ্য আসলে আমরা কিভাবে নিজেদের সভ্যতাকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে পারি।
ধরুন এটা জেনে আমরা এও জানলাম কিভাবে অন্যের সভ্যতাকে ধ্বংস করতে হবে।কিন্তু অন্যের সভ্যতা ধ্বংসের পিছনে আমাদের উদ্দেশ্য থাকবে নিজের সভ্যতাকে রক্ষা করা। আমাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা গুলো আমদের কাছে মূল্যবান কারন সেগুলি আমাদেরকে টিকে থাকতে সাহায্য করে। rule of thumb গুলি বিবর্তন থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার বাইরের কিছু না। এগুলিকে বাদ দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। বিজ্ঞান এগুলিকে বাদ দেয়ার অবস্থায় পৌঁছায়নি আর কোন দিন সে অবস্থায় পৌঁছাবে বলেও আমার মনে হয় না। প্রতিটা আবিস্কারের সাথে সাথে আমরা এও জানছি যে আমরা আসলে কত কম জানি।
বিজ্ঞান বলে যখন কিছু আমাদের জানা ছিল না, মানবিক বোধ তখনো ছিল। আমরা প্রতিবেশির বাড়িতে আগুন লাগলে পানি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি, কারন আমি চাই, আমার বিপদে প্রতিবেশীও পাশে থাকুক। উদ্দেশ্য কিন্তু সেই প্রাচীন, ঠিকে থাকা, আরেকটু নিরাপদ থাকা। এই প্রবনতাকে মানবিক বোধ বা আবেগ বলা যায় আবার বিবর্তনজাত নৈ্তিকতাও বলা যায়।কোনটা দিয়ে ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, সেটাকেই আমাদের ভেবে দেখা ও গ্রহন করা উচিত।
@আতিক রাঢ়ী,
ব্যাখ্যা হিসেবে সব চেয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই গ্রহণ করা উচিত, অবশ্যই। বাকি কথাগুলোয় একমত।
@আতিক রাঢ়ী,
মানুষের একটি মজার আচরণ হচ্ছে, মানুষ টিকে না থাকতে চাইতে পারে। টিকে থাকতে চাওয়া একটি প্রবৃত্তিগত আচরণ। মানুষ অন্য প্রাণীর চেয়ে অনেক বেশি সজ্ঞান-সচেতন আচরণ দ্বারা প্রভাবিত। মানুষের এসব কনশাস আচরণ কি সব টিকে থাকার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সহজ উত্তর হচ্ছে না। মানুষের এই সজ্ঞান সচেতনতা আরো স্ফীত হচ্ছে। টিকে থাকাটা যে তার প্রদত্ত উদ্দেশ্য, সেটা সে আরো বেশি করে ভুলে থাকার ক্ষমতা লাভ করছে। ক্রিটিক্যাল অবস্থায় পড়লে মানুষের সজ্ঞান-সচেতনতা মুহুর্তে লুকিয়ে যাবে আর টিকে থাকার প্রবৃত্তিগত তাকে পেয়ে বসতে বাধ্য। কিন্তু বাকি সময় কনশাস মানুষ এমন আচরণ করবে যাকে বিবর্তন দ্বারা সামান্যই ব্যাখ্যা করা যাবে।
কনশাস মানুষের বায়াস তাই টিকে থাকা না। সেটা যে কি, বের করা মুশকিল। তবে আমার ধারণা মানুষ ভেদেই সেটা ভিন্ন। পরম কিছু নেই। গড় একটা ঝোঁক বের করতে পারেন। কিন্তু সেটাও সময়ের সাথে বদলাবে। মানুষকে কোন নৈতিকতা প্রভাবিত করবে, এটা একটা একাডেমিক ইন্টারেস্ট। কিন্তু মানুষের উপর কোনো নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা না করাই ভালো। সব নৈতিকতাই জাজমেন্ট দেয়। নিশ্চয়ই জাজমেন্ট দেয়া দুনিয়া নরকের কাছাকাছি।
@ধ্রুব,
কুকুর বা পাখিদের মধ্যেও অত্মহননের ব্যাপার আছে। টিকে থাকতে না চাওয়াটাও মানুষের একক কোন বৈশিষ্ট না। মাত্রাগত পাথক্য আছে কেবল।
আবার যাদের কাছে অবসর এখনো বিলাসিতা, তারা রাত-দিন ছুটছে কেবল আহারের সন্ধানে। টিকে থাকার সংগ্রাম ছাড়া সেখানে কিছুই নেই। গোত্র বা সমাজের কোন সদস্যের অত্মহননের থেকে বাকি সদস্যরা কখনই প্রলুব্ধ হয় না। মুসলিম জংগিদের মধ্য একজনের কাজ অন্যদেরকে প্রভাবিত করে কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে অনন্ত স্বর্গ লাভ। সেই টিকে থাকার বাসনা। টিকে না থাকতে চাওয়ার বাসনা খুবই প্রন্তিক একটা বৈশিষ্ট যা আবার অন্যদের জন্য টিকে থাকার শিক্ষা হিসাবে কাজে দেয়।
গৌতন বুদ্ধের দুঃখ বাদ টিকে না থাকতে চাওয়ার বাসনার বড় উদাহরন। কিন্তু সব মানূষ বুদ্ধের সংঘে যোগ দিক এমন আশা বুদ্ধ কোথাও করেনি। বরং বাকিরা শান্তিতে থাক এটাই তিনি চেয়েছিলান। পরবর্তিতে রামায়নের পরিবার কেন্দ্রিক উচ্ছাসের স্রোতে ভেসে যেতে দেখা গেছে বুদ্ধের দুঃখ বাদকে।
ধরুন, রংধনু আসলে পানির ক্ষুদ্র কনার প্রিজমের মত আচরন। এখন আপনি যদি বলেন, না-সব বাজে কথা, তবে আপনাকেই বলতে হবে রংধনুর আরো গ্রহন যোগ্য কারন। যদি বলেন, বলা মুশকিল, তাহলে কিন্তু হবে না। মানে আপনার বক্তব্য গ্রহনযোগ্য হবে না।
@আতিক রাঢ়ী,
রংধনুর ব্যখ্যা যদি প্রিজম তত্ব গ্রহণযোগ্য নির্ভুলতায় না দিতে পারে তাহলেই সে বাতিল। তার জন্য আরো ভাল বিকল্প ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
@রৌরব,
আমার মনে হয়, প্রিজম তত্ত্বুকে বাতিল করার জন্য, হয় আপনাকে আরো অগ্রসর কোন ব্যাখ্যা হাজির করতে হবে অথবা প্রিজম তত্ত্বের ঠিক আগের ব্যাখ্যাতে আস্থা রাখতে হবে। এর মধ্যবর্তি সময়টা আপনি আপনার ভাবনায় কাটাতে পারেন কিন্তু মানুষ গ্রহন করবে সর্বশেষ গ্রহন যোগ্য ব্যাখ্যাই।
@আতিক রাঢ়ী,
বাজিমাৎ করে দিলেন! ঠিক জায়গায় এসে পৌছে গেছেন, এখানেই থামতে চাচ্ছিলাম বা বলতে পারেন এখান থেকেই শুরু করতে চাচ্ছিলাম। চলুন, এখন তাহলে দেখি জৈবিকভাবে বা প্রাকৃতিকভাবে টিকে থাকা বা প্রাকৃতিক নির্বাচন কি বলছে, যা হচ্ছে বিবর্তনের অন্যতম মৌলিক বিষয়। যোগ্যতমের টিকে থাকা, ঠিক? মানুষের ক্ষেত্রে কি সবসময় তাই হচ্ছে? আজকের আধুনিক সভ্যতা এবং বিজ্ঞান আমাদেরকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে এসেছে যে এই বিষয়টা কেমন যেন মিলেমিশে গুলিয়ে লাবড়া খিচুরি হয়ে যাচ্ছে। দাঁড়ান, বহুদিন ধরে এটা নিয়ে একটা লেখা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল মুক্তমনার সবার সাথে আলোচনা করার জন্য, কালকের মধ্যেই দিয়ে দিচ্ছি, আপনার সাথে তাহলে সেখানে আরও বিস্তারিত আলোচনার হবে……।।
@বন্যা আহমেদ,
খুবই আশার কথা। ধর্মবাদীদের সাথে তর্ক-বিতর্কের কারণে আমরা প্রয়োজন অতিরিক্ত বিবর্তন নির্ভর আলোচক হয়ে আছি। ভবিষ্যতের দিকে তাকানো দরকার।
ওয়েটিং।
@বন্যা আহমেদ,
জম জমাট আরেকটি আলোচনার আভাস দেখতে পাচ্ছি।
অপেক্ষায় বসলাম।
@বন্যা আহমেদ, :yes:
@বন্যা আহমেদ,
সংবিধীবদ্ধ সতর্কিকরনঃ পরিবেশের ভয়াবহ কোন বিপর্যয়ে আমরা বাংলাদেশ বাসির টিকে থাকার সম্ভাবনা অন্য জাতির চেয়ে বেশী। সুতরাং যোগ্যতার স্কেল বহুমুখি। লেখা নামানোর সময় খুব খিয়াল কইরা। 😀
পুরো লেখাটা একটানে পড়লাম। জানতাম এই লেখা সবার ভাল লাগবে। আমি আকাশ ভাইয়ের সাথে একমত। অভিদা লেখায় বোধী লাভ করেছে,
ফলে যেকোন কঠিণ বিষয় তার হাতে গেলে সহজ হয়ে যায়। আভিদা, অনেক অনেক লিখুন। আপনার লেখা আমাদের খুব প্রয়োজন।
@আতিক রাঢ়ী,
আপনার আর আকাশ মালিকের মন্তব্যগুলো সত্যই আমাকে লজ্জায় ফেলছে। লেখার সমালোচনা করুন বরং বোধী টোধী বাদ দিয়ে। বোধী লাভ করতে করতে বুদ্ধু হয়ে যাবো নাইলে! 🙂
@অভিজিৎ,
এট্টু লজ্জা পাওয়া ভাল। মানে বিজ্ঞান যে আপনাকে আবেগ শূন্য করতে পারেনি, সেটা মাঝে মাঝে বাজিয়ে দেখা আমাদের কাজ। 😀
এই বিষয়ের উপরে ডকিন্সের পাঁচ পর্বের (Nice Guys Finish First) একটি ডকুমেন্টেরী রয়েছে। আগ্রহীদের জন্য প্রথম পর্বটি দিলাম এখানে। সেখান থেকে পরের পর্বগুলোও পাওয়া যাবে।
httpv://www.youtube.com/watch?v=-2zlbnwZ4VM&feature=related
@স্বাধীন,
এই ডকুমেন্টরীটার কথা আমি অনেক শুনেছি। ইউটিউবে যে ছিলো তা জানতাম না। খুব ভাল কাজ করেছেন এটি দিয়ে। বস্তুতঃ এটা দেখার পর এতোই গুরুত্বপূর্ণ মনে হল যে, আগে যদি এটার উৎসের কথা জানতাম তবে নির্ঘাত আমি মূল লেখায় ব্যবহার করতাম!
সার্থপরতা থেকেই কীভাবে পরার্থিতার উদ্ভব হয়েছে তা বুঝতে এই পাঁচ পর্বের ডকুমেন্টরিটি অনন্য।
যাহোক এখানে অন্য পর্বগুলোর লিঙ্কও রেখে যাচ্ছি।
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব
@অভিজিৎ,
এখনো মূল লেখায় ব্যবহারে তো আমি কোন বাঁধা দেখছি না। তাতে যদি লেখাটি পরিপূর্ণতা পায় তবে আমি বলবো অবশ্যই ব্যবহার করা উচিত। অনেক ক্ষেত্রে বই পড়ে, বা লেখা পড়ে বা শুধু অডিও শুনে যতটা না বুঝা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি বুঝা যায় যখন অডিও এর সাথে ভিউজুয়াল কিছু থাকে। আমি বলবো এই ডকুমেন্ট্রীর কথা আপনার বই বা লেখায় উল্লেখ করতে পারেন। এটা যেন অন্তত ব্লগে থাকে তাই আমি যুক্ত করে দিয়েছিলাম।
অভিদা, গত পর্বেই দারুন জমেছে আলোচনা। এইপর্ব আরো শানিত করল সহোযোগিতা বা পরার্থিতার খেলার ধারণাকে। এমন লেখায় কেবল প্রগাঢ় অভিনন্দন জানিয়ে গেলাম। স্যালুট ফর ইউ। :rose2:
কিভাবে যেন আপনার বক্তব্যগুলো খুব সহজেই আমার চিন্তাগুলোর সাথে মিলে যায়। সাম্প্রতিক কালের জীবিত বিবাহিতই কেবল ব্যতিক্রম লেগেছিল।
@নীল রোদ্দুর,
চমৎকার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আর জীবিত বিবাহিত নিয়ে এতো পেরেশান হবার কিছু নেই, বিষয়টি আমার মতোই এখন মৃত!
আপনি লেখা দিচ্ছেন কবে?
@অভিজিৎ, ‘মৃত’ যদি তোমার মত ‘জিন্দা’ হ্য় তাহলে মৃতের সংজ্ঞাই পালটায় দিতে হবে… ‘জিন্দা’রাতো এরকম ‘সরব’ এবং ‘সদাসচল’ ‘মৃত’ দেখে লজ্জায় মৃত্যুবরণ করবে!!!!
মিথ্যে বললে সেই ব্যক্তি যে বাড়তি সুবিধে পাবে সেটা নিয়ে দারুণ একটি মুভি আছে (The invention of lying)। যদি দেখা না থাকে দেখে ফেলুন। আমার খুব খুব ইচ্ছে ছিল কয়েকটি মুভি নিয়ে একটি লেখা দেওয়ার। কিন্তু সময় একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার জন্য।
মুভিটির ট্রেইলার দিলাম এখানে।
httpv://www.youtube.com/watch?v=a-H2dNfx-Uw
অভিজিৎ’দা
এই লেখাটিকে আপনার সবগুলো লেখার মধ্যে অন্যতম হিসেবে রাখবো আমি। হয়তো অনেকদিন থেকেই যা যা চাচ্ছিলাম ঠিক সবগুলোওই এই লেখায় পেয়ে যাওয়াতে সেরকম লাগছে। অসাধারণ হয়েছে, বিশেষ করে এই পর্বটি।
মুক্তমনায় বিবর্তন নিয়ে জানার পর থেকে, বিবর্তনীয় মনোবিদ্যা নিয়ে পড়ার পর থেকে, এই বিষয়ে বাংলায় ভালো কিছু লেখার অভাব বোধ করছিলাম এবং এই বিষয়ে সবচেয়ে ভাল লিখতে পারেন একমাত্র আপনি এবং বন্যা’পু। আপনার মনে আছে কিনা জানি না, তবে আমি প্রায়ই প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে আপনাদেরকে এই বিষয়ে লেখার জন্য বলে যেতাম। কথা হল যে নিজেও লিখতে পারতাম, কিন্তু সেটা আপনাদের মত হতো না জানতাম। এখন সেই অভাব পূরণ হলো। আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ সে জন্য। এখন এটাকে বই আকারে বের করে ফেলুন এই বইমেলায়। অগ্রীম অভিনন্দন রইল তার জন্য। তার আগে কষ্ট করে ই-বুক করে ফেলুন, রেফারেন্স এর জন্য কাজে লাগবে।
@স্বাধীন,
ধন্যবাদ স্বাধীন। বলা যায় আপনার খোঁচাখুঁচি এবং অনুপ্রেরণাতেই কিন্তু এই লেখাটার সূত্রপাত। আপনি এমনভাবে না গুতালে এটা আসলে লেখা হতো না। এখন বুঝতেছি – ব্যাপারটা আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণই ছিলো।
@অভিজিৎ,
ধন্যবাদ আপনাকেও।
@অভিজিৎ,
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ রয়ে গেল। বাদ হয়তো অনেক কিছুই রয়ে যাবে, সব কিছু কাভার করা হয়তো একেবারে সম্ভব হবে না। যদি সম্ভব হয়, এই সম্পর্কে কোন লেখা দাঁড় করাতে পারেন। তা হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে এবং সুখ, কিংবা দুঃখ কিংবা অনুভুতি যেমনঃ কান্না, হাসি এগুলো কিভাবে মানুষের জৈবিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত সেগুলো নিয়ে একটি অধ্যায় হতে পারে। মস্তিষ্কের কার্যপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছুটা লিখেছিলাম সচলে আমার জীবনের উদ্দেশ্য ও ইন্সেপশান নিয়ে লেখায়। তবে সেখানে অল্প কথায় সেরেছিলাম। আগের কোন এক লেখায় evolutionary psychology নিয়ে একটি বইয়ের কথা বলেছিলাম। হয়তো আপনি আরো ভাল কোন রেফারেন্স খুঁজে পাবেন নিশ্চিত। তবে অনুরোধ রইল মানবিক অনুভূতিগুলো কিভাবে কাজ করে সেসম্পর্কে পারলে লিখবেন। আর মস্তিষ্ক কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয় সেটা নিয়েও। কারণ গেম থিউরি আর টিট ফর ট্যাট যাই বলি না কেন শেষ পর্যন্ত এই মস্তিষ্ককেই সেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই সেটা কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে কিছু ধারনা দেওয়া ভাল। তাড়াহুড়া নেই, সময় করেই লিখুন। আমার কাছে মনে হয় এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভাল থাকুন।
@স্বাধীন,
এই দাবী আমারও। মস্তিষ্কের ফাংশানটা কিভাবে আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। কনশাসনেস জিনিসটাই বা কি? কোথায় বাস করে? যুক্তিহীন আবেগকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার জন্য মস্তিষ্কের কোন কোন জায়গা ছেঁটে ফেললেই চলবে, ইত্যাদি। 🙂
@স্বাধীন,
আমার শুধু শুধুই মনে হয়, মূল ব্যাপার দুটোইঃ- পদার্থ এবং রাসায়নিক ক্রিয়া। রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে ধীরে অতি ধীরে জীবের উতপত্তি (এসেছে জীব বিদ্যা)। জীবের অভ্যন্তরে রাসায়নিক ক্রিয়ার শেষ নেই। হবেও না। এই ক্রিয়া থেকেই কেমিক্যাল সিক্রেশন – ফলে অনুভূতির রদ-বদল। একই মানুষ আজকে মানবপ্রেমী এবং কালকে খুনী। (এই রাসায়নিক ক্রিয়াকে কোন বিস্ফোরণ মনে করি না। ধীরে – শান্ত চিত্তে হয়তো খুবই nano লেভেলে।)
আপনার
বইটার একাদশ অধ্যায় একবার পড়েছি। আবারও পড়তে হবে। evolution এর উপর কোন রসায়ণবিদের লেখা আছে কি? তারা বোধ হয় ভিন্ন আলোকে ব্যাখ্যা করবেন।
ধন্যবাদ।
(ডঃ অভিজিতের এই লেখাটি এখনও পড়ে শেষ করতে পারিনি)
(১) নৈতিকতা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে রুল, গাউডবুক ইত্যাদি।
(২) এই রুল বুক বা গাইডবুক ঠিক না বেঠিক-তা নির্ভর করে ব্যাক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্র জীবনের উদ্দেশ্যকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করছে-জীবনের উদ্দেশ্য ছারা নৈতিকতার স্বতন্ত্র কোন অস্তি্ত্ব নেই।
(৩) যেহেতু জীবনের কোন পরম উদ্দেশ্য নেই-সব উদ্দেশ্যই একটি আপাত এবং স্বনির্দেশিত-সেহেতু নৈতিকতার কোন বৈজ্ঞানিক বা যুক্তিবাদি ভিত্তি থাকতে পারে না। কিন্ত নৈতিকতার গণতান্ত্রিক জৈবিক বা ধার্মিক ভিত্তি থাকতে পারে। এবং নৈতিকতাতে আমরা যেভাবেই পৌঁছায় না কেন, সেটিকে যুক্তিবাদি ভিত্তি বলা সম্ভব না-কারন জীবনের কোন পরম উদ্দেশ্য নেই বা তার যুক্তিবাদি ভিত্তি ও নেই।
(৪) ধার্মিক বা বিবর্তন ভিত্তিক নৈতিকতা মোটেও আলাদা কিছু না। ধার্মিক নৈতিকতার পেছনেও সেই রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস কাজ করেছে। অতীতে অসংখ্য ধার্মিক নৈতিকতা তৈরী হয়েছে-সেগুলো হারিয়ে গেছে-নির্বাচিত হয় নি। সুতরাং যেটা আমরা বলবো-সেটা এই যে ধার্মিক নৈতিকতা এক কালে প্রসঙ্গিক ছিল-বর্তমানে তা নেই। কারন সেই রুল বুক দিয়ে বর্তমান কালে নিজের কবর খোঁড়া যায় বড় জোর। সব নৈতিকতার এখনো পর্যন্ত একটাই ভিত্তি -সমাজ বা ব্যাক্তির রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস। ধর্মীয় নৈতিকতা বিবর্তন নৈতিকতার বাইরে আলাদা কিছু না।
কালকেই খবরে পড়লাম-ভারত এবং বাংলাদেশ আবাহাওয়া জনিত পরিবর্তবনের কারনে পৃথিবীর সব দেশের থেকে বেশী ভালনারেবল-মানে ক্ষতি সব থেকে বেশী হবে এই দুটি দেশে। কারন হিসাবে অধিকতর জন সংখ্যা এবং তার জন্যে দুর্বল আইনের সরকারকে দায়ী করা হয়েছে। সরকারের পরিবেশ বিমুখতাকেও দায়ী করা হয়েছে।
তাহলে এই মুহুর্তে ভারত এবং বাংলাদেশে সম্পূর্ন বিজ্ঞানভিত্তিক এক রাষ্ট্র এবং সমাজ তৈরী করতে না পারলে-এই দুটিদেশের কপালে অসম্ভব দুঃখ আছে। সেই ক্ষেত্রে কোরান বা ব্যাদে বিজ্ঞান পাওয়া পি এচ ডি ধারী ছাওয়াল বা ছাগলদের দিয়ে ( ভারত বা বাংলাদেশে এরাই সংখ্যাগুরু) এই রাষ্ট্রগুলিতে বিজ্ঞানচেতনা আসবে না। নতুন নৈতিকতার জন্ম-যা আমাদের বাঁচতে সাহায্য করবে তা আসন্ন।
@বিপ্লব পাল,
আমার মনে হয় এখানে তুমি নৈতিকতা, সামাজিক প্রথা, উদ্দেশ্য, পরম উদ্দেশ্য সব গুলিয়ে ফেলছো আর সেজন্যই একই কথা বারবার চলে আসছে। খুব সাধারণ একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি আরেকবারঃ
– পরার্থিতা নামক আপাত (অভার আর্চিং) ব্যাপারটাকে যদি একটা নৈতিকতা বলে ধরি তাহলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে এর একটা বিবর্তনীয় ( এ কে এ জৈবিক বা বৈজ্ঞানিক) ভিত্তি আছে, এটা আকাশ থেকে পড়া কোন স্বর্গীয় বৈশিষ্ট্য নয়। এতদিন ধার্মিকেরা বলে এসেছে এই গুনাবলীগুলো ধর্মীয় সম্পত্তি, এর উদ্ভব ঘটেছে ধর্মীয় ভিত্তি থেকে। এখন বোঝা যাচ্ছে সেটা ভুল, এর জন্য কোন ধর্মীয় ভিত্তির প্রয়োজন নেই। এখন এই নৈতিকতাকে ‘উদেশ্য’র সাথে গুলিয়ে ফেলা ভুল হবে, ধর্ম একে স্বর্গে যাওয়ার বাহন হিসেবে ব্যবহার করে এর পিছনে একটা ‘ধর্মীয় উদ্দেশ্য’ জুড়ে দিয়েছে যেটা শুধু ভুলই নয়, বড় ধরণের প্রতারণাও বটে। টিকে থাকার জন্যই এর উদ্ভব ঘটেছে, এবং খুব সহজেই তাকে বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়েই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান এর উদ্ভব কিভাবে কেন হয়েছে তার ব্যাখ্যা দিচ্ছে, প্রয়োগের রীতিনীতি বা পদ্ধতির নয়, তার জন্য আমাদের পরের স্তরে যেতে হবে।
এখন আসি এই নৈতিকতার প্রয়োগ কিভাবে হচ্ছে, সেটার জন্য বিভিন্ন ‘প্রথা’র উদ্ভব ঘটেছে, যেটাকে ‘সামাজিক’, ‘ধর্মীয়’, ‘গনতান্ত্রিক’, ‘সামন্ততান্ত্রিক’ যে লেবেলই দেওয়ার চেষ্টা কর না কেন। আমার মতে সর্বাঙ্গীণ রিপ্রডাক্টিভ ফিটনেসই বল আর টিকে থাকাই বল, এর জন্য দরকার নৈতিকতার বাস্তবায়ন, আর সেখানেই চলে এসেছে প্রথা। এই প্রথাগুলো সময়ের সাথে সাথে বদলা, বিভিন্ন সময়, পরিবেশ, সমাজ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ইত্যাদির সাথে তাল মিলিয়ে টিকে থাকার জন্যই এগুলোর বদলানোর প্রয়োজন পড়ে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে নৈতিকতা বজায় রাখার জন্য যে প্রথাগুলোকে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল সেগুলো আজকের দিনে আর প্রযোজ্য নাই হতে পারে। আর সেখানেই ধর্মের অসাড়তা বেরিয়ে আসে, ধর্ম বলে এই প্রথাগুলো স্থির, দুই হাজার বছর আগে যেভাবে এর প্রয়োগ ঘটেছিল এখনো সেভাবেই ঘটবে। ধর পরার্থিতা বাস্তবায়ন করার জন্য কোন ধর্ম জাকাত দিতে বলছে, কোরবানী করে মাংস বিলিয়ে দিতে বলছে, কোন ধর্ম চার্চের মাধ্যমে বিভিন্ন চ্যারিটি করছে, কিন্তু সব ধর্মেই কম বেশী এধরণের বিলিয়ে দেওয়ার কথা বলা আছে। আজকের সমাজ ব্যবস্থায় জাকাত, কোরবানী, চার্চ বা মন্দিরের মাধ্যমে চ্যারিটির মূল্য আগের মত আর নাও থাকতে পারে, কিন্তু পরার্থিতার ব্যাপারটা কিন্তু থাকছেই। আজকের পুজিবাদী সমাজ ব্যবাস্থায় বেশী হারে ট্যাক্স প্রদানের মাধ্যমে আমরা বেকার ভাতা, ফ্রি স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা, শিক্ষাব্যাবস্থা, হোমলেসদের জন্য ফুড ব্যাঙ্ক তৈরি করার কথা ভাবছি। আসলে যে পুরোনো প্রথাগুলো টিকে থাকতে আর সাহায্য করবে না তাদের বদলাতেই হবে, না হলে আমাদের অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি পড়ে যেতে পারে।
আর পরম উদ্দেশ্যর কথা কেন বারবার নিয়ে আসছো সেটা কিন্তু বুঝছি না, এটা নিয়ে আগেও বিতর্ক হয়েছে। এখানে আমার মতে ‘পরম উদ্দেশ্য’র ব্যাপারটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক, এগুলো তো ধর্মিকেরা বলে থাকে আর সেজন্যই এই বিষয়গুলোকে বৈজ্ঞানিকভাবে দেখাটা এত জরুরী।
কি আশ্চর্য, এতক্ষণ না বললে যে নৈতিকতাকে যুক্তি বা বিজ্ঞান দিয়ে বোঝার দরকার নেই… এ তো দেখছি উলটো কথা হয়ে গেল।
@বন্যা আহমেদ,
এখানে এবার তুমি গোলাচ্ছে। আগে ত টিভি ইন্টারনেট ছিল না-কোন নৈতিকতা বা কিছু চাপাবার সহজ পন্থা ছিল ঈশ্বরের নামে চালানো। নইলে সেই মিম টা ভাইরালি ছড়াত না। ঈশ্বরের নামে চালানোর এই ভাইরাল পদ্ধতিটাত পশুকুলে নেই-মানব কূলে বিবর্তনের পথেই জন্মেছে। আমার বক্তব্য ছিল সেটাই। তোমাকে বুঝতে হবে ঈশ্বর বা ধর্ম একটি ভাইরাল মিম যা “নৈতিকতার” কে ধারন করে-এবং এটিও বিবর্তনের পথেই এসেছে।
মোটেও সেটা বলি নি। বলেছি-যুক্তি দিয়ে বলা সম্ভব না এই নৈতিকতাই পরম সত্য বা পরম গ্রহনযোগ্য-যেটা ধর্মের একটা প্রবল দাবি।
যেটা এখানে বলেছি সেটা এই যে-ধর্মের নৈতিকতার জন্ম ও মানুষের
[এক বা গ্রুপ] রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস বাড়াতে-সেটা বর্তমানে না বদলালে এবং বিজ্ঞানমূখী না হলে, নৈতিকতার সাধারন বা ঐতিহাসিক উদ্দেশ্যটি নষ্ট হবে।
@বিপ্লব পাল,
কিন্তু আমারতো মনে হচ্ছে জীবনের পরম উদ্দেশ্য হলো জিনপুল রক্ষা। মানে কদিনের আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে এসেছি। প্রানীকূল সচেতন, অসচেতন বা অবচেতনে এই কাজই করে, মানে নিজের জিনপুলকে রক্ষার কাজ করে।
এক্ষেত্রে মানূষ বা তেলাপোকায় কোন পার্থক্য নেই। উদ্দেশ্য আমরা নির্ধারন করি না। উদ্দেশ্যটা আসলে নির্ধারিত। বলা যায় রুল অফ নেচার। তাহলে একে কেন পরম উদ্দেশ্য বলবো না ?
একমত যে, ধর্মের নামে যে ভাল কাজের নির্দেশ দেয়া হতো তা আসলে ঐ সময়ের জন্য রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস দিয়েছিল, ফলে তা প্রায় সবার দ্বা্রা ততকালিন সময়ে গৃহীত হয়েছিল। এখন যেমন বিজ্ঞান আমাদের কে বলে দিচ্ছে কোন কাজে আমাদের ভাল হবে। ফলে ধর্মগুলিও নিজেদের সত্যায়নের জন্য ছুটছে বিজ্ঞানের কাছে।
@আতিক রাঢ়ী,
আপাত “পরম” উদ্দেশ্য । পরম উদ্দেশ্য কি করে হবে? সবই ত এককালে বিনাশ হবে। যেবিন্দুতে মহাবিশ্বের শুরু সেই বিন্দুতেই সব শেষ হবে।
@বিপ্লব পাল,
কথাতো হচ্ছে জীবনের পরম উদ্দেশ্য নিয়ে। মহা বিশ্বের শুরু বা শেষে জীবনের কোন ভূমিকা নেই। জীবের বিকাশ না হলেও মহা বিশ্বে্র কিছু হের-ফের হবার কথা না।
যদিও আমি ব্যাক্তিগত ভবে মহাবিশ্বে্র শুরু বা শেষের ধারনাকে ধারন করতে এখনো অক্ষম। ইয়স্তেভ গার্নার তার সোফিস ওয়ার্ল্ড ,যে বাক্যের মাধ্যমে শেষ করেছেন, আমরো সেই একই কথা, মহা বিশ্বে্র উৎপত্তির কারন যদি বিগ ব্যাং না হয়ে একটা কমলা লেবুও হত, প্রশ্নটা তখনো থেকে যেত যে, কমলা লেবুটা এলো কোথা থেকে।
@আতিক রাঢ়ী,
ঠিক তাই। আর এই জন্যেই মানুষ হচ্ছে সব দর্শনের সিঙ্গুলার পয়েন্ট। আরে সেই জন্যেই যেহেতু মানুষ নিজেই একটা সিঙ্গুলারিটি-সে নিজের জীবন দর্শন যা ঠিক করবে-সেটাকে ঠিক বা বেঠিক বলা “পরম” সত্যের নিরিখে সম্ভব না।
কিয়ার্ডগার্ডের ধর্মীয় অস্তিত্বতাবাদ এখান থেকেই শুরু হয়-ঈশ্বর থাকা বা না থাকা যেহেতু সম্পূর্ন মানুষ নির্ভর-তাই কেও ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে, সে ভুল করছে, এই দাবীটা আমরা করতে পারি না।
@বিপ্লব পাল,
আমার কাছে এখনো মনে হয় পরম উদ্দেশ্যের প্রশ্ন অবান্তর। তবে এই শব্দের ব্যবহার তার অনুমিত অর্থের উপর নির্ভর করে। দর্শনে এই এক সমস্যা। আপনি প্রিমাইসগুলো সব যথার্থভাবে ডিফাইন না করলে অর্থের আয়্ম্বিগুইটি থেকে যায়।
ব্যক্তি মানুষ সচেতনভাবে তার উদ্দেশ্য চয়নে মুক্ত। সে যদি এমন উদ্দেশ্য নেয় যার সাথে জিনপুল রক্ষার উদ্দেশ্য সংঘাতময়, তখন কি বলা যাবে যে সে একটা ইনফেরিয়র উদ্দেশ্য বহন করে? পরম উদ্দেশ্যের অস্তিত্ব থাকলে এটা বলা যাবে। তখন হিটলাররা এর সুযোগ নিতে পারে। বিজ্ঞান দিয়েও পরম উদ্দেশ্য বের করা সম্ভব নয় বলেই অভিমত পোষণ করি। ইসলাম যেমন মনে করে যে একটা পরম উদ্দেশ্য আছে, এবং তেমনটা মনে করে দেখেই যাদের উদ্দেশ্য ইসলামিক পরম উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক, তাদেরকে ইনফেরিয়র হিসেবে দেখতে পারে, তেমনি বিজ্ঞান দিয়েও যদি একটা পরম উদ্দেশ্য বের করা সম্ভব হয় – যেমন জিনপুল রক্ষা, তখন বিজ্ঞানকেন্দ্রিক অথরিটির পক্ষে সম্ভব হবে মানুষের নিজের উদ্দেশ্য নির্বাচনের মুক্তিতে বেড়ি পরানো। ভাগ্গিস সেটা সম্ভব না।
কেবল বলা সম্ভব হবে, যে জিনপুল রক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক উদ্দেশ্য বহন করে, যে বিবর্তনের সাপেক্ষে একটা ইনফেরিয়র উদ্দেশ্য বহন করে। মানে যদি ধরে নেই বিবর্তন অথরিটি। মানে এই পরম উদ্দেশ্যও আসলে আপাত, সাপেক্ষ অর্থে, ঠিক পরম অর্থে পরম নয়। কারণ বিবর্তনকে (যদিও বিবর্তনই নৈতিকতার উত্স) নৈতিকতার অথরিটি মনে করা একটা ফ্যালাসি।
ব্যাপারটা প্লেটোর ইউথাইফ্রোর সঙ্কটের সাথে তুল্য। কেবল ঈশ্বরের বদলে বিবর্তনকে আর নৈতিকতার জায়গায় জিনপুল রক্ষার উদ্দেশ্যকে কল্পনা করতে হবে। মানে জিনপুল রক্ষার উদ্দেশ্য বিবর্তনের একটি সৃষ্টি কেবল, এর মাঝে অসাধারণত্বের (ভালো, খারাপ, পরম) এমন কিছু নেই।
@বিপ্লব পাল,
এই জায়গাটায় আসলেই গুলিয়ে ফেলেছ। নৈতিকতার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি নেই সেটা নিয়ে দার্শনিক আলোচনার জন্য লেখাটা লেখা হয়নি (এ ধরণের সমস্যা নিয়ে ধ্রুব চিন্তিত,আমি নই), লেখা হয়েছে জীবজগতে পরার্থিতা আর সহযোগিতার জৈবিক উৎস সন্ধান করে। অন্য প্রানীজগতে যদি বিবর্তনের পথে পরার্থিতার উদ্ভব হয়ে থাকে, তবে ব্যাপারটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়া অসম্ভব কিছু নয়। তাই দেয়া হয়েছে।
@বিপ্লব পাল,
ভুল করে ডিজলাইক দিয়ে দিয়েছি। ভাবছিলাম লাইকটা আমার কিনা। সেটা পরীক্ষা করতে গিয়ে ডিজলাইক-এ চাপ দেয়ায় ফেঁসে গেছি :((। 😀
ভাল লাগল। আশা করি শুধু বিবর্তন নয়, গেম থিয়োরি সম্বন্ধেও এই লেখা আগ্রহের সৃষ্টি করবে।
মন্তব্য:
একটা জিনিস আমার কাছে অপরিষ্কার রয়েছে। সেটা হচ্ছে “ইট-পাটকেল” এবং রক্তের মিথষ্ক্রিয়ার একটি পরিমাণগত ব্যাখ্যা। কতদূর পর্যন্ত রক্ত সম্পর্ক “ইট-পাটকেল” কে হটিয়ে দেয়? “স্বজাতি”-র সংজ্ঞা কি? এটা কি গেম থিয়োরি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়?
অানী-ধানীর উদাহরণের পয়েন্ট সিস্টেমের মূল্য টা বুঝতে পারলাম না। ১০০ পয়েন্ট দিয়ে কি করব আমি?
এই অংশে কিছু জিনিস বুঝলাম না। প্রথমত, মনে হচ্ছে র্যাপোর্ট এর বয়স সত্তরের মত ছিল আশির দশকে। দ্বিতীয়ত, আশির দশকের প্রথমে প্রথম প্রতিযোগিতা, এবং তার কয়েক বছর পরে দ্বিতীয় প্রতিযোগিতা হলে এর উপর ভিত্তি করে ৮২ সালে বই লেখা সম্ভব হল কিভাবে?
এবং সবচেয়ে গর্হিত…
আরব্য রজনীর গল্প ফেঁদে বসলেন যে! স্ত্রী শিম্পাঞ্জীদের “নারী” বলা কি ঠিক 😀 ?
@রৌরব,
এইতো একটা ভালো মন্তব্য পাওয়া গেলো। অনেক ধন্যবাদ!
এটা আসলে বলা মুশকিল। আমি যতটুকু জানি, (এবং আগের পর্বে উল্লেখ করেছি) হ্যামিলটনের সূত্রে r যত বেশী হবে, তত বেশি হবে পরার্থিতাসূচক মনোভাব। রক্তচোষা বাদুরদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কাছের জেনেটিক সদস্যরা – যেমন মা বাবা সন্তান, ভাই বোন এর ক্ষেত্রে স্বজাতি নির্বাচন বিনিময়ী পরার্থতাকে অতিক্রম করে যায়। অর্থাৎ, তাদের মধ্যে কেউ আগে রক্ত খাওয়াক আর না খাওয়াক, তাদের বিপদে বাদুড়েরা সাহায্য করে থাকে। আর অন্যদের ক্ষেত্রে টিট ফর ট্যাট থেকে সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এমন অনেক প্রাণী আছে যারা ‘স্বজাতিকে’ আরেকটু বড় পরিসরে চিন্তা করে। যেমন ভার্ভেট বানরেরা তাদের প্রজাতির কেউ আক্রান্ত হলে শিস বাজিয়ে সতর্ক করে, কিন্তু তারপ্রেও সেতা কেবল নিজ প্রজাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কোন খরগোশ বিপদে পড়লে শিস বাজায় না কিন্তু! এদের ক্ষেত্রে স্বজাতির সংজ্ঞা হয়তো প্রজাতির সংজ্ঞায় গিয়ে ঠেকবে।
এই পয়েন্ট সিস্টেম পুরোটাই কাল্পনিক। ব্যাপারটা সাধারণ পাঠকদের সহজে বোঝানোর জন্য করা হয়েছে। আপনি গানিতিক ভাবে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে চাইলে এখানে এবং এখানে দেখতে পারেন।
পয়েন্টের পুরো ব্যাপারটা আসলে পরিস্থিতি নির্ভর। ডকিন্স তার সেলফিশ জিন বইয়ে একটা চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন, সময় নষ্ট করা জন্য -১০ পয়েন্ট বরাদ্দ হয়েছে, আর মারাত্মক আহত হবার জন্য -১০০। কিন্তু শীতপ্রধান কোন অঞ্চলে যেখানে সূর্যের আলো একটা বড় ফ্যাক্টর, সেখানে সময় নষ্ট করাটা অনেক বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে। দিনের প্রতিটি মিনিটই তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো সেখানে সময় নষ্ট করার পয়েন্ট -৫০ বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে… এই রকম আরকি!
আমার মতে নারীই হওয়া উচিৎ। আর নারী শিম্পাঞ্জীতে সমস্যা কি? ‘স্ত্রী’ শব্দটাতে একটা বউ বউ ভাব আছে। আপনাদের এই এক সমস্যা। সবাইরেই নিজের বউ বানায় ফেলেন, সেটা তিন্নি/ প্রভাই হোক, আর বেচারা শিম্পাঞ্জীই হোক! 😀 । এর চেয়ে নারী শব্দটা অনেক নিরপেক্ষ!
@অভিজিৎ,
কিন্ত হ্যামিল্টনের সূত্র static ধরণের, আগে পাওয়া উপকার তার মধ্যে বিধৃত নেই। যাহোক, এর একেবারে গাণিতিক ফর্মুলা পাওয়া যাবে, সেটা আমি ঠিক আশাও করিনি, কিন্তু প্রশ্নটি কৌতুহল উদ্রেককারী।
লিংকগুলি পড়তে হবে, কারণ কিছু প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। গেম থিয়োরিতে সাধারণত রেশনাল এজেন্ট এবং সব “খেলোয়াড়”-এর কাছে পুরো তথ্য আছে এটা ধরে নেয়া হয়, বিবর্তনে কিভাবে এটাকে এড়ানো হয়েছে সেটা জানা দরকার।
আরেকটা মন্তব্য যেটা আগে করতে ভুলে গেছিলাম। “অক্ষশক্তি” কথাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য প্রযোজ্য বলেই জানতাম।
@রৌরব,
আপনার ধারনা সঠিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিলো ‘মধ্যশক্তি(Mittelmächte/central powers)’ বনাম ‘মিত্রশক্তির (allied powers)’ । ‘মধ্যশক্তি’ এবং ‘অক্ষশক্তি’ নামকরণের অবকাশ ক্ষেত্রবিশেষে সুনির্দিষ্ট এবং সীমিত।
অনেক কিছু জানতে পারলাম। অভিজিৎদার লেখা পড়েই আসলে আমার বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এই পর্ব গত পর্বের চেয়ে ভালো লেগেছে আমার; অনেক যুক্তিপূর্ণ এবং কৌতুহলউদ্দীপক মনে হয়েছে।
ইট-পাটকেল খেলা চলছে বেশ
অভি’দার সিরিজও জমেছে বেশ 😀
@নিটোল,
আর মন্তব্যও জম্পেশ! 😀
জানার জন্য এই লেখাটা গুরুত্বপূর্ণতো বটেই, তাছাড়া এই বিষয়ে আরো কাজ করা দরকার।
ধর্মবাদীরা বিজ্ঞানের ফ্রন্টে হারতে হারতে শেষে নৈতিকতা, ভালবাসা– এধরনের ফিলসফিক্যাল বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ বিষয়গুলোর প্রকৃত বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যখ্যাও সব সময়ে দেয়া যায়না।
এ ধরনের লেখাগুলো সেই পথকে প্রসস্ত করবে।
আমার নিজের জন্যেও অনেক ভালো হয়েছে লেখাটা। অনেক লোকের অনেক উত্তর সময়ের এবং জ্ঞানের অভাবে দিতে অসুবিধা হচ্ছিল।
ধন্যবাদ অভি দা।
@bokolom,
হাঃ হাঃ, তা তো বুঝলাম, কিন্তু আপনার নাম ইংরেজী হরফে হয়ে গেলো কেন। আমি শিওর না লিখতে লিখতে লগইন একাউন্ট গ্যাছেন ভুইলা। অমাবশ্যার চাঁদের মত হঠাৎ হঠাৎ উদয় হইলে এমনই হয়।
নিয়মিত লিখবেন আশা করি!
পড়ে বেশ ভাল লাগল। অতি প্রয়োজনীয় একটি লেখা ।
@সৈকত চৌধুরী,
ধন্যবাদ! অতি প্রয়োজনীয় মন্তব্যের জন্যও ধন্যবাদ!
@অভিজিৎ রায়,
প্রবন্ধটিতে আপনি চমৎকারভাবে সূক্ষ বিশ্লেষণের অনন্য পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে ‘বিবর্তনের দৃষ্টিতে নৈতিকতার উদ্ভব’ জ্ঞানপিপাসু পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেই শুধু ক্ষান্ত হননি , বরং আধুনিক বিজ্ঞাননির্ভর বিশ্লেষণী দর্শনের হাতে ‘মহাদেশীয় দর্শনের’ ক্রমান্বয়ে পরাজয়বরণ ও তার নিশ্চিত মৃত্যর ঘণ্টাধ্বনি আরো একবার শোনালেন।
মুক্তমনা লেখকদের কাছে পাঠকেরা ঠিক এরকম উঁচুমানের বিজ্ঞান নির্ভর লেখাই আশা করে।
@সংশপ্তক,
ধন্যবাদ। কিন্তু আমি কিন্তু সত্যই মনে করি আমার লেখার চেয়ে আপনার মন্তব্য অনেক উঁচুমানের। অনেকেই কিন্তু আপনাকে লিখতে বলছে। আমি নিঃসন্দেহ যিনি এমন জ্ঞানগর্ভ মন্তব্য করার ক্ষমতা রাখেন, তার লেখা ততোধিক সুন্দর হবে। কেবল মন্তব্যের ভিতর পড়ে না থেকে লিখে ফেলুন না আমাদের জন্য এইবারে।
সিরিজটা দুই পর্বে সীমাবদ্ধ রাখব বলে মনস্থ করেছিলাম। এখন দেখছি এই পর্বটা অতিরিক্ত বড় হয়ে গেছে…
কী আর করা!
@অভিজিৎ,
অভিজিৎ দা,
মিথ্যে কথা বলা পাপ তাই মিথ্যে বলবোনা। সত্যি বলি আমি অনেক বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা মনযোগ দিয়ে সম্পূর্ণ পড়িনা। দরকারও নেই। আল্লাহ বৈজ্ঞানিক পয়দা করছেনই তার ঈমানদার বান্দাদের খেদমতের জন্যে। কিন্তু এই লেখাটা সম্পূর্ণ না পড়ে পারলাম না। কয়েকবার পড়লাম আর ভাবলাম এর মূলে আছে সহজ ভাষায় উপস্থাপনার যাদু। অনেকেই আমাকে বিজ্ঞানে বেসিক জ্ঞান না থাকার অপবাদ দিয়ে গলা ধাক্কা দিয়ে ক্লাস থেকে বের করে দেন। আমার তো বেসিক জ্ঞান নেই কিন্তু এই লেখাটি পড়তে বুঝতে কোনই অসুবিধে হয়নি। বিজ্ঞানের আসরে আমার মত পাঠকদের উপস্থিতি কামনা করলে উপস্থাপনা হওয়া চাই, বন্যা আহমেদ ও অভিজিতের মত।
অভিজিৎ দা, আপনি ইচ্ছে করলে এই প্রবন্ধের কিছু কিছু বাক্য ও শব্দের বাংলা ব্রাকেটে দিতে পারতেন, দিলে ভাল হত সুন্দর হত যেমন- Do unto others, as you would have them do unto you.
ঠিক যেমন দিয়েছেন এখানে-
এই অনুপাতই এক্ষেত্রে বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল (Evolutionary stable strategy )।
ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হবে – এই তত্ত্বের ইংরেজী ‘টিট ফর ট্যাট’ (Tit for tat)।
হাইলাইট করা অংশটুকু কোটেশন হিসেবে বোল্ড বা ইটালিক করে দিলে কেমন হয় ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।
সুন্দর সাবলীল বোধগম্য ভাষায় লেখাটির জন্যে – :rose2: :rose2: :yes: :yes:
@আকাশ মালিক,
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। এমনতর প্রশংসাবাক্যের চোটে লজ্জিতই হচ্ছি। তবে আপনি যে সাবলীলভাবে লেখাটা পড়ে যেতে পেরেছেন সেটাই আনন্দের ব্যাপার।
Do unto others, as you would have them do unto you এর নীচে এর একটা অনুবাদ দিয়ে দিচ্ছি।
@অভি দা,
আমিতো পড়তে পড়তে এসে দেখি হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল। 🙁 🙁
অনবদ্য লেখা।
@সাইফুল ইসলাম,
হাঃ হাঃ আপনার কবিতার চেয়ে লেখাটা ইট্টু বড় হইসে!
@অভিজিৎ দা,
এবারের পর্বটি খুব কঠিন হচ্ছে। নাহ্, আরো কয়েকবার দাঁত বসানোর চেষ্টা করে দেখি। 😀