পূর্ববর্তী পর্বের পর …
 
স্বার্থপর জিন এবং বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল
 
রিচার্ড ডকিন্সের সেলফিশ জিন বইটির কথা আমরা আগেও বলেছি। ডকিন্স বইটি লেখেন ১৯৭৬ সালে। এটি রিচার্ড ডকিন্সের প্রথম বই এবং তার শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোর একটি। এই বইয়ের মাধ্যমেই ডকিন্স সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করলেন যে, বিবর্তন কাজ করে জিনের উপর, একক কোন জীবের উপর নয়। আমাদের দেহ যাই করুক শেষ পর্যন্ত ‘অত্যন্ত স্বার্থপর’ভাবে জিনকে রক্ষা করা আর জিনকে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দেয়াতেই  উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে বাধ্য করে, বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোন থেকে  জীবনের কোন ‘উদ্দেশ্য’ যদি থেকে থাকে তবে সেটাই সে উদ্দেশ্য। বইটির নাম ‘সেলফিশ জিন’ হলেও বইটির মূল লক্ষ্য ছিলো ঠিক বিপরীত। জিনগত স্বার্থপরতা থেকেই ক্রমান্বয়ে কীভাবে  উদ্ভব হয় পরার্থিতার মত একটি বিপরীতমুখী অভিব্যক্তির – তা ব্যাখ্যা করাই ছিলো বইয়ের মূল উদ্দেশ্য। ডকিন্স কিন্তু নতুন কিছু লেখেননি, বরং জর্জ উইলিয়ামস এবং উইলিয়াম হ্যামিলটনের কাজ গুলোকেই জনপ্রিয় বিজ্ঞানের মোড়কে মলাটবন্দী করেছেন।তথ্যে নতুনত্ব না থাকলেও নিঃসন্দেহে নতুনত্ব আর অভিনবত্ব ছিলো উপস্থাপনায়। উইলিয়ামস এবং হ্যামিলটনের কাজ ছিলো একেবারেই কাঠখোট্টা একাডেমিক লেভেলে। ডকিন্স তাদের কাজকেই সাধারণ মানুষের দরবারে নিয়ে গেলেন একাডেমিক জার্গন সরিয়ে। আসলে এমনকি একাডেমিক স্তরেও ডকিন্সের বইটি প্রকাশের আগে এত ব্যাপকভাবে     উইলিয়ামস এবং হ্যামিলটনের কাজ সম্বন্ধে কারও এতো জানাশোনা কিংবা গ্রহণযোগ্যতা ছিলো না। এই বইয়ের মাধ্যমেই আসলে জীববিজ্ঞানীরা সমাজ এবং জীবনকে ভিন্নভাবে দেখা শুরু করলেন।  পরার্থিতা, আত্মত্যাগের মত যে বিষয়গুলো আগে বিজ্ঞানীরা পরিস্কার করে ব্যাখ্যা করতে পারতেন না, সেগুলো আরো বলিষ্ঠভাবে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে ব্যখ্যা করতে পারলেন তারা। ডকিন্সের বইটি প্রকাশের আগে জীববিজ্ঞানীরা পরার্থিতা এবং আত্মত্যাগকে ব্যাখ্যা করতেন গ্রুপ সিলেকশন বা দলগত নির্বাচনের মাধ্যমে। অর্থাৎ, আত্মত্যাগ ব্যাপারটি ব্যক্তির জন্য খারাপ হলেও পুরো দলের জন্য ভালো – এটাই ছিলো আত্মত্যাগের মত প্রবৃত্তিগুলো  টিকে থাকার কারণ- এভাবেই ভাবতেন জীববিজ্ঞানীরা। কিন্তু ডকিন্সের সেলফিশ জিন বইটি এসে দাবার ছক একেবারেই উলটে দিলো। ডকিন্স দেখালেন যে, দলের কথা মাথায় রেখে বিবর্তন কখনোই কাজ করে না। আসলে দলগত নির্বাচন ব্যাপারটাই বিবর্তনের পরিভাষা থেকে উঠিয়ে দেয়া উচিৎ। যে ব্যাপারগুলোকে আপাতঃভাবে দলগত নির্বাচনের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে, তার সবগুলোকেই আসলে স্বার্থপর জিন তত্ত্বের মাধ্যমে আরো অনেক ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ, নির্বাচন হয় জিন লেভেলে, গ্রুপ লেভেলে নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জীববিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন নিজের জিনকে রক্ষা কিংবা যাদের সাথে জিনের নৈকট্য বেশি থাকে, তাদেরকেই রক্ষার তাগিদ প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। আর তা থেকেই ঘটে বৃহৎ স্কেলে পরার্থিতার সূত্রপাত। পিঁপড়া, মৌমাছি,উইপোকা থেকে শুরু করে বানর, শিম্পাঞ্জি কিংবা মানুষ – সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে জিনগত স্বার্থপরতা থেকেই উদ্ভব ঘটে পরার্থিতার, যা এতোদিন ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা হতো দলগত নির্বাচনের মাধ্যমে। জীববিজ্ঞানে এ এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি।  মানবসমাজের বিভিন্ন সামাজিক প্যাটার্ন ব্যখ্যা করার নতুন এক দুয়ার খুলে দিলো  ডকিন্সের স্বার্থপর জিন তত্ত্ব। স্বার্থপর জিনতত্ত্বই দলগত নির্বাচনকে সার্থকভাবে প্রতিস্থাপন করলো উইলিয়ামস- হ্যামিলটন-স্মিথের প্রস্তাবিত স্বজাতি নির্বাচন (Kin selection) দিয়ে।
 
ডকিন্স তার বইয়ে দেখিয়েছেন স্বার্থপর জিন তত্ত্বের মাধ্যমে খুব সফলভাবে জীবজগতে পরার্থিতার উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করা যায়। শুধু তাই নয়, জীবগগতে সবসময়ই স্বার্থপরতা আর পরার্থিতার মধ্যে এক ধরণের ‘দড়ি টানাটানির’ খেলা চলতে থাকে। সেই টানাটানি থেকেই শেষপর্যন্ত নির্ধারিত হয় বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল (Evolutionary Stable Strategy)। কিভাবে স্থিতিশীল কৌশল জীবজগতে রাজত্ব করে, তা বাংলায় একটি চমৎকার প্রবন্ধের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন মুক্তমনা লেখক দিগন্ত সরকার[1]। দিগন্ত লেখা শুরু করেছিলেন একটি মজার উদাহরণ দিয়ে –

 
‘ধরা যাক মুক্তমনায় অপার্থিব আর বন্যা আমার প্রতিযোগী দুই সদস্য। এটা ভাবা খুবই স্বাভাবিক যে আমি এখন অপার্থিবের মুখোমুখী হলেই তাকে মেরে ফেলতে উদ্যত হব। কিন্তু, এমন যদি হয় যে অপার্থিব আবার বন্যারও প্রতিযোগী, তাহলে অপার্থিবকে মারলে আদপে বন্যার সুবিধাই হয়ে যাবে। বরং, বন্যা আর অপার্থিবের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্র হলেই আমার লাভ বেশী। তাই, প্রতিযোগিতার জটিল ঘূর্ণাবর্তে প্রতিযোগীদের নির্বিচারে হত্যা করাটা নির্বাচিত হবার জন্য খুব একটা ভাল কৌশল নাও হতে পারে’।

অর্থাৎ কেবল মার মার কাট কাট করলেই লাভ হবে না। কারণ ‘মার মার কাট কাট’ স্ট্র্যাটিজি অনেক সময়ই টিকে থাকার জন্য কোন ভাল স্ট্র্যাটিজি নয়। মারামারির পাশাপাশি রপ্ত করতে হবে সহযোগিতার কৌশলও। ব্যাপারটা গাণিতিকভাবেই সহজে প্রমাণ করা যায়। দিগন্ত  তার লেখায় এই আকর্ষনীয় বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন  ডকিন্সের বইয়ের একটি চমৎকার উদাহরণ হাজির করে।আমি কিছুটা পরিবর্তিত আকারে উদাহরণটি পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। বলা বাহুল্য, এই উদাহরণটি মূলতঃ মায়নার্ড স্মিথের দেয়া কাল্পণিক  ‘Hawk and Dove’ এর ঈষৎ পরিবর্তিত উদাহরণ[2]।

ধরা যাক, একটি জীবগোষ্ঠীর মধ্যে দুই ধরণের পরষ্পরবিরোধী কৌশল অবলম্বনকারী জীব রয়েছে। প্রথমটি আগ্রাসী নীতি (আনী), আরেকটি ধান্দাবাজ-বিবাদ নীতি (ধানী)। আনীরা হচ্ছে আগ্রাসী, এরা মার মার কাট কাট। তারা সবসময় শেষ রক্তবিন্দু অবধি লড়াই করে, মৃতপ্রায় না হলে রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে না। অপরদিকে ধানীরাও বিবাদী, কিন্তু একটু ধান্দাবাজ টাইপের। এরা মারামারি না করে অন্য উপায়ে লড়াই করে। এরা ঝগড়া করে, রক্তচক্ষু দেখায়, আক্রমণের ভাব করে কিন্তু রক্তপাত করেনা।কিন্তু তারপরেও দুই ধানীতে লড়াই বাধলে শেষপর্যন্ত একজন জিতে আরেকজন হারে। এদের পার্থক্যটা অনেকটা অনেকটা ডিপ্লোম্যাট আর আর্মির পার্থক্যের মত। আনীর সাথে ধানীর লড়াই হয়না, কারণ ধানী পালিয়ে যায়। কিন্তু দুই আনীর লড়াইতে সর্বদা কোনো না কোনো একজন মারা যায় (বা গুরুতর আহত হয়)।
 
এবারে  লড়াইয়ের কৌশলটি গাণিতিকভাবে হিসেব করা যাক।  হিসাবের সুবিধার্থে আমরা ধরে নিব, কোনো জীবই জীবদ্দশায় তার কৌশল বদলায় না, এবং এমনকি  প্রতিযোগিতার শুরুতে একে অন্যের কৌশল সম্বন্ধেও অবগত থাকে না। আমাদের এই মডেলের কাল্পনিক পয়েন্ট সিস্টেমে ধরা যাক :
 
প্রতিযোগিতায় জিতলে ৫০ পয়েণ্ট,
প্রতিযোগিতায় হারলে ০ পয়েন্ট,
সময় নষ্টের জন্য -১০,
গুরুতর আহত হলে -১০০ পয়েন্ট   বরাদ্দ করা হলো।
 
– জিনের নির্বাচনের সম্ভাবনার সাথে মিল রেখেই এরকম পয়েন্ট সিস্টেম।
 
আমরা হিসাব করতে চাই যে এদের মধ্যে কোন্‌ কৌশলটি (বা এদের কোনো সংমিশ্রণ) স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।  
 
মনে করা যাক, জীবগোষ্ঠীর সব জীবই প্রথমে ধানী (ধান্দাবাজ বিবাদী নীতি) ছিলো।  তাহলে তাদের মধ্যে প্রতিটি প্রতিযোগিতায়, একজন জেতে (+৫০), একজন হারে (০); আর দুজনেই সময় নষ্ট করে (-১০x২ = -২০), কিন্তু কেউই আহত হয় না। সমষ্টিগতভাবে লাভ হয় ৩০ পয়েন্ট, প্রত্যেকের ভাগে যায় ১৫ পয়েন্ট করে। এবার ধরা যাক একটা  আনী (আগ্রাসী নীতি) জীব হঠাৎ এসে হাজির হল এই গোষ্ঠীতে। সে ধানীদের সহজেই লড়াইতে হারিয়ে দেবে, প্রতি যুদ্ধে +৫০ পয়েণ্ট হাসিল করবে। তার ফলে তার আগ্রাসী জিন খুব সহজেই জীবগোষ্ঠীতে বিস্তার লাভ করবে। বিস্তার লাভ করতে করতে, ধরা যাক, একটা সময় পরে জীবগোষ্ঠীতে ধানীদের সংখ্যা একেবারেই কমে যাবে আর গোষ্ঠীর প্রায় সবাই আনী হয়ে যাবে। এখন স্বভাবতই দুই আনীতে লড়াই বাধবে। দুটি আগ্রাসী জীবের লড়াইয়ে প্রত্যেকে গড়ে -২৫ পয়েণ্ট পায় (জেতায় +৫০, আর গুরুতর আহত হওয়ায় -১০০)। একটি বিবাদী সেই দলে থাকলে সে সব লড়াইতে হারে, কিন্তু গড়ে সে ০ পয়েণ্ট পায় (আগের গণনা থেকে )। -২৫ পয়েণ্ট এর চেয়ে ০ পয়েন্ট অনেক ভাল। +৩৫ পয়েন্টের সুবিধা থাকায় সহজেই ধানী কৌশল নিয়ন্ত্রক জিন  জনপুঞ্জে বিস্তার লাভ করতে থাকবে।

 
এতদূর পর্যন্ত গল্পটা শুনে মনে হতে পারে যে জীবগোষ্ঠীতে সবসময় এই দুই কৌশলের জীবেদের মধ্যে একটা বাড়াকমা চলবে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা অংক কষে দেখেছেন যে ধানী আর আনীদের  অনুপাত ৫:৭ অনুপাতে পৌঁছলে সমাজ স্থিতিশীলতা লাভ করবে! মানে, ওই অনুপাতে পৌঁছনর পরে প্রতিটি আগ্রাসী (আনী) আর প্রতিটি ধান্দাবাজ বিবাদী (ধানী)র গড়পরতা লাভ-ক্ষতির তুলনামূলক হিসাব মিলে যায়। অর্থাৎ ধানী : আনী = ৫:৭ হয়ে গেলে নির্বাচনে আর কেউই অন্যের তুলনায় সুবিধা পায় না।  এই অনুপাতই এক্ষেত্রে বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল (Evolutionary stable strategy )।
 
স্থিতিশীল কৌশল কেবল আনী-ধানীর ক্ষেত্রেই নয়, চমৎকারভাবে কাজ করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মানব সমাজে নারী পুরুষের অনুপাত থাকে ১০০ : ১০৫ অনুপাতে। ক্রীড়াতত্ত্বের সাম্যাবস্থার জন্যই এটি ঘটে। রিচার্ড ডকিন্স তার সেলফিশ জিন বইয়ের ‘ব্যাটেল অব সেক্স’ অধ্যায়ে উপরের আনী-ধানীর মতোই নারীপুরুষের মধ্যে প্রতারণা এবং বিশ্বস্ততা নিয়েও একটি সরল ‘গেম থিওরীর’ অবতারণা করে দেখিয়েছেন যে, সেখানেও দড়িটানা টানির একটা খেলা চলে, ফলে পূর্ণ বিশ্বস্ত নারী-পুরুষে ভর্তি সমাজ যেমন আমরা পাইনা, তেমনি এমনো পাইনা এমন সমাজও যেখানে সবাই অবিশ্বস্ত। বরং সমাজে দেখা যাবে- বিশ্বস্ততা এবং প্রতারণা রাজত্ব করে একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে যা শেষ পর্যন্ত বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল বা Evolutionary stable strategy তৈরি করে।
 
একই ধরণের মডেল তৈরি করা যায় সত্যবাদী আর মিথ্যাবাদীদের মিথস্ক্রিয়ার মধ্যেও। বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশলের কারণেই পরিপূর্ণ সত্যবাদী সমাজ যেমন আমরা পাই না, ঠিক তেমনি এমন সমাজও আমরা পাব না যেখানে সবাই মিথ্যা কথা বলছে। এমনকি একই মানুষের মধ্যেও দেখা যাবে কারো পক্ষেই জীবনের সবসময় সত্য কথা বলা যেমন সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি সম্ভব নয় সর্বদা মিথ্যে কথা বলাও। পদার্থবিদ হাইন্‌য পেগেল্‌স  তাঁর ‘‘যুক্তির স্বপ্ন” বইয়ে এজন্যই বলেছেন[3] –
 
 

“জটিলতার নতুন বিজ্ঞান আর কম্পিউটারের প্রতিরূপ (মডেল) তৈরির মাধ্যমে আমরা মূল্যবোধ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছি, যা আগে কখনোই সম্ভব ছিলো না। নৈতিকতা নিয়ে বিতর্কের সুরাহা করতে না পারুক, বিজ্ঞান অন্ততঃ মডেলের সাহায্যে ব্যাপারগুলোর একটা যৌক্তিক কাঠামো তৈরি করতে পারে। একটা উদাহরণ নেয়া যাক।  যেমন মিথ্যা বলা। আমরা সত্যবলাকে একটা পুণ্য বলে মনে করি আর মিথ্যা বলাকে পাপ হিসেবে গণ্য করি। এখন একটি সমাজ কল্পণা করি – যেখানে  সবাই সর্বদা সত্য কথা বলছে। এখন সেই সমাজে কোন এক মিথ্যেবাদী এসে হাজির হল (অনেকটা উপরের ধানী সমাজে আনীর আগমনের মতো)। এখন সত্যবাদী সমাজে এরকম একজন মিথ্যা বললে তার বিপুলভাবে লাভবান হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু এই সম্ভাবনা সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষার জন্য সহায়ক নয়। অপরদিকে যে সমাজে সবাই সর্বদা মিথ্যা বলে, সেই সমাজও বেশিদিন স্থিতাবস্থায় থাকতে পারে না এবং একসময় ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। সবচেয়ে স্থিতাবস্থার দশা হল যখন সবাই অধিকাংশ সময় সত্য বলে কিন্তু মাঝে মধ্যে মিথ্যা বলে, যা বাস্তব জগতে দেখা যায়। এক অর্থে বলা যায় যে আমাদের মধ্যে যারা মিথ্যাবাদী তারাই আমাদের বাকি সবাইকে সত্যবাদী ও সতর্ক থাকতে সহায়তা বা বাধ্য করে। মিথ্যাকথনের এই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আমরা কেন মিথ্যা বলি সেটা বুঝতে আমাদের সাহায্য করতে পারে।’’

 
ক্রীড়াতত্ত্ব এইরকম বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে সমর্থন দেয়, শুধু  জীববিজ্ঞানে নয়, বিজ্ঞানের নানা শাখাতেই। যেমন অর্থনীতি নিয়ে যারা পড়াশুনা করেছেন তারা জানেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তথা বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে, গেম থিয়োরী প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করে। প্রথমে কোন দ্রব্যের মনোপলি বাজার থাকলে দ্রব্য প্রস্তুতকারীর একচেটিয়া মুনাফা থাকে। দ্রব্যের দামও হয়তো বসাতে পারে ইচ্ছেমতো। কিন্তু একটা সময় পরে অন্য প্রতিযোগীরাও একই দ্রব্য তৈরিতে নেমে পড়লে কারো একতরফা মুনাফা থাকে না। দ্রব্যের মূল্য নির্ধারিত হয় গেম থিয়োরীর মাধ্যমে বোঝাপড়ার নিরিখে। আবার কোনো ব্যবসায়ী একই দ্রব্য কমদামে বিক্রি শুরু করলে তার সাময়িকভাবে লাভ হয় বটে, কিন্তু তার অন্য প্রতিযোগীরাও সাথে সাথেই দাম কমিয়ে ফেললে তার আখেরে অনেক লোকসানই হবে। তাই শেষমেষ নিজেদের মধ্যে এক ধরণের বোঝাপড়ার মাধ্যমে বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রিত হওয়া শুরু করে। স্বার্থপরতা আর পরার্থিতাও ঠিক একইভাবে কাজ করে। তারা মিলেমিশে এক হয়ে থাকে ক্রীড়াতত্ত্বের দড়ি টানাটানির মাঝখানে। চীনের অধিবাসীদের অনেকেই ইন এবং অ্যান (Yin and yang)নামক দুই পরষ্পরবিরোধী শক্তিতে বিশ্বাস করে। তারা মনে করে মানুষ সহ সবকিছুই আসলে ইন এবং অ্যান-এর সুষম মিশ্রণ। শুধু চীনারা কেন,  আমরাও ছোটবেলেয় স্কুলে ভাব সম্প্রসারণ করতে গিয়ে শিখেছিলাম – শুভ এর জন্যই অশুভের দরকার, কিংবা আলোর জন্যই অন্ধকারের প্রয়োজন। নিরঙ্কুষ সত্যবাদী সমাজ তৈরির মতো প্রদীপ জ্বেলে আঁধার দূর করার চেষ্টা হলেও দেখা যায় – প্রদীপের নীচেই থেকে যাচ্ছে গাঢ় অন্ধকার। ঠিক একইভাবে বলা যায়, আমরা পরার্থিতার যতোই বিজয় কেতন উড়াই না কেন, স্বার্থপরতাকে বাদ দিয়ে তা সম্ভব নয়। প্রদীপের অন্ধকারের মতোই তা নীচের স্তরে থেকে যাবে। কারণ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন পরার্থিতার মূল উৎস আসলে স্বার্থপর জিনের উপস্থিতির কারণেই। ক্রীড়াতত্ত্বের আধুনিক মডেলগুলো যেন তারই বাস্তব প্রতিধ্বনি। সেজন্যই ম্যাট রিডলী তার ‘নৈতিকতার উদ্ভব’ বইয়ে বলেন[4] –

Cooperation was first used, not for virtuous reasons, but as a tool to achieve selfish results. And if we are to celebrate the unusually cooperative result of the societies, we must first recognize the base metal from which it was forged.

এই স্বার্থপরতার উপস্থিতির কারণেই কিভাবে পরার্থিতার উদ্ভব ঘটে তা আরো স্পষ্ট হবে নীচের কিছু উদাহরণে।
 
 
ইট-পাটকেল এবং পিঠ চুলকোচুলকির খেলা
 
জীবজগতে গেম থিওরী এবং বিবর্তনীয় স্থিতিশীল তত্ত্ব কিভাবে কাজ করে তা না হয় জানা গেল। কিন্তু একটি জীব কি করে বুঝবে কখন তাকে স্বার্থপর হতে হবে,আর কখন পরার্থ? কিভাবে বুঝবে  কখন সত্যবাদী যুধিষ্ঠির সাজতে হবে, আর কখন হতে হবে বিশ্বাসঘাতক বিভীষণ? এর উত্তর পাওয়া গেছে দুই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী রবার্ট এক্সেলরড (Robert Axelrod) এবং রবার্ট ট্রাইভার্স (Robert Trivers)-এর পৃথক দুটি গবেষণায়। দু’জন বিজ্ঞানী আলাদা দুটি তত্ত্ব দিয়েছেন। নামে আলাদা হলেও তত্ত্বের বিষয়বস্তু মোটামুটি একই। তুমি আমার পিঠটি চুলকালে আমিও এক সময় তোমার পিঠটি চুলকে দিব। আর তুমি ইট মারলে আমিও দেব পাটকেলটি মেরে। কাজেই বাপু যা করবে – বুঝে কোর। এই হল তত্ত্বদুটির মোদ্দা কথা।
 
ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হবে – এই তত্ত্বের ইংরেজী ‘টিট ফর ট্যাট’ (Tit for tat)। এটি দিয়েছেন এক্সেলরড। আর রবার্ট ট্রাইভার্সের ‘পিঠ চুলকাচুলকি’ সংক্রান্ত তত্ত্বের নাম – বিনিময়ী পরার্থিতা (Reciprocal Altruism)। দুটি তত্ত্বই ইঙ্গিত করছে- অতীতে আমার প্রতি তুমি কী আচরণ করেছ সেটা মনে করে আমি তোমার প্রতি আচরণ করব। ভাল আচরণ করে থাকলে আমার থেকেও ভাল আচরণ পাবে, আর ঝামেলা করে থাকলে আমার দিক থেকেও তাই পাবে।কাজ কর্মে এক হলেও তত্ত্ব দুটিতে সূক্ষ কিছু পার্থক্য থেকে গেছে। টিট ফর ট্যাট ঘটে একই প্রজাতিতে। এক ভার্ভেট বানর ক্ষিদার সময় আরেক বানরকে কলা দিলে, সেই বানরও পরবর্তীতে কলা দিয়ে প্রথম বানরকে সাহায্য করবে।  শিকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হবার মুহূর্তে কোন পরোপকারী বানর বন্ধু যদি চীৎকার করে সতর্ক করে দেয়, তবে পরোপকারী বানরটি কখনো বিপদে পড়লেও ঠিক একইভাবে  সেই আক্রান্ত বানরটি চীৎকার করে তাকে বিপদে সাহায্য করবে। টিট ফর ট্যাট বিদ্যমান থাকে একই প্রজাতির মধ্যে। বানর কেবল চীৎকার করে সতর্ক করবে আরেকটি বানর বিপদে পড়লেই, কোন খরগোশ বিপদে পড়লে নয়। আর তাদের সাহায্যের ধরণও একই ধরনের হবে। কলার বিনিময়ে কলা, কিংবা চীৎকারের বিনিময়ে চিৎকার। অন্য কিছু নয়। কিন্তু অন্য দিকে রেসিপ্রোকাল অলট্রুইজম বা বিনিময়ী পরার্থিতার ক্ষেত্রে  পরার্থিতা প্রজাতির স্তর অতিক্রম করে যায়। এক প্রজাতি অন্য প্রজাতিকে সহায়তা করে। আমরা আগে  আমরা আগে ক্লাউন মাছ আর এনিমোন, হামিং বার্ডের সাথে অর্নিথোপথিলাস ফুলের, কিংবা এংরাকোয়িড অর্কিডের সাথে আফ্রিকান মথের সহবিবরতনের উদাহরণের সাথে পরিচিত হয়েছি যেগুলো প্রজাতির স্তর অতিক্রম করে পরার্থিতার বিকাশ ঘটিয়েছে। সাহায্যের ধরণও ভিন্ন হতে পারে। আমি পুজা উপলক্ষে  প্রতিবেশীকে পায়েশ  পাঠলে, প্রতিবেশীও যে পায়েশই পাঠাবে তা নয়, হয়তো ঈদের দিন পাঠাবে কোরমা – এই ধরণের!
 
ইট-পাটকেল তথা টিট ফর ট্যাট তত্ত্বের উদ্ভবটা বেশ মজার। আশির দশকের প্রথমভাগে  কম্পিউটারের  শক্তি বাড়তে শুরু করেছে হু হু করে। পার্সোনাল কম্পিউটারও বাজারে আসতে শুরু করেছে। এই সময় রবার্ট এক্সেলরড নামের এক তরুণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর শখ হল কম্পিউটারের সাহায্যে আসামীর সঙ্কটের একটা সিমুলেশন পরীক্ষা করবেন। তিনি একটি মজার প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন যেখানে প্রতিযোগীরা আসামীর সংকট সমাধানের জন্য একটা ভাল এলগরিদম সাবমিট করবে। প্রায় দুশবার একে অপরের মধ্যে ক্রমান্বয়ে খেলা চলবে।এর মধ্যে যার পয়েন্ট সবচেয়ে বেশি হবে সেই এলগোরিদমই বিবেচিত হবে শ্রেষ্ঠ হিসেবে। চোদ্দজন প্রতিযোগী সেই প্রোগ্রামিং এর খেলায় অংশ নেন – তারা সহজ সরল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জটিল জটিল এলগোরিদম সাবমিট করলেন। এনাতল র‍্যাপোর্ট (Anatol Rapoport) নামে এক তরুণ প্রোগ্রামারের এলগোরিদম সর্বোচ্চ পয়েন্ট পেয়ে জয়লাভ করল – আর সেই প্রোগ্রামের স্ট্র্যাটেজি ছিলো সবচেয়ে সরল – সেই টিট ফর ট্যাট। প্রথমে সহযোগিতা করে সে খেলা শুরু করবে, আর মনে রাখবে তার প্রতিপক্ষ ঠিক কি করেছিলো তার সাথে –  সহযোগিতা নাকি বিরোধিতা। প্রতিপক্ষ সহযোগিতা করে থাকলে সেও সহযোগিতা করবে, আর বিরোধিতা করলে সেও করবে বিরোধিতা। এভাবেই এগুতে থাকবে। এভাবেই সে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট অর্জন করে প্রথম স্থানে পৌঁছিয়ে গেল।  এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই বেরিয়ে এলো যে, টিট ফর ট্যাট – বা ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয় – এইটিই আসামীর সংকট মোকাবেলার জন্য সর্বোত্তম সমাধান।
 
কয়েক বছর পরে রবার্ট এক্সেলরড আবারো আরেকটি টুর্নামেন্টের আয়োজন করলেন টিট ফর ট্যাট আলগোরিদমকে কেউ হারাতে পারে কিনা সেটা পুনর্বার পরীক্ষা করার জন্য। এবারেও শীর্ষস্থান অধিকার করে বসে রইলো সেই আদি অকৃত্রিম টিট ফর ট্যাট!তিনি ১৯৮১ সালে বিষয়টি ফোকাস করে হ্যামিলটনের সাথে মিলে সায়েন্স পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লেখেন ‘দ্য ইভোলুশন অব কোঅপারেশন’ নামে[5], এবং বছরখানেক পরে একটি বই লেখেন সেই একই শিরোনামে[6]। এভাবেই টিট ফর ট্যাট অ্যালগরিদম বিবর্তনীয় গেম থিওরীর এক রাজকীয় স্থান অধিকার করে নিলো।
 
 
রক্তচোষা বাদুড়দের কথা
 
খাতায় কলমে আর কম্পিউটার সিমুলেশনে না হয় ইট-পাটকেল তথা টিট ফর ট্যাট এক বাস্তব সমাধান হিসেবে হাজির হল, কিন্তু কথা হচ্ছে প্রকৃতিতে কি আসলেই ইট-পাটকেল কিংবা বিনিময়ী পরার্থিতার প্রয়োগ দেখা যায়, নাকি এগুলো কেবলই কিছু আঁতেলেকচুয়াল বিজ্ঞানীদের অলস মস্তিষ্কের প্যাচপ্যাচানি?
 
এর উত্তর পাওয়া গেলো  ১৯৮৩ সালে ভ্যাম্পায়ার বাদুড় নিয়ে জীববিজ্ঞানী গেরাল্ড উইলকিনসনের (Gerald Wilkinson)একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায়। ভদ্রলোক কোস্টারিকায় এই বাদুড়দের নিয়ে অনেকদিন ধরেই রিসার্চ করছিলেন। এই সমস্ত বাদুড়েরা খুবই অদ্ভুত। বাদুড়দের অন্য প্রজাতিদের মত এদের ফলমূলে  কোন রুচি নেই। এদের আহার হল কেবল তাজা রক্ত। এরা গাছের ডালে ঝুলে থাকে আর  অপেক্ষা করে থাকে কোন ঘুমন্ত স্তন্যপায়ী জীবের গা থেকে রক্তপানের জন্য। তারপর গভীর রাত্রিতে বের হয় শিকারের সন্ধানে। নিঃসন্দেহে এ ভাবে  খাদ্য সংগ্রহের ব্যাপারটি বাদুড়দের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর বহুসময়ই তারা পর্যাপ্ত আহার  যোগাড় করতে পারে না। কারণটি বোঝা কঠিন কিছু নয়। খাবার মানে রক্ত সংগ্রহের জন্য শিকারকে জায়গা মতো পেতে তো হবে, আর যার দেহ থেকে রক্ত যোগাড় করতে যাচ্ছে, সেই বা রাজি থাকবে কেন। টের পেয়ে বাধা দিলে তো আর রক্ত খাবার উপায় নেই। জান নিয়ে পালানোটাই তখন বুদ্ধিমানের কাজ। সেজন্য দেখা যায় এই বাদুড়েরা অনেক সময়ই দুই তিন দিন পর্যন্ত অভুক্ত থেকে যায় কোন কিছু যোগাড় না করতে পেরে। পঞ্চাশ -ষাট ঘন্টা না খেয়ে থাকার পর তাদের বাদুড়দের কী অবস্থা হয় তা বোধহয় সহজেই অনুমেয়।
 
সৌভাগ্যক্রমে এই দূরাবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটা রাস্তা তারা নিজেরাই বাতলে নিয়েছে। তারা যখন খাবার পায় তখন  তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেয়ে নেয়। রক্ত খেয়ে একেবারে পেট ফুলিয়ে বসে থাকে। কিন্তু পেট ফুলায় এমনি এমনি না। তারা গোত্রের অভুক্ত বাদুড়দের রক্ত খাইয়ে সাহায্য করে। তারা পরার্থতা প্রদর্শন করে সমগোত্রীয়দের প্রতি। তারা এই পরার্থতাপরায়ণ সামাজিক আচরণের মাধ্যমেই সফলভাবে টিকে থাকে।
 
মজার ব্যাপার হলো বাদুড়দের সবাই যে নিঃস্বার্থ তা কিন্তু নয়। তাদের মধ্যে অনেকে পেট ফুলিয়ে রক্ত খাওয়ার পরেও এমন ভান করে যে সে খায়নি। পরার্থপরায়ণ এই বাদুড় সমাজে  কোন বাদুড়কে যদি বিপদের সময় কাউকে রক্তপান না করাতে হয়, কিন্তু নিজে বিপদে পড়লে যদি কেউ না কেউ তাকে খেতে দেয়, তাহলে সে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে।  আবার অন্যদিকে এমন যদি হয় যে কোন বাদুড় কারো বিপদের সময় অন্যকে রক্ত খাইয়ে সাহায্য করছে, কিন্তু নিজে বিপদে কেউ তাকে খাওয়াতে এগিয়ে আসছে না – তা হলে সে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
 

vampire-bat

চিত্র: ভ্যাম্পায়ার বাদুড় নিয়ে জীববিজ্ঞানী গেরাল্ড উইলকিনসনের গবেষণায় দেখা গেছে যে,তারা  ইট-পাটকেল আর বিনিময়ী পরার্থতাপরায়ণতা প্রদর্শন করে একে অন্যকে সাহায্য করে।
 
 

এই ডাইনামিক্স-এর ধরণটা আসামীর সংকটের আলোকে বুঝার চেষ্টা করা যাক। নিঃসন্দেহে কোন বাদুড়ই চাইবে না ক্ষতির বোঝা বাড়াতে, বরং বাদুড় সমাজে ‘অতি চালাক’ এমন কেউ না কেউ থাকবে যে ধোঁকাবাজি করে সবচেয়ে বেশি লাভবান থাকতে চাইবে। অর্থাৎ এ সমস্ত বাদুরেরা রক্ত খেয়ে এসে মুখ টুখ মুছে এমনভাবে চলাফেরা করবে যে তারা রক্ত খায়নি; ফলে অন্য কাউকে তার রক্ত খাওয়াতে হবে না। সত্যই এরকম কিছু বাদুড় দেখা যায় গোত্রে। যারা চালাকি করে প্রতারণার পথ নেয়। কিন্তু  অতি চালাকের গলায় দড়ি পড়তে সময় লাগে না। তার ফোলা পেটের ধরণ দেখেই অন্য অভিজ্ঞ বাদুর সদস্যদের কেউ কেউ বুঝে ফেলে ব্যাটা ‘সাধু বেশে পাকা চোর অতিশয়’। ফলে তাকে একঘরে করে ফেলা হয়, কেউ তাকে তার বিপদের সময় রক্ত খেতে দিয়ে সাহায্য করে না। মূলতঃ বাদুড়েরা তাদের নিজেদের মধ্যে খেলতে থাকে ‘ইট-পাটকেল’ বা ‘টিট-ফর ট্যাট’-এর মায়াবী খেলা – কেউ তাকে রক্ত খেতে দিলে সেও তার বিপদে নিজের ভাগের রক্ত খেতে দেয়। কিন্তু কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সেও প্রত্যাখ্যান করে। এভাবেই ইট-পাটকেল  এবং বিনিময়ী পরার্থিতা নীতি বাদুড় সমাজে রাজত্ব করে চলে অত্যন্ত সফলভাবে[7]।
 
এই সমস্ত রক্তচোষা বাদুরদের মত আফ্রিকান ভার্ভেট বানরদের মধ্যেও কিন্তু বিনিময়ী পরার্থতা দেখতে পাওয়া যায়। সেখানেও বানর সদস্যরা টিট ফর ট্যাটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয় অপর বানরকে সাহায্য করা হবে নাকি প্রতাখ্যান করা হবে। যদি অতীতে সাহায্য পেয়ে থাকে কারো কাছ থেকে, বিপদের সময় তাকে সাহায্য করে। আর যদি উল্টোভাবে সাহায্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়, তবে বিপদের সময় তাকেও কাঁচকলা দেখিয়ে দেয়া হয়। এই ইট-পাটকেলের পাশাপাশি স্বজাতি নির্বাচনও খুব জোড়ালোভাবে কাজ করে ভার্ভেট বানরদের মধ্যে। শুধু জোড়ালো বললে ভুল হবে, স্বজাতি নির্বাচনের সম্পর্ক অনেক সময় ছাপিয়ে যায় ইট-পাটকেল এবং বিনিময়ী পরার্থপরায়ণতাকেও। যেমন, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, দুই বানরের মধ্যে যদি রক্তের সম্পর্ক থাকে  তাহলে অতীতে সাহায্য পাক না পাক, তার বিপদে অন্য সদস্য সাহায্য করে। অর্থাৎ রক্তের সম্পর্ক ছাড়িয়ে যায় ইট-পাটকেলের খেলাকে। মা বানর তার শিশু বিপদে পড়লে এমনিতেই সাহায্য করে, কোন কিছুর বিনিময়ের দাবীতে নয়। ঠিক একই ব্যাপার ঘটে ভাই বোনদের মধ্যেও। কিন্তু রক্তের সম্পর্কের বাইরে কাউকে সাহায্য সহযোগিতার প্রশ্ন আসলে সেই ইট-পাটকেলেরই শরণাপন্ন হয় সবাই। সাধে কি আর বলে – Blood is thicker than water!
 
ভ্যাম্পায়ার বাদুর আর ভার্ভেট বানরের ক্ষেত্রে যা দেখা গেলো সেরকম ব্যাপার তো মানুষের জন্যও খাটে, তাই না? বিপদের সময় কারো কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে থাকলে আমরাও প্রাণপণে সেটা শোধ করে দিতে চেষ্টা করি। আর বিশ্বাসঘাতক কিংবা কৃতঘ্ন লোকজনকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। এ ধরণের লোককে অনেকসময় সামাজিকভাবেও একঘরে করে ফেলা হয়। এটা কিন্তু ঘুরেফিরে উপরের টিট ফর ট্যাট আর রেসিপ্রোকাল অল্ট্রুইজমেরই প্রতিফলন। আবার, ভার্ভেট বানরদের মতো মানব সমাজেও দেখা যায় এই টিট ফর ট্যাট নীতিকে বহু সময়ই অতিক্রম করে যায় স্বজাতি নির্বাচন তথা রক্তের সম্পর্ক। ছেলে মেয়ে বিপদে পড়লে  ‘রক্তের টান’ই মূখ্য হয়ে উঠে ইট-পাটকেলের চেয়ে। বিপদ থেকে সন্তানকে রক্ষার চিন্তাই প্রাধান্য পায় তখন।অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভার্ভেট বানরের মধ্যে স্বজাতি নির্বাচনের সম্পর্ক যেভাবে অনেক সময় ছাপিয়ে যায় ইট-পাটকেল এবং বিনিময়ী পরার্থপরায়ণতাকে, ঠিক সে ধরনের প্যাটার্ণ কাজ করে মানব সমাজেও।  
 
বিজ্ঞানীরা আরো দেখেছেন, ইট-পাটকেল আর বিনিময়ী পরার্থতার খেলা ভাল জমে যদি সদস্যরা খুব ‘ক্লোজড কমিউনিটি’তে বাস করে। ভার্ভেট বানরেরা আর ভ্যাম্পায়ার বাদুড়েরা দীর্ঘদিন ধরে একই জায়গায় বাস করে একই সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাই তাদের মধ্যে সহজাতভাবেই এক ধরণের সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠে।ব্যাপারটা মানব সমাজের জন্যও ঠিক একইভাবে প্রযোজ্য। আমরা প্রায় সময়ই অনেকের মুখেই বলতে শুনি যে, শহরের লোকেরা অনেক বাটপার, তার তুলনায় গ্রামের লোকেরা অনেক ভালো – সহজ সরল। আসলে এটার কারণ হলো, গ্রামের লোকেরা একটা ক্লোজড কমিউনিটিতে বাস করে।সেখানে সবাই সবাইকে চেনে, আর প্রায়ই হাটে মাঠে একে অপরের সাথে দেখা হয়ে যায়। ফলে কারো পক্ষে বাটপারি কিংবা চুরি চামারি করে খুব বেশি সুবিধা সেখানে পাওয়া সম্ভব নয়।কিন্তু ঢাকা শহরের মত জায়গায় যেখানে লক্ষ লোকের বাস, সেখানে একজন বাটপার জানে যে, আজকে বাসে একটি অপরিচিত লোকের পকেট মেরে দিলে পরের দিন তার সাথে দেখা হবার সম্ভাবনা একেবারেই কম। তাই গ্রামের চেয়ে শহরে ছিনতাইকারী, পকেটমার, চোর ছ্যাচর বেশি দেখা যায়, মানুষ আক্রান্তও হয় তুলনামুলক বেশী। এটাও ক্রীড়াতত্ত্বের সিমুলেশনেরই একটি বাস্তব ফলাফল।
 
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট এক্সেলর্ড তার ‘সহযোগিতার বিবর্তন’ বইয়ে   টিট ফর ট্যাটের একটি বাস্তব উদাহরণ হাজির করছেন। ১৯১৪ সালে  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সৈন্যরা বেলজিয়াম দখল করে নেয়। স্বভাবতই পশ্চিমা শক্তি (western front) আর অক্ষশক্তির মধ্যে শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ আর সঙ্ঘাত। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, এই সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতিতেও একটা সময় পরে দেখা গেল, রেলজিয়ামের একটি পরিখার দুই পাশে জার্মান সৈন্য আর পশ্চিমা শক্তির (ফ্রান্স এবং বেলজিয়াম) কিছু ট্রুপের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমরা আগের কিছু উদাহরণে দেখেছি যে, দীর্ঘদিন ধরে একই জায়গায় বাস  করতে থাকলে  সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতার পাশাপাশি সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠে।আসামীর সংকট থেকে উদ্ভুত টিট ফর ট্যাটের কারণেই এটি ঘটে। রবার্ট এক্সেলর্ডের মতে, ঠিক একই কারণে বেলজিয়ামের একটি পরিখার দুই পাশে অবস্থিত দুই বিরোধীপক্ষের সৈন্যদের মধ্যে এক ধরণের সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। কারণ একই জায়গায় দুই দলের সৈন্যদের একই ট্রুপকে বেশ কয়েকবার একে অপরের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। প্রাথমিক সময়গুলোতে সঙ্ঘাত আর সংঘর্ষ চললেও একটা সময় পরে গেম থিওরীর নিয়মেই ‘আসামীর সংকটের’ মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। তারা পারতপক্ষে শত্রুদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতো না, অতর্কিতে পেছন থেকে আক্রমণ করে জয়লাভের চেষ্টা করতো না, কিংবা যত কম হত্যাকাণ্ডের মধ্যে নিজেদের নিয়োজিত রাখা যায়, তার সর্বাত্মক চেষ্টা করতো। বিনিময়ে তারা প্রত্যাশা করতো যে শত্রুপক্ষও প্রতিদানে তাদের প্রতি অনুরূপ ব্যবহার করবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছিলো যে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছিলো। এমনি শত্রুপক্ষ খুব সহজ নিশানায় কাউকে পাওয়ার পরেও গুলি করেনি কিংবা ভুল দিকে গুলি ছুঁড়েছে –এমন দৃষ্টান্তও আছে। টনি এশওয়ার্থ সহ অনেক ইতিহাসবিদই ব্যতিক্রমী ব্যপারটি উল্লেখ করে বই লিখেছেন। স্বার্থের কারণে ঘোর শত্রুদের মধ্যে আপাতঃ সমঝোতার  ব্যাপার কিন্তু  রণক্ষেত্রের ইতিহাসে অনেক পাওয়া যায়। এমনি একটি উদাহরণ ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘটা  ‘মলোটোভ-রিবেন্ট্রোপ’ চুক্তি (কমিউনাৎসী চুক্তি হিসেবে কুখ্যাত), যার ফলশ্রুতিতে নাৎসী জার্মানী আর স্ট্যালিনিস্ট রাশিয়ার মধ্যে একধরণের সমঝোতা স্থাপিত হয়।

চিত্রঃ ১৯৩৯ সালের ২৩ শে আগাস্ট – ‘মলোটোভ-রিবেন্ট্রোপ’  চুক্তির দৃশ্য

এই সমঝোতার ফলশ্রুতিতে নাৎসী জার্মাণ সৈন্যরা পোল্যাণ্ডের একাংশ নিরাপদে অধিকার করে নেয়, আর অন্য অংশ স্ট্যালিনিস্ট রাশিয়া দ্বারা অধিকৃত হয়। পিসা, নারেভ, ভিস্টুলা আর সান নদীর অববাহিকার কিয়দংশ রাশিয়ার ভাগে পড়ে, আর পশ্চিমাংশ থাকে জার্মানীর পদতলে। জার্মানী ফ্রান্স অধিকার করে নেয়, লিথুনিয়া এবং পশ্চিম প্রুসিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকে, আর অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়া থাবা বসায় পূর্ব ফিনিল্যাণ্ড, এস্টোনিয়া আর লাটভিয়ার উপর। নিঃসন্দেহে মানবেতিহাসের প্রেক্ষাপটে স্বার্থপর সহযোগিতার (কিংবা সঠিকভাবে বললে দুই স্বার্থপর রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যকার সহযোগিতা) নির্জলা সত্য এটি। মানুষের জন্য ‘স্বার্থপর সহযোগিতার’ ব্যাপারটি  আমাদের অনেকের মধ্যেই অস্বস্তি তৈরি করলেও জীবজগতে এ ধরণের সহযোগিতার  উদাহরণই দৃশ্যমান। বেবুনদের মধ্যে গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, দুই পুরুষ বেবুনের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠে নারী বেবুনের দখল নিতে গিয়ে অপর কোন শক্তিশালী বেবুনকে বিতারিত করতে[8]। এই সহযোগিতার চুক্তি অনেকটা ‘মলোটোভ-রিবেন্ট্রোপ’  চুক্তির মতোই হয় সাময়িক[9]। হিটলার যেমন চুক্তি ভেঙ্গে এক সময় সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ঠিক তেমনি বেবুন সমাজেও শক্তিশালী বেবুনটি বিতারিত হবার পরে চুক্তি ভেঙ্গে শুরু হয় সহযোগী দুই বেবুনের মধ্যে প্রতিযোগিতা – কে সবার আগে নারী বেবুনটির দখল নিতে পারে! একই ধরণের স্ট্র্যাটিজি বিজ্ঞানীরা প্রবলভাবেই প্রত্যক্ষ করেছেন  বটলনেক ডলফিনদের মধ্যেও[10]। চুক্তির কথা না হয় বাদ দেই, আমরা যে সহবিবর্তন এবং মিথোজীবীতার উদাহরণগুলো জানি – যেমন, শিকারী মাছদের থেকে বাঁচার জন্য ক্লাউন মাছদের সাথে এনিমোনের সহবিবর্তন, হামিং বার্ডের সাথে অর্নিথোপথিলাস ফুলের সহবিবর্তন, এংরাকোয়িড অর্কিডের সাথে আফ্রিকান মথের সহবিবর্তন সেগুলো কিন্তু সবই প্রকারন্তরে স্বার্থপর সহযোগিতারই উদাহরণ। আসলে এ ব্যাপারগুলো প্রকৃতিতে এতোই স্পষ্ট যে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স  তার ‘আনউইভিং দ্য রেইনবো’বইয়ের নবম অধ্যায়ের শিরোনামই দিয়েছেন – স্বার্থপর সহযোগী (The selfish cooperator)। তিনি পুরো ব্যাপারটিকে দেখেছেন অনেকটা এভাবে[11] –    

‘আমি বরাবরই মনে করেছি যে, জীবজগতের প্রকৃতি বহুলাংশেই পরার্থপরায়ণ, সহযোগিতাপ্রাবণ, এমনি অনেকসময় আবেগপ্রবণও। এগুলো কিন্তু তাদের স্বার্থপর জেনেটিক স্তর থেকেই উদ্ভুত হয়। প্রানীরা কখনো  খুব ভাল (পরার্থ), আবার কখনো খুবই খারাপ (স্বার্থপর)আচরণ করে, আর কখন কোনটা করবে তা নির্ধারিত হয় জেনেটিক স্তরে সর্বোচ্চ হিস্যা আদায়ের নিরিখে।… প্রানীজগতে পরার্থতা আসলে একটি সুচারু মাধ্যম  যার  ফলশ্রুতিতে অতলস্পর্শী জিনগুলো নিজ নিজ স্বার্থ সর্বোত্তম উপায়ে চরিতার্থ করতে পারে।’ 

যৌনতা, যৌনতার নির্বাচন এবং পরার্থিতা
 
আমাদের বিবর্তনীয় যাত্রাপথের খুব কাছের আত্মীয় শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলেন গবেষকেরা। তারা দেখলেন শিম্পাঞ্জিদের মধ্যেও সহযোগিতা দৃশ্যমান, কিন্তু সেটার পেছনে কাজ করে এক ধরণের যৌনাভিলাস। শিম্পাঞ্জিরা শিকার করে, কিন্তু অনেক সময়ই সেই শিকার  নিজেদের বা গোত্রের পুষ্টির জন্য নয়, বরং নারীদের আকর্ষণ করে  যৌনসঙ্গমে প্রবৃত্ত করার জন্য।
 
ধরা যাক একদল শিম্পাঞ্জি জঙ্গলে ঘুরতে ফিরতে গিয়ে কলোবাস বানরদের একটা দলের দেখা পেলো। অনেক সময় তারা কলোবাসদের আক্রমণ করে, কখনো বা আবার করে না। আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই নির্ভর করে দলে নারী শিম্পাঞ্জিদের উপস্থিতি এবং আধিক্যের উপর। দলে কোন যৌনান্মুখ শিম্পাঞ্জি (swollen female chimp)থাকলে নির্ঘাত আক্রমণের সূচনা ঘটে। দক্ষ শিকারীরা  সফল অভিযানের পর সাথে করে মাংস নিয়ে আসে সেই সব যৌনান্মুখ নারী শিম্পাঞ্জির জন্য। দেখা গেছে নারী শিম্পাঞ্জিরা সেই সব পুরুষদের প্রতিই থাকে উদার যারা মাংসের ব্যাপারে কোন কৃপণতা করে না।

  

 ব্যাপারটা কি মানব সমাজের জন্যও প্রযোজ্য? বলা মুশকিল। মাংসের জন্য না হলেও অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রির পেশা তো মানব সমাজে আছে, তা সবারই জানা। শিম্পাঞ্জিদের সমাজে যৌনতার বিপননের মাধ্যম মাংস, মানব সমাজে অর্থ কড়ি। এখন, আদিম মানব সমাজে নৈতিকতার উদ্ভবের পেছনে এ ধরণের কোন ধরণের যৌনাভিলাস কাজ করেছিলো কিনা সেটা পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞানীরা কিছু আদিম ট্রাইবে গবেষণাকাজ চালিয়েছেন। তাঞ্জানিয়ার অদূরে হাডজা (Hadza) নামে একটি ট্রাইবে গবেষণা চালিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই হাডজা মানুষেরা এখনো শিকারী-সংগ্রাহক হিসেবে জীবন যাপন করে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সেখানে যে সব পুরুষেরা  শিকারে অধিকতর দক্ষ হয়,তারা আবার একই সাথে বহু নারীর প্রণয় অর্জনে সক্ষম হয়।   
 
 
মনোবিজ্ঞানী জিওফ্রি মিলার তার ‘সঙ্গমী মন’ বইয়ে[12] এবং একটি গবেষণাপত্রে[13] সম্প্রতি প্রস্তাব করেছেন যে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের মত গুণাবলীগুলো আসলে যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে মানব সমাজে বিকশিত হয়েছিলো। ব্যাপারগুলো ঘটা অসম্ভব কিছু নয়। সততা, দয়া, মমতা এবং সহমর্মিতার মত গুণ গুলো জাতি, লিঙ্গ এবং সংস্কৃতি নির্বিশেষে মানুষের কাছে আদৃত।  আমরা বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ে ডেভিড বাসের জরিপের গবেষণার কথা জেনেছি। সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ৩৭ টি দেশের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে ছেলে এবং মেয়েদের পছন্দের উপর জরিপ চালিয়েছিলেন তিনি[14]। সেই গবেষণায় নারী-পুরুষ – দুই লিঙ্গের কাছেই যে বৈশিষ্টটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে তা হলো দয়া। অর্থাৎ, পছন্দের তালিকায় দয়ার স্থান বুদ্ধিমত্তা, সৌন্দর্যসহ অন্যান্য সব কিছুর উপরে।  এটা হতেই পারে যে, আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যাদের এই  দয়া, মমতা, বিশ্বস্ততার মতো গুণগুলো ছিলো তারাই খুব বেশি করে বিপরীত লিঙ্গের মনোযোগ এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল, এবং তারাই অধিক হারে এ পৃথিবীতে সন্তান সন্ততি রেখে গেছে।  সেজন্যই এখনো যে কোন সমাজেই দেখা যাবে ভাল মানুষের সংখ্যাই বেশি – যারা অন্য মানুষের দুঃখ দুর্দশার প্রতি সংবেদনশীল এবং সহানুভূতিশীল; চোর ছ্যাচোর, গুণ্ডা, বদমায়েশ এবং স্বার্থপরদের সংখ্যাই সমাজে তুলনামূলকভাবে কম থাকে, এবং এ ধরণের লোকজনকে সাধারণতঃ কেউই সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করতে চায় না।
 
 
মরাল ল্যান্ডস্কেপ
একটা সময়ে ধর্মবাদীরা একচেটিয়াভাবে নৈতিকতার উৎসের জন্য ধর্ম এবং ঈশ্বরকে সাক্ষীগোপাল হিসেবে উপস্থাপন করতেন। তারা বহুকাল ধরেই নৈতিকতার পুরো ব্যাপারটাকে ঈশ্বরিক প্রলেপ লাগিয়ে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন এবং দাবী করেছেন (এবং এখনো অনেকে করেন) যে, জৈববৈজ্ঞানিকভাবে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের উদ্ভবের মতো ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যা করা যাবে না। এগুলোর কোন জৈবিক ব্যাখ্যা নেই। এগুলোর ব্যাখ্যা একমাত্র ঈশ্বর। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা বৈজ্ঞানিক মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়নি মোটেই, বরং জৈবিক উৎস তথা বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কীভাবে পরার্থিতা কিংবা সহযোগিতার মতো ব্যাপারগুলো প্রাণীজগতে উদ্ভুত হয়েছে – এটা যখন থেকে বিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করেছেন, তখন থেকেই ব্যাপারগুলো বরং অনেক বিজ্ঞানভিত্তিক হয়ে উঠেছে।

শুধু ধার্মিকেরাই নয়, অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তিরাও ধার্মিকদের মতো একই ফাঁদে পা দিয়ে বলেন, মানব সমাজের নৈতিকতা ভিন্ন। বিবর্তন দিয়ে এটিকে ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই।  এরাও আসলে ধার্মিকদের মতোই অবচেতন মনে ধরে নেন যে, মানুষ আসলে অন্যান্য প্রানী জগত থেকে আলাদা,  যেন স্বর্গীয় কোন সৃষ্টি! কিন্তু এটি তো ঠিক নয়। মানুষ তো শেষ বিচারে এই জীবজগতেরই অংশ।  অন্য প্রানীতে পরার্থিতা আর নৈতিকতা যে জৈবিক নিয়মে উদ্ভুত হয়েছে, মানুষের মধ্যেও সেই একই উৎসই কাজ করছে, তা এখন যতই অস্বাভাবিক লাগুক না কেন। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, মানব সমাজ অনেক জটিল। কিন্তু সেই জটিলতা ব্যাখ্যার জন্য জীববিজ্ঞানকে বাদ দেয়ার দরকার নেই। পিঁপড়ে, মৌমাছি কিংবা ডলফিনদের সমাজও জটিল। জটিল শিম্পাঞ্জিদের সমাজও। তাদেরও ভিন্ন ভিন্ন জটিল সোশাল স্ট্রাকচার আছে। সেগুলো বিজ্ঞানীরা জৈববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াতেই বিশ্লেষণ করে চলেছেন। মানব সমাজের বিবিধ জটিলতার উৎসের কারণে নৈতিকতার স্তরে যে পার্থক্যগুলো আছে তা বিভিন্নভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় স্বর্গীয় উৎস সরিয়ে রেখে। সম্প্রতি (২০১০ সালে প্রকাশিত) স্যাম হ্যারিস একটি চমৎকার বই লিখেছেন ‘দ্য মরাল ল্যান্ডস্কেপ’ শিরোনামে। বইটিতে হ্যারিস দাবী করেছেন যে, নৈতিকতা নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো আসলে বিজ্ঞানের একটি ‘অবিকশিত শাখা’ (undeveloped branch of science)র ই অংশ।  তাই নৈতিকতার ঔচিত্য কিংবা অনুচিত্য নিয়ে  সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার এখন বিজ্ঞানের কাঁধেই থাকা উচিৎ, অশিক্ষিত মোল্লা-পাদ্রী-পুরুতদের কাঁধে নয়। তিনি বলেন,

‘বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা প্রতিদিনই জানতে পারছি কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক, কোনটা মানবিক, কোনটা অমানবিক, কোনটা পরিবেশ সম্মত কিংবা কোনটা স্বাস্থ্যসম্মত। শতাব্দীপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থে লেখা ভুল ভাল বাণী থেকে উঠে আসা মূল্যবোধের চেয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া নৈতিকতাই অধিকতর নির্ভরযোগ্য। …পৃথিবীতে যেমন খ্রীষ্টান পদার্থবিদ্যা কিংবা মুসলিম বীজগণিত বলে কিছু নেই ঠিক তেমনি  মুসলিম নৈতিকতা কিংবা  খ্রীষ্টান নৈতিকতা বলাটাও হাস্যকর। আমি দাবী করব, নৈতিকতার গবেষণা বিজ্ঞানেরই অংশ, বিজ্ঞানের এক অবিকশিত শাখা এটি’।

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে জীববিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক এবং বিবর্তনীয় উৎসের সন্ধান করে বহু বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ এবং গবেষনাপত্র প্রকাশিত হয়েছে[15]। এমনকি ডারউইন নিজেও সে সময় জেনেটিক্সের কোন জ্ঞান ছাড়াই কেবল জীবজগৎ পর্যবেক্ষণ করে সহযোগিতা এবং পরার্থতার বিবর্তনীয় উপযোগিতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।আধুনিক বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং চিন্তাবিদেরা  বহুভাবে দেখিয়েছেন যে এই ডারউইনীয় পদ্ধতিতে প্রাকৃতিকভাবেই পরার্থপ্রায়ণতা, সহযোগিতা, নৈতিকতা আর মূল্যবোধের মতো অভিব্যক্তিগুলো জীবজগতে উদ্ভুত হতে পারে, যা বিবর্তনের পথ ধরে মানব  সমাজে এসে আরো বিবর্ধিত আর বিকশিত হয়েছে।গবেষক এলিয়ট সোবার তার একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন,

‘যদি আমরা বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোন থেকেও নৈতিকতার ব্যাপারগুলো চিন্তা করি, তারপরেও এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে বিবর্তন মানুষকে কেবল স্বার্থপর  এবং অহঙ্কারী হিসেবে গড়ে তুলবে।  বরং উল্টোভাবে এটা বরং খুবই সম্ভব যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন তাদেরকেই বাড়তি উপযোগিতা দিয়েছিলো যারা আত্মম্ভরী কিংবা স্বার্থপর না হয়ে গোত্রের মধ্যে সহযোগিতামূলক ব্যবহার প্রদর্শন করেছিলো’।

আমরা অধ্যায়ের শুরুতে স্যামুয়েল বাওয়েলের বিবর্তন মনোবিজ্ঞান নিয়ে একটি মজার কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ গবেষণার উল্লেখ করেছিলাম। সেখানে আবারো ফিরে যেতে হচ্ছে। বাওয়েলের গবেষণায় বেড়িয়ে এসেছিলো যে, মূঢ় সহিংসতা থেকেই সম্ভবতঃ একসময় জন্ম হয়েছে মূঢ় পরার্থিতার। এলিয়ট সোবারের মত স্যামুয়েল বাওয়েলও মনে করেন,  প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যে গোত্রের সদস্যরা অনেক বেশি নিজেদের মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা করেছে, তারাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের ছাকুঁনিতে তারাই টিকতে পেরেছে অন্যদের চেয়ে বেশি। কাজেই পরার্থিতার মত অভিব্যক্তিগুলো সমাজে এক সময় না একসময় উদ্ভুত না হবার কোন কারণ নেই। মানব সমাজে এটির উদ্ভবের পরে সেটার বিকাশ এবং বৃদ্ধি তো স্রেফ সময়ের ব্যাপার। সমাজে সুগুণের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা, দুর্বলদের রক্ষার জন্য এক সময় রাষ্ট্রের উদ্ভব, গণতান্ত্রিক আইনের প্রয়োগ, শিক্ষার প্রসার, নারী অধিকার, সাংস্কৃতিক অগ্রসরতা প্রভৃতি মানব নৈতিকতাকে ভিন্ন একটি মাত্রায় নিয়ে গেছে নিঃসন্দেহে। আমাদের আধুনিক মূল্যবোধগুলো যে প্রতিদিনের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকেই উদ্ভুত এবং উৎসারিত, দার্শনিক পল কার্জের ‘নিষিদ্ধ ফল : মানবিকতার মূল্যবোধ’ গ্রন্থে এই মতের সুস্পষ্ট সমর্থন মেলে[16]।

প্রখ্যাত মনোবিদ, বিজ্ঞানের দার্শনিক এবং স্কেপটিক ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা ড. মাইকেল শারমার মানব সমাজে মুল্যবোধ এবং নৈতিকতার অভিব্যক্তি নিয়ে আলাদা করে ভেবেছেন এবং এ নিয়ে লিখেছেন। তিনি তার ‘দ্য সায়েন্স অব গুড এণ্ড এভিল’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন সমাজ বিকাশের প্রয়োজনেই মানুষ কিছু নীতিকে প্রথম থেকে ‘গোল্ডেন রুল’ হিসেবে গ্রহন করেছিল[17] :

Do unto others, as you would have them do unto you.
(অন্যদের প্রতি সেরকম ব্যবহারই করো যা তুমি তাদের থেকে পেতে চাও)

কারণ এই নীতির অনুশীলন ছাড়া কোন সমাজ ব্যবস্থা টিকে থাকবে না। মাইকেল শারমার তার গবেষনায় দেখিয়েছেন যে, মানব বিবর্তনের ধারাতেই পারষ্পরিক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি আবার নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সহনশীলতা, উদারতা, স্বার্থত্যাগ, সহানুভূতি, সমবেদনা প্রভৃতি গুনাবলির চর্চা হয়েছে। সভ্যতার প্রতিনিয়ত সংঘাত ও সংঘর্ষেই গড়ে উঠেছে মানবীয় ‘প্রোভিশনাল এথিক্স’, যা মানুষকে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। আমরা এখনো মানবিকতার কষ্টিপাথরে নিজেদের মূল্যবোধ প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে চলেছি। বিগত কয়েক শতকের সামাজিক বিবর্তন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আমরা আমাদের মানবিক মূল্যবোধ গুলোকে বাড়িয়ে নিতে পেরেছি বহুক্ষেত্রেই। এখন আর কালো মানুষদের দেখলে ‘নিগ্রো’ শব্দটি উচ্চারণ করি না, বাংলাদেশে ‘উপজাতি’র বদলে লিখি ‘পাহাড়ী জনগোষ্ঠি’। আমরা জীর্ণ শীর্ণ পুরাতন মূল্যবোধগুলোকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করে সেগুলোর সংস্কার করতে পেরেছি।সাড়া বিশ্বজুড়েই নারীবাদী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে জেণ্ডার সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়ছে, বৃদ্ধি পেয়েছে বৃদ্ধ কিংবা শিশু অধিকারের প্রতি দায় দায়িত্বও। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার-সচেতনতা, সমকামী এবং রূপান্তরকামীদের প্রতি সহমর্মিতাসহ অনেক মূল্যবোধই আজকে খুব ভালভাবে চোখে পড়ে, যেগুলো কয়েক দশক আগেও ছিলো একেবারেই অনুপস্থিত। রিচার্ড ডকিন্স তার ‘গড ডিলুশন’ গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে ‘Natural Selection as a consciousness Raiser’ অংশে মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, আসলে ডারউইনীয় সিলেকশনের মতোই এক ধরণের নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের মূল্যবোধগুলোকে ক্রমশঃ বাড়িয়ে তুলছি, ঠিক যেভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন নামের ডারউইনীয় সিলেকশন প্রক্রিয়ায় সরল জীব থেকে উদ্ভুত হয়েছে জটিল জীবজগতের[18]। নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের ক্রমিক চর্চার মাধ্যমে জৈববৈজ্ঞানিক পথেই আমরা প্রতিদিনই বাড়িয়ে তুলছি, জাগিয়ে তুলছি আমাদের সুপ্ত মানবতাবোধ।  
 

তথ্যসূত্র :
[1] দিগন্ত সরকার, ‘স্বার্থপর জিন’ -এর আলোকে সহযোগিতা এবং আত্মত্যাগ, বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়, মুক্তমনা ই-বুক, মুক্তমনা দ্রষ্টব্য
[2] In the biological literature, this game of game theory is referred to as Hawk-Dove. The earliest presentation of a form of the Hawk-Dove game was by John Maynard Smith and George Price in their 1973 Nature paper, “The logic of animal conflict”, Nature 246: 15–18.
[3] Heinz R. Pagels, The Dreams of Reason: The Computer and the Rise of the Sciences of Complexity, Bantam, 1989; অনুবাদের কিয়দংশ অপার্থিব জামান, বিবর্তনের দৃষ্টিতে নৈতিকতার উদ্ভব, বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়, মুক্তমনা ই-বুক।
[4] Matt Ridley, The Origins of Virtue: Human Instincts and the Evolution of Cooperation, Penguin;  1998
[5] Axelrod, Robert; Hamilton, William D, “The Evolution of Cooperation”, Science 211: 1390–96, 1981
[6] Axelrod, Robert, The Evolution of Cooperation, Basic Books, 1984
[7] Gerald S. Wilkinson, Reciprocal food sharing in the vampire bat, Nature, 308, 181 – 184, 1984
[8] Craig Packer,  Reciprocal Altruism In Olive Baboon, Nature, 265: 441-3
[9] R Noë, Alliance formation among male baboons: shopping for profitable partners. In: Harcourt AH, de Waal FBM, editors. Coalitions and alliances in humans and other animals. Oxford: Oxford University Press. pp. 285–321, 1992
[10] R.C. Connor,   R.A. Smolker, and A.F. Richards,  Dolphin alliances and coalitions. In A.H. Harcourt and F.B.M. de Waal (Eds.), Coalitions and alliances in animals and humans (pp. 415-443). New York: Oxford University Press, 1992.
[11] Richard dawkins, Unweaving the Rainbow: Science, Delusion and the Appetite for Wonder, Mariner Books; First Edition edition, 2000
[12] Geoffrey Miller, The Mating Mind: How Sexual Choice Shaped the Evolution of Human Nature, Anchor, 2001
[13] Geoffrey Miller, Sexual Selection for Moral Virtues, The Quarterly Review of Biology, 82(2) : 2007
[14] D.M. Buss,  Sex differences in human mate preferences: evolutionary hypotheses tested in 37 cultures. Behavioral and Brain Sciences 12, pp. 1–49, 1989.
[15] সাম্প্রতিক সময়গুলোতে জীববিজ্ঞান, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং বিবর্তনীয় উৎসের সন্ধান করে বহু বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ এবং গবেষনাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়:
* Robert Axelrod, The Evolution of Cooperation, Basic Books, 1985
* Richard Alexander, The Biology of Moral Systems, Aldine Transaction, 1987
* Robert Wright, The Moral Animal : Why We Are, the Way We Are: The New Science of Evolutionary Psychology, Vintage, 1995
* Frans B. M. de Waal, Good Natured: The Origins of Right and Wrong in Humans and Other Animals, Harvard University Press, 1997
* Larry Arnhart, Darwinian Natural Right: The Biological Ethics of Human Nature, State University of New York Press, 1998
* Leonard D. Katz, Evolutionary Origins of Morality : Cross-Disciplinary Perspectives, Imprint Academic, 2000
* Donald M. Broom, The Evolution of Morality and Religion, Cambridge University Press, 2004  ইত্যাদি 
[16] Paul Kurtz, Forbidden Fruit: The Ethics of Humanism, Prometheus Books, 1988
[17] Michael Shermer, The Science of Good & Evil: Why People Cheat, Gossip, Care, Share, and Follow the Golden Rule, Holt Paperbacks, 2004
[18] Richard Dawkins, The God Delusion, Houghton Mifflin Harcourt; 2006