ছেলেবেলায় পরিবার পরিজন কিংবা আত্মীয়স্বজনরা বাংলা প্রবাদ বাক্যের বহুরূপতার সুযোগ নিয়ে যে অন্যায়টা করেছে, তার দায়ভার আমাকে এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ছলনাময়ী বাংলাভাষার কারসাজিতে জীবন থেকে হারিয়ে গেছে দুরন্ত সব দিন। আর পাঁচ-দশটা ছেলের মত ছোটবেলায় আমারও ইচ্ছে করতো মাঝদরিয়ার মাঝি কিংবা ভেঁপু বাজিয়ে বিপুল বিক্রমে ছুটে চলা ভারী কোন পাবলিক পরিবহনের ড্রাইভার হতে। আহারে! নদী অথবা রাস্তার মাঝখান দিয়ে কি সুনিপুণ কৌশলে তারা চালিয়ে নিয়ে যেত তাদের বাহনগুলিকে। সমস্ত যাত্রীর জীবন-মরণ তাদের হাতে। গর্বে-তো তাদের মাটিতে পা পড়বার কথা নয়। তাদের পড়ে পড়ুক, আমার অন্তত পড়ত না।

কিন্তু আমার সেই স্বপ্নে বিপত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো আমারি আপনজনেরা। বুদ্ধি হতে না হতেই হাতে ধরিয়ে দিলো বই। “পড়, তোমার প্রভুর নামে”। আরে আশ্চর্য, প্রভুর নাম করে নৌকা চালাতে বললেওতো পারতো; “চালাও, তোমার প্রভুর নামে”। পড়তো পড়, সারা বছর ধরে পড়। সেই সারাবছর জুড়ে পড়িয়ে নেবার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হত ছলনাময়ী ভাষা। বছরের শুরুতে বলে, “ সকাল দেখলে বুঝা যায় দিন কেমন যাবে”। আরো একটু গম্ভীর হলে, ইংরেজীটাকেও টেনে এনে বলতো, “মর্নিং শৌজ্ দ্যা ডে”। অতএব, শুরুতেই ভালো রেজাল্ট করতে হবে, শুরুতেই পড়তে হবে। আশা ছিলো শেষে বুঝি না পড়লেও হবে। হায় খোদা! কে জানতো, “শেষ ভালো যার, সব ভালো তার” বলে বাংলায় আরেকটা বাক্য আছে। সেটাইতো দিলো সব শেষ করে। অতএব, শেষে ভালো না করলে প্রথমে ভালো করলেও লাভ নেই। আরে সেটা আগে বলেন, তাহলে আগে লেখাপড়া বাদ দিয়ে শুরুর কটা দিন নৌকা চালাতাম। যত্তসব কারসাজিরতো মানে হয় না।

সে-যাই হোক। পড়ালেখাটা না হয় সবাই মিলে অন্যায়ভাবে করিয়ে নিলেন। তাই বলে আমাকে দুঃখ পেতে দেখলে সবাই মিলে এসে বলবেন, “দুঃখের পরে সুখ, রাতের শেষে ভোর, আঁধার গেলে আলো”। কত শত মধুর সব সান্ত্বনার কথা। খুব মানলাম। আপনাদের কথার রেশ ধরেই বুঝি আমারও সুখের দিন আসে, যায়ও দিন ভালো। তখন কেন এসে আবার বলেন, “এত খুশি হয়ো না,যায় দিন ভালো, আসে দিনে খারাপ।” মানেটা কি? আমার ভালো খারাপের দরকার নাই। যা বলবেন, যে-কোন একটা বলুন দয়া করে।

সবচাইতে বড় প্রহসনটা হয়েছে, “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু”, এই প্রবাদ বাক্যটি। এত বড় মিথ্যা কথা আমি ইহজনমে খুব বেশি একটা শুনিনি। পাপে মৃত্যু মানে কি? “লোভে পাপ, পাপে জেল জরিমানা দোজখ” টাইপ কিছু একটা হলেও মানা যেত, মৃত্যুতো ভাবার্থে ব্যবহার করারও প্রশ্ন আসে না। তবে এ-প্রবাদ বাক্যের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে এটি ছলনাময়ী নয়। কখনো গিয়ে আবার বলেনি, “লোভেই পাপ, পাপেই সুখ”। যদিও সেটা খুব একটা মিথ্যা বলা হত না। তবে এর থেকে মারাত্মক কথাও আছে, “যেখানে দেখিবে ছাঁই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন”। হায় মাবুদ্! এত কিছু থাকতে রতন খোঁজার জন্য ছাঁই উড়াতে বলে কেন?

কিন্তু সবচাইতে বড় যেই কারসাজির শিকার আমি হতে দেখেছি, সেটা প্রবাদ নয়, বরং ভাষার মারপ্যাঁচ। বাংলাদেশের খুব নামকরা একটা সফটওয়্যার ফার্ম। বরাবরের মতই যেখাকার সিইও একজন ধূর্ত, ধুরন্ধর এবং কেতাদুরস্ত মানবসন্তান। সফট্ওয়্যার ফার্মগুলোর জন্য বিশেষ সময়ে খুব অভিজ্ঞলোকজনের দরকার হয়ে পড়ে, যেটা অনভিজ্ঞদের দিয়ে করানো সম্ভব নাও হতে পারে। তো সিইও সাহেবের সে বছরের মত একটা প্রজেক্ট এর কাজ সুসম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশের ফার্মগুলোর মৌলিক যে সমস্যা, দীর্ঘমেয়াদী কোন চিন্তা বা পরিকল্পনা নেই। প্রজেক্ট শেষ, তো কর এমপ্লয়ি ছাঁটাই। এই সিইও সাহেবও তার ব্যতিক্রম নয়। তিঁনি হিসেব করে দেখলেন, ঐ প্রজেক্টে দুইজন অনভিজ্ঞ এবং একজন অভিজ্ঞ এমপ্লয়ি কাজ করেছে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ দুইজনের বেতনভাতার যোগফল অভিজ্ঞজনের চেয়ে কিছুটা বেশি। অতএব, মহামান্য সিইও অভিজ্ঞজনকে রেখে অনভিজ্ঞ দুইজনকে ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু প্রতিটা ছাঁটাইয়ের পিছনে একটা করে নাটক থাকে। বাঙ্গাল সিইওরা আবার নাটক করতে খুব পছন্দ করেন। অতএব, নাটকের কুশীলব ও নট-নটী অর্থাৎ ম্যানেজারদেরকে নিয়ে মিটিং বসানো হল। ম্যানেজারগণ পরামর্শ দিলেন, দুইজনকে না ছাঁটাই করে অভিজ্ঞ যে একজন তাকে করলেই ভালো। কারণ, অভিজ্ঞতা থাকার কারণে তিনি অন্য কোথাও থেকে ঠিকই চাকুরী পেয়ে যাবেন।

এটা শোনার সাথে সাথেই নাট্যকার সিইও সাহেব নাটকের প্রথম দৃশ্যের অবতারণা করলেন। স্ক্রিপ্ট পড়ে শুনাতে লাগলেন একটু একটু করে। “আপনারাতো হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এর নাম শুনেছেন?” বোকা ম্যানেজারগুলো জোর করে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত কিংবা বিটিভির পবিত্র গীতা পাঠকারী কোনো শ্রী শ্রী এর চেহারা মনে করার চেষ্টা করলেন। সিইও বলে চললেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান, মহোমহোপাধ্যায় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একবার বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ করার দরকার হলে একজন রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) নিয়োগ করার জন্য মনঃস্থির করেন। সহকর্মীরা বিভাগের শিক্ষক সংকটের কথা তুলে ধরে তাঁকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন, একজন রিডার নিয়োগ করতে বিভাগের যে পরিমাণ ব্যয় হবে, তা দিয়ে দুইজন লেকচারার(প্রভাষক) নিয়োগ দেয়া যেতে পারে, এতে করে বিভাগের শিক্ষক সঙ্কট কিছুটা হলেও দূর হবে। উত্তরে শাস্ত্রী মহোদয় তাঁদেরকে শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ১৬ বছরের একজন যুবতীর অভাব কি ৮ বছরের দুইজন বালিকা দিয়ে দূর করা সম্ভব?” সিইও সাহেব নাটকের এই পর্যায়ে এসে খানিকটা দম নিলেন, ম্যানেজারদের মুগ্ধ হবার জন্য সময় দিলেন। ম্যানেজারগণ সিইও সাহেবের প্রতিভায় মুগ্ধ হলেন, তারপর বুঝতেও পারলেন কেন তারা আজও ম্যানেজার, আর সিইও-ইবা কেন সিইও। যথাসময়ে অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞ দু’জনকে চাকুরী থেকে অব্যাহতি দেয়া হল।

সফট্ওয়্যার ফার্মের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী কিছুদিন পর আবার নতুন প্রজেক্ট আসলো। আবারো নতুন এমপ্লয়ি নিয়োগ দেয়া হল। গতির সমীকরণ অনুযায়ী কাজে-কর্মে গতিশীলতাও আসলো এবং বলের ধর্ম অনুযায়ী একসময় প্রজেক্ট সম্পন্নও হলো। অন্যদিকে, কালের নিত্যতা সূত্র অনুযায়ী আবারো আসলো ছাঁটাইয়ের সময়। সিইও সাহেব এবার হিসেব করে দেখলেন, অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞদের যে বেতনভাতা দিতে হচ্ছে, তার থেকে অনেক বেশি দিতে হচ্ছে অভিজ্ঞজনকে। অনভিজ্ঞ দুইজনের বেতনভাতার যোগফলও অভিজ্ঞ একজনের থেকে অনেক কম।

যথা সময়ে ম্যানেজারদের ডাকা হল। তাদের পুর্বাভিজ্ঞতা আছে, তাই তারা এখন জানেন, জানতে চাওয়া হলে তারা কাকে ছাঁটাই করার পরামর্শ দেবেন। নাট্যকার সিইও সাহেব এবার তাঁদের কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না, শুধু বললেন, অভিজ্ঞজনকে তিনি রিলিজ দেবার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কারো কোনো কথা বলবার আছে কি-না? ম্যানেজারদের মধ্য থেকে একজন বললেন, “মিঃ সিইও, অভিজ্ঞজনকে কেন রিলিজ দেয়া হচ্ছে, ১৬ বছরের একজন যুবতীর অভাবতো ৮ বছরের দুইজন বালিকার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়?” সিইও সাহেব উত্তর দিলেন, “ম্যানেজার সাহেব, আপনার কথা অত্যন্ত সঠিক। কিন্তু মনে রাখবেন, ৩২ বছরের একজনের অভাব ১৬ বছরের দুইজনের পক্ষে দাপটের সাথেই পালন করা সম্ভব।

মইনুল রাজু
সেপ্টেম্বর ২৮,২০১০
[email protected]