কয়েক দিন ধরেই মনে হচ্ছিল আমেরিকা ইরানের পারমানবিক বিষয় নিয়ে এত যে মাতামাতি করছে তার পিছনে একটা গভীর উদ্দেশ্য কাজ করছে। কারন ইরান এমন কোন শক্তি নয় বা তার এমন কোন হিম্মত নেই যে আমেরিকাকে চ্যলেঞ্জ করবে। সাথে সাথে এটাও মনে হচ্ছিল সে উদ্দেশ্য হলো মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সৌদি আরবে বিপুল পরিমান অস্ত্র বিক্রি করা। মনে হতে না হতেই দেখলাম আমার অনুমান শতভাগ সত্যি। আমেরিকা সৌদি আরবের কাছে ৬০০০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করার চুক্তি করেছে। অত্যাধুনিক মডেলের এফ-১৫ জঙ্গী বিমান, এপাচি ও ব্লাক হক হেলিকপ্টার, ক্ষেপনাস্ত্র বিধ্বংসী অস্ত্র সহ নানান কিছিমের বিপুল সংখ্যক অস্ত্র বিক্রি করার ব্যবস্থা হয়েছে। তার মানে ইরান নিয়ে এত মাতামাতির কারন আমেরিকার অস্ত্র বিক্রির রাস্তা পরিস্কার করা আর একই সাথে তাদের গুদামে পড়ে থাকা তাদের কাছে সেকেলে অস্ত্র ভান্ডার খালি করে গুদাম পরিস্কার করা। আর পরোক্ষ ভাবে আমেরিকার বিভিন্ন ব্যাংকে সৌদিদের অলস পড়ে থাকা বিপুল অর্থকে স্রেফ গায়েব করে সৌদিদের পকেট ফাকা করে দেয়া। ইতোপূর্বে দেখা যেত যখনই আমেরিকা আরব দেশসমূহে অস্ত্র বিক্রি করত, ইসরাইল তা নিয়ে মাতম শুরু করত। এবারে একদম চুপ। ইসরাইল চুপ আর তার শক্তিশালী মার্কিন লবিও চুপ। কারন কি ? কারন হলো – ইসরাইলও ইরানের হম্বি তম্বিতে একটু হলেও ভয় পেয়েছে, আর তাই আমার শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু এ ফর্মুলায় ইসরাইল এ বিপুল অস্ত্র বিক্রির ব্যপারে একেবারে নিস্ক্রিয়। এক্ষেত্রে ইসরাইলের শত্রু হলো ইরান, ইরানের শত্রু হলো সৌদি আরব, আর তাই এখন সৌদি আরব ইসরাইলের বন্ধুর ভুমিকায় অবতীর্ন। তবে অন্য একটা কারনও আছে ইসরাইলের এ নিশ্চুপ ভুমিকার। তা হলো- আমেরিকা ইসরাইলকে সর্বাধুনিক পঞ্চম প্রজন্মের স্টীলথ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ জঙ্গী বিমান দিতে সম্মত হয়েছে। পক্ষান্তরে আমেরিকা সৌদিকে দিচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের এফ-১৫। তাছাড়া ইসরাইলের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আ্যন্টি ব্যলাস্টিক মিসাইল ব্যটারী তো আছেই । তাই ইসরাইলের চিন্তার তেমন কোনই কারন নেই। মনে পড়ে ১৯৮১ সালের দিকে ইরাক যখন তার পারমানবিক প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন হঠাত এক রাতে ইসরাইলের জঙ্গী বিমান বহর ঝটিকা আক্রমন চালিয়ে পুরো প্রকল্প মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। এবার সে কেন ইরানের ব্যপারেও একই পদক্ষেপ গ্রহন করছে না। বিষয়টি আমাকে বেশ আশ্চর্য করছিল। এখন বোঝা গেল কেন ইসরাইল সে কান্ডটি করেনি। অথচ ইসরাইলের এখনও সে কান্ডটি করার ক্ষমতা বিদ্যমান।

সুতরাং এর সাথে নিউইয়র্কের গ্রাউন্ড জিরো পয়েন্টের কাছে মুসলমানদের ইসলামী সেন্টারের নামে মসজিদ স্থাপনের পরিকল্পনার একটা যোগ সূত্র বিদ্যমান। যাতে নাকি সৌদি প্রিন্সের এক বিরাট আর্থিক অবদান থাকবে। আমেরিকা চাচ্ছে তার পুরনো অস্ত্র বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করতে ও একই সাথে তাদের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও সচল করতে, সৌদিরা আর আগের মত অত বোকা নেই, তারা ভালই জানে যে আমেরিকা ইরানকে দিয়ে খেলিয়ে তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে চায় ও তাদের কোষাগার নি:শেষ করতে চায়, তাই তারাও যতটা সম্ভব আমেরিকাতে ইসলাম রপ্তানী করতে চায় এ সম্ভাবনায় যে দুর ভবিষ্যতে হলেও যদি আমেরিকাকে মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠ করা যায়। কারন এখন সৌদিরা বুঝে গেছে তেল হয়ত আর বেশীদিন থাকবে না, যখন তা ফুরিয়ে যাবে তখন আর কোন কিছু্ই করা যাবে না, কোন কৌশল খাটানো যাবে না , তাই তা থাকতে থাকতেই যতটা ব্যবহার করা যায় ততই মঙ্গল। ফ্লোরিডার প্যষ্টরের কোরান পোড়ানোর যে পরিকল্পনা আমার কাছে মনে হচ্ছে তা আমেরিকা সরকারী মহল থেকেই উস্কে দেয়া হয়েছে যাতে আমেরিকানদের মনে ইসলাম সম্পর্কে আরও বেশী ঘৃণার সৃষ্টি করা যায়, যাতে করে গ্রাউন্ড জিরো পয়েন্টের কাছে ইসলামী প্রকল্পের বিরুদ্ধে আরও বেশী মার্কিনী সোচ্চার হয় , যার পরিনতিতে সরকার সেখানে জনমতের অজুহাত দেখিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্দ করার ঘোষণা দিতে পারে। তার মানে আমেরিকা সৌদিদের কাছে অস্ত্রও বিক্রি করতে চায়, অথচ গ্রাউন্ড জিরোতে কোন মসজিদ নির্মান করতে দিতে চায় না। অথচ আমেরিকার সরকার সৌদি রাজ পরিবারকে বুঝ দিতে চায় যে সরকারের পক্ষ থেকে কোন দ্বিমত ছিল না মসজিদের ব্যপারে কিন্তু জনমত বিরুদ্ধে যাওয়ায় তা সম্ভব হচ্ছে না। আমেরিকা সাপও মারতে চায় কিন্তু লাঠি ভাঙতে চায় না। তবে এ ব্যপারে আমার কাছে মনে হয় যে- মসজিদ নির্মানের ব্যপারে প্রেসিডেন্ট ওবামার সায় থাকলে থাকতেও পারে কিন্তু সে ভিতরের কুটচাল সম্পর্কে অতবেশী অবহিত ছিল না আর অবহিত থাকলেও তার করার কিছু নেই। তাই সে ধরি মাছ না ছুই পানি জাতীয় একটা বক্তব্য প্রদান করেছে অতি সুকৌশলে আর যার আসলে তেমন কোন সুনির্দিষ্ট অর্থ নেই। আর কে না জানে ওবামা এ ধরনের আকর্ষণীয় অথচ সুনির্দিষ্ট অর্থহীন বক্তব্য প্রদানে দারুন পারদর্শী? মূলত তার এ বিরল বাকপটুতার কারনেই আজকে সে আধা কালো হওয়া সত্ত্বেও এত দুর আসতে পেরেছে। আমেরিকাকে তো আসলে সে দেশের প্রেসিডেন্ট চালায় না , চালায় ওদেশের কর্পোরেট কোম্পানীগুলো, সি আই এ আর ইসরাইলী লবী। এখানে একটা ব্যপার কিন্তু খুব ভাল ভাবে বুঝতে হবে , যখনই ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিশ্চিত হয়ে গেছিল তখন তার সম্ভাব্য ইসলামের প্রতি দুর্বলতাকে প্রতিরোধ করতেই হিলারী ক্লিন্টনকে তার পররাষ্ট্র মন্ত্রী করা হয়। আর কে না জানে হিলারী ক্লিন্টনের ইসরাইলি প্রেম অত্যাধিক। অন্য কথায় হিলারী ক্লিন্টন নামেই ডেমোক্রাটিক আসলে তার নীতি আদর্শ রিপাবলিকানদের মতই কট্টর। অনেকেই জানেন, বুশ জুনিয়র যখন ইরাক আক্রমনের জন্য কংগ্রেসে ভোটাভুটি করছিল তখন হিলারী ক্লিন্টন অত্যন্ত প্রভাবশালী ডেমোক্রাটিক লীডার ও সরকার বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও বুশের পক্ষে মানে সরকারের পক্ষে ভোট দেয়। যার ফলে বুশের পক্ষে সহজ হয়ে যায় ইরাক আক্রমন করা। ওবামার হাতকে আরও ছেটে ফেলার জন্যে হোয়াইট হাউজ স্টাফ প্রধান করা হয় এক কট্টর ইহুদি রাম ইম্মানুয়েলকে।

কমুনিষ্টদের বিরুদ্ধে তথা প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়ার আমলে আসলে আমেরিকার অস্ত্র বিক্রির জন্য ভাল উপলক্ষ্য ও অজুহাত ছিল। রাশিয়ার পতনের পর বেশ বেকায়দা অবস্থায় ছিল আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কিন্তু বুশ সিনিয়র অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করায় মানে ইরাক আক্রমন করে তা সামাল দেয়। এর পর ক্লিন্টনের আমলে তারা আবার বিপদে পড়ে। অস্ত্র ব্যবসায়ে ভাটা পড়ে কারন ক্লিন্টন বহির্বিশ্ব নিয়ে মাথা ঘামানো বাদ দিয়ে আভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে বেশী মাথা ঘামায়, জোর দেয় আভ্যন্তরীন অর্থনীতি চাঙ্গা করা ও বেকারত্ব দুর করার প্রচেষ্টায়। তাতে সে বেশ সফলও হয়, তার আমলে আমেরিকায় বেকারত্বের মাত্রা ছিল সব চাইতে কম। তার আমলে আমেরিকার সাধারন মানুষ ভাল ভাবে থাকলেও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের জন্য ছিল খারাপ। একই সাথে বিশ্ব মোড়লীপনাতেও একটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল তখন আমেরিকার। অত:পর বুশ জুনিয়র আসার পর অস্ত্র ব্যবসায়ীরা নড়ে চড়ে বসে ও বিশ্ব মোড়লিপনাতে গতি আসে। আর তার আমলে অজুহাতটাও পাওয়া যায় ভাল আর সেটা হলো টুইন টাওয়ার ধ্বংস। ব্যাস, এবার দৃশ্যপটে কম্যুনিজম এর পরিবর্তে আসে ইসলাম তথা ইসলামী সন্ত্রাস। শুরু হয় একের পর এক আক্রমন, আফগানিস্তান, ইরাক ইত্যাদি। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা নড়ে চড়ে বসে। কিন্তু আসলে বুশের এসব কর্মকান্ডে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের আন্তর্জাতিক ব্যবসা তেমন বাড়ে না। কারন মার্কিনীরা নিজেরাই যদি বাইরের দেশ আক্রমন করে তাহলে তার বন্ধু রাষ্ট্র গুলোর তো আর অস্ত্র কেনার দরকার পড়ে না। অচিরাত আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসায়ীরা বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারে আর তা ফলে তারা আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাজারের সন্ধানে হন্যে হয়ে লেগে পড়ে। উপলক্ষ্যও পেয়ে যায় ইরান ও উত্তর কোরিয়া। ইরানের জুজু দেখিয়ে আরব দেশ গুলোতে অস্ত্র বিক্রি করা যাবে আর উত্তর কোরিয়ার জুজু দেখিয়ে দক্ষিন কোরিয়া ও জাপানে অস্ত্র বিক্রি করা যাবে। আরব দেশের আছে পেট্রো ডলার , দক্ষিন কোরিয়া ও জাপানের আছে বানিজ্য উদ্বৃত্তের বিপুল অর্থ। চায়না কার্ড খেলে তাইওয়ানের কাছেও ভাল রকম অস্ত্র বিক্রি করা যাবে। দেশ ছোট্ট হলে কি হবে, তাইওয়ানের আছে বিপুল বানিজ্য উদ্বৃত্ত অর্থ। এসব কারনেই ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পারমানবিক ইস্যূ বর্তমানে সবচাইতে বড় ইস্যূ যা আমেরিকার দরকার তার অস্ত্র বিক্রির স্বার্থে। আর এ ব্যবসার মধ্যে সৌদি আরব সুযোগ বুঝে তার ইসলাম রপ্তানী করতে চায় আমেরিকা ও ইউরোপে তার পেট্রোডলারের জোরে। মাঝখান দিয়ে লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফিও এ খেলায় অংশ নিতে চায়। তাই তো সেদিন সে ইতালী গেছিল বেড়াতে। এক কোম্পানীকে অর্ডার দিয়েছিল ৫০০ সুন্দরী মেয়ে জোগাড় করতে যাদেরকে জনপ্রতি ১০০ ইউরো করে ভাতা দেয়া হবে। শর্ত ছিল মেয়েদের উচ্চতা কম পক্ষে ৫ফুট ৬ ইঞ্চি হতে হবে, শরীর ঢাকা পোশাক পরতে হবে। ইতালীতে চলছে উচ্চ হারের বেকারত্ব, তাই টাকার বিনিময়ে মেয়ে জোগাড় করতে মোটেও বেগ পেতে হয় নি। অনুষ্ঠানে আসা সব মেয়েকেই ভাল খানা পিনা দেয়া হয়, ভাতা দেয়া হয় আর উপহার হিসাবে একটা সুদৃশ্য মলাট আবৃত কোরান উপহার দেয়া হয়। আমি তখন ইউরোপে ছিলাম , দেখলাম খবরটা বেশ বড় করেই পত্রিকাতে ছেপেছে। আমার বেশ মজাই লাগল খবরটা পড়তে। অন্যদিকে হলান্ডের কট্টরপন্থি নেতা গার্থ বিল্ডারসকে দেখলাম আমেরিকায় সফর করছে আর বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে, জোরে সোরে আমেরিকানদের কাছে আর্জি জানাচ্ছে তারা যেন জিরো পয়েন্টের কাছে কোন মসজিদ স্থাপন করতে না দেয়। বলা বাহুল্য , গার্থ বিল্ডারস হলো হলান্ডের উঠতি নেতা যে মুসলমান ইমিগ্রান্টের কট্টর বিরোধী কারন তার ধারনা মুসলমানরা গোপনে গোপনে ইউরোপে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে সেখানে কোরান হাদিস ভিত্তিক শরিয়া আইন চালু করতে চায়। গেল সাধারন নির্বাচনে সে বেশ ভাল ফলাফল করেছে হলান্ডে এখন তাকে বাদ দিয়ে সরকার গঠন করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। মজার ব্যপার হলো- ইউরোপে দেখলাম প্রতিটি মুসলিম নারী হিজাব পরে ঘোরাঘুরি করে তা যেন অনেকটা ইউরোপীয় মুক্ত সমাজের প্রতি চপেটাঘাতের মত। আমি কিছু সাধারন লোকের সাথে এ বিষয়ে কথা বললাম- দেখলাম তারা এখনও বিষয়টাকে ব্যাক্তি স্বাধীনতার পর্যায়ে রাখতে পছন্দ করে আর ইসলাম যে তাদের জন্য একটা হুমকি অনেকেই ব্যপারটাকে আমলে নিল না। মোট কথা, অস্ত্র ব্যবসা, পেট্রো ডলার, ইসলাম সমন্বয়ে একটা বেশ জটিল লড়াই শুরু হয়েছে দুনিয়া ব্যপী। এখন অপেক্ষা কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাড়ায়।