– আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম।
– Allah creates what He pleases; surely Allah has power over all things.
সূরা নূর- আয়াত নং-৪৫(২৪ : ৪৫)

পৃথিবীর সবগুলো প্রধান ধর্মেই মানুষ কিংবা অন্যান্য প্রাণীদের উৎপত্তি সম্পর্কে মোটামুটি ভাবে ইশ্বরকে এভাবেই গুনাণ্মিত করা হয়েছে। এ মহাবিশ্বের সবকিছুই তার সুপরিকল্পিত ডিজাইনের ফলাফল। আজকের পোস্টে আমরা প্রকৃতিতে-প্রাণীজগতে জন্ম/সৃস্টি প্রক্রিয়ায় ঘটে এমন কিছু ঘটনা যা ইশ্বর কতৃক সুপরিকল্পিত ভাবে ডিজাইন করা সেরকম কিছু ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হব। ।

প্রাণীজগতে শিশুহত্যা (Infanticide) এবং সহোদর হত্যা (Siblicide) অহরহই ঘটে। জন্মের পরপরই, যখন বাবা-মা কিংবা অন্য সদস্যরা উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে কোন শিশুকে হত্যা করে তখন তাকে Infanticide বলে। আর এই হত্যা যখন ভাই-বোনের হাতে ঘটে তখন তাকে বলা হয় Siblicide। Siblicide কখনও কখনও মাতৃ গর্ভে থাকতেই ঘটে থাকে।

আগে এ ঘটনাগুলোকে ব্যতিক্রম হিসাবে মনে করা হলেও বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ দিনের পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা জানতে পারছি যে এই ধরণের হত্যার ঘটনা অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখী, মাছ, কিংবা কীট পতঙ্গের মধ্যে আসলে বহুল প্রচলিত। পুরো প্রাণীজগতেই জন্মের পরপরই কিংবা শিশু অবস্হাতেই সহোদরদের মধ্যে প্রতিযোগীতা দেখা যায় যা কিনা পরবর্তীতে হত্যার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। অনেক সময়ই এই হত্যাকান্ডে মা-বাবা অংশগ্রহণ করে অথবা এটাকে ঠেকাতে কোন ভূমিকাই রাখে না। কিছু উদাহরণ দেখা যাকঃ

১) স্যান্ড শার্কঃ মায়ের গর্ভে থাকা অবস্হাতেই শিশু হাঙরেরা একজন আরেকজনকে আক্রমণ করে হত্যা করে এবং তাদের খেয়ে ফেলে যা তাদের পুষ্টি জোগায়। শুরুতে ২০টির মত শিশু হাঙর মায়ের গর্ভে বড় হতে শুরু করলেও ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে একটি মাত্র স্যান্ড শার্কের শিশু বেঁচে থাকে। যে শিশু হাঙরটি ভূমিষ্ঠ হয় তার সম্পর্কে অবধারিত ভাবেই বলা যায় যে সে তার অন্যান্য ১৯টির মত ভাই-বোনকে মায়ের গর্ভেই হত্যা করেছে। এদের জন্মের শুরুই হয় সহোদর ভাই কিংবা বোনকে হত্যা এবং ভক্ষণের মাধ্যমে।

sand shark

ভিডিও:

২) ব্লু ফুটেড বুবিজঃ জন্মের পরপরই ভাই বোনদের হত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশী দেখা যায় সামুদ্রিক পাখীদের মধ্যে। এই পাখীদের সব সময় তা দিতে সক্ষম এমন সংখ্যার চেয়ে একটি বেশী ডিম পাড়ে। এর পর যেটা ঘটে তা নির্ভের করে নির্দিষ্ট প্রজাতির পাখী এবং খাদ্যের পর্যাপ্ততার উপর। ব্লু ফুটেড বুবিসদের মধ্যে সহোদর হত্যার ঘটনা শুরু হয় যখন সবচাইতে বড় বাচ্চাটি স্বাভাবিকের চাইতে ২০ ভাগের বেশী ওজন কমে গেলে। বড় বাচ্চাটি তখন তার ছোট ভাই-বোনদের ঠোকর দিতে দিতে মেরে ফেলে অথবা বাসা থেকে বের করে দেয়। ফলশ্রুতিতে ছোট বাচ্চাটি খাদ্যের অভাবে কিংবা অন্য প্রাণীদের আক্রমণের শিকার হয়ে মারা যায়। যতগুলো প্রজাতির পাখীর মধ্যে এই ঘটনা লক্ষ্য করা যায় তাদের সবার মধ্যে যে মিলটা খুব বেশী দেখা যায় তা হলো বড় বাচ্চাদের হাতে ছোট বাচ্চারা নিহত হয়। আরও আশ্চর্য্যজনক ঘটনা হলো বাবা-মা এই হত্যা ঠেকানোর কোন প্রচেষ্টাই নেয় না। প্রকৃতপক্ষে বাবা-মাও কখনও কখনও এই হত্যায় অংশগ্রহণ করে। বড় বাচ্চাটি যখন ছোটবাচ্চাটিকে ঠুকরিয়ে বাসা থেকে বের করে দেয় বাবা কিংবা মা পাখিটি তখন ছোট বাচ্চাটির বাসায় ঢোকার প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করে। ব্লু ফুটেড বুবিস পাখিদের ক্ষেত্রে এই হত্যা প্রচেষ্টা একটি দলগত প্রচেষ্টা বা টীম এফোর্ট।

blue footed boobies

৩) কোকিলঃ যত ধরণের প্রজাতির মাঝে শিশুহত্যার প্রবণতা দেখা যায় তাদের মধ্যে কোকিলকে নিঃসন্দেহে চ্যাম্পিয়্যন হিসাবে ধরা যায়। মা কোকিল অন্য পাখীদের বাসায় ডিম পাড়ে। একটি পাখীর বাসায় একটিই ডিম। কোকিল শিশু ডিম থেকে ফুটে বের হওয়ার সাথে সাথেই সে যে কাজটি করে তা হলো অন্য ডিমগুলোকে বাসা থেকে ফেলে দেয়া, এমনকি জন্ম নেয়া বাচ্চাকেও। শিশু কোকিলের পিঠে বিশেষ ধরণের একটি গর্তের মত থাকে যেটা তাকে ডিমগুলোকে দুই ডানার মাঝের খাঁজে উঠাতে সাহায্য করে এবং পাখির বাসার কার্নিশের উপর দিয়ে ফেলে দিতে সাহায্য করে। কোকিল শিশুরা এই কাজটি সহজাত প্রবৃত্তির বশেই করে থাকে। আর এই কাজটা সে করে ডিম থেকে ফুটে বের হওয়ার সাথে সাথেই যখনও কিনা তার চোখ ফুটেনি বা অন্ধ অবস্হাতেই।

siblicide

Cuckoo

৪) মৌমাছিঃ রাণী মৌমাছি মারা যাওয়ার পর লার্ভাগুলো একটি বিশেষ রাজকীয় সেল-এ বিশেষ যত্নে লালিত হতে থাকে। এই সেল সাধারণ অন্যান্য সেল থেকে বড় হয়ে থাকে। লার্ভা গুলিকে সাধারণ কর্মী মৌমাছিরা বিশেষ ধরনের খাবার খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে। এদেরই একজন হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের রাণী। কিন্তু অবাক করা ঘটনা হলো প্রথম ভবিষ্যত রাণী মৌমাছিটা লার্ভা থেকে পিউপাতে পরিণত হওয়ার সাথে সাথেই সে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দী সহোদরাদের, এক্ষেত্রেও প্রায় বিশটির মত, হুল ফুটিয়ে মেরে ফেলে। একজনও তার হাত থেকে নিস্তার পায় না। এভাবেই সে তার সব বোনদের যারা তার প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠতে পারে তাদেরকে সে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

Queen Bee

৫) প্যারাসিটোয়েড বোলতাঃ আরেকটা চরম উদাহরণ হলো এই পয়ারাসিটয়েড বোলতারা যারা কিনা নিজেরা প্যারাসিটিক না কিন্তু অন্য একটি হোস্ট দেহে ডিম পাড়ে এবং সেই হোস্টের দেহেই বাচ্চারা খেয়ে-দেয়ে বড় হয়। মা বোলতা একটি শুঁয়োপোকাকে হুল ফুটিয়ে প্যারালাইজড করে ফেলে এবং সেটার দেহে দুটি ডিম পাড়ে। একটি মেয়ে এবং একটি ছেলে ডিম।

শু্যোপোকার দেহে তৈরী হয় বাচ্চাদের জন্য একটি নার্সারী যাতে রয়েছে সীমিত খাদ্য সরবরাহ। মা বোলতা ডিম পেড়ে চলে যাওয়ার পর আর কখনও ফিরে আসে না। এই ডিম দুটো দ্রুত একটা ক্লোনিং পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যায় যাকে বলা হয় পলিএমব্রয়নি, যা থেকে ২০০’র মত যময ভাই এবং প্রায় ১২০০’র মত যময বোন জন্ম নেয়। এর মধ্যে থেকে ৫০টির মত বোন খুব দ্রুত বড় হয়’। এদের দেহের তুলনায় বিশাল বড় একটি চোয়াল তৈরী হয় এবং এদের কোন সেক্স অর্গান থাকে না। তাই এদের নিজেদের প্রজননেরও কোন সম্ভাবনাও থাকে না। এরা নিজেদের ভাইগুলোকে খেতে শুরু করে। যে ভাইটি আগে পিউপাতে পরিনত হয় সে অন্যান্য ভাইদের পিউপাতে পরিণত হওয়ার আগেই নিজেদের বোনদেরকে নিষিক্ত করা শুরু করে। একেকটি ভাই বোলতা বহুসংখ্যক বোনকে নিষিক্ত করার ক্ষমতা রাখে।

বড় চোয়াল ওয়ালা বোনরা শেষপর্যন্ত অল্প কয়েকটি ভাইকে জীবিত রাখে যাতে হোস্ট শুঁয়োপোকার দেহের সীমিত খাদ্য সরবরাহ বোনগুলোর বড় হওয়া পর্যন্ত পর্যাপ্ত থাকে। আরও অবাক হওয়ার মত ঘটনা হলো মা বোলতাটি হুল ফুটিয়ে প্যারালাইজ করা থেকে বাচ্চারা বড় হওয়া পর্যন্ত শূঁয়োপোকাটি জীবিত থাকে। এতে করে বাচ্চাদের খাবার পচে যায় না। কি অবাক কান্ড!!!!

parasitoid wasp

৬) সিফাকা লিমার: পুরুষ সিফাকা লিমারেরা শিশু হত্যার অভিনব পন্হা অবলম্বন করে থাকে। মেয়ে লিমারদেরকে মনঃসংযোগ নস্ট করে তাদের কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তারা অদ্ভূত কিছু কাজ করে যেমন মেয়েটির কাঁধ কিংবা বাহুতে কামড় দেয়া। মেয়ে লিমারটির কোলের শিশু অরক্ষিত হয়ে পরলে ছেলে লিমারটি শিশু লিমারটিকে মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পেট দুভাগ করে মাটিতে ফেলে দেয়। বলাই বাহুল্য শিশু লিমারটি সংগে সংগে মারা যায় না। তাকে ভোগ করতে হয় একটি দীর্ঘ বেদনাদায়ক মৃত্যু।

সিফাকা লিমারই শুধু নয় এরকম ২০টি প্রজাতির প্রাইমেট এবং প্রোসিমিয়ানদের (লোয়ার প্রাইমেট) ক্ষেত্রে জীববিজ্ঞানীরা শিশুহত্যার প্রচলন পর্যবেক্ষন করেছেন।

sifaka lemur

উপরেল্লিখিত প্রজাতি ছাড়াও আরও বহু প্রাণী, মাছ কিংবা কীটপতঙ্গের জন্ম এবং জীবন ধারণের প্রক্রিয়ার সাথে শিশুহত্যা এবং সহোদর হত্যার প্রক্রিয়া অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। যেমন স্পটেড হায়েনা, মাগেলানিক পেঙ্গুইন, রয়াল পেঙ্গুইন, আমেরিকান কুটস (পাখি), ইউরোপীয়ান কালো সারস, বটল নোজ ডলফিন, ম্যাকাকি বানর, হনুমান, সিংহ, এবং প্রায় সব ধরণের প্যারাসিটোয়েড বোলতা ছাড়াও আরও অনেক অনেক প্রাণী।

সৃস্টিকর্তা কেন এই প্রাণিগুলার ক্ষেত্রেই এমন কস্টদায়ক এবং জটিল পরিকল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন তার কোন ব্যাখ্যা করা যায় না তবে জীব বিজ্ঞানীরা দাবী করে থাকেন এই ঘটনাগুলোর তাৎপর্য্য নাকি বিবর্তন তত্ত্ব দিয়ে অত্যন্ত পরিস্কার ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।

সূত্র:
১) আল-কোরান
২) বর্ন টু রেবেল – ফ্রাঙ্ক জে সালোওয়ে
৩) উইকি
৪)গুগল ইমেজ
৫) টাইটেলের ইংরেজী অংশটুকু ৮০’র দশকে সারা দুনিয়া ব্যাপী বিপুল জনপ্রিয় “The Gods must be crazy” মুভি সিরিজ থেকে ধার করা হয়েছে।