কুলদা রায়ের, “তিনি সেদিন না থাকলে আমাকে হয়ত একটি ছোট মফস্বল শহরে রাস্তার পাশে ছালা বিছিয়ে আলুপটল বিক্রি করতে হত” মনে করিয়ে দেয় আমার ভবিতব্য। কারণ আত্মহননের মত চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমার মাথায় ঝুলছিল। শুধুই সময়ের অপেক্ষা।

১৫ থেকে ২৪ বছরের সম্ভাবনাময় যুবক-যুবতীদের আত্মহত্যার কারণ গুলোর মধ্যে ড্রাগ এবিউজ, প্রেমে ব্যর্থতা, পিতা-মাতার আর্থিক অস্বচ্ছলতা বা বিবাহ বিচ্ছেদ, বন্ধুদের প্রচ্ছন্ন চাপ, সমাজচ্যুতিকরণ, রাগ, অপরাধবোধ, শারিরীক প্রতিবন্ধকতা, পড়ালেখায় ব্যর্থতা, মানসিক ব্যাধি অন্যতম। পিতা-মাতাদের অবহেলাই ৯০% টিন-এজারদের আত্মহত্যার কারণ। আবার ৭৫% আত্মহত্যা মানসিক বিপর্যস্ততা থেকে। ইভ-টিজিংএর শিকার হয়ে আত্মহনন না ঘটলেও জীবনের গতি হয় স্তব্ধ। অনেকগুলো জলধারা্র সম্মিলিত প্রবাহে সৃষ্টি হয় প্রমত্তা মেঘনা। তা থেকে বিচ্যুত দু-একটা জলধারা হারিয়ে যায় অখ্যাত নদী-নালা বা জলাশয়ে। তুচ্ছ আবেগও জীবনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পারে। কেউ দেবদাস হয়। বাপের কথায় রাগ করে স্কুল ছেড়ে শাহ আলম হয় দেশান্তরী। ফিরে এসে জমিতে লাংগল চষে। কেউ বা ছালা বিছায়ে আলুপটলের দোকানদারী করে।

আমার আত্মহননের মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ ছিল আমার দম্ভ, আমার গুমড়া রাগ। ভাল ছাত্র হিসেবে আমার তীব্র অহংকারে আঘাত। ১৫-২৪ বছর বয়েসী ছেলেমেয়েরা চঞ্চল হয়। এরা সামান্য কারণে চুড়ান্ত একটা ভুল করে বসে। তাই ভাবি, আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল থাকলে আমিই হতাম কুলদা রায়ের আলুপটল বিক্রেতা। কত নির্বোধ দুর্বল চিত্ত ছেলেমেয়ে্রা প্রিয়জনের বিরুদ্ধে ভ্রান্ত প্রতিশোধ নিতে গিয়ে দুর্লভ জীবনটাকে বঞ্চিত করে। আমি বেঁচে গেছি। তাই আজ আমার মরা নদীর কানায় কানায় জল। যিনি আমার বঞ্চিত জীবনের অতি তুচ্ছ কারণ হতে পারতেন তিনিই আমাকে বাঁচিয়ে ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক – কাজী মোজাম্মেল হক।

অঙ্ক পরীক্ষা। সব প্রশ্নের উত্তর শেষ। হাতে একঘন্টা অতিরিক্ত সময় আছে তখনও। পেছনে সঞ্জীব একটা ফর্মূলা কিছুতেই মনে করতে পারছে না। মুখে বলছি। কিন্তু ধরতে পারছে না। শেষে প্রশ্নপত্রে লিখে উচু করে ধরে রেখেছি। প্রফেসর হক দেখে ফেলেছেন। আমার নাম এবং প্রশ্নটি নিয়ে গেলেন। তা নিক। কিন্তু আমাকে অভিযুক্ত করলেন আমি নাকি নকল করছি। অভিযোগ সামান্য। কিন্তু তীক্ষ্ণ ফলার মত আমার বুকে বিদ্ধ হল। নকলের অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে! বেটা আমাকে চিনে না! আনুক অঙ্কের বই। বের করুক এমন একটি অংক যা সমাধান করতে আমার দুবার চিন্তা করতে হয়!

তিনি রিপোর্ট করলেন। শো-কজ করা হল। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে জবাব জমা দিয়ে নামছি সিড়ি দিয়ে। অপ্রত্যাসিত ভাবে সেই শিক্ষক মহোদয় তখনই উপরে উঠছেন। বললেন – কী খবর?
– খবর তো আপনি।
– মানে?
– শো-কজের জবাব দিয়ে এলাম।
– কী জবাব?
– না জেনে প্রশ্ন পত্রে লিখেছি। তাই মাফ করতে বলেছি।

প্রফেসর হকের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল – তুমি তো নিজেই নিজের প্যাঁচে পড়ে গেছ। পরীক্ষার হলে কথা বলা শৃঙ্খলা বিরুদ্ধ কাজ। শাস্তি সামান্য নাম মাত্র আর্থিক জড়িমানা। প্রশ্ন-পত্রে কিছু লেখার শাস্তি দুবছরের জন্য বহিষ্কারাদেশ। আমি তো সে রিপোর্ট করিনি। শিগগীর উপরে যাও। জবাব ফিরিয়ে নিয়ে এস। উপরে গেলাম। সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের উত্তর – আমি তিনবার জিজ্ঞেস করছি, জবাব ভেবেচিন্তে দিয়েছেন কি? প্রতিবারই আপনি বলেছেন, হ্যা। আপনার জবাব চলে গেলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের হাতে। আর কিছুই করার নেই।

বাড়ীতে চলে এসেছি। তিন মাস পরে লিখিত উত্তর জানা যাবে। দুবছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার। শুধুই অপেক্ষা। বটগাছের ছায়ায় একটা মরা খেঁজুর গাছ। দিন যায়। মাস যায়। সারাদিন ওর উপর বসে থাকি। পরিকল্পনা করি। আর কোন দিন পড়াশুনা করব না। আমাকে বহিস্কার করবে, করুক। কিন্তু রেজাল্ট যখন বেরোবে তখন তো দেখবে আমি প্রথম হয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় আমার জন্য কেঁদেকেটে তখন সাড়া হবে। তখন কোথাও খুঁজে পাবে না আমাকে। দেখিয়ে দেব প্রতিশোধ কাকে বলে। নকলের অভিযোগ আমাকে?

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাবার নামে একটি পোস্টকার্ড এল। তাতে লেখা – “আপনার ছেলের পড়াশুনার অগ্রগতি সন্তোষজনক নহে। পরীক্ষায় অসৎ উপায় অবলম্বনের দায়ে তাকে পনের টাকা জরিমানা করা হইল।” পরে জেনেছি প্রফেসর হক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সাথে কথা বলেছিলেন নিজ তাগিদে। সেই জন্য শাস্তিটা পনের টাকার উপর দিয়ে গেল।

২০০৭ সাল। পশ্চিম বংগের মালদহ জেলার উত্তর-পূর্ব দিকে বাংলাদেশ ঘেষে ছোট একটি মফঃস্বল শহর, নালাগোলা। ওখানে আমার বাল্যবন্ধু নরেশের সাথে দেখা। ১৯৬৪ সালের রায়টে ওদের বাড়ী পুড়িয়ে দিলে এখানে চলে আসে। একটা সমবায় সমিতিতে চাকরী করে। ছোট দুইভাই তিন চাকা ভ্যানগাড়ী টানে। বয়স ওদেরকে অনেক সামনে নিয়ে গেছে। নরেশ আমাকে ওর বাসায় নিয়ে যাবে। পথে থামল। বাসার ভিতরে পড়ার জন্য এক জোড়া চপ্পল কিনবে। ইটের গাথুনির উপর একতলা দোকান। টিনের একচালা ছাউনী। দুইজন কর্মচারী। পাশে গদীতে বসা ক্যাসিয়ার। তিনিই মালিক। চেনা চেনা মনে হল। কাছে গেলাম। মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল একটি শব্দ – “অপূর্ব!” মালিক মাথা তুলে বড় বড় চোখে তাকাল। হ্যা, অপূর্ব তালুকদার।

১৯৬৮ সাল। মে মাস। কেমিস্ট্রি পরীক্ষার প্রশ্নে কারও কমন পড়েনি। অপূর্বরও পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। কোন্ প্রশ্নের কী উত্তর দিয়েছে, বলল। চল্লিশে পাশ। কিন্তু চল্লিশ হতে চায় না। আমার রুমেও দু বার এল। চল্লিশ বানানো যাচ্ছে না। পরীক্ষকের মর্জি ভাল থাকলে হবে। না হলেই বা অসুবিধা কী? সবাইকে নিশ্চয় ফেল করাবে না। গ্রেস নম্বর আছে। তাছাড়া “রেফার্ড” নামে সুযোগ তো একটা আছেই।

পরদিন সকাল। সব কিছু স্বাভাবিক। শুধু অপূর্ব নেই। নেই তো নেই। তার আর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। আট বছরের ছাত্রজীবনে কত ছাত্র আন্দোলন এসেছে। যোগ হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রাম। ব্রহ্মপুত্রের কতজল হারিয়ে গেছে সমুদ্রে। অপূর্বও হারিয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রের জল। মানুষ আসে, যায়। অপূর্ব স্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। কেউ কোনদিন ওর নামটি উচ্চারণ করেনি। প্রানের দোস্ত শহিদুলও না। দীর্ঘ ৩৯ বছর পরে সেই অপুর্বকে এখানে পাওয়া যাবে স্বপ্নেও ভাবা যায়নি।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের প্রথম ব্যাচের ছাত্র অপূর্ব। বাকী নয় জনের প্রত্যেকে শিক্ষক হয়েছে। পরবর্তীতে কেউ ফিসারিজ রিসার্চ ইনস্টিউটের ডাইরেক্টর বা কোন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হয়েছে। অপূর্বও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত। ডাইরেক্টর বা উপচার্য না হলেও একজন গবেষক হত। কিন্তু ওর মাথায় আবেগের কোন্ ভূত বাসা বাঁধল! জীবনটাকে নিজেই বঞ্চিত করল। দুই জন কর্মচারীকে সে যখন ইচ্ছা হায়ার করে। ফায়ার করে।

টেক্সাস, ১৯ আগষ্ট ২০১০।