নৃপেনদা (নৃপেন্দ্র সরকার) একটি চমৎকার লেখা লিখেছেন বিবর্তনের চোখে চোখের জল শিরোনামে। তিনি লেখাটিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। আমি কিছু উত্তর দিয়েছি এখানে। উত্তর দিয়েছি মূলত মানবীয় আবেগের সাথে বিবর্তনের সম্পর্ক নিয়ে। বিবর্তনের চোখে আবেগের উৎস সন্ধান বিষয়ে আবছা অবতারণা করা হয়েছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ভিন্নতা নিয়ে নৃপেনদার প্রশ্নগুলোর উত্তর উহ্যই থেকে গিয়েছিল। একটু আগে উত্তর দিতে বসলাম। উত্তর দিতে গিয়ে দেখছি উত্তরটা ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। তাই আলাদা লেখা হিসেবে দেওয়াটাই সমীচীন মনে হল। সচেতন পাঠকেরা ধরে ফেলতে পারেন যে, লেখাটির কিছু অংশ আগেকার বিবর্তন মনোবিদ্যা ই-বইয়ে (মানব প্রকৃতির জৈববিজ্ঞানীয় ভাবনা) প্রকাশিত হয়েছে। পুনরুক্তির জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
:line:
নৃপেনদা একটি প্রশ্ন করে শেষ করেছেন তার লেখা,
বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাব ভিন্ন ভাবে কাজ করে আমাদের জৈবিক প্রক্রিয়ায়। বিবর্তন কী ব্যাখ্যা আনে এখানে?
বিভিন্ন সংস্কৃতির যে আপাত পার্থক্যের কথা নৃপেনদা বলছেন তা বুঝতে হলে আমাদের আগে মানবপ্রকৃতি নিয়ে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীদের আধুনিক গবেষনাগুলোর কথা জানতে হবে। এখানে মনে রাখতে হবে, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা রঙ্গমঞ্চে হাজির হবার আগে সার্বজনীন ‘মানব প্রকৃতি’ বলে কিছু আছে কিনা সেটাই ঠিকমত আমাদের কাছে পরিস্কার ছিলো না। যেমন, স্প্যানিশ লিবারেল দার্শনিক হোসে ওর্তেগা গ্যাসেট মানব প্রকৃতির অস্তিত্ব অস্বীকার করে বলতেন, ‘Man has no nature, what he has is history’। ব্রিটিশ-আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ অ্যাশলে মন্টেগু বলতেন, ‘মানুষের সহজাত স্পৃহা (instinct) বলে কিছু নেই; কারণ তার সব কিছুই তার চারপাশের সমাজ-সংস্কৃতি থেকেই শেখা’। কেউ বা আবার মানব প্রকৃতিকে স্বীকার করে নিলেও তাকে একেবারেই কাঁচামালের মত আদিম মনে করতেন। যেমন প্রখ্যাত নৃতাত্ত্বিক মার্গারেট মীড বলতেন, ‘Human nature is the rawest, most undifferentiated of raw material’।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা এসে মানব প্রকৃতি নিয়ে এই প্রচলিত ছকটিকেই উলটে দিয়েছেন। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করা যাক। একজন সার্জন যখন হাসপাতালে অপারেশনের জন্য আসা কোন রোগীর পেটের ভিতর ছুরি চালাবেন বলে ঠিক করেন তখন তিনি জানেন যে, পেট কাটলে এর ভিতরে কি পাওয়া যাবে। পাকস্থলি, বৃহদান্ত্র, ক্ষুদ্রান্ত্র, অগ্ন্যাশয় ইত্যাদি। পাকস্থলির জায়গায় পাকস্থলি থাকে, আর অগ্ন্যাশয়ের জায়গায় অগ্ন্যাশয়। অন্য রোগীর ক্ষেত্রেও পেট কেটে চিকিৎসক পাকস্থলির জায়গায় পাকস্থলি দেখবার প্রত্যাশাই করেন। এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন রোগীর পাকস্থলিতে পার্থক্য থাকতে পারে – কারোটা মোটা, কারোটা চিকন, কারোটা দেখলেই হয়ত বোঝা যাবে ব্যাটা আমাশা রুগি, কারোটা আবার স্বাস্থ্যকর। বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য যাই থাকুক না কেন, মানুষের পাকস্থলি দেখে কারো গরুর কিংবা ঘোড়ার পাকস্থলি বলে ভুল হবে না। কারণ মানুষের পাকস্থলির একটা প্রকৃতি আছে, যেটা গরুর পাকস্থলি থেকে আলাদা । আমি অবশ্য গরুর পাকস্থলি বিশেষজ্ঞ নই, যিনি বিশেষজ্ঞ – যেমন পলাশি বাজারের সলিমুল্লাহ কসাই- তিনি খুব ভাল করেই আমাদের দেখিয়ে দিতে পারবেন গরুর পাকস্থলি কেমন হয়, খাসিরটা কেমন, ভেড়ারটা কেমন আর মুরগীরটা কেমন। ঠাটারিবাজারের নিত্যানন্দ কসাই হলে তার লিস্টে শুয়োরের পাকস্থলিও চলে আসতে পারে। সলিমুল্লা কিংবা নিত্যানন্দ কসাইয়ের অভিজ্ঞ চোখকে খাসির পাকস্থলির নামে শুয়োরের পাকস্থলি বলে চালানোর চেষ্টা করে ধোঁকা দেয়া যাবে না। কারণ তারা জানেন, খাসির পাকস্থলির প্রকৃতি শুয়োরেরটা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। একই কথা মানুষের পাকস্থলির জন্যও প্রযোজ্য। একথা বলা ভুল হবে না যে, মানুষের পাকস্থলির প্রকৃতিই অন্যপ্রানীর পাকস্থলি থেকে তাকে আলাদা করে দিচ্ছে।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, পেটের ভিতরে পাকস্থলির যেমন একটা প্রকৃতি আছে, তেমনি মানুষের মনেরও আলাদা একটা প্রকৃতি আছে – যেটা অন্য প্রানী থেকে আলাদা। উদাহরণ দেয়া যাক। মানুষের খুব কাছাকাছি প্রজাতি শিম্পাঞ্জি। শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের জিনগত মিল শতকরা ৯৯ ভাগ। কাজেই ধরে নেয়া যায় শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের অনেক কিছুতেই মিল থাকবে। কিন্তু যতই মিল থাকুক না কেন – সার্বজনীনভাবে মানব প্রকৃতি শিম্পাঞ্জির প্রকৃতি থেকে আলাদা হবে বলে আমরা ধরে নিতে পারি, অনেকটা উপরের উদাহরণের পাকস্থলির প্রকৃতির মতই। কিছু উদাহরণ হাজির করি। শিম্পাঞ্জি সমাজে মেয়ে শিম্পাঞ্জিরা বহুগামী হয় – তারা যত ইচ্ছা ছেলেদের সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে – তাদের আসলেই কোন বাছ বিচার নেই। পুরুষ শিম্পাঞ্জিরা আবার অন্য মেয়ে শিম্পাঞ্জি (যাদের সাথে এখনো দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় নাই) – তাদের বাচ্চাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে। এ ধরণের কোন প্যাটার্ন আমাদের মানব সমাজে চোখে পড়ে না। চোখে না পড়াই স্বাভাবিক, কারণ মানুষের প্রকৃতি শিম্পাঞ্জিদের প্রকৃতি থেকে আলাদা।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীদের কথামত আমরা জানলাম ‘মানব প্রকৃতি’ বলে একটা কিছু তাহলে আছে, যেটা অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা। কিন্তু কেমন সে প্রকৃতি? সমাজ বিজ্ঞানী কিংবা নৃতাত্ত্বিকরা অনেকদিন ধরেই এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন। তারা বলেন এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে মানব সমাজের সংস্কৃতিতে। সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা এমিল ডার্খেইম কোন সার্বজনীন মানব প্রকৃতির জন্মগত প্রকরণকে অস্বীকার করে তাকে ব্ল্যাঙ্ক স্লেটের সাথে তুলনা করেছিলেন। তার মতে সাংস্কৃতিক বিভাজনই মানব প্রকৃতিকে তুলে ধরার একমাত্র নিয়ামক। কাজেই মানব প্রকৃতি বিষয়ে যে প্রশ্নই করা হোক না কেন – এর উত্তর আমাদের খুঁজে নিতে হবে সংস্কৃতিতে। মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা বেশি সহিংস কেন – এর উত্তর হল – সংস্কৃতিই এর কারণ। ছেলেরা কেন সত্তুর বছরের বুড়ির চাইতে বিশ বছরের ছুঁড়ির প্রতি বেশি লালায়িত হয় – এর উত্তর হচ্ছে সংস্কৃতি। ছেলেরা কেন মেয়েদের চেয়ে বেশি পর্ণগ্রাফি দেখে, কিংবা বহুগামী – উত্তর একটাই – ‘সংস্কৃতি’! Omnia cultura ex cultura!
সমাজবিজ্ঞানের পুরোধা এমিল ডার্খেইম যে ইটের গাথুঁনি দিয়ে গিয়েছিলেন তাতে ‘সংস্কৃতির প্রাসাদ’ বানাতে এবারে এগিয়ে এলেন নৃতাত্ত্বিকেরা। নৃতত্ত্ববিদের জনক বলে যাকে অভিহিত করা হয় সেই – ফ্রানজ বোয়া এবং মার্গারেট মীড ছিলেন এদের মূল কান্ডারী। ফ্রানজ বোয়া যে মতবাদ প্রচার করলেন তাতে সকলের মনে হল, মানুষের প্রকৃতি বুঝি একেবারেই নমনীয়। এতে জন্মগত কোন বৈশিষ্ট্যের কোন ছাপ নেই, কোনদিন ছিলোও না। সব কিছুই সংস্কৃতিনির্ভর। আর বোয়ার প্রিয় ছাত্রী ‘নৃতত্ত্বের রাণী’ মার্গারেট মীড আদিম ‘স্যামোয়া’ জাতির মেয়েদের নিয়ে এমন এক আদর্শিক সমাজ কল্পণা করে ফেললেন, যার বাস্তব অস্তিত্ব আসলে পৃথিবীর কোথাওই নেই। মীডের ‘স্যামোয়া’ যেন আক্ষরিক অর্থেই হচ্ছে স্বর্গের প্রতিরূপ। সেখানে কারো মধ্যে নেই কোন ঝগড়া, নেই কোন ঘৃণা, ঈর্ষা কিংবা হিংসা। যৌনতার ক্ষেত্রে তাদের আচরণ একেবারে স্বতস্ফুর্ত। সেখানকার মেয়েরা বহুগামী, যৌনতার ব্যাপারে পুরোপুরি স্বাধীন – যখন ইচ্ছে স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে প্রিয় মানুষের সাথে সম্পর্ক করে নিতে পারে। তারা স্বাধীনভাবে যেটা চায় সেটা করতে পারে। মীডের অনুকল্প ছিলো, স্যামোয়া জাতির সংস্কৃতিই তাদের মেয়েদের এমন স্বতস্ফুর্ত আর স্বাধীন করে তুলেছে। তিনি সেসময় ফাপুয়া (Fa’apua’a) এবং ফোফোয়া (Fofoa) নামের দুজন স্যামোয়ান নারীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য তার গবেষোনায় ব্যবহার করেন। তাদের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে মীড সিদ্ধান্তে আসেন, বংশগতি নয় বরং সংস্কৃতিই ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে। মার্গারেট মীড তার চিন্তাধারা ব্যক্ত করে ১৯২৮ সালে ‘Coming of Age in Samoa’ নামের যে গ্রন্থ রচনা করেন সেটি ‘সংস্কৃতিভিত্তিক প্রাসাদের’ এক অগ্রগন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়[1] ।
ছবি – দুটি আলোচিত বই : উপরে মার্গারেট মীডের কামিং অফ এজ ইন সামোয়া, আর নীচে ডেরেক ফ্রিম্যানের দ্য ফেটফুল হোক্সিং অব মার্গারেট মীড
কিন্তু পরবর্তীতে ডেরেক ফ্রিম্যানসহ অন্যান্য গবেষকদের গবেষণায় প্রমানিত হয় যে, মীডের অনুকল্পগুলো স্রেফ ‘উইশফুল থিংকিং’ ছাড়া আর কিছু ছিলো না[2],[3]। গবেষকেরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, মীডের গবেষণা ছিলো একেবারেই সরল এবং মীড স্যামোয়ান মেয়েদের দ্বারা নিদারূণভাবে প্রতারিত হয়েছিলেন। ফ্রিম্যানের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এলো, স্যামোয়ান্ জাতির মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, ঘৃণা, হত্যা লুন্ঠন- আর দশটা জাতির মতই প্রবলভাবে বিদ্যমান, সরলমনা মীড সেগুলো দেখতেই পাননি। ডেরেক ফ্রিম্যানের অনুমান এবং অভিযোগের একেবারে সরাসরি সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় মীডের গবেষণা প্রকাশের ষাট বছর পর। ১৯৮৮ সালের মে মাসে ফাপুয়া (Fa’apua’a), যখন তার বয়স ৮৬ বছর অফিশিয়ালি স্যামোয়ান সরকারের কাছে স্বীকার করে নেন যে, তিনি আর তার বন্ধু ফোফোয়া স্যামোয়ান নারীদের যৌনপ্রবৃত্তি নিয়ে যে তথ্য মীডকে ১৯২৬ সালে দিয়েছিলেন তার সবটুকুই ছিলো বানোয়াট। এ কম্পলিট হোক্স।
সেজন্যই ম্যাট রীডলী তার ‘এজাইল জিন’ বইয়ে মীডের গবেষণা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেন[4], ‘তার মানব প্রকৃতির সাংস্কৃতিক ভিন্নতা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা অনেকটা এমন কুকুর খুঁজে পাওয়ার মতোই – যে কুকুর ঘেউ ঘেউ না করে মিউ মিউ করে’।
ছবি- মার্গারেট মীড কিভাবে স্যামোয়ান মেয়েদের দ্বারা নিদারূণভাবে প্রতারিত হয়েছিলেন তার একটি ব্যঙ্গচিত্র
মার্গারেট মীডের মতোই শান্তিপূর্ণ এক জাতির সন্ধান করতে গিয়ে সত্তুরের দশকে লেজে গোবরে করেছেন ম্যানুয়েল এলিজাল্ডে জুনিয়র (Manuel Elizalde Jr)। তিনি দেখাতে গিয়েছিলেন ঢালাওভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সহিংসতা, যুদ্ধবাজির কথা ঢালাওভাবে উল্লেখ করা থাকলেও ফিলিপাইনের এক জঙ্গলে টেসাডে (Tasaday) নামে এমন এক ট্রাইব আছে যারা নাকি আক্ষরিক অর্থেই এখনো সেই আদিম প্রস্তর যুগে বাস করছে। তারা ছাল বাকল পড়ে ঘুরে বেড়ায়, গুহায় বসবাস করে আর তারা নাকি এমনই শান্তিপ্রিয় যে তাদের ভাষাতে সহিংসতা, আগ্রাসন কিংবা সংঘর্ষসূচক কোন শব্দই নেই। তাদের সংস্কৃতি একেবারে শান্তিতে শান্তিময়। এই মহা ব্যতিক্রমী শান্তিপূর্ণ মানবপ্রজাতি নিয়ে ১৯৭৫ সালে একটি বইও বের হয়েছিল ‘শান্ত টেসাডে’ নামে[5]।
কিন্তু থলের বেড়াল বেরিয়ে যেতে সময় লাগেনি। আশির দশকের শেষদিকে বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসলো যে ম্যানুয়েল এলিজাল্ডের আগেকার কাজকর্ম আসলে ছিলো পুরোটাই সাজানো[6]। আশে পাশের গ্রাম থেকে জিন্স আর টিশার্ট পরা সুশিক্ষিত ছেলেপিলেদের ছাল বাকল পরিয়ে ‘শান্ত টেসাডে’ সাজানো হয়েছিল। টেসাডের শান্তিময় ধরণের কোন ট্রাইবই আসলে ফিলিপাইনে নেই। সত্তুরের দশকে ফিলিপাইনের একনায়ক ক্ষমতাশীন মার্কোস সরকারের পরিকল্পনায় ম্যানুয়েল এলিজাল্ডের কুকর্মে ইন্ধন যোগানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিলো ‘শান্ত টেসাডেকে পুঁজি করে বহির্বিশ্বে ফিলিপাইনের ইমেজ বাড়ানো।
ছবি –মার্কোস সরকারের পরিকল্পনায় সভ্য মানুষকে অর্ধনগ্ন করে ছাল বাকল পড়িয়ে শান্তিপূর্ণ টেসাডের মিথ সুপরিকল্পিত ভাবে তৈরি করা হয়।
আসলে সংস্কৃতির বিভাজনের কথা ঢালাও ভাবে সাহিত্য, সংস্কৃতিতে আর নৃতত্ত্বে উল্লিখিত হয় বটে, কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় এই বিভাজন মোটেই বস্তুনিষ্ঠতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয় না। ব্যাপারটা নৃতত্ত্ববিদ আর সমাজবিদদের জন্য এক নিদারূন লজ্জার ব্যাপার। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, সংস্কৃতির যত বিভাজনই থাকুক না কেন, প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই দেখা যায়, মানুষেরা একইভাবে রাগ অনুরাগ, হিংসা, ক্রোধ প্রকাশ করে থাকে। পশ্চিমা বিশ্বের আলো ঝলমলে তথাকথিত ‘আধুনিক’ সভ্যতা থেকে শুরু করে পৃথিবীর আনাচে কানাচে যত গহীন অরন্যের যত নাম না জানা গোত্রের মধ্যেই অনুসন্ধান করা হোক না কেন – দেখা যাবে নাচ, গান, ছবি আঁকার ব্যাপারগুলো সব সংস্কৃতিতেই কম বেশি বিদ্যমান। কেউ হয়ত গুহার পাথরে হরিণ শিকারের ছবি আঁকছে, কেউ পাথরে খোদাই করে মূর্তি বানাচ্ছে, কেউ নদীর ধারে বসে পাল তোলা নৌকাকে ক্যানভাসে উঠিয়ে আনছে, কেউবা আবার মাটির পটে গড়ে তুলছে অনবদ্য শিল্পকর্ম। সংস্কৃতির বিবিধ উপাদান যোগ হবার কারণে ব্যক্তি কিংবা সংস্কৃতিভেদে চিত্রকল্পের প্রকাশ ভঙ্গিতে হয়ত পার্থক্য আছে কিন্তু চিত্র প্রকাশের বিমূর্ত স্পৃহাটি সেই একই রকম থেকে যাচ্ছে। শুধু ছবি আঁকা নয়, নাচ-গানের ক্ষেত্রেও আমরা তাই দেখব। এক দেশে কেউ একতারা হাতে বাউল গান গেয়ে চলছে তো আরেকজন অন্য দেশে নিবিষ্ট মনে পিয়ানো বাজিয়ে চলছে। কেউবা চোখ মুদে সেতার বাজাচ্ছে তো কেউবা গিটার কিংবা কেউ সন্তুর। যে একেবারেই আলসে সে হয়ত পড়াশুনা করার টেবিকেই ঢোল বানিয়ে তাল ঠুকছে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে। এক সংস্কৃতিতে কেউ হয়ত ডিস্কো নাচ নাচছে, অন্য জায়গায় সেরকমই একজন কেউ ভরত নাট্যম, আরেক জায়গায় কেউ ল্যাটিন ফিউশন, কেউবা কোন অচেনা ট্রাইবাল ড্যান্স। নাচের রকম ফেরে কিংবা মূদ্রায় পার্থক্য থাকলেও সংস্কৃতি নির্বিশেষে নাচ-গানের অদম্য স্পৃহাটি কিন্তু এক সার্বজনীন মানব প্রকৃতিকেই উর্ধ্বে তুলে ধরছে। এই ব্যাপারটির তাৎপর্য উপলব্ধি করেই ডোনাল্ড ব্রাউন তার ‘Human Universals’ গ্রন্থে বলেছেন[7] – ‘It is the human universals not the differences that are truly intriguing’।
নৃপেনদাও সেটা জানেন। তিনি হিন্দুদের কান্নার উদাহরণ দিয়েছেন। দিয়েছেন মুসলমানদের কান্নারও। কান্নার রকমফেরে পার্থক্য থাকলেও সবাই কিন্তু কাঁদে প্রিয়জনের মৃত্যুতে। কেউ চল্লিশা করতে করতে কাঁদে, কেউ বা শ্রাদ্ধশান্তি করতে করতে কাঁদে। কিন্তু কাঁদে তো। এটাই হিউম্যান ইউনিভার্সাল। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু তারপরেই নৃপেনদা বড় একটা ভুল করে ফেলেছেন। তিনি বোধ হয় মীডের মতই উইশফুল থিঙ্কিং থেকে ভেবেছেন, অনেক জনগোষ্টি আছে যাদের চোখ একেবারে শুষ্ক – মরুভূমি। তারা প্রিয়জনের মৃত্যুতে নাকি কাঁদে না। উদাহরণ হিসেবে হাজির করেছেন এরিক ভ্যালির একটি মুভির উদাহরণ। মুভির উদাহরণ কোন ভাল উদাহরণ নয়। অতিরঞ্জনের সুযোগ থাকে পুরোমাত্রায়। মার্গারেট মীড বা ম্যানুয়েল এলিজাল্ডের গবেষণাতেই আছে, আর মুভি তো কোন ছাড়! আমি নিশ্চিত, যদি সঠিকভাবে অনুসন্ধান করা হয় তবে তিব্বতিদের চোখ একেবারে শুষ্ক – মরুভূমি – ব্যাপারটাও হোক্স হিসেবেই প্রতিপন্ন হবে।
যা হোক, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সংস্কৃতি ব্যাপারটা মানব সমাজের অনন্য বৈশিষ্ট হিসেবে গন্য হলেও এটি কোন গায়েবী পথে নয়, বরং অন্য সব কিছুর মতো জৈব বিবর্তনের বন্ধুর পথ ধরেই উদ্ভুত হয়েছে (evolved biologically)[8]। আমরা উপরে যে নাচ, গান, ছবি আঁকা, যুদ্ধসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছি (যেগুলো মানব সভ্যতার যে কোন সংস্কৃতিতেই খুঁজে পাওয়া যাবে ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে), সেরকম অন্ততঃ ৪০০টি বৈশিষ্ট্য স্টিভেন পিঙ্কার লিপিবদ্ধ করেছেন তার ব্ল্যাঙ্ক স্লেট বইয়ের পরিশিষ্টে[9]। হ্যা তার মধ্যে কান্না বা ক্রায়িং ব্যাপারটিও তালিকায় আছে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন এগুলো সবগুলোই অভিন্ন মানব প্রকৃতির দিকেই ইঙ্গিত করে। লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাতোশি কানাজাওয়া তার ‘ There is only one human culture ‘ প্রবন্ধে সেজন্যই বলেন[10],
বাহ্যিকভাবে যত পার্থক্যই আমরা দেখি না কেন, আসলে আমরা মানুষেরা এক অভিন্ন সংস্কৃতির অংশ।কারণ, আমাদের দেহ কাঠামোর মতো সংস্কৃতিও মোটা দাগে মানব বিবর্তনের অভিযোজনগত ফসল।ঠিক যেমন আমাদের হাত পা কিংবা অগ্ন্যাশয় তৈরি হয়েছে বংশানু বা জিনের নিয়ন্ত্রণে, ঠিক তেমনি মানব সংস্কৃতিও তৈরি হয়েছে বংশানুর দ্বারাই (বংশানুর দ্বারা বলা হচ্ছে কারণ, দীর্ঘকালের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়াতেই তৈরি হয়েছে মানব বংশানু যা আবার মস্তিস্কের গঠনের অবিচ্ছেদ্য নিয়ামক, আর সংস্কৃতি হচ্ছে সেই মানব মস্তিস্কেরই সম্মিলিত অভিব্যক্তি)।
বাঘের যেমন নখর বিশিষ্ট থাবা আছে, ক্যাঙ্গারুর পেটে আছে থলি, ঠিক তেমনি মেরুভল্লুকের গায়ে আছে পুরু পশম। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন স্ব স্ব প্রজাতির ক্ষেত্রে অনন্য বৈশিষ্টের দিকে নির্দেশ করে; ঠিক তেমনি মানব সমাজের জন্য অনন্য বৈশিষ্টের নিয়ামক হয়ে আছে মানব সংস্কৃতি। বাঘে বাঘে নখরের আকার আকৃতিতে পার্থক্য থাকলেও সেটা যেমন শেষ পর্যন্ত বাঘের নখরই, ঠিক তেমনি সংস্কৃতিতে কিছু বাহ্যিক ছোটখাট ভেদাভেদ থাকলেও সেটা শেষ পর্যন্ত অভিন্ন মানব সংস্কৃতিই। হ্যা,শতধা বিভক্তি সত্ত্বেও মানব কালচারগুলো আসলে সম্মিলিতভাবে সার্বজনীন সংস্কৃতি বা কালচারাল ইনিভার্সাল (Cultural Universal)কেই উর্ধ্বে তুলে ধরে, অন্ততঃ বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের তাই অভিমত।
——————————————————————————–
তথ্যসূত্র
[1] মুক্তান্বেষার প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যায় মার্গারেট মীডকে নিয়ে ফরিদ আহমেদের একটি চমৎকার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে মার্গারেট মিড : নৃতত্ত্বের রাণী’ শিরোনামে।
[2] Derek Freeman, Margaret Mead and Samoa: The Making and Unmaking of an Anthropological Myth, Penguin, 1983.
[3] Derek Freeman, The Fateful Hoaxing of Margaret Mead: A Historical Analysis of her Samoan Research Basic Books, 1999
[4] ম্যাট রিডলীর মূল উক্তিটি ছিলো – ‘Her failure to discover the cultural determinism of human nature is like the dog that failed to bark’।
[5] John Nance, The gentle Tasaday: A Stone Age people in the Philippine rain forest, Harcourt Brace Jovanovich, 1975
[6] The Gentle Tasaday Are Merely a Persistent Hoax, The Newyork Times, January 9, 1988.
[7] Donald Brown, Human Universals, McGraw-Hill Humanities/Social Sciences/Languages, 1991
[8] Pierre van den Berghe, a pioneer sociobiologist at the University of Washington, puts it best when he says,
Certainly we are unique, but we are not unique in being unique. Every species is unique and evolved its uniqueness in adaptation to its environment. Culture is the uniquely human way of adapting, but culture too evolved biologically.
[9] Steven Pinker, The Blank Slate: The Modern Denial of Human Nature, Viking, 2002, p 435-9, appendix
[10] Satoshi Kanazawa, There is only one human culture: All cultures are more or less the same, http://www.psychologytoday.com/blog/the-scientific-fundamentalist/200805/there-is-only-one-human-culture
এটা বিজ্ঞান সম্মতভাবে ঠিক কথা না-কারন আসলে বিবর্তন বা তাপগতিবিদ্যা হিউরিস্টিকি ফর্মুলেশনের বেশী কিছু দেয় না।
সেত বিজ্ঞানের সূত্র মাত্রই রিডাকশনিজম-সেটাতে ত কিছু কেও বলছে না। প্রশ্ন হচ্ছে সমাজবিজ্ঞানের জৈবিক রিডাকশনিজম চলবে কি না।
@বিপ্লব পাল,
কেন নয়? এতদিন সমাজবিজ্ঞানীরাও নানা ধরণের রিডাকশনিজম করে এসেছিলেন, কিন্তু জীববিজ্ঞানকে বাইরে রেখে। পুরুষেরা সহিংস কেন, কিংবা সিরিয়াল কিলার পুরুষদের মধ্যে বেশি কেন, কেন পুরুষেরা পর্নগ্রাফি বেশি দেখে, আর মেয়েরা রোমান্স নভেল বেশি পড়ে – এগুলো কেবল সামাজিক অবস্থান, প্রতিপত্তি, পাওয়ার প্লে, সংস্কৃতি এগুলোদিয়েই ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে বিবর্তনের ট্রেন্ড না বুঝলে পুরোটা কখনোই কেবল স্ট্যান্ডার্ড সোশাল সায়েন্স মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। মূলতঃ এখন অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন আসলে সোশাল সায়েন্স সুড বি দ্যা ব্রাঞ্চ অব বায়োলজি। এটা দেখতে পার। আর বইয়ের জন্য –
The Adapted Mind: Evolutionary Psychology and the Generation of Culture এই বইটা অসাধারণ। সোশাল সায়েন্সের মডেলের ত্রুটিগুলো খুব চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে, দেখানো হয়েছে বিবর্তনকে গোনায় না ধরায় তাদের মডেল কেন অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছে। আসলে, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে সাড়া পৃথিবীতেই এখন খুব ভাল কাজ হচ্ছে। সেই কাজগুলো জানানোর জন্যই আমার প্রচেষ্টা। দেখি কতদূর যাওয়া যায়।
@অভিজিৎ,
বিহেভেরিয়াল জেনেটিক্সের অনেক তথ্য এবং পরীক্ষা আইডেন্টিক্যাল টুইন স্টাডি থেকে-যত এই ধরনের পরীক্ষা হয়েছে-প্রতিটি পরীক্ষাই প্রশ্নবিদ্ধ। হয় স্যাম্পল সাইজের সমস্যা-নইলে পুওর করিলেশনকে স্ট্রং বলে চালানো থেকে অনেক ধরনের সংখ্যাতাত্ত্বিক জালিয়াতির সাহায্য অনেকেই নিয়েছেন-ফলে অনেকেই গে জিন পর্যন্ত আবিস্কার করে ফেলেছিলেন আর কি! সবটাই নিজেদের গবেষনার জন্যে ফান্ড আনার একাডেমিক তাগিদ আর কি। সেটাকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার মানে নেই।
সমাজ একটি কমপ্লেক্স সিস্টেম-এটার সিম্পল রিডাকশনিজম মার্কসবাদ বা বিবর্তন যা দিয়েই করার চেষ্টা হোক না কেন-সেটা খুব সফল কোনদিনই হবে না। মার্কসবাদ বা বিবর্তন একটা ধারাপাতিক আইডিয়া দিতে পারে-কার্যকারন সম্পর্ক-কিন্ত সেগুলোকে বৈজ্ঞানিক সত্য বা সূত্রের কোনকিছুরই পর্যায়ভুক্ত করা যাবে না-যদ্দিনা পর্যন্ত একই সাথে তাপগতিবিদ্যা, বিবর্তন ইত্যাদি নিয়ে সমাজবিজ্ঞানের জটিল মডেলিং অনেক পাওয়ারফুল কম্পুতে করা সম্ভব হবে।
@বিপ্লব ,
বৈজ্ঞানিক গবেষণা বৈজ্ঞানিকভাবেই করতে হবে। স্যাম্পল সাইজ ছোট থাকলে ভবিষ্যতের গবেষণায় বড় সাইজ নিয়ে করা হবে, কিংবা আরো ভাল কোন পদ্ধতি পাওয়া গেলে সেটাও ব্যবহার করা হবে। এভাবেই তো এগুবো। কোন কিছু ভুল হলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যেই ভুল প্রমাণ করা যাবে।
আর প্রানী জগতের বিবর্তন একটি প্রমাণিত বিষয়। এটাকে মানুষের সমাজের জন্য প্রয়োগ কয়ার যাবে না কেন? এমন তো নয় যে, বিবর্তন শিম্পাঞ্জি বা গরিলা পর্যন্ত এসে শেষ হয়ে গেছে যে মানুষকে এর বাইরে রেখে মডেল করতে হবে। কিংবা অংগ প্রত্যঙ্গের বিবর্তন গলার কাছে এসে থেকে গেছে, মাথা পর্যন্ত আর যায় নি, যে সমাজ সংস্কৃতিকে এর বাইরে রাখতে হবে! আসলে সোশাল সায়েন্টিস্টরা বহুদিন ধরে এভাবেই চিন্তা করছিলেন। আসলে এই ধারণার একটা বড় কারণ নিজেদের অজান্তেই মানুষকে ‘এক্সেপশনাল’ কিংবা ‘স্বর্গীয়’ ধরে নিয়ে বাকি সমস্ত প্রানীজগত থেকে আলাদা রাখার একটা ইচ্ছা।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন শাখা । যত দিন এগুবে এর ভিত্তি ততই মজবুদ হবে। তবে তুমি ঠিকই বলেছ যে, ভবিষ্যতে অনেক পাওয়ারফুল কম্পুতে করা সম্ভব হলে ব্যাপারগুলো আরো সঠিক ফলাফল নিয়ে আসবে।
@অভিজিৎ,
মার্কসীয় তত্ত্বও ত বিবর্তনের ওপর দাঁডিয়ে। এমরফিক প্রিন্সিপাল হিসাবে বিবর্তন ত আসবেই-সমস্যা হচ্ছে জৈবিক বিবর্তনের সাথে সাথে আরো অনেক কিছু এসেই যায়-যেমন মানুষের জৈবিক বিবর্তনের স্পিডের থেকে বর্তমানে উৎপাদন ব্যাবস্থার বিবর্তন অনেক বেশী দ্রুত-তারপরে মেডিক্যাল সিস্টেমের জন্যে শিশু মৃত্যু হয় না-ফলে জৈবিক বিবর্তনের বেসিকটাই বর্তমান সমাজের বিবর্তনে মিসিং।
ফলে একজন মানুষ যখন গে হয় তখন কতটা জেনেটিক্সের জন্য আর কতটা সমাজের জন্য-এই সমস্যাটাই সমাধান করা যায় না-বা ধর হিউম্যান জেনোম প্রজেক্টের লোকেরাই বলেছে জেনেটিক মার্কারের সাথে মানুষের ব্যাবহারে কোরিলেশন আছে কিন্ত তা দুর্বল-কারন মানুষের নৈতিকতা বা ব্যাবহার শুধু জেনেটিক্স দিয়ে প্রভাবিত না।
সমস্যা হচ্ছে কি মার্কসবাদি আর কি ধার্মিক আর কি নিধার্মিক-সবাই একটা কনফার্মেশন কমফোর্ট জোন চাই। ফলে জটিল সিস্টেমের ফাজি ব্যাপার স্যাপার অনেকেরই ভাল লাগে না। বরং একটা পরিস্কার কার্য কারন সম্পর্ক দেখতে সবাই ভালবাসে। মেয়েরা কেন হিংসুটে সেটার যদি এখন একটা বিবর্তনবাদি প্রমান দাও অনেকেই বিশ্বাস করবে-কিন্ত বাস্তব ত এটাই এগুলোও সেই মার্কসবাদের মতন কোথাও হইবে কোথাও হইবে না।
ভেবে দেখ মার্কসবাদ ও কিন্ত ভুল না-কিন্ত সামাজিক একটা কমপ্লেক্স সিস্টেমের সরল রিডাকশনিজম করে এবং সেটাকে বিজ্ঞান বলে চালিয়ে কত গুলো নর পিশাচের সৃষ্টি করেছিল?
এই ধরনের ফিল্ডে যারা গবেষনা করে সবাই খবরে আসার জন্যে
দেদারসে রেজাল্ট ম্যানিপুলেট করে-কারন স্ট্রাইকিং ক্লেইম না হলে, পরের ফান্ড পেতে সমস্যা হয়। ফলে এই ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষনার অধিকাংশই ফাঁপানো-যার প্রায় সবটাই পরবর্তীকালে আবর্জনা বলে প্রমানিত। উদাহরন সমকামিতার এর ওপর সব জেনেটিকাল গবেষনা পরে গারবেজ বলে প্রমানিত হয়েছে ১০ বছরের মধ্যেই।
সুতরাং এসব গবেষনার দিকে আমাদের চোখ রাখতেই হবে-কিন্ত পাশাপাশি এটা ভুললেও চলবে না-মার্কসবাদ বা তাপগতিবিদ্যা ইত্যাদি দিয়েও কিছু কিছু সামাজিক ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া গেছে-বিবর্তন দিয়েও আরো কিছু যাবে-কিন্ত শুধু বিবর্তন বা শুধু মার্কসবাদ দিয়েই মানুষের বা সমাজের ব্যাবহার সব কিছু বুঝে যাব -এটা ভাবাই অবৈজ্ঞানিক।
মার্কসবাদ দিয়ে মানুষের কান্নাকে বিশ্লেষন করা যেমন হাস্যকর হবে-ঠিক তেমনই সামাজিক বৈষম্যের বিশ্লেষনে জৈবিক বিবর্তন ও চলবে না। এর কারনটাই হচ্ছে জটিল সিস্টেমকেশুধু কিছু কিছু ক্ষেত্রেই সিম্পল সিস্টেম হিসাবে রিডিউস করা যায়।
@বিপ্লব পাল, :yes:
@বিপ্লব পাল,
কেউ তো সেটা বলছে না যে, সবকিছুই জেনেটিক। মানুষের কোন ব্যবহারের পেছনে একটিমাত্র জিন খোঁজা খুব সরল এবং হাস্যকর। ‘আলকোহলের জিন’, স্মোকিং জিন, গে জিন এভাবে দেখাটাই ভুল। কিন্তু তা বলে মানব প্রকৃতি গঠনে জিনের গুরুত্ব একেবারেই নেই তাও নয়। সেজন্যই তো উইলসন ব্যাপারটাকে বলেছেন ‘জিন-কালচার কোএভুলুশন’। প্রায় প্রতিটি ট্রেইটই আসলে জেনেটিক্স আর পরিবেশের সুষম সমন্বয়। শুধু একটি দিয়ে ব্যাখ্যা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্পুর্ণ। এতদিন সমাজবিজ্ঞানীরাই বরং বায়োলজিকাল পার্টটিকে অস্বীকার করে মডেল তৈরি করেছিলান। সেটা ভুল ছিল। আবার কিছু জেনেটিক্সওয়ালারা জিনকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে পরিবেশকে অস্বীকার করেছিলেন। পরে এপিজেনেটিক্স সহ অনেক গবেষণাতেই পরিবেশের গুরুত্ব প্রকাশিত হয়েছে। এখন কোন ট্রেইটের কতটুকু পরিবেশের জন্য আর কতটুকু জেনেটিক, তা নিয়ে গবেষণা চলবেই, বিতর্কও হবে, কিন্তু এর মাধ্যমেই আবার বহু সঠিক ব্যাপার বেড়িয়ে আসবে। তৈরি হবে নতুন নতুন গবেষণার ক্ষেত্র।
যা হোক বিতর্ক অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে, আপাততঃ ইস্তফা দেই।
@অভিজিৎ’দা ও বিপ্লব’দা
বিতর্কটা কিন্তু খারাপ লাগছিল না। আমি অবশ্য এটাকে বিতর্ক না বলে আলোচনাই বলবো। বিতর্কে দিন শেষে হার/জিতের বিষয় থাকে, আলোচনায় যেটা নেই। এ কারণে বিতর্ক পরিহার করে চলি।
যা হোক, রিডাকশনিজমকে আমি খারাপ হিসেবে ধরবো না যতক্ষন আমি জানি যে এটা রিডাকশনিজম। যতক্ষন একটি কমপ্লেক্স সিস্টেমকে পুরোপুরি জানতে না পারছি ততক্ষন সেটার সরল অবস্থা নিয়ে গবেষণায় ক্ষতি নেই। অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ারিং এর ক্ষেত্রে আমরা এটা প্রয়োগ করে থাকি। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে সত্যিকার সিস্টেম আরো জটিল, এবং সরল অবস্থা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল সরাসরি জটিল সিস্টেমে ব্যবহার করা যাবে না। গেলেও জানতে হবে সেটা অনেক ক্ষেত্রে কাজ করবে, অনেক ক্ষেত্রে করবে না। আমিও বিপ্লব’দার সাথে একমত হবো যে সব ক্ষেত্রেই কাজ করবে দাবী করা হবে অতিরঞ্জিত। কিন্তু তাই বলে রিডাক্শনিজম বাতিল হয়ে যাবে না। এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটাও একটি বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া। সরল গবেষনা হতে পরবর্তী ধাপে আরেকটু জটিল অবস্থা নিয়ে গবেষণা হবে, তারপর আরো জটিলতর, এবং পর্যায়ক্রমে আমাদের জ্ঞান আরো সুদৃঢ় হবে।
সামাজিক মডেল, অর্থনৈতিক মডেল গুলোকে আমার কাছে মনে হয় যথেষ্ট নন-লিনিয়র এবং যথেষ্ট কম্পলেক্স মডেল। সিম্পল সলিউশান নেই কোন। এবং নন-লিনিয়রের মূল কারণ হল এই বিবর্তনীয় মন। আপনি যে সলিউশনই দিন না কেন কিছু মানুষ সেই সলিউশনের মাঝে ফাঁক বের করে ফেলে। অনেকটা ভাইরাস/ব্যাক্টেরিয়ার এর সাথে আমাদের মেডিসিনের যুদ্ধের মত।
আসলে এই চোর-পুলিশ খেলাই মনে হয় আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে মনে হয় দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি দিয়ে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা যায়। বিবর্তনকেও এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মাঝেই ফেলা যায়। জিনকে টিঁকিয়ে রাখা এবং এর বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য যে যুদ্ধ সে দ্বন্দ্বই আমাদের তাবৎ প্রাণী জগতকে এগিয়ে নিচ্ছে বলে আমার মনে হয়। যার ফলাফল হিসেবে চলে আসে ন্যাচারাল সিলেকশন, গ্রুপ সিলেকশন অথবা সেক্সুয়াল সিলেশান।
যা হোক আপনাদের আলোচনা হতে উপকৃত হলাম, এটা জানাতেই মন্তব্য করা। ধন্যবাদ দু’জনকেই।
প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করি আর সমাজকেই ব্যাখ্যা করি রিডাকশনের ব্যাপার সবসময়ই চলে আসে। মহাকর্ষকে ব্যাখ্যার জন্য নিউটনের সূত্রও এক ধরণের রিডাকশনিজম। আইনস্টাইনের তত্ত্বও তাই। সামাজিক প্যাটার্ন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও কিন্তু তা খাটে। এতদিন স্ট্যান্ডার্ড সোশাল সায়েন্সের মডেলে (Standard Social Science Model, SSSM) সমাজের গতি-প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছিল, এখন দেখা যাচ্ছে এর অনেককিছুতেই আরো ভাল ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে। জন টুবি আর লিডা কসমাইডসের Evolutionary Psychology: A Primer লেখাটায় অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
ডেনিয়েল ডেনেটের মতই বলি – রিডাকশনিজম কোন সমস্যা না, সমস্যা হচ্ছে গ্রিডী রিডাকশনিজম।
সাংস্কৃতিক বিষয় গুলি নিয়ে পর্যবেক্ষন থেকে বৈজ্ঞানিক সূত্রে রিডাকশন বিপজ্জনক। সাধারনত সমাজবিজ্ঞানের গবেষণাতে সার্বজনী্ন ব্যাপারটাকে প্রমান করা হয় নাল হাইপোথেসিস থেকে। এবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সে রিডিউসড সিস্টেমের ওপর এটা করা হচ্ছে, তার রিডাকশনিজমই প্রশ্নবিদ্ধ।
মানব সভ্যতার মতন একটা কাওটিক সিস্টেমের এই ধরনের রিডাকশনিজম না করে-বরং একটা কোয়ালিটেটিভ বক্তব্য রাখা উচিত-
যে মানব আচরনকে বিবর্তন ঘটিত কিছু হিউরিস্টিক মডেলে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে তা বৈজ্ঞানিক সূত্রের পর্যায়ে ফেলা যাবে না।
গবেষনা ভালো লেগেছে। বিবর্তনের সাথে মনোবিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি গভীরভাবে সম্পর্ক যুক্ত। আসলে, সংস্কৃতি এমন একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দেয়, যা আমাদের দারুনভাবে প্রভাবিত করে। আমরা তখন কাজ করতে থাকি ঐ মানদন্ডের সাপেক্ষে। আমাদের কাজগুলোকেও যাচাই করি একি মানদন্ডের সাপেক্ষে। অর্থাৎ কোন অবস্থাতেই আমরা সেই মান্দন্ডকে উপেক্ষা করতে পারিনা। আমাদের চিন্তায় স্বাভাবিক ভাবেই একটা ছাঁচ আছে, যার ব্যাপারে মানুষ সাধারনত সতর্ক নয়। অনেকটা বাতাসের মধ্যে আছি বলেই বাতাসকে উপেক্ষা করে বাঁচতে পারিনা। এটমোস্ফেয়ারিক প্রেসারকে উপেক্ষা করেই আমরা প্রেসার মাপি। অ্যাবসলিউট প্রেসার মাপতে গেলে মনে পড়ে, এটমোস্ফিয়ারিক প্রেসারকে বিবেচনায় আনতে হবে।
আমাদের আবেগ অনুভূতি গুলোও গড়ে উঠেছে টাইম অ্যান্ড স্পেস সেন্সের উপর ভিত্তি করে। সংস্কৃতি এইখানে এটমোস্ফিয়ারিক প্রেসারের মত। আমরা যখন বলি, আমাদের চিন্তা আমাদের স্বতন্ত্র, তখন আসলে এটা বিবেচনায় আনি না, স্বতন্ত্র চিন্তা গড়ে ওঠার বহু আগেই পারিপার্শ্বিক সংস্কৃতি একটা ভিত্তিভূমি গড়ে দিয়েছে। আমাদের স্বাতন্ত্র্য পরিমাপ করি, পারিপার্শ্বিকতার সাপেক্ষে আমরা কতটুকু ভিন্ন ভাবে চিন্তা করি, কাজ করি, সেইটুকু বিচার করে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমরা ইউনিভার্সাল হিউম্যান কালচারের বাইরে যাই না। কেবল বহুল প্রচলিতর চেয়ে ভিন্ন পন্থা অনুসরন করি। স্বজন হারানোয় কে চল্লিশ দিন কাঁদল আর কে চোখ শুষ্ক করে রেখেছিল, সেগুলো কেবল মাত্র মানদন্ড থেকে ভিন্নতার উদাহরণ। ভিত্তিভূমি হল, স্বজন হারানোতে বিচ্ছেদ ব্যথা বা কষ্ট অনুভব করা। এইখানেই সার্বজনীনতা।
@জওশন আরা,
আবেগটা আসলে বিশ্বজনীন একই কিন্তু এর প্রকাশের ধরনে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পার্থক্য বিদ্যমান । আলবেনিয়ার কথা ধরা যাক । সেখানে মাথা দু দিকে নাড়ালে হ্যা সূচক এবং উপর নিচ করলে না সূচক অর্থ প্রকাশ পায় । বাংলাদেশে ঠিক এর উল্টোটা সত্যি ।
@সংশপ্তক, সহমত।
আবেগ বিশ্বজনীন, প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে।
@জওশন আরা,
মুক্তমনায় স্বাগতম। খুবই চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। বিশেষ করে আপনার বলা শেষ কটি লাইনই বোধ হয় আমার লেখার সারাংশ –
:yes:
চাইব যে, আপনি মুক্তমনায় নিয়মিত লিখুন।
@অভিজিৎ, চেষ্টা করব। আশা করছি, প্রথম লেখাটা দিতে পারব কিছুদিনের মধ্যে, হাতে লেখার মত যথেষ্ট সময় পেলে। 🙂
@কেয়া রোজারিও , অভিজিৎ রায় ,
আমাদের বুঝতে হবে , আমাদের মস্তিষ্ক কিভাবে তথ্য প্রসেস করে। ডানহাতি -বামহাতির মত সব মানুষের মস্তিষ্কের এই প্রসেসিং য়াকে এনকোড এবং ডিকোডের সাথে তুলনা করা যেতে পারে – এক রকম নয়। একটা কমপিউটার ফাইল যেমন বিভিন্ন ফরমেটে ( .docx ,pdf, avi , flac , psd, png, wmv,svg ইত্যাদি ) হতে পারে , তেমনি একেকজন মানুষের মস্তিষ্কে একেক ফরমেটে (Picture thinking, visual thinking , visual/spatial learning , kinesthetic, musical, mathematical ইত্যাদি ) কাজ করতে পছন্দ করে । একটা খাবারের স্বাদ কিছু মানুষের মস্তিষ্কে ছবি বা শব্দ ফরমেটেও এনকোড হতে পারে ।
এখন এই এনকোডিং আমাদের চিন্তায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলে । যেমন, একজন মানুষের মস্তিষ্ক যত শব্দ প্রতি সেকেণ্ডে প্রসেস করে , তার চেয়েও বহুগুন বেশী পরিমান ছবি সে একই সমযে প্রসেস করতে সক্ষম । তাহলে, একটা visual মানুষ , একজন musical মানুষের চেয়ে সমান সমযে দ্রততর চিন্তা করে সর্বোত্তম সমাধান বের করতে সক্ষম ।
@সংশপ্তক, অভিজিৎ রায়
মেনে নিচ্ছি, কিন্তু মনে নিতে পারছি না। কেনো পারছি না -বলছি। যদি “মানুষের মস্তিষ্কের এই প্রসেসিং কে এনকোড এবং ডিকোডের “সাথে তুলনা করি অথবা “পরিস্থিতি সামলাতে নিজের অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই সাহায্য নেয়। ” ধরে নেই তাহলে একজন তুখোড় খেলুড়ে দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে পর দিন ই কেনো অন্য খেলোয়াড় দের হিংসে করছেন? যার জীবন আচরণে হয়তো কোন দিন ই হিংসের লেশ মাত্র ছিলো না।তার বর্তমান শারীরিক পরিস্থিতি কি তাকে রিসোশালাইজেশন বা পুণঃ সামাজীকিকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে না? এই নতুন মানষিক অবস্থা নিশ্চয় শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। শারীরিক পরিবর্তনটা নিয়ন্ত্রন করছে তার পুরো চিন্তার ধরনটা।
@কেয়া রোজারিও,
একজন তুখোড় খেলুড়ে দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে পর দিন ই অন্য খেলোয়াড় দের হিংসে করছেন তার Ego এবং Super Ego এর মধ্যকার সংঘর্ষের কারণে । হিংসে করা একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি কিন্তু আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব । যার জীবন আচরণে হয়তো কোন দিন ই হিংসের লেশ মাত্র ছিলো না , Ego এবং Super Ego এর মধ্যকার সংঘর্ষের কারণে তিনি এই বিশেষ আচরণকে আর নিয়ন্ত্রণ করছেন না ।
অভিজিৎ রায়,
স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে থাকে তবে যতদুর মনে পড়ছে ছোটবেলায় একবার বাবার সঙ্গে জয়পুর হাটের পাচঁবিবির ভেতর আতাপুর – তারো ভেতরে এক গ্রাম উচাঁই ওখানে এক প্রজেক্ট দেখতে গিয়েছিলাম।
নির্দিষ্ট একটা জায়গায় এসে থেমে যেতে হোল গাড়ী আর এগুবে না। তিনখানা মোটর সাইকেল জোগাড় হলো , চালক প্রজেক্টের ই কর্মী, আমরা সহযাত্রী হলাম। বেশ কিছু দুর্গম পথ পাড়ি দেবার পর সাইকেল তিনটি একটা জলের ছড়ার কাছে এসে থেমে গেলো।বেশ জল জমা। কে যেনো একটা গাছের গুড়ি ফেলে রেখেছে পারাপারের জন্যে। মোটর সাইকেল চালক তিনজন -একজন ময়মনসিং এলাকার গারো। অন্যজন সমতল এলাকার , বাকী জন সাওঁতাল -উত্তর বঙ্গের।
আমি তখন ক্লাস সেভেন এ পড়ি , ছোট বেলা থেকেই মানুষ পড়তে খুব ভালোবাসতাম।
লক্ষ্য করলাম গারো ( মান্দী) ভদ্রলোক ম্যালাক্ষন তাকিয়ে থেকে মোটর সাইকেল টা নিয়ে অনেক অনেক ঘোরা পথে সেই ছড়ার জায়গাটা পেরুলেন। সমতলের ভদ্রলোক সেই পড়ে থাকা কাঠের গুড়ির ওপর দিয়েই ছাগলের দু’কান চেপে ধরার মত তার মোটর সাইকেলের হাতলে হাত রেখে ঘষ্টাতে ঘষ্টাতে ওঠাবার চেষ্টা করতে থাকলেন , পিছলিয়ে পড়ছেন আবার উঠছেন কিন্তু তিনি ক্রমাগত “ দেখিয়ে দেয়া পথেই” পেরুবার চেষ্টা করছেন।
চোখ পড়লো সাওঁতাল ভদ্রলোক সালভাতোর পাউরিয়ার দিকে , দেখলাম থার্ড বা ফোর্থ গিয়ারে তুলে খিপ্র গতিতে প্রায় উড়েই পেরিয়ে গেলেন জলাটা।
আচ্ছা, এই যে এক ই পরিস্থিতি তে তিনজনের তিনটি কর্মপন্থা বেছে নেয়া একি নিছক ব্যাক্তিগত ইচ্ছেই? নাকি সামাজিকীকরন, সামাজিক অভিযোজন নাকি পারিপাশ্বিকতার প্রভাব নাকি জাতিতত্বের কোন ছিটে ফোঁটা? আমি কাব্য করে বলি লক্ষ মানুষের জীবন সাধনার নাম সংস্কৃতি – এটি কি সংস্কৃতির কোন প্রভাব? নাকি এর অন্য কোন ব্যাখা আছে? অথবা এমন ও তো হতে পারে আমার সংস্কৃতি আমাকে ঘটনা টি কে এ ভাবেই পর্যবেক্ষন করতে শিখিয়েছে, অন্য কেউ অন্য ভাবে দেখবেন ?
@কেয়া রোজারিও,
কেয়া, অনেকদিন পরে লিখলেন। নিয়মিত লিখতে অনুরোধ করি।
আমার জ্ঞানগর্মি এমনিতেই কম। আপনার প্রশ্নের সঠিক ব্যাখ্যা আমি কতটুকু দিতে পারব জানি না। তবে যেটুকু বুঝি মানুষ এ ধরণের পরিস্থিতি সামলাতে নিজের অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই সাহায্য নেয়। যার এ ধরণের পরিস্থিতিতে জীবন যাপনের অভিজ্ঞতা বেশি তার সমাধানও তত চৌকষ এবং বাস্তব সম্মত হবে। একজন সমতলভূমিতে বাস করা লোকের পক্ষে পাহাড় ডিঙ্গানো আর পাহাড়ী এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বাস করা একটি লোকের পাহাড় ডিঙ্গানোতে পার্থক্য থাকবেই। আর তা থাকবে তাদের স্বীয় অভিজ্ঞতার কারণে। যে কখনো জলে নামেনি তাকে সাঁতার নিয়ে যতই জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দেন না কেন, সেই অভিজ্ঞতার ফলাফল খুব বেশি সুখপ্রদ হবে না বলাই বাহুল্য। আবার আপনি ঠিকই ধরেছেন – আমাদের ঘটনা বিশ্লেষণের ব্যাপারটাও আমাদের অভিজ্ঞতার উপরে অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এমন হতেই পারে আপনি ঘটনাটি যেভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, অন্য কেউ অন্য ভাবে হতো করতো।
‘লক্ষ মানুষের জীবন সাধনার নাম সংস্কৃতি’ -উক্তিটি চমৎকার লাগলো।
@কেয়া রোজারিও,
চমৎকার পর্যবেক্ষণ! :rose: অনেকদিন আপনার লেখা পড়ি না! :deadrose:
” হ্যা,শতধা বিভক্তি সত্ত্বেও মানব কালচারগুলো আসলে সম্মিলিতভাবে সার্বজনীন সংস্কৃতি বা কালচারাল ইনিভার্সাল (Cultural Universal)কেই উর্ধ্বে তুলে ধরে, অন্ততঃ বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের তাই অভিমত।”
বুঝতে একটু অসুবিধা হচ্ছে।
ধরুন কান্নার ব্যাপারটা। জিওগ্রাফী চ্যানেলে তো একবার দেখলাম জেব্রার দল নদী পার হওয়ার সময় এক জেব্রাকে কুমিরে খেয়ে ফেলার পর তার মা কান্না করতেছিল ।
তারপর ধরুন মা তার সন্তানকে লালন-পালন করে। এই বৈশিষ্ট্যতো অন্য প্রাণীদের মধ্যেও পাওয়া যায়। তারপর ধরুন দলবদ্ধভাবে বাস করা, একে অপরের সাথে যুদ্ধ করা এসবের ওতো উদাহরন আছে।
আমি আসলে বলতে চাচ্ছি কিছু মিল পশুদের সাথে খুজলে পাওয়া যেতে পারে যেখানে হয়ত মানুষের নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক মিল অনেক বেশি। কিন্তু অমিলও কিন্তু খুব কম নয়। তাই সেটাকে কি পুরোপুরি সার্বজনীন বলা যায়?
মানব প্রজাতির পুরাটা নিশ্চয়ই বিবর্তনের একই পথ ধরে যাবে না। এবং এক সময় হয়ত বিবর্তনের পথ ধরে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা প্রকট আকার ধারন করতে পারে যদিও কিছু সাধারন বৈশিষ্ট্য অবশ্যই থাকবে।
মোটের ওপর আমার কথা হলো, অভিন্ন সংস্কৃতির ব্যাপারটা অনেকটা পরিমানগত , প্রকারগত নয়।
আসলে অল্পবিদ্যা ভয়ংঙ্করী। তাই হয়ত উল্টাপাল্টা মন্তব্য করে ফেলতে পারি। সেজন্য ক্ষমাপার্থী।
অফটপিকঃ
কিছু প্রশ্নের উত্তর এখনো পেলাম না।
১.কান্নায় মানুষের চোখে জল আসার বিবর্তনীয়ব্যাখা
২.যুদ্ধ এবং ছবি আকার ব্যাপারটা যদিও বুঝতে পেরেছি তবে নাচ-গানের কি বিবর্তনীয়ব্যাখা দেয়া যায়?
@রনবীর সরকার,
ঠিক আছে আরো একবার বোঝার চেষ্টা করা যাক। 🙂
প্রথম কথা হল, বিবর্তন যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের পৃথিবীতে দেখা জীবজগতের মধ্যে উৎপত্তিগতভাবে, বংশধারার উত্তরাধিকারসূত্রে পারষ্পরিক একটা সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ, তিনশ বছর আগে থেকে শুরু করে বর্তমানকালের সকল জীবই আসলে একে অন্যের আত্মীয়! কাজেই সে হিসেবে মানুষের সাথেও অন্য জীবের কিছু না কিছু মিল থাকবেই, কারণ মানুষও বিবর্তনের ধারাবাহিকতাতেই উদ্ভুত। কিন্তু কথা হচ্ছে কতটুকু মিল? যে প্রজাতি থেকে আমরা যত পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছি,তাদের সাথে আমাদের নৈকট্য তত বেশি হবে। শিম্পাজিদের সাথে আমাদের অনেক মিল, সে তুলনায় মুরগীর সাথে আমাদের মিল কম, কলাগাছের সাথে আরো কম। এর কারণ হচ্ছে কলাগাছ থেকে আমাদের লিনিয়েজ বিচ্ছিন্ন হয়েছে বহু আগে, তার অনেক পরে মুরগী থেকে আর অনেক পরে শিম্পাঞ্জিদের কমন পূর্বপুরুষ থেকে। কাজেই শিম্পাঞ্জিদের সাথেই আমাদের য়াচার ব্যবহারে অনেক বেশি মিল থাকবে মুরগীর আচরণের চেয়ে। ঠিক তাই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তারপরেও বলা যাবে না যে, শিম্পাঞ্জিদের সাথে আমাদের সবকিছুই মিলবে। কারণ মানুষ শিম্পাঞ্জি নয়, তার প্রকৃতি শিম্পাঞ্জির প্রকৃতির সাথে আলাদা হবে, বেশ কিছু জায়গায় মিল থাকা সত্ত্বেও।
ব্যাপারটা আরো ভাল ভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে মস্তিস্কের শেয়ার্ড এবং ইউনিক মডিউল গুলোর কথা জানতে হবে। ধরা যাক, আমাদের পুর্বপূরষদের কথা যদি বলতে হয়, তবে সব স্তন্যপায়ী প্রানীদের পুর্বপুরুষ ছিলো সরিসৃপেরা। কাজেই কিছু মডিউল থাকবেই মানুষের জন্য ‘ইউনিক’ নয়। সুবিন যেমন দেখিয়েছেন – আমাদের দেহগত স্ট্রাকচারে ‘ইনার ফিশ’ এর ছোয়া আছে, আমাদের মস্তিস্ক বিশ্লেষন করলেও আমাদের সরিসৃপ কিংবা মৎস প্রজাতির বিভিন্ন মডিউল পাওয়া যাবে – যা আমরা শেয়ার করি। কিন্তু তারপরেও কিছু মডিউল পাওয়া যাবে ইউনিক। কুমির এবং মানুষের – উভয়েরই চোখ আছে – এবং দুজনেই একই পূর্বপূরুষ হতে বিবর্তিত এবং বিকশিত, কিন্তু তার মানে এই নয় যে একটি মানুষের ‘কুমিরের চোখ’ আছে। মানব প্রজাতিতে চোখের বৈশিষ্ট কুমিরের বৈশিষ্ট থেকে আলাদা। আমি আমার লেখায় পাকস্থলির উপমা দিয়ে বুঝিয়েছি যে, সলিমুল্লাহ কসাই খুব ভাল করেই আমাদের দেখিয়ে দিতে পারবেন গরুর পাকস্থলি কেমন হয়, খাসিরটা কেমন, ভেড়ারটা কেমন আর মুরগীরটা কেমন। মানুষের পাকস্থলি এদের থেকে আলাদা হবে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, পেটের ভিতরে পাকস্থলির যেমন একটা প্রকৃতি আছে, তেমনি মানুষের মনেরও আলাদা একটা প্রকৃতি আছে – যেটা অন্য প্রানী থেকে আলাদা।
এই প্রকৃতিটি সার্বজনীন। আমি লেখায় বলেছি – একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, সংস্কৃতির যত বিভাজনই থাকুক না কেন, প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই দেখা যায়, মানুষেরা একইভাবে রাগ অনুরাগ, হিংসা, ক্রোধ প্রকাশ করে থাকে। নাচ, গান, ছবি আঁকার ব্যাপারগুলো সব সংস্কৃতিতেই কম বেশি বিদ্যমান। প্রকাশভঙ্গি হয়ত সংস্কৃতিভেদে আলাদা হতে পারে, কিন্তু সার্বজনীনরূপটি সব জায়গাতেই একই রকম হবে। কোন সংস্কৃতি খুঁজলেই পাওয়া যাবে না যে, নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি ভায়োলেন্ট, কিংবা কোন সংস্কৃতিতেই পাওয়া যাবে না যে, নারীদের মধ্যে সিরিয়াল কিলার বেশি কিংবা নারীরা বেশি পর্ণগ্রাফির ভক্ত, ইত্যাদি। যুদ্ধের ব্যাপারটাও প্রতিটি সংস্কৃতিতেই কম বেশি আছে। কেউ বা যুদ্ধ করেছে লাঠি সটা দিয়ে, কেউ বা বল্লম দিয়ে, কেউ বা তীর ধনুক দিয়ে কিংবা কেউ বুমেরাং ব্যবহার করে, কেউ বা কামান বন্ধুক ব্যবহার করে, কেউ বা পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র বানিয়ে। আদিম গুহাচিত্রগুলোতে চোখ রাখলেই দেখা যায় তীক্ষ্ণ সেসব অস্ত্র ব্যবহার করে তারা পশু শিকার করেছে, কখনো বা হানাহানি মারামারি করেছে নিজেদের মধ্যেই। কাজেই কেউ যদি দাবী করে কোন এক ‘এক্সোটিক’ সংস্কৃতিতে মানুষ এতোই শান্তিপ্রিয় যে তাদের ভাষাতে সহিংসতা, আগ্রাসন কিংবা সংঘর্ষসূচক কোন শব্দই নেই, তাহলে সেটা সার্বজনীনতার বিরুদ্ধে যায়। কিন্তু সেরকম কিছু পাওয়া যায়নি। বরং যারা সেরকম কিছু দাবী করেছিলেন, তাদের দাবীই হোক্স বলে প্রমাণিত হয়েছে (টেসাডে, স্যামোয়া প্রভৃতি) । কাজেই, বাহ্যিকভাবে যত পার্থক্যই আমরা দেখি না কেন, আসলে আমরা মানুষেরা এক অভিন্ন সংস্কৃতির অংশ।
এটা নিয়ে আমি আগেই বলেছি। জিওফ্রি মিলার তার মেটিং মাইণ্ড বইয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এ নিয়ে। আপনি পড়ে দেখতে পারেন। তার মতে শুধু নাচ গানই নয়, শিল্পানুরাগ, ক্রিয়েটিভিটি, কাব্য চর্চা – এগুলো আসলে আমাদের পূর্বপুরুষদের কেয়ারফুল সেক্সুয়াল সিলেকশনের ফল। এই নাচ গানগুলো আমাদের বেঁচে থাকায় কোন বাড়তি উপযোগিতা দেয়নি, কিন্তু এই গুণগুলো দ্বারা আমাদের পূর্বপুরুষেরা বহুমাত্রায় আকৃষ্ট হয়েছিল, আর তা নির্বাচন করেছিল যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে , ঠিক যেভাবে ময়ুরী নির্বাচন করে দীর্ঘপুচ্ছবিশিষ্ট ময়ুরকে। এ ছাড়াও আরো অনেক ব্যাখ্যা আছে সেগুলোতে আর গেলাম না।
@রনবীর সরকার,
আমিও উত্তর খুজছিকান্নায় মানুষের চোখে জল আসার বিবর্তনীয়ব্যাখা
ভবঘুরে বলেছেন
অভিজিৎ রায়ের নীচের মন্তব্য থেকে কিছু লিঙ্ক পাওয়া গেছে। আমার গতি শম্বুকের ন্যায়। কাজেই প্রচুর সময় লাগবে বুঝতে।
@নৃপেন্দ্র সরকার,
কান্নার একটা বড় ফাংশন হচ্ছে স্ট্রেস রিলিভ। এটার তো বায়োলজিকাল উৎস সন্ধান করাই যায়, এবং এটা নিয়ে কাজ হয়েছেও। এমনকি উইকিতেও আছে-
generally referred to as crying or weeping, is increased lacrimation due to strong emotional stress, suffering, mourning, or physical pain. This practice is not restricted to negative emotions; many people cry when extremely happy. In humans, emotional tears can be accompanied by reddening of the face and sobbing—cough-like, convulsive breathing, sometimes involving spasms of the whole upper body. Tears brought about by emotions have a different chemical make up than those for lubrication; emotional tears contain more of the protein-based hormones prolactin, adrenocorticotropic hormone, and leucine enkephalin (a natural painkiller) than basal or reflex tears. The limbic system is involved in production of basic emotional drives, such as anger, fear, etc. The limbic system, specifically the hypothalamus, also has a degree of control over the autonomic system. The parasympathetic branch of the autonomic system controls the lacrimal glands via the neurotransmitter acetylcholine through both the nicotinic and muscarinic receptors. When these receptors are activated, the lacrimal gland is stimulated to produce tears.
এ ছাড়া আরেক ধরণের ‘কান্না’ আছে চোখের ইরিটেশনের জন্য। যেমন পেঁয়াজ কাটলে, কিংবা চোখে আঘাত পেলে পানি আসে। এগুলোর জন্য চোখের আভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে রক্ষার বিবর্তনীয় ব্যাখ্যা আসবে। Dr. Margaret Crepeau সহ অনেকেই এ নিয়ে গবেষণা করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এই লেখাটা পড়া যেতে পারে- BIOLOGICAL ROLE OF EMOTIONAL TEARS EMERGES THROUGH RECENT STUDIES
Biological Purpose of Sadness নিয়েও গবেষণা হচ্ছে। সাউথ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন “Tears Can Keep Us Safe”।
যা হোক, এগুলো আমার গবেষণার টপিক নয়, খুব বেশি সাহায্য করতে পারবো না। যার আগ্রহ আছে তাকে একটু কষ্ট করে আরো গবেষণার হদিস খুঁজে নিতে হবে।
@অভিজিৎ,
Here we go. আপনার এই ব্যাখ্যাটা দারূণ লেগেছে। স্ট্রেস ডেভেলপমেন্ট। এটি একটি বাইওকেমিক্যাল প্রসেস। সাংস্কৃতিক মিথ্যা আশ্বাস (ভগবান তাকে স্বর্গে স্থান দিয়েছেন। বাপ মরেছে, কী হয়েছে? আমরা আছি না! ইত্যাদি) বাইওকেমিক্যাল প্রসেসটাকে ভিন্ন সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভাবে কম বা বেশী করছে। তাই কান্নার ভ্যারিয়েশন হচ্ছে।
আপনার উইকি রেফেরেন্স পরিস্কার ধারণা দিয়েছে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটা পথ সামনে এসেছে। শুধু ধন্যবাদ দিলে আপনা্র মূল্য দেওয়া হয় না। তাই কিছুই বলছি না।
অভিজিৎ দা,
আপনার লেখাটি খুব সুন্দর হয়েছে।
মুক্ত মনা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমার এখন আফসোস হচছে যে, এত দিন ধর্ম এর পেছনে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি। এই মূল্যবান সময় গুলো জ্ঞান চরচার পেছনে নষ্ট করলেও লাভ হত।
কম্পিউটার এ নতুন বাংলা লেখা শিখেছি তাই ২ ১ টা বানান ভুল হয়েছে। তাই আমি ক্ষমা প্রাথী।
@রনি,
মুক্ত-মনায় স্বাগতম। নিয়মিত আলোচনায় অংশগ্রহণ কাম্য। :rose2:
@রনি,
স্বাগতম মুক্তমনায়।
শ্রী অভিজিৎ সংষ্কৃতির উপর এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে ফেললেন । তিনি পন্ডিত ব্যক্তি, মানব জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করতে সমর্থ হন । বর্তমানে মানব জ্ঞানের যথেষ্ট উৎকর্ষ ঘটায়, জ্ঞানের আদি শাখা সমূহ বিভিন্ন উপ-শাখায় বিভাজিত হয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়টিকে জটিল করে তুলছে । ফলে আমার মতো সাধারণ পাঠকের পক্ষে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি বুঝা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় । তাই আমাদের মতো পাঠকের জন্য জ্ঞানের আদি রূপ বুঝার জন্য সহজতর । উদাহরণ নিউটনের মাধ্যমে পদার্থবিদ্যা বুঝা যত সহজতর, আধুনিক পদার্থবিদের মাধ্যমে পদার্থবিদ্যা বুঝা ততই কঠিন ।
আমার কাছে সংষ্কৃতির সংজ্ঞা হলো বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার সমন্বিত রীতিনীতির প্রতীকী, যা স্থান, কাল ও মানব গ্রুপের উপর নির্ভরশীল এবং ভাববাদের মাধ্যমে যার আদি বহির্প্রকাশ । কালক্রমে সংষ্কৃতি উপাসনালয়ের গন্ডি পেড়িয়ে, সামন্তবাদের বৈঠকখানা হয়ে, রাজপথে গণ-মানুষের কাছে উপস্থিত হয়েছে । বর্তমানে বলা হচ্ছে সংগিতের ভাষা নাই, নৃত্যের কোন নির্দিষ্ট অংগভংগি নাই । এগুলি সার্বজনীন ।
অতএব সংষ্কৃতি বুঝতে হলে সমাজ ও তার মনোস্তাত্বিক বিবর্তনের কারন উদ্ঘাটন করতে হবে ।
@অভিজিৎ রায়,
ধন্যবাদ। আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আপনি সময় ব্যয় করে এত দীর্ঘ তথ্যবহুল লেখা লিখেছেন তার জন্য আমি অভিভূত। আমি পড়েছি। আরও কয়েক বার পড়তে হবে। তখন হয়ত কিছুটা বুঝতে পারব।
স্বাধীনের দেওয়া রেফারেন্স বইটি
Evolutionary psychology : an introduction / Lance Workman and Will Reader.
Amazon.com এ আজকেই অর্ডার করব। জিনিষগুলো বুঝতে আমার ভাল সময় লাগবে।
@নৃপেন্দ্র সরকার,
ধন্যবাদ নৃপেনদা। তবে স্বাধীনের দেওয়া বইটা আমি পড়ি নাই। তাই বলতে পারছি না।
@অভিজিৎ,
বইটা পড়ে দেখতে পারেন। আমার কাছে লিটেরাচার রিভিউগুলো বেশ আপ টু ডেট মনে হয়েছে।
@অভিজিৎ,
অর্ডার করা হয়ে গেল। খারাপ বললেও ফেরত দেওয়ার উপায় নেই।
ডিজিটাল ব্যাপার-স্যাপার।
বিজ্ঞান ছাইড়া সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞানেও নাক গলাইছো তুমি। ঘট্নাডা কী? স্নিগ্ধার ভাত মারতে চাও নাকি? নাকি কালচারাল ইউনিভারসাল এর মত সায়েন্টিফিক ইউনিভারসালের যুক্তি তুইলা ধইরা কইবা যে ছোটোখাটো কিছু বাহ্যিক ভেদাভেদ থাকলেও সব বিজ্ঞানগুলোই আসলে একই বিজ্ঞান। তা সে হোক না কেন সমাজবিজ্ঞান কিংবা জীববিজ্ঞান অথবা পদার্থবিজ্ঞান। লেজেতো সবগুলারই বিজ্ঞান আছে। 🙂
অভির লেখা নিয়ে দুর্দান্ত, চমৎকার, অসাধারণ, ফাটাফাটি, ব্রিলিয়ান্ট, গবেষণা নির্ভর, শ্রমসাধ্য কাজ, এই সব বিশেষণ দিতে দিতে এখন সবগুলোকেই আমার কাছে এডজেক্টিভিক্যালি ইউনিভার্সাল লাগে। তাই আর কোন বিশেষণে গেলাম না। হইছে এক রকম আর কি। 😀
প্রিয়জন মারা গেলে সব সমাজের লোকই কাঁদে এতে মনে হয় কারো কোন আপত্তি নেই। তবে এই কান্নার প্রকারভেদের ক্ষেত্রে সামাজিক চাপটাকেও অস্বীকার করা যায় না একেবারে।
গত পরশুদিন কাছাকাছি বসবাস করা আমার পরিচিত এক ভদ্রলোকের মা মারা গিয়েছেন। ভদ্রলোকের স্ত্রীর সাথে তাঁর মায়ের সম্পর্কটা ছিল একেবারে সাপে-নেউলে। এর জের দুই পরিবারেও গিয়ে পড়েছিল। দুইজনের মা-বাবাই ঢাকা শহরে খুব কাছাকাছি জায়গায় থাকার পরেও তাঁদের মধ্যে কোন যোগাযোগ ছিল না। ভদ্রলোকের মা মারা যাবার পরে তাঁদের পরিবার থেকে ভদ্রমহিলার পরিবারকে এই খবরটা জানাবার প্রয়োজনটুকুও কেউ বোধ করে নি। মা মারা যাবার খবর শুনে ভদ্রলোক তাঁর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন যে তিনি মা হারা হয়েছেন (মা মারা যাবার পরে কেউ কম্পিউটার খুলে ফেসবুকে যেতে পারে এটা বিশ্বাস করতেও অবশ্য কষ্ট হচ্ছিল আমার।) সেই স্ট্যাটাস দেখে ভদ্রমহিলার বাবা-মা জানতে পারেন যে তাঁদের কন্যার শাশুড়ি মারা গিয়েছেন।
এখন এই ভদ্রমহিলা পরিচিত সবাইকে ফোন করে তাঁর শাশুড়ির মৃত্যু সংবাদ দিচ্ছেন আর গগনবিদারী কান্নাকাটি করছেন। মৃত্যু সংবাদ পাবার পর থেকে কীভাবে মেঝেতে গড়াগড়ি করে তিনি কাঁদছেন তাঁর সবিস্তার বর্ণনা দিচ্ছেন ওই সশব্দ আকুল কান্নার ফাঁকে ফাঁকেই। যাদের সুস্থ মন তাঁরা বলবেন যে, জীবিত মানুষের সাথে মানুষের শত্রুতা থাকতেই পারে, মারা যাবার পরে সেটা কী আর কেউ মনে রাখে। কাজেই তিনি সত্যি সত্যিই হয়তো প্রচণ্ড দুঃখ পেয়েছেন, ফলে ওরকম কোরবানির গলাকাটা পশুর মত মেঝেতে পড়ে কাঁদছেন। কিন্তু আমার অসুস্থ মনে কেন যেন বারবার শুধু সামাজিক চাপের কথাই ভেসে ভেসে উঠছে। শাশুড়ির মৃত্যুতে না কাঁদলে লোকে কী ভাববে সেটাই হয়তো কাজ করছে ভদ্রমহিলার মনে।
আরেক খান কথা। কাহিনির মত এইটাও মানবা না জানি, তবুও কইতাছি। এমিল ডার্খেইম নয়, ভদ্রলোকের নাম এমিল ডুর্খাইম। 🙂
@ফরিদ আহমেদ,
ডিজিটাল প্রেমের কাহিনী বহু শোনা যায়, তবে ডিজিটাল শোকের কাহিনী এইই প্রথম শুনলাম।
হাসিনা শুনলে মনে হয় খুব খুশী হবেন।
@আদিল মাহমুদ, :laugh:
@ফরিদ ভাই,
আপনের মন্তব্য আমার লেখার চাইতে ভালা, এইটা বোধ হয় না বললেও চলবো। আর, ঠিক আছে এমিল ডুর্খাইমই সই। আপ্নাগো লাইনের লুক আফটার অল! ধন্যবাদ কারেকশনটার জন্য।
আর ডিজিটাল শোকের বর্ণনাটা আসলেই খাসা।
ফরিদ আহমেদ,
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হোল এখানে সোশ্যাল রেকগ্নিশন বা সামাজিক অনুমোদন টাই কাজ করেছে বেশী। যদিও প্রশ্ন থেকে যায় -একটি ঘটনা দিয়ে সব কি ব্যাখ্যা করা যায় বা তা’ আদৌ উচিত কিনা।
আপনার মননের খেড়ো খাতা মানে ফেইস বুকের গল্প শুনে একটা গল্প বলতে ইচ্ছে হচ্ছে -এক ভদ্রলোক নিত্যিদিনের মত কাজ সেরে বাড়ী ফিরে দেখলেন স্ত্রী ঘেমে নেয়ে হাতে মুখে হলুদ মেখে রান্নায় ব্যাস্ত। আজ বুঝি আগেই রান্না চড়িয়েছেন। ভদ্র মহিলা খানিক বাদে গলা উচিঁয়ে বললেন তোমার একখানা চিঠি এসেছে, খুলি নি। ভদ্রলোক আয়েশ করে বসে চিঠি খুলে দেখলেন লেখা আছে স্ত্রীর বাবা , তার শ্বশুর গত হয়েছেন। খানিক টানা পোড়েনের পর স্ত্রীকে খবর টা দিতেই বাবার নাম করে গগন বিদারী আওয়াজে মহররমের মাতম করে কেঁদে উঠলেন স্ত্রী। ভদ্রলোক স্বান্তনা দিতে ছুটে যাবার আগে হঠাৎ ই লক্ষ্য করলেন চিঠির নীচে বাঁদিকের কোনায় হলুদ মাখা বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ আর খামের ওপরে খানিক টা ভাতের আঠা লেগে রয়েছে।
হয়তো বা কাদঁতে গেলেও সামাজিক অনুমোদন লাগে আর ভোগ তো একলা করা যায় , কিন্তু উপোভোগ করতে হয় সবাইকে নিয়ে।
@ফরিদ আহমেদ,
ঠিক কইছেন ভাই। 😀
@ফরিদ আহমেদ,
ফরাসী ভদ্রলোকটির Émile Durkheim নাম এর উচ্চারণ হবে এমিল(অ) দুর্কেম । ড , হ এবং খ ফরাসী ভাষায় নেই এবং ফরাসী R বাংলায় লেখা সম্ভব নয় ।
@সংশপ্তক,
জানি। আমি ইংরেজিভাষী দেশে তাঁর নাম যেভাবে উচ্চারণ করে সেটাই বলেছি।
অনেক কিছু জানতে পারলাম।
ধন্যবাদ!
মানব সংস্কৃতি নিয়ে লেখাটি বেশ যুক্তিপুর্ন। ভালো লাগলো জেনে যে
খুবই সুখপাঠ্য, তথ্যবহুল লেখা। ধন্যবাদ।
@রৌরব,
আপনাকেও ধন্যবাদ, পড়ার জন্য।
অভিজিৎএর লেখা মানেই কঠিন বিষয়কে চারপাশ থেকে উপাত্ত নিয়ে উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেওয়া। সংস্কৃতির ভূতও এর ব্যতিক্রম নয়।
লেখাটি পড়ে নিজেকে একটু সমৃদ্ধ করলাম।
ধন্যবাদ অভিজিৎ।
@গীতা দাস,
এ ক ম ত। :yes:
@গীতা দি এবং বিপ্লব,
আপনাদের ধইন্যা পাতা 🙂
@অভিজিৎ,
সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস। কাজেই আপনাদের মত লোকদের সাথে interaction করতে গিয়ে আপনার ধইন্যা পাতার উত্তরে নতুন শব্দ ব্যবহার করে বলছি শুক্তো ভাত ( স্বাগতম)।