নৃপেনদা (নৃপেন্দ্র সরকার) একটি চমৎকার লেখা লিখেছেন বিবর্তনের চোখে চোখের জল শিরোনামে। তিনি লেখাটিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। আমি কিছু উত্তর দিয়েছি এখানে। উত্তর দিয়েছি মূলত মানবীয় আবেগের সাথে বিবর্তনের সম্পর্ক নিয়ে। বিবর্তনের চোখে আবেগের উৎস সন্ধান বিষয়ে আবছা অবতারণা করা হয়েছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ভিন্নতা নিয়ে নৃপেনদার প্রশ্নগুলোর উত্তর উহ্যই থেকে গিয়েছিল। একটু আগে উত্তর দিতে বসলাম। উত্তর দিতে গিয়ে দেখছি উত্তরটা ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। তাই আলাদা লেখা হিসেবে দেওয়াটাই সমীচীন মনে হল। সচেতন পাঠকেরা ধরে ফেলতে পারেন যে, লেখাটির কিছু অংশ আগেকার বিবর্তন মনোবিদ্যা ই-বইয়ে (মানব প্রকৃতির জৈববিজ্ঞানীয় ভাবনা) প্রকাশিত হয়েছে। পুনরুক্তির জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

:line:

নৃপেনদা একটি প্রশ্ন করে শেষ করেছেন তার লেখা,  

বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাব ভিন্ন ভাবে কাজ করে আমাদের জৈবিক প্রক্রিয়ায়। বিবর্তন কী ব্যাখ্যা আনে এখানে?

বিভিন্ন সংস্কৃতির যে আপাত পার্থক্যের  কথা নৃপেনদা বলছেন তা বুঝতে হলে আমাদের আগে মানবপ্রকৃতি নিয়ে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীদের আধুনিক গবেষনাগুলোর কথা জানতে হবে। এখানে মনে রাখতে হবে,  বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা রঙ্গমঞ্চে হাজির হবার আগে সার্বজনীন ‘মানব প্রকৃতি’ বলে কিছু আছে কিনা সেটাই ঠিকমত আমাদের কাছে পরিস্কার ছিলো না। যেমন, স্প্যানিশ লিবারেল দার্শনিক হোসে ওর্তেগা গ্যাসেট মানব প্রকৃতির অস্তিত্ব অস্বীকার করে বলতেন, ‘Man has no nature, what he has is history’। ব্রিটিশ-আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ অ্যাশলে মন্টেগু বলতেন, ‘মানুষের সহজাত স্পৃহা (instinct) বলে কিছু নেই; কারণ তার সব কিছুই তার চারপাশের সমাজ-সংস্কৃতি থেকেই শেখা’। কেউ বা আবার মানব প্রকৃতিকে স্বীকার করে নিলেও তাকে একেবারেই কাঁচামালের মত আদিম মনে করতেন। যেমন প্রখ্যাত নৃতাত্ত্বিক মার্গারেট মীড বলতেন, ‘Human nature is the rawest, most undifferentiated of raw material’।

বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা এসে মানব প্রকৃতি নিয়ে এই প্রচলিত ছকটিকেই উলটে দিয়েছেন। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করা যাক। একজন সার্জন যখন হাসপাতালে অপারেশনের জন্য আসা কোন রোগীর পেটের ভিতর ছুরি চালাবেন বলে ঠিক করেন তখন তিনি জানেন যে, পেট কাটলে এর ভিতরে কি পাওয়া যাবে। পাকস্থলি, বৃহদান্ত্র, ক্ষুদ্রান্ত্র, অগ্ন্যাশয় ইত্যাদি। পাকস্থলির জায়গায় পাকস্থলি থাকে, আর অগ্ন্যাশয়ের জায়গায় অগ্ন্যাশয়। অন্য রোগীর ক্ষেত্রেও পেট কেটে চিকিৎসক পাকস্থলির জায়গায় পাকস্থলি দেখবার প্রত্যাশাই করেন। এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন রোগীর পাকস্থলিতে পার্থক্য থাকতে পারে – কারোটা মোটা, কারোটা চিকন, কারোটা দেখলেই হয়ত বোঝা যাবে ব্যাটা আমাশা রুগি, কারোটা আবার স্বাস্থ্যকর। বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য যাই থাকুক না কেন, মানুষের পাকস্থলি দেখে কারো গরুর কিংবা ঘোড়ার পাকস্থলি বলে ভুল হবে না। কারণ মানুষের পাকস্থলির একটা প্রকৃতি আছে, যেটা গরুর পাকস্থলি থেকে আলাদা । আমি অবশ্য গরুর পাকস্থলি বিশেষজ্ঞ নই, যিনি বিশেষজ্ঞ – যেমন পলাশি বাজারের সলিমুল্লাহ কসাই- তিনি খুব ভাল করেই আমাদের দেখিয়ে দিতে পারবেন গরুর পাকস্থলি কেমন হয়, খাসিরটা কেমন, ভেড়ারটা কেমন আর মুরগীরটা কেমন। ঠাটারিবাজারের নিত্যানন্দ কসাই হলে তার লিস্টে শুয়োরের পাকস্থলিও চলে আসতে পারে। সলিমুল্লা কিংবা নিত্যানন্দ কসাইয়ের অভিজ্ঞ চোখকে খাসির পাকস্থলির নামে শুয়োরের পাকস্থলি বলে চালানোর চেষ্টা করে ধোঁকা দেয়া যাবে না। কারণ তারা জানেন, খাসির পাকস্থলির প্রকৃতি শুয়োরেরটা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। একই কথা মানুষের পাকস্থলির জন্যও প্রযোজ্য। একথা বলা ভুল হবে না যে, মানুষের পাকস্থলির প্রকৃতিই অন্যপ্রানীর পাকস্থলি থেকে তাকে আলাদা করে দিচ্ছে।

বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, পেটের ভিতরে পাকস্থলির যেমন একটা প্রকৃতি আছে, তেমনি মানুষের মনেরও আলাদা একটা প্রকৃতি আছে – যেটা অন্য প্রানী থেকে আলাদা। উদাহরণ দেয়া যাক। মানুষের খুব কাছাকাছি প্রজাতি শিম্পাঞ্জি। শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের জিনগত মিল শতকরা ৯৯ ভাগ। কাজেই ধরে নেয়া যায় শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের অনেক কিছুতেই মিল থাকবে। কিন্তু যতই মিল থাকুক না কেন – সার্বজনীনভাবে মানব প্রকৃতি শিম্পাঞ্জির প্রকৃতি থেকে আলাদা হবে বলে আমরা ধরে নিতে পারি, অনেকটা উপরের উদাহরণের পাকস্থলির প্রকৃতির মতই। কিছু উদাহরণ হাজির করি। শিম্পাঞ্জি সমাজে মেয়ে শিম্পাঞ্জিরা বহুগামী হয় – তারা যত ইচ্ছা ছেলেদের সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে – তাদের আসলেই কোন বাছ বিচার নেই। পুরুষ শিম্পাঞ্জিরা আবার অন্য মেয়ে শিম্পাঞ্জি (যাদের সাথে এখনো দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় নাই) – তাদের বাচ্চাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে। এ ধরণের কোন প্যাটার্ন আমাদের মানব সমাজে চোখে পড়ে না। চোখে না পড়াই স্বাভাবিক, কারণ মানুষের প্রকৃতি শিম্পাঞ্জিদের প্রকৃতি থেকে আলাদা।

বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীদের কথামত আমরা জানলাম ‘মানব প্রকৃতি’ বলে একটা কিছু তাহলে আছে, যেটা অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা। কিন্তু কেমন সে প্রকৃতি? সমাজ বিজ্ঞানী কিংবা নৃতাত্ত্বিকরা অনেকদিন ধরেই এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন। তারা বলেন এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে মানব সমাজের সংস্কৃতিতে। সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা এমিল ডার্খেইম কোন সার্বজনীন মানব প্রকৃতির জন্মগত প্রকরণকে অস্বীকার করে তাকে ব্ল্যাঙ্ক স্লেটের সাথে তুলনা করেছিলেন। তার মতে সাংস্কৃতিক বিভাজনই মানব প্রকৃতিকে তুলে ধরার একমাত্র নিয়ামক। কাজেই মানব প্রকৃতি বিষয়ে যে প্রশ্নই করা হোক না কেন – এর উত্তর আমাদের খুঁজে নিতে হবে সংস্কৃতিতে। মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা বেশি সহিংস কেন – এর উত্তর হল – সংস্কৃতিই এর কারণ। ছেলেরা কেন সত্তুর বছরের বুড়ির চাইতে বিশ বছরের ছুঁড়ির প্রতি বেশি লালায়িত হয় – এর উত্তর হচ্ছে সংস্কৃতি। ছেলেরা কেন মেয়েদের চেয়ে বেশি পর্ণগ্রাফি দেখে, কিংবা বহুগামী – উত্তর একটাই – ‘সংস্কৃতি’! Omnia cultura ex cultura!

সমাজবিজ্ঞানের পুরোধা এমিল ডার্খেইম যে ইটের গাথুঁনি দিয়ে গিয়েছিলেন তাতে ‘সংস্কৃতির প্রাসাদ’ বানাতে এবারে এগিয়ে এলেন নৃতাত্ত্বিকেরা। নৃতত্ত্ববিদের জনক বলে যাকে অভিহিত করা হয় সেই – ফ্রানজ বোয়া এবং মার্গারেট মীড ছিলেন এদের মূল কান্ডারী। ফ্রানজ বোয়া যে মতবাদ প্রচার করলেন তাতে সকলের মনে হল, মানুষের প্রকৃতি বুঝি একেবারেই নমনীয়। এতে জন্মগত কোন বৈশিষ্ট্যের কোন ছাপ নেই, কোনদিন ছিলোও না। সব কিছুই সংস্কৃতিনির্ভর। আর বোয়ার প্রিয় ছাত্রী ‘নৃতত্ত্বের রাণী’ মার্গারেট মীড আদিম ‘স্যামোয়া’ জাতির মেয়েদের নিয়ে এমন এক আদর্শিক সমাজ কল্পণা করে ফেললেন, যার বাস্তব অস্তিত্ব আসলে পৃথিবীর কোথাওই নেই। মীডের ‘স্যামোয়া’ যেন আক্ষরিক অর্থেই হচ্ছে স্বর্গের প্রতিরূপ। সেখানে কারো মধ্যে নেই কোন ঝগড়া, নেই কোন ঘৃণা, ঈর্ষা কিংবা হিংসা। যৌনতার ক্ষেত্রে তাদের আচরণ একেবারে স্বতস্ফুর্ত। সেখানকার মেয়েরা বহুগামী, যৌনতার ব্যাপারে পুরোপুরি স্বাধীন – যখন ইচ্ছে স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে প্রিয় মানুষের সাথে সম্পর্ক করে নিতে পারে। তারা স্বাধীনভাবে যেটা চায় সেটা করতে পারে। মীডের অনুকল্প ছিলো, স্যামোয়া জাতির সংস্কৃতিই তাদের মেয়েদের এমন স্বতস্ফুর্ত আর স্বাধীন করে তুলেছে। তিনি সেসময় ফাপুয়া (Fa’apua’a) এবং ফোফোয়া (Fofoa) নামের দুজন স্যামোয়ান নারীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য তার গবেষোনায় ব্যবহার করেন। তাদের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে মীড সিদ্ধান্তে আসেন, বংশগতি নয় বরং সংস্কৃতিই ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে। মার্গারেট মীড তার চিন্তাধারা ব্যক্ত করে ১৯২৮ সালে ‘Coming of Age in Samoa’ নামের যে গ্রন্থ রচনা করেন সেটি ‘সংস্কৃতিভিত্তিক প্রাসাদের’ এক অগ্রগন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়[1] ।

margaret_mead_coming_age_samoa

 

derek_freeman

ছবি – দুটি আলোচিত বই : উপরে মার্গারেট মীডের কামিং অফ এজ ইন সামোয়া, আর নীচে ডেরেক ফ্রিম্যানের দ্য ফেটফুল হোক্সিং অব মার্গারেট মীড

কিন্তু পরবর্তীতে ডেরেক ফ্রিম্যানসহ অন্যান্য গবেষকদের গবেষণায় প্রমানিত হয় যে, মীডের অনুকল্পগুলো স্রেফ ‘উইশফুল থিংকিং’ ছাড়া আর কিছু ছিলো না[2],[3]। গবেষকেরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, মীডের গবেষণা ছিলো একেবারেই সরল এবং মীড স্যামোয়ান মেয়েদের দ্বারা নিদারূণভাবে প্রতারিত হয়েছিলেন। ফ্রিম্যানের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এলো, স্যামোয়ান্ জাতির মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, ঘৃণা, হত্যা লুন্ঠন- আর দশটা জাতির মতই প্রবলভাবে বিদ্যমান, সরলমনা মীড সেগুলো দেখতেই পাননি। ডেরেক ফ্রিম্যানের অনুমান এবং অভিযোগের একেবারে সরাসরি সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় মীডের গবেষণা প্রকাশের ষাট বছর পর। ১৯৮৮ সালের মে মাসে ফাপুয়া (Fa’apua’a), যখন তার বয়স ৮৬ বছর অফিশিয়ালি স্যামোয়ান সরকারের কাছে স্বীকার করে নেন যে, তিনি আর তার বন্ধু ফোফোয়া স্যামোয়ান নারীদের যৌনপ্রবৃত্তি নিয়ে যে তথ্য মীডকে ১৯২৬ সালে দিয়েছিলেন তার সবটুকুই ছিলো বানোয়াট। এ কম্পলিট হোক্স।

সেজন্যই ম্যাট রীডলী তার ‘এজাইল জিন’ বইয়ে মীডের গবেষণা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেন[4], ‘তার মানব প্রকৃতির সাংস্কৃতিক ভিন্নতা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা অনেকটা এমন কুকুর খুঁজে পাওয়ার মতোই – যে কুকুর ঘেউ ঘেউ না করে মিউ মিউ করে’।

mead_protarito

ছবি- মার্গারেট মীড কিভাবে স্যামোয়ান মেয়েদের দ্বারা নিদারূণভাবে প্রতারিত হয়েছিলেন তার একটি ব্যঙ্গচিত্র

মার্গারেট মীডের মতোই শান্তিপূর্ণ এক জাতির সন্ধান করতে গিয়ে সত্তুরের দশকে লেজে গোবরে করেছেন ম্যানুয়েল এলিজাল্ডে জুনিয়র (Manuel Elizalde Jr)। তিনি দেখাতে গিয়েছিলেন ঢালাওভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সহিংসতা, যুদ্ধবাজির কথা ঢালাওভাবে উল্লেখ করা থাকলেও ফিলিপাইনের এক জঙ্গলে টেসাডে (Tasaday) নামে এমন এক ট্রাইব আছে যারা নাকি আক্ষরিক অর্থেই এখনো সেই আদিম প্রস্তর যুগে বাস করছে। তারা ছাল বাকল পড়ে ঘুরে বেড়ায়, গুহায় বসবাস করে আর তারা নাকি এমনই শান্তিপ্রিয় যে তাদের ভাষাতে সহিংসতা, আগ্রাসন কিংবা সংঘর্ষসূচক কোন শব্দই নেই। তাদের সংস্কৃতি একেবারে শান্তিতে শান্তিময়। এই মহা ব্যতিক্রমী শান্তিপূর্ণ মানবপ্রজাতি নিয়ে ১৯৭৫ সালে একটি বইও বের হয়েছিল ‘শান্ত টেসাডে’ নামে[5]।

কিন্তু থলের বেড়াল বেরিয়ে যেতে সময় লাগেনি। আশির দশকের শেষদিকে বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসলো যে ম্যানুয়েল এলিজাল্ডের আগেকার কাজকর্ম আসলে ছিলো পুরোটাই সাজানো[6]। আশে পাশের গ্রাম থেকে জিন্স আর টিশার্ট পরা সুশিক্ষিত ছেলেপিলেদের ছাল বাকল পরিয়ে ‘শান্ত টেসাডে’ সাজানো হয়েছিল। টেসাডের শান্তিময় ধরণের কোন ট্রাইবই আসলে ফিলিপাইনে নেই। সত্তুরের দশকে ফিলিপাইনের একনায়ক ক্ষমতাশীন মার্কোস সরকারের পরিকল্পনায় ম্যানুয়েল এলিজাল্ডের কুকর্মে ইন্ধন যোগানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিলো ‘শান্ত টেসাডেকে পুঁজি করে বহির্বিশ্বে ফিলিপাইনের ইমেজ বাড়ানো।

 

tasaday_hoax

ছবি –মার্কোস সরকারের পরিকল্পনায় সভ্য মানুষকে অর্ধনগ্ন করে ছাল বাকল পড়িয়ে শান্তিপূর্ণ টেসাডের মিথ সুপরিকল্পিত ভাবে তৈরি করা হয়।

আসলে সংস্কৃতির বিভাজনের কথা ঢালাও ভাবে সাহিত্য, সংস্কৃতিতে আর নৃতত্ত্বে উল্লিখিত হয় বটে, কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় এই বিভাজন মোটেই বস্তুনিষ্ঠতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয় না। ব্যাপারটা নৃতত্ত্ববিদ আর সমাজবিদদের জন্য এক নিদারূন লজ্জার ব্যাপার। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, সংস্কৃতির যত বিভাজনই থাকুক না কেন, প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই দেখা যায়, মানুষেরা একইভাবে রাগ অনুরাগ, হিংসা, ক্রোধ প্রকাশ করে থাকে। পশ্চিমা বিশ্বের আলো ঝলমলে তথাকথিত ‘আধুনিক’ সভ্যতা থেকে শুরু করে পৃথিবীর আনাচে কানাচে যত গহীন অরন্যের যত নাম না জানা গোত্রের মধ্যেই অনুসন্ধান করা হোক না কেন – দেখা যাবে নাচ, গান, ছবি আঁকার ব্যাপারগুলো সব সংস্কৃতিতেই কম বেশি বিদ্যমান। কেউ হয়ত গুহার পাথরে হরিণ শিকারের ছবি আঁকছে, কেউ পাথরে খোদাই করে মূর্তি বানাচ্ছে, কেউ নদীর ধারে বসে পাল তোলা নৌকাকে ক্যানভাসে উঠিয়ে আনছে, কেউবা আবার মাটির পটে গড়ে তুলছে অনবদ্য শিল্পকর্ম। সংস্কৃতির বিবিধ উপাদান যোগ হবার কারণে ব্যক্তি কিংবা সংস্কৃতিভেদে চিত্রকল্পের প্রকাশ ভঙ্গিতে হয়ত পার্থক্য আছে কিন্তু চিত্র প্রকাশের বিমূর্ত স্পৃহাটি সেই একই রকম থেকে যাচ্ছে। শুধু ছবি আঁকা নয়, নাচ-গানের ক্ষেত্রেও আমরা তাই দেখব। এক দেশে কেউ একতারা হাতে বাউল গান গেয়ে চলছে তো আরেকজন অন্য দেশে নিবিষ্ট মনে পিয়ানো বাজিয়ে চলছে। কেউবা চোখ মুদে সেতার বাজাচ্ছে তো কেউবা গিটার কিংবা কেউ সন্তুর। যে একেবারেই আলসে সে হয়ত পড়াশুনা করার টেবিকেই ঢোল বানিয়ে তাল ঠুকছে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে। এক সংস্কৃতিতে কেউ হয়ত ডিস্কো নাচ নাচছে, অন্য জায়গায় সেরকমই একজন কেউ ভরত নাট্যম, আরেক জায়গায় কেউ ল্যাটিন ফিউশন, কেউবা কোন অচেনা ট্রাইবাল ড্যান্স। নাচের রকম ফেরে কিংবা মূদ্রায় পার্থক্য থাকলেও সংস্কৃতি নির্বিশেষে নাচ-গানের অদম্য স্পৃহাটি কিন্তু এক সার্বজনীন মানব প্রকৃতিকেই উর্ধ্বে তুলে ধরছে। এই ব্যাপারটির তাৎপর্য উপলব্ধি করেই ডোনাল্ড ব্রাউন তার ‘Human Universals’ গ্রন্থে বলেছেন[7] – ‘It is the human universals not the differences that are truly intriguing’।

নৃপেনদাও সেটা জানেন। তিনি হিন্দুদের কান্নার উদাহরণ দিয়েছেন। দিয়েছেন মুসলমানদের কান্নারও। কান্নার রকমফেরে পার্থক্য থাকলেও সবাই  কিন্তু কাঁদে প্রিয়জনের মৃত্যুতে। কেউ চল্লিশা করতে করতে কাঁদে, কেউ বা শ্রাদ্ধশান্তি করতে করতে কাঁদে। কিন্তু কাঁদে তো। এটাই হিউম্যান ইউনিভার্সাল। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু তারপরেই নৃপেনদা বড় একটা ভুল করে ফেলেছেন। তিনি বোধ হয় মীডের মতই উইশফুল থিঙ্কিং থেকে ভেবেছেন, অনেক জনগোষ্টি আছে যাদের চোখ একেবারে শুষ্ক – মরুভূমি। তারা প্রিয়জনের মৃত্যুতে নাকি কাঁদে না। উদাহরণ হিসেবে হাজির করেছেন এরিক ভ্যালির একটি মুভির উদাহরণ। মুভির উদাহরণ কোন ভাল উদাহরণ নয়। অতিরঞ্জনের সুযোগ থাকে পুরোমাত্রায়। মার্গারেট মীড বা ম্যানুয়েল এলিজাল্ডের গবেষণাতেই আছে, আর মুভি তো কোন ছাড়! আমি নিশ্চিত, যদি সঠিকভাবে অনুসন্ধান করা হয় তবে তিব্বতিদের  চোখ একেবারে শুষ্ক – মরুভূমি – ব্যাপারটাও হোক্স হিসেবেই প্রতিপন্ন হবে।

যা হোক, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সংস্কৃতি ব্যাপারটা মানব সমাজের অনন্য বৈশিষ্ট হিসেবে গন্য হলেও এটি কোন গায়েবী পথে নয়, বরং অন্য সব কিছুর মতো জৈব বিবর্তনের বন্ধুর পথ ধরেই উদ্ভুত হয়েছে (evolved biologically)[8]। আমরা উপরে যে নাচ, গান, ছবি আঁকা, যুদ্ধসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছি (যেগুলো মানব সভ্যতার যে কোন সংস্কৃতিতেই খুঁজে পাওয়া যাবে ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে), সেরকম অন্ততঃ ৪০০টি বৈশিষ্ট্য স্টিভেন পিঙ্কার লিপিবদ্ধ করেছেন তার ব্ল্যাঙ্ক স্লেট বইয়ের পরিশিষ্টে[9]।  হ্যা তার মধ্যে কান্না বা ক্রায়িং ব্যাপারটিও তালিকায় আছে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন এগুলো সবগুলোই অভিন্ন মানব প্রকৃতির দিকেই ইঙ্গিত করে। লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাতোশি কানাজাওয়া তার ‘ There is only one human culture ‘ প্রবন্ধে সেজন্যই বলেন[10],

বাহ্যিকভাবে যত পার্থক্যই আমরা দেখি না কেন, আসলে আমরা মানুষেরা এক অভিন্ন সংস্কৃতির অংশ।কারণ, আমাদের দেহ কাঠামোর মতো সংস্কৃতিও মোটা দাগে মানব বিবর্তনের অভিযোজনগত ফসল।ঠিক যেমন আমাদের হাত পা কিংবা অগ্ন্যাশয় তৈরি হয়েছে বংশানু বা জিনের নিয়ন্ত্রণে, ঠিক তেমনি মানব সংস্কৃতিও তৈরি হয়েছে বংশানুর দ্বারাই (বংশানুর দ্বারা বলা হচ্ছে কারণ, দীর্ঘকালের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়াতেই তৈরি হয়েছে মানব বংশানু যা আবার মস্তিস্কের গঠনের অবিচ্ছেদ্য নিয়ামক, আর সংস্কৃতি হচ্ছে সেই মানব মস্তিস্কেরই সম্মিলিত অভিব্যক্তি)।

বাঘের যেমন নখর বিশিষ্ট থাবা আছে, ক্যাঙ্গারুর পেটে আছে থলি, ঠিক তেমনি মেরুভল্লুকের গায়ে আছে পুরু পশম। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন স্ব স্ব প্রজাতির ক্ষেত্রে অনন্য বৈশিষ্টের দিকে নির্দেশ করে; ঠিক তেমনি মানব সমাজের জন্য অনন্য বৈশিষ্টের নিয়ামক হয়ে আছে মানব সংস্কৃতি। বাঘে বাঘে নখরের আকার আকৃতিতে পার্থক্য থাকলেও সেটা যেমন শেষ পর্যন্ত বাঘের নখরই, ঠিক তেমনি সংস্কৃতিতে কিছু বাহ্যিক ছোটখাট ভেদাভেদ থাকলেও সেটা শেষ পর্যন্ত অভিন্ন মানব সংস্কৃতিই। হ্যা,শতধা বিভক্তি সত্ত্বেও মানব কালচারগুলো আসলে সম্মিলিতভাবে সার্বজনীন সংস্কৃতি বা কালচারাল ইনিভার্সাল (Cultural Universal)কেই উর্ধ্বে তুলে ধরে, অন্ততঃ বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের তাই অভিমত।

——————————————————————————–
তথ্যসূত্র

[1] মুক্তান্বেষার প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যায় মার্গারেট মীডকে নিয়ে ফরিদ আহমেদের একটি চমৎকার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে মার্গারেট মিড : নৃতত্ত্বের রাণী’ শিরোনামে।

[2] Derek Freeman, Margaret Mead and Samoa: The Making and Unmaking of an Anthropological Myth, Penguin, 1983.

[3] Derek Freeman, The Fateful Hoaxing of Margaret Mead: A Historical Analysis of her Samoan Research Basic Books, 1999

[4] ম্যাট রিডলীর মূল উক্তিটি ছিলো – ‘Her failure to discover the cultural determinism of human nature is like the dog that failed to bark’।

[5] John Nance, The gentle Tasaday: A Stone Age people in the Philippine rain forest, Harcourt Brace Jovanovich, 1975

[6] The Gentle Tasaday Are Merely a Persistent Hoax, The Newyork Times, January 9, 1988.

[7] Donald Brown, Human Universals, McGraw-Hill Humanities/Social Sciences/Languages, 1991

[8] Pierre van den Berghe, a pioneer sociobiologist at the University of Washington, puts it best when he says,

Certainly we are unique, but we are not unique in being unique. Every species is unique and evolved its uniqueness in adaptation to its environment. Culture is the uniquely human way of adapting, but culture too evolved biologically.

[9] Steven Pinker, The Blank Slate: The Modern Denial of Human Nature, Viking, 2002, p 435-9, appendix

[10] Satoshi Kanazawa, There is only one human culture: All cultures are more or less the same, http://www.psychologytoday.com/blog/the-scientific-fundamentalist/200805/there-is-only-one-human-culture