ছেলেটার দিকে তাকান। বয়স? ১০? ১২?

নাম? ক মুর্মু বা খ মুর্মু। যারা ঝাড়্গ্রাম বা মেদিনীপুরের আদিবাসী এলাকা ঘুরেছেন-তাদের কাছে এই মুখ কি খুব অচেনা?

ছেলেটা যৌথবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। সংঘর্ষে মারা গেছে ওর ৮ বন্ধু-তিন জন তরুণী, পাঁচ জন তরুন। তাদের মুখ কি এদের থেকে আলাদা? না বোধ হয়?

এবার আসুন সিভিল-মানে ভদ্র সমাজের দিকে আমরা টেলিস্কোপ ফেলি। কি দেখবেন? একদল বলবে ব্যাটারা পিঁপড়ের মতন জওয়ানদের মারছিল, সিপিএম করার অপরাধে দিন মজুর মারছিল, আর ওদের মারলেই মানবতাবাদিরা , ইয়ে আমাদের অরুন্ধুতিদি ট্যাঁফো করে কেন?

আরেকদল বলবে, বর্বর রাষ্ট্র। এই কিশোর কিশোরীদের এই ভাবে অভিমন্যুর চক্রবুহ্যে বেঁধে হত্যা করল। এরা কেন মাওবাদি হল দেখতে হবে না? যদি ওরা মানুষের সন্মানে বেঁচে থাকতে পারত-ওরা কি মাওবাদি হত? যদি ওদের জমি, কর্পরেট দখল করে না নিত-ওরা কি বন্দুক তুলে নিত? গণতন্ত্র ওদের কোন সমাধান দেয় নি। তাই ওরা বন্দুক তুলে নিয়েছে।

সরকার যে ওদের জন্যে কিছু বরাদ্দ করে নি তা না। যথেষ্টই করেছে। অন্যদের থেকে যে কম করেছে তাও না। কিন্ত সেই টাকা গেছে অনুজ পান্ডের অট্টালিকা বানাতে। ঘাবরাবেন না-আমাদের যাদের গ্রামে গঞ্জে ঘোরা অভ্যেস আছে-তাতে আজকাল গ্রামে গ্রামে অট্টালিকা চোখে পড়ে-এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে বাড়ির মালিক পার্টির এই বা ওই। আমি শুধু সিপিএমকে দোষ দিচ্ছি না। টাকা মারার ব্যাপারে সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি ভাই ভাই। কোন পার্থক্য নাই। মোদ্দা কথা খেলাটা ভদ্রলোকেদের-যা্রা তথাকথিত শিক্ষিত-রবীন্দ্রিক বাঙালী এবং আরো অনেক কিছু-তারাই আদিবাসিদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছেন। ওরা ছোটলোকেদের জাত ত! বেঁচে থাকতে সবার জন্যে অত ভাবলে কি ভাবে হবে? আমি বেশ ভালো আছি-আমার বাথরুমে জয়পুরের মার্বেল পাথর লাগছে। ছেলেটাকে প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতায় ঢুকিয়ে দিয়েছি। ঠিকেদারদের কাছ থেকে যা আসে উপরি ইনকাম-তাতে বছরে দুবার এদিক ওদিক ঘুরে আসি। অতসত ভেবে কি হবে ওই টাকাটা আদিবাসিরা পেল কি না পেল? ওরা সাপ খেয়েই ভাল আছে। আজকাল সবার দুপয়সা হচ্ছে-আমাদের বাড়ীটা একটু আধুনিক না হলে কি করে সভ্য বাঙালী সমাজে প্রেস্টিজ থাকে বলুন ত?

বন্দুক তোলা অবশ্যই কোন সমাধান না। মাওবাদের স্বরণ নেওয়া আরো ভুল-কারন এই কমিনিউস্টরাই যেভাবে আদিবাসি সংস্কৃতি এবং আদিবাসিদের তাদের বাসভূমি থেকে তাড়িয়েছে মধ্য এশিয়া ও চীনে-তার তুলনা গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। কিন্ত আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত সভ্য বাঙালী বলে মনে করি, তারাই কি কোনদিন আদিবাসি দের প্রতি বঞ্চনা নিয়ে সরব হয়েছি? বরং তার বদলে কি করে সিপিএমের দুঃপয়সা অনুগ্রহ পেয়ে বুদ্ধিজীবি হওয়া যায় বা দুটো সুবিধা করে নেওয়া যায় ( লোকসভা নির্বাচনের পরে, সেই তালিকায় এখন তৃনমূল ও এসেছে) -আর না হলে বিদেশে ভাল চাকরির লোভে দেশের সমস্যাগুলোকে মায়া করে দিয়েছি। গ্রামের গঞ্জে এই অট্টালিকাগুলো ত একদিনে হয় নি-আর দুবিগত পাশে বস্তির সমাহার ও আজকের দৃশ্য না। কোথায় ছিলাম আমরা তখন? বড়জোর মনে রাগপুশে আবার সেই পার্টি অফিসের পাশেই ঘুর ঘুর করেছি! আর আজ যখন, মাওবাদি সমস্যা দগদগে ঘায়ের মতন ভারতের গায়ে ফুটে উঠছে-আমরা দরদী গান বা মিলিটারি হুমকি ছারছি!

এই ছবিটা দেখে গুরুদেবের দুই ছত্র মনে এলঃ

পথে-চলা এই দেখাশোনা ছিল যাহা ক্ষণচর চেতনার প্রত্যন্ত প্রদেশে , চিত্তে আজ তাই জেগে ওঠে ; এই-সব উপেক্ষিত ছবি জীবনের সর্বশেষ বিচ্ছেদবেদনা দূরের ঘণ্টার রবে এনে দেয় মনে ।