ambedkar3742858_std
(পূর্ব-প্রকাশিতের পর…)

অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ পর্ব:[০১] [০২] [০৩] [০৪] [০৫] [০৬] [০৭] [*]

রাজনৈতিক ব্যাপ্তি
১৯৩৬ সালে ড. আম্বেদকর ‘ইনডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে এই পার্টি কেন্দ্রীয় আইন সভায় ১৫ টি আসন লাভ করে। এ সময় আম্বেদকর The Annihilation of Caste নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এ বইয়ে হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথা ও সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের তীব্র সমালোচনা করেন। এতে তিনি অস্পৃশ্য সম্প্রদায়কে গান্ধী কর্তৃক ‘হরিজন’ (ঈশ্বরের সন্তান) নামে অভিহিত করার কংগ্রেসীয় সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেন।

১৯৩৯ সালের প্রথম দিকে ভাইসরয় তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেন। এই পদ্ধতিতে রাজ্যের প্রতিনিধিরা যোগদান করবে, কিন্তু রাজ্যে কোন দায়িত্বশীল সরকার থাকবে না। মনোনয়নের ভিত্তিতে প্রতিনিধি করা হবে। এই প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেন কংগ্রেস সভাপতি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মুসলিম লীগ এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টির পক্ষে ড. আম্বেদকর। হিন্দু মহাসভা এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের এই প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা সমালোচনা চলতে লাগলো।
এ সময় কংগ্রেসের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও গান্ধিজীর সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রে সুভাষ চন্দ্র বসু সভাপতির পদ ও কংগ্রেস ত্যাগ করেন। ইতোমধ্যে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভাইসরয় ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত রাখেন।

তৎকালীন ভারতীয় ভাইসরয় লর্ড লিন লিথগো অক্টোবর মাসে ভারতীয় নেতৃবর্গের সাথে সাক্ষাতে মিলিত হন। এদের মধ্যে গান্ধিজী, নেহরু, ড. আম্বেদকর, জিন্নাহ, সাভারকর, বল্লভ ভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, সুভাস বসু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সাক্ষাতে ড. আম্বেদকর বলেন-

পুনা চুক্তির ফলাফলে তারা খুবই ক্ষুব্ধ এবং ভবিষ্যতে ভারতীয় সংবিধান সংক্রান্ত আলোচনা হলে তাদের আরো বক্তব্য আছে।

কিছুদিন পর ভাইসরয়ের বিবৃতি প্রকাশিত হলে কংগ্রেস অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে এবং সমস্ত প্রদেশ থেকে তাদের মন্ত্রীসভা প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা জানিয়ে দেয়। এ ঘটনার পর ড. আম্বেদকর বিবৃতি দিলেন যে,

গান্ধিজীর একনায়কত্বের মনোভাবই ভারতে সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।

১৯৩৯ সালের নভেম্বরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা সমূহকে পদত্যাগের নির্দেশ দেয়। এ দিনটিকে জিন্নাহ সাহেব ‘মুক্তি দিবস’ হিসেবে পালন করে। ১৯৪০ সালে মার্চ মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে মুসলিম লীগ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেয়। এপ্রিল মাসে রামগড়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সম্মেলনে ভারত বিভাগকে কোনক্রমেই বরদাস্ত করা হবে না বলে ঘোষণা করে। হিন্দু-মুসলমানের দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগের এ প্রস্তাবকে ঘিরে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে মতদ্বৈধতা বাড়তে লাগলো। ১৯৪০ সালে ড. আম্বেদকরের Thoughts on Pakistan বইটি প্রকাশিত হলে ভারতীয় রাজনীতিতে বইটির প্রতিপাদ্য বিষয়কে কেন্দ্র করে মারাত্মক ঝড়ো হাওয়ার সৃষ্টি হয়। এ গ্রন্থের সারকথা হলো,

সম্পূর্ণ লোক বিনিময় পূর্বক মুসলমানদের দাবীর প্রেক্ষিতে তাদের জন্য পাকিস্তান সৃষ্টিই ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যার একমাত্র বাস্তব ও স্থায়ী সমাধান। দুটি ভিন্ন শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানসিকতা সম্পন্ন জাতিকে নিয়ে একটি দেশ গড়ে উঠতে পারে না। যে হিন্দুরা নিজেদের একটি অংশকে হাজার হাজার বছরব্যাপী ঘৃণিত ও বঞ্চিত করে রেখেছে তাদের কাছে কোন্ ভরসায় মুসলমানরা উদারতা ও সমমর্যাদা আশা করবে ?

আম্বেদকরের প্রস্তাবে জিন্নাহ সাহেব ঐকমত্য পোষণ করেন। কিন্তু গান্ধিজীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস লোক বিনিময়ের এ প্রস্তাবকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়।

রাজনৈতিক অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আম্বেদকর গণভোট সংক্রান্ত একটি ফর্মূলা সরকারের কাছে পেশ করেন। মুসলমান প্রধান অঞ্চলে দু’টি গণভোটের ব্যবস্থা করাই এই ফর্মূলার বিষয়। প্রথম গণভোটে মুসলমানরা ঠিক করবে তারা পাকিস্তান চায় কিনা। যদি মুসলিমরা পাকিস্তান চায় তবে প্রস্তাবিত পাকিস্তানে অমুসলিমদের গণভোট হবে যে তারা পাকিস্তানে থাকতে চায় কিনা। যদি না চায় তাহলে উক্ত প্রদেশ চায় কিনা। যদি না চায় তাহলে উক্ত প্রদেশ সমূহে সীমানা কমিশন গঠন করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাসমূহ নির্ধারণ করা হবে এবং মুসলমানরা রাজী থাকলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাসমূহ নিয়ে পাকিস্তান করা যেতে পারে। পরবর্তীকালে পশ্চিম বঙ্গ ও পূর্ব পাঞ্জাব ভারতভুক্তিও ড. আম্বেদকরের উক্ত ফর্মূলার বাস্তবায়ন।

যদিও ১৯৪৫ সালে Thoughts on Pakistan এর দ্বিতীয় সংস্করণ Pakistan or Partition of India গ্রন্থে কিছু নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয়। সংযোজিত নতুন অধ্যায়ে বলা হয়-

পৃথিবীতে এমন কিছু কিছু দেশ আছে যেখানে একাধিক জাতি একই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বসবাস করছে। উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি। সুতরাং পাকিস্তান সৃষ্টি না করেও মুসলমানরা একটা আলাদা জাতি হিসেবে স্বাধীন ভারতে সম্পূর্ণ পৃথক সত্তা নিয়ে বসবাস করতে পারবে। সংবিধান রচনাকালে তাদের পৃথক সত্তা সম্পর্কে সংবিধানসম্মত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

কিন্তু এ প্রস্তাব আর তৎকালীন নেতৃবৃন্দের কাছে গৃহীত হয়নি।

১৯৪১ সালের জুলাইয়ে ভাইসরয় কয়েকজন ভারতীয়কে নিয়ে একটি প্রতিরক্ষা পরামর্শদাতা কমিটি এবং এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিরক্ষা পরামর্শদাতা কমিটিতে ড. আম্বেদকরকে অন্তর্ভুক্ত করলেও এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে নির্যাতিত শ্রেণীর ও শিখদের মধ্য থেকে কোন প্রতিনিধি না নেওয়ায় আম্বেদকর ব্রিটিশ সরকারের কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দির শেষ ভাগ পর্যন্ত নির্যাতিত শ্রেণীর যুবকদের নিয়ে গঠিত ‘মাহার ব্যাটেলিয়ান’ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে কাজ করে আসলেও বর্ণহিন্দুদের প্ররোচনায় অস্পৃশ্যতার ধূয়া তুলে ১৮৯২ সালে ইংরেজ সরকারের এক আদেশ বলে অস্পৃশ্যদের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ বন্ধ করে দেয়া হয। ড. আম্বেদকরের আপ্রাণ চেষ্টায় বৃটিশ সেনাবাহিনীতে পুনরায় মাহারদের (অস্পৃশ্য) নিয়োগদান চালু করা হয়।

১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্টাফোর্ড ক্রিপস ভারতের রাজনৈতিক অচলবস্থা নিরসনকল্পে ভারতে আসেন। ৩০ মার্চে এক সাক্ষাতকারে ক্রিপস ড. আম্বেদকরকে ইনডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টির নেতা, না নির্যাতিত শ্রেণীর নেতা হিসেবে তাঁর সাথে আলোচনা করছেন এই প্রশ্ন করলে আম্বেদকরকে সমস্যায় ফেলে দেন। সেদিনই তিনি তার অনুগামী ও অফসিলী নেতাদের নিয়ে দিল্লীতে এক বৈঠকে বসলেন। সারা ভারতে তফসিলীদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার উপর গুরুত্বারোপ করা হয় এবং ১৮ ও ১৯ জুলাই সারা ভারত তফসিলী সম্মেলনের দিন ধার্য করা হয়।

২রা জুলাই ভাইসরয় তার এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে আরো ৫ জন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করলে নির্যাতিত শ্রেণীর পক্ষে এই প্রথম ড. আম্বেদকর ভারত সরকারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে আসীন হন।

১৮ ও ১৯ জুলাই পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী নাগপুরে আয়োজিত সারাভারত তফসিলী সম্মেলনে ৭০ হাজারের অধিক তফসিলী প্রতিনিধির সামনে আম্বেদকর তাঁর ভাষণে বলেন, তফসিলীরা হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত হলেও জাতীয় ও রাজনৈতিক জীবনে তাদের একটা পৃথক সত্তা আছে যা হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থেও স্বীকৃত। গান্ধিজীর মতো বর্ণহিন্দু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠিরা তফসিলীদের পৃথক সত্তাকে অস্বীকার করে আত্মসাৎ করার চক্রান্তে লিপ্ত। তফসিলীদের পৃথক জাতিসত্তার ভিত্তিতে এই সম্মেলনে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন All India scheduled castes Federation গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।

১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে ‘ভারত ছাড়’ ধ্বনি তুলে কংগ্রেস ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের ডাক দেয় এবং পরে দেশবাসীর মনোযোগ আকর্ষণের উদ্দেশ্যে গান্ধিজী পুনার আগা খাঁ প্রাসাদে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ দিনের অনশন শুরু করেন। ড. আম্বেদকর তখন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত থাকায় তার উপর কংগ্রেসী নেতাদের প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। এতে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে শ্রমিকদের জীবনের মানোন্নয়নের কথা চিন্তা করে কতকগুলো কমিশন গঠন করে কিছু উদ্যোগ নিতে থাকেন।

১৯৪৫ সালের জুন মাসে আম্বেদকরের What Congress and Gandhi have done to the untouchables? নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হলে তা ভারতীয় রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। এ বছর জুলাই মাসে ইংল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে টোরীদের ভরাডুবি হলে লেবার পার্টি ক্ষমতাসীন হয়। ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল ১৯৪৬ সালে ভারতেও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করেন। এর পর পরই ভারতের রাজনৈতিক আবহাওয়া উত্তপ্ত হতে লাগলো। নির্বাচনে কুখ্যাত পুনাচুক্তির কুফল তফসিলীরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেলো। আম্বেদকরের তফসিলী ফেডারেশন কংগ্রেসের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হলো।

এর আগ পর্যন্ত ড. আম্বেদকর ৪ বৎসর শ্রমমন্ত্রী থাকাকালীন নারী, শিশু শ্রমিকসহ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র শ্রমিক সমাজের কল্যাণে কিছু অধিকার বাস্তবায়ন করে গেছেন-

১) শ্রমিকদের বিষয়ে যে কোন আলোচনায় আগে শুধু সরকার পক্ষ এবং মালিকপক্ষ বসতেন। ড. আম্বেদকর শ্রমমন্ত্রী থাকাকালীন ঘোষণা করলেন শ্রমিক সম্পর্কিত যে কোন আলোচনায় শ্রমিক প্রতিনিধিও যোগদান করতে পারবেন। এই পদ্ধতির নাম ‘ত্রি-পাক্ষিক’ শ্রম আলোচনা।
২) আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের ন্যায় ভারতেও ‘Joint Labour Management Committee’ বা যৌথ শ্রম পরিচালনা কমিটি গঠন করেন।
৩) বিভিন্ন অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানায় প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক সমিতিকে অধিকার দানের উদ্দেশ্যে ‘Trade Union’ এর স্বীকৃতি দানের আইন পাশ করেন।
৪) শ্রমিকদের কাজের সময় ১০ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টা ধার্য করা হয় এবং ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করলে ‘Over time salary’ প্রদানের আইন পাশ করা হয়।
৫) শ্রমিকদের বেতন, বাসস্থান, খাদ্য, শিক্ষা, পোশাক আশাক ও প্রশিক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে খোঁজ খবর রাখার জন্য ‘শ্রম অনুসন্ধান সমিতি’ গঠন পূর্বক তাদের উন্নয়নের অনেকগুলো আইন পাশ করা হয়।
৬) ‘কারখানা সংশোধনী বিল’ পাশের মাধ্যমে শিল্প ও কারখানা শ্রমিকদের সবেতন ছুটির ব্যবস্থা চালু করেন। এতে প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিক কর্মচারীরা বছরে ১০ দিন এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিক কর্মচারীরা বছরে ১৪ দিন সবেতন ছুটি ভোগ করতে পারবেন। এর আগে সাপ্তাহিক ছুট ছাড়া অন্যান্য দিন ছুটি ভোগ করলে মালিক কর্তৃক বেতন কর্তন করে নেয় হতো।
৭) নারী শ্রমিক কর্মচারীদের সাথে পুরুষ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন বৈষম্যের বিলোপ সাধন। এই কাজের জন্য নারী পুরুষ সমহারে বেতন পাবেন।
৮) কয়লা শ্রমিকদের আর্থিক উন্নয়নকল্পে ‘কয়লা খনি শ্রমিক উন্নয়ন তহবিল’ গঠনের আইন পাশ।
৯) প্রসবকালীন ‘Maternity Leave’ ছুটির আইন বিধিবদ্ধ করেন।

সংবিধানের স্থপতি ড. আম্বেদকর
১৯৪৭ সালের ১৫ জুলাই বৃটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক ‘স্বাধীন ভারত’ হিসেবে আইন পাশ করা হলে গণপরিষদ সার্বভৌম ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। দেশ বিভাজনের ফলে গণপরিষদও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। ড. আম্বেদকর পূর্ব পাকিস্তানের ভোটার কর্তৃক জয়লাভ করে গণ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে দেশ বিভাজনের ফলে তার সদস্যপদও খারিজ হয়ে যায়। এ সময় ড. এম.আর জয়াকর গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ করায় ড. আম্বেদকর কংগ্রেসের সমর্থনে পুনরায় মহারাষ্ট্র থেকে গণ পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁকে কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত করা হয়।

এদিকে ভারতের জাতীয় পতাকা তৈরির দায়িত্ব ড. আম্বেদকরের উপর ন্যস্ত হবার সুযোগে তিনি রাজর্ষি সম্রাট অশোকের রাজকীয় স্মারক ‘অশোক চক্র’ জাতীয় পতাকায় অন্তর্ভুক্ত করেন।

২৯ আগস্ট গণপরিষদ কর্তৃক সর্বশ্রী কৃষ্ণস্বামী আয়ার, এন ধাবরাও, স্যার বি.এন.রাও, যুগল কিশোর খান্না, সৈয়দ সাদুল্লা, এস.এন.মুখার্জী ও কেবলকৃষ্ণকে সদস্য এবং ড. আম্বেদকরকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে একটি খসড়া সংবিধান কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি খসড়া সংবিধান সম্পূর্ণ করে গণপরিষদের সভাপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের কাছে হস্তান্তর করেন। অতঃপর সংবিধানটি জনমত যাচাইয়ের জন্য ৬ মাস সময় নেয়ার পর ১৯৪৮ সালের ৪ঠা নভেম্বর ড. আম্বেদকর খসড়া সংবিধানটি গণপরিষদে পেশ করেন।

এই সংবিধান রচনা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নীতিবিরোধী কিছু কিছু ধারা পার্টির হাই কমান্ডের চাপের মুখে সংযোজন করতে হয়েছে। বিশেষ করে কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতাদের পরামর্শও শুনতে হয়েছে। ফলে অনেক সময় নিজেদের অভিরুচি ও স্বাধীন বিবেচনা মাফিক কাজ করতে পারেননি বলে সংবিধান কমিটির সদস্য এম.সাদুল্লা ও অনেকেই স্বীকার করেন। তবু এই সংবিধান ভারতের সকল শ্রেণীর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে তৈরির জন্য যত বেশি সম্ভব চেষ্টা করা হয়েছে।

১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক খসড়া সংবিধানকে স্বাধীন ভারতের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করে সভাপতির ভাষণে ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ ড. আম্বেদকরকে খসড়া সংবিধান কমিটির সদস্য ও চেয়ারম্যান নির্বাচন করাকে একটি নির্ভুল সিদ্ধান্ত বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন-

‘আমি সভাপতি হিসেবে বলতে চাই, আমরা ভারতের সবচেয়ে যোগ্যতম ব্যক্তির হাতেই আমাদের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার ভার অর্পন করেছিলাম।’

দ্বিতীয় বিয়ে
১৯৩৫ সালে স্ত্রী রমাবাঈয়ের মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল তিনি নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন আম্বেদকর। ফলে বেশি করে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেকে সচেষ্ট করতে গিয়ে সীমার অতিরিক্ত যে শারীরিক ও মানসিক চাপে পড়েছেন, প্রাকৃতিক নিয়মেই তা তাঁর শরীর মন বইতে পারছিলো না। ফলে একসময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বোম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে গিয়ে নিয়মিত চিকিৎসা করাতে হতো তাঁকে। কিন্তু হাসপাতালে পড়ে থাকার ব্যক্তিও তিনি নন। আর এ অনিয়মের কারণে বারবারই তাঁকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যেতেই হয়। সে হাসপাতালের ডাঃ শ্রীমতি সারদা কবির চিকিৎসা করতেন। তিনি ড. আম্বেদকরের চিকিৎসা ও সেবা সুশ্রূষার প্রতি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। এভাবে দীর্ঘ চিকিৎসা জীবনে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে গড়ে ওঠা সখ্যতা একটু একটু করে হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে মোড় নেয়।

রমাবাঈয়ের মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় কোন রমণীর দারপরিগ্রহ না করার সংকল্পবদ্ধ হয়ে দীর্ঘ নিঃসঙ্গ জীবন অতিবাহিত করলেও ক্রমবর্ধমান শারীরিক ও মানসিক চাপ এবং জীবন-যাপনে বিশ্রামহীন অনিয়ম ও নৈকট্যসঙ্গের অভাবে যখন দৈহিক অবস্থা দ্রুত ভেঙে পড়ছিলো, সেই সময় ডাঃ সারদার সাহচর্যে সেই অভাব অনেকটা লাঘব হতে চলছিলো। ব্যক্তি জীবনে এরকম একজন দরদী ও সহানুভূতিশীল সঙ্গির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়লো। অবশেষে ১৯৪৮ সালের ১৫ এপ্রিল ৫৭ বছর বয়সে নয়াদিল্লীর ১নং হার্ডিঞ্জ এভিনিউস্থ স্বীয় বাসভবনে ড. আম্বেদকর ও ডাঃ শ্রীমতি সারদা কবির রেজিস্ট্রির মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। শেষপর্যন্ত সারদা কবির নিঃসন্তান ছিলেন। আম্বেদকরের এই বিয়ের সিদ্ধান্তে সর্বত্র অনেক বিতর্কের ঝড় বয়ে গেলো।

হিন্দু কোড বিল ও মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ
হিন্দু আইনের সংস্কারের নিমিত্তে ১৯৪১ সালের দিকে গঠনকৃত একটি কমিটি ‘হিন্দু কোড বিল’ নামে একটি খসড়া বিল তৈরি করে। ‘হিন্দু কোড বিল’ মূলত হিন্দু নারী সমাজের কল্যাণের উদ্দেশ্যে প্রচলিত ধর্মীয় বিধানের সংস্কার। ১৯৪৭ সালে ড. আম্বেদকর কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন সময়ে হিন্দু কোড বিল তাঁর হস্তগত হলে তিনি এই বিলকে আরো ঢেলে সাজালেন। বিশেষ করে যৌথ পরিবারের ক্ষতিকর প্রভাব, মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার ও বিবাহ বিচ্ছেদ প্রভৃতি বিষয়ে তিনি নতুনত্ব আনতে চাইলেন। এতে হিন্দু গোঁড়াপন্থীরা তাঁর উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন এবং প্রগতিবাদীরা তাঁকে স্বাগত জানালেন।

১৯৫১ সালের গোড়ার দিকে পার্লামেন্টের অধিবেশন বসার পূর্ব পর্যন্ত ‘হিন্দু কোড বিল’ নিয়ে তীব্র সমালোচনার ঝড় বইতে লাগলো। পার্লামেন্টে হিন্দু কোড বিল পাশ না হলে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাঁর পদ থেকে পদত্যাগ করবেন বলেও ঘোষণা দেন। অন্যদিকে সরদার প্যাটেল ও ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ বিলটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৯৫১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ড. আম্বেদকর বিলটি পার্লামেন্টে পেশ করলেন। তিন দিন পর্যন্ত এই বিলটির উপর প্রচণ্ড বিতর্ক চলার পর অবশেষে বিলটি মূলতবী রাখা হয়।

এপ্রিল মাসে দিল্লীতে আম্বেদকর ভবনের ভিত্তি প্রস্তর অনুষ্ঠানে ড. আম্বেদকর তফসিলীদের প্রতি সরকারের বিরূপ মনোভাবের অভিযোগ তুলে বক্তব্য রাখলে মন্ত্রী সভায় তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু আম্বেদকরকে তাঁর অসন্তোষের কথা জ্ঞাপন করেন এবং মন্ত্রী সভা পুনর্গঠনের নিমিত্তে পদত্যাগ করার কথাও ব্যক্ত করেন। এ পরিস্থিতিতে আম্বেদকর তাঁর অনুগামীদের সাথে আলোচনার জন্য বোম্বাই যান এবং তাদের সাথে আলোচনা করে পার্লামেন্টের পরবর্তী অধিবেশনে ‘হিন্দু কোড বিল’ পাশ না পর্যন্ত পদত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত হয়।

কংগ্রেসের পার্লামেন্টারি বোর্ডেও অধিকাংশ সদস্য বিলটির বিরোধিতা করলে নেহেরু বাধ্য হয়ে বিলটি সম্পর্কে পার্লামেন্টে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অনুমতি দিতে হলো। শেষ পর্যন্ত বিলটি দু অংশে বিভক্ত করে এক অংশকে বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ বিধি নামে পার্লামেন্টে পেশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ড. আম্বেদকর এতে সম্মতি দিলেন, তবে এই অংশের আলোচনার জন্য ১৭ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টে উত্থাপন করা হলে অনেকেই বিলটির তীব্র বিরোধিতা করেন। পার্লামেন্টের ভিতরে বাইরে এত তীব্র অসন্তোষের কারণে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ড. আম্বেদকরকে বিলটি তুলে নেয়ার জন্য অনুরোধ জানালে বিলটি আর পাশ করানো সম্ভব হলো না। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ড. আম্বেদকর এ ঘটনায় খুবই আঘাত পেলেন এবং ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পদত্যাগের কথা জানিয়ে দেন। কয়েকটি সরকারি বিলে তাঁর বক্তব্য রাখার বিষয় পূর্ব নির্ধারিত থাকায় তিনি সৌজন্যের খাতিরে সে বিলগুলোর উপর আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারকে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন।

১৯৫১ সালের ১১ অক্টোবর পার্লামেন্টে বক্তব্য পেশ করতে এলে লোকসভার ডেপুটি স্পীকার আম্বেদকরের বক্তব্যের একটি কপি তাঁর কাছে জমা দিতে বলায় আত্মসম্মানে প্রচণ্ড ঘা লাগে এবং বক্তব্য না রেখেই তিনি লোকসভা ত্যাগ করে চলে যান। পরের দিন সংবাদ পত্রে ৫টি বিশেষ কারণ উল্লেখপূর্বক তাঁর পদত্যাগের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়।

ধর্মান্তর পর্ব
ড. আম্বেদকর অস্পৃশ্যদের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে দীর্ঘকাল ধরে ব্যাপক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারলেন যে, ব্রাহ্মণ্যবাদী গোষ্ঠি অস্পৃশ্য জনগণকে একদিকে যেমন হিন্দু ধর্মীয় অধিকার দিতে নারাজ অন্যদিকে তাদেরকে হিন্দু বলে স্বীকৃত দিতেও অনিচ্ছুক। তাই ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠিত ইয়োলা সম্মেলনে অস্পৃশ্যদের সামাজিক মর্যাদা আদায়ের ব্যাপারে সর্বসম্মতিক্রমে কংগ্রেস তথা বর্ণবাদী হিন্দু সংগঠনগুলোর কাছে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করা হয়েছিলো এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত না হলে হিন্দু ধর্ম ত্যাগের হুমকিও দিয়েছিলেন। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৩৬ সালে ১৯ এপ্রিল এক সভায় ‘হিন্দু ধর্ম ত্যাগ কমিটি’ও গঠিত হয়েছিলো। এরপর সামাজিক রাজনৈতিক বহু ডামাডোলের মধ্য দিয়ে আরো অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও হিন্দু ধর্ম তাঁর কূপমণ্ডুকতা থেকে বের হতে তো পারেই নি, অস্পৃশ্যদের ব্যাপারেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গির এতটুকু উন্নতি হয়নি। এ নিয়ে হিন্দু সমাজের ধর্মগ্রন্থ ও অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে তীব্র সমালোচনামূলক প্রচুর লেখালেখিও করে গেছেন তিনি। কিন্তু এতেও তাদের একটুও উন্নতি হয়নি এবং হবার সম্ভাবনাও দেখা গেলো না। আম্বেদকর তাই এতকাল ভেতরে লালন করে রাখা বৌদ্ধদর্শনের মানবিক সমৃদ্ধির বিষয়গুলো সামনে তুলে ধরতে লাগলেন। তা যে বহুকাল ধরে তিনি ভেতরে লালন করে আসছেন, তাঁর কর্মকাণ্ডে তা তাঁকে এক অভূতপূর্ব মানবিক শক্তি যুগিয়ে গেছে, তাঁর বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ড. আম্বেদকরের ‘আমার জীবন দর্শন’ নামক এক বক্তৃতা প্রচারিত হয়। সেখানে তিনি বলেন-

‘তিনটি শব্দের মধ্যে আমার জীবন দর্শন খুঁজে পাই। স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। যদিও আমরা ভারতীয় সংবিধানে রাজনৈতিক কারণে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতিকে গ্রহণ করেছি বস্তুত আমাদের সমাজ জীবনে এগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই। এগুলো আমি বুদ্ধের বাণী থেকে গ্রহণ করেছি। হিন্দু ধর্মে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের কোন স্থান নেই, তাই বুদ্ধের আদর্শ গ্রহণ করলে ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শ পরস্পরের পরিপূরক হবে।’

সে বছরই ডিসেম্বর মাসে ড. আম্বেদকর সস্ত্রীক তাঁর একান্ত সচিব মিঃএস.ভি সবদকরকে নিয়ে রেঙ্গুনে তৃতীয় বৌদ্ধ সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে তিনি বলেন-

‘…বিশ্ব বৌদ্ধ সংস্থা যদি সহায়তা করে তাহলে আমি বুদ্ধের জন্মস্থান ভারতে বুদ্ধের করুণা ও সাম্যের বাণী প্রচারে আত্মনিয়োগ করবো।’

ভারতীয় জাতীয় পতাকায় অশোক চক্র, জাতীয় প্রতীক হিসেবে অশোক স্তম্ভের প্রতিষ্ঠা এবং তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বৈশাখী পূর্ণিমা দিবসকে সর্বভারতে সাধারণ ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা থেকেই বুঝা যায় যে, অনেক আগে থেকেই তিনি বুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করে নিয়েছিলেন। রেঙ্গুন থেকে প্রত্যাবর্তনের অল্পদিন পরেই লুনার নিকটবর্তী দেহু রোডে তিনি এক বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করেন এবং সেখানে রেঙ্গুন থেকে আনীত একটি বৌদ্ধ মূর্তি প্রতিস্থাপন করেন। মন্দির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ২০ হাজার জনতার উপস্থিতিতে তিনি জানিয়ে দেন অচিরেই তিনি তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বুদ্ধ ও তাঁর বাণী’ প্রকাশ করবেন।

আম্বেদকরের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশ বিদেশের বহু বৌদ্ধ সোসাইটি থেকে অভিনন্দন আসতে লাগলো। এদিকে আম্বেদকরের স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি ঘটতে লাগলো, শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে তাঁকে প্রায়ই অক্সিজেন ব্যবহার করতে হচ্ছে। তার পরও তাঁর কলম থেমে থাকলো না। Revolution and Counter Revolution in India, Buddha or Karl Marx, The Riddless in Hinduism নামে কয়েকটি গ্রন্থ রচনায় প্রচুর ব্যস্ত তিনি। ১৯৫৬ সালের প্রথম দিকেই তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Buddha and his Gospel বা বুদ্ধ ও তাঁর বাণীর কিছু অংশ প্রকাশিত হয়। ২৪ মে বোম্বাইয়ের নারে পার্কে অনুষ্ঠিত বুদ্ধ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে আগামী অক্টোবর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের কথা ঘোষণা করলেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি হিন্দুধর্মের সাথে বৌদ্ধধর্মের পার্থক্য পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেন। সে বছর মে মাসেই বি.বি.সি (ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশান)-এ দেয়া ‘কেন আমি বৌদ্ধধর্ম পছন্দ করি’ শীর্ষক প্রচারিত এক বক্তৃতায় বলেন-

‘আমি তিনটি নীতির জন্য বৌদ্ধধর্ম পছন্দ করি। প্রথমটি হলো প্রজ্ঞা (অলৌকিক ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিসংগত জ্ঞান), দ্বিতীয়টি হলো করুণা (প্রেম অর্থাৎ সমস্ত প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা) এবং তৃতীয়টি হলো সাম্য (সমতা অর্থাৎ সমস্ত মানুষকে সমান মনে করা)।

জুন মাসের দিকে ড. আম্বেদকরের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। ২৩ সেপ্টেম্বর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রচার করা হলো যে, আগামী ১৪ অক্টোবর বিজয়া দশমীর দিনে বেলা ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে প্রাচীন কালের বৌদ্ধ শাস্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত নাগার্জুনের জন্মস্থান নাগপুরে ড. আম্বেদকার বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা পর্ব সম্পন্ন করবেন। দীক্ষাদানের জন্য গোরপুরের কুশীনারাতে অবস্থানরত অশীতিপর বৃদ্ধ বৌদ্ধ ভিক্ষু চন্দ্রমণিকে ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে আমন্ত্রণ জানালেন। কলকাতা মহাবোধি সোসাইটির সম্পাদক ডি. ঊলিসিনহাকেও দীক্ষানুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানালেন। তাছাড়া তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী, অনুগামী যারা তাঁর সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তারাও যেন উক্ত দিবসে পরিচ্ছন্ন শ্বেতবস্ত্র পরিধান করে নাগপুরে উপস্থিত হন সেজন্য তাদের প্রতি আবেদন জানালেন।

দীক্ষা দিবসের তিনদিন পূর্বে আম্বেদকর সস্ত্রীক নাগপুরে চলে গেলেন। তাঁকে ঘিরে লক্ষ লক্ষ মানুষের আগমনে নাগপুর মুখরিত হয়ে ওঠলো। নাগপুরের শ্রদ্ধানন্দ পার্কে ১৪ একর জায়গা নিয়ে তৈরি করা হলো ঐতিহাসিক দীক্ষাভূমি। ১৩ অক্টোবর আহূত এক প্রেস কনফারেন্সে ড. আম্বেদকর জানালেন-

‘আমি যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে যাচ্ছি তা হবে আধুনিক সমাজ জীবনের ভিত্তিতে বৌদ্ধধর্মের এক নবতর রূপ, যার নাম হবে নবযান। আমি বিগত ৩০ বছর ধরে হিন্দুধর্মকে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে তোলার আন্দোলন করে আসছি। কায়েমী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠি হিন্দুধর্মের স্তরে স্তরে অসাম্য বজায় রেখে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির মতলব ত্যাগ না করাতে বাধ্য হয়ে অনুগামীদের নিয়ে আমাকে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করতে হচ্ছে এবং অন্য কোন ধর্মের চেয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলে ভারতীয় সংস্কৃতিই অটুট থাকবে বলে আমি মনে করি।’

১৪ অক্টোবর সকাল ন’টায় শ্বেতবস্ত্রে সুসজ্জিত আম্বেদকর, তাঁর স্ত্রী ও একান্ত সচিব দীক্ষাভূমির ডায়াসে উঠে একান্ত সচিবের কাঁধে হাত রেখে অন্য হাতে তাঁর লাঠিটি উঁচু করে ধরতেই লক্ষ কণ্ঠের আনন্দ ধ্বনিতে সারা নাগপুর শহর প্রকম্পিত হয়ে উঠে। মারাঠি ভাষায় রচিত এক প্রশস্তি সংগীতের মাধ্যমে অন্যুষ্ঠানের সূচনা হয়। ৮৩ বছর বয়স্ক ভিক্ষু চন্দ্রমণি মহাস্থবির তাঁদের দীক্ষাকার্য সম্পন্ন করেন।

স্বয়ং দীক্ষাগ্রহণের পর আম্বেডকর তাঁর প্রায় ৪ লক্ষ অনুগামীকে দীক্ষাপ্রদান করেন। পরের দিন একই দীক্ষাভূমিতে এক লাধিক জনতা দীক্ষা গ্রহণ করেন। ত্রিরত্ন এবং পঞ্চশীল গ্রহণের পর তাঁরা সম্মিলিতভাবে ২২টি শপথ গ্রহণ করেন। এরপর ১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে আম্বেডকর অপর একটি গণদীক্ষার আয়োজন করেন এবং সেখানেও নবদীক্ষিত বৌদ্ধগণকে নিম্নোল্লিখিত ২২টি শপথ প্রদান করেন।

১. আমি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের প্রতি কোন বিশ্বাস রাখব না এবং তাদের উপাসনা করব না।
২. আমি রাম এবং কৃষ্ণ, যারা ঈশ্বরের অবতার রূপে পরিচিত, তাদের প্রতি কোন বিশ্বাস রাখব না এবং তাদের উপাসনা থেকে বিরত থাকব।
৩. আমি গৌরী, গণপতি সহ অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীগণের প্রতি কোন বিশ্বাস রাখব না এবং তাদের আরাধনা করব না।
৪. আমি ঈশ্বরের অবতারে বিশ্বাস করি না।
৫. আমি ভগবান বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে স্বীকার করি না এবং ভবিষ্যতেও করব না। আমি মনে করি এই তত্ত্বটি একটি মিথ্যা প্রচারমাত্র।
৬. আমি শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এবং মৃতের উদ্দেশে পিণ্ডদান করা থেকে বিরত থাকব।
৭. আমি সেই সমস্ত কার্যাবলি থেকে বিরত থাকব যার দ্বারা ভগবান বুদ্ধের শিক্ষার অবমাননা হয়।
৮. আমি ব্রাহ্মণগণকে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে ধর্মীয় ক্রিয়াদি সম্পাদন করতে দেব না।
৯. আমি মানুষের মধ্যে সাম্যে এবং ঐক্যে বিশ্বাস করব।
১০. আমি মানবসমাজে সাম্য এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠার্থে আপ্রাণ প্রয়াস করে যাব।
১১. আমি ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত অষ্টাঙ্গ মার্গ অনুসরণ করে চলব।
১২. আমি ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত দশ পারমিতা মান্য করে চলব।
১৩. আমি জগতের সকল জীবের প্রতি দয়া এবং করুণা প্রদর্শন করব এবং তাদের রক্ষা করব।
১৪. আমি চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করব না।
১৫. আমি মিথ্যা বাক্য উচ্চারণ করব না এবং কখনও মিথ্যাচার করব না।
১৬. আমি ইন্দ্রিয়কাম চরিতার্থ করার জন্য কোন অসাধু কার্যে লিপ্ত হব না।
১৭. আমি মদ্যাদি মাদকদ্রব্য সেবন করব না।
১৮. আমি জীবনে প্রতিনিয়ত অষ্টাঙ্গ মার্গ অনুশীলনের প্রয়াস করব এবং সকলের প্রতি করুণা অভ্যাস করব।
১৯. আমি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করছি কারণ হিন্দুধর্ম মনুষ্যত্বের পক্ষে ক্ষতিকর। হিন্দুধর্ম বর্ণাশ্রমভিত্তিক সমাজব্যবস্থার মাধ্যমে মানবসমাজে বিভেদের প্রাচীর সৃষ্টি করেছে এবং সাম্য প্রতিষ্ঠাকে প্রতিহত করেছে। তাই আমি বৌদ্ধ ধর্মকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমার ধর্ম হিসেবে অবলম্বন করলাম।
২০. আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম।
২১. আমি বিশ্বাস করি যে আমি জন্মান্তরিত হয়েছি।
২২. আমি এতদ্বারা ঘোষণা করছি যে আমি ভবিষ্যতে ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত ধর্ম দর্শন এবং শিক্ষানুসারে জীবনযাপন করব।

১৬ অক্টোবর চান্দাতে বিশাল জনতাকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করে আম্বেদকর দিল্লী অভিমুখে রওনা হন। ধর্মান্তরের কারণে ভারতের কোন নেতৃবর্গ তাঁকে অভিনন্দন না জানালেও বিশ্বের অনেক দেশ ও নেতৃবর্গের কাছ থেকে অভিনন্দিত হন।

এরপর সারা ভারতব্যাপী ধর্মদীক্ষা অনুষ্ঠান পরিচালনা করার এক ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেন তিনি। এদিকে তাঁর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকলে সেই কর্মসূচি পরিচালনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবু ৩০ নভেম্বর নেপালে অনুষ্ঠিতব্য চতুর্থ বিশ্ব বৌদ্ধ সম্মেলনে তিনি সস্ত্রীক গমন করেন। সেখানে বৌদ্ধধর্ম ও কার্ল মার্কসের উপর গবেষণামূলক ভাষণে বৌদ্ধ ধর্মের শ্রেয়তর পথগুলো সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেন। এটাই তাঁর জীবনের শেষ বৌদ্ধধর্ম প্রচার।

বৌদ্ধধর্মের মূলনীতিগুলো হচ্ছে
ক) চতুরার্য সত্য-
১) যথা দুঃখ
২) দুঃখ সমুদয়: দুঃখের কারণ
৩) দুঃখ নিরোধ: দুঃখ নিরোধের সত্য
৪) দুঃখ নিরোধ মার্গ: দুঃখ নিরোধের পথ

খ) অষ্টাঙ্গিক মার্গ- (তিনটি মৌলিক শ্রেণীতে আটটি উপাদান)
প্রজ্ঞা
১) সম্যক ধারণা বা দৃষ্টি
২) সম্যক সংকল্প
শীল
৩) সম্যক বাক্য
৪) সম্যক আচরণ বা কর্ম
৫) সম্যক জীবনধারণ বা জীবিকা
সমাধি
৬) সম্যক চেষ্টা
৬) সম্যক মনন বা স্মৃতি
৭) সম্যক ধ্যান বা সমাধি

গ) ত্রিশরণ মন্ত্র-
আর্যসত্য এবং অষ্টবিধ উপায় অবলম্বনের পূর্বে ত্রিশরণ মন্ত্র গ্রহণ করতে হয়। এই মন্ত্রের তাৎপর্য:
১) বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি – আমি বুদ্ধের শরণ নিলাম। বোধি লাভ জীবনের মূখ্য উদ্দেশ্য। বুদ্ধত্ব মানে পূর্ণ সত্য, পবিত্রতা, চরম আধাত্মিক জ্ঞান।
২) ধম্মং শরণং গচ্ছামি – আমি ধর্মের শরণ নিলাম। যে সাধনা অভ্যাস দ্বারা সত্য লাভ হয়, আধ্যাত্মিকতার পূর্ণ বিকাশ হয় তাই ধর্ম।
৩) সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি – আমি সঙ্ঘের শরণ নিলাম। যেখানে পূর্ণ জ্ঞান লাভের জন্য ধর্মের সাধনা সম্যক্ ভাবে করা যায় তাই সঙ্ঘ।

জীবনাবসান
নেপাল থেকে ফিরে আম্বেদকরের স্বাস্থ্যের আরো অবনতি ঘটলো। কিছুটা সুস্থ বোধ করলে ২রা ডিসেম্বর অশোক পার্ক বিহারে তিনি নির্বাসিত তিব্বতীয় ভিক্ষু দালাইলামার সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে মিলিত হন। পরদিন ‘বুদ্ধ ও তাঁর ধর্ম’ গ্রন্থটির শেষ অধ্যায়ের লেখা সম্পন্ন করে কার্ল মার্কসের ‘দাস ক্যাপিট্যাল’-এ চোখ বুলালেন। কার্ল মার্কস সবসময়ই তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিলো। যা তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রতিভাত হয়েছে। ৪ঠা ডিসেম্বর তিনি রাজ্যসভার অধিবেশনে যোগদান করলেন। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তফসিলী ফেডারেশনের প্রার্থী হিসেবে আম্বেদর কেন্দ্রীয় লোকসভায় কংগ্রেস প্রার্থীর কাছে খুব অল্প ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। পরে ১৯৫২ সালের মে মাসে রাজ্যসভার নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিরোধীদলীয় এমপি হন। ৪ঠা ডিসেম্বরের পর যে আম্বেদকরের মতো একজন প্রতিভাবান সাংসদকে আর লোকসভায় দেখা যাবে না সেটা হয়তো কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। বাসায় ফিরে সিদ্ধান্ত নিলেন আগামী ১৬ ডিসেম্বর বোম্বাইতে অনুষ্টিতব্য দীক্ষা সমারোহে যোগদানের উদ্দেশ্যে ১৪ ডিসেম্বর বোম্বাই রওনা দেবেন। ৫ ডিসেম্বর রাত ৮টায় সাক্ষাতপ্রার্থী কয়েকজন জৈন নেতার সাথে নিজ বাসভবনেই বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম সম্পর্কে কিছুক্ষণ আলোচনা হলো। রাত ১১টার পর গুনগুন করে ‘বুদ্ধং শরনং গচ্ছামী’ গাইতে গাইতে ড. আম্বেদকর নিদ্রামগ্ন হলেন। সবার অগোচরে এটাই তাঁর শেষ নিদ্রা। পরদিন ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ভোর বেলা আম্বেদকর যথারীতি আর জাগলেন না।

তাঁর মৃত্যু সংবাদ দাবানলের মতো দ্রুত সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়লো। তাঁর বাড়িতে ছুটে এলেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পণ্ডিত গোবিন্দ বল্লভ পন্থ, যোগাযোগ মন্ত্রী জগজীবন রামসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গ। সেদিন রাতেই তাঁর মরদেহ বোম্বাই নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হলো। যোগাযোগ মন্ত্রী স্পেশাল প্ল্যানের ব্যবস্থা করলেন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সুসম্পন্ন করার সমস্ত দায়িত্ব নিলেন। মাথার উপর বুদ্ধের করুণা বিগলিত মূর্তি সম্বলিত ড. আম্বেদকরের মরদেহ ৪ লক্ষ জনতার বিশাল শোভাযাত্রা দাদার শ্বশানক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছলে সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে তাঁর একমাত্র সন্তান যশোবস্তরাও মুখাগ্নি করলেন।

ড. আম্বেদকরের আত্মার সৎগতি কামনা করে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর প্রস্তাবে লোকসভা ও রাজ্যসভা একদিন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ড. আম্বেদকরের জন্মদিনকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন।

আম্বেদকরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক বিশাল যুগের অবসান ঘটলো। বেঁচে থাকতে যে রাষ্ট্র তাঁকে যথাযথ সম্মান জানাতে পারেনি, তাঁর মৃত্যুর পরও যে জাতি এখনো অস্পৃশ্য বর্ণবাদ মুক্ত হতে পারেনি, সেই ভারত তাঁর মৃত্যুর ৪৪ বছর পর ১৯৯০ সালে তাঁকে মরণোত্তর ভারত রত্ন উপাধিতে ভূষিত করে হয়তো পাপস্খালনের কিছুটা প্রয়াস নিয়েছে। তবে এর আগেই বিশ্বব্যাপী দলিত অস্পৃশ্য জাতিগোষ্ঠির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানাতে ড. আম্বেদকরের মৃত্যু দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ৬ ডিসেম্বর-এর আগের দিনটিকে জাতিসংঘ বিশ্ব মর্যাদা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা করে।

কৃতজ্ঞতা: তথ্য সূত্র-
১) ‘মনুসংহিতা’ / সম্পাদনা মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় / সদেশ, সুলভ সংস্করণ, বইমেলা ১৪১২, কলকাতা।
২) অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মুক্তির প্রবক্তা ডঃ আম্বেদকর / সুভাষ কান্তি বড়ুয়া / ১৯৯৮ প্রথম সংস্করণ।
৩) ইংরেজিবাংলা ‘উইকিপিডিয়া’, অনলাইন মুক্তবিশ্বকোষ (Wikipedia, the free encyclopedia)।
৪) ’তিতাস’ থেকে ‘পিতৃগণ’ / জাকির তালুকদার।
৫) বিশ্ব মর্যাদা দিবসের ভাবনা ড. আম্বেদকর ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা / ‘সন্তবন্ধু’ মাস্টার কানাই লাল রবিদাস, সহসভাপতি, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত অধিকার আন্দোলন এবং আহবায়ক, বাংলাদেশ দলিত ফোরাম। (BPERM)।
৬) ভারতীয় শাসকদের ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা / বাঙ্গাল আব্দুল কুদ্দুস।