[বার্ট্রান্ড রাসেলের এর আনপপুলার এ্যাসেজ প্রকাশিত হয় ১৯৫০-এ। বইয়ে প্রবন্ধের সংখ্যা বার। এর মধ্যে আমার সবচাইতে পছন্দের প্রবন্ধটাই (An Outline of Intellectual Rubbish) সবচে বিশাল। ওটা অনুবাদ করার চেষ্টা করছি অনেকদিন থেকেই। দেখা যাক, এবার অন্তত আলস্য ছেড়ে কাজটা শেষ করা যায় কি-না।]

:line:

মানুষ হচ্ছে যুক্তিবাদী প্রাণী-অন্তত এরকমটাই আমি শুনে আসছি। একটা লম্বা সময় ধরে প্রচুর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই তত্ত্বের স্বপক্ষে তথ্যপ্রমাণ খুঁজে বেরিয়েছি, কিন্তু পাওয়ার সৌভাগ্য এখনো হলো না বুঝি, অথচ তন্নতন্ন করে বেরিয়েছি তিনটে মহাদেশের অনেকগুলো দেশ। অন্যদিকে দেখেছি পৃথিবী ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছে আরো আরো উন্মাদনায়। অনেক মহান জাতি দেখলাম, দেখলাম মানবসভ্যতার ভূতপূর্ব নেতাদের, সবাই, সবকিছু কিভাবে গালভরা ছাইপাঁশ প্রচারকদের কারণে গোল্লায় গেলো। দেখেছি প্রবল বেগে বাড়ছে নৃশংসতা, নির্যাতন আর কুসংস্কার, পৌঁছেছি এমন এক জায়গায় যেখানে যুক্তিবাদের কেউ প্রশংসা করলে সে চিহ্নিত হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগের দুঃখজনকভাবে টিকে-যাওয়া কোন বুড়ো ধোঁয়াটে চরিত্র হিসেবে। সবটাই মন খারাপ করে দেওয়ার মতো, কিন্তু দুঃখবোধ হচ্ছে একটা ফালতু আবেগ। ওটা থেকে বাঁচার জন্যে আগে যেমনটা করতাম তার চাইতে আরো অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে পুরনো দিনের ইতিবৃত্ত ঘাঁটাঘাঁটি করি, আর খুঁজে পাই যেমনটা ইরাসমুস বলেছেন, বোকামি হচ্ছে বহুবর্ষজীবী আর তারপরও মানবজাতি এখনো টিকে আছে। আমাদের সময়ের বোকামিগুলো সহজেই মেনে নেওয়া যায় যদি ওগুলো আগের দিনের বুদ্ধুমিগুলোর সাথে মেলাই। পরবর্তী আলোচনায় আমি একালের হাঁদামিগুলো পুরনো শতাব্দীগুলোর বোকামির সাথে মেলাবো। হয়তো ফলাফল হিসেবে নিজেদের সময়টা দেখতে পাবো অতীতের পরিপ্রেক্ষিতে। দেখবো যে ধ্বংস না হয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে-সময়ে বাস করে গেছেন, আমাদেরটা তার চাইতে খুব বেশি খারাপ না।

যতদূর জানি, এ্যারিস্ততলই প্রথম খোলাখুলি দাবি করেন যে, মানুষ যুক্তিবাদী প্রাণী। এ-মন্তব্যের পেছনে তাঁর যে-দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তা আজকাল হালে তেমন একটা পানি পাবে না; ওটা ছিলো এই যে মানুষ অঙ্ক কষতে পারে। তাঁর ধারণা আত্মা ত্রিবিধঃ জড় আত্মা (vegetable soul), সব প্রাণময় সত্তাতেই আছে, উদ্ভিদ বা প্রাণী উভয়টাতেই, এবং স্রেফ পুষ্টি আর বৃদ্ধির সাথে জড়িত; জান্তব আত্মা (animal soul), সংশ্লিষ্ট গতির সাথে, এবং পাওয়া যাবে মানুষ আর নিচুস্তরের প্রাণী দুটোতেই; শেষমেষ বিবেকী আত্মা বা প্রজ্ঞা (rational soul), যা কিনা স্বর্গীয় মানস (Divine mind), কিন্তু যা মানুষের মাঝে তাদের জ্ঞানের অনুপাতে কমবেশি উপস্থিত। প্রজ্ঞার স্বভাবটাই এমন যে মানুষ যুক্তিবাদী হতে বাধ্য। এই প্রজ্ঞার প্রকাশ নানা উপায়ে হয়, কিন্তু সবচে বেশি বোঝা যায় গাণিতিক দক্ষতায়। গ্রিসের গাণিতিক নিয়ম ছিলো বেজায় বাজে, গুণন সারণিগুলো ছিলো অসম্ভব জটিল, আর সবচে মাথাওয়ালা লোকগুলোই শুধু ঘোরালো হিসেবনিকেশগুলো সারতে পারতো। আজকাল অবশ্য সবচাইতে মেধাবী মানুষটার চাইতেও ক্যালকুলেটর অঙ্ক অনেক ভালোই পারে, যদিও কেউ এ-সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছাবে না এসব দরকারি যন্ত্রগুলো অমর, অথবা দৈবী অনুপ্রেরণায় কাজ করে। অঙ্ক-কষা সহজ হওয়ায় ওটার ওপর শ্রদ্ধাবোধটাও গেছে কমে। ফলাফল, যদিও অনেক দার্শনিক আমাদের বলে গেছেন, যাচ্ছেন আমরা কী দারুণ জাতি, আমাদের গাণিতিক দক্ষতার প্রশংসা তাঁরা আর করেন না।

যেহেতু যুগের হাওয়া আমাদের বুঝতে শেখায় না যে, অঙ্ক-কষা ছেলেরা মানুষের যুক্তিবাদী হওয়ার প্রমাণ দেয়, আর আত্মা, অন্তত কিছুটা হলেও অমর, তাহলে চলুন খুঁজি অন্য কোথাও। কোথায় নজর দেই প্রথমে? সেসব দেশনায়কদের দিকে তাকাবো যাঁরা দুনিয়াকে নিয়ে এসেছেন আজকের অবস্থায়? নাকি বেছে নেবো মহাপণ্ডিত, বিদ্বানদের? অথবা দার্শনিকদের? সবার দাবিই আছে, কিন্তু আমার মনে হয় তাঁদের দিয়েই শুরু করা উচিত যাদেঁর সব বিবেচক লোকেরা মানুষের মাঝে সবচাইতে জ্ঞানী এবং সৎ বলে মনে করেন, যেমন ধর্মযাজকেরা। যদি তাঁরাই যুক্তিবাদী না হন, তবে নিচুস্তরের অন্য মানুষগুলোর কী হবে? আর, হায়-যথেষ্ট শ্রদ্ধা নিয়েই বলছি-এমন অনেক ঘটনাই আছে যেগুলোতে তাদের মধ্যে জ্ঞানের ছিঁটেফোঁটাও নজরে পড়ে নি, এবং অবাক-করা ব্যাপার, ঘটনাগুলো বেশিরভাগ সেসময়েরই যখন যাজকদের ক্ষমতা ছিলো তুঙ্গে।

নিওস্কলাস্টিকেরা যেসময়টার প্রশংসা করেন, সেই বিশ্বাসের যুগ (The Ages of Faith) হচ্ছে এমন একটা সময় যখন সব কাজই হয়েছে যাজকদের পছন্দে। দৈনন্দিন জীবন ভর্তি থাকতো সন্তদের অলৌকিক ঘটনায় আর শয়তান ও প্রেতসিদ্ধদের (Necromancer=মৃতদের সাথে যোগাযোগ করে ভবিষ্যৎ জানায় দক্ষ) জাদুকরি খেলায়। বহু হাজারো ডাইনিকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে খুঁটিতে-বেঁধে। মানুষের পাপের সাজা হয়েছে মড়ক আর দুর্ভিক্ষে, ভূমিকম্প, বন্যা আর দাবানলে। এবং তারপরেও, আজব ব্যাপারই বলতে হয়, এখনকার চাইতে তারা তখন পাপ করতো আরো বেশি। পৃথিবী সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক বিবরণ ছিলো খুব কম। অল্প কিছু শিক্ষিত লোকেরা গ্রিক প্রমাণ মনে রেখে ভাবতো যে পৃথিবী গোল। কিন্তু অনেকেই প্রতিপাদ স্থানের ধারণা নিয়ে বেশ হাসিঠাট্টা করতো। প্রতিপাদ বিন্দুতে মানুষ আছে, এটা ধরে নেওয়াও ছিলো ধর্মদ্রোহিতা। সাধারণভাবে এটাই ধরে নেওয়া হতো যে (যদিও আধুনিক ক্যাথলিকেরা অতোটা কট্টর নন) মানবজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশেরই কোন ভবিষ্যৎ নেই। প্রতি পদক্ষেপেই ওঁৎ পেতে আছে বিপদ। সন্ন্যাসীরা যে-খাবার খাবেন, তাতে ঠাঁই পেতে ঘাপটি মেরে আছে শয়তানেরা আর সেসব বেখেয়ালি খাইয়েদের শরীরে তারা ঢুকবেই যারা প্রতি গ্রাস খাবার মুখে তোলার আগে ক্রশচিহ্ন আঁকতে ভুলে যায়। পুরনো আমলের লোকেরা এখনো কেউ হাঁচি দিলে বলে ওঠেন, “মঙ্গল হোক”, কিন্তু এই নিয়মের উৎস ভুলে গেছেন তাঁরা। কারণটা ছিলো এই যে, লোকেরা আগে ভাবতো হাঁচি দিলে তাদের আত্মা বাইরে বেরিয়ে যায়, আর আশেপাশের শয়তানেরা ওই আত্মাহীন শরীরে ঢুকে পড়তে পারে। কিন্তু, কেউ যদি বলে, “খোদা খায়ের”, শয়তানেরা তখন ভয় পেয়ে তফাৎ থাকে।

বিগত ৪০০ বছর ধরে, যে-সময়টা জুড়ে বিজ্ঞানের বৃদ্ধি ক্রমাগতভাবে মানুষকে দেখিয়েছে কিভাবে প্রকৃতির চলন সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হয় এবং ঈশিত্ব স্থাপন করা যায় প্রাকৃতিক শক্তির ওপর, সেই পুরো সময়টা জুড়েই যাজকেরা বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে একটা হারা লড়াই চালিয়ে গেছেন; জ্যোতির্বিজ্ঞান আর ভূতত্ত্বে, অঙ্গসংস্থানবিদ্যা আর শারীরবৃত্তীয় জ্ঞানে, জীববিদ্যায়, মনোবিজ্ঞান আর সমাজতত্ত্বে। এক জায়গা থেকে খেদানো হলো তো তাঁরা ডেরা গাড়তে গেলেন অন্যখানে। জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে তাড়া খেয়ে ভূতত্ত্বের উত্থান ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলেন তাঁরা; ডারউইনের সাথে লড়াই বাধালেন জীববিদ্যায়, এবং অধুনা মনোবিজ্ঞান আর শিক্ষণপ্রক্রিয়ার নানান বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে তাঁরা লড়াই চালিয়েই যাচ্ছেন। প্রতিটি পদক্ষেপেই তাঁরা চাইছেন তাঁদের পুরনো পশ্চাৎমুখিনতাগুলো জনসাধারণ ভুলে যাক, যাতে করে তাঁদের বর্তমান পশ্চাৎমুখিনতাগুলো লোকেরা ঠিকভাবে চিনতে না পারে। দেখা যাক বিজ্ঞানের উত্থানের যুগ থেকে যাজকদের কিছু অযৌক্তিক আচরণের উদাহরণ, আর তারপর তদন্ত চালানো যাক মানবজাতির বাকি অংশটা ভালো কি-না সেব্যাপারে।

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন যখন বিদ্যুৎবারণ দণ্ড আবিষ্কার করলেন, তখন রাজা তৃতীয় জর্জের উৎসাহভরা সমর্থন নিয়ে ইংল্যান্ড আর আমেরিকা জুড়ে যাজকেরা ঘোষণা করলো যে, এটা হচ্ছে ঈশ্বরের ইচ্ছা রুখে দাঁড়ানোর এক অধার্মিক প্রচেষ্টা। কারণ সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই জানতো যে, ঈশ্বরই অধার্মিকতা কিংবা এমনি কোন গুরুতর অপরাধের দণ্ড দেওয়ার জন্যেই বজ্রপাত ঘটান-ধর্মপ্রাণেরা কখনোই বাজ পড়ে মৃত্যুবরণ করেন না। এবং তাই যদি ঈশ্বর কাউকে আঘাত হানতে চান-ই, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের তো সেই মহদেচ্ছা রোখা উচিত নয়, কারণ এর মানে নির্ঘাৎ অপরাধীদের বাঁচানো। অবশ্য যদি বোস্টনের একজন শীর্ষস্থানীয় ধর্মপ্রাণ ডঃ প্রাইসের কথা বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে মানতে হবে যে ঈশ্বর এব্যাপারে ছাড় দেন নি। “ধীমান ডঃ ফ্রাংকলিনের উদ্ভাবিত লোহার কাঁটার কারণে” বজ্রপাত ব্যর্থ হয়ে যায়। ম্যাসচুসেটস কাঁপিয়ে দেয় ভূমিকম্প, কারণ হিসেবে ডঃ প্রাইস দেখাচ্ছেন ঈশ্বর ক্ষেপে উঠেছেন ‘লোহার কাঁটা’-র ওপর। ওই বিষয়ের ওপর দেওয়া এক ধর্মোপদেশে তিনি জানান, “নিউ ইংল্যান্ডের অন্য যেকোন জায়গার চাইতে বোস্টনে ওগুলোর পরিমাণ বেশি। আর বোস্টন কেঁপে উঠেছিলো ভয়ঙ্করভাবে। আঃ! ঈশ্বরের মহান হাত থেকে কোন পরিত্রাণ নেই।” অবশ্য শেষাশেষি মনে হয় মহান ন্যায়াধীশ বোস্টনকে পাপমুক্ত করার সব আশায় জলাঞ্জলি দিয়েছেন, কারণ যদিও বিদ্যুৎবারণ দণ্ড দিনের পর দিন বেড়েই গেছে, ম্যাসাচুসেটস-এ কিন্তু ভূমিকম্প বিরল থেকে বিরলতরই হয়েছে। সব কিছুর পরও ডঃ প্রাইস, অথবা প্রায় ওঁর মতোই অনেকটা দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান সময়ের অনেক প্রভাবশালীই ধারণ করেন। ভারতে একবার যখন বেশ কিছু ভূমিকম্প হয়, মহাত্মা গান্ধী তাঁর অনুসারীদের গম্ভীরভাবে সতর্ক করেন যে এসব দুর্ভোগ তাদের পাপের কারণেই প্রেরিত (রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এর বিরোধিতা করেন-অনুবাদক)

এমনকি আমার নিজের দ্বীপটিতেও এরকম দৃষ্টিভঙ্গি আজো বর্তমান। ১৯১৪-১৮ যুদ্ধকালে ব্রিটিশ সরকার খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে বেশ জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯১৬-তে, যখন অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়, একজন স্কটিশ যাজক পত্রিকায় লিখলেন যে সামরিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণ হচ্ছে সরকারি সুবিধে নিয়ে এমনকি স্যাবাথ-এর (বিশ্রামবার) দিনেও আলু বোনা হচ্ছে। অবশ্য দুর্যোগ এড়ানো শেষ অব্দি সম্ভব হয়, কারণ জার্মানেরা দশ দেশনার একটা-দুটো নয়, বরং সবগুলোই অমান্য করে।

কখনো কখনো, যদি ধার্মিকমণ্ডলীকে বিশ্বাস করতে হয়, ঈশ্বরের করুণা কৌতূহলজাগানিয়াভাবে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। রক অব এজেস-এর লেখক টোপলাডি এক মঠ থেকে অন্য মঠে চলে যান। যাওয়ার এক সপ্তাহ পর, যে-মঠে তিনি ছিলেন, সেটা পুড়ে যায়। ফলে নতুন মঠাধ্যক্ষ বিরাট ক্ষতির মুখোমুখি হন। টোপলাডি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান, কিন্তু নতুন মঠাধ্যক্ষ কী করেন সেটা জানা যায় নি। বোরো তাঁর ‘বাইবেল অব স্পেন’-এ লিপিবদ্ধ করে গেছেন কিভাবে ডাকাত-অধ্যুষিত এক গিরিপথ তিনি নিতান্ত নির্ঝঞ্ঝাটে পার হয়ে গেছেন। অবশ্য পরবর্তী যে-দলটা পার হতে যায়, তাদের ওপর হামলা হয়, ডাকাতি চলে, আর কয়েকজন খুনও হয়; বোরো যখন এ-সংবাদ পান, তখন টোপলাডির মতো তিনিও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান।

যদিও আমাদের পাঠ্যপুস্তকে কোপার্নিকীয় জ্যোতির্বিদ্যা শেখানো হয়, ওটা এখনো আমাদের ধর্মই বলি, আর নীতিই বলি, কোথাও জায়গা করে নিতে পারে নি, এবং জ্যোতিষশাস্ত্রেও বিশ্বাস টলাতে পারে নি মোটেই। লোকেরা এখনো ভাবে মানবজাতির সঙ্গে ঈশ্বরিক পরিকল্পনার কোন সম্পর্ক আছেই, এবং বিশেষ একটা শক্তি শুধু কল্যাণের দিকটাই দেখভাল করে না, বরং দুষ্টদের শাস্তিও দিয়ে থাকে। কখনো কখনো নিজেদের ধার্মিক ভাবা লোকেদের ঈশ্বরনিন্দায় আমি রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে পড়ি-যেমন সেসব যাজিকারা যাঁরা কখনোই বাথরোব না পড়ে স্নান সারেন না। যদি প্রশ্ন করা হয় কেন, ওখানে তো কোন পুরুষ আর তাঁদের দেখতে যাচ্ছেন না, তখন তাঁদের উত্তর: “ওঃ, আপনি পরম করুণাময় ঈশ্বরের কথা ভুলে যাচ্ছেন?” নিঃসন্দেহে তাঁরা সেই দেবাদিদেবকে পিপিং-টম হিসেবে ভাবেন, যাঁর সর্বশক্তির বলে তিনি বাথরুমের দেওয়াল ভেদ করেও সব দেখতে পান, কিন্তু আটকে যান বাথরোবে এসে। এহেন দৃষ্টিভঙ্গি আমায় আগ্রহী করে বৈকি।

‘পাপ’ সম্পর্কিত পুরো ধারণাটাই বেশ গোলমেলে মনে হয় আমার কাছে, যদিও আমার নিজের স্বভাবটাই বেশ পাপাচারী। যদি ‘পাপ’ ব্যাপারটা বর্ণনাতীত কষ্টভোগের জন্ম দিতো, তাহলেও বুঝতাম। কিন্তু পাপ বরং বহু যন্ত্রণার অবসান ঘটাতেই সাহায্য করে। বছরখানেক আগে, ইংরেজ হাউজ অব লর্ডস-এ, যন্ত্রণাদায়ক এবং আরোগ্যাতীত সব রোগের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছামৃত্যু আইনসঙ্গত করার ব্যাপারে একটা বিল উত্থাপন করা হয়। রোগীর সম্মতি তো জরুরি বটেই, সাথে কিছু ডাক্তারি সার্টিফিকেটেরও প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়। আমি সরল মনে রোগীর সম্মতি নেয়াটা স্বাভাবিক বলেই ধরে নেই, কিন্তু ক্যান্টারবেরির প্রয়াত আর্চবিশপ, ‘পাপ’-এর ইংরেজ অফিসিয়াল এক্সপার্ট, এহেন দৃষ্টিভঙ্গির ভ্রমাত্মক দিকটা সুস্পষ্ট করেন। রোগীর সম্মতিতে স্বেচ্ছামৃত্যু রূপ নেয় আত্মহত্যায়, এবং আত্মহত্যা হচ্ছে পাপ। লর্ডশিপেরা কর্তার ভাষ্য শুনলেন, এবং বিলটা দিলেন খারিজ করে। ফলে হলো কি, আর্চবিশপকে-এবং তাঁর ঈশ্বরকেও, যদি বিশপের বর্ণনা সত্যি হয়-খুশি করতে গিয়ে ক্যান্সারের রোগীরা মাসের পর মাস ধরে সহ্য করে যাচ্ছে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রণা, যতক্ষণ না তাদের চিকিৎসক বা নার্সেরা নেহাৎ মানবিক হয়ে তাদের হত্যার ঝুঁকি নিচ্ছে। এরকম একজন ঈশ্বরের ধারণা করতে আমার বেশ ঝামেলা হয় যিনি এধরনের অত্যাচারের চিন্তা করে আনন্দ লাভ করেন; এবং যদি এরকম স্বেচ্ছাচারী নৃশংসতা দেখানোর মতো কোন ঈশ্বর থেকেও থাকেন, তবে তাঁকে কোনভাবেই ভজনার যোগ্য বলে আমি মনে করি না। এতে অবশ্য এটাই প্রমাণিত হয় আমি নীতিহীনতার কতোটা অতলে ডুবে গেছি।

[ক্রমশ]