স্টিভেন পিংকারের “ব্ল্যাংক স্লেট’ বইটা এখন পর্যন্ত্য আমার পড়া অন্যতম সুপাঠ্য বই। “আত্মা” নিয়ে আগে কখনও মাথা ঘামাতাম না, কিন্তু বইটিতে স্নায়ুবিজ্ঞানের কিছু গবেষণা সম্পর্কে পড়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছি। সুখ, দুঃখ, প্রেম, হতাশার মত অনুভূতি যে মস্তিস্কের স্নায়ুকোষগুলোর মিথস্ক্রীয়ায় সৃষ্টি হতে পারে এই সম্ভবানাটা আগেই আমার মাথায় ঘুরত, এই বইটা পড়ে এখন নিশ্চিত হলাম। তবে আত্মা বইটার বিষয়বস্তু না, এই লেখাটারও না। বইটিতে আলোচিত বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে গর্ভপাতবিরোধী আন্দোলনে ডানপন্থীরা কিভাবে “আত্মা” নামক বিমূর্ত ও ভিত্তিহীন ধারণাটি ব্যবহার করে সেটার প্রসঙ্গ এসেছিল, ভীষণ কৌতূহলোদ্দীপক ঠেকায় সেই অংশটাই অনুবাদ করে ফেললাম।

গর্ভপাতের বৈধতা পাশ্চাত্য বিশ্বে এক চিরসবুজ বিতর্ক। ভাববাদ আর বিজ্ঞানের সংঘর্ষের এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। যৌন স্বাধীনতার সাথে উপজাত হিসেবে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ চলে আসে এবং সন্তান জন্মদানে অনিচ্ছুক মাতারা গর্ভপাতের মধ্যেই সমাধান খোজেন। ডানপন্থীদের দাবি- যেই মুহূর্তে একজন মহিলা গর্ভবতী হন(moment of conception) সেই মুহূর্তে একটি নতুন আত্মা পৃথিবীতে আসে, তাই ভ্রূণ হত্যা আসলে নরহত্যার সামিল। গর্ভপাত বিতর্কের আসলে বহু মাত্রা আছে, বইটিতে শুধু বৈজ্ঞানিক দিকটার উপরই আলোকপাত করা হয়েছে। গর্ভপাতের মুহূর্তে একটি নতুন মানব জিনোম নির্ধারিত হয় এবং আমরা এমন একটি সত্ত্বা পাই যে ভবিষ্যতে একটি অনন্য ব্যক্তিত্বে রুপান্তরিত হবে। খ্রীষ্টধর্মের বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং আমার জানামতে ইসলাম ধর্মও এই মুহূর্তটিকে আত্মার সঞ্চারণ ও একটি নতুন জীবনের সূচনাকাল হিসেবে অভিহিত করে। কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে একটি ঋজু প্রান্তকেও যেমন অমসৃণ দেখা যায়, তেমনি মানব প্রজননের উপর গবেষণার মাধ্যমে এটাও এখন পরিস্কার হয়ে গিয়েছে যে “গর্ভধারণের মুহূর্ত” আসলে কোন মুহূর্তই না! মাঝেমাঝে বেশ কয়েকটা শুক্রাণু ডিম্বের বহিঃঝিল্লি ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং এই শুক্রাণুগুলোর মাধ্যমে আবির্ভূত বাড়তি ক্রোমজোমগুলোকে বহিস্কার করতে ডিম্বের কিছুটা সময় লাগে। এই সময়ে আত্মা কোথায় থাকে? এরপরও যখন একটি শুক্রাণু ডিম্বে প্রবেশ করে, তার জিনগুলো ডিম্বের জিন থেকে এক বা একাধিক দিন পৃথক থাকে। শুক্র আর ডিম্বের জিনগুলো অঙ্গীভূত হয়ে যে নতুন জিনোম উৎপন্ন করে, সেটি কোষের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য আরও কয়েকদিন সময় নেয়। তো দেখা যাচ্ছে এই গর্ভধারণের “মুহূর্ত” আসলে ২৪ ঘন্টা থেকে ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত্য বিস্তৃত! তাছাড়া এই কনসেপটাস যে পরে মানুষ হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। দুই-তৃতীয়াংশ থেকে তিন-চতুর্থাংশ কনসেপটাস কখনওই জঠরে উপ্ত হয় না, এই ঘটনাকে অনেকে “প্রাকৃতিক গর্ভপাত” বলেন। এটা জিনগত ক্রুটির কারণে হতে পারে, আবার কোন অজানা কারণেও হতে পারে।

আপনি হয়ত বলতে পারেন, “যাই হোক, যখনই জিনোম তৈরী হবে তখনই আত্মা সঞ্চারিত হবে!”। তবুও কিন্তু রক্ষা নাই! এই রেখার যুক্তি আত্মাকে জিনের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে। কিছুদিন পর যখন ভ্রুণের কোষ বিভাজন শুরু হবে, তখন জিনোমটা একাধিক ভ্রুণে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে যেগুলো পরে বড় হয়ে অভিন্ন যমজ শিশু(identical twin) অথবা ত্রৈত(triplet) হতে পারে। অভিন্ন যমজ শিশুরা কি একই আত্মা ধারণ করে? এক সাথে জন্মগ্রহণ করেছে এমন পাঁচটি শিশুর প্রত্যেকে কি একই আত্মার এক-পঞ্চমাংশ ধারণ করে? তা যদি না হয়, তবে বাকি চারটা আত্মা কোথা থেকে আসল? একটা ভ্রুণের প্রত্যেকটি কোষের স্বাধীন ভ্রুণে রুপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে যেগুলো প্রত্যেকটা বড় হয়ে আলাদা শিশু হতে পারে। একটি বহু কোষ বিশিষ্ট ভ্রুণের প্রত্যেকটি কোষের কি আলাদা আলাদা আত্মা থাকে? তা যদি না হয়, তাহলে কোষগুলো যখন ভ্রুণ হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন তাদের আত্মাগুলো কোথায় যায়? শুধু যে একটা ভ্রুণ দু’টো মানুষ হতে পারে তা না, দু’টো ভ্রুণ মিলে একটা মানুষও হতে পারে। মাঝেমাঝে দু’টো উর্বর ডিম্ব, যেগুলোর সাধারণত fraternal twin(যেসব যমজ জিনগত ভাবে অভিন্ন না) হওয়ার কথা, একটিমাত্র ভ্রুণে অঙ্গীভূত হয় এবং এর ফলে আমরা এমন একজন মানষ পাই যে জিনগতভাবে একটা chimera এর মতই। এই মানুষটার এক কোষে এক জেনোম থাকে তো আরেক কোষে আরেকটা জেনোম থাকে। এই মানুষতার কি তাহলে দু’টো আত্মা থাকবে? মানব ক্লোনিং যদি কখনও সম্ভব হয়(কারিগরী কোন প্রতিবন্ধকতা অবশ্য নেই), তবে মানুষটার শরীরের প্রত্যেকটি কোষ একটা কনসেপটাসের মতই বড় হয়ে নতুন আরেকটা মানুষ হওয়ার ক্ষমতা রাখবে। এটা সত্য যে আমাদের গন্ডদেশের কোষগুলোর জিনগুলো অপ্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় আলাদা আলাদা মানুষ হয়ে যেতে পারে এবং in vitro fertilization অথবা IVF(দেহের বাইরে যে fertilization বা উর্বরকরণ ঘটে) এর ক্ষেত্রে কিন্তু তাই ঘটে। কেউ কিন্তু কখনও বলবে না IVF এর মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুদের আত্মা নেই।

গর্ভধারণের মুহুর্তে আত্মার সঞ্চারণ শুধু যে অবৈজ্ঞানিক তা নয়, এর কোন নৈতিক উৎকর্ষতাও নেই। কনসেপটাসকে জরায়ুতে উপ্ত হতে বাধা দেয় এমন যেকোন জন্ম নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাকে এই অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে নরহত্যা হিসেবে অভিহিত করা যায়। আমাদের তো তাহলে ক্যানসার আর হৃদরোগের গবেষণা বন্ধ করে প্রাকৃতিক গর্ভপাত প্রতিরোধের জন্য গবেষণা শুরু করা উচিত! ফারটিলিটি ক্লিনিকের হিমঘরে যেসব ভ্রুণ বেকার বসে আছে তাদের জন্য সারোগেট মাতা খোজা উচিত। এই দৃষ্টিভঙ্গী স্টেম-সেল গবেষণাকে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে হারাম করে দিয়েছে, অথচ নৈতিকতা কপচানো ধর্মজীবি গোষ্ঠীর বায়ুভর্তি আধ্যাত্মিক মস্তকে এই সামান্য বিষয়টা ঢুকে না যে এই বোবা, কালা, অন্ধ, ধর্মহীন স্টেম সেলগুলো চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশাল এক বিপ্লব আনতে পারে, Alzheimer’s disease, Parkinson’s disease, ডায়াবেটিস আর মেরুদন্ডের সমস্যাগুলোর সমাধান বাতলে দিতে পারে। বিল মার তাঁর “রিলিজুলাস”(Religulous) তথ্যচিত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আরকানসাসের ডেমোক্রেটিক সিনেটর ডেভিড প্রায়রের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় বলেন, “আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে আমরা আমেরিকানরা এমন এক ব্যক্তির হাতে আমাদের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সপে দিয়েছি যিনি কথা বলা সাপে(বাইবেলে আদম-হাওয়ার গল্পে শয়তানের স্থান নিয়েছে কথা বলা সাপ) বিশ্বাস করেন”। প্রায়রের মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে, “আমাদের তো আই.কিউ টেস্ট পাস করে নিয়োগ পেতে হয় না”। রাষ্ট্রের হর্তা-কর্তারা যখন গাঁও-গেরামের বুড়া-বুড়ির মত কুসংস্কারাচ্ছন্ন হন, তখন রাষ্ট্রও চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে গাঁও-গেরামের পর্যায়েই বন্দি থাকে।