কবির মৃত্যু

 

গ্রানাডা, স্পেন।

 

দূর উঁচু নীলাভ পর্বতমালা।

 

পর্বতমালার উপরে সারি সারি পাইন গাছে ছাওয়া ঘন নিবিড় অরণ্য। সেই অরণ্যের মাঝখানে ছায়াঢাকা মায়াময় এক গভীর উপতক্যা। আর, এর ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতেই বর্ণময় ফুলে ফুলে ছাওয়া খুব আটপৌরে একটি সমাধি। পাইনের মাতাল করা গন্ধ গায়ে মেখে আন্দালুসীয় মৃদুমন্দ এলোমেলো হাওয়া উড়ে আসছে সেখানে। মমতা মাখানো আলতো কোমল পরশ বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সেই সমাধিক্ষেত্রে। গভীর ভালবাসায় রিনরিন শব্দে ঝরা পাতারা আবেশী প্রেমিকার মত লুটিয়ে পড়ছে সমাধিক্ষেত্রের বুকে।

 

এখানেই যে শুয়ে আছেন আন্দালুসিয়ার শ্রেষ্ঠতম কবি এবং নাট্যকার, কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। অপূর্ব রূপবান এক মহতি কবি। ফ্যাসিস্ট ফ্রাংকোর ফ্যালাঞ্জিস্ট বাহিনী এখন থেকে চুয়াত্তর বছর আগে এই মানবতাবাদী কবিকে হত্যা করেছিল ভয়াবহ নৃশংসতায়। তারপর তার লাশ গায়েব করে দিয়েছিল কাপুরুষের মত।

lorca1

 

লোরকা কি জানতেন যে তাকে এভাবে খুন করা হবে? কবিরা কি ভবিষ্যতদ্রষ্টা হন? কোন এক বিচিত্র উপায়ে দেখতে কি পান না ঘটা ঘটনাপঞ্জিকে? অনুভব কি করতে পারেন অনাগত সময়কে? নাহলে কী করে তিনি মৃত্যুর কয়েক বছর আগেই লিখে যান এমন কবিতা, যে কবিতার সাথে হুবহু মিলে যায় তার মৃত্যুকালীন ঘটনাসমূহলোরকার সেই কবিতার কয়েকটি পংক্তি এরকম-

 

 

আমি বুঝতে পারছি, খুন করা হয়েছে আমাকে

তারা ক্যাফে, কবরখানা আর গীর্জাগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজছে

তারা সমস্ত পিপে আর ক্যাবার্ডগুলো তছনছ করেছে

তিনটে কংকালকে লুট করে খুলে নিয়ে গেছে সোনার দাঁত

আমাকে তারা খুঁজে পায়নি

কখনো-ই কি পায় নি তারা?

          না, কখনোই নয় 

 

ডন কুইজোট এবং জিপসিদের বর্ণিল ফ্লামেনকো সঙ্গীত এবং নাচের প্রেমময় রোমাঞ্চকর স্পেনতিরিশের দশকে সেই রোমাঞ্চকর প্রেমভূমি কেঁপে উঠেছিল রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দামামায়১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী এই গৃহযুদ্ধে অর্ধ মিলিওনেরও বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছিল১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে জুন মাসের মধ্যে ২৩৯টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়ন্যাশনালিস্টরা প্রতিমাসে গড়পড়তায় এক হাজার করে রিপাবলিক্যানদেরকে হত্যা করতোশুধু হত্যা করেই বর্বরতার শেষ হতো নাএই সব হত্যাকাণ্ডের পরে মৃতদের আত্মীয়স্বজনদেরকে শোক করার স্বাধীনতাও দেওয়া হতো না

 

এরকমই এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন লোরকামাত্র আটত্রিশ বছর বয়স তার তখন১৯৩৬ সালের অগাস্ট মাসের ১৮ তারিখে লোরকাকে গ্রানাডার জেল থেকে নিয়ে যাওয়া হয় পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের পাদদেশেএকজন শিক্ষক এবং দুজন ন্যাশনালিস্ট বিরোধী বামপন্থী বুলফাইটারের সাথে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়হত্যার পরে অবহেলায় অন্যদের সাথে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয় তাকেফ্যালাঞ্জিস্টরা বহুদিন ধরেই লোরকাকে পৃথিবী থেকে বিদায় জানানোর জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলএর পিছনে কারণও ছিললোরকা প্রকাশ্যেই তার সমর্থন ঘোষণা করে দিয়েছিলেনতিনি কোন পক্ষের লোক সেটা বুঝতে কারোরই সময় লাগেনিতিনি বলেছিলেন, ‘আমি সবসময়ই তাদের সাথে থাকবো যাদের সহায়সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই, এমনকি সেই কিছু না থাকাটাকেও যাদেরকে শান্তিতে উপভোগ করতে দেওয়া হয় না

 

লোরকাকে বন্দী করা একজন ফ্যালাঞ্জিস্টকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে লোরকার কী অপরাধসে তখন পরিষ্কারভাবেই বলেছিল যে, ‘তার লেখালেখিঅন্যেরা পিস্তল-বন্দুক হাতে নিয়েও যে ক্ষতি করতে পারেনি, সে কলম হাতে নিয়েই তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করে ফেলেছিলতার হত্যাকারীরা অবশ্য প্রকাশ্যে একথা স্বীকার করেনি কখনোবরং তার মৃত্যুর জন্য তার সমকামী হওয়ার অপরাধকে তুলে ধরেছেতারা মনে করতো ঘৃণ্য এই অপরাধের জন্য তার মৃত্যুদণ্ড পাওয়াটা প্রাপ্যই ছিল

 

ফ্রাংকোর স্বৈরাচারী সরকারতো লোরকাকে হত্যা করার কথা স্বীকারই করেনিযুদ্ধে আহত হয়ে রাস্তার ধারে মরে পড়েছিল বলে ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করেছিল তারাজীবিত কবি ভীতিকর, কিন্তু মৃত কবি বড়ই ভয়ংকর

 

কবি পাবলো নেরুদা লোরকার মৃত্যু সংবাদ শুনে বিপন্ন উচ্চারণে বলেছিলেন, ‘স্পেনের সেরা ফুল ঝরে গেলআসলেই তাইস্পেন তার আর কোন কবি বা শিল্পীকে এত আবেগ আর ভালবাসা দিয়ে বুকে টেনে নেয়নিরুশ কবি মায়াকোভস্কির মতই হাজার হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে গলা খুলে কবিতা পড়তে ভালবাসতেন লোরকামানুষের প্রতি তার অপরিসীম ভালবাসায় মানুষ ফিরিয়ে দিয়েছিল শতগুনে তাকে

 

সমসাময়িক কবিদের মত ভবিষ্যতবাদ এবং দাদাবাদে ভেসে না গিয়ে একবারে মাটির কাছাকাছি গিয়ে কবিতা লিখেছেন তিনিস্পেনের জল মাটিতে শিকড় গেড়ে বসে ছিলেন লোরকাস্বদেশের বিচিত্র রূপ-রস, গন্ধ, বর্ণ তাকে রেখেছিল আচ্ছন্ন করেদেশের যা কিছু সম্পদ, যা কিছু বর্ণময়, যা কিছু উজ্জ্বল তাকেই ভালবাসার চাদর মুড়িয়ে পরম যত্নে তুলে এনেছিলেন তিনিতার কবিতা হয়ে উঠেছিল দেশ আর দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসার অফুরন্ত আধার

 

আন্দালুসিয়ার জল, মাটি, নিসর্গ, লোকগাথা, সব আয়োজন, কৃষকজীবন, দুরন্ত ষাড়ের লড়াই সবকিছু নতুন আদল পেয়ে উঠে এলো লোরকার কবিতায়জিপসিদের বর্ণময় বাঁধনহীন মুক্তজীবনও মূর্ত হয়ে উঠলো নতুন স্বাদে, নতুন ঘ্রানে

 

তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ রোমান্সেরো গিতানোপ্রকাশ হবার সাথে সাথেই সারা স্পেনের নয়নের মণিতে পরিণত হন তিনিএত গভীর ভালবাসা দিয়ে, এত মায়াময় দরদ দিয়ে, এত প্রবল প্রেম দিয়ে, এত তীব্র আবেগ দিয়ে আর কেউ যে স্বদেশের কথা বলেনি আগেসেই যে স্বদেশ উঠে এলো লোরকার তুলিতে, আর কখনোই তা থামেনিআজীবন দেশ, মানুষ আর মাটিকে সঙ্গে নিয়ে চলেছেন তিনি, বুকের মধ্যে আগলে রেখেছেন পরম মমতায়শুধুমাত্র মৃত্যু এসেই বিরাম চিহ্ন টেনেছে সেখানে

 

মৃত্যুর কিছুদিন আগে অসাধারণ কিছু সনেট লিখেছিলেন লোরকাগৃহযুদ্ধের রক্তাক্ত ডামাডোলে হারিয়ে গিয়েছে সেই সব সনেটগুলো কোথায় কেউ জানে নাঅসম্ভব ভালবাসা আর কষ্ট মাখানো সেইসব অমূল্য রত্নভাণ্ডার আর খুঁজে পাওয়া যায়নি কোথাও

 

লোরকার উপস্থিতি এতই দ্যুতিময় ছিল যে তার পাশে সব কিছুকেই বড় বিবর্ণ বলে মনে হততার কবি বন্ধু জর্জ গুইলেন বলেছিলেন যে, ‘লোরকা আশেপাশে থাকলে গরম-ঠান্ডার কোন অনুভূতিই টের পাওয়া যেত নাতার উপস্থিতি এমনই মাদকপূর্ণ ছিল যে সবকিছু ভুলে তা হয়ে উঠতো লোরকাময়

 

সময়ের চেয়েও এগিয়ে ছিলেন লোরকাফলে বহু লোকের চক্ষুশূল ছিলেন তিনিতার মেধা, তার সাফল্য, তার চিন্তাভাবনার প্রাগসরতা, সমকামিতা তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলইয়ান গিবসন তার পোয়েটস ডেথগ্রন্থে বলেছেন, ‘লোরকার মৃত্যুর ক্ষেত্রে ঈর্ষা এক বিশাল ভূমিকা পালন করেছেতার মেধা, সাফল্য, মুক্তচিন্তা, বামপন্থী ধ্যানধারণায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তৈরি হয়েছিল অসংখ্য শত্রুতারাই তাকে বাঁচতে দেয়নি  সামরিক জান্তা স্পেনের ক্ষমতা দখলের পর তার মৃত্যু হয়ে উঠেছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র

 

লোরকার দৈহিক মৃত্যুকে নিশ্চিত করেছে তার শত্রুরা ঠিকইকিন্তু মুছে ফেলতে পারেনি তার অস্তিত্বকেআজো সারা পৃথিবীর সকল বিপন্ন কবির অস্তিত্বের প্রতীক হিসেবে লোরকার বেঁচে রয়েছেন আমাদের মাঝে

 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লোরকার স্মরণে অসাধারণ একটি কবিতা লিখেছিলেন কবির মৃত্যুশিরোনামেকবিতাটি আমার অসম্ভব প্রিয় একটি কবিতাএই কবিতার শিরোনাম থেকেই প্রবন্ধের শিরোনামটি ধার করাআপনাদের জন্য তুলে দিলাম কবিতাটাএছাড়া লোরকার একটি কবিতাও আছে এই কবিতাটির পরপরইআশা করি সেটিও ভাল লাগবে আপনাদের

 

 

 

কবির মৃত্যু

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

দুজন খসখসে সবুজ উর্দিপরা সিপাহী
      কবিকে নিয়ে গেল টানতে টানতে
কবি প্রশ্ন করলেন : আমার হাতে শিকল বেঁধেছো কেন?
      সিপাহী দু
জন উত্তর দিল না;
      সিপাহী দু
জনেরই জিভ কাটা
অস্পষ্ট গোধুলি আলোয় তাদের পায়ে ভারী বুটের শব্দ
তাদের মুখে কঠোর বিষন্নতা
তাদের চোখে বিজ্ঞাপনের আলোর লাল আভা


মেটে রঙের রাস্তা চলে গেছে পুকুরের পার দিয়ে
      ফ্লোরেসেন্ট বাঁশঝাড় ঘুরে-
      ফসল কাটা মাঠে এখন
      সদ্যকৃত বধ্যভূমি

সেখানে আরও চারজন সিপাহী রাইফেল হাতে প্রস্তুত
তাদের ঘিরে হাজার হাজার নারী ও পুরুষ
কেউ এসেছে বহু দূরের অড়হর ক্ষেত থেকে পায়ে হেঁটে
কেউ এসেছে পাটকলের ছুটির বাঁশি আগে বাজিয়ে
কেউ এসেছে ঘড়ির দোকানে ঝাঁপ ফেলে
কেউ এসেছে ক্যামেরায় নতুন ফিল্ম ভরে
কেউ এসেছে অন্ধের লাঠি ছুঁয়ে ছুঁয়ে
জননী শিশুকে বাড়িতে রেখে আসেননি
যুবক এনেছে তার যুবতীকে
বৃদ্ধ ধরে আছে বৃদ্ধতরের কাঁধ
     সবাই এসেছে একজন কবির
             হত্যাদৃশ্য
             প্রত্যক্ষ করতে

খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হলো কবিকে,
        তিনি দেখতে লাগলেন
        তাঁর ডান হাতের আঙুলগুলো-
কনিষ্ঠায় একটি তিল, অনামিকা অলঙ্কারহীন
মধ্যমায় ঈষৎ টনটনে ব্যথা, তর্জনী সংকেতময়
বৃদ্ধাঙ্গুলি বীভৎস, বিকৃত-
কবি সামান্য হাসলেন,
একজন সিপাহীকে বললেন,আঙুলে
         রক্ত জমে যাচ্ছে হে,
         হাতের শিকল খুলে দাও!
সহস্র জনতার চিৎকারে সিপাহীর কান
         সেই মুহূর্তে বধির হয়ে গেল

জনতার মধ্য থেকে একজন বৈজ্ঞানিক বললেন একজন কসাইকে,
         পৃথিবীতে মানুষ যত বাড়ছে, ততই মুর্গী কমে যাচ্ছে

একজন আদার ব্যাপারী জাহাজ মার্কা বিড়ি ধরিয়ে বললেন,
         কাঁচা লঙ্কাতেও আজকাল তেমন ঝাল নেই!
একজন সংশয়বাদী উচ্চারণ করলেন আপন মনে,
         বাপের জন্মেও এক সঙ্গে এত বেজম্মা দেখিনি, শালা!
পরাজিত এম এল এ বললেন একজন ব্যায়ামবীরকে,
         কুঁচকিতে বড় আমবাত হচ্ছে হে আজকাল!
একজন ভিখিরি খুচরো পয়সা ভাঙিয়ে দেয়                                                                      বাদামওয়ালাকে
একজন পকেটমারের হাত অকস্মাৎ অবশ হয়ে যায়
একজন ঘাটোয়াল বন্যার চিন্তায় আকুল হয়ে পড়ে
একজন প্রধানা শিক্ষয়িত্রী তাঁর ছাত্রীদের জানালেন
           প্লেটো বলেছিলেন

একজন ছাত্র একটি লম্বা লোককে বললো,
           মাথাটা পকেটে পুরুন দাদা!
এক নারী অপর নারীকে বললো,
           এখানে একটা গ্যালারি বানিয়ে দিলে পারতো

একজন চাষী একজন জনমজুরকে পরামর্শ দেয়,
          বৌটার মুখে ফোলিডল ঢেলে দিতে পারো না?
একজন মানুষ আর একজন মানুষকে বলে,
          রক্তপাত ছাড়া পৃথিবী উর্বর হবে না

তবু একজন যেন সমম্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, এ তো ভুল লোককে
         এনেছে
ভুল মানুষ, ভুল মানুষ

রক্ত গোধূলির পশ্চিমে জ্যোৎস্না, দক্ষিণে মেঘ
বাঁশবনে ডেকে উঠলো বিপন্ন শেয়াল
নারীর অভিমানের মতন পাতলা ছায়া ভাসে
            পুকুরের জলে
ঝমঝুমির মতন একটা বকুল গাছে কয়েকশো পাখির ডাক
কবি তাঁর হাতের আঙুল থেকে চোখ তুলে তাকালেন,
            জনতার কেন্দ্রবিন্দুতে
রেখা ও অক্ষর থেকে রক্তমাংসের সমাহার
            তাঁকে নিয়ে গেল অরণ্যের দিকে
ছেলেবেলার বাতাবি লেবু গাছের সঙ্গে মিশে গেল
            হেমন্ত দিনের শেষ আলো
তিনি দেখলেন সেতুর নিচে ঘনায়মান অন্ধকারে
            একগুচ্ছ জোনাকি
দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হলো চুল, তিনি বুঝতে পারলেন
            সমুদ্র থেকে আসছে বৃষ্টিময় মেঘ
তিনি বৃষ্টির জন্য চোখ তুলে আবার
            দেখতে পেলেন অরণ্য
            অরণের প্রতিটি বৃক্ষের স্বাধীনতা-
গাব গাছ বেয়ে মন্থরভাবে নেমে এলো একটি তক্ষক
            ঠিক ঘড়ির মতন সে সাতবার ডাকলো :

সঙ্গে সঙ্গে ছয় রিপুর মতন ছজন
            বোবা কালা সিপাহী
            উঁচিয়ে ধরলো রাইফেল-
যেন মাঝখানে রয়েছে একজন ছেলেধরা
            এমন ভাবে জনতা ক্রুদ্ধস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো
            ইনকিলাব জিন্দাবাদ!
কবির স্বতঃপ্রবৃত্ত ঠোঁট নড়ে উঠলো
তিনি অস্ফুট হৃষ্টতায় বললেন :
            বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!
            মানুষের মুক্তি আসুক!
            আমার শিকল খুলে দাও!
কবি অত মানুষের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি মানুষ
নারীদের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি নারী
            তিনি দু
জনকেই পেয়ে গেলেন
কবি আবার তাদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বললেন,
            বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! মিলিত মানুষ ও
            প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব বিপ্লব!

প্রথম গুলিটি তাঁর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল-
            যেমন যায়,
কবি নিঃশব্দে হাসলেন
দ্বিতীয় গুলিতেই তাঁর বুক ফুটো হয়ে গেল
কবি তবু অপরাজিতের মতন হাসলেন হা-হা শব্দে
তৃতীয় গুলি ভেদ করে গেল তাঁর কন্ঠ
কবি শান্ত ভাবে বললেন,
            আমি মরবো না!
মিথ্যে কথা, কবিরা সব সময় সত্যদ্রষ্টা হয় না

চতুর্থ গুলিতে বিদীর্ণ হয়ে গেল তাঁর কপাল
পঞ্চম গুলিতে মড়মড় করে উঠলো কাঠের খুঁটি
ষষ্ঠ গুলিতে কবির বুকের ওপর রাখা ডান হাত
            ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেল
কবি হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলেন মাটিতে
জনতা ছুটে এলো কবির রক্ত গায়ে মাথায় মাখতে-
কবি কোনো উল্লাস-ধ্বনি বা হাহাকার কিছুই শুনতে পেলেন না
কবির রক্ত ঘিলু মজ্জা মাটিতে ছিট্‌কে পড়া মাত্রই
        আকাশ থেকে বৃষ্টি নামলো দারুণ তোড়ে
শেষ নিঃশ্বাস পড়ার আগে কবির ঠোঁট একবার
            নড়ে উঠলো কি উঠলো না
            কেউ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেনি

আসলে, কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো
মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন,
         বলেছিলুম কিনা, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না!

 

গান

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা

 

চারুমুখী মেয়েটি জলপাই কুড়োয়।

দুর্গচূড়ার প্রেমিক বাতাস তার ক্ষীণ কোমর জড়িয়ে থাকে।

দীর্ঘ আঙরাখা আর নীল ও সবুজ পোশাকে

আন্দালুসীয় ঘোড়ার পিঠে চার আরোহী

চলে যেতে যেতে বলে,

ও মেয়ে, চলো করাডোবায় যাই।

মেয়েটি ফিরেও দেখে না।

 

নারেঙ রঙের পোশাকে, ঝকঝকে রূপোর তলোয়ার

সিংহ কটিতে এঁটে চলে যেতে যেতে

বলে ওঠে তিন তরুণ মাতাদোর,

ও মেয়ে, চলো, সেভিল ঘুরে আসি।

মেয়েটি তাকিয়েও দেখে না।

 

সন্ধ্যা যখন রক্তমুখী হয়ে ওঠে

শেষের আলোয়,

গোলাপগুচ্ছ আর চন্দ্রভুক ফুল হাতে

চলে যেতে যেতে বলে ওঠে একটি যুবক

ও মেয়ে, এসো গ্রানাদায় যাই।

মেয়েটি ভ্রূক্ষেপও করে না।

 

চারুমুখী মেয়েটি শুধু জলপাই কুড়িয়ে যায়

আর, তার কোমর ধরে

ঘুরপাক খেতে থাকে প্রেমিক হাওয়া।