দর্শন শাস্ত্রের প্রান্তিক টুকিটাকি বিষয়গুলো নিয়ে একে একে ছোট ছোট কিছু পোস্ট লেখা শুরু করেছিলাম মুক্তমনায় । এর প্রেক্ষিতে এর আগে একটি পোস্টে নিবেদন করা হয়েছিলো – ‘নাস্তিকতাও একটি ধর্ম হলে’ নামক নিবন্ধটি। এর পরে একই ধারাবাহিকতায় এসেছিলো ‘অক্কামের ক্ষুর এবং বাহুল্যময় ঈশ্বর‘।

আজকে প্রকাশিত হল ফ্রেড্রিক হয়েলের বোয়িং ৭৪৭। হয়েলের এই বোয়িং উপমা বর্তমান কালের বিজ্ঞানের দর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ অভিব্যক্তি।
:line:

 

ফ্রেড্রিক হয়েলের বোয়িং ৭৪৭

 
 

hoyleছবি:  ফ্রেড্রিক হয়েল (১৯১৫-২০০১)

ফ্রেড্রিক হয়েল (১৯১৫-২০০১) ছিলেন বিগত শতকের এক নামকরা  জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী। আজকে যে আমরা মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং তত্ত্বের কথা শুনি,সেই ‘বিগ ব্যাং’ শব্দটি তার কাছ থেকেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছিলো ১৯৪৯ সালের একটা রেডিও প্রোগ্রামে, যদিও বিগ ব্যাং শব্দটি তিনি তখন উচ্চারণ করেছিলেন অনেকটাই সমালোচনা আর শ্লেষের সুরে। শ্লেষ থাকার করণ, সে সময় বিগ ব্যাং-এর সাথে সমানে পাল্লা দিচ্ছিলো হয়েলেরই নিজস্ব একটি তত্ত্ব; যাকে বিজ্ঞানীরা ডাকতেন স্থিতিশীল অবস্থা তত্ত্ব (steady state theory) নামে। ১৯৬৪ সালে আর্নো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন মহাজাগতিক পশ্চাদপট বিকিরণ[1] খুঁজে পাবার আগ পর্যন্ত কিন্তু পৃথিবীর বহু নামকরা পদার্থবিজ্ঞানীই স্থিতিশীল অবস্থা তত্ত্বের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন।  ফ্রেডরিক হয়েল ছিলেন সেই স্থিতিশীল তত্ত্বের মূল প্রবক্তা, যদিও তার এই বিখ্যাত তত্ত্বের সাথে জড়িত ছিলেন আর কয়েকজন নামকরা পদার্থবিদ – হারমান বন্দি, থমাস গোল্ড এবং পরবর্তীকালে এক ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী – জয়ন্ত নারলিকর। স্থিতিশীল তত্ত্ব ছাড়াও স্টেলার নিউক্লিওসিন্থেসিস সহ জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক কিছুতেই ফ্রেডরিক হয়েলের অবদান ছিলো। জীবনের শেষ বয়সে তিনি তার ছেলের সাথে মিলে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখায়ও হাত দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানে তার সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি ‘স্যার’ উপাধি পেয়েছিলেন, পুরস্কার পেয়েছিলেন রয়েল এস্ট্রোনমিকাল সোসাইটি থেকেও, এ ছাড়া আরো অন্যান্য ছোট-খাট পুরস্কার তো আছেই। কাজেই ফ্রেড্রিক হয়েলের সুনাম কম ছিলো  না তার সময়ে ।
 
কিন্তু বড় বিজ্ঞানী হলে  কি হবে তিনি জায়গায় বেজায়গায় নাক গলিয়ে নিজের মতামত দিতে পছন্দ করতেন। এমনি একটা ঘটনা ঘটেছিলো যখন বিজ্ঞানীরা বিগত শতকের মাঝামাঝি সময়ে বেশ কটি ডায়নোসর এবং পাখির মধ্যবর্তী জীবাশ্ম আর্কিওপটেরিক্সের ফসিল খুঁজে পাচ্ছিলেন। হয়েল হঠাৎ করেই বলে বসলেন আর্কিওপটেরিক্সের ফসিলগুলো নাকি সব জালিয়াতি। অথচ, আর্কিওপটেরিক্স কিন্তু বিজ্ঞানীদের জন্য নতুন কিছু ছিলো না সে সময়।  আর্কিওপটেরিক্সের প্রথম পালকের ফসিল খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো  বহু আগেই – সেই ১৮৬০ সালে। এমনকি ডারউইন তার ‘অরিজিন অব স্পিশিজ’ গ্রন্থের চতুর্থ সংস্করণে আর্কিওপটেরিক্সের উল্লেখও করেছিলেন। ডারউইনের সমসাময়িক বিজ্ঞানী টিএইচ হাক্সলি তখনই মন্তব্য করেছিলেন যে, হাবভাবে মনে হচ্ছে আধুনিক পাখিগুলো সব থেরোপড ডায়নোসর থেকেই এসেছে; আর আর্কিওপটেরিক্সের মত ফসিলগুলো এই যুক্তির পেছনে জোরালো প্রমাণ হিসেবে হাজির হয়েছে[2]’।  তারপর ১৮৬১ সালের দিকে জার্মানীর ল্যাংগেনালথিমে[3] পাওয়া গেলো আর্কিওপটেরিক্সের পূর্ণাংগ কঙ্কাল। একই পরিক্রমায় ১৮৭৭ সালে ব্লুমেনবার্গে[4], ১৮৫৫ সালে রিডিনবার্গে, ১৯৫৮ সালে ল্যাংগেনালথিমে[5], ১৯৫১ সালে ওয়ার্কারসজেলে, ১৯৬০ সালে জার্মানীর ইৎসচাটে, ১৯৯১ সালে ল্যাংগেনালথিমে, ২০০৫ এবং ২০০৬ এ জার্মানীতে আর্কিওপটেরিক্সের বিভিন্ন ফসিল উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আর জীববিজ্ঞানীরা কষ্ট করে ফসিল  পেলে কি হবে,  বিজ্ঞানী হয়েল তার সহকর্মী গণিতবিদ চন্দ্র বিক্রমসিংহের সাথে মিলে হঠাৎ করেই ১৯৮৫ সালে তুমুল সোরগোল শুরু করলেন এই বলে যে, আর্কিওপটেরিক্সের ফসিলগুলো সব নাকি বানোয়াট। তারা বললেন, ফসিলগুলো নাকি এত চমৎকারভাবে সংরক্ষিত থাকার কথা না,মধ্যবর্তী স্তরে নিশ্চয় আধুনিক পাখির পালক ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, ইত্যাদি। ব্রিটিশ ন্যাচারাল হিস্ট্রি জাদুঘরের বিজ্ঞানীরা হয়েলের প্রতিটি সন্দেহ পরীক্ষা করে দেখলেন, এবং তাদের পরীক্ষায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হল ফসিলগুলো আর্কিওপটেরিক্সেরই। এমনি একটি পরীক্ষায় অ্যালেন চ্যারিগ সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরা স্ল্যাবের কিনারাগুলোর মাপ নিয়ে দেখালেন  আর্কিওপটেরিক্সের দুটি পাললিক শিলাস্তরের স্ল্যাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে একে অপরের স্তরে খাপ খেয়ে যায়, ফলে মধ্যবর্তী স্তরে আধুনিক পাখির পালক থাকার ব্যাপার এখানে নেই। তাদের সম্পূর্ণ পরীক্ষার ফলাফল সায়েন্স জার্নালের ১৯৮৬ সালের ২৩২ সংখ্যায় ‘ আর্কিওপটেরিক্স কোন জোচ্চুরি নয়’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়[6]। হয়েল যখন ফসিলের সত্যতা নিয়ে সোরগোল করছিলেন, ঠিক সেসময়ই জার্মানীর সোলনহফেনে ১৯৮৭ সালে আরেকটি  আর্কিওপটেরিক্সের ফসিল পাওয়া যায়, আর বিজ্ঞানীরা সবাই মিলে পুরো প্রক্রিয়াটিকে বস্তুনিষ্ঠভাবে অবলোকন করার সুযোগ পান।কিভাবে পাখির পালকের ছাপ পাললিক শিলায় পড়ে, কিভাবে শিলাস্তরে চির ধরে সবকিছুই বিজ্ঞানীরা আরো একবার ভালমতো যাচাই করার সুযোগ পেয়ে যান। দেখা গেল আর্কিওপটেরিক্সের এই সোলনহফেন নমুনাটিও অন্যগুলোর মতই একই ফলাফল নিয়ে আসলো। এই আবিস্কারের ব্যাপারটিও সায়েন্স জার্নালে আর্কিওপটেরিক্সের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে আবির্ভুত হল[7] আর আর্কিওপটেরিক্স নিয়ে হয়েলের যাবতীয় ‘কন্সপিরেসি তত্ত্বের’সমাধি রচনা করলো ।

443px-archaeopteryx_lithographica_berlin_specimen

ছবি:  আর্কিওপটেরিক্স (১৮৭৭) : বার্লিন স্পেসিমেন
 
 

আসলে অধ্যাপক হয়েল পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে সুপরিচিত হলেও জীববিজ্ঞান কিংবা প্রত্নতত্ত্বের খুঁটিনাটি বিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন না; সত্যি বলতে কি – বিবর্তন কিংবা পাললিক শিলায় কিভাবে ফসিল সংগৃহীত হয়,কিভাবে পালকের ছাপ স্ল্যাবে পড়ে এগুলো নিয়ে পরিস্কার জ্ঞান হয়েলের ছিলো না। কিন্তু সেই অপরিচ্ছন্ন জ্ঞান নিয়েই বিশেষজ্ঞীয় এলাকায় সেঁদিয়ে গিয়েছিলেন, তর্ক করে ভুল প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন পোড় খাওয়া জীববিজ্ঞানীদের খুঁজে পাওয়া কষ্টার্জিত সাক্ষ্য-প্রমাণগুলোকে। অল্পবিদ্যা কিভাবে  ভয়ঙ্করি হয়ে উঠে শেষপর্যন্ত নিজেকেই খেলো করে তুলে হয়েলের দৃষ্টান্তই বড় প্রমাণ। এ প্রসঙ্গে টিম বেড়া তার ‘ইভোলুশন এন্ড দ্য মিথ অব ক্রিয়েশনিজম’ বইয়ে খুব সেজন্য চাঁছাছোলা ভাবেই বলেন[8] –

Hoyle and Wickramasinghe, it should be noted, had no experience in biology or paleontology, do not understand natural selection, and have espoused a variety of anti-evolutionary ideas. Because these allegations, regardless of their lack of merit, could give aid and comfort to the creationists…. Hoyle’s  motive was unclear, but he would not for a moment brook a comparable challenge in his own area of expertise. His claim demonstrates what can happen when a scientist makes uninformed remarks about a subject in which he is unqualified.

অধ্যাপক টিমবেড়ার কথায় অত্যুক্তি নেই। হয়েলের অভিযোগ কিংবা বিশ্লেষণগুলোতে কোন সারবত্তা না থাকলেও সৃষ্টিবাদীদের জন্য সেগুলো তখন ভালই রসদ যুগিয়েছিলো।ধর্মবাদী সাইটগুলো বুঝে না বুঝে হয়েলের ভুল অভিযোগগুলোই পুনরাবৃত্ত করে চললো (এবং কিছু ক্ষেত্রে এখনো চলছে)।তারা খোঁজ করে দেখারও চেষ্টা করেননি যে হয়েলের ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো  ন্যাচারাল হিস্ট্রি জাদুঘরের বিজ্ঞানীরা (যারা এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান রাখেন) ভুল প্রমাণ করে দিয়েছিলেন সে সময়ই।
 
হয়েল  শুধু  আর্কিওপটেরিক্স নিয়েই জল ঘোলা করেননি, করেছিলেন আরো একটা বড় ব্যাপারে, যেটা নিয়ে সৃষ্টিবাদীরা এখনো যার পর নাই উচ্ছ্বসিত। হয়েল তার ‘নিজস্ব গণনা’ থেকে একসময় সিদ্ধান্তে চলে এসেছিলেন যে, সরল অবস্থা থেকে উচ্চতর জটিল জীবের সৃষ্টি অনেকটা নাকি  টর্নেডোর ঝড়ে জাঙ্কইয়ার্ডে পড়ে থাকা লোহার জঞ্জালের স্তুপ থেকে এক লহমায় বোয়িং ৭৪৭ বিমান তৈরি হয়ে যাওয়ার মত অবাস্তব! 

boiing_scrapyard_hoyle

ছবি: হয়েল ধারণা করেছিলেন যে, সরল অবস্থা থেকে উচ্চতর জটিল জীবের সৃষ্টি অনেকটা নাকি  টর্নেডোর ঝড়ে জাঙ্কইয়ার্ডের স্তুপ থেকে বোয়িং ৭৪৭ বিমান তৈরি হয়ে যাওয়ার মত অসম্ভাব্য কিছু!

মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, এই ‘জঞ্জাল  থেকে বোয়িং ৭৪৭ বিমান’ তৈরি হবার উপমা হয়েল কোন বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে লেখেননি।তবে শোনা যায় তিনি ১৯৮২ সালের একটি সেমিনারে প্রাণের রাসায়নিক উৎপত্তি তত্ত্বের বিপরীতে তার প্যান্সপারমিয়া তত্ত্বের সাফাই গাইতে গিয়ে একথা বলেছিলেন। ইস্টের সাথে বোয়িং  ৭৪৭ এর তুলনা করার কারণ হিসেবে বলেছিলেন দুটোরই নাকি সমান সংখ্যক প্রত্যঙ্গ, এবং জটিলতার স্তরেও বেশ মিল আছে[9]। যাহোক ফ্রেড হয়েলের এই ‘যুক্তিমালা’পরবর্তীতে তার একটি বই ‘দ্য ইন্টেলিজেন্ট ইউনিভার্স'(১৯৮৩)-এ সন্নিবেশিত হয়েছিলো এভাবে[10] –

 
ধরা যাক একটি জাঙ্কইয়ার্ডে বোয়িং ৭৪৭ বিমানের সকল অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হঠাৎ একটি ঘূর্ণিঝড় (whirlwind)এসে জাঙ্কইয়ার্ডের উপর দিয়ে বয়ে চলে গেলো। সেই ঘূর্ণিঝড়ে পুরো বোয়িং ৭৪৭ তৈরি হয়ে উড়ার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় চলে আসার সম্ভাবনা বা চান্স কতটুকু?

 
তারপর থেকেই সৃষ্টিতাত্ত্বিকেরা জায়গায় বেজায়গায় হয়েলের উপমাকে ‘বিবর্তনের বিরুদ্ধে এক মোক্ষম অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার শুরু করেন।
 
শোনা যায় হয়েল ব্যক্তিগত জীবনে নাস্তিক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু সরল অবস্থা থেকে উচ্চতর জীবের উৎপত্তির সম্ভাবনা গণনা করতে গিয়ে দেখেন সেটার চান্স এতোই কম (১০৪০০০০ ভাগের ১ ভাগ) যে, তাতে নাকি তার ‘নাস্তিকতার বিশ্বাস টলে গিয়েছিলো’ এবং হয়েল ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন, এবং সে সময়ই তিনি ঘূর্ণিঝড়ে বোয়িং ৭৪৭ তৈরি হবার উপমা এনে দেখানোর চেষ্টা করেন যে,সরল অবস্থা থেকে জটিল জীবের উদ্ভব নাকি প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার, ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ নাকি লাগবেই। এই গুজবের পেছনে আমি কোন সত্যতা খুঁজে না পেলেও (যদিও ব্যাপারটা সত্য হলেও খুব বেশি অবাক হব না) সম্প্রতি বইপত্র  ঘাটার ফলে একটা  মজার জিনিস বেরিয়ে এসেছে। হয়েল কিন্তু কোন সৃষ্টিবাদী বা ক্রিয়েশনিস্ট ছিলেন না। বরং তার অনেক প্রবন্ধ এবং বই পত্রেই তিনি বিবর্তন তত্ত্বের উপর প্রগাঢ় আস্থা ব্যক্ত করেছেন। যেমন, তার ‘অরিজিন  অব লাইফ ইন দ্য ইউনিভার্স’বইয়ে তিনি খুব স্পষ্ট করেই বলেন[11] –

We are inescapably the result of a long heritage of learning, adaptation, mutation and evolution, the product of a history which predates our birth as a biological species and stretches back over many thousand millennia…. Darwin’s theory, which is now accepted without dissent, is the cornerstone of modern biology. Our own links with the simplest forms of microbial life are well-nigh proven.

      
 এমনকি তার জীবনের একেবারে শেষদিককার বইগুলোতেও তিনি সৃষ্টিবাদকে প্রত্যাখ্যান করে লিখেছিলেন যে, কোন প্রকৃত বিজ্ঞানী সৃষ্টিবাদে বিশ্বাস করতে পারেননা[12]। তারপরেও সৃষ্টিবাদীরা আর ধর্মবাদীরা হয়েলের বোয়িং ৭৪৭ উপমা নিয়ে যার পর নাই উচ্ছ্বসিত। এ যেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ তাদের কাছে। জাকির নায়েক হারুন ইয়াহিয়ারা তো আছেই, আমি শুনেছি সম্প্রতি শিবিরও নাকি তাদের কিছু মুখপত্রে আর লিফলেটে ‘সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রমাণ’ হিসেবে হয়েলের যুক্তিমালা ব্যবহার করা শুরু করেছে। বোঝা যাচ্ছে কেবল কোরান হাদিস কিংবা অনুরূপ ধর্মগ্রন্থের আয়াতের বিভিন্ন ব্যাখ্যা আর অপব্যাখ্যা হাজির করে আর কাজ চলছে না, শিবিরকে দারস্থ হতে হচ্ছে বিবর্তন-বিশ্বাসী এবং সম্ভবত পাঁড় নাস্তিক হয়েলের উপমার কাছে। সম্প্রতি রায়হান আবীর মুক্তমনায় তার একটি প্রবন্ধে যেমন লিখেছিলেন ‘প্যালের ঘড়ির মৃত্যু নেই’ ঠিক তেমনি হয়তো বলা যেতে পারে  ‘হয়েলের বোয়িং বিমানের মৃত্যু নেই’! প্যালের ঘড়ি আর হয়েলের বোয়িং যেন পরষ্পরের পরিপূরক; তামাক আর ফিল্টার – দু’জনে দুজনার!
 
আমার আজকের প্রবন্ধটি অবশ্য হয়েল সাহেব আস্তিক নাকি নাস্তিক, সৃষ্টিবাদী না অসৃষ্টিবাদী তা নিয়ে নরক গুলজার করার জন্য লেখা নয়,বরং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে তার আর্গুমেন্টগুলোকে যাচাই করে দেখা যে সত্যই হয়লের বোয়িং উপমা বিবর্তনের বিরুদ্ধে কোন শক্তিশালী যুক্তি হিসেবে গ্রহনীয় হতে পারে কিনা। তবে সেখানে ঢুকবার আগে একটি ব্যাপার পরিস্কার বোধ হয় করে নেয়া দরকার যে, আধুনিক বিশ্বের প্রায় সকল জীববিজ্ঞানীরাই হয়েলের এই বোয়িং উপমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন[13]। তারা মনে করেন হয়েলের এই বোয়িং ৭৪৭ উপমা বিবর্তনের সাথে তুলনীয় হতে পারে না। কারণ –

  • বিবর্তন টর্নেডো বা ঘুর্ণিঝড়ের মত কোন আকস্মিক ব্যাপার নয়। এটা কোন দৈবাৎ প্রক্রিয়াও নয়, যে কেবল চান্স দিয়ে একে পরিমাপ এবং ব্যাখ্যা করতে হবে।
  • টর্নেডো দিয়ে চূড়ান্ত কোন কিছু তৈরি করার চেষ্টা আসলে একধাপে ঘটা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোন কিছু বানানোর চেষ্টা। আর অন্যদিকে বিবর্তন ঘটে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বহু ধাপে  পরিমিত ভিন্নতার মধ্য দিয়ে ক্রমবর্ধমান নির্বাচন (Cumulative Selection)-এর মাধ্যমে।
  • প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা  বিভিন্ন সরঞ্জাম (যেমন জাঙ্কইয়ার্ডে রাখা বিমানের বিভিন্ন অংশ) জোড়া লেগে লেগে কিন্তু বিবর্তন ঘটে না। বিবর্তন ঘটে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবে শুধুমাত্র বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে দীর্ঘ সময় ধরে পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত হওয়ার মাধ্যমে।
  • বোয়িং বিমানের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত দ্রব্য থাকে স্থির। আর বোয়িং বিমান বানানোর পেছনে থাকে নকশাকারীর লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। অপরদিকে বিবর্তন কিন্তু কোন ভবিষ্যতের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য মাথায় রেখে কাজ করে না, চূড়ান্ত লক্ষ্যের ব্যাপারে থাকে একেবারেই উদাসীন।


 
প্রথম দুটো  পয়েন্ট আরেকটু বিস্তৃত করা যাক। অনেকেই ভেবে থাকেন প্রথমিকভাবে মিউটেশনের ফলে বিভিন্ন প্রকারণের অভ্যুদয় যেহেতু ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে (randomly) ঘটে থাকে,বিবর্তন বোধ হয় কেবল চান্সের খেলা। আসলে কিন্তু তা নয় মোটেই। বিবর্তনের পেছনে মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন। প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যাপারটা কিন্তু  কোন  কোন চান্স নয়। প্রাথমিক পরিব্যক্তি (মিউটেশন) গুলো রান্ডম হতে পারে, কিন্তু তার পর বৈশিষ্ট্যগুলো ন্যাচারাল সিলেকশনের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটি কিন্তু র‌্যান্ডম নয়, বরং ডিটারমিনিস্টিক, কারণ তা নির্ভর করে বিদ্যমান উপযুক্ত পরিবেশের উপর।সেজন্যই বিবর্তন কেবল চান্সের খেলা নয়[14]। পরিব্যক্তিগুলো র‌্যান্ডম হবার পরেও কিভাবে তা বিবর্তনকে একটি নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তা জানতে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ If Mutation is Random, Why Does Evolution Occur at All ‘ প্রবন্ধটি পড়া যেতে পারে। প্রবন্ধটিতে দুটি চমৎকার উদাহরণ হাজির করে বঝানো হয়েছে – Mutation was random, but selection provided a direction to the evolution. 

এ প্রসঙ্গে  আমাদের চোখের অভ্যুদয় এবং বিকাশের  ব্যাপারটা চিন্তা করি। আজকে আমরা চোখের যে পূর্নাংগ গঠন দেখে বিস্মিত হই, তা কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি, বরং বহুকাল ধরে ক্রমান্বয়ে ঘটতে থাকা  ছোট ছোট পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে। খুব সম্ভবতঃ আলোর প্রতি সংবেদনশীল একধরনের স্নায়বিক কোষ থেকে প্রথম চোখের বিকাশ শুরু হয়। তারপর হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত হতে হতে আজকে তারা এই রূপ গ্রহন করেছে। কতগুলো সংবেদনশীল কোষকে কাপের মত অবতলে যদি ঠিকমতভাবে সাজানো যায় তাহলে যে নতুন একটি আদি-চোখের উদ্ভব হয় তার পক্ষে আলোর দিক নির্ণয় করা সম্ভব হয়ে উঠে। এখন যদি কাপটির ধারগুলো কোনভাবে বন্ধ করা যায়, তা হলে আধুনিক পিন হোল ক্যামেরার মতো চোখের উৎপত্তি ঘটবে।
 

miller_eye-evol-1miller_eye-evol-2 
ছবি:  চোখের বিবর্তন : চোখের মত একটি জটিল প্রত্যঙ্গ সহজেই আলোর প্রতি সংবেদনশীল খুব সরল স্নায়বিক কোষ বিশিষ্ট ‘আই-স্পট’ থেকে বিভিন্ন ধাপে ধাপে পরিমিত ভিন্নতার মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হতে পারে। যখনই এ ধরনের কোন পরিবর্তন – যা কিছুটা হলেও বাড়তি সুবিধা প্রদান করে, তা ধীরে ধীরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জনপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে।
 

তারপরে এক সময় গতি নির্ধারণ করতে পারে এমন একটি অক্ষিপট বা রঙ বুঝতে পারে এমন কোনের মতো অংশ বিকাশ লাভ করে, তা হলে উন্নত একটি চোখের সৃষ্টি হবে। এরপর যদি বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইরিস ডায়াফ্রামের উৎপত্তি ঘটে তা হলে চোখের ভেতরে কতখানি আলো ঢুকবে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এরপর আস্তে আস্তে যদি লেন্সের উদ্ভব ঘটে তা তাকে আলোর সমন্বয় এবং ফোকাস করতে সহায়তা করবে, আর এর ফলে চোখের উপযোগিতা আরো বাড়বে। এভাবেই সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবে উপযোগিতা নির্ধারণ করে চোখের ক্রমান্বয়িক পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা এখনও আমাদের চারপাশে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত বিভিন্ন ধাপের চোখের অস্তিত্ব দেখতে পাই, অনেক আদিম প্রাণীর মধ্যে এখনও বিভিন্ন রকমের এবং স্তরের আদি-চোখের অস্তিত্ব দেখা যায়।
 
কিছু এককোষী জীবে একটা আলোক-সংবেদনশীল জায়গা আছে যা দিয়ে সে আলোর দিক সম্পর্কে খুব সামান্যই ধারণা করতে পারে, আবার কিছু কৃমির মধ্যে এই আলোক-সংবেদনশীল কোষগুলি একটি ছোট অবতল কাপের মধ্যে বসানো থাকে যা দিয়ে সে আরেকটু ভালোভাবে দিক নির্ণয় করতে সক্ষম হয়।

variuos_eye_nature

ছবি: প্রকৃতিতে পাওয়া বিভিন্ন ধরণের চোখ- খুব সরল ধরণের চোখ থেকে শুরু করে জটিল চোখের  অস্তিত্ব এই প্রকৃতিতেই আছে, আর তা সবই তৈরি হয়েছে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় [24]।

  
 
সমতলের উপর বসানো নামমাত্র আলোক সংবেদনশীলতা থেকে শুরু করে পিনহোল ক্যামেরা সদৃশ চোখ কিংবা মেরুদন্ডী প্রাণীদের অত্যন্ত উন্নত চোখ পর্যন্ত সব ধাপের চোখই দেখা যায় আমাদের চারপাশে (অন্ধ গুহা মাছ মেক্সিকান টেট্রা থেকে শুরু করে সালামানদরে, নটিলাস, প্লানারিয়াম, অ্যান্টার্কটিক ক্রিল, মৌমাছি, মানুষের চোখ ইত্যাদি), এবং তা দিয়েই বিবর্তন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর ব্যাখ্যা করা সম্ভব। বিবর্তন প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে ক্রমবর্ধমান নির্বাচনের মাধ্যমে না ঘটলে আমরা প্রকৃতিতে এত বিভিন্ন ধরণের চোখের অস্তিত্ব পেতাম না। সম্প্রতি সুইডিশ অধ্যাপক ড্যান এরিক নিলসন এবং পেলগার গবেষণার মাধ্যমে[15] বের করে দেখিয়েছেন যে, আদি  সমতল পিগমেন্টেড আলোক সংবেদনশীল সেল থেকে শুরু করে প্রায় ২০০০ ধাপের মধ্যে পরবর্তীতে মানুষের চোখের মতো জটিল যন্ত্রে পরিবর্তিত হতে পারে। তাদের করা সিমুলেশনের সচিত্র ফলাফল নীচে দেয়া হল –
 
        

800px-modele_eye_evolution_nilsson_pelger_1994svg 
ছবি: অধ্যাপক ড্যান এরিক নিলসন এবং পেলগারের সিমুলেশনের ফলাফল, তারা দেখিয়েছেন আদি সমতল আলোক সংবেদনশীল সেল থেকে শুরু করে ৪০০ ধাপ পরে তা রেটিনাল পিটের  আকার ধারণ করে, ১০০০ ধাপ পরে তা আকার নেয় পিন-হোল ক্যামেরার মত আকৃতির, আর  প্রায় ২০০০ ধাপ পরে অক্টোপাসের মত জটিল চোখের উদ্ভব ঘটে।  জীববিজ্ঞানী মার্ক রিডলীর  সাইটে ব্যাপারটি এনিমেশনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, এখানে

  
 
এবার হয়েলের সম্ভাবনার মারপ্যাচ নিয়ে একটু গভীরে ঢুকি।  হয়েলের এই জঞ্জাল থেকে বোয়িং উপমা খুব মৌলিক কিছু নয়। অসীম বানর তত্ত্ব (Infinite monkey theorem) নামে একটা ব্যাপার  দর্শনের আঙ্গিনায় প্রচলিত ছিলোই। হয়েল সেটাকে বোয়িং মোড়কে মুড়ে কোষীয় প্রাণবিজ্ঞানের আঙ্গিনায় ব্যবহার করতে চেয়েছেন।  আমি ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ নামের বইয়ে এই অসীম বানর তত্ত্ব নিয়ে ছোট করে লিখেছিলাম[16]।  ব্যাপারটা পাঠকের সামনে পুনর্বার একটু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করছি।
 
অসীম বানর তত্ত্ব হচ্ছে এমন একটা ধারণা – যেখানে মনে করা হয় যে, অফুরন্ত সময় দেয়া হলে  আপাতঃ দৃষ্টিতে প্রায় অসম্ভব সমস্ত ব্যাপারও ঘটে যেতে পারে সম্ভাবনার নিয়মেই।  যেমন, একটা বানরকে যদি টাইপরাইটারের সামনে বসিয়ে দেয়া হয়, তবে তার অন্ধভাবে টাইপিং করা থেকে শেক্সপিয়পিয়রের হ্যামলেট বেরিয়ে আসলে আসতেও পারে, যদি বানরটিকে অফুরন্ত সময় দেয়া হয় টাইপিং চালিয়ে যাবার জন্য।  হয়েল এই বানরের বিক্ষিপ্তভাবে টাইপ করে হ্যামলেট লেখার উপমাকেই প্রাকৃতিক উপায়ে জটিল জীবজগত  তৈরির ব্যাখ্যায় নিয়ে গেছেন, কেবল  পার্থক্য এই যে, তিনি শেক্সপিয়রের হ্যামলেটের বদলে ব্যবহার করেছেন বোয়িং ৭৪৭।
 
হয়েলের ধারণা সত্য হলে সরল অবস্থা হতে প্রাকৃতিকভাবে জটিল জীবজগতের উদ্ভব অনেকটা হঠাৎ  লটারী জিতে কোটিপতি হওয়ার মতই একটা ব্যাপার যেন।  কম সম্ভাবনার ঘটনা যে ঘটে না তা নয়। অহরহই তো ঘটছে। ভূমিকম্পে বাড়ী-ঘর ধবসে পড়ার পরও অনেক সময়ই দেখা গেছে প্রায় ‘অলৌকিক’ভাবেই ভগ্নস্তুপের নীচে কেউ বেঁচে আছেন। এই যে হাইতিতে বিশাল ভূমিকম্প হল কিছুদিন আগে, প্রায় পনেরো দিন, এমনকি একটি ক্ষেত্রে ২৭ দিন পরেও জীবন্ত অবস্থায় এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়েছে[17]।   নিউইয়র্ক টাইমস-এ একবার এক মহিলাকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল যিনি দু দুবার নিউজার্সি লটারির টিকেট জিতেছিলেন।  তারা সম্ভাবনা হিসেব করে দেখেছিলেন ১৭ ট্রিলিয়নে ১। এত কম সম্ভাবনার ব্যাপারও ঘটছে।  কাজেই সম্ভাবনার নিরিখেই প্রাণের উৎপত্তি এবং সর্বোপরি জটিল জীবজগতের উদ্ভব যত কম সম্ভাবনার ঘটনাই হোক না কেন,ঘটতে পারেই।
 
কিন্তু জীববিজ্ঞানীদের কাছে স্রেফ সম্ভাবনার মার-প্যাঁচ থেকেও ভাল উত্তর আছে, প্রাণের আবির্ভাব এবং বিবর্তনের পেছনে।  আর সেই উত্তরটি হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন। আর পূর্বেই ব্যাখ্যা করা হয়ছে যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন জিনিসটা কোন চান্সের খেলা নয়।  এটা  একটা নন- র‌্যান্ডম  ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়া। সেজন্যই ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার গ্রন্থে  অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স পরিস্কারভাবেই বলেন[18] –

প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা ডারউইনীয় বিবর্তন কে র‌্যান্ডম মনে করা শুধু ভুলই নয়, চূড়ান্ত বিচারে অসত্য। এটা সত্যের পুরোপুরি বিপরীত। চান্স জিনিসটা ডারউইনীয় রেসিপিতে খুব ছোট একটা উপাদান, কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ বড় উপাদানটির নাম ক্রমবর্ধমান নির্বাচন – যেটা একেবারেই নন-র‌্যান্ডম।

 
 একটা উদাহরণ দেই।  আমাদের গ্যালাক্সিতে ১০১১ টি তারা আর ১০৬০ টি ইলেকট্রন আছে। দৈবাৎ   এ ইলেকট্রনগুলো একত্রিত হয়ে আমাদের গ্যালাক্সি, কোটি কোটি তারা, আমাদের পৃথিবী এবং শেষ পর্যন্ত এই একটি মাত্র গ্রহে উপযুক্ত পরিবেশে প্রথম জীবকোষটি গঠনের সম্ভাবনা কত? আমাদের গ্যালাক্সি এবং পৃথিবীর যে বয়স, তা কি ওই সম্ভাবনা সফল করার জন্য যথেষ্ট? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন।  কারণ এই সম্ভাবনা মাপতে গেলে যে হাজারটা চলক নিয়ে কাজ করতে হয়, তার অনেকগুলো সম্বন্ধে আমরা এখনও অনেক কিছু ঠিকমত জানি না।  তারপরেও এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, হয়েলের মত শুধু চান্স দিয়ে পরিমাপ করে একধাপী সমাধান হাজির করলে  সেটার সম্ভাবনা এতোই কম বেরুবে যে ‘জঞ্জাল থেকে বোয়িং’ হবার মতোই শোনাবে ; কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনকে গোনায় ধরলে আর সেটা মনে হবে না।  বিজ্ঞানী কেয়রেন্স-স্মিথ এমনি একটি কৃত্রিম উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি আমাদের বুঝিয়েছিলেন ১৯৭০ সালেই।
 

monkey-typing

ছবি:  অনেকে ভাবেন, একটা বানরকে যদি টাইপরাইটারের সামনে বসিয়ে দেয়া হয়, তবে তার অন্ধভাবে টাইপিং করা থেকে শেক্সপিয়পিয়রের হ্যামলেট বেরিয়ে আসলে আসতেও পারে, যদি বানরটিকে অফুরন্ত সময় দেয়া হয় টাইপিং চালিয়ে যাবার জন্য।

  
তিনি বলেছেন, ধরা যাক একটা বানরকে জঙ্গল থেকে ধরে নিয়ে এসে টাইপরাইটারের সামনে বসিয়ে দেয়া হল। তারপর তার  সামনে ডারউইনের ‘প্রজাতির উৎপত্তি’ নামক বইটি খুলে এর প্রথম বাক্যটি টাইপ করতে দেয়া হল।  বাক্যটি এরকম :
 
When on board HMS Beagle, as a naturalist, I was much struck with certain facts in the distribution of the inhabitants of South America, and in the geological relations of the present to the past inhabitants of that continent.
 
এই লাইনটিতে ১৮২ টি অক্ষর আছে। বানরটিকে বলা হল এই লাইনটিকে সঠিকভাবে কাগজে ফুটিয়ে তুলতে। এখন বানর যেহেতু অক্ষর চিনে না, সেহেতু সে টাইপরাইটারের চাবি অন্ধভাবে টিপে যাবে। টিপতে টিপতে দৈবাৎ একটি শব্দ সঠিক ভাবে টাইপ হতেও পারে। কিন্তু একটা শব্দ টাইপ হলে চলবে না, পুরো বাক্যটি সঠিকভাবে যেমনিভাবে লেখা আছে – ঠিক তেমনিভাবে-  টাইপ হতে হবে। মানে শুধু সবগুলো শব্দ  সঠিক ভাবে টাইপ নয়, এর ধারাবাহিকতাও রাখতে হবে।  এখন এই বানরটির এই বাক্যটি সঠিকভাবে টাইপ করার সম্ভাবনা কত? কত বছরের মধ্যে অন্ততঃ একবার হলেও বানরটি সঠিকভাবে বাক্যটি টাইপ করতে পারবে? সম্ভাবনার নিরিখে একটু বিচার-বিশ্লেষণ করা যাক।
 
মনে করা যাক যে, টাইপরাইটারটিতে ৩০ টি অক্ষর আছে এবং বানরটি প্রতি মিনিটে ৬০ টি অক্ষর টাইপ করতে পারে। শব্দের মধ্যে ফাঁক-ফোকর গুলো আর বড় হাত-ছোট হাতের অক্ষরের পার্থক্য এই গণনায় না আনলেও, দেখা গেছে পুরো বাক্যটি সঠিকভাবে টাইপ করতে  সময় লাগবে ১০৮০ বছর, মানে প্রায় অনন্তকাল!  কিন্তু যদি এমন হয় যে, একটি সঠিক শব্দ লেখা হবার সাথে সাথে সেটিকে আলাদা করে রাখা হয়, আর বাকী অক্ষরগুলো থেকে আবার নির্বাচন করা হয় বানরের সেই অন্ধ টাইপিং এর মাধ্যমে, তবে কিন্তু সময় অনেক কম লাকবে,  তারপরও ১৭০ বছরের কম নয়। কিন্তু যদি এই নির্বাচন শব্দের উপর না হয়ে অক্ষরের উপর হয়ে থাকে (অর্থাৎ, সঠিক অক্ষরটি টাইপ হওয়ার সাথে সাথে এটিকে আলাদা করে রেখে দেয়া হয়); তবে কিন্তু সময় লাগবে মাত্র ১ ঘন্টা, ৩৩ মিনিট, ৩০ সেকেন্ড। 
 
কাজেই উপরের উদাহরণ থেকে বুঝা যায়, প্রাকৃতিক নির্বাচনকে গোনায় ধরলে  ব্যাপারগুলো আর ‘অসম্ভব’ থাকে না, বরং  অনেক সহজ হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে পরীক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ; তারপরেও উপরের উদাহরণটির কিছু ত্রুটি আছে।। একে তো এ ধরনের প্রোগ্রাম খুব সরল, তার উপর সঠিক বাক্য বা অক্ষর নির্বাচিত হবার সাথে সাথে  ‘ সেটিকে আলাদা করে রাখা’র ব্যাপারটা কিন্তু সেইভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে প্রকাশ করে না। প্রাকৃতিক নির্বাচন জিনিসটি তাহলে কি? আমি মুক্তমনায় আমার আগের একটি লেখায় প্রাকৃতিক নির্বাচন জিনিসটাকে ব্যাখ্যা করার জন্য বেছে নিয়েছিলাম নীচের তিনটা ধাপকে[19] –
 
 
১) জনপুঞ্জের অধিবাসীরা নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করে (জীববিজ্ঞানীরা এর একটা গালভরা নাম দিয়েছেন – ‘রেপ্লিকেশন’ ) ।
 
২) প্রতিলিপি করতে গিয়ে দেখা যায় – প্রতিলিপি গুলো নিঁখুত হয় না, অনেক ভুল ভাল হয়ে যায় (জীববিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘মিউটেশন’ বা পরিব্যক্তি )
 
৩) এই ভুল ভালের কারণে প্রজন্মে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের তারতম্য ঘটে (জীববিজ্ঞানিরা বলেন ‘ভ্যারিয়েশন’ বা প্রকরণ )
 
কাজেই প্রতিলিপি, পরিব্যক্তি এবং প্রকারণের সমন্বয়ে যে নির্বাচন প্রক্রিয়া জীবজগতের জনপুঞ্জে যে পরিবর্তনের জন্য দায়ী তাকেই আমরা প্রাকৃতিক নির্বাচন নামে অভিহিত করব। কাজেই এই ধরণের প্রাকৃতিক নির্বাচনকে গোনায় ধরলে আমাদের উপরের সমস্যাটা কিভাবে সমাধান করতে হবে? করতে হবে মিউটেশন এবং রেপ্লিকেশনের ব্যাপারটা মাথায় রেখে, এবং সেখান থেকে শুরু করে।
 
বিক্ষিপ্ত পরিব্যক্তি (random mutation) এবং  প্রতিলিপির (replication) ব্যাপারটা মাথায় রেখে  অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স নিজ হাতে আশির দশকে একটি প্রোগ্রাম লেখেন, প্রথমে জি ডাব্‌লিউ বেসিক ভাষায়, এবং পরে প্যাস্কেলে, যেটাকে এখন অভিহিত করা হয় Weasel program  নামে। বানর দিয়ে পুরো হ্যামলেট না লিখে তিনি হ্যামলেট এবং পলোনিয়াসের মধ্যকার কথোপকথনের  একটি উদ্ধৃতি – METHINKS IT IS LIKE A WEASEL সিমুলেশনের জন্য তার প্রোগ্রামে ব্যবহার করেন। তবে তিনি অন্ধভাবে টাইপরাইটার বা কিবোর্ড টেপা কোন বানর খুঁজে পাননি, তার বদলে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তার এগারো মাস বয়সী কন্যাকে – কম্পিউটারেরর কিবোর্ডের সামনে বসিয়ে দিয়ে। তার কন্যা কম্পিউটারের কিবোর্ডে হাত রেখে টাইপ করেছিলো নীচের অর্থহীন কিছু অক্ষরমালা –
 
WDLTMNLT DTJBKWIRZREZLMQCO P
 
এই অক্ষরমালাকেই তিনি প্রতি জেনারেশন বা প্রজন্মে  প্রতিলিপি করতে দেন ডকিন্স। যেহেতু তিনি জানতেন জীবজগতে প্রতিলিপি গুলো নিঁখুত হয় না, অনেক ভুল ভাল হয়ে যায় (অর্থাৎ মিউটেশন ঘটে), ডকিন্সও প্রতিলিপিতে কিছু ‘ভুল হবার’ সুযোগ করে দেন তার সিমুলেশনে, ফলে  প্রতি প্রজন্মে একটি বা দুটি অক্ষর পরিবর্তিত হয়ে যাবার সুযোগ থাকতো। তিনি এভাবে সিমুলেশন করে এগিয়ে গিয়ে  অনেকটা এ ধরণের ফলাফল পেলেন –
 
প্রজন্ম 0১:   WDLTMNLT DTJBKWIRZREZLMQCO P
প্রজন্ম 0২:   WDLTMNLT DTJBSWIRZREZLMQCO P

প্রজন্ম ১০:   MDLDMNLS ITJISWHRZREZ MECS P


প্রজন্ম ২০:   MELDINLS IT ISWPRKE Z WECSEL


 
প্রজন্ম ৩০:   METHINGS IT ISWLIKE B WECSEL


 
প্রজন্ম ৪০:   METHINKS IT IS LIKE I WEASEL

প্রজন্ম ৪৩:   METHINKS IT IS LIKE A WEASEL
 
অর্থাৎ একেবারেই অর্থহীন কিছু অক্ষরমালা থেকে ৪৩ প্রজন্ম পরে তিনি  METHINKS IT IS LIKE A WEASEL এর মতো অর্থপূর্ণ বাক্যাংশ গঠিত হতে দেখলেন। ডকিন্স তার ব্লাইন্ড ওয়াচমেয়ার বইয়ে বলেছেন, তিনি যখন প্রথমে বেসিক ভাষায় প্রোগ্রামটি লিখে লাঞ্চের জন্য আধা ঘন্টার বাইরে গিয়েছিলেন,ফিরে এসে দেখেন এর মধ্যেই METHINKS IT IS LIKE A WEASEL বেরিয়ে গিয়েছিলো।পরে তিনি একই প্রোগ্রাম প্যাস্কাল  ব্যবহার করে লিখেছিলেন, এবং তাতে সময় লেগেছিল মাত্র ১১ সেকেন্ড। নীচে ভিডিওগুলো থেকে ডকিন্সের এই সিমুলেশন সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে –
 
httpv://www.youtube.com/watch?v=OvEl1lOc0Iw
 
এছাড়া সিমুলেশন প্রক্রিয়াটি বুঝার জন্য দেখা যেতে পারে এটাও –
 
httpv://www.youtube.com/watch?v=AXxCsHGIxww
 
 
১৯৮৪ সালের দিকে  গ্লেনডেল কলেজের রিচার্ড হার্ডিসন  একই ধরনের স্বতন্ত্র একটি  কম্পিউটর প্রোগ্রাম তৈরী করে তাতে দেখান যে  এভাবে র‌্যান্ডমলি ‘মিউটেশন বা পরিব্যক্তি ঘটতে দিয়ে’   শেক্সপিয়রের গোটা হ্যামলেট নাটিকাটি সারে চার দিনে একেবারে অগোছালো অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ সঠিক ভাবে পুনির্বন্যস্ত  করা সম্ম্ভব[20]।
 
তারপরেও ডকিন্সের সিমুলেশনেরও কিছু সমালোচনা আছে। তার প্রোগ্রামও সরলতার দোষে দুষ্ট। এ ছাড়া তার প্রোগ্রাম একটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যকে (long term goal) সামনে রেখে চালিত (এ ক্ষেত্রে অভীষ্ট লক্ষ্যটি ডকিন্সই নির্বাচন করেছিলেন – METHINKS IT IS LIKE A WEASEL)। বিবর্তন কিন্তু এ ধরনের কোন সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগোয় না। তিনি নিজেই ‘ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার’ বইয়ে তার প্রোগ্রামের এই সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছিলেন  এভাবে –

Although the monkey/Shakespeare model is useful for explaining the distinction between single-step selection and cumulative selection, it is misleading in important ways. One of these is that, in each generation of selective ‘breeding’, the mutant ‘progeny’ phrases were judged according to the criterion of resemblance to a distant ideal target, the phrase METHINKS IT IS LIKE A WEASEL. Life isn’t like that. Evolution has no long-term goal. There is no long-distance target, no final perfection to serve as a criterion for selection, although human vanity cherishes the absurd notion that our species is the final goal of evolution. In real life, the criterion for selection is always short-term, either simple survival or, more generally, reproductive success.

তারপরেও ডকিন্সের এই উইসেল প্রোগ্রাম এই অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি দেখালেন – পরিব্যক্তি এবং প্রতিলিপির প্রভাবে ঘটা ক্রমবর্ধমান নির্বাচনের মাধ্যমে আপাতঃ অসম্ভব বলে মনে হওয়া ঘটনাও স্বাভাবিক নিয়মে ঘটতে পারে। সেজন্যই তিনি তার বইয়ে বলেন –

ক্রমবর্ধমান নির্বাচন জীবনের অস্তিত্বের সমস্ত আধুনিক ব্যাখ্যার চাবিকাঠি। এটা এক বিনি সূতার মালায় খুব সৌভাগ্যপ্রসূত ঘটনা (বিক্ষিপ্ত পরিব্যক্তি)গুলোকে গ্রন্থিত করে চলে অবিক্ষিপ্ত এক অনুক্রমে; ফলে অনুক্রমের শেষে এসে আমরা যখন চূড়ান্ত কাঠামোর দিকে তাকাই তখন আমাদের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রম তৈরি হয়, আমরা ভাবি – এধরনের কাঠামো তৈরি হবার সম্ভাবনা এতোই কম যে, চান্সের মাধ্যমে এমনি একটি কাঠামো তৈরিতে যে সময় লাগবে – তার তুলনায়  সমগ্র মহাবিশ্বের বয়সও অতীব নগন্য।

ডকিন্স পরবর্তিতে তার প্রোগ্রামটিকে আরো উন্নত করেন, এবং  METHINKS IT IS LIKE A WEASEL বাদ দিয়ে কোন সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ছাড়াই সিমুলেশন ঘটান। গাছের থেকে যেমন শাখা প্রশাখা বিস্তার লাভ করে, ঠিক সেভাবেই ‘জিন নির্বাচনের’ মাধ্যমে বিবর্তনকে কম্পিউটারে চালিত করে  সরল অবস্থা থেকে মাকড়শা কিংবা  অক্টোপাস সদৃশ জটিল জীবজগতের কাঠামো  তৈরি করে দেখান, তার সেই প্রোগ্রামের নাম দেন ‘বায়োমর্ফ’। ডকিন্সের বায়োমর্ফ সম্বন্ধে জানতে হলে এই ভিডিওটি দেখা যেতে পারে – 
 
httpv://www.youtube.com/watch?v=4ThaHhIkYAc
 
ডকিন্স তার পরবর্তী বই ‘ক্লাইম্বিং মাউন্টেন্ট ইম্প্রোবেবল’এ অন্য প্রোগ্রামারদের লেখা আরো কিছু জটিল প্রোগ্রামের উল্লেখ করেন বিবর্তনের বাস্তবসম্মত মডেল তুলে ধরতে। এমনি একটি মডেলের অ্যানিমেশন দেখানো হল এখানে –

 


ছবি:   বিবর্তনের বায়োমর্ফ সিমুলেশনের একটি জটিল গাণিতিক মডেল

 
এ গাণিতিক সিমুলেশনের সবগুলোই আমাদের খুব পরিস্কারভাবে দেখিয়েছে যে নন-র‌্যান্ডম প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবে জটিল জীবজগতের উদ্ভব ঘটতে পারে, কোন ধরণের ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই। মূলতঃ অধ্যাপক হয়েল প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যাপারটা ঠিকমত বোঝেননি বলেই তিনি জটিল জীবজগতের উদ্ভবকে কেবল চান্স দিয়ে পরিমাপ করতে চেয়েছিলেন এবং একে  বোয়িং ৭৪৭ উপমার সাথে তুলনা করে ফেলেছিলেন। এমনকি হয়লের চান্সের গণনাও সম্প্রতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। যেমন, টক অরিজিন সাইটে ডঃ ইয়ান মাসগ্রেভ Lies, Damned Lies, Statistics, and Probability of Abiogenesis Calculations প্রবন্ধে হয়েলের অজৈবজনি (Abiogenesis) সংক্রান্ত গণনার নানা ভুলভ্রান্তির প্রতি নির্দেশ করেছেন[21] । একটি ভ্রান্তি এই যে, হয়েল সম্ভাবনা পরিমাপের সময় প্রতিটি ঘটনাকে একটির পরে একটি – এভাবে সিরিজ বা অনুক্রম আকারে সাজিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃতির সিমুলেশনগুলো এভাবে সিরিজ আকারে ঘটেনি, অনেকগুলোই ঘটেছে সমান্তরাল ভাবে। ফলে সময় লেগেছে অনেক কম। আপনার চারজন বন্ধুকে চারটি মূদ্রা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঝোঁকমুক্ত ভাবে নিক্ষেপের সুযোগ করে দিলে- চারটি HHHH পেতে যে সময় লাগবে, সেই একই ফলাফল (অর্থাৎ চারটি HHHH) পেতে আপনার ষোলজন বন্ধুকে লাগিয়ে দিলে অনেক তাড়াতাড়িই কাঙ্খিত ফলাফল বেরিয়ে আসবে। ঠিক একই ভাবে, একটি বানর দিয়ে পুরো হ্যামলেট পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম মনে হলেও, যদি এক লক্ষ বানরকে একই কাজে লাগিয়ে দেওয়া যায়, তবে আর সেরকম অসম্ভব কিছু মনে হবে না। সেজন্যই ইয়ান মাসগ্রেভ তার প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, ‘যদি এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সম্ভাবনার কোন কিছু ঘটিয়ে দেখাতে চান – তা হলে চীনের জনসংখ্যার মত চলক নিযুক্ত করে দিন’। আর ডকিন্সের মত ইয়ান মাসগ্রেভও মনে করেন, সৃষ্টিবাদীদের বোয়িং উপমার সাথে বিবর্তনবাদের পার্থক্য মূলতঃ এই জায়গাটিতে –
 

creationist_vs_abiogenesis

ছবি:  অধ্যাপক হয়েল ভেবেছিলেন কতকগুলো রাসায়নিক পদার্থ মিলেমিশে হটাৎ করেই ব্যাকটেরিয়ার মত জটিল জীবের  অভ্যুদয় হওয়াটাই অজৈবজনি, কিন্তু সত্যিকার  অজৈবজনি কখনোই সেরমকভাবে একধাপে ঘটে না।

 
সব মিলিয়ে  হয়েলের জঞ্জাল থেকে বোয়িং উপমা জীববিজ্ঞানে বহু আগেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। খ্যাতনামা জীববিজ্ঞানী জন মায়নার্ড স্মিথ তো স্পষ্ট করেই বলেন, ‘কোন জীববিজ্ঞানীই হয়লের মত চিন্তা করেন না যে, জটিল কাঠামো জঞ্জাল থেকে বোয়িং-এর মতো এক ধাপে হুট করে তৈরি হয়'[22]। হয়েলের এই বোয়িং উপমার সমালোচনা সময় সময় করেছেন স্ট্রাহেলার,ম্যাক্লিভার, কাউফম্যান, দ্য দ্যুভে, পিটার স্কেলটন, রুডলগ রাফ, পেনক, ম্যাট ইয়ং এবং ডেনিয়েল ডেনেট সহ বহু বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকই।  মূলতঃ হয়েলের এই অপরিনামদর্শী উপমাকে এখন অবহিত করা হয়ে থাকে হয়েলের হেত্বাভাষ (Hoye’s fallacy) হিসেবে[23]।  
 
রিচার্ড ডকিন্স তার সাম্প্রতিক ‘গড ডিলুশন’  (২০০৬) বইয়ে রসিকতা করে বলেন, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা জটিল জীবজগতের উদ্ভবের তাও একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাই। কিন্তু  ঈশ্বর নামে সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান এক জটিল সত্ত্বা হুট করে কোথা থেকে উদ্ভুত হল, তার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই আমরা কোথাও পাইনা, কখনো পাবোও না। তাই  ঈশ্বরই হচ্ছেন  হয়েলের ‘আল্টিমেট বোয়িং ৭৪৭’ [26]।
 
httpv://www.youtube.com/watch?v=LRQQmCpmuGc 
 
 
তথ্যসূত্র:

[1] অভিজিৎ রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অঙ্কুর, ২০০৬ দ্রঃ
[2] Huxley T.H. the animals which are most nearly intermediate between birds and reptiles. Geol. Mag. 5, 357–65; Annals & Magazine of Nat Hist 2, 66–75; Scientific Memoirs 3, 3–13, 1968
[3] পরে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে স্থানান্তরিত; লন্ডন স্পেসিমেন হিসেবে গন্য
[4] বার্লিন স্পেসিমেন হিসেবে গন্য
[5] ম্যাক্সবার্গ স্পেসিমেন হিসেবে গন্য
[6] Charig, A.J.; Greenaway, F.; Milner, A.N.; Walker, C.A.; and Whybrow, P.J., “Archaeopteryx is not a forgery”. Science 232 (4750): 622–626, 1986
[7] Wellnhofer P. , A New Speciment of Archaeopteryx,  Science 240, 1790, 1988.
[8] Tim Berra, Evolution and the Myth of Creationism: A Basic Guide to the Facts in the Evolution Debate, Stanford University Press, 1990,  p41.
[9] Elliot Meyerowitz of Caltech quoted by Gail Vines, New Scientist 2 Dec 2000 p36-39.
[10] Hoyle Fred, The Intelligent Universe. New York: Holt, Rinehart and Winston, 1983, pp. 18-19 .
[11] Fred Hoyle and Chandra Wickramasinghe, Lifecloud: The Origin of Life in the Universe, 1978, p.15-16
[12] Fred Hoyle and Chandra Wickramasinghe, Our Place in the Cosmos, 1993, p.14 
[13] Derek Gatherer, The Open Biology Journal, 2008, 1, 9–20, Finite Universe of Discourse: The Systems Biology of Walter Elsasser (1904–1991)
[14] Why Evolution Isn’t Chance, http://www.ebonmusings.org/evolution/evonotchance.html
[15] Nilsson, D.-E., and S. Pelger. 1994. A pessimistic estimate of the time required for an eye to evolve. Proc. Roy. Soc. Lond. B 256:53-58.
[16] অভিজিৎ রায় এবং ফরিদ আহমেদ, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, অবসর, ২০০৭
[17] Haiti earthquake survivor Evan Muncie trapped under rubble for 27 days, Times Online, February 10, 2010,  http://www.timesonline.co.uk/tol/news/world/us_and_americas/article7021168.ece
[18]  Richard Dawkins, The Blind Watchmaker: Why the Evidence of Evolution Reveals a Universe without Design, W. W. Norton & Company, 1996, page 49.
[19] অভিজিৎ রায়, বিবর্তনের সহজ পাঠ,যুক্তি, সংখ্যা ৩, জানুয়ারি ২০১০; এ ছাড়া অনলাইনে পড়ুন, এক বিবর্তনবিরোধীর প্রত্যুত্তরে : https://blog.mukto-mona.com/?p=936   
[20] John Rennie, Scientific American, July 2002, “15 Answers to Creationist Nonsense”, page 81
[21] Ian Musgrave, Lies, Damned Lies, Statistics, and Probability of Abiogenesis Calculations, TalkOrigins Archive.
[22] John Maynard Smith, The Problems of Biology, p.49. (1986), ISBN 0-19-289198-7, “What is wrong with it? Essentially, it is that no biologist imagines that complex structures arise in a single step.”
[23] George Johnson, Bright Scientists, Dim Notions NY Times, October 28, 2007
[24] বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর, ২০০৭
[25] Richard Dawkins, The God Delusion, Houghton Mifflin Harcourt; 2006, page 114