সিমন জোহান্স কারমিখেল(জন্মঃ১৯১৩-মৃত্যু১৯৮৭)নেদারল্যান্ডে ।ঔপন্যাসিক ও কলামলেখক।
তার বাবা মাংসের দোকানে চাকরী করতেন আর মার ছিল একটা হ্যাট ও ক্যাপের দোকান।
পরিবারটি ছিল সমাজতান্ত্রিক,এন্টিফ্যাসিস্ট মতবাদের।
তার কর্মজীবনের শুরু হেগের ‘হেট ভল্ক’পত্রিকায় সাংবাদিকতা দিয়ে।প্রতিদিনের কলামে নাটক ও সিনেমার সমালোচনাও লিখতেন।১৯৩৯ সালে টিনি দে গুইয়ের সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।
দিতীয় মহাযুদ্ধ লাগলে জার্মানী নেদারল্যান্ড দখল করে নেয়। এতে প্রেসের কাগজের ওপর নিষেধাজ্ঞা
চলে আসলে, তিনি চাকরী ছেড়ে দেন ও বন্ধুদের সাথে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা ‘হেট প্যারল’এ যোগ দেন।
নেদারল্যান্ড জার্মানী থেকে মুক্তহওয়ার পর তিনি এতে প্রায় প্রতিদিন কলাম লেখা শুরু করেন।
তিনি অনেক উপন্যাসও লিখেছেন।
তার কলামে তিনি মানুষের জীবনের নিত্য দিনের ঘটে যাওয়া অসংখ্য গল্প রঙ্গ-রস মিশিয়ে লিখেছেন।
কলামগুলি লিখতেন বাড়ীতে,পার্কের বেঞ্চে অথবা রেষ্টুরেন্টের টেরাসে(সামনের খোলা জায়গা)।
শহরে ঘুরে ঘুরে তিনি লেখার মালমশলা যোগাড় করতেন। মানুষের বাহিরের সাথে তার ভেতরের কথাও বের করে আনতেন তার কলমের ডগায়।
রেডিও ও টেলিভিশনেও তার হিউমার নিয়ে উপস্থিত হতেন তিনি।
পানাসক্তি,ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে ভূগে ১৯৮৭তে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
(অনেকদিন আগে অনুবাদটা করেছিলাম, জানিনা কারমিখেল মুক্তমনার লেখক ও পাঠকদের কাছে কেমন লাগবে)!
“সকল জাতিই শান্তি চায়, কোন সরকারই তা চায় না”!
পাউল লেউটাডের শ্রমিক সম্মেলনের উক্তিটি আমি যখন ছোট ছিলাম লোকমুখে বেশ জনপ্রিয় ছিল।আমার চার বছরের বড় ভাই তখনও হাল ছাড়েনি।সে ছিল তরুন ‘শান্তিসংঘের’সদস্য কৃষকদের কাছে ব্রোশিউর বিক্রি করে করে ডোনেটর বাড়াবার জন্য উদবুদ্ধ করত। সে মনে করত আমারও এসব জানা উচিত,
তাই সে একদিন সন্ধ্যায় আমাকে নূতন সদস্য হিসাবে তাদের দলের মূলনীতি শেখাতে নিয়ে গেল।
আমরা প্রথমে আমার মার খালাত বোন রিয়া খালার বাসায় গেলাম।তিনি তিন তিনটা ছোট ছেলে মেয়ের মা, কিন্তু দেখতে তরুনী।খালু স্প্যানিশ জরে মারা গিয়েছেন।একটু মোটা হলেও সুন্দরী,তাকে দেখে হয়ত জার্মান সৈন্যরা ই-উ-পি বলে শিস্ দিত।অথবা তিনি হতে পারতেন গত শতাব্দীর ন্যুড ফটোর আদর্শ
মডেল!তখন আদর্শ সুন্দরী বলতে ফিল্মি সুন্দরীদের বোঝাত।
রিয়া খালার ধারনাই ছিলনা আমরা কি জন্য এসেছি।তিনি আমাদের সাদরে গ্রহন করলেন।চায়ের সাথে একটা ডিমের মত বেশ দামী রুপার কৌটা থেকে একটা করে বিস্কিট নিতে বললেন।কৌটাটা লুকিয়ে রাখার পর তার ছেলেমেয়েরা গত চার মাসে কি কি মজার ঘটনা ঘটিয়েছে তা বলতে শুরু করলেন!তার উতসাহে পরিবেশটা চমতকার হয়ে উঠছিল।কিন্তু আমার ভাই বাধা দিল।
তার ব্যাগ খুলতে খুলতে সে বলা শুরু করল খালা, বিশ্শযুদ্ধ থেকে সরকার কিছুই শেখেনি।নিরস্ত্রবাদের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে বলতে সে ব্রোশুর্ গুলো টেবিলের ওপর রেখে যত্নের সাথে দাম বসিয়ে দিতে
লাগল যেন নিলামে বসেছে।
হঠাত রিয়া খালা কান্না শুরু করলেন আমার ভাই চুপ।
নিঃশব্দে আমরা তার অশ্রুবর্ষণ দেখতে লাগলাম।কারণ বয়স্কদের কান্না দেখবার সৌভাগ্য আমাদের হয়না।কান্না শেষে তিনি বলে উঠলেন “আহা ছেলেরা এটা ভাল যে তোমরা এ ব্যাপারে এত উতসাহী কিন্তু আমার যে টাকা নেই”,তোমার খালু আমাকে সম্পূর্ণ নিঃসহায় রেখে চলে গেছে।সে ছিল মিষ্টি হালকা সভাবের,ভবিষ্যতের ভাবনা কখনও ভাবেনি।ছবি এম্ব্রডারী ও সেলাই করে আমি সংসার চালাই। এম্ব্রডারী গুলো আমি পাঁচ গিল্ডারে বিক্রি করি জানো!দাঁড়িয়ে সেগুলোর কয়েকটা তিনি আমাদের দেখাতে লাগলেন, পরচুলা যুগের সৌখিন জিনিস সেগুলো।
তিনি বললেন ‘খুবসুন্দর’ তাইনা?তখনও কয়েকটা অশ্রুবিন্দু তার গালে লেগে ছিল।কয়েকটা নিয়ে যাও সাথে, হয়ত তোমাদের মা কিনতে পারে!একজোড়া?তার সূচীকর্ম খবরের কাগজ দিয়ে মুড়ে আমরা রাস্তায় বের হই।
প্রচন্ড শীত ও বৃষ্টির সন্ধ্যা আমাদের বিচলিত করতে পারেনা।।দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় আমরা প্রালদের বাসার দিকে চললাম।তারা আমাদের আত্তীয় না হলেও বাবামার বন্ধুপরিবার।প্রাল ভদ্রলোকের বংশ পরিচয় তেমন নয়!
সে একটা পাইকারী মশলার দোকানে চাকরী করত।একবার ছাত্ররা এক থিয়েটার শো’র আয়োজন করলে তারা আমার বাবামার সাথে দেখতে গিয়েছিল,হঠাত করে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে পরে ও ছাত্রদের সাথে সমবেত সঙ্গীতে অংশগ্রহন করে,যদিও তার সঙ্গীতচর্চা ছিলনা।আমার মা থতমত খেয়ে বলেছিলো আহা,
করছেনকি!করছেনকি!কিন্তু তার গাওয়া থামেনি।
প্রাল দম্পতির একটা সতের বয়সের ছেলে আছে।নাম ‘আরি’।ভবিষ্যত ব্যাঙ্কের বড় কর্মকর্তা হবার বাসনা তার। কিন্তু ঐ সন্ধ্যায় ভেতরে ঢুকে মেঝেয় বসে তার পুজেল খেলা দখে সেটার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে হল।চওড়া কাধেঁর মিষ্টার প্রাল ইজিচেয়ারে এমন ভাবে বসেছেন,যেন ওটা সিংহাসন!তরুন বয়সে তীব্র প্রানশক্তি দিয়ে তিনি যে স্ত্রীকে জয় করে নিয়েছিলেন,তার অসাধারণ অধরা সৌন্দর্য ক্ষয়িঞ্চুতার পথে। এনগেজমেন্ট হয়ার পর এক তরুন চিত্রশিল্পী
তাদের গাড়ীতে কফিহাউসে নিয়ে যাবার পথে স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছিলেন বলে তিনি তার কান ধরে মুচড়ে দিয়েছিলেন।আমি তাদের মধ্যে “তরুন শান্তি সংঘের”ডোনেটর হওয়ার সম্ভাবনা দেখলামনা।
কিন্তু আমার ভাই সাহস করে মুখ খুললঃ “বিশশযুদ্ধ থেকে সরকার কিছুই শেখেনি” সে ব্রোশুর্ গুলো আবার বের করতে শুরু করল।মিঃপ্রালের মুখে একটা অহংকারী হাসি ফুটে উঠল,আর তার স্ত্রী যাকে সে আদর করে মপি বলেডাকে, তাকে যেন একটু চঞ্চল মনে হল!আরি তখনও নিঃশব্দে পুজেল মিলাচ্ছে।প্রাল বলল হুঁ, “আছা ধর আমরা নিরস্ত্র হলাম আর শত্রু আসল”? ‘সেটা কখনই হবেনা’-একটা নিরস্ত্র দেশকে আক্রমন করা অনৈতিক।আবার যদি নুতন করে যুদ্ধ লাগে তবে লক্ষ লক্ষ নিরীহ লোক এর শিকার হবে।
পৃথিবীতে এখন অনেক লোক, প্রালের উত্তর !
কার কথা বলছেন আপনি?আমার বাবা,আমি,আপনি আর আরি?
এইবার আরি শব্দ করে মৃদ্যু হেসে উঠল।
যখন আমরা অসফল হয়ে রাস্তায় নামলাম,পিছনে কার যেন দ্রুত পদশব্দ শুনলাম!
মিসেস প্রাল!হাঁফাতে হাঁফাতে এসে তিনি ভাইকে আড়াই গিল্ডার দিলেন।বাতাস তার সোনালী কোঁকড়া চুল উড়িয়ে এক গোছা চুল কপালে ফেলল!ধীরে ধীর পা ফেলে তিনি বাড়ীর দিকে চললেন।
লেখাটার জন্য লাইজু নাহারকে ধন্যবাদ । ওলন্দাজ় ভুমিতে কৈশোর কাটিয়েছি আর তাই ওখান কার কিছু বাংলার পাঠকদের মাঝে দেখে খুশি হ্লাম।
সিমন ইয়োহানেস কারমিখল্ত (ওলন্দাজ় উচ্চারণ) মূলত জনপ্রিয়তা লাভ করেন ক্রংকল (Kronkel) ছদ্মনামে হেট পারল-এ কলাম লেখার সময় ।
@বিজয়,
ছোটবেলা এখানে কাটিয়েছেন জেনে খুশি হলাম!
আপনাকেও ধন্যবাদ!
@লাইজু নাহার,
আমার মতে, ওলন্দাজ ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি পশ্চিমা বিশ্বের মাঝে সবচেয়ে উদার এবং সৃজনশীল যা কিনা এক কথায় ‘মুক্তমনা’ । তারপরেও , বাংলা ভাষায় ওলন্দাজ সাহিত্যের অনুবাদ চোখে পড়ে না । সময় এবং অনুপ্রেরণার অভাবে আমি নিজেও কিছু অনুবাদ করতে পারছিনা বলে প্রায়ই খারাপ লাগে । এবার চেষ্টা করবো মুক্তমনা পাঠকদের জন্য ওলন্দাজ সাহিত্য থেকে নেয়া অনুবাদ নির্ভর কিছু লিখতে । এক্ষেত্রে আপনার লেখাকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে ধরে নিলাম ।
গল্পটা আমার কম করে হলেও ৫ বার পরা হয়েছে। কিন্তু ছোটবেলা থেকে সারাংশ আর মূলভাব মুখস্ত করে বড় হওয়া এই আমার পক্ষে মন্তব্য করা থার্ড ডিগ্রি বার্নের মত একটা দুঃস্বপ্নের মত।
😥 😥
@আশিকুর রহমান,
আপনি দেশে যদি থাকেন তবে মূলধারার সাহিত্যের সমালোচনা সব
লাইব্রেরীতেই পাবেন।সাহিত্য পত্রিকাগুলোতেও পাবেন।
ঐ গুলো পড়ুন বেশী করে।
পড়তে পড়তে ধারনা চলে আসবে কিভাবে লিখবেন!
এটা আমার সামান্য সাজেশন ভাবতে পারেন।
দেশের বাইরে থাকায় ইচ্ছা থাকলেও এসব পড়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনা।
এতবার গল্পটা পড়েছেন জেনে খুবই ভাল লাগছে!
@লাইজু নাহার,
ধন্যবাদ আপনাকে। 🙂
@আফরোজা আলম,
সাহিত্যের গ্রামার উপভোগ করার মত পাঠক মনে হয় মুক্তমনায় তেমন কেউ নেই।
😥 😥 😥
@আশিকুর রহমান,
আমি সাহিত্য সংস্ক্রিতি ভালবাসি।
মনে করি এগুলোতেই সমাজবদলের উপাদান থাকে।
সাংস্ক্রিতিক মুক্তিই রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য!
ধন্যবাদ মূল্যবান মন্তব্যের জন্য!
@আশিকুর রহমান,
সাহিত্যবোদ্ধা যে একেবারেই নেই তা নয়। আপনি, আফরজা, লাইজু সহ অনেকেই আছেন। অনেকেই ত দেখি নিজেদের ব্লগে চুটিয়ে কবিতা লিখছেন। এদের আবার অনেকে বইও প্রকাশ করে চলেছেন সমানে। এরা অন্যদের সাহিত্য আলোচনায় অংশ নেন না কেন কে জানে!
সে যাই হোক, আপনারাই সাহিত্য নিয়ে আলোচনা সমালোচনার নতুন ট্রেন্ড তৈরি করতে পারেন। দেখবেন অনেকেই চলে আসবে।
@অভিজিৎ,
:yes: :yes:
@আফরোজা আলম,
গল্পটা ভালো লাগার জন্য অজস্র শুভেচ্ছা!
অভ্র এখনও অতটা রপ্ত করতে পারিনি, চেষ্টা করছি।
মুক্তমনায় থাকবেন এই আশায় থাকলাম!