নিউইয়র্কে কন্যার বাসায় বেশ কিছুদিন হল বাংলাদেশের চারটি টিভি চ্যানেল এসেছে। আমরা স্বস্তি পেলাম এই ভেবে যে, আমাদের আমেরিকান নাতী-নাতনীরা এখন শুদ্ধভাবে বাংলা বলা শিখবে। হা হতোহম্মি! বাংলাদেশের টিভিগুলো থেকে ওরা বাংলা শিখবে কি ! ঢাকার বাঙালীরা যে বাংলা বলছে, তার আদর্শ ত আমাদের নাতী-নাতনীরাই। এ উৎকট বাংলার নতুন একটি নামাকরণের যেন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
ইংরেজীর মাধ্যমে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরিত হয়েছে এবং হচ্ছে বলে, বাংলার উপরে ইংরেজীর একটা প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। বাচনিক বাংলা সে প্রভাবটার তোড়ে এক সময় শ্র“তিকটু হয়ে ’বাংলিশ’ নামে আখ্যায়িত হয়েছিল । বাংলিশে বাংলাই প্রধান ছিল। কিন্তু ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম ছাড়া বাকি পদগুলিও ইংরেজীর দখলে চলে যাবার উপক্রম হওয়ায় ’বাংলিশ’ বাংলা ইংরেজী প্রধান হয়ে এবার ’ইংবা’ হয়ে গেল। শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী, রাজনীতিবীদ, মন্ত্রী-সাংসদ, সরকারী কর্মচারী, আমলা-সেনা-পুলিশ, উকিল-মোক্তার, ডাকতার-কবিরাজ, কৃষক-শ্রমিক, রিকশাওয়ালা-ফেরিওয়ালা, পন্ডিত-গবেষক এমন কোন পেশা নেই, যে পেশার মানুষেরা আজ আর শুদ্ধ বাংলা বলে বা বলার চেষ্টা করে। গোঁদের উপর বিষফোঁড়া ইলেট্রনিক মাধ্যমগুলি বিশেষ করে টিভি মাধ্যমগুলি। ভাষার পক্ষে দাঁড়ানোর অতুলনীয় ক্ষমতা থাকা সত্তেও ওরাই যেন হৈ চৈ করে বাংলা হত্যায় মেতেছে। অনর্থক ইংরেজীর ফোড়ন দিয়ে যারা নিজেরাই বাংলা বলে, অন্যদের উৎসাহ দেয়ার বা বাধ্য করার ক্ষমতা তারা পাবে কোথায়? টেলিভিশন যেহেতু সবচেয়ে ক্ষমতাশালী গনমাধ্যম, তাদের সু অথবা কু প্রভাব জনমানসে সর্বাধিক ব্যাপক ও অপ্রতিরোধ্য হয়। অথচ, প্রত্যেক চ্যানেলের প্রধান ব্যক্তিটি মাত্র একবার হুকুম দিলেই সকলের অজান্তে তৈরি হওয়া এই অনাচার রাতারাতি বন্ধ হতে পারে। কিন্তু তাঁরা তা করছেন না। তাঁদের ভয়, চলতি হাওয়ার বিপক্ষে গেলে তাদের দর্শক কমে যাবে, বিজ্ঞাপনের আয়ে ভাটা পড়বে। তারা বলেও বসতে পারেন, এটা আমাদের দায়িত্ব নয়।
দায়িত্বটা যেন কারও নয়। সকলের এ দায়িত্বহীনতা ও ঔদাসীন্যতার পরিবেশে, লক্ষ লক্ষ টেলিভিশন, লক্ষ লক্ষ গৃহফোন, মুঠোফোন, ক্যমপিউটর, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, কল-কারখানা, মাঠঘাট, হাট-বাজার, শেখ মুজিবের সোনার বাংলার প্রতিটি ঘরে (যেখান থেকে যার যা আছে তাই নিয়ে মানুষ একদিন স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছে), আজ প্রতিদিন প্রতি মূহূর্তে ইংরেজী ভাষা আমাদের মাতৃভাষার উপর স্তরে স্তরে আবর্জনার আস্তরন বসিয়ে চলেছে। আজ এ মূহূর্তে এ প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে ঢাকার কুট্টি, রাওয়ালপিন্ডির লালকুর্তির মত বাংলা ভাষাও একটি ’পিডগিন’ ভাষা হয়ে যাবে। ’পিডগিন’ মানে এমন ভাষা যা পরগাছা ভাষার নীচে চাপা পড়ে যায়।
বাংলার পিডগিন অবস্থা তার বিলুপ্তির প্রথম স্তর। নানা কারনে মানবজাতির ভাষা মরে যায়। জাতি-বিদ্বেষ, যুদ্ধ, মহামারি, অসহ্য দারিদ্র্য, প্রকৃতিক বিপর্যয়, গৃহযুদ্ধ, উন্নত জীবনের প্রত্যাশা ইত্যাদি নানা কারনে দেশান্তরী মানুষের স্রোত এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে প্রবাহিত হয়। এ হিজরতের বলি হয় মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি। এ প্রক্রিয়ায় মানুষের এক কালের হাজার হাজার ভাষা মরতে মরতে বর্তমানে মাত্র ৬৯০৮ টি অবশিষ্ট আছে। এই সেদিন আন্দামানে বো ভাষার একমাত্র ব্যবহারকারী মারা যাওয়ায় ঐ ভাষাটিও মারা গেল। আমরা কি কখনও চাইব আমাদের অন্তত: দেড় হাজার বয়সী ভাষাটির মৃত্যু হোক?
বাংলা ভাষার বিলুপ্তি হবে এমন অলক্ষুনে কথা কোন বাঙালী শুনতেও চাইবেনা। বিশ্বে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য প্রানবিসর্জনের প্রথম ঘটনা বাঙালীই ঘটিয়েছে। এশিয়া মহাদেশের প্রথম নোবেল বিজয়ীর আবির্ভাব এ বাংলা ভাষাতেই হয়েছে। মানবজাতির মানবাধিকারের সবচেয়ে শক্তিশালী বাক্য “ শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”, তাও প্রথম উচ্চারিত হয়েছে এ বাংলায় চতুর্দশ শতাব্দীতে। এই বাঙালীই তার উদার উচ্চমানবিকতাপূর্ন গনতান্ত্রিক সংস্কৃতি রক্ষার জন্য বীরত্বপূর্ন যুদ্ধ করেছে এবং বিজয়ী হয়ে নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য এমন অহঙ্কার কয়টি জাতির আছে! বিশ্বসভা এমন জাতির মাতৃভাষা-শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে উপযুক্ত সন্মান দিয়েছে। বাঙালীরাই হয়ে গেল পৃথিবীর সকল মানুষের ভাষার যতè ও রক্ষার দায়িত্ব মনে করিয়ে দেয়ার আদর্শ। এহেন বাঙালী নিজের রক্তার্জিত ভাষাকে প্রতিদিন প্রতি মূহূর্তে ইংরেজীর কাঁটা চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঝাঝরা করে দিচ্ছে। নিজের এবং স্বজাতির বিরুদ্ধে এ অপরাধের জন্য দায়ী কে? কারা এই সংস্কৃতি সন্ত্রাস চালাচ্ছে?
বাংলা ভাষাকে ভেজাল বানানোর কোন বিশেষ ষড়যন্ত্র আছে, এটা বিশ্বাস করা যায়না। এটি আসলে আমাদের শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর অসাবধানতা, অবজ্ঞা ও সামগ্রিক হীনমন্যতা বোধের ফসল। একুশে ফেব্র“য়ারীর বিনম্র নগ্নপদ প্রভাত ফেরি, উৎসব মুখর বইমেলা সত্বেও এই শ্রেনীর মানুষের অন্তরে গোপনে বাসা বেঁধে আছে পাশ্চাত্তের ভোগবিলাসময় সংস্কৃতি। দেশীয় সংস্কৃতি ওদের বসার ঘরে কাঁচের শোকেসের একটি রুচিসামগ্রী মাত্র। মাটির প্রতি এদের টান বেশি নেই। অথচ এরাই দেশের অধিকাংশ সম্পদ ও দন্ডমুন্ডের মালিক। দেশের ভাল-মন্দ এদের মর্জির উপর নির্ভর করে। রাষ্ট্র-শক্তি-নিয়ামক রাজনৈতিক শক্তিও এই শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মুষ্ঠিগত। এদের সংগে জনগনের সম্পর্ক রাজা-প্রজার। রাজপুরুষদের অনুকরণ প্রভু-ভক্তির লক্ষন। বাংলার এ মধ্যবিত্ত শ্রেনী তাদের প্রভু বৃটিশের অনুকরণ করে তাদের জীবন ধারা গঠন করেছে। এখন তাদের অনুকরণ করছে বাংলার সাধারন মানুষ। তবে প্রজাকূলের অজ্ঞতার কারনে এ ভেজাল বাংলা আরও বিকৃত ও বিষাক্ত হয়ে উঠছে।
বাংলা ভাষার লিখিত রূপটি ক্যমপিউটর ও ছাপামাধ্যমের ব্যাপক বিস্তৃতি এবং বিপুল সংখ্যক লেখক-লেখিকার ক্রমাগত আত্বপ্রকাশের কারনে সহজে পরাভূত হবে না। তবে আজ, এখনই, ব্যবস্থা না নিলে অদূর ভবিষ্যতে বাচনিক বাংলার পিডগিন অবস্থা ঠেকান কঠিন হয়ে যাবে।
মুখের ভাষা বাংলাকে তার স্বাভাবিক মর্যাদা ফেরৎ দিতে হলে সরকারি বেসরকারি দুপ্রকারের ব্যবস্থার যে কোন একটিই হয়ত কাজ দেবে। সরকারি ভাবে একটি মাত্র নির্দেশই যথেষ্ট হবে : সরকারের সকল কর্মচারী শুদ্ধ বাংলায় কথা বলবেন। বাংলার সংগে অকারন ভেজাল দিলে চাকুরীতে অবমূল্যায়ন করা হবে। ব্যস! গ্রামের চৌকিদার থেকে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, প্রাথমিক শিক্ষক থেকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান পর্যন্ত থতমত খেয়ে শুদ্ধ বাংলা বলতে আরম্ভ করবেন। একই সংগে শিক্ষা বিভাগ বাড়তি ব্যবস্থা নিলে সোনায় সোহাগা হবে।
বেসরকারিভাবে কথ্য বাংলাকে নিষ্কন্টক করা একটু কঠিন কারন সেখানে কারও একক কতৃত্ব নেই। তথাপি ব্যক্তমালিকানাধীন গনমাধ্যমগুলি বিশেষ করে টেলিভিশন সমূহ এক যোগে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করলে ধীরে হলেও ফল পাওয়া যাবে। আবার যে কোন একটি টেলিভিশনই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে একাই একশ হতে পারে।
বেসরকারী খাতে যদি এমন হত, যে একটি দেশপ্রেমিক রাজনীতিক দল জনগনকে বুঝিয়ে দেয় ‘বন্ধুগন, যারাই আমার আপনার মায়ের ভাষার সংগে অনর্থক ইংরেজী মেশায়, তারা শোষক এবং বিদেশীদের দালাল। বিদেশ থেকে আসা আপনাদের আত্বীয়স্বজনের ঘামের টাকা দিয়ে ওরা বিদেশী যন্ত্রপাতি কিনে এনে টেলিভিশনের পর টেলিভিশন বসিয়ে যাচ্ছে। এটার উদ্দেশ্য আপনাদের ভাষাটা নষ্ট করে দেয়া। ওই শহুরে মানুষগুলি ভাল না। বঙ্গবন্ধু বলেছেন ঐ ‘ছাপকাপুড়্যা মানুষগুলা থাইক্যা বাঁইচা থাকবা’। পরবর্তী নির্বাচনে জনগন সম্ভবত: বঙ্গবন্ধুর কথাই স্মরন করবে।
পাঠক ! বাংলার সংগে ইংরেজীর ফোড়ন মহামারি হিসাবে দেখা দিয়েছে। এর প্রতীকারে প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে। সমাধানটি সহজ এবং মাত্র কয়েক নিমেষর। কথা বলার ঠিক মূহূর্তে চকিতে ভেবে নিন ইংরেজী ফোড়ন দেবেন না। ব্যস !
কথ্য বাংলা ’পিডগিন’ হয়ে গেলে একদিন ওটা সাহিত্যের ভাষাও হয়ে যেতে পারে। ঐ সর্বনাশটি হলে বাঙালী জাতীয়তাবাদেরও ঘটবে নীরব অবলুপ্তি। বিষয়টি জরুরী চিন্তার দাবীদার। বিষয়টির সংগে ইংরেজী শিক্ষার কোন দ্বন্ধ নেই। ইংরেজী বিশ্বজনের ভাষা; মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান মাধ্যম ও আকর। ইংরেজী আমাদের শিখতেই হবে; তবে বলতে হবে যথাস্থানে এবং যথাযত ভাবে। বাংলার সংগে ইংরেজী এবং ইংরেজীর সংগে বাংলা বলা অশিক্ষা ও কুশিক্ষার লক্ষন।
যেহেতু এসেছে চির অম্লান একুশে ফেব্রুয়ারী
দেখি বাংলায় শুদ্ধ অশুদ্ধ কতটা খুঁজতে পারি
অফিসে-মেলাতে দোকানের নামে শুরু হবে বাড়াবাড়ি
বাংলার তরে ভাষন মিছিলে আহত চোয়াল ও মাড়ি
(যেন রমজানে মাথায় টুপি, বন্ধ কামানো দাড়ি
বাকি বছরটা ফি আমানিল্লা, খেয়ে যাও মদ তাড়ি)
সালাম রফিক বেঁচে থাকলে বিষন্ন হতো ভারী
how can we forget them, we are really sorry!
কুকুর পুচ্ছ সরল হতে বহু দেরী বহু দেরী!!
ভাষা কখন অশুদ্ধ সেটা নিয়ে আমার দ্বিমত আছে। বাংলা আর ইংরেজী শব্দ মিশান বাক্যে বাংলা শব্দগুলি যদি শুদ্ধ (বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী) ভাবে উচ্চারন করা হয় তাহলে সেটা অশুদ্ধ বাংলা বলা যায় না। মিশ্র বাক্য বলা যায়। সেটা ভাল না মন্দ, উচিত না অনুচিত সে বিচারে যাচ্ছি না। সে বিচারটা অবশ্যই ব্যক্তিনির্ভর। বরং বাংলা শব্দকে ভুল উচ্চারন করে বা ব্যাকরণ না মেনে বাক্য গঠন করা হলে বা বলা হলে সেটাকেই আমি অশুদ্ধ বাংলা বলব। এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রটাই বাংলাদেশে প্রকটভাবে দেখা যায় দৈনন্দিন জীবনে আর গণমাধ্যম গুলিতে। যারা মিশ্র বাক্য বলছে তারাও বাংলা অংশটা (এমনকি ইংরেজী অংশটাও) ভুল উচ্চারণ করে। শুদ্ধ বাংলা বা শুদ্ধ মিশ্র বাক্য বলা লোকের সংখ্যাই কম মনে হয়। অনেকে আঞ্চলিকতাকে প্রমিত বাংলা বলে ঘোষণ দিয়ে সেটাকে শুদ্ধ বাংলা বলে চালাতে চায়। কিন্তু আঞ্চলিকতা কখনই শুদ্ধ ভাষা হতে পারে না। আঞ্চলিকতা ত শত শত বছর ধরে আছে উভয় বাংলায় । কিন্তু বাংলা ভাষার পন্ডিতেরা কখনই ত সেটাকে প্রমিত বাংলা হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। আঞ্চলিক ভাষা সংজ্ঞা অনুযায়ী এক বিশেষ অঞ্চলের ভাষা। আঞ্চলিক বাংলাকে প্রমিত বাংলা না বললে তাকে হেয় করা হচ্ছে, তা ত না। আঞ্চলিকতার নিজস্ব স্থান আছে। প্রমিত বাংলা সব অঞ্চলের জন্য এক সর্বগ্রহণযোগ্য বাংলা। জাতীয় পর্যায়ে সব ব্যাপারে প্রমিত বা শুদ্ধ বাংলা বলাটাই সমীচীন। আমি জাতীয় পর্যায় বলতে বোঝাচ্ছি যেখানে সব অঞ্চলের মানুষ উপ্সথিত আছে সমানঅধিকার বা মর্যাদা নিয়ে। সব অঞ্চলের ভাষাকেই যদি প্রমিত বলা হয় তাখলে প্রমিত বাংলা অর্থহীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকায় ঢাকার আসে পাশের অঞ্চলের আঞ্চলিকতা মিশিয়ে এক অশুদ্ধ বাংলা বলা হয় যাকে এখন বেসরকারীভাবে প্রমিত বাংলা হিসেবে চালান হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনে, এমনকি গণমাধ্যমেও, নাটক বা টক শোতে। আসলে এটাকে এক বাংলা এবনিক্স বলা যায়। তারা সিলেট বা চট্টগ্রামের বা খুলনার আঞ্চলিক ভাষাকে কিন্তু প্রমিত বাংলা বলবে না। এই বাংলা এবনিক্স কেই কার্যত প্রমিত বাংলায় রুপান্তরিত করা হচ্ছে ধীরে ধীরে। আঞ্চলিক ভাষা আছে অঞ্চলের জন্য। প্রমিত বাংলা আছে সবার জন্য। তাহলে এই ঢাকাই এবনিক্স কেন? (যা আসলে ঢাকা ও তার আস পাশের জেলা গুলির আঞ্চলিক ভাষার এক মিশ্রণ)।
প্রিয় বেলাল বেগ,
ভাষাবিজ্ঞানের আলোকে ভাষার প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবসম্মত নয়।আপনার সনাতন ধ্যান-ধারনা ভাষার স্বভাববিরুদ্ধও বলা যায়। কারণ, ভাষা সতত পরিবর্তনশীল এবং এর ”শুদ্ধ” রূপ বলতে কোন কথা নেই।
মধুর ক্ষেত্রে যা ভেজাল ভাষার ক্ষেত্রে তা সমৃদ্ধি!
বাঙলা কথ্যভাষা নিয়ন্ত্রনের আপনার প্রস্তাব সত্যি ভয়াবহ! মানুষের মুখের ভাষাকে কি কেউ কখনো নিয়ন্ত্রন করতে পারে?!!!
এই যে, আপনার লেখায় আপনি নিজেই একে একে বিশপঁচিশটি ইংরেজি শব্দ বাঙলার সঙ্গে বলেছেন,আপনি কি এটাকে অশিক্ষা ও কুশিক্ষার লক্ষন বলবেন?
আপনার প্রতি রইলো ভাষা দিবসের অনেক অনেক শুভেচ্ছা!
সালাম
@সালাম,
প্রিয় সালাম, আপনার মন্তব্য আমাকে ভাবায়। প্রায়ই আপনার অবস্থান মূল স্রোতের বিপরীত হয়ে থাকে, যা চিন্তার পুনরায় মূল্যায়নে আমকে বাধ্য করে। আমি প্রথমবার পড়ার সময় জনাব বেলাল বেগের উল্ল্যেখকরা সমস্যাগুলোতে যতটা মনোনিবেশ করেছিলাম তাঁর উল্ল্যেখকরা সমাধানে ততটা না। আসলে বল প্রয়োগের ব্যাপারে আমিও একমত হতে পারছিনা।
তবে সমস্যার ব্যাপারে এখনো আমি জনাব বেলাল বেগের সাথে একমত। চেয়ার কে কেদারা বলাটা হাস্যকর হবে মানি। কম্পিউটারের বংলা প্রতিশব্দ খোঁজাও অর্থহীন ব্যাপার। কিন্তু যেখানে সুন্দর বাংলা শব্দ আছে সেখানে অযথা ইংরেজি ব্যাবহার করার প্রবনতা কিভাবে ভাষার সমৃদ্ধির কাজ করে ঠিক বুঝলাম না।
আমাদের ভাষার ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া উচিত।
মিডিয়া ইচ্ছে করলেই “ইংবা” সংস্কৃতি বা
মোস্তফা ফারুকীর সংলাপের নূতন ধারার ব্যাপারে
সচেতন হতে পারে।এরপর আছে এফ.এম.রেডিওর জকিদের ভাষা.
এখনই সতর্ক না হলে শুদ্ধ বাংলাভাষা হয়ত অদূরভবিষ্যতে শুধু
বইয়ে স্থান পাবে।
তরুনদের সইজেই প্রভাবিত করা যায়।
তাই ঘটছে ধীরে ধীরে!
সময়োপযোগী লেখার জন্য ধন্যবাদ!
আসতেছি, যাইতেছি, খাইছো, গেছিলা এটা আমার কাছে কথ্য বাংলার বিবর্তন যা খুব স্বাভাবিক
মনে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে, মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী তার নাটকে খুব সফল ভাবে এর ব্যাবহার করছেন। ইদানিং অনেক নাট্য নির্মাতাই তার দ্বারা অনুপ্রানিত। অনেককে দেখছি এটা নিয়ে সোচ্চার হতে। আমার কাছে এটা সাধুভাষা থেকে চলতি ভাষায় সহিত্য চর্চার শুরুতে যে হৈ চৈ টা হয়েছিলো সেরকমই একটা কছু মনে হয়। সত্যি কথা বলতেকি বন্ধুদের আড্ডায় আমি যদি “ছ” এর উপর বিশেষ জোর দিয়ে বাক্য শেষ করি, যেমন -ভাল আ-ছো? কখন এসে-ছো…………আমকে আড্ডা থেকে বেরকরে দেয়ার সম্ভাবনা খুবই জোরালো।
কিন্তু কেউ যখন ইংরেজির অযথা ফোরন দিতে বা বাংলা শব্দের শেষে “র” / “ড়” পেলেই সেটা মূর্ধার কছাকাছি যায়গা থেকে উচ্চারন করে ইংরেজির Father, Mother, Brother এর অনুকরনে তখন ইচ্ছা করে কানে আঙ্গুল গুজে দিতে। সিমাহীন বিতৃষ্নায়, ঘৃ্নায় মুখ বিকৃ্ত হয়ে উঠে। ইদানিং সংবাদ পাঠক/পাঠিকাদের মধ্য এই প্রবনতা দেখে কি পরিমানে যে হতাশ হয়েছি তা বলে বোঝাতে পারবোনা।
আপনার অত্যন্ত সময়উপযোগী এই লেখাটার জন্য বিশেষভাবে কৃ্তজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
@আতিক ভাই,
বিষয়টা ভাবার মত।
প্রথমত ‘শুদ্ধ ভাষা’ কথাটিতে আমার আপত্তি আছে। আঞ্চলিক ভাষা কখনোই ‘অশুদ্ধ’ নয়! বলা ভালো প্রমিত বাংলা বা চলতি বাংলা।
ছ’র জায়গায় স’র ব্যবহার আসলে প্রমিত বাংলায় আঞ্চলিকতার অনুপ্রবেশ। এতে মহাভারত অশুদ্ধ হবার মত ব্যাপার নেই। আসলে মনে হয় ডিজুস সংস্কৃতিটাকে আমাদের প্রজন্মের একটা অংশ একটা বিপ্লব হিসেবে নিয়েছে, অনেকটা হিপি কালচারের মত। তাই অনেক জায়গায় খাইসি,গেসি-র স্বাভাবিক অনুপ্রবেশের সাথে জোস,জটিল,আবার জিগায় – ইত্যাদির ঢালাও অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এটাকে ফারুকী তার নাটকে এবং আনিসুজ্জামান উপন্যাসে সার্থকভাবে ব্যবহার করছেন। অনেকে এর বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্চার। আমার এক শিক্ষক যিনি অসামান্য আবৃত্তি শিল্পী – এর বিপক্ষে রীতিমত খড়্গহস্ত। তবে আমার মতে সংস্কৃতিতে কোন বিধিনিষেধ না থাকাই উত্তম। মানুষকে বেছে নেবার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়া উচিত। বিটকেল গানের পাশাপাশি উচ্চাঙ্গ,রবীন্দ্র,নজরুল,পল্লীগীতি প্রচার করলে মানুষ সুন্দর মেলোডিটাই বেছে নেবে বলে আমার বিশ্বাস।
বাড়াবাড়ি অত্যন্ত ক্ষতিকর। আজকাল ডিজুস ভাষা নিয়েও অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হচ্ছে। ফারুকীর কিছু নাটকে এর অতিপ্রয়োগ বেশ একঘেয়ে লেগেছে। আমার মনে হয় আমাদের নাট্যশিল্পের অমর অবদানগুলোর পুনঃপ্রচার জরুরী হয়ে পড়েছে।
‘র’ এর জায়গায় ‘ড়’ উচ্চারণ একটা অত্যন্ত বিরক্তিকর বদ-অভ্যাস। এটার কারণ ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার পর বাংলার প্রতি জন্মানো অবজ্ঞা কখনো বা ইশটাইল! রকসঙ্গীতের কিছু বাজে ও অযোগ্য শিল্পী এই ঢালাও বিকৃতিকে জনপ্রিয় করেছে। এর মধ্যে Crooner তাহসান ও আরো কয়েকজন অপশিল্পীর অবদান অতি নিন্দনীয়। যে ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি তার উচ্চারণটা কেন আমেরিকান একসেন্ট এনে বিকৃত করতে হবে। এদের প্রতি একটাই কথা বলব, আপনারা ইংরেজিই চালান,খামাখা বাংলার বারোটা বাজাবেন না । আর
“যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।”
উদ্ধৃতিতে ভুল থাকলে শুধরে দিন।
@আগন্তুক,
১০০ % সহমত। :yes:
আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় হিন্দী ভাষার মনে হয় এক কালে আমাদের বাংলার মতই দিন গেছে। হিন্দী ভাষা এখন অনেকটাই মনে হয় ইংরেজী নির্ভর। অবশ্য পুরোই আমার অনুমান। আদি রূপ নি:সন্দেহে এমন ছিল না। বাংলারও কি ভবিষ্যতে তেমন কিছুই হবে ভাবতেই মন তেতো হয়ে যায়।
কবছর আগে শুনেছিলাম কোন এক একুশে ফেব্রুয়ারীর সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে হিট হিন্দী গানে নৃত্যের তালে তালে। আত্মসম্মান না থাকলে একটা জাতির আর থাকে কি? আসলেই এর মাঝে কোন ষড়যন্ত্র নেই, আছে হীনমন্যতা।
প্রিয় বেলাল বেগ,
লেখাটা নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয় এবং আলোচনার দাবি রাখে। বাংলার মধ্যিখানে ইংরেজীর ফোড়ন যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত, তেমনি কিন্তু বানান প্রমাদ বা টাইপোও 🙂
পোস্টের শিরোনামে কি আপনি “কথ্য বাংলার বিপজ্জনক ‘অবস্থা'” বলতে চাইছিলেন, নাকি ওটা আসলেই ‘অবজ্ঞা’ই হবে?
সরকারি মালিকানাধীন মাধ্যমগুলোকেও তো প্রতিযোগিতার কথা ভাবতে হয়। তবে, আপনার কথাটা বোধহয় ঠিক, শুদ্ধ বাংলা প্রচারের ব্যাপারটা কোন একটা সিদ্ধান্ত হিসেবে আসলে প্রায়োগিক দিক দিয়ে বেশি সফল হতে পারে।
আমি নিজেও বানান ভুলের ক্ষেত্রে প্রায় নিরাময়ের অযোগ্য, তবুও চেষ্টা করে যাই। আর যাঁরা বাংলা আমার চাইতে অনেক ভালো জানেন বলে বিশ্বাস করি, তাঁদের অনবধানতাজনিত ভুল হলে সবিনয়ে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে দিতে চাই – আশা করছি আপনি এই মন্তব্য ঠিক ত্রুটিনির্দেশ হিসেবে নেবেন না 🙂