আজ ডারউইন দিবস। বাংলাদেশের অনেকেই ১৪ ফেব্রুয়ারী ভ্যালেন্টাইস ডে’ বা ভালবাসা দিবসের সাথে পরিচিত, কিন্তু তার দু’দিন আগের অর্থাৎ ১২ই ফেব্রুয়ারীর ডারউইন দিবসের সাথে নয়। আমরা মনে করি – বাঙালী পাঠকদের জন্য ডারউইন দিবসের ইতিহাসটা একটু তুলে ধরার প্রয়োজন । বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদের সম্মানে প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের ১২ তারিখে বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী চার্ল ডারউইনের জন্মবার্ষিকীতে বিশ্বজনীনভাবেই ডারউইন দিবস (Darwin Day) পালিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার প্যালো এল্টোর মানবতাবাদী সম্প্রদায় ১৯৯৫ সালে প্রথম ডারউইন ডে পালন করা শুরু করে এবং এর পর থেকে এটি প্রতি বছর উদযাপিত হতে থাকে বিরামহীনভাবে। বিখ্যাত সংশয়বাদী জীববিজ্ঞানী প্রফেসর মাসিমো পিগলিউসি নিজে উদ্যোগ নিয়ে ১৯৯৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব টেনেসিতে ডারউইন দিবস অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, যা বছর বছর ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে। আজ ডারউইন দিবস উৎসবের অনুষ্ঠানের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট হচ্ছে www.darwinday.org. আগ্রহীরা অনুষ্ঠানের আয়োজকদের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য এখানে নিবন্ধিকৃত হতে পারেন। এ ছাড়াও ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় সহ অনেকেই সারাদিনব্যাপী উৎসব পালন করছে। ন্যাচারাল জিওগ্রাফিক এবং সায়েন্টিফিক আমেরিকানের মত স্বনামধন্য পত্রিকা প্রকাশ করেছে ডারউইন দিবস উপলক্ষে তাদের বিশেষ সংখ্যা। সেই তুলনায় বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় এই দিনটি নিয়ে উচ্ছ্বাস কিন্তু একদমই কম।  সে দিক থেকে সমকাল পত্রিকাটি ব্যতিক্রম। সমকালের কালস্রোত বিভাগের সম্পাদক আসিফ মুক্তমনার একজন শুভানুধ্যায়ী এবং ডিস্কাশন প্রজেক্টের জনপ্রিয় বিজ্ঞান বক্তা এবং সুলেখক। মুক্তমনাতেও তিনি মাঝে সাঝে লেখেন। তার উদ্যোগেই এবারের কালস্রোতে ডারউইন দিবসকে ফীচার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে কালস্রোত সমকালে বেরোয় প্রতি শনিবার। কাজেই আমাদের সেই ফীচার সংখ্যার জন্য আরো একটি দিন অপেক্ষা করতে হবে। দৈনিক সমকালের দিকে চোখ রাখুন, প্রিয় পাঠক।

আমি আসিফের ডারউইন দিবসের উদ্যোগের কথা যখনই শুনলাম – তখন থেকেই ভাবছিলাম সমকালের জন্য কি লেখা যায়।  প্রথমেই মনে এলো, বিবর্তনকে সহজবোধ্য ভাবে জনপ্রিয় করেছেন কে? অবধারিত ভাবে যে নামটি প্রথমেই চলে এলো, তিনি অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স। আমি অনেকদিন ধরেই ডকিন্সের লেখা বিবর্তনের বইগুলো পড়ছি। বস্তুতঃ ডকিন্সের বই (সেলফিশ জিন) দিয়েই আমার আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার শুরু। তারপরে ধীরে ধীরে পড়ে ফেলেছি তার সবগুলো বইই। ডকিন্সের লেখা নিয়ে এন্তার তর্ক বিতর্ক মুক্তমনায় করলেও তার বইগুলো নিয়ে কোন পূর্ণাঙ্গ আলোচনা আমি কোথাও করিনি। আমি ভাবলাম  ডারউন দিবসের এই মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশী পাঠকদের জন্য রিচার্ড ডকিন্সের বইগুলো নিয়ে লেখার চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে! আর  তাই এই প্রয়াস। তবে সমকালের শব্দসংখ্যার লিমিটেশনের কথা মাথায় রেখে রিভিউটাকে খুব ছোট স্কেলে আটকে রাখতে হল, যা হয়ত পাঠককে পূর্ণ তৃপ্তি নাও দিতে পারে।

:line:

রিচার্ড ডকিন্স – বিবর্তনকে জনপ্রিয় করার এক  ও অদ্বিতীয় কান্ডারী
অভিজিৎ রায়

রিচার্ড ডকিন্স আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের অন্যতম। নিজেই আজ যেন নিজের পরিচিতি, এক কথায় জীবিত কিংবদন্তী। পেশায় বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী, তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর চার্লস সিম্নোয়ি চেয়ার ইন দি পাবলিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং অফ সায়েন্স-এর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, সম্প্রতি ২০০৮ সালে তিনি এই পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। এর আগে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগেও অধ্যাপনা করেছেন বহুদিন। অক্সফোর্ডে প্রাণীবিদ্যায় পি.এইচ.ডি (ডি.ফিল) করেছেন ১৯৬৬ সালে; পরবর্তীতে সম্মানসূচক ডক্টোরেট ডিগ্রী পেয়েছেন ওয়েস্ট মিনিস্টার, ডারহাম, হাল সহ একগাদা নামিদামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৮৯ এ ডি.এস.সি। নেচার, সায়েন্স সহ প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর শতাধিক প্রবন্ধ। বৈজ্ঞানিক মহলে শুধু নয়, এর বাইরে বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী এবং সমাজসচেতন লেখালিখির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ড. রিচার্ড ডকিন্সের খ্যাতি আজ আক্ষরিক অর্থেই তুঙ্গস্পর্শী। বিবর্তনের মত জটিল বিষয় রিচার্ড ডকিন্সের নিপুন রং-তুলিতে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে পাঠকের ক্যানভাসে; ‘ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার’, ‘সেলফিশ জিন’, ‘আনোয়েভিং দ্য রেইনবো’, ‘ক্লাইম্বিং মাউন্ট ইম্প্রোবেবল’, ‘ডেভিলস চ্যাপ্লেইন’, ‘অ্যান্সেসটর টেল’ এবং সর্বশেষ বই ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ সহ অসংখ্য পাঠকনন্দিত জনপ্রিয় ধারার বিজ্ঞানভিত্তিক বইগুলো যেন তারই সার্থক মঞ্চায়ন। ডকিন্স-ছন্দে বিমোহিত পাঠক আজ বিজ্ঞানের মত ‘নিরস’ বিষয়ের মধ্যেও খুঁজে পায় অনুপম মহাকাব্য। সম্প্রতি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল রিচার্ড ডকিন্সের লেখা নিয়ে মন্তব্য করেছে- ‘যদি বিজ্ঞান জিনিসটা কারো হাতে সত্যি সত্যি কাব্যে রূপ নেয়, তবে সে ব্যক্তির নাম রিচার্ড ডকিন্স’। সেজন্যই বোধ হয় বিজ্ঞান-লেখক হওয়া সত্ত্বেও ২০০৫ সালে অর্জন করেছেন ‘শেক্সপিয়র পুরষ্কার’ যা এতদিন কেবল সাহিত্যিকদের কপালেই জুটতো। বিজ্ঞান, দর্শন এবং সাহিত্যবোধ ছাড়াও ডকিন্সের যে ব্যাপারটি পাঠকদের আলোড়িত করে তা হল সামাজিক দায়বদ্ধতা। বিশ্বের সংখ্যালঘু নাস্তিক এবং মানবতাবাদীদের অধিকার রক্ষায় আজকের বিশ্বে এক উদীপ্ত ‘চার্বাক’ যেন তিনি! নীতি-নৈতিকতার ব্যাপার-স্যাপারগুলো যে ঈশ্বর-প্রদত্ত ‘গায়েবী’ কিছু নয়, কিংবা ধার্মিকদের একচেটিয়া নয়, তা ডকিন্সের লেখালিখিতে দিনের আলোর মতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মানুষকে বিজ্ঞান সচেতন ও যুক্তিবাদী করে তুলতে লেখালিখির পাশাপাশি সভা-সমিতি সেমিনারের আয়োজন করছেন, কখনও বা যোগদান করেছেন নিজের আগ্রহেই, চষে বেড়াচ্ছেন সারা পৃথিবী। ২০০৬ সালে ইংল্যান্ডের ‘চ্যানেল ফোর’ -এ তাঁর উপস্থাপনা ও গ্রন্থনায় প্রদর্শিত হয় ‘দ্য রুট অব অল ইভিল’ নামের নব্বই মিনিটের তথ্যচিত্র। ধর্ম জিনিসটা যে কেবল বহুল প্রচলিত ‘শান্তির আঁকর’ নয় বরং সময় সময় হয়ে ওঠে অশান্তি, হিংসা ও বিদ্বেষের হাতিয়ার তাই স্পষ্ট করেছেন ডকিন্স তার তথ্যচিত্রের মাধ্যমে, সেই সাথে হয়েছেন কোন কোন মহলে ‘বিতর্কিত’। সম্প্রতি নিজ উদ্যোগে তৈরী করেছেন ‘রিচার্ড ডকিন্স ফাউন্ডেশন’। সাংবাদিক গোর্ডি স্ল্যাক রিচার্ড ডকিন্সকে বর্ণনা করেছেন ‘খোলস ছেড়ে বেরুনো পৃথিবীর খ্যাতনামা জীবিত নাস্তিক বিজ্ঞানীদের অন্যতম’ হিসেবে। আরেক লেখক টেরি ইগ্লেটন ডকিন্সকে অভিসিক্ত করেছেন- ‘বার্ট্রান্ড রাসেলের পর সবচেয়ে খ্যাতনামা প্রফেশনাল নাস্তিক’ অভিধায়। তাঁর ‘দ্য গড ডিলুশন’ ৩০শে সেপ্টেম্বর ২০০৭ পর্যন্ত বাহান্ন সপ্তাহ ধরে নিউয়র্ক টাইমসের ‘বেস্ট সেলার’ তালিকায় ছিলো, এবং এখন পর্যন্ত ২ বইটির মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। শুধু তাঁর লেখা নয়, ডকিন্স আজ নিজেই যেন পরিণত হয়েছেন গবেষকদের ‘গবেষণার বিষয়’ হিসেবে। খোদ রিচার্ড ডকিন্সের উপরই আজ তাবৎ রথী-মহারথী বিজ্ঞানী আর দার্শনিকেরা বই লিখছেন। এমনি একটি বই ‘Richard Dawkins: How a Scientist Changed the Way We Think’। ২০০৬ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত এই বইটিতে ড. হেলেনা ক্রোনিন, ড. মাইকেল রুজ, ড. ডেনিয়াল ডেনেট, ড. ম্যাট রিডলী, স্টিভেন পিঙ্কারের মত লব্ধ-প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরা অভিমত দিয়েছেন কেন ডকিন্সকে আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী চিন্তাবিদ হিসেবে গ্রন্য করা হয়।

২০০৪ সালের প্রোসপেক্ট ম্যাগাজিনের জরিপে ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ডকিন্স ছিলেন শীর্ষস্থানে। ডকিন্স রয়্যাল সোসাইটির সাহিত্য পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৮৭ সালে, একই বছর পেয়েছেন লস এঞ্জেলেস টাইমস সাহিত্য পুরষ্কার, লন্ডনের জুলজিক্যাল সোসাইটির রৌপ পদক পেয়েছেন ১৯৮৯ সালে, ১৯৯০ সালে পেয়েছেন মাইকেল ফ্যারাডে পুরষ্কার। ন্যাকায়্যামা পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৯৪ সালে। পঞ্চম আন্তর্জাতিক কসমস পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৯৭ সালে, কিৎসলার পুরষ্কার পেয়েছেন ২০০১ সালে, একই বছর পেয়েছেন ইতালীর প্রেসিডেন্সি পুরষ্কার। মানবতাবাদের প্রতি বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫ সালে নির্বাচিত হয়েছেন ‘হিউম্যানিস্ট অব দ্য ইয়ার’ । ২০০৬ সালে বিবিসির পাঠক এবং দর্শকদের ভোটে ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ও নির্বাচিত হয়েছেন ড. রিচার্ড ডকিন্স।

এখানে পাঠকদের জন্য অধ্যাপক ডকিন্সের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল।

সেলফিশ জিন এবং এক্সটেডেড ফেনোটাইপ: রিচার্ড ডকিন্সের ‘সেলফিশ জিন’ (১৯৭৬) নামের অনন্যসাধারণ বইটি রিচার্ড ডকিন্সের প্রথম বই এবং তার শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোর একটি। এই বইয়ের মাধ্যমেই ডকিন্স সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করলেন কেন জেনেটিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। তিনি এই বইয়ের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দিলেন যে বিবর্তন কাজ করে জিনের উপর, একক কোন জীবের উপর নয়। তিনি তার বইয়ে দেখালেন যে, আমরা আমাদের এই দেহের পরিচর্যা নিয়ে যতই চিন্তিত থাকিনা কেন- দেহ কিন্তু কোন প্রতিলিপি তৈরি করেনা; প্রতিলিপি তৈরি করে বংশানু বা জিন। তার মানে হচ্ছে আমাদের দেহ কেবল আমাদের জিনের বাহক (vehicle) হিসেবে কাজ করা ছাড়া আর কিছুই করে না। আমাদের খাওয়া, দাওয়া, হাসি কান্না, উচ্ছ্বাস, আনন্দ, সিনেমা দেখা, খেলাধূলা বা গল্প করা – আমাদের দেহ যাই করুক শেষ পর্যন্ত ‘অত্যন্ত স্বার্থপর’ভাবে জিনকে রক্ষা করা আর জিনকে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দেয়াতেই উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে বাধ্য করে, বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোন থেকে জীবনের কোন ‘উদ্দেশ্য’ যদি থেকে থাকে তবে সেটাই সে উদ্দেশ্য। শুধু মানুষ নয় অন্য যে কোন প্রানীর মধ্যেই সন্তানদের প্রতি অপত্য স্নেহ প্রদর্শন কিংবা সন্তানদের রক্ষা করার জন্য মা বাবারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে। অর্থাৎ, নিজের দেহকে বিনষ্ট করে হলেও পরবর্তী জিনকে রক্ষা করে চলে। ‘পরবর্তী জিন’ রক্ষা না পেলে দেহসৌষ্ঠব যত আকর্ষনীয় হোক না কেন, বিবর্তনের দিক থেকে কোন অভিযোজিত মূল্য নেই। এক ধরণের ইঁদুর আছে যারা শুধু সঠিক সঙ্গী খুঁজে জিন সঞ্চালন করার জন্য বেঁচে থাকে। যৌনমিলনের পর পরই পুরুষ ইঁদুরটি মৃত্যুবরণ করে। অথচ এই মৃত্যুকূপের কথা জেনেও পুরুষ ইঁদুরটি সকল নিয়ে বসে থাকে ‘সর্বনাশের আশায়’। এক প্রজাতির ‘ক্যানিবাল’ মাকড়শা আছে যেখানে স্ত্রী মাকড়শাটি যৌনমিলনের পর পরই পুরুষ মাকড়শাটিকে খেয়ে ফেলে। সাক্ষাৎ এই মৃত্যুর কথা জেনেও দেখা গেছে পুরুষ মাকড়শাগুলো জিন সঞ্চালনের তাড়নায় ঠিকই তাড়িত হয়। অর্থাৎ, দেহ এবং জিনের সঙ্ঘাত যদি উপস্থিত হয় কখনো – সে সমস্ত বিরল ক্ষেত্রগুলোতে দেখা গেছে জিনই জয়ী হয় শেষপর্যন্ত। আমাদের দেহে ‘জাংক ডিএনএ’ কিংবা ‘সেগ্রেগেশন ডিস্টরশন জিন’-এর উপস্থিতি সেই সত্যটিকেই তুলে ধরে যে – শরীরের ক্ষতি করে হলেও জিন অনেক সময় নিজেকে টিকিয়ে রাখে – অত্যন্ত ‘স্বার্থপর ভাবে’ই। ডকিন্সের এ বইয়ের মূল্য একাডেমিয়ায় অনেক। এই বইয়ের মাধ্যমেই আসলে জীববিজ্ঞানীরা সমাজ এবং জীবনকে ভিন্নভাবে দেখা শুরু করলেন। বইটির নাম ‘সেলফিশ জিন’ হলেও বইটির মূল লক্ষ্য ছিলো ঠিক বিপরীত। পরার্থতা, আত্মত্যাগ, দলগত নির্বাচনের মত যে বিষয়গুলো আগে বিজ্ঞানীরা পরিস্কার করে ব্যাখ্যা করতে পারতেন না, সেগুলো আরো বলিষ্ঠভাবে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে ব্যখ্যা করতে পারলেন তারা। তবে তার চেয়েও বড় যে ব্যাপারটি ঘটল, সেটা হল মানবসমাজের বিভিন্ন সামাজিক প্যাটার্ন ব্যখ্যা করার নতুন এক দুয়ার খুলে গেল জীববিজ্ঞানীদের জন্য।

তার পরবর্তী বই ‘এক্সটেডেড ফেনোটাইপ’-এও ডকিন্স সেলফিশ জিনের ধারণাকেই আরো প্রসারিত করেন।

ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার : ১৯৮৬ সালে লেখা রিচার্ড ডকিন্সের এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি আধুনিক জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে প্রাচীন দার্শনিক এবং ধর্মবেত্তা উইলিয়াম প্যালের সৃষ্টির পরিকল্প যুক্তি বা ‘ডিজাইন আর্গুমেন্টের’ বলিষ্ঠ খন্ডন। উইলিয়াম প্যালে (১৭৪৩-১৮০৫)’র বিখ্যাত বই ‘Natural Theology, or Evidence of Existence and Attributes of the Deity, collected from the Appearences of Nature’ প্রকাশিত হয় ১৮০২ সালে। ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েও প্যালে ভেবেছিলেন বিস্তর, কিন্তু নিজেই শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন ‘বুদ্ধিদীপ্ত স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞান উপযুক্ত মাধ্যম নয়’; এ ক্ষেত্রে প্যালের ‘উপযুক্ত মাধ্যম’ মনে হয়েছিল বরং জীববিজ্ঞানকে। আর পূর্ববর্তী অন্যান্য ন্যাচারাল থিওলিজিয়ানদের মতই প্যালেও জীবজগতকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে জীবের অভিযোজনের ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। প্যালে লক্ষ্য করেছিলেন যে, প্রতিটি জীবদেহে নির্দিষ্ট কাজ করবার জন্য নির্দিষ্ট অংগ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে, যা জীবটিকে একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে টিকে থাকতে সহায়তা করে। তিনি জটিল জীবদেহকে কিংবা চোখের মত প্রত্যঙ্গকে ঘড়ির কাঠামোর সাথে তুলনীয় মনে করেছিলেন, আর তার মধ্যেই দেখেছিলেন স্রষ্টার সুমহান পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য আর নিপুণ তুলির আঁচর। বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তার ‘প্রজাতির উদ্ভব’ বইয়ের মাধ্যমে প্যালের এই ডিজাইন আর্গুমেনটের সমাধি রচনা করেন। ডারউইন তার তত্ত্বে কারিগরের বদলে প্রস্তাব করেছিলেন একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার নাম প্রাকৃতিক নির্বাচন- যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লাখ লাখ বছর ধরে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা পরিবর্তনের ফলে চোখের মত অত্যন্ত জটিল অংগ-প্রত্যংগ গড়ে ওঠা সম্ভব। একাধিক ধাপের এই ক্রমবর্ধমান নির্বাচনের মাধ্যমে যে ধাপে ধাপে যে জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ভুত হতে পারে তা ইতোমধ্যেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত হয়েছে। রিচার্ড ডকিন্স তার বইয়ে সর্বাধুনিক আধুনিক তথ্য এবং উপাত্তের সাহায্যে সৃষ্টির পরিকল্প যুক্তির অসাড়তা সাফল্যের সাথে তুলে ধরেছেন আরো একবার। সেই সাথে বইয়ের একটি অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে স্টিফেন জ়ে গুল্ডের ‘পাংচুয়েটেড ইকুইলিব্রিয়াম’-এর প্রখর এবং গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা।

এর পরবর্তী ‘রিভার আউট অব ইডেন’ বইয়ে তিনি সাধারণ পাঠকদের জন্য বিবর্তনকে জনবোধ্য করে তোলেন।

ক্লাইম্বিং মাউন্ট ইম্প্রবেবল বইয়ে তিনি সৃষ্টিবাদীদের যুক্তি নস্যাৎ করে দেখান যে, খুব ছোট সম্ভবনা থেকেই প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে জটিল জীবজগতের উদ্ভব হতে পারে।

ডকিন্স তার পরের বইটি একটু ভিন্ন আঙ্গিকে লেখেন। তার এই ‘আনউইভিং দ্য রেইনবো’ বইয়ে তিনি যুক্তি দেন যে, একটি গল্প, কবিতা কিংবা কোন সার্থক শিল্পকীর্তির মত বিজ্ঞানও বলিষ্ঠভাবে করতে পারে সৌন্দর্যের প্রতিনিধিত্ব। ঐতিহাসিকভাবে অনেকের মাঝেই একটা গৎবাঁধা প্রচলিত ধারণা আছে যে বিজ্ঞান ও কলা বা সাহিত্য বুঝি পরস্পর বিরোধী। ডকিন্স তার এই বইয়ে এই সজ্ঞাত ধারণা খন্ডন করে মত প্রকাশ করেন যে বিজ্ঞানকে তিনি একটি অনুপম কবিতার চেয়ে কম সৌন্দর্যময় মনে করেন না।

ডেভিলস চ্যাপ্লিন নামের পরবর্তী বইটি ডকিন্সের প্রবন্ধ সংকলন। তার মধ্যে বিবর্তন তো আছেই, সেই সাথে আছে ছদ্মবিজ্ঞান, ধর্ম এবং সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়েও মনোজ্ঞ আলোচনা।

অ্যান্সেস্টর টেল নামের বইটি আমাদের বিবর্তনের এক ধারাবাহিক ইতিহাসের এক সার্থক চলচিত্র। বইটি পড়লে মনে হবে – ডকিন্স তার পাঠকদের সাথে নিয়ে হোমোসেপিয়েন্স থেকে শুরু করে প্রণের উৎপত্তি পর্যন্ত বিবর্তনের এক তীর্থযাত্রা যেন সম্পন্ন করলেন।

এর পরে বেরোয় ডকিন্সের বর্ষকালীন সেন্সেশন – দ্য গড ডিলুশন (২০০৬)। এই বইয়ে ডকিন্স যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, কোন অপার্থিব সত্ত্বার হাতে আমাদের মহাবিশ্ব, প্রাণ কিংবা প্রজাতির সৃষ্টি হয়নি, হয়েছে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায়। তিনি তার বইয়ে ঈশ্বর বিশ্বাসকে এক ধরণের বিভ্রান্তি বা ডিলুশন বলে উল্লেখ করেছেন। বইটি ‘ব্রিটিশ বুক এওয়ার্ড’-এর জন্য নির্বাচিত হয়েছিলো।

ডকিন্সের সর্বশেষ বই ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ (২০০৯) ডকিন্সের এ পর্যন্ত পাওয়া বিবর্তনের যাবতীয় সাক্ষ্য প্রমাণের সর্বশেষ দলিল। তিনি এই বই প্রসঙ্গে বলেন, ‘এর আগে আমি বিবর্তনের স্পেশাল কিছু বিষয় নিয়ে লিখেছি, এই বইটি পাঠকদের জন্য লিখেছি বিবর্তনের সার্বজনীন সত্যতা জনবোধ্যভাবে তুলে ধরার লক্ষ্যে।‘

বিবর্তনের উপর অতীতে লিখছেন অনেকেই, ভবিষ্যতে লিখবেনও অনেকেই। কিন্তু বিবর্তনকে জনপ্রিয়করণে ডকিন্সের মত সফল বোধ হয় কোন লেখকই হননি। যিনি ইংরেজীতে বিবর্তনের উপর একটি বইও কখনো পড়েছেন, তিনি সম্ভবতঃ রিচার্ড ডকিন্স পড়েছেন – এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ডকিন্সের কাজে শিক্ষায়তনের গবেষকরা যেভাবে প্রভাবিত হয়েছেন, তেমনি হয়েছেন বিবর্তন না জানা বহু সাধারণ মানুষও। কখনো বা হয়ে উঠেছেন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুও। এক সময় বিজ্ঞানী টি এইচ হাক্সলিকে ডাকা হতো “ডারউইনের বুলডগ’ হিসেবে, আর বর্তমানে অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স হয়ে উঠেছেন “ডারউইনের রটউইলার”।

ডারউইন দিবসে ডারউইনের রটউইলারের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।

:line:

আপডেটঃ  লেখাটি ঈষৎ সংক্ষিপ্ত আকারে দৈনিক সমকালে (ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১০) প্রকাশিত।